#পরিণীতা
#পর্ব_৭
#লেখনীতে_সাবরিনা_সিদ্দিকা_তাবাচ্ছুম
সকালে আদিব চলে গেল। যাওয়ার আগে রাতের কথাগুলোর জন্য সরি বলে গেলো। আমিও বুঝলাম সে মজা করে বলেছে এসব।
আমি ড্রয়ংরুমে বসে বসে মোবাইল দেখছিলাম হঠাৎ দেখি লিজা তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যাচ্ছে বাড়ি থেকে।
“কোথায় যাচ্ছো লিজা?”
লিজা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ গরম করে বলল,
“তোমার সেটা না জানলেও চলবে”
বলে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেল। আমি তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর সাদাফ ভাইয়া অফিসের জন্য বেরোচ্ছিল। বড় আব্বু ডেকে বলল,
“লিজা এভাবে বেরিয়ে গেলো কেন?”
“ওকে ওর বাবার বাড়ি চলে যেতে বলেছি।”
“মানে?”
“এমনিও কিছুদিন পর সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে গেলে সমস্যা কোথায়? আর তাছাড়া ও এখানে থাকলেই সমস্যা। বাড়িতে তো শান্তি থাকেই না; আমাকেও শান্তিতে থাকতে দেয় না। যত উ’টকো ঝামেলা।”
বুঝলাম ওদের মধ্যে আবার ঝামেলা হয়েছে।
সাদাফ ভাইয়া আবার বলল,
“এমনিতেও সন্ধ্যায় দেখবে যে ও নিজেই চলে এসেছে। কেন যে আসে”
বলতে বলতে বেরিয়ে গেল।
ওহ হ্যাঁ বলা হয় নি,
সাদাফ ভাই ও লিজার আমার বিয়ের দিনই বেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। লিজা বাবার বাড়ি চলে যাওয়ায় সাদাফ ভাইয়া আপাতত অফিসের হোটেলে উঠে কয়েকদিন পর লিজা নিজেই ফেরত আসে সাদাফ ভাইয়ের কাছে। পরে তারা বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার দুই মাস পর আবার ফিরে এসেছিল। এসে কাকুতি মিনতি করেছিল। এমনকি বলেছিল তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। নিজেদের পরিবর্তন করে নিয়েছে। বাড়ির সবাই ওদের কথা মেনে নিয়েছে। ভেবেছে হয়তো সত্যিই নিজেকে পরিবর্তন করেছে কিন্তু ধারণা ভুল! সাদাফ ভাইয়া নিজেকে পরিবর্তন করলেও লিজা আগের মতোই ছিল। শুধু নাটক করে গিয়েছে। বাড়িতে প্রথম প্রথম সব ঠিকঠাক করলেও কয়েকমাস পর আসল রূপ বেরিয়ে যায়। তারপর তাদের আলাদা হওয়ার চিন্তা আসে।
এবার আসি বর্তমানে,
আমি ওই বাড়িতে কল দিলাম। সবার খোঁজ খবর নিলাম।
আমি অনেকদিন পর বাড়িতে আসায় আমার ছোটো খালা আসছে আমার সাথে দেখা করতে। ছোটো থেকে ওনার সাথে আমি অনেকটাই ফ্রী। তাই আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুর মতো। আর বয়সের দিকেও কাছাকাছি হওয়ায় আমাদের মন মানসিকতা একই বলা চলে।
আমি নিচে বসে ছিলাম তখনই মেইনগেইটে গাড়ির হর্ণ শুনলাম। আমি গিয়ে দরজা খুলতেই দেখি আম্মুর ছোটো বোন এসেছে। ও দৌঁড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“এই বিল্লি কেমন আছিস?”
“তোর এই নাম এখনো গেলো না”
“যাবেও না”
“ভালো; আসো ভেতরে”
ও আসায় বাড়িটা আরো মেতে উঠেছে। আমার রুমে বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ ফোনের রিং বেজে উঠলো। মোবাইলে দেখি আদিব কল দিয়েছে। এই অসময়ে কেন হঠাৎ কল দিলো? কী হলো?
“আসসালামু আলাইকুম”
“ওয়াআলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ”
“কী করছেন?”
“অফিসের কাজ। বলেছিলাম যে অনেক চাপ রয়েছে”
“তো হঠাৎ কল দিলেন?”
“এমনিই! কথা বলতে ইচ্ছে হলো। কেন বিজি নাকি তুমি?”
“না এমনিই ছোটো খালা এসেছে। তোমাকে বলেছিলাম না?”
“ওহ আচ্ছা ঠিক আছে তুমি গল্প করো। পরে কথা বলবো”
“আচ্ছা”
“আল্লাহ্ হাফেজ।”
“আসসালামু আলাইকুম”
“ওয়াআলাইকুমুস সালাম”
বলে কল কেটে দিলাম।
“কে রে? তোর জামাই নাকি?”
“হ্যাঁ। তুমি বিয়েতে আসলে না কেন?”
“তোমার মতো এতো ভালো জামাই তো আর আমার কপালে জোটেনি। সে খুবই কড়া ভাই। সেদিন আমি একটু অসুস্থ ছিলাম। বললো জার্নি করলে এই হবে সেই হবে আর আসায় হলো না”
“ওহ তবে তোমার ভালোর জন্যই কিন্তু বলেছে। তোমার কিন্তু খুব কেয়ার করে।”
“হ্যাঁ তা ঠিক”
“তাহলে আবার খারাপ জামাই বলো কেন?”
“ওটা তো এমনি বলি। ও এতোটাও খারাপ না”
দুজনেই হেসে উঠলাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম,
“এক পা’গলের ভাত নাই আরেক পা’গল এসে জুটেছে”
ঝুমু( ছোটো খালা) দরজার দিকে তাকিয়ে কিছু না বুঝলেও আমি খুব ভালোই বুঝতে পেরেছি কে বলেছে এই কথা।
“কী হলো এটা?”
“আরে বাদ দাও তো”
“না না কেন বাদ দিবো?”
“আরে ওকে তো জানোই ইচ্ছে করে বাড়িতে ঝামেলা করতে চাই তাই এখন কিছু বলিনা আর।”
আমরা বুঝতে পেরে চুপ করে রইলাম। এটা এখন লিজার স্বভাব হয়ে দাড়িয়েছে। তাই ওকে কিছু বলে না কেউ। সবাই জানে বলেও লাভ নেই। পাগ’লে কত কিছু বলে কিন্তু সেগুলো পাত্তা না দিলেই হয়।
বিকেলে আমি আর ঝুমুর বেরিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ঘোরাফেরা করা। তবে আমরা শপিংমলে ও গিয়েছিলাম। আমরা সারা বিকেল ঘুরলাম, খেলাম, শপিং করলাম। অনেকদিন পর এতো বেশি আনন্দ করলাম। এর মাঝে আদিবকে খুব মিস করেছি। ও থাকলে ভালো হতো। তাই এক ফাঁকে ওকে মেসেজ দিলাম। বের হওয়ার আগেই অবশ্য বলে এসেছি। ও বলল ঘুরে আসতে। আমরা বাসায় এসে অনেক বেশি টায়ার্ড হয়ে গেছি। আসতে আসতে মাগরিব হয়ে গিয়েছে। তাই একসাথে নামাজ পড়ে দুজনেই শুয়ে পড়লাম। সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়লাম। বাইরে থেকে খেয়ে আসায় ক্ষিদে ছিল না। তাই বাসার কেউ ও আর জোর করলো না। হঠাৎ চিল্লাচিল্লির শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। বাইরে মনে হচ্ছে অনেক আওয়াজ আসছে। ঘুমের ঘোর কাটার পর বুঝতে পারলাম পাশের রুম তথা সাদাফ ভাইয়ের ঘর থেকে আসছে আওয়াজ। আমি বুঝলাম না কী হলো। তুমুল ঝ’গড়া বেঁধেছে মনে হচ্ছে। আমি ঝুমুরকে ডাকলাম।
“কী হয়েছে রে?”
“ওই দেখো কী নিয়ে যেন ঝ’গড়া বেঁধেছে”
“কার?”
“জানি না সাদাফ ভাইয়ের ঘর থেকে আওয়াজ আসছে। চলো দেখে আসি”
“আরে রাখ তো। ঘুমোতে দে”
এই বলে ঝুমুর আবার ঘুমিয়ে পড়লো। আমি ওকে আরো কয়েকবার ডেকেও তুলতে পারিনি। অগত্যা একাই গেলাম। রুম থেকে বের হয়ে দেখি বাড়ির পরিবেশ শান্ত। মানে ওরা যে ঝগড়া করছে কেউ এলো না এদিকে! সবাই হয়তো ওদের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এই চিন্তায় এসব পাত্তা দিচ্ছে না। আমি আশে পাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে সাদাফ ভাইয়ের ঘরের দিকে পা বাড়াবো তখনই পেছন থেকে আম্মু ডেকে উঠলো,
“ওদের রুমে যাস না”
“আম্মু ওদের ঝামে’লা হচ্ছে। এটা কাউকে তো মিটমাট করতে হবে”
“তোর ওদের মাঝে ঢোকার দরকার নেই।” বলে আম্মু আমাকে ওদিকে টেনে নিয়ে গেলো।
“আম্মু এরকম করছো কেন বলোতো? ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে বলে? কিন্তু যতদিন আছে ততদিন তো ওরা হাসবেন্ড ওয়াইফ!”
“চুপ! এটা ওদের নিত্যদিনের অভ্যাস। কোনো একটা দিন যায় নি যে ওরা ঝগড়া করেনা। এগুলোতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি।”
“কী বলছো? তোমরা থামাও নি কেন?”
“আমরা থামাতে গিয়েছিলাম। প্রথম যেদিন ওরা এসব শুরু করেছিল সেদিন সাদাফ ছিল লিজার আঁচলে বাঁধা। সাদাফ সবাইকে সেদিন বলেছিল রুম থেকে বের হয়ে যেতে। তাদের মাঝে যেন কেউ না আসে। এমনকি তার মা বাবাকেও সে এসব বলেছিল। তারপর তখন দেখা গেল লিজা বাড়াবাড়ি করছে তখন সাদাফ ওর গায়ে হাত তুলল। এর থেকেই তো ওদের সম্পর্কের পরিণয় এটা হয়েছে। লিজা রা’গের ব’শে প্রথমে বললেও সাদাফ তো এক পায়ে রাজি ওকে ছেড়ে দিতে।”
আমি এসব শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। এতো কিছু!! আম্মু হঠাৎ বলল,
“তরকারি চড়িয়ে এসেছি। যাই নাহয় আবার পুড়ে যাবে। তুই নিশ্চয়ই এরকম কিছু করতে যাবি জানতাম তাই এসেছি”
“হুম যাও”
বলে আম্মু চলে গেলো আর আমি রুমে এসে গেলাম। ওদের রুম আমার রুমের পরে হওয়ায় ওদের কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। আমি রুমে এসে ব্যালকনিতে চলে গেলাম। সাদাফ ভাইয়া আর লিজা এখনো ঝগড়া করে যাচ্ছে। হঠাৎ ঠাসসসস শব্দ হলো। বুঝলাম সাদাফ ভাইয়া চড় মেরেছে। এতে লিজার গলার আওয়াজ আরো বাড়ছে। তবে এভাবে লিজার গায়ে হাত তোলাটা আমার উচিত বলে মনে হয় নি যতই সে ভুল করুক। অন্যভাবে শাস্তি দেওয়া যেতো।
“তোকে তো বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেছিলাম ফিরে এসেছিস কেন?”
“এখন আমার অধিকার আছে এই বাড়িতে। তুমি বলার কে?”
“দুইদিন পর এই অধিকার ছুটে যাবে। ঘাড় ধা”ক্কা দিয়ে বের করে দিবো।”
সাদাফ ভাইয়া তুই তুকারি করছে!! আমি আর শুনতে পারলাম না। এইসব চলে এই বাড়িতে! অথচ আমি কিছু জানলামই না। আমার মনে আসলো আমি কত ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ। আদিব কখনোই আমার সাথে উঁচু স্বরে কথা পর্যন্ত বলেনি। গায়ে হাত তোলা তো দূরে থাক। আর এখানে তো দেখি তুই তুকারি থেকে শুরু করে চড় মারা পর্যন্ত চলে গিয়েছে। এক সময় ভেবেছিলাম সাদাফ ভাই এমন কেন করেছিল! আমার ভাগ্য এমন কেন। এখন বুঝতে পারছি যা ভেবেছিলাম সব ভুল। সঠিক সময় আল্লাহ্ সঠিক জিনিসটাই দেয়। সাদাফ ভাই বলেছিল আমি তার যোগ্য না। এখন এটা মনে পড়লে হাসি আসে। আসলেই আমি তার যোগ্য না। কারণ এমন পরিস্থিতির শি’কার আমি হতে চাইনা। আদিব সবসময় চেষ্টা করে রাগ সংযত করতে।
একবার সে অফিসের তাড়াহুড়ো করে বেরোচ্ছিল ঠিক সেই সময় আমি নাস্তা দিই তবে আমি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নাস্তা পুড়ে ফেলি। সেদিন মানুষটা কিছু খেয়ে যেতে পারেনি। এরকম একটা সময়ে মানুষের মেজাজ হওয়াটা স্বাভাবিক। আমি নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছিলাম কিছু শোনার জন্য। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে আদিব
“একটু সাবধানে আর মনোযোগী হও।” বলে বেরিয়ে গেলো। হয়তো রাগ আমার উপর ঝাড়তে চাই নি। এই সাত মাসে আমি কখনোই তার রাগ কিংবা খারাপ ব্যবহার দেখি নি। আমি ভাবতাম আমার পরিণতি কী আছে এখন মনে হচ্ছে আমিই হয়তো #পরিণীতা!
এসব ভাবতে ভাবতে ওদের ঝগড়া থেমে গেল। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। তারপর আদিবকে ফোন করলাম।
এর মাঝে আদিব হঠাৎ বলল,
“তোমার কথা অন্যরকম মনে হচ্ছে?”
“কেমন?”
“বুঝতে পারছি না”
আমি হেসে বললাম,
“কাল আমাকে নিতে এসো”
“এতো তাড়াতাড়ি চলে আসবে?”(অবাক হয়ে)
“হুম”
“তুমি তো অনেক তোড়জোড় করে গিয়েছিলে অনেকদিন থাকবে বলে হঠাৎ কী হলো?”
“কিছু না। কেন তোমার সমস্যা হবে নাকি?”
“আরে না সমস্যা কীসের আমি তো খুশি হবো। বউ ফিরে আসলে কে না খুশি হয়!”
তারপর কিছুক্ষণ কথা বলে কল কেটে দিলাম। সে তো মহা খুশি। রাতে খেতে বসে সবাইকে জানালাম কাল চলে যাওয়ার কথা। সবাই প্রশ্ন করলেও আম্মু কিছু বলল না উল্টো সামাল দিলো। আম্মু হয়তো কিছু বুঝতে পেরেছে। আমি খেয়ে আসার সময় আম্মুর দিকে কৃতজ্ঞতাসূচক হাসি দিলাম। আম্মু হেসে আমাকে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করলো।
সকালে আদিব এসে নিয়ে গেলো আমাকে।
চলবে….?
(1408 শব্দের)
[গতকাল গল্প দিতে পারিনি তার জন্য দুঃখিত। আজকে আরো বড় করে দিয়েছি। কেমন হয়েছে জানাবেন]