#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_৬ (বোনাস পার্ট)
অহি টলমল পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সদর দরজার কাছে গেল।যত সূরা পারে সব মনে মনে পড়ে দরজা খুলল।সঙ্গে সঙ্গে রোদ্দুর ভাইয়ের বাজখাঁই গলা কানে এলো!
—“ফাঁসির কাষ্ঠে উঠেছিলি নাকি?এতক্ষণ লাগে দরজা খুলতে?তোর হাড় গোড় আজ আমি মাংস থেকে আলাদা করবো।”
অহি দু চোখে ঝাপসা দেখছে।তার সম্পূর্ণ শরীর থরথর করে কাঁপছে।চোখে অন্ধকার নেমে আসছে।সে ভয়ার্ত গলায় গড়গড় করে বলল,
—“রোদ্দুর ভাই, আমায় মাফ করুন।আমায় মাফ করুন।আমি ওসব পাঠাইনি।এই কাঠের দরজা ছুঁয়ে বলছি আমি ওসব পাঠাইনি।আমার আইডি হ্যাক হয়েছে।হ্যাঁ,আমার দোষ নেই!আমায় ক্ষমা করু……”
বাকিটুকু শেষ করার আগেই অহি শরীর এলিয়ে দিল।পড়ে যেতে নিতেই রোদ্দুর ঝটপট হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল।
রোদ্দুরের চোখে মুখে ভয় ছড়িয়ে পড়লো।সে অহির গালে আস্তে করে থাপড় মেরে বলল,
—“অজান্তা!হেই অজান্তা!তোর আবার কি হলো?চোখ খোল!চোখ খোল!কিছু দেখে ভয় পেয়েছিস?কি সব আবোল তাবোল বকছিস?কি পাঠসনি?”
অহি চোখ খুললো না।রোদ্দুর তাকে পাঁজা কোল করে সোফায় শোয়ালো।একি মুসিবতে পড়লো?দরজা খুলতে দেরি করছিল বলে সে ভেবে রেখেছিল দু একটা চড়, থাপ্পড় দিবে।আগের রাগও রয়েছে।তার ফোন কেন পিক আপ করছে না সেসব জিজ্ঞেস করবে।মেয়ে তো তার আগেই অজ্ঞান!
সে রান্নাঘর থেকে পানির জগ এনে অহির মাথায় দিল একটু।চোখে মুখে পানির হালকা ছিটা দিতেই অহি ধড়ফড় করে উঠে বসলো।তার শরীর কাঁপছে।চোখ মুখ ইতোমধ্যে লাল হয়ে গেছে।
রোদ্দুরকে সামনে দেখে আরো ভয়ে কুঁকড়ে গেল।চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু বের হলো।রোদ্দুর বুঝতে পেরে পানির জগটা মেঝেতে রেখে অহির মাথাটা নিজের কাঁধে চেপে ধরে বলল,
—“অজান্তা ভয় কেন পাচ্ছিস এত?কিছু হয়েছে?বল আমায়!”
অহির শরীরের কাঁপুনি আস্তে আস্তে থামলো।সে চোখ মুছে হালকা স্বরে বলল,
—“আমি ওসব ইচ্ছে কৃত ভাবে পাঠাইনি রোদ্দুর ভাই।অন্য কেউ ফাজলামো করে পাঠিয়েছে।আমায় ক্ষমা করুন!”
রোদ্দুর কপাল কুঁচকে বলল,
—“দিব এক চড়!কি সব ছাই পাস বলছিস?কিছু খেয়েছিস অজান্তা?”
অহিরও কপাল কুঁচকে উঠলো।সে রোদ্দুরের কাঁধে থেকে মাথা সরিয়ে তার মুখপানে তাকালো।এত স্বাভাবিক কেন?রোদ্দুর ভাই কি তাহলে মেসেজটা দেখেনি?
মুহূর্তে অহির সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়লো।যাক বাবাঃ!এ যাত্রায় সে হয়তো বেঁচে গেল।সে দ্রুত রোদ্দুরের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে একটু দূরে গিয়ে বসলো।
রোদ্দুর এখনো কপাল কুঁচকে অহির দিকে চেয়ে আছে।অহিকে তার স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।কেমন উদ্ভট আচরণ করছে।এই কাঁদছে তো এই হাসছে!
সে একটু অহির কাছাকাছি বসে বলল,
—“অজান্তা তুই ঠিক আছিস তো?এত বড়ো বাসায় তোকে একা রেখে এরা কিভাবে যায়?কবে যে এদের আক্কেল হবে কে জানে!তোর কি জ্বর টর?”
বলেই সে অহির কপালে হাত রাখলো।ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে অহি কেমন কেঁপে উঠে।দ্রুত হাতটা সরিয়ে বলে,
—“আমি একদম ঠিক আছি।আসলে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখে একটু ভয় পেয়েছিলাম।”
—“আহ!তাই বল!আমি তো ভেবেছিলাম কি না কি হয়ে গেল।সাত মিনিট দরজার বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম।এমন রাগ উঠেছিল না!তুই যদি সেন্সলেস না হতি তাহলে এতক্ষণে আমার হাতের পাঁচটা আঙুল তোর গালে ফুটে উঠতো!”
অহি মাথা নিচু রেখে বলল,
—“আপনি হঠাৎ আমাদের এখানে কেন?অফিস যাননি?”
—“আমি ছুটিতে আছি।বাবা একাই সব সামলাচ্ছে।তুই এখন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।”
অহি অবাক হয়ে রোদ্দুরের দিকে তাকালো।রোদ্দুর হাত দুটো সোফায় এলিয়ে দিয়ে রিলাক্স হয়ে বসলো।চোখ দুটো বন্ধ করে বলল,
—“রোদেলা আপু নিয়ে যেতে বলেছে তোকে।আপুর কলেজে কি যেন একটা প্রোগ্রাম।দুপুর দুটো থেকে আরম্ভ।নে, চট জলদি রেডি হ।”
—“আমি যাব না রোদ্দুর ভাই।আমার প্রোগ্রাম ট্রোগ্রাম ভালো লাগে না।”
রোদ্দুর চোখ না খুলেই বলল,
—“আমি অসহায়।তোর কথা রাখতে পারবো না রে।রোদ আপুর পারমিশন।সোজা কথায় না গেলে জোর করে কোলে তুলে নিয়ে যেতে বলেছে।সময় বেশি নেই।তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নে।পায়ে হেঁটে যাবি নাকি…….”
—“বাসায় তো কেউ নেই।খালি বাসা রেখে যাব কিভাবে?যদি চুরি হয়ে যায়?”
—“হবে না।খালুর সাথে কথা হয়েছে।দুপুরে কলেজ ছুটি হয়ে যাবে।আর একটাও কথা না।দশ মিনিট সময় দিলাম।রেডি হয়ে নে।আমি এই দশ মিনিট একটু ঘুমাব।কয়েক দিন হলো অফিসের কাজের চাপে ঘুমানোর সময়ও পাই না।”
রোদ্দুর চোখ বন্ধ রেখেই সোফায় পা টান করে ঘুমিয়ে পড়লো।অহি উঠে গিয়ে জায়গা করে দিল আরো।কয়েক সেকেন্ড রোদ্দুরের মুখের দিকে চেয়ে উপরে উঠে গেল।
কিছুক্ষণ পর ব্যাগ কাঁধে নিচে নামল অহি।হিজাবে শেষ পিনটা গেঁথে বলল,
—“রোদ্দুর ভাই উঠুন।আমি রেডি।”
রোদ্দুর উত্তর দিল না।সে এখন গভীর ঘুমে।ক্ষণে ক্ষণে ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ আসছে শুধু।অহি কাঁধের ব্যাগটা অন্য সোফায় রেখে গভীর মনোযোগে রোদ্দুরের দিকে তাকালো।কতগুলো দিন পর এত কাছে থেকে দেখছে!
সে বিড়বিড় করে বলল,
“গাছে গাছে পাখিরা গাহিছে কুজন,
চলো আরো একবার প্রেমে পড়ি দুজন!
অ-প্রেম কেটে গিয়ে ফুটুক প্রভাত
চলো আরো একবার হাতে রাখি হাত!”
~অজান্তা
হঠাৎ মনে পড়তেই অহি রোদ্দুরের আশপাশে ফোনটা খুঁজলো।কিন্তু কোথাও চোখে পড়লো না।বুকপকেটে নেই,প্যান্টের পকেটও উঁচু নয়।তাহলে?বাসায় রেখে এসেছে হয়তো!অহি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রোদ্দুরের দিকে তাকালো।
রোদ্দুর ভাইয়ের সমস্ত শরীরে ক্লান্তি ভর করেছে।মুখটা আগের থেকে শুকিয়ে গেছে।চোখের নিচে কালো দাগ বসেছে।রোদ্দুর ভাই কি এখনো বৃষ্টি আপুর কথা ভেবে রাত জাগে?
অহির বুক কাঁপে।বার বার মনে হয়, মানুষটাকে শক্ত করে জড়িয়ে যদি তার সব দুঃখ নিজের করে নিতে পারতো!
সে পণ করে।একবার মানুষ টাকে কাছে পাওয়ার পর আর দূরে যেতে দিবে না।একটানা সাত দিন সব বাদ দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে থাকবে।তার বুক থেকে মাথা উঠাবে না। কোনো কষ্টকে ছুঁতে দিবে না।সবসময় ভালোবাসায় ডুবিয়ে রাখবে।সবসময় নিজের সাথে বেঁধে রাখবে।
হাত ঘড়ির দিকে তাকায় অহি।দুটো বাজতে মোটামুটি অনেক সময় বাকি।মানুষটা আর একটু ঘুমাক।সে রোদ্দুরের থেকে কয়েক হাত দূরে বসে তার মুখের দিকে অপলকভাবে চেয়ে থাকে।গুনগুন করে গেয়ে উঠে,
“অন্ধ হয়ে তোমায় আমি বেসেছি যে ভালো,
নাই বা থাকুক দু চোখ আমার, না বা থাকুক আলো!”
——————
রোদেলা আজ কালো রঙের সিল্কের শাড়ি পড়েছে।গলায় চিকন চেইনের সাথে ছোট্ট একটা লকেট।চুলগুলো ছাড়া।আর কোনো অর্নামেন্টস নেই।এতটুকু তেই তাকে পরীর মতো লাগছে।কিশোরী মেয়েদের মতো ঝলমল করছে।অহি মুগ্ধ হয়ে বলল,
—“আপু,তোমাকে কি সুন্দর লাগছে!তোমার মনের মতোই তুমি সুন্দর।তুমি এত সুন্দর কেন?”
রোদেলা কিশোরী মেয়েদের মতো খিলখিল করে হাসে।অহির মাথায় একটা চাটি মেরে বলে,
—“তোর দেখার চোখ সুন্দর রে অহি।সেজন্য আমাকে ভালো লাগছে।”
অহি কিছু বলতে নিতেই গাড়ি থেমে যায়।তারা কলেজে পৌঁছে গেছে।অহি রোদেলার শাড়ির রঙের সাথে ম্যাচিং করে আজ কালো রঙের লম্বা গোল জামা পড়েছে।সাথে কালো হিজাব।
রোদেলা গাড়ি থেকে নামলো।অহি তার পাশে এসে পলকহীন নয়নে কলেজ দেখলো।পুরো কলেজ ফুলে ফুলে ছেঁয়ে গেছে।আজ দ্বিতীয় বারের মতো সে এই কলেজে ঘুরতে এলো।
দুজন ভেতরে হাঁটা ধরলো।ভেতরটা মানুষে গিজ গিজ করছে।টিচার,স্টুডেন্ট সবমিলিয়ে হাজার মানুষ।একটা প্রিন্সপালের রিসিপশন যে এত জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে পালন করে তা অহির অজানা ছিল।
সে রোদেলার হাত চেপে ফিসফিস করে বলল,
—“আপু,নতুন প্রিন্সিপাল ইয়াং নাকি বয়স্ক মানুষ?”
—“আমি কিভাবে বলবো রে পাগলা?বিদেশ টিদেশ থেকে হরেক রকমের ডিগ্রি নেয়া নাকি।তাহলে তো বয়স্ক মানুষই হওয়ার কথা!”
গার্ডিয়ান সাড়িতে অহিকে বসিয়ে রোদেলা বলল,
—“অহি সোনা!এখানে চুপচাপ বসে থাকো।আমি টিচার্স রুম থেকে ঘুরে আসি।দেখি,কোন কাজ আছে কি না আমার।”
—“হুঁ!”
—“তুই কিন্তু এখান থেকে নড়বি না।এত মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া অনেক টাফ হবে।এখানেই বসে থাকবি,কেমন?”
—“আপু,তুমি যাও।আমি এখানেই থাকবো।”
রোদেলা চলে গেল।অহি চুপচাপ চারিদিকে তাকালো।ফোনটা বের করে দেখলো,রোদ্দুর ভাই এখনো মেসেজ চেক করেনি।মেসেজটা চোখে পড়লে কি যে হবে কে জানে!অহির গা দিয়ে চিকন ঘাম বের হওয়া শুরু হলো।
আধ ঘন্টার মধ্যে অনুষ্ঠান শুরু হলো।রোদেলা স্টেজের উপর বিশাল বড়ো এক ফুলের বুকে হাতে দাঁড়িয়ে আছে।নতুন প্রিন্সিপালকে ফুল দিয়ে বরণ করার দায়িত্ব তার উপর পড়েছে।সমস্ত টিচার্সদের মধ্যে সেই একমাত্র ইয়াং নাকি সেজন্য!
রোদেলা চক্ষু ডান দিকে সামান্য ঘুরিয়ে অহির দিকে তাকালো।অহি ঝলমলে মুখে হাত নাড়লো।রোদেলা মুচকি হাসে!
তার পা ধরে আসছে।অনেক্ক্ষণ হলো এভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।প্রিন্সিপালের স্টেজে উঠার খবর নেই।প্রিন্সিপাল কলেজে এসে পৌঁছেছে মিনিট বিশেক আগে।সে খবর রোদেলার কানে এসেছে।কিন্তু স্টেজে কেন আসছে না?টিচার হওয়ার এই এক ঝামেলা।দুদিন পর পর এটা ওটা উপলক্ষে ঘন্টার পর ঘন্টা উপর মহলের লোকদের গুরুগম্ভীর বকবকানি শুনতে হয়।শুধু শুনলে হয় না,মনোযোগী হওয়ার ভান ধরতে হয়!
রোদেলার ভাবনার মাঝে চারিপাশ করতালিতে মুখরিত হয়ে গেল।হাজারো হাতের শব্দে তার কান ঝাঁ ঝাঁ করা শুরু হলো।শব্দ যেন মধ্য পর্দা ভেদ করে মস্তিষ্কে প্রতিটি নিউরনে গিয়ে আঘাত হানছে।রোদেলা চোখ বন্ধ করে আবার খুলল।
ভাইস প্রিন্সিপাল তার নাম ধরে ডাকছে।ক্রমাগত স্পিকারে বলে যাচ্ছে, অত্র কলেজের সম্মানিত নতুন প্রিন্সিপাল,জুলকারনাইন সাদিদ,বিএসসি,এমএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়;পিএইচডি, কানাডা!উনাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিচ্ছে এই কলেজের ইংরেজির প্রফেসর মিস রোদেলা জান্নাত!
স্পিকারে ঘোষিত নাম শুনে রোদেলার মাথা ঘুরছে।সে অগোছালো ভাবে হেঁটে সামনে এগিয়ে গেল।চারিদিক থেকে করতালির আওয়াজ ছাপিয়ে এক গুচ্ছ ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠলো।কেউ একজন তার হাতে রাখা বুকেটার একপাশ ধরলো।
অনেক কষ্টে রোদেলা চোখ তুলে তাকালো।ফুলের একপাশ ধরে রাখা স্যুট,বুট পরিহিত হাস্যোজ্জ্বল চেহারার মানুষটিকে দেখে তার অন্তরাত্বা কেঁপে উঠলো।
মানুষটি হাসি মুখেই তার চোখের দিকে তাকালো।সেই চেনা চোখ, সেই পরিচিত হাসি!যে হাসিতে রোদেলা বহু বছর আগে ঘায়েল হয়েছে।
রোদেলার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসছে।গা গুলাচ্ছে।বমি বমি পাচ্ছে।নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।টেনে টেনে দু তিনবার শ্বাস নিয়েই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নিষ্ঠুর মানুষটার উপর চোখ বন্ধ করে হেলে পড়লো!
(চলবে)
নিন!অগোছালো ভাবে আরেক পার্ট দিলাম।খুশি তো?😊😍
#পর্ব_০৭
রোদেলা টেনে টেনে দু তিনবার শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নিষ্ঠুর মানুষটির উপর হেলে পড়লো।
মঞ্চে উপবিষ্ট সকল মানুষসহ সামনের দর্শক সারিতে গুঞ্জন শুরু হলো।সাথে চাপা উত্তেজনা।অহি সব মানুষকে সাইড করে হাঁফাতে হাঁফাতে স্টেজে উপস্থিত হলো।তার নিজেরো হাত পা কাঁপছে।
সে সবাইকে সরিয়ে রোদেলার হাত ধরে বলল,
—“রোদেলা আপু,কথা বলো!কথা বলো আপু!কেউ একজন একটু সাহায্য করুন।পানি দিন কেউ একটু! ”
রোদেলা নতুন প্রিন্সিপালের বুকের উপর হেলে আছে।নতুন প্রিন্সিপাল বাম হাতে হালকা করে রোদেলাকে ধরে আছে।তিনি শীতল গলায় অহিকে বললো,
—“মিস!ভয় পাওয়ার কিছু নেই।আজ অত্যধিক গরম পড়েছে।সেখানে উনি চুল ছেড়ে রেখেছেন।সেজন্য সেন্সলেস হয়ে গেছে জাস্ট।আপনি বরং উনাকে টিচার্সদের রেস্টিং রুমে নেয়ার ব্যবস্থা করুন।”
এক নাগাড়ে বলে ভাইস প্রিন্সিপালের দিকে তাকালেন।উনি স্পিকারে সবাইকে ক্রমাগত শান্ত হতে বলছেন।
পরিস্থিতি অনুকূলে আনার জন্য অন্য একটা টিচার এসে রোদেলাকে পাঁজা কোল করে নিয়ে স্টেজ থেকে নেমে গেল।দুজন মহিলা টিচার এবং অহি তাদের পিছন পিছন গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই চারিপাশ শান্ত হয়ে গেল।সবাই আগের মতো আগ্রহ নিয়ে নতুন প্রিন্সিপালের দিকে তাকালো।সাদিদ একটু সামনে এসে মুচকি হেসে সবার উদ্দেশ্যে হাত নাড়লো।প্রথম দিনই এরকম কিছু ঘটবে তা তার ভাবনা তে ছিল না।
——————-
রোদেলার জ্ঞান ফিরেছে।সে শুয়ে আছে কলেজের প্রাথমিক চিকিৎসালয়ে।কলেজের কোনো স্টুডেন্ট হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়লে এখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়।দিনের বেলার জন্য সার্বক্ষণিক একটা বয়স্ক এসবিবিএস রাখা আছে।
রোদেলার বাম হাতে স্যালাইন লাগানো হয়েছে।সে আধো ঘুম,আধো চৈতন্যে আছে।তার চোখের সামনে স্যুট,বুট পড়া একজনের চেহারা ভেসে উঠছে বার বার।
অহি রোদেলার মাথার চুলে আঙুল চালিয়ে বলল,
—“আপু,এখন কেমন লাগছে তোমার?একটু বেটার ফিল করছো?”
রোদেলা পিটপিট করে চোখ খুললো।অহির দিকে চেয়ে জোরপূর্বক হেসে বলল,
—“আমি একদম ঠিক আছি। তোকে অনেক ভয় পাইয়ে দিয়েছিলাম, তাই নারে?”
—“শুধু আমি না আপু!তুমি সবাইকে ভয় পাইয়ে দিয়েছো।আমি হাউমাউ করে কাঁদতে নিয়েছিলাম।তোমাদের নতুন প্রিন্সিপাল বলল,ভয় পাবেন না।উনার কিছু হয়নি।”
রোদেলা চমকে বলল,
—“আমাকে এখান অবধি কে নিয়ে এলো অহি?”
—“তোমার ডিপার্ট্মেন্টের এক টিচার আপু।ওই যে টাকলা করে।এর আগের বার তোমার সাথে যখন কলেজে এসেছিলাম তখন কিছু কথা হয়েছিল ওনার সাথে।”
রোদেলা চোখ বন্ধ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।ফের চোখ খুলে বলে,
—“ড্রাইভার কাকাকে গাড়ি নিয়ে আসতে বল অহি।আমি বাসায় যাব।”
—“আপু,স্যালাইন তো এখনো শেষ হয়নি।আধ ঘন্টা পর যাই।”
—“নাহ!আমি এক্ষুনি যাব রে।এখানে থাকলে দমবন্ধ হয়ে মারা যাব!”
অহি আর জোর করলো না।ফোন হাতে নাম্বার ডায়াল করতে করতে বাইরে বের হয়ে গেল।
রোদেলার কানে গানের আওয়াজ ভেসে আসছে।কেউ একজন আবেগ ঝরা কন্ঠে গেয়ে যাচ্ছে,
“আমি হবো রাত আর তুই হবি চাঁদ,
জোসনায় ঘর আমাদের!
তুই হলে রোদ আমি রংধনু হই,
ছিলো সে শহর আমাদের!”
রোদেলার চোখের কোণ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু বের হয়ে কানের কাছে পৌঁছায়।সে ডান হাতে মুছে বড়ো বড়ো করে শ্বাস নেয়।সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে।তার মানে অনুষ্ঠান শেষের দিকে।
দরজায় মৃদু টোকার আওয়াজে সেদিকে তাকায় রোদেলা।
কেউ একজন শীতল পুরুষালি গলায় বলে,
—“ভেতরে আসলাম!”
রোদেলা উত্তর দেয়ার আগেই সাদিদ ভাইস প্রিন্সিপালকে সাথে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।রোদেলা উত্তেজিত হয়ে এক লাফে উঠে বসে।সঙ্গে সঙ্গে তার হাতের সুঁচে টান পড়ে রক্ত উঠে।
সাদিদ দ্রুত এগিয়ে এসে রোদেলার হাতটা টান করে হুকুমের সুরে বলে,
—“মিস রোদেলা, আপনি ব্যস্ত হবেন না।শুয়ে পড়ুন।”
রোদেলা শুয়ে পড়ে।তার মাথা কাজ করছে না।অহিটা কোথায় গেল?এরা প্রিন্সিপাল মানুষ।তার সালাম দেয়া উচিত।সে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
—“আসসালামু আলাইকুম স্যার!”
সাদিদ উত্তর নিল না।ভাইস প্রিন্সিপাল বয়স্কা মানুষ।চুলে বহু বছর আগেই পাক ধরেছে।তিনি সালামের উত্তর দিয়ে বললেন,
—“রোদেলা, তোমাকে বহু বার বলেছি শরীরের যত্ন নিবে।তোমাকে মেয়ের মতো মনে করি।কিন্তু তুমি তো আমার একটা কথাও শোনো না।আজ তোমার গাফিলতির জন্য কি একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হলো সবাইকে।”
রোদেলা নরম গলায় বললো,
—“আমি স্যরি!”
সাদিদ একটু পিছিয়ে গিয়ে বলল,
—“মিস,রোদেলা। আপনার শরীরের কন্ডিশন বেশি ভালো মনে হচ্ছে না।আপনি বরং তিনদিনের লিভ নিন।”
রোদেলা চোখ তুলে সাদিদের দিকে তাকালো।এতগুলো বছর পর দেখছে।অথচ চেহারায় বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আসেনি।আরো সুন্দর হয়েছে মানুষটা!মাথার চুল আরো ঘন হয়েছে।জগতের সমস্ত মায়া যেন একত্রে হয়ে দু চোখে ভর করেছে।কপালের ডান সাইডের কাটা দাগটা আরো উজ্জ্বলতা বাড়িয়েছে।রোদেলা চোখ সরিয়ে নেয়।
সাদিদ নিজেই ভাইস প্রিন্সিপালের দিকে ঘুরে বললেন,
—“স্যার!আপনি মিস রোদেলার ছুটির সব ব্যবস্থা করুন।আমি আসছি।”
বলেই গটগট করে চলে গেল।একবারও পেছন ঘুরে তাকালো না।
কিছুক্ষণ পর অহি এসে বলল,
—“আপু,জব্বার কাকা গাড়ি নিয়ে এসে গেছে।”
——————-
আজ সোমবার।অহির জন্মদিন আজ।সব ঘরোয়া ভাবে করা হবে।দুই ফ্যামিলির মানুষ শুধু।তারা আর রোদেলা আপুদের পরিবার।
রোদেলা কলেজ থেকে সোজা এখানে চলে এসেছে।বিকেলের দিকে তার পরিবারের সবাই আসবে।সে একেবারে শাওয়ার নিয়ে নতুন ড্রেস পড়ে বের হলো।এ বাসায় হুটহাট চলে আসে বলে কিছু জামাকাপড় সবসময়ই রাখে।
অহি দু কাপ কফি নিয়ে রোদেলার রুমে আসলো।রোদেলা তাদের বাসায় আসলে গেস্ট রুমে বেশির ভাগ সময় থাকে।ঘুমানোর সময় দুজন একসাথে ঘুমায়।
—“আপু,তোমার কফি!”
রোদেলা মাথা মোড়ানো টাওয়ালটা সরিয়ে রেখে কফি হাতে নিল।বিছানায় বসে এক চুমুক দিয়ে বলল,
—“এটাই এখন প্রয়োজন ছিল।তুই কিভাবে যেন আমার মনের কথা বুঝে যাস!”
অহি নিজেও আপুর পাশে বসে নিজের কাপে চুমুক দিল।তারপর আপুকে বলল,
—“তোমার কলেজে সময় কেমন কাটে?”
—“তোকে একটা কথা বলি অহি।কাউকে বলবি না কিন্তু।তোকেই প্রথম বলছি।আমি ওই কলেজে আর চাকরি করবো না।রেজিগনেশন লেটারের সব ব্যবস্থা করেছি।”
—“সে কি!কেন আপু?তোমার তো কলেজটা ভীষণ প্রিয় ছিল?”
—“কারণ টা পরে বলবো অহি।তুই যা এখন।আমি ঘুমাব।খু্ব ক্লান্ত!”
রোদেলা সত্যি সত্যি হাই তুলল।কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বিছানায় গুটিশুটি হয়ে বাচ্চাদের মতো পা ভাঁজ করে শুয়ে পড়লো।
অহি উঠে দাঁড়ালো।কয়েক পা এগুতেই রোদেলা চোখ জোড়া বন্ধ রেখেই বলল,
—“শুভ শুভ্র জন্মদিন কলিজা!দোয়া করি,খুব শীঘ্রই রোদ্দুর পাগলাটা যেন তোর ভালোবাসা বুঝতে পারে।আর লাইটটা বন্ধ করে দিয়ে যা।”
অহি লজ্জা পেয়ে মুচকি হাসলো।লাইটটা বন্ধ করে নিঃশব্দে রুম থেকে বের হয়ে গেল।রোদেলা আপু কেন যে তাকে সবসময় লজ্জায় ফেলে?
নিচে রান্নার তোড়জোড় চলছে।অহির মা কাজের লোকেদের সাথে নিয়ে রান্না করছে।অহি এক নজর চারপাশে চোখ বুলিয়ে উপরে উঠে গেল।রোদ্দুর ভাইদের আসার সময় হয়েছে।আজ সে শাড়ি পড়বে।
শাওয়ার নিয়ে টাওয়ালটা বেলকনিতে শুকাতে দিল অহি।দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে অনেক আগেই।রোদের তেজ কমে গেছে।গোধূলি লগ্নের এই শেষ বিকেলটা যেন শুধুমাত্র রোমান্টিকতার জন্যই সৃষ্টি!ইশ!এমন একটা বিকেলে যদি হুডতোলা কোনো রিকশায় সে আর রোদ্দুর ভাই পাশাপাশি থাকতো!কারণ ছাড়াই সে হুট করে রোদ্দুরের হাত চেপে ধরতো তখন।কখনো বা চুলগুলো এলোমেলো করে দিতো!
“আটকে তোকে রাখতে চাইছি খুব সকালে আমার,বিকেলে আমার!”
গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে রুমে ঢুকলো অহি।ওয়ারড্রবের কাপড়ের সারি থেকে বেছে বেছে সবুজ রঙের,কালো পাড়ের শাড়ি বের করলো।
রোদ্দুর অহিদের বাসায় ঢুকেই প্রথমে রোদেলা আপুর খোঁজ করলো।রোদেলা ঘুমাচ্ছে শুনে অপূর্বের সাথে কিছুক্ষণ দুষ্টুমি করলো।তারপর অহির রুমের দিকে পা বাড়ালো।
অহির রুমের দরজা ভেতর থেকে আটকানো।রোদ্দুর বিরক্ত হলো।দিনে দুপুরে এরা দরজা বন্ধ করে কি করে তা আল্লাহ মালুম!সে কপাল কুঁচকেই দরজার উপর একের পর এক আঘাত করলো।
সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল।রোদ্দুর হেলাফেলা করে ভেতরে ঢুকে অহির বিছানায় বসলো।ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললো,
—“এই অসময়ে দরজা বন্ধ করে কি করিস বল তো?প্রেম ট্রেম করিস নাকি?বয়ফ্রেন্ড আছে?”
অহির মনটা খারাপ হয়ে গেল।আশাহত হলো সে।নাহ!মানুষটা তাকে আর কোনোদিন বুঝবে না।একে দিয়ে আর কোনো আশা ভরসা নেই।এখন পর্যন্ত তার দিকে চোখ তুলে তাকায়নি।
মনে মনে বলল,
“জগতের সব মানুষের ব্যাপারে তোমার কত্তো কৌতূহল রোদ্দুর ভাই।শুধু আমার ব্যাপারে তুমি এতো নির্লিপ্ত কেন?”
কন্ঠে একরাশ বিষণ্নতা ঢেলে মুখে বলল,
—“শাড়ি পড়ছিলাম রোদ্দুর ভাই।”
রোদ্দুর মাথা ঘুরিয়ে অহির দিকে তাকালো।সঙ্গে সঙ্গে তার চক্ষু কোটর থেকে বের হওয়ার উপক্রম হলো।অহিকে আজ জীবন্ত পরীর মতো লাগছে।তাকে এ পৃথিবীর মানুষ বলে ভ্রুম হচ্ছে।
সবুজ রঙের শাড়ি ফর্সা ত্বকে ফুটে উঠেছে।চোখে গাঢ় কাজল।ডান গালে টোল খাওয়া গর্ত, ভেজা ভেজা পাপড়ি গুলো চোখের উজ্জ্বলতা যেন বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।টানা টানা ভ্রু যুগল যেন কাছে যাওয়ার জন্য আহ্বান করছে।ঠোঁটের হালকা পার্পল শেডের লিপস্টিক আর অবিন্যস্ত ভেজা চুলে অহিকে যেন অপ্সরীদের থেকেও সুন্দর লাগছে।ঠোঁটের উপরের বাদামি তিলটা যেন রোদ্দুরকে চুম্বকের মতো টানছে।এই প্রথম তার অহিকে ছুঁয়ে দিতে মন চাইলো।অন্য রকমের ছোঁয়া।
সে নিজের অজান্তে উঠে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলল,
—“ও মাই গড!ও মাই গড!ও হঠাৎ করে এতো রূপবতী হলো কি করে?”
অহি চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে রোদ্দুর গভীর মনোযোগে তার দিকে চেয়ে আছে।চোখে মুখে অন্য ধরনের ঘোর।পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে আর বিড়বিড় করে কি যেন বলছে।
—“রোদ্দুর ভাই, আপনি ঠিক আছেন?”
বলে সে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই রোদ্দুর চিৎকার করে ডান হাত সামনে এনে বলল,
—“খবরদার,কাছে আসবি না অজান্তা!ওখানেই থাক।এক পা নড়বি না।একদম কাছে আসবি না বলে দিলাম!”
অহি বারণ শুনলো না।সে বেশ বুঝতে পারছে কোনো একটা কারণে রোদ্দুর ভাই তাকে প্রচন্ড ভয় পাচ্ছে।সে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
—“আপনি কি অসুস্থ?দেখি জ্বর এসেছে কি না?”
অহি হাত বাড়ানোর আগেই রোদ্দুর এক দৌঁড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।দরজায় ঠেস দিয়ে বসে পড়লো সে।তার বুকের ভেতর তোলপাড় হচ্ছে।এটা কি হলো তার সাথে?বুকের ধুকপুকানি যেন বেড়েই চলেছে।সে বুকের বা পাশে হাত দিয়ে চেপে বলল,
—“ও মাই গড!ও মাই গড!”
(চলবে)
মনে তো হচ্ছে রোদ্দুর অহির প্রেমে কাইত!আপনাগো কি মনে হয়? 🙃