পরিণীতা পর্ব -০৮

#পরিণীতা
#পর্ব_৮
#লেখনীতে_সাবরিনা_সিদ্দিকা_তাবাচ্ছুম

বাড়িতে চলে আসায় দুই বাড়ির সবাই কম বেশি অবাক হয়ে আছে। ওদের এসব কান্ড দেখে আমি বেশ মজা পাচ্ছি। আদিব আমাকে বাড়িতে ড্রপ করে অফিসে চলে গিয়েছিল। সারাদিন আমার শাশুড়ি আর ননদ দুইজনেই আমাকে শুধু জিজ্ঞাসা করতে করতে পা’গল করে দিয়েছে। আমি তেমন কিছুই বলিনি। রাতে আদিব আসার পর ফ্রেশ হয়ে রুমে বসেছিল আমি শরবত হাতে রুমে ঢুকেছি। সে এক পলক তাকিয়ে আবার মোবাইল দেখা শুধু করলো। মনে হচ্ছে কিছু লিখছে। হয়তো কোনো ইমেইল। আমি আর কিছু বললাম না। রুমের কিছু জামা কাপড় ভাজ করার ছিল সেসব করে নিলাম। একটু পর আদিব শরবত শেষ করে আমার ডাকলো। আমি বিছানায় ওর মুখোমুখি হয়ে বসলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম ও কী জিজ্ঞাসা করবে। আমি মুচকি মুচকি হাসছি দেখে আদিব জিজ্ঞাসা করলো,

“কী হয়েছে? তুমি হাসছো কেন?”(ভ্রু কুঁচকে)

“আমি বুঝতে পারছি তুমি কী জিজ্ঞাসা করতে চাইছো”(হেসে)

“তাহলে বলে দাও”(বিছানায় শুয়ে)

“তুমি জানতে চাও তো যে আমি হঠাৎ এতো তাড়াতাড়ি চলে এলাম কেন?”

“হুম”

“আমার আসলে ওই বাড়িতে ভালো লাগছিল না। আর সাদাফ আর লিজার এই বিষয়গুলো মিটমাট হলেই যাবো। কাল সারারাত ঝগড়া করেছে। ছোটো থেকে বাড়িতে এসব কিছু দেখি নি। আমার এসব ভালো লাগে না। আর এই বাড়িতেও কখনো এমন হয়নি। তাই আর থাকতে ইচ্ছে হলো না”

“ওহ। তা তোমার পরিবারের সবাই কিছু বলে নি?”

“জিজ্ঞাসা করেছিল। আম্মু সামাল দিয়েছে। আম্মু হয়তো বুঝতে পেরেছে আমি কেন চলে এসেছি। এসব যে আমার অস্বস্তির কারণ সেটা আম্মু ভালো করেই জানে”

“বুঝতে পেরেছি। তবে ভালোই হয়েছে। আমার একা একা আর থাকতে হলো না। একা থাকতে ভালো লাগে বলো?”

“একা কোথায় একদিন মাত্র!”(কোণা চোখে তাকিয়ে)

“হাহা। আচ্ছা ক্ষিদে লেগেছে খেতে দাও।”

“নিচে আসো। খাবার বাড়ছি।”

বলে আমি খাবার বাড়তে চলে এলাম। নিচে শুনশান নিরবতা। মনে হয় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি খাবার গরম করে টেবিলে সাজিয়ে রাখলাম। একটু পর আদিব চলে এলো। দুইজনে একসাথে খেলাম। তারপর আদিব রুমে চলে গেলো আর আমি এসব গুছিয়ে রাখলাম।

রুমে গিয়ে দেখলাম আদিব বসে আছে।

“এখনো ঘুমাওনি?”

“না তোমার জন্য বসে ছিলাম”

“আমার জন্য? কেন?”

“একটা কথা বলার ছিল এদিকে এসো”

আমি গিয়ে বসতেই বলল,

“ঘুরতে যাবে?”

আমি তো শুনে খুশি সাথে অবাক!

“কোথায়?”

“সেটা কোনো এক জায়গায় যাওয়া যাবে তবে যাবে কিনা সেটা বলো?”

“যেতে তো পারি কিন্তু হঠাৎ? তোমার ছুটি আছে?”

“সেটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তুমি রাজি তো?”

“হুমম”

“তাহলে হয়ে গেলো।”

“হুম আমাদের বিয়ের পর তেমন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি আম্মু ও বলছিল তাই আজকে ভাবলাম। কালকে বের হবো।”

“ঠিক আছে”

আমি খুশি খুশি মনে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে ফজরের নামাজ আদায় করে আর ঘুমায় নি আমরা কেউই। হঠাৎ প্ল্যান হওয়ায় সব গুছিয়ে বেরোতে হবে। তাই আজকে সকালেই সব গোছাচ্ছি। বাড়ির সবাইকে বলে দেওয়া হয়েছে। ওদের ও সাথে যেতে বলেছিলাম কিন্তু কেউই যাবে না বলছে। তাই আমরা দুজন যাচ্ছি। তিনদিন থাকবো আমরা। যেহেতু আমাদের দুজনেরই পাহাড় খুব ভালো লাগে তাই আমরা ঠিক করেছি প্রথম দুদিন বান্দরবান আর সাজেক যাবো তারপরের দিন সমুদ্র ঘুরে আসবো।

আমরা সকালে নাস্তা করেই বেরিয়ে পড়লাম। ফুরফুরে মন নিয়ে বেরোলাম। কেমন যেন বাড়িটা মন টানছে। কিন্তু আমরা তো শুধু তিনদিনের সফরে যাচ্ছি তাই এসব চিন্তা না করে ট্যুরে মনোযোগ দিলাম।

সকাল ১০:১৫ মিনিটে আমরা বান্দরবান পৌঁছে গেলাম। এই সৌন্দর্য যেন মনকে নাচিয়ে তুলছে। আমার তো সারাদিন দেখে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। এসে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে নিলাম। ঘুম ভাঙলো বেলা ১২:৩০ মিনিটে। উঠে দেখি আদিব কোথায় যেন বেরিয়েছে। একটু পর দেখলাম খাবার হাতে ঘরে আসলো। আমাদের রিসোর্টটা একদম পাহাড়ের উপর হওয়ায় সেখানের ব্যালকনি থেকে প্রকৃতি দেখা যায়। আমরা ব্যালকনিতে বসে খাবার খাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। এটা অবশ্য আমার আবদার। খাওয়া শেষে আমরা পাশাপাশি বসে প্রকৃতি দেখছি। আদিব আমাকে এক হাতে জড়িয়ে রেখেছে আর আমি আদিবের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছি। এরকম একটা মুহূর্তোই তো আমার চাওয়া ছিল!
একটু পর নামাজ আদায় করে আমরা বাইরে বেরোলাম। দুজনে হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর পর্যন্ত চলে এলাম। এতো সুন্দর পরিবেশ। আশে পাশে পাহাড়গুলো যেন দাঁড়িয়ে দেখছে আমাদের। আর এখন শীতকাল হওয়ায় আবছা আবছা কুয়াশা ও আছে। আমরা অনেক আনন্দ করেছি আজ পুরো দিন। রাতে আরো একবার বেরিয়েছিলাম। তবে বেশি দূর যায় নি। এই শীতের রাত তার সাথে পাহাড়ি জঙ্গল! কটেজে এসে খাওয়া দাওয়া করে নিলাম। অনেক হাঁটাহাটি আর জার্নির কারণে অনেক টায়ার্ড আমরা তাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে ফজরের নামাজ আদায় করে আমরা আবারো ব্যালকনিতে বসে সূর্যোদয় দেখছি। আল্লাহ্ তায়ালার সৃষ্টি যে এতো সুন্দর যা বলার ভাষা নেই। আমার জীবনে এমন কিছু সময় যা আমি ভাবতেও পারছি না। একটু পর আমরা বের হবো সাজেক ভ্যালির উদ্দেশ্যে। আমরা বের হই সকাল সাতটায়। সেখানে পৌঁছেই আমরা ঘোরাফেরা শুরু করে দিই। সুন্দর সুন্দর জায়গা কী মিস দেওয়া যায়? আমার মনে হচ্ছে সময় যেন খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে। এখানেই যদি থেমে যেতো! আমরা অনেকক্ষণ ঘুরলাম। তারপর কটেজে উঠলাম। বাহ! এই কটেজটা আরো সুন্দর। তারপর আমি আবদার করলাম মেঘ ছুঁয়ে দেখতে চাই আমি। আদিব রাজি হয়ে গেলো। আমরা মেঘের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম। দুজন মিলে মুহূর্তগুলিকে আরো সুন্দর করে তুলছি। আমাদের তো ইচ্ছে হচ্ছে এখান থেকে আর কখনোই না যায়। এরই মাঝে যে দুদিন চলে গেলো বুঝতেই তো পারছি না। বিকেলে কটেজে এসে মনে হলো বাড়িতে তো ফোন দেওয়া হয়নি। তারপর আমি নিজে ফোন দিয়ে কথা বলেছি। তাদের সবাইকে এসবের সৌন্দর্য বোঝাচ্ছি।

“বিহি?”

“হুম”(বাইরে তাকিয়ে)

“ভালো লাগছে?”

“অনেক! এতো সুন্দর জায়গায় ভালো না লেগে উপায় আছে?”

“হুম। এরকম ভাবেই সুন্দর করে একসাথে সারাজীবন চলতে চাই”

বিহি আদিবের হাতটা ধরে বলল,

“ইনশাআল্লাহ চলতে পারবো আমরা”
তারপর আদিব বিহিকে জড়িয়ে ধরে প্রকৃতি উপভোগ করতে লাগলো। সারাদিনটা সুন্দর কেটে গেলো এভাবেই। পরের দিন সমুদ্রে যাওয়ার আগে এই সুন্দর জায়গায় চাঁদের গাড়ি নামক সুন্দর যানবাহনে চড়তে চাই বিহি। আদিব তার আবদার ফেললো না। তবুও আদিবের কেন যেন এই আবদারটা কী ঠিক হলো? ঠিক না হওয়ার কোনো কারণ নেই ভেবে রাজি হয়ে গেলো।

“বিহি তুমি ভেতরে বসো। একেবারে কোণায় বসাটা রিস্ক মনে হয়”

“আরে না কিছু হবে না চিন্তা করো না।”

বিহি গাড়ির একদম প্রথমের সিটে বসলো। আদিব মানা করা সত্ত্বেও সে বলল কিছু হবে না। আদিব হাত দিয়ে বিহিকে ধরে রাখলো। গাড়ি চলতে শুরু করবো। রাস্তা পাহাড়ি আর খালি থাকায় গাড়ি খুব দ্রুত চলে(যারা চড়েছেন তারা জানেন কত দ্রুত)। সবাই খুব আনন্দের সাথে উপভোগ করছে। বিহির মন ফুরফুরে। সে আদিবের সাথে সারাজীবন এভাবে কাটাতে চাই। সে আদিবকে দেখলো বিহিকে শক্ত করে ধরে আছে। তার এই কেয়ারগুলো বিহির খুব ভালো লাগে।

গাড়ি খুব দ্রুত চলছিল হঠাৎ উল্টোদিক থেকে আসা আরেকটা গাড়ি নি’য়ন্ত্রণ হা’রিয়ে বা চালকের ভু’লবশত বিহিদের গাড়ির সামনে এসে যায় ফলে দুটো গাড়ির ঘর্ষণের গাড়ি দুদিকে ছিটকে যায়। গাড়ি উল্টে বিহি আর আদিবকে আলাদা করে দেয় তবে আদিবের জ্ঞান থাকা পর্যন্ত সে বিহির হাত হে ধরে রাখে। কিন্তু মুহূর্তেই সব তছনছ হয়ে যায়। আদিব হালকা চোখ খুলে আশে পাশে তাকাতে থাকে। এখানে সবাই পড়ে আছে। সে অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে বিহিকে খুঁজতে লাগলো।

“বিহি! বিহি কোথায় তুমি?”(চিৎকার করে)

কোনো সাড়াশব্দ নেই। এই জায়গায় মানুষ কম থাকে। আশে পাশে কেউ নিস্তেজ হয়ে আছে কেউবা নড়াচড়া করছে। আদিবের মাথা ঘুরছে। সে এখনি পড়ে যাবে ঠিক তখন দেখে পাশেই একটা বিরাট খাদ। কেউ পড়লে বাঁচবে না! তার মনে হলো শেষ মুহূর্তে বিহির হাত ছুটে যাওয়ার সময় সে বামে ছিটকে গিয়েছিল আর আদিব ডানে। আর খাদ টাও বামে! আদিব আর কিছু বলতে পারছে না সে সেখানেই পড়ে গেলো।

তবে কী আদিব আর বিহির একসাথে হাতে হাত রেখে চলাটা এই পর্যন্তই? একটু আগেও তো দুজনের চোখে স্বপ্ন ছিল সারাজীবন এক হয়ে থাকার! তাদের একসাথে পথ চলাটা কী তাহলে এখানেই সমাপ্তি টানলো?

চলবে…?

(1165 শব্দের)

[তাহলে কী শেষ সব? দুজনে সারাজীবন চলা স্বপ্ন এখানে থেমে যাবে?]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here