পথে হলো দেরি পর্ব ৪

#পথে_হলো_দেরি
#নুশরাত_জেরিন
#পর্বঃ৪

,
,
কিছুক্ষণ চোখ ডলাডলি করে সামনে তাকায় শৌখিন।
ইরাকে দেখে তার কপাল কুঁচকে আসে।
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই মেজাজ গরম হয়।
কাল রাতেও দেখেছিলো সে ইরাকে।
মাকে বারবার বলেছিলো এ মেয়েকে বাড়ি থেকে বিদেয় করতে।
কিন্তু মা বিদেয় করা দুরে থাক উল্টো ওকে এখানকার ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে।
সব খোজ খবরই চাকরীতে বসে পেয়েছে শৌখিন।
কাল রাতেই বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলো সে।কিন্তু পারেনি।
ওতোদুর জার্নি করে এসে শরীর খুব ক্লান্ত লাগছিলো।কথা বলার মতো শক্তিও অবশিষ্ট ছিলোনা শরীরে।
ইরার দিকে রাগী চোখে তাকায় সে।
দেখে ইরা ড্যাবড্যাব চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
শৌখিনের মেজাজ আরও গরম হয়।কিন্তু এতো সকালে সিন্ক্রেট করতে মনে চায়না।
গম্ভীর গলায় দাতে দাঁত চেপে বলে,

—এখানে কি তোর?

ইরা শব্দ পেয়ে তড়িঘড়ি করে চোখ নামায়।মাথা নিচু করে।
এতক্ষণের না পাওয়া ভয় একবারে জেঁকে বসে।
মিনমিন করে বলে,

—না মানে চা নিইইয়ে এসেছিলাম।

শৌখিন তীক্ষ্ণ চোখে ইরার হাতের দিকে তাকায়।
ইরা সেদিকে লক্ষ করে কাপসহ হাত সামনে বাড়িয়ে ধরে।
হাত কাপে থরথর করে।
কাপে প্রিচে শব্দ হয়।

শৌখিন হাত কপালে নিয়ে আঙুল দিয়ে কপালে ম্যাসাজ করে।
এই মেয়ের সাহস দেখে সে তাজ্জব হয়ে গেছে।যে মেয়েকে এ বাড়িতে সহ্যই করতে পারছেনা সে মেয়ে কিনা তার জন্য চা নিয়ে এসেছে?
কেনো?
বউ সাজতে চায়?
বউয়ের অধিকার দেখাতে চায়?
চোখ বন্ধ করে জোরে নিশ্বাস নেয় সে।
রাগ কমাতে চায়।
বলে,

—আমার সামনে থেকে দুর হ।

ইরা সাহস করে বলে,

—কিন্তু চা?

শৌখিন এতক্ষণের আটকে রাখা রাগ আর আটকাতে পারেনা।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ছুড়ে মারে।
কাপ ভেঙে ফ্লোরে ছিটকে পরে।
ঝনঝনিয়ে শব্দ হয়।
তার চেয়ে বেশি জোরে শব্দ হয় হয়তো ইরার বুকে।
ভেতরটা ধক করে ওঠে।
ভয়ে গুটিশুটি মেরে একপাশে সরে দাড়ায়।
শোখিন এগিয়ে এসে দুকাধ চেপে ধরে।
চিৎকার করে বলে,

—তোকে চা দিতে বলেছি আমি?বলেছি?জানিস না তোকে সহ্য হয়না আমার?
আমার সামনে আসবিনা,আর কক্ষনো আসবিনা।
তোকে দেখলেই আমার রাগ হয়।রাগে গা জ্বলে যায়।

ইরা ফুপিয়ে ওঠে।
তার কাধে ব্যাথা লাগছে।শৌখিন এতো শক্ত করে চেপে ধরে আছে যেনো মনে হচ্ছে এক্ষুনি কাধের হাড় ভেঙ্গে পরবে।
শৌখিন সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেনা।
ইরাকে ছেড়ে দিয়ে হনহন করে আবার রুমে ঢোকে।
ঠাস করে দরজা লাগায়।

ইরা সেদিকে তাকিয়ে চোখ মুছে নেয়।ভাঙা কাচগুলো একেএকে হাতে তোলে।
গুছিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামে।

———

খাওয়ার টেবিলে রেহেনা বেগম শৌখিনের অপেক্ষা করেন।সকালে ছেলেটার সাথে দেখা হয়েছিলো তার।
মায়ের সাথে ঠিকমতো কথা বলেনি সে।
শুধু কুশল বিনিময় করেছে তাও মুখ গম্ভীর করে।
সিড়ি বেয়ে গটগট পায়ে নিচে নামে শৌখিন।
রেহেনা বেগম মায়াভরা চোখে সে দৃশ্য দেখে।কতোদিন ছেলেটা কে দেখেননি।নিজের হাতে খাবার খাইয়ে দেননি।
ওখানে বসে ছেলেটা ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করে তো?
মনে হয় তো না।
কেমন শুকিয়ে গেছে।মায়ের উপর রাগ করে নিজেই নিজেকে কষ্ট দিচ্ছে।
এলোমেলো চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে চেয়ার টেনে বসে শৌখিন।
তার পাশে বসে শাম্মি।
রিফাত কাল থাকবো বলেও থাকেনি।
শৌখিনের জন্য বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করে চলে গিয়েছিল সে।
রেহেনা বেগম শৌখিনের অন্য পাশে বসেন।
নিঃশব্দে নানা পদের তরকারির বাটি ছেলের সামনে এগিয়ে দেন।
শৌখিনও কথা বলেনা।চুপচাপ খায়।
রেহেনা বেগম এরমাঝে একবার উঠে রান্নাঘরে উকি দেন।
ইরা আজ তাদের সাথে বসেনি।
কিচেনে বসে খাচ্ছে সে।
রেহেনা বেগম অনেক জোর করেছিলো তাকে কিন্তু সে কথা শোনেনি।
বারবার বলেছে সে আজ কিচেনে বসেই খাবার খাবে।রহিমা খালার সাথে কোনদিন খাওয়া হয়নি তাই আজ খেতে ইচ্ছে করছে।
যদিও এটা মিথ্যা কথা।রেহেনা বেগম ঠিক বুঝেছেন, শৌখিনের সাথে এক টেবিলে বসবে না বলেই এমন কথা বলছে ইরা।
তাছাড়া সকালে শৌখিনের চিৎকারের আওয়াজও শুনেছেন তিনি।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শৌখিনের পাতে খাবার তুলে দেন তিনি।
শৌখিন খাওয়া শেষ করে দ্রুত।
চেয়ার টেনে উঠতে যায় আবার কিছু মনে পরায় বসে পরে।
মায়ের দিকে তাকায়।বলে,

—কিছু কথা ছিলো মা।

রেহেনা বেগম বলেন,

—কি বল?

—ইরা এখনো এ বাড়িতে কি করে?

রেহেনা বেগম শৌখিনের কথার অর্থ বোঝেন।তবু বলেন,
–এটা আবার কেমন ধরনের প্রশ্ন?এ বাড়িতে থাকবেনা তো কোথায় থাকবে?

শৌখিন আরেকটু গম্ভীর হয়।

—তুমি কি সত্যিই বুঝতে পারছোনা?

—বুঝবোনা কেনো?কিন্তু ও তোর বউ।

শৌখিন যেন জ্বলে ওঠে।
–বউ? কার বউ?
তুমি জানো ওকে বউ হিসেবে আমি মানিনা।
সেদিন শুধুমাত্র ওকে বাঁচাতে পরিস্থিতির চাপে পরে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছি আমি।
এটাকে কি অদৌ বিয়ে বলে?

রেহেনা বেগম দমে যান।সত্যিই তিনি সেদিন ছেলেকে বিয়েটা করতে বাধ্য করেছিলেন।
কিন্তু তাই বলে বিয়েটাকে মানবেনা?
যতো যাই হোক,বিয়েতো হয়েছে।
মনে মনে এসব বললেও মুখে কিছু বলা হয়ে ওঠেনা।

শৌখিন নিজেকে শান্ত করে আবার বলে,

—তো কবে যাচ্ছে ও এ বাড়ি ছেড়ে?

পাশ থেকে শাম্মি বলে ওঠে,

—কিসব কথা বলিস ভাইয়া?ইরা এখান থেকে চলে গেলে কোথায় যাবে?ওর কি কোথাও যাওয়ার জায়গা আছে?
একবারও সেকথা ভাবলিনা?

শৌখিন চুপ হয়।সত্যিই ইরার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই সেকথা সে জানে।
কিন্তু তারপরও সে নিরুপায়।
ইরার সাথে বিয়ের কথা এ বাড়ির লোক ছাড়া আর কেউ জানেনা।
জানলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
মিতালী ভেঙে পরবে খুব।
বিষয়টাকে সে কিছুতেই মানতে পারবেনা।
চার বছরের সম্পর্ক মিতালীর সাথে।
তাছাড়া যাই হোক না কেনো ইরা তো শৌখিনের বউ,তার সামনে তো আর মিতালিকে বউ করে নিয়ে আসতেও পারবেনা।
সবকিছু বিবেচনা করেই ইরার এ বাড়িতে থাকলে চলবেনা।
অন্তত শৌখিন তাই মনে করে।

শাম্মির কথার উত্তরে সে বলে,

—-সেসব কথা আমি জানিনা।
ওকে নিয়ে তোরা কি করবি কর।তবু এ বাড়িতে থাকা চলবেনা।
নয়তো কালই আমি আবার চলে যাবো।
এবার সিদ্ধান্ত তোরা নে।

কথাটা বলেই শৌখিন দাড়ায়না।
হনহন করে উঠে চলে যায়।
রেহেনা বেগম তার যাওয়ার পথে ছলছল নয়নে তাকান।
কিচেনের দরজার সামনে দাড়িয়ে আরেকজনও চোখের জল ফেলে।
রহিমা খালা সে দৃশ্য দেখে ইরার কাধে হাত রাখে।
বলে,

—কষ্ট পাইও না মা।দেইখো একদিন সব ঠিক হইয়া যাইবো।

ইরা মনে মনে হাসে।
তার জিবনটাই এমন এবড়োখেবড়ো। তার জিবনে কক্ষনো কিচ্ছু ঠিক হয়না।কক্ষনোই না।

,

—————

,

বাইক থেকে নেমে হন্তদন্ত হয়ে রেস্টুরেন্টে ঢোকে শৌখিন।
তার আসার কথা ছিলো দশটায় কিন্তু এখন বাজে সাড়ে এগারোটা।
একেবারে গুনেগুনে দেড় ঘন্টা লেট করেছে সে।
সকালে নাস্তা করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে বের হয়েছিলো।কিন্তু কখন যে সময় গড়িয়ে গেলো বুঝতেই পারেনি।
তবু বন্ধুরা কিছুতেই ছাড়ছিলো না তাকে।
শৌখিনই আবোলতাবোল বুঝিয়ে তারপর এসেছে।

রেস্টুরেন্টে ঢুকে চারিদিকে ভালোমতো চোখ বুলায় সে।
এককোনায় একটা চেয়ারে মুখ গোমড়া করে মিতালীকে দেখে সেদিকে ছোটে।
চেয়ার টেনে ধপ করে বসে।
তাড়াহুড়ো করায় ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে।
শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলে কলার সোজা করে।

মিতালি এতক্ষণ চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে ছিলো।
শৌখিনকে দেখে মুখটা আরও ফুলায়।অভিমানে গলা আটকে আসে তার।
মুখ অন্যদিকে ঘুরায়।
শৌখিন সেদিকে দেখে মিষ্টি হাসে।
হাতে রাখা টকটকে লাল গোলাপের তোড়াটা টেবিলে রাখে।মিতালীর গোলাপ পছন্দ।
মৃদু গলায় বলে,

—সরি।

মিতালী ফুসে ওঠে।
—সরি বললেই হবে নাকি?কতক্ষণ অপেক্ষা করছি জানো তুমি?

—কি করবো বলো,তোমার ভাইটাই তো আসতে দিচ্ছিলো না।

মিতালী ভ্রু কুঁচকায়।

—ভাই আসতে দিচ্ছিলো না মানে?
এতক্ষণ কই ছিলে তুমি?

—রিফাত, আমি আর সব বন্ধুরা মিলে একটু আড্ডা দিচ্ছিলাম।

মিতালি শান্ত হয়।
তবু মুখটা ভারই রাখে।থমথমে গলায় বলে,

—তো কি বলে আসলে ভাইয়ার কাছে?

শৌখিন দুষ্টুমি মাখা হাসি হাসে।
বলে,

—রিফাতকে বললাম আমায় ছেড়ে দে ভাই,আমি একটু তোর বোনের সাথে দেখা করে আসি।
কতোদিন দেখা হয়না।ফোনে ফোনে কি আর প্রেম জমে বল?

মিতালী চোখ বড়বড় করে তাকায়।বিস্ময়ে তার মুখ হা হয়।

—সিরিয়াসলি? তুমি ভাইয়াকে আমাদের ব্যাপারে বলে দিয়েছো?

শৌখিন শব্দ করে হেসে ওঠে।
গা দুলিয়ে হাসে।
বলে,
—দেখেছো কেমন করে বোকা বানালাম তোমায়?

মিতালী রেগে ফুসে ওঠে।
শৌখিনের হাতে কিল ঘুসি মারে।
পরমুহূর্তে নিজেও হেসে ফেলে।

শৌখিন হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়।মিতালীর হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে বুক শীতল হয়।
মনে হয় এই হাসিটা ফিকে হতে দেওয়া যাবেনা।কোনমতেই না।ইরার জন্য তো না-ই।
এতে যদিও ইরার প্রতি অন্যায় হবে ।
তবুও একজনের প্রতি ন্যায় করতে গেলে আরেকজনের সাথে অন্যায় করতেই হবে।
তাছাড়া জিবনে ভাল থাকতে গেলে একটু স্বার্থপর হতেই হয়।
,

,

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here