#নয়নতারা [৩০]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
রামিশা নক্ষত্রদের বাড়ি থেকে চলে গেছে। জীবন থেকে সব ঝামেলাই যেন দূর হয়ে গেছে এমনটাই মনে হচ্ছে নয়নের। এখন তার ছোট্ট সুখের সংসারে শুধু সে আর নক্ষত্র। কোন তৃতীয় ব্যক্তির ছায়া পড়বে না ওদের উপর।
রামিশা কেন চলে গেল এই নিয়ে নক্ষত্রর মা অবশ্য ঝামেলা করেছে। প্রথমে তিনি অনেক চেঁচামেচি করছিলেন। নক্ষত্র যখন বলল,
—-রামিশা একটা ক্রিমিনাল মা। ও তারাকে মারতে গেছিল। রামিশা আরও কী কী করেছে শুনলে অবাক হবে তুমি। রামিশা আমার আর তারার সম্পর্ক নষ্ট করতে উঠে পড়ে লেগেছিল। ওকে পুলিশে দেওয়া উচিত ছিল।”
নক্ষত্রর মা তারপর থেকেই চুপ হয়ে গেল। রামিশার সত্য প্রকাশ পেয়ে গেছে। এখন যদি নক্ষত্র জানতে পারে তার নিজের মা রামিশাকে সাহায্য করেছে তাহলে কখনও মা’কে ক্ষমা করবে না নক্ষত্র। নয়নতারাকে নিয়ে নক্ষত্র বাড়ি থেকেও চলে যেতে পারে। একমাত্র ছেলেকে হারানোর ভয়ে নক্ষত্রর মা নয়নকে মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। ছেলে যদি নয়নতারার সাথে সুখে থাকে তাহলে উনার আপত্তি কিসে? ছেলেটা ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসার কাঙ্গাল ছিল। বাবা মা কারো কাছ থেকেই ভালোবাসা পায়নি সে। এখন বউকে নিয়ে সে যদি জীবনে সুখী হয় তাহলে মা হয়ে উনার আর কী চাই? ছেলের সুখটাই কী বড় নয়?
শাশুড়ি মা’ও এখন নয়নকে চোখে হারায়। শ্বশুর বেশিরভাগ সময়ই কাজ নিয়ে নানান জায়গায় ঘোরাঘুরি করে। বাড়িতে থাকেই না বলতে গেলে।
শাশুড়ি মা নয়ন আর নক্ষত্রকে একসাথে পেয়ে বলে,
—-তোমাদের বিয়েতে তো আমি তোমাদের কিছুই দেইনি। তাই আমার আর তোমার বাবা একটা প্ল্যান করেছি। বউ মা’কে নিয়ে কয়েকদিনের জন্য দেশের বাইরে থেকে ঘুরে আসো। তোমাদের যে জায়গা পছন্দ হয় আমাকে জানাবে। আমি তোমার বাবাকে জানাব। উনি তোমাদের যাবার ব্যবস্থা করবেন।”
মা’কে এভাবে দেখে নক্ষত্রর সত্যিই ভালো লাগছে। মা নয়নকে মন থেকে মেনে নিয়েছে। নক্ষত্র পেছন থেকে নয়নের কোমর পেঁচিয়ে ধরে বলে,
—-মা কিন্তু আমাদের হানিমুনে পাঠাচ্ছে। সরাসরি এটা বলতে পারেনি তাই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলেছে।”
নয়ন কাজ করছিল। তার কাজে নক্ষত্র ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। সারাদিন বউয়ের পেছন পেছন ঘুরে। আগে তো বাড়িতে পাওয়া যেত না। এখন জোর করেও বাড়ি থেকে বের করা যায় না। সব কাজে নয়নের সাহায্য করে। নয়ন বাধা দিলে বলে,
—-বউ আমার বাচ্চা মানুষ, এত কাজ একা একা করতে পারবে নাকি? সরো সরো, হাত টাত পুড়ে গেলে শ্বশুর মশাই আবার আমার গলায় দড়ি ঝুলাবে।”
এখনও নক্ষত্র তাকে জ্বালাতন করছে। নয়ন মনে মনে খুশি হলেও মুখে বিরক্তি প্রকাশ করে বলে,
—-দিন দিন আপনার স্বভাব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। যখন তখন জড়াজড়ি। আমরা ছাড়াও বাড়িতে আরও মানুষ আছে তো নাকি?”
—-তুমি দিনদিন এমন হাইস্কুলের ম্যাডাম হচ্ছো কেন বলো তো? আন রোমান্টিক বউ আমার।”
—-আপনি বউয়ের আঁচল ধরে সব সময় ঘুরঘুর করেন কাজের লোকগুলো নিজেদের মধ্যে এসব বলাবলি করে হাসে। আমার কানে আসে সব। তখন আমার লজ্জা করে না বুঝি।”
কপালে ভাঁজ পড়ে নক্ষত্রের।
—-লজ্জা! লজ্জা কিসের হ্যাঁ? অন্যের বউয়ের পিছন ঘুরি নাকি! নিজের বউ ভাই। যা খুশি তা-ই করব। কার বাপের কী? কে কি বলে, ওটার চাকরি খাব আমি।”
—-আপনি পাগল।”
—-মা আমাদের হানিমুনে কেন পাঠাচ্ছে জানো?”
নয়ন কথা বলে না। লজ্জা লাগছে তার। কান গরম হয়ে যাচ্ছে।
—-শুনবে না কেন?”
—-কেন?”
—-ওখান থেকে ফিরে যেন মা’কে দাদী বানাতে পারি।”
নয়ন লজ্জায় মুখ নীচু করে নেয়। নক্ষত্র হাসে। দু’হাতে নয়নের গাল ধরে মুখ উপরের দিকে তুলে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়।
—-তোমার এই লজ্জা মাখা মুখ দেখে আমি আজীবন কাটিয়ে দিবে পারব। এখনও এতো লজ্জা! আমি কি তোমার পর?”
এভাবে আরও দুই সপ্তাহ কেটে যায়। নক্ষত্র বাবা ওদের সুইজারল্যান্ড যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে। দুইদিন পর ফ্লাইট। কিন্তু যাওয়ার একদিন আগেই নয়নের বাপের বাড়ি থেকে খবর আসে, ছোট চাচীর বেবি হবে। চাচীর অবস্থা ভালো না। বেবিকে বাঁচানো না-ও সম্ভব হতে পারে। চাচী কান্নাকাটি করে ভেঙে পড়েছে। নক্ষত্র ওদের যাওয়া ক্যান্সেল করে নয়নকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যায়। সন্ধ্যায় চাচীর পেইন উঠেছে। উনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বেবিকে বাঁচানো যাবে না শুনে জাহিদ বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। নয়ন ওকে বোঝাচ্ছে।
—-কিচ্ছু হবে না পাগল। তুই এখন থেকেই এভাবে কাঁদছিস কেন? চাচীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তো। কারো কিচ্ছু হবে না। দেখে নিস তুই।”
—-আমার মা আর বাবুর কিছু হবে না তো আপু?”
নয়ন নিজেও মনে মনে ভয় পাচ্ছে। জাহিদ চাচীর একমাত্র ছেলে। তারপর আরও দু’জন বাবু মারা গেছে। হয়তো পেটে থেকেই মারা গেছে। নইলে জন্ম নেওয়ার কিছু সময় পর। এবারও তেমন কিছু হবে নাকি? চাচী তাহলে একেবারেই ভেঙে পড়বে। প্রতিবার দশ মাস গর্ভে ধরেও সন্তানকে কোলে নিতে পারে না। সবাই এখন হাসপাতালে। নয়নের পক্ষে আর বাড়িতে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। সে নক্ষত্রকে বলল,
—-আমাকেও চাচীর কাছে নিয়ে যান না।”
নক্ষত্র নয়নকে বোঝায়।
—-সবাই তো চাচীর কাছে আছে তারা। তুমি ওখানে গিয়ে শুধু শুধু কী করবে। তুমি বরং জাহিদের কাছে থাকো। ও বেচারাও তো ভয় পাচ্ছে।”
নয়ন নক্ষত্রর কথা শুনে রাগ হয়ে যায়।
—-শুধু শুধুই যাব। তবুও নিয়ে যান। বাড়িতে বসে আমার অস্থির লাগবে। চাচীর আগেও আরও দু’টা বাচ্চা এরকম ভাবে মারা গেছে। আপনি বুঝতে পারছেন না। নিয়ে যান না প্লিজ।”
—-আচ্ছা চলো। জাহিদও চলো। একা তুমি বাড়িতে থাকবে কীভাবে?”
নয়ন হাসপাতালে এসেই ঝিনুকের কাছে ছুটে আসে।
—-চাচী এখন কেমন আছে আপু?”
—-জানি না রে। এবারও মনে হয় বাবুটা…
—-ওরকম বোলো না আপু। চাচীর অনেক কষ্টের সন্তান।”
—-হ্যাঁ রে। মামীর জন্যই কষ্ট হচ্ছে। প্রতিবার আল্লাহ মামীর সাথে অন্যায় করে। বেচারি একটা সন্তানের জন্য এতটা পাগল। আল্লাহ দিয়েও তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়। তার থেকে না দেওয়াই ভালো।”
রাত দশটার সময় চাচী মেয়ে সন্তানের মা হয়। ডাক্তার জানায় মা বেবি দু’জনই ভালো আছে। ঝুঁকি কেটে গেছে। বাচ্চা একটু দুর্বল। তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ভালো করে ওর দেখাশোনা করলে অল্প দিনেই হেলদি হয়ে উঠবে।
সবাই আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে। যাক বাবা শেষ পর্যন্ত আল্লাহ চাচীকে সুখের মুখ দেখিয়েছেন। সেই রাতটা মা, ফুপু, জেঠিমা হাসপাতালে থাকে। বাকিরা বাড়ি চলে আসে। ফেরার সময় ঝিনুক নয়নকে জিজ্ঞেস করে,
—-তোরা কখন এসেছিস?”
—-সন্ধ্যায়। ইমন ভাইয়া ফোনে জানিয়েছিল।”
—-তোদের না দু’দিন পর যাওয়ার কথা।”
—-যাব না। ও না করে দিয়েছে।”
—-ওরে গাধী! কবে মানুষ হবি তুই? ছেলেটা কত আশা নিয়ে যাবার সব ব্যবস্থা করেছে। সেদিন এসে আমাদের বলে গেলি। আজ বলছিস যাবি না! আমার ভাইয়ের সব স্বপ্নে ছাই ফেলে দিলি তুই।”
—-আমি একবারও না করেছি নাকি! তোমার ভাই-ই চাচীর এরকম অবস্থা শুনে বলল থাক এবার যেতে হবে না। পরে কোনো একসময় যাওয়া যাবে।”
—-বাহ নয়ন! কী ভাগ্যবাতী রে তুই! নক্ষত্রর থেকে পারফেক্ট তোর জন্য আর কেউ হতেই পারতো না। তোরা মেইড ফর ইচ আদার।”
নয়নও খুব করে উপলব্ধি করে নক্ষত্রর জন্যই সে তৈরি হয়েছে। নক্ষত্রর থেকে ভালো সে আর কাউকে পেতো না।
দু’দিন হাসপাতালে থাকার পর নতুন বাবু সহ চাচীকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। সবাই বেশ ঘটা করে নতুন বাবুকে তার বাড়িতে ওয়েলকাম করে।
ইমন নয়নকে খেপানোর জন্য বলে,
—-তোর আদরে ভাগ বসানোর মানুষ এসে গেল রে নয়ন। এবার থেকে সবাই ছোট নয়নকেই আদর করবে। তুই পর হয়ে গেলি। এমনিতেও তো তোর বিয়ে হয়ে গেছে। পরের বাড়ির বউ তুই। এখন থেকে তো ছোট নয়নই আমাদের সাথে থাকবে। ঝিনুক আমি কী ভেবেছি জানিস? ছোট বাবুর নামও নয়নতারা রাখব। আমাদের দ্বিতীয় নয়নতারা। প্রথম নয়নতারা তো এখন নক্ষত্রদের বাড়ির।”
নয়ন সত্যিই খেপে গেল। নিজের ভাগ কাউকে দিতে রাজি না সে। নয়ন যতই রাগ করছে ইমন ওকে আরও খেপিয়ে দিয়ে বলছে,
—-এতদিন তুই ছিলি আমাদের বাড়ির সবথেকে ছোট মেয়ে। তাই সবার আদর তুই একা পেয়েছিস। এবার তোর থেকেও ছোট আরেকজন এসে গেছে। এখন সব আদর ও পাবে। আমাদের ছোট্ট বোনটা।”
নয়ন প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখে বলে,
—-ভাইয়া ভালো হচ্ছে না কিন্তু। তুমি এমন করলে আমি কিন্তু চলে যাব।”
—-চলে যাবি? আচ্ছা। নক্ষত্র ওকে নিয়ে যাও তো। পরের বাড়ির বউকে আমাদের বাড়িতে রেখে লাভ নেই। যা নয়ন।”
নয়ন ভ্যাভ্যা করে কেঁদে ফেলে। নক্ষত্র ওদের ভাইবোনের কাণ্ড দেখে হাসে। নয়ন যেমন অবুঝ, ইমনও তেমন নাছোড়বান্দা। নয়নকে কাঁদিয়ে মা, চাচী, ঝিনুকের বকা খেয়ে সে-ই আবার নয়নকে শান্ত করে।
—-আরে পাগলি! সত্যি সত্যি কাঁদছিস নাকি তুই? আমি তো মজা করছিলাম রে। আমাদের নয়নতারা একটাই। আর সেটা তুই। আমাদের সবার নয়নের মণি ছোট্ট বোনটা। ছি! নিজের বরের সামনে কেউ এভাবে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদে! কী বিশ্রী দেখতে লাগছে তোকে! নক্ষত্র কী ভাববে বল তো? ভাববে তার বউটা ছিঁচকাঁদুনে। এ্যাহ হে, প্রেস্টিজ পাংচার করে দিচ্ছিস রে তুই।”
নয়ন গাল টাল লাল করে নাক টানতে টানতে কান্না থামাতে চায়। ওর নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে। নক্ষত্রর ইচ্ছে করছে টুপ করে ওই নাকের ডগায় একটা চুমু খেয়ে ফেলে৷ কিন্তু সবার সামনে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। এখানে আসার পরে বউটাকেও একটু সময়ের জন্য একা পাচ্ছে না। সবার সাথে বসে গল্প করছে। নয়তো চাচীর ঘরে গিয়ে বাবু কোলে নিয়ে বসে থাকছে। ও বেচারা অসহায় হয়ে ঘরে একা বসে থাকে। কই সে নিজের বাচ্চার কথা ভাবছে, কিন্তু তার বউ চাচাতো বোনকে নিয়ে মহা ব্যস্ত আছে। তাকে সময় না দিলে কীভাবে নিজেদেরও অমন একটা ফুটফুটে মেয়ে হবে? হানিমুনের প্ল্যানটাও ক্যান্সেল করতে হলো।
চলবে___