#পরীজান
#পর্ব ৩৭
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
অন্যায় কারী কেই পরী কখনোই ক্ষমা করেনি আজও করবে না। দোষীদের সে শাস্তি দেবেই। শায়ের কিছু বলুক বা না বলুক পরী বলবেই। এতদিন চুপচাপ থাকা পরীকে দূর্বল ভেবে তারা যে ভুল করেছে তার মাশুল এবার পাবে তারা। তার আগে সবকথা জানতে হবে। তাই পরী খুসিনাকে আবারও জিজ্ঞেস করে, ‘চম্পা আর কি কি বলেছে ফুপু? আপনি সব বলুন। সব সত্য বলবেন।’
কিছু একটা ষড়যন্ত্র আছে তা বুঝতে পারে খুসিনা। তাই তিনি বলতে লাগলেন,’চম্পা কইলো তুমি নাকি পোলাপান হওয়াইতে পারবা না। কোন ফকিররে দেখাইছো। চম্পা সব হুনছে,হের লাইগা হেরোনা কইলো বউর যহন পোলাপান হইবো না তাইলে চম্পার লগে বিয়া দিলেই ভালো হইবো। পোলাপানের সুখ পাইবো সেহরান।’
-‘আপনাকে সাদাসিধে পেয়ে যা বুঝিয়েছে তাই বুঝেছেন ফুপু কিন্ত আমি সঠিক টাই বুঝেছি। চম্পা অনেক বড় চাল চেলেছে ফুপু যা আপনি টের পাননি।’
ক্রমাগত রাগ বেড়ে চলছে পরীর। শায়ের বুঝলো এবার পরী নিজেও নিজেকে থামাতে পারবে না। পরী পালঙ্কে গিয়ে বসে। মাটির দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবতে লাগল সে। খুসিনা নিঃশব্দে প্রস্থান করে। পরীকে এমন শান্ত হতে দেখে শায়ের ওর পাশে গিয়ে বসে। নিমজ্জিত কন্ঠে সুধায়,’চম্পা আর চামেলিকে আমি সবসময় নিজের বোনের চোখে দেখতাম। কখনোই অন্য চিন্তা ওদের নিয়ে মাথাতে আসতো না। কিন্ত চম্পার মনে যে অন্য কিছু থাকবে তা আমি জানতাম না। শুধু এই জেদ ধরে এতবড় মিথ্যা ও বলল কেন??’
পরী চোখ তুলে তাকালো শায়েরের দিকে। মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেছে।
-‘চম্পা শুধু এই কাজটাই করেনি। আরো একটা জঘন্য কাজ করেছে জানেন কি?’
শায়ের মুখে কিছু না বললেও চোখের মাধ্যমে বোঝালো সে জানতে চায়। পরী বলল,’কাল রাতে ওটা মেজ কাকিই ছিলো। আমার সাথে ধাক্কা লাগতে তিনি অনেকটা ভয় পান। সেটা আমি তখনই বুঝেছি। কিন্ত কারণটা আমি আজ সকালে বুঝলাম।’
বালিশের তল থেকে একটা কাচের শিশি বের করে পরী। সেটা শায়েরের দিকে তুলে ধরে বলে,’মেজ কাকি কাল এটা ফেলে গিয়েছিল। আপনি খেয়াল না করলেও আমি করেছি। এটার মধ্যে একটা ওষুধ আছে,কিন্ত তা কিসের সেটা জানতাম না। তাই চামেলিকে দিয়ে উসমান ফকিরের কাছে পাঠিয়ে জানতে পারি সব। আমি যাতে মা না হতে পারি সেজন্য একটু একটু করে আমাকে খাইয়েছে চম্পা। আমি অনেক আগেই খেয়াল করেছি সব কাকিরা আমাকে নিয়ে কিছু বলেন। আমার ক্ষতি করতে চান। কিন্ত এসবে যে চম্পারও হাত আছে তা জানতাম না। ফুপু যখন এলো আমি কিছুটা আন্দাজ করেছি তিনি কি বলতে এসেছেন।’
-‘কেয়ামত হলেও আমি আপনার হাত ছাড়বো না পরীজান। কিন্ত তার আগে চম্পাকে ওর কাজের হিসাব দিতে হবে।’
শায়ের উঠতে নিলে পরী হাত ধরে থামিয়ে দেয় বলে,’হিসেব টা আমি নিজেই নেবো মালি সাহেব। পরীর কাজ পরীকে করতে দিন। আরেকটা কথা শুনে রাখুন। বিশ্বাস ঘাতকের বুকে ছুরি চালাতে আমার বুক কাঁপবে না। আপনি চেয়েও আমার থেকে দূরে যেতে পারবেন না। আপনাকে আমার হয়ে থাকতে হবে ইহকাল এবং পরকাল। ভালোবাসা সহজ নয়।’
-‘সত্যিকারের ভালোবাসাকে কোন ঝড় আলাদা করতে পারেনা পরীজান। দেহ আলাদা করলেও মনকে আলাদা করা যাবে না। আমি আপনার সব বিপদের ঢাল হয়ে দাঁড়াবো কথা দিলাম। বিপদকে আপনাকে ছোঁয়ার আগে আমাকে ছুঁতে হবে।’
হুট করেই জড়িয়ে ধরে শায়ের কে। শায়ের নিজেও বক্ষে ঠাই দিলো পরীকে। পরীর এতো বড় ক্ষতি হয়ে গেল অথচ পরী শান্ত। ভিশন শান্ত,এরমানে পরী ভয়ানক কিছু করবে। শায়ের পরীকে আজ একা ছাড়লো না। কাজে না গিয়ে পরীর কাছেই থেকে গেল। কিন্ত দুপুরের পর পরীকে ফেলে যেতে হলো। ইলিয়াস লোক পাঠিয়েছিল। জরুরি তলবে শায়ের কে যেতেই হলো।
পরী তখন ঘরে একা। সারাদিন কোন কথা সে মুখ থেকে বের করেনি। এমনকি শায়েরের সাথেও কথা বলেনি। রাগটা একটু কমে এলেও বিকেলে তা দ্বিগুণ বাড়লো। চামেলি চম্পা দুজনেই এসেছে। এবারও খালি হাতে আসেনি ওরা। পায়েশ হাতে চামেলির। পরী বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। পায়েশের বাটিটি হাতে নিয়ে চম্পার দিকে তাকিয়ে বলল,’আমাকে তো অনেক খাইয়েছো চম্পা আজকে তুমি একটু খাও।’
চম্পার ভয় লাগলো একটু। সে চামেলির দিকে তাকালো। চামেলি বোকাসোকা হলেও আজ সে পরীর পক্ষে। পরীর এতোই ভক্ত সে, যে পরী যা বলবে সে তাই করবে। তবে পুরো বিষয়টা চামেলি নিজেও জানে না। পরী এগিয়ে গেলো চম্পার দিকে বলল,’একটু খাও চম্পা!!’
-‘না ভাবি,আপনের লাইগা আনছি আপনে খান।’
-‘আমার জন্য এতো দরদ কেন তোমাদের? এতো খাওয়াচ্ছো কেন আমাকে? কি মিশিয়েছো পায়েশে?’
চম্পা ঘামতে শুরু করেছে। পরী জানলো কিভাবে?পরী চম্পার গাল চেপে ধরে বাটি সুদ্ধ মুখে ঢেলে দিলো চম্পার। চম্পা পরীর থেকে ছিটকে সরে গেলো। দৌড়ে বাইরে এসে সঙ্গে সঙ্গেই বমি করে দিলো। পরী নিজেও বাইরে চলে এসেছে। চম্পা পিছনে ফিরতেই একহাতে গলা টিপে ধরে চম্পার। পরীর শক্ত হাতের বাঁধন শত চেষ্টা করেও পরীর থেকে ছাড়াতে পারলো না। পরীর চোখে রাগ দেখে ভিশন ভয় পাচ্ছে চম্পা। হিংস্র মানবীর ন্যায় চোখ দিয়ে ভষ্ম করে দিচ্ছে চম্পাকে।
-‘আমার হিংস্রতা দেখোনি তুমি চম্পা। আজ দেখবে, এই হাতে অনেক পুরুষদের কাবু করেছি। আর তুমি তো একজন নারী মাত্র।’
চম্পা মুখ দিয়ে কথা বের করতে পারলো না। শ্বাস আটকে আসছে ওর। চোখে ঝাপসা দেখছে। সে হাত নাড়িয়ে চামেলিকে বলছে তাকে বাঁচাতে কিন্ত চামেলি নিজেই ভয় পেয়েছে। হঠাত করে পরীর হলো কি তা সে নিজেও জানে না। পরী আবারো বলল, ‘আমার স্বামী একান্তই আমার। তুমি কি ভেবেছো বাচ্চা জন্ম না দিতে পারলে আমি তার সাথে তোমার বিয়ে দেবো? এতোই সহজ? আমার স্বামী আমার ভালোবাসা। কষ্ট পেলে দুজনে একসাথে পাবো আর হাসলে একসাথে হাসবো। আমাদের দেহ আলাদা হলেও আত্মা কিন্ত এক। পারলে আমাদের আলাদা করে দেখাও।’
ঝটকা মেরে চম্পাকে ফেলে দিলো পরী। মাটিতে শুয়ে কাশতে লাগল সে। চামেলি দ্রুত বোনকে ধরে ওঠায় বলে,’কি হইছে ভাবি? তুমি এমন করতাছো ক্যান? আপা কি করছে?’
-‘তুমি বুঝবে না। কিন্ত এটা জেনে রাখো তোমার মা এবং বোন জঘন্য অপরাধ করেছে।’
পরী নিজের ঘরে চলে গেল। যতক্ষণ চম্পার সামনে থাকবে ততক্ষণ ও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। চামেলি তার বোনকে ঘরে নিয়ে গেল। এবং সাথে সাথেই সব বলে দিলো। হেরোনা কিছুটা বিচলিত হলেও তেমনভাবে নিলেননা বিষয়টা। পরী আর কিইবা করতে পারবে। আর সেহরান তো তার সাথে কথাই বলে না। তবুও রাতে তিনি দুই জা কে ঘরে ডাকলেন গভীর পরামর্শ করতে। হেরোনা বললেন, ‘সেহরান তো সব জাইনা গেলো। এহন তো সবদিক গেলো। কি করি এহন?’
ছোট জা কনক বললেন,’ভাবি আমি কই বাদ দেন এইসব। ওই জমি আমরা পামু না।’
কনককে ধমক দিলেন হেরোনা,’তুই চুপ থাক। এতোদিন জমি আমরা খাইলাম অহন তো আমাগো হইয়া গেছে। আমরা দিমু না জমি। তোর ভাইয়ের লগে এই নিয়া কথা কইতে হইবো। কোন ঝামেলায় পড়লাম রে।’
দরজার ঠকঠক আওয়াজে চম্পা গিয়ে দরজা খুলে দিলো। কিন্ত সে অবাক হলো পরীকে এসময় দেখে। শান্ত চোখে চম্পাকে দেখে নিলো পরী। আজ যেন পরীকে ভয়ানক সুন্দর লাগছে পরীকে। লাল শাড়িতে পরীর মতো লাগছে। স্মিত হাসলো পরী। পরীর সবকিছুই আজকে ভয়ানক মনে হচ্ছে চম্পার কাছে।
পরী বলল,’ভেতরের আসতে দিবে না?’
চম্পা দ্রুত দরজা হতে সরে দাঁড়ালো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে দরজাটা আটকে দিলো পরী। হেরোনা বলল,’দরজা আটকাও ক্যান তুমি?’
জবাব না দিয়ে পরী চম্পাকে বলে,’আমাকে বসতে দাও। সবকথা দাঁড়িয়ে বলবো নাকি?’
জলচৌকি এনে বসতে দিলো পরীকে। পরী শান্ত স্বরেই বলল,’আমাকে ওই ওষুধ খাওয়ানোর পিছনের কারণটা কি শুধুই চম্পা নাকি আরো অন্য কারণ আছে?’
কথাটা বলে হেরোনার চোখে চোখ রাখে পরী। হেরোনা জবাব দিল,’তোমারে এতো কথা কমু না। ঘরে যাও। রূপ দিয়া সেহরান রে বশ করলেও আমাগো পারবা না।’
পরী হাসলো বলল,’নারীর রূপে পুরুষ বশ হয় আর নারীরা ঈর্ষান্বিত হয়। আমি সত্য জানতে চাই বলে ফেলুন। নাহলে,,,’
-‘এই মাইয়া কি করবা তুমি? মারবা নাকি? সাহস তো কম না।’
পরী সোজা হয়ে বসে। তারপর বলে,’আমি যখন খুন করি তখন আমার বয়স তেরো বছর। তাহলে ভেবে দেখুন তের বছরে একটা খুন করেছি আর এখন চারটা খুন করার সাহস আছে আমার মধ্যে।’
হেরোনা নড়েচড়ে বসলো। পরী কি সত্যি বলছে নাকি ভয় দেখাচ্ছে। অতটুকু মেয়ে মানুষ মারবে কীভাবে? সে বলে,’মশকরা করতাছো আমাগো লগে?’
-‘আমি কি আপনার বেয়াই লাগি যে মজা করবো। এই হাতে দা তুলে নিয়েছিলাম সেদিন। শুয়ো*র বাচ্চাটার ঘাড়ে এক কোপ মারতেই সে শেষ। ওর রক্তে ভিজেছি সেদিন।’
পরীর কথা শেষ করার আগেই বজ্রপাতের শব্দ এলো। পরী বাদে কেঁপে উঠল সবাই। বিকাল থেকেই আকাশে মেঘ ছিলো। এখন হয়তো বৃষ্টি হবে। সেই আভাস দিচ্ছে প্রকৃতি। পরী আবারো বলতে লাগল, ‘তবে আমার সবচেয়ে খারাপ লেগেছিল কেন জানেন? ওর ঘাড় থেকে মাথাটা আলাদা করতে পারিনি বলে। মেজাজ টাই খারাপ হয়ে গেলো।’
পরীর কথাগুলো সবাইকে ভয় পাইয়ে দিলো। তবে কেউ কোন কথা বলল না দেখে পরী আবারও বলে, ‘আপনাদের এসব কেন বলছি তার কারণ জানতে চাইবেন না? কারণ হলো এবারের মতো আপনাদের ক্ষমা করলাম। কিন্ত পরের বার কিছু করার আগে নিজের ঘাড়ের কথা চিন্তা করবেন। এখন বাকি কারণটা কি ভালোভাবে বলবেন নাকি শ্বাসনালী চেপে ধরে কথা বের করতে হবে।’
কনক খুনখারাবি ভয় পায় খুব। পরীর কথাটা সে বিশ্বাস করে ফেলেছে সে। তাই সব সত্য গড়গড় করে বলে দেয়। হেরোনা চেয়েও আটকাতে পারে না। হেরোনা এখনও পরীর কথা পুরোপুরিই বিশ্বাস করতে পারেনি। কিন্ত চম্পার কেন জানি মনে হচ্ছে পরী সত্যি বলছে। পরী আজ যেভাবে ওর গলা চেপে ধরেছিল মনে হচ্ছে আজ সে মরেই যাবে। ওই হাতে নিশ্চিত কাউকে মেরেছে পরী। কনকের কথা শুনে পরী বলে,’এটুকু সম্পদের জন্য আপনারা একটা মেয়ের মাতৃত্ব কেড়ে নিলেন। বাহ খুব ভালো। এর থেকে আরো বেশি সম্পদ পাবেন আপনারা। আমি দেবো,তবে তার সাথে আমার মাতৃত্ব ফিরিয়ে দিতে পারবেন?’
ইতিমধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। সবাই চুপ করে আছে। শুধু বৃষ্টি পড়ার শো শো শব্দ ভাসছে চারিদিকে। পরী সবার দিকে তাকিয়ে আছে। এবার সে দরজার শব্দে সেদিকে তাকায়। দরজা খোলে চম্পা। বাইরে থেকে শায়েরের কন্ঠস্বর শোনা গেল,’ঘরে চলুন পরীজান।’
পরী কথা না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ঘরে যেতে যেতে অনেকটাই ভিজে গেল পরী। শায়ের আরও বেশি ভিজে গেছে। আড়ত থেকে ফিরতে ফিরতে ভিজে জুবুথুবু সে। পরীকে ঘরে না দেখে শায়ের বুঝে গেছে সে কোথায় থাকতে পারে। ঘরে
আসতেই শায়ের বলল,’আপনি ওই ঘরে কেন গিয়েছিলেন? আর কখনোই যাবেন না।’
পরী কথা বলল না। চুপচাপ গামছা এনে শায়েরের মাথা মুছতে লাগল সে। শায়ের নিজেও চুপ রইল। একটু পরে বলে উঠল,’আপনি কাকে খুন করেছেন পরীজান?’
-‘আপনি সব শুনেছেন দেখছি।’
-‘এটা বলবেন না যে আপনি ভয় দেখানোর জন্য বলেছেন। আমি আপনার কথাতে বুঝেছি আপনি সত্য বলছেন।’
প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে পরী। বলে,’সুরমা পড়লে আপনাকে এতো ভালো লাগে কেন মালি সাহেব?? আপনার সব সৌন্দর্য কেন ওই চোখে ঢেলে দিয়েছেন বিধাতা? আমার যে নেশা ধরে যায়।’
-‘আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি।’
-‘আমাকে আজ ভালোবাসা দিবেন মালি সাহেব!! আগের থেকে আরো বেশি ভালোবাসা চাই আমার।’
পরীকে কেমন যেন উন্মাদ মনে হচ্ছে শায়েরের। আজকের ঘটনাটা ওকে কেমন যেন ঘোরে ফেলে দিয়েছে। শায়ের বলল,’আপনার কি হয়েছে পরীজান? শরীর খারাপ করেছে?’
-‘আপনার ভালোবাসার অসুখ আজীবন থাকবে আমার। আমাকে সুস্থ করতে কোনদিন পারবেন না আপনি।’
কথা শেষ করতেই শায়েরের বুকে ঢলে পড়ে পরী। শায়ের পরীকে কোলে তুলে নিলো সাথে সাথেই। এইবার সে খেয়াল করলো পরীর সম্পূর্ণ চুল ভেজা। শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।
#পরীজান
#পর্ব ৩৮
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
সন্ধ্যাবেলা কলপাড়ে গিয়ে ইচ্ছামতো ভিজেছে পরী।
মাতৃত্ব হারিয়ে ফেলেছে সে,এটা কিছুতেই মানতে পারছে না। আর কি কখনো মা হওয়া সম্ভব কি পরীর পক্ষে??বেশি ভেজার কারণে শরীরে জ্বর নেমে এসেছে। তারপর আজকের ঘটনা পরীর মস্তিষ্কে বেশ গভীর ভাবে আঘাত করেছে। যার জন্য উল্টাপাল্টা বকছে। পরীকে পালঙ্কে শুইয়ে দিয়ে কাথা টেনে দিলো শায়ের। সে নিজে উঠতে গেলে পরী হাতটা টেনে ধরে। হারিকেনের টিমটিম আলোতে শায়ের খেয়াল করে অস্থিরচিত্ত নয়নে তাকিয়ে আছে পরী। জ্বরে ফর্সা মুখখানা রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। অসম্ভব ভাবে কাঁপছে ঠোঁট দুটো। পরী কম্পিত কন্ঠে বলে,’আপনার সব ভালোবাসা আমাকে দিন না মালি সাহেব যাতে আপনার কাছ থেকে আর কেউ ভালোবাসা না চায়। সবাই যেন খালি হাতে ফিরে যায়। আপনার সব ভালোবাসা শুধু আমার কাছে থাকবে।’
পরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো শায়ের বলল, ‘আপনার শরীরে জ্বর এসেছে পরীজান। আপনি একটু চুপ করে শুয়ে থাকুন।’
পরী হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলে,’নাহ আমি ঠিক আছি।’
-‘কেন পাগলামি করছেন? আমি কখনোই আপনাকে ছেড়ে যাবো না। একটু শান্ত হন।’
-‘আপনাকে ছেড়ে যেতে কখনো দিলে তো যাবেন।’
শায়ের পরীর থেকে হাত ছাড়িয়ে পরনের ভেজা পাঞ্জাবিটা খুলে ফেলে। ভেজা পোশাক বদলে আবার পরীর পাশে এসে বসে। পরীর কপালে হাত রেখে দেখে জ্বর ক্রমাগত বেড়ে চলছে। শায়ের জলপট্টি দিতে চাইলে পরী বারণ করলো। পরীর বারণ উপেক্ষা করতে শায়ের পারলো না। পরী জেদ ধরে বসে আছে। শায়ের পড়লো বিপাকে। পরী উঠে বসে জড়িয়ে ধরে শায়ের কে। উত্তাপে কেঁপে উঠল শায়ের,’আপনি ভিজেছেন কেন পরীজান? এখন তো কষ্ট পাচ্ছেন।’
-‘আপনি পাশে থাকলে আমার কোন কষ্ট হবে না। বহু কষ্ট পার করে আপনার কাছে সুখের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছি। আমার আর কষ্ট হবে না।’
-‘আমার কাছেই তো আপনার সব কষ্ট। আপনার মতো চাঁদের গায়ে আমার মতো কলঙ্ক মানায় না পরীজান।’
-‘আকাশের চাঁদের গায়ে যে কলঙ্ক আছে তা চাঁদের সৌন্দর্য বহন করে। তেমনি আপনিও আমার কলঙ্ক এই কলঙ্ক ছাড়া আমার অস্তিত্ব নেই।’
বৃষ্টির তোড় বাড়ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে,মেঘের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। পরীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে শায়ের। পরী ঘুমায়নি,সে শায়ের কে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে আর শায়ের উত্তর দিচ্ছে। শায়ের বুঝতে পারছে পরী কেন এরকম করছে। সে মা হতে পারবে না কখনো। কষ্ট তো হবেই। নিজের কাছের মানুষ যে এমন বিশ্বাস ঘাতকতা করবে তা শায়ের ভাবেনি। সে তো ওদের কোন ক্ষতি করেনি তাহলে তারা কেন এরকম করলো। পরীকে অনেক মেহনত করে ঘুম পাড়াতে হলো। পরীর জ্বর নামা না পর্যন্ত শায়ের জেগে ছিলো। জলপট্টি দিয়েছিল।
সকাল হলো,কিন্ত বৃষ্টি কমলো না। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি নামতেছিল। বৃষ্টি মাথায় শায়ের কোথায় যেন বেড়িয়ে গেলো। ফিরলো ঘন্টা দুয়েক পর। হাতে তার কিছু কাগজপত্র। পরী চুপচাপ শায়েরের কাজ দেখতে লাগলো। সবকিছু ঠিকঠাক করে বের হতে নিলে পরী জিজ্ঞেস করে,’আবার কোথায় যাচ্ছেন? আর ওসব কিসের কাগজ??’
শায়েরের মনে হলো এবার পরীকে সব জানানো উচিত। সে পরীর কাছে এসে বসে বলে,’আমার ভাগের যেটুকু জমি আছে তার দলিল এগুলো। আমি সব ওদের দিয়ে দিবো। বিনিময়ে আমি আপনাকে নিয়ে একটু শান্তিতে থাকতে চাই।’
পরী কথা বলল না। শুধু শায়েরের দিকে তাকিয়ে রইল। শায়ের পরীর গালে হাত রেখে বলল,’নিজের সাধ্যের মধ্যে রাণীর মতো করে রাখবো আপনাকে। রাজা হতে পারবো না কখনো তবে কোন রাজার সাধ্য নেই আমার মতো হওয়ার। আমার মতো করে আপনাকে কেউ আগলে রাখতে পারবে না পরীজান।’
শায়েরের হাতে হাত রাখে পরী। স্মিত হেসে বলে, ‘আপনার মনের রাজ্যের রাণী হতে পারলেই হবে। আপনি সব দিয়ে দিন ওদের। আপনার ভালোবাসাতেই বেঁচে থাকতে পারবো।’
পরীর সম্মতি পেয়ে শায়ের ছুটলো হেরোনার ঘরের দিকে। চম্পা তখন মন খারাপ করে বসেছিল। শায়ের কে আসতে দেখেই সে উঠে দাঁড়াল। শায়ের বলল, ‘তোর মা কোথায়??’
চম্পার গলা দিয়ে কথা বেরোলো না। গলাতেই সব কথা আটকে গেল। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে হেরোনা এলো। শায়ের দলিলটা হেরোনার হাতে দিয়ে বলে,’এই নিন আপনাদের জমি। এটুকু সম্পদের জন্য আমার সবকিছু তো কেড়ে নিলেন। এবার আশা করি শান্তিতে থাকবেন। আপনাদের কারো ছায়া যেন আমার পরীজানের উপর না পড়ে। আমার ধৈর্যের বাধ ভাঙ্গার সময় কিন্ত এসে পড়েছে। তাই সাবধান।’
ঘর থেকে বের হওয়ার আগে শায়ের চম্পাকে উদ্দেশ্য করে বলে,’যে মানুষ টা তোকে এতো কাছে টানলো তার এতোবড় ক্ষতি করতে তোর বুক কাঁপলো না? তোর মুখ যেন দ্বিতীয়বার আমি না দেখি।’
শায়ের চলে গেল। চম্পা কাঁদতে লাগল মাটিতে বসে। হেরোনার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল,’তোমার সম্পদ তো তুমি পাইছো মা। আমি ক্যান আমার সম্পদ খোয়াইলাম? তুমি পারলা না আমার সম্পদ আইনা দিতে।’
হেরোনার মুখ গম্ভীর দেখলেও সে মনে মনে ভিশন খুশি। শায়ের যে ওকে সব দিয়ে গেছে। তিনি এও ভাবলেন এবার চম্পাকে বড় ঘরে বিয়ে দেবেন। তাহলেই ওনার ষোলকলা পূর্ণ হবে।
দিন মাস পেরিয়ে বছর ঘোরে। পরী মন খারাপ করে বসে থাকে বাড়ির জন্য। কিন্ত সময়ের অভাবে শায়ের পারে না পরীকে নিয়ে যেতে। কিন্ত তার ভালোবাসার কোন কমতি রাখেনি শায়ের। পরী কখনো প্রশ্ন করতে পারেনি শায়ের কে। জিজ্ঞেস করতে পারেনি শায়ের তাকে ঠিক কতখানি ভালোবাসে। তার প্রমাণ সে পদে পদে পেয়েছে। শায়েরের ছোট ঘরটাকে রাজপ্রাসাদ মনে হয় পরীর। সারাদিন রাত ঘরে বসে কাটে ওর। সেদিনের পর থেকে পরী সম্পূর্ণ একা থাকে। চম্পা তো আসেনা, এমনকি চামেলিকেও আসতে মানা করেছে। কেননা চামেলি সহজ সরল মানুষ। কখন কি বুঝিয়ে পাঠাবে কে জানে? তবে মাঝেমধ্যে চামেলি উঠোনের দরজা খুলে উঁকি দিয়ে দুয়েক কথা বলে। আবার চলে যায়।
এমনই একদিন চামেলি এসে বলল,’ভাবি আপার বিয়া ঠিক হইছে।’
-‘তাই নাকি? কোথায়?’
-‘পাশের গেরামের সুজনের লগে। মায় কইলো এই শুক্রবার বিয়া।’
পরী কথা বলল না। একটু চুপ থেকে চামেলি আবার বলে,’আমার ভালো লাগে না ভাবি। তুমি তো আইবা না বিয়াতে। আমি একলা একলা কি যে করমু?’
-‘কিছু করার নেই চামেলি। তোমার ভাই চায় না আর আমিও চাই না।’
-‘আপা আর মা একটুও ভালা না ভাবি।’
শায়ের আসার সময় হয়ে গেছে। তাই পরী বলল, ‘তুমি এখন যাও চামেলি। তোমার ভাই এখুনি চলে আসবে। তোমাকে দেখলে বকবে।’
চামেলি মন খারাপ করে প্রস্থান করলো। পরীও নিজের কাজে চলে গেল। সবকিছু জানার পর খুসিনাও তার ভাইয়ের বউদের সাথে কথা বলে না। তিনি পরীকে নিয়ে ছোটেন নানা ফকিরের কাছে। মাতৃত্বের স্বাদের জন্য পরী নিজেও যায়। কিন্ত কোন লাভ হয় না। কত ওষুধ খেয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। দিন শেষে পরী হতাশই হয়েছে। তবুও আল্লাহর উপর ভরসা রাখছে।
শায়ের ফিরলে ওর মন খারাপ কখনোই তাকে বুঝতে দেয়নি। পরী জানে ওর হাসি মুখ দেখলে শায়েরের সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।
চম্পার বিয়েতে শায়ের কে দাওয়াত করে যায় আকবর। কিন্ত সাথেই সাথেই তা প্রত্যাখ্যান করে শায়ের। আকবর কিছু বলার সুযোগ ও পেলো না। শায়ের সে সুযোগ কখনো দেবে না। পরী নিজেই শায়ের কে বলে,’ফিরিয়ে না দিলেই পারতেন। নিজের লোকই তো। অন্তত বিয়েতে নাহয় থাকুন।’
-‘আমি শুধু আপনার সাথে বাকি জীবনটুকু কাটাতে চাই। এছাড়া অন্য কাউকে আমাদের মাঝে আনতে চাই না। ওদের ক্ষমা করলেও আমার ক্ষোভ কিন্ত যায়নি। আপনি ওদের হয়ে কিছু বলতে আসবেন না।’
আর কোন বাক্য পরী উচ্চারণ করে না। সে শায়ের কে যতটা চায় তার চেয়েও গভীর ভাবে শায়ের পরীকে চায়। এভাবেই দুজনের ছোট্ট সংসারে সময় কেটে যাচ্ছে খুব।
চম্পার বিয়ের আগের দিন খুসিনাকে ধরেবেধে সবাই নিয়ে গেল। যতই হোক তার তো যাওয়া উচিত। একমাত্র ফুপু বলে কথা। শায়ের নিজেই খুসিনাকে যেতে বলেছে।
শায়ের তাই সন্ধ্যা হতেই বাড়িতে এসে পড়েছে। নাহলে পরী একা হয়ে যাবে। হঠাৎই চম্পা ছুটে আসে এবং ঝাপটে ধরে শায়ের কে। আকস্মিক ঘটনাতে শায়ের নিজেকে ছাড়ানোর বদলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। চম্পা কাঁদতে কাঁদতে বলে,’মাফ করো সেহরান ভাই। আমি মা’র কথায় সব করছি। আমি তো ইচ্ছা কইরা কিছু করি নাই। আমিতো তোমারে চাই। এমনে ছাইড়া দিও না। আমি বিয়া করতে চাই না। মইরা যামু আমি।’
হাতে টান লাগতেই ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় সে। পরী এক ঝটকায় চম্পাকে শায়েরের থেকে ছাড়িয়ে আনে। ক্রোধ নিয়ে তাকিয়ে বলে,’তোমার মুখটা আমি দেখতে চাই না চম্পা। আমার স্বামীকে ছোঁয়ার সাহস দ্বিতীয়বার দেখিও না। আমি কিন্ত অতো ভালো মেয়ে না। যে বারবার তোমার অপরাধ ক্ষমা করে দেবো।’
চম্পাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে পরী ওকে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিলো। শায়ের চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। সে চম্পাকে কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্ত তার কথাটা পরীই বলে দিয়েছে। পরী যে একা কতো লড়াই করছে তা ধারণার বাইরে।
চম্পার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত শায়ের আর বাড়িতে আসলো না।
তবে বিকেলে একটা চিঠি এসেছে শায়েরের নামে। চামেলি খামটা এসে পরীকে দিয়ে যায়। চিঠিটা ওলট পালট করে দেখে পরী। চিঠির উপরে দেওয়া ঠিকানা দেখে সে। নূরনগর থেকে এসেছে চিঠিটা। পরী একবার ভাবল খুলে দেখবে। যেহেতু চিঠিটা শায়েরের নামে তাই অন্যের চিঠি খোলা ঠিক নয় ভেবে পরী খুলল না।
রাতে শায়ের ফিরতেই চিঠিটা দিলো পরী এবং বলল,’নূরনগর থেকে আপনাকে কে চিঠি পাঠিয়েছে? নামটা লেখেনি। খুলে দেখুন তো?’
শায়ের চিঠিটা হাতে নিয়ে আবার রেখে দিলো বলল,’এখন পড়তে ইচ্ছা করছে না। পড়ে পড়বো।’
পরী ভাবলো শায়ের ক্লান্ত। তাই চিঠিটা আগের স্থানে রেখে দিলো। তবে শায়ের কে বিচলিত দেখাচ্ছে খুব। কোন ঝামেলা হয়েছে? রাতে তেমন ঘুম হলো না পরীর। ভয়ানক একটা স্বপ্ন দেখে জেগে উঠল সে।
#পরীজান
#পর্ব ৩৯
#Ishita_Rahman_Sanjida(Simran)
❌কপি করা নিষিদ্ধ ❌
গ্লাসের সবটুকু পানি খেয়ে ক্ষ্যান্ত হলো পরী। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে শায়েরের দিকে তাকালো। একটু আগেই সে স্বপ্নে দেখেছে কয়েক জন কালো মুখোশধারী লোক তার কাছ থেকে শায়ের কে টেনে হিঁচড়ে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। তারপর ওর হাত পা বেঁধে রেখেছে। একজন হাতে করে ধারালো অস্ত্র নিয়ে এসে যেই না শায়েরের গলায় বসাতে যাবে ঠিক তখনই ঘুম ভাঙে পরীর। সে ঘামছে খুব,এমন বাজে স্বপ্ন সে কখনোই দেখেনি। শায়ের যাতে টের না পায় তাই সে আবার শুয়ে পড়ল। শক্ত করে শায়ের কে জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে বলল,’আপনাকে কখনো হারাতে দেবো না। আমাকে বিলীন করে হলেও আপনার অস্তিত্ব আমি টিকিয়ে রাখবো।’
সে রাতখানা আর ঘুমাতে পারল না পরী। শায়ের কে জড়িয়ে ধরেই শুয়ে রইল। ভোর বেলাতে ঘুমালো পরী। ততক্ষণে শায়ের উঠে পড়েছে। পরীকে ঘুমাতে দেখে সে আর ডাকলো না। ফুপুকেও ডাকতে মানা করে দিলো।
পরী ঘুম থেকে উঠে শায়ের কে পেলো না। সে বুঝলো তার স্বামী নিজ কাজে চলে গেছে। শায়ের জানে পরী প্রায় রাতই নির্ঘুমে কাটায়। তার কারণ পরীর বিষন্নতা। পরী আজও তার মাতৃত্ব নিয়ে মন খারাপ করে। রাতে ঘুম হয় না তার। এজন্য প্রায়শই দেরিতে ঘুম ভাঙে পরীর। তাই শায়ের ওকে বিরক্ত করে না।
রাতের স্বপ্ন টা পরীকে বেশ ভাবায়। কিন্ত পরমুহূর্তে যখন শায়েরের সান্নিধ্য পায় তখন সব ভুলে যায়। পরী শায়েরকে চিঠির কথা জিজ্ঞেস করতে সে বলে নূরনগরে ওর একজন বন্ধু আছে। ওর মা অসুস্থ তাই টাকা চেয়ে চিঠি লিখেছে। সেজন্য শায়ের কে টাকা নিয়ে নূরনগরে যেতে হবে। পরী বলে সেও যাবে কিন্ত শায়ের রাজি হয়না। তার আড়তে কাজ আছে। তাই সে একদিনের ছুটি নিয়ে সেখানে গিয়ে টাকা দিয়ে আবার চলে আসবে। এবং পরে বেশ কিছুদিন ছুটি নিয়ে পরীকে ওর গ্রামে বেড়াতে নিয়ে যাবে। পরী তাতেই রাজি হলো।
তারপর কেটে গেলে কয়েক মাস। শায়ের ছুটির জন্য চেষ্টা করেও ইলিয়াসের থেকে ছুটি পেলো না। পরী নিজেও অপেক্ষা করে ছুটির জন্য। ঈদ ছাড়া শায়ের বোধহয় আর ছুটি পাবেনা তাই পরীর অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
এমনি একদিন দুপুর বেলা,শায়ের দুপুরের খাবার খেয়ে বেড়িয়ে গেছে। পরী উঠোনের কোণে বসেছিল। হঠাৎই সে থমকে গেল পরিচিত একটা মুখ দেখে। ‘জুম্মান’ বলে সে দৌড়ে গেলো তার কাছে। খুশি হয়ে বলে,’জুম্মান কেমন আছিস? আমি খুব খুশি হয়েছি তোকে দেখে।’
জুম্মানের হাবভাব দেখে পরীর ভালো লাগলো না। কেমন ফ্যাকাশে হয়ে আছে মুখটা। পরী জিজ্ঞেস করল,’কি হয়েছে জুম্মান? সব ঠিকঠাক আছে তো? বাড়ির সবাই ভাল আছে?’
থমথমে গলায় জুম্মান বলে,’বড় আম্মার অসুখ করছে আপা। ডাক্তার কইছে বাঁচবো না। তোমারে নিয়া যাইতে কইছে। তুমি যাইবা না?’
পরী মুহূর্তেই চুপ হয়ে গেলো। অবিশ্বাস্য লাগল জুম্মানের কথাগুলো। তবে পরমুহূর্তে মায়ের জন্য মনটা কেঁদে উঠল পরীর। চোখ থেকেও নোনাজল গড়িয়ে পড়ল। সে বলল,’কি হয়েছে আম্মার? তুই এসব কি বলিস জুম্মান?’
-‘তোমারে দেখতে চাইছে আম্মা। আহো আমার লগে।’
-‘তুই একা এসেছিস?’
-‘নাহ আব্বা গাড়ি আর লোক পাঠাইছে। তুমি আহো তাড়াতাড়ি।’
-‘আমি যাবো জুম্মান। কিন্ত উনি আসুক একসাথে যাবো।’
-‘শায়ের ভাই পরে যাইবোনে। তুমি আগে আহো। বড় আম্মা মনে হয় আর বেশিক্ষণ বাঁচবো না। মরার আগে তোমারে দেখতে চায়।’
মায়ের মরার কথা শুনে পাগলপ্রায় পরী। তাছাড়া রাত ছাড়া শায়ের ফিরবে না। কাকে দিয়ে শায়ের কে খবর পাঠাবে তাও মাথায় আসছে না পরীর। তাই সে খুসিনা কে সবটা খুলে বলে। ফুপু পরীকে আশ্বস্ত করে। সে পরীকে জুম্মানের সাথে যেতে বলে। শায়ের আসলে সে নিজ দায়িত্বে শায়ের কে নূরনগর পাঠিয়ে দেবে। পরী কিছু না ভেবেই জুম্মানের সাথে নূরনগরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। সারা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে গেলো পরী। বারবার আল্লাহর কাছে মায়ের জন্য সময় ভিক্ষা চাইতে লাগল। পরী যাওয়া অবধি যেন মালা বেঁচে থাকে। চোখের জলে বুক ভাসাতে ভাসাতে পরী পৌঁছালো জমিদার বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নেমে সে দৌড়ে বাড়ির ভেতর চলে গেল।
বৈঠক পেরিয়ে মহিলা অন্দরে ঢুকতেই কুসুমের মূখোমুখি হলো সে। পরীকে দেখা মাত্রই কুসুমের হাতের থালাবাসন ঝমঝম শব্দে মেঝেতে পড়ে গেল। চোখের কোণে জল দেখা দিলো তার। কুসুম দৌড়ে পরীর কাছে এসে বলল,’পরী আপা আপনে এইহানে ক্যান আইছেন?’
পরী জবাব না দিয়ে বিচলিত হয়ে মালার ঘরের দিকে এগোলো। কুসুম ওর হাত টেনে ধরে বলে,’আপনে চইলা যান আপা। বাড়িতে অহন কেউ নাই। আপনে পলাইয়া যান তাড়াতাড়ি।’
পরী অবাক হলো কুসুমের কথা শুনে বলল,’কি যা তা বলছিস কুসুম? আম্মা অসুস্থ আমি দেখতে আসছি। আম্মা কোথায়? আম্মা আম্মা,,,’
জোর গলায় পরী মালাকে ডাকতে লাগল। রুপালি ঘর থেকে ছুটে এলো। পরীকে দেখে সে পরীর হাত চেপে ধরে বলল,’পরী তুই এখানে এসেছিস কেন?’
-‘তোমরা এমন করছো কেন আপা? আমি এসেছি তো কি হয়েছে? আম্মা অসুস্থ আমি আম্মাকে দেখতে এসেছি।’
রুপালি ধমকে বলল,’কে তোকে বলেছে আম্মা অসুস্থ?’
-‘জুম্মান গিয়েই তো আমাকে বলল। তারপর আমি জুম্মানের সাথে চলে এলাম।’
রুপালি ভয় পেয়ে গেলো। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল ওর। সে বলল,’তারমানে শায়ের তোর সাথে আসেনি। একা কেন এসেছিস তুই? এখন কি হবে?’
রুপালি ভিত চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ভয়ে রীতিমত কাঁপছে সে।
এমন সময় মালাকেও দেখা গেল। সে পরীর গলার আওয়াজ পেয়ে এসেছে। মালাকে দেখে পরী দ্রুত পদে তার কাছে গেলো। মালার দুই বাহু ধরে মালাকে দেখতে দেখতে বলল,’আম্মা আপনি ঠিক আছেন তো? আপনার কিছু হয়নি তো?’
রুপালির মতো মালাও কাঁদছে। সে পরীকে বলল, ‘তুই এখান থাইকা চইলা যা পরী। ওরা আহার আগে তাড়াতাড়ি যা।’
পরী আর পারছে না। সবাই কেন ওকে চলে যেতে
বলছে? মালাকে দেখে তো সুস্থ মনে হচ্ছে। তাহলে জুম্মান কেন ওকে মিথ্যা বলে আনলো? পরী চিৎকার করে বলল,’তোমরা সত্যিটা বলবে? কি হয়েছে? আম্মা যখন সুস্থ তাহলে জুম্মান মিথ্যা বলে আমাকে আনলো কেন? আর এখন আমাকে পালাতে বলছো কেন? এই বাড়িতে হচ্ছে কি?’
রুপালি পরীর হাত টেনে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে,’পরে শুনিস ওসব কথা। আগে নিজের জীবন বাঁচা। তুই এক কাজ কর ছাদে গিয়ে যেভাবে আগে বাড়ির বাইরে যেতিস সেভাবে চলে যা। বাইরে এখন অনেক কড়া পাহারা।’
রুপালি পরীর হাত টানতে লাগল। কিন্ত পরী এক পা ও নড়লো না। সে আজকে সব জেনেই ছাড়বে। সে বলে উঠল,’আমি যাবো না আপা। আগে তোমরা আমাকে সব বলো। নাহলে আমি কোথাও যাবো না।’
-‘বেশি কথা না বলে নিজের ঘরে যাও পরী।’
আফতাবের কন্ঠস্বর শুনে পিলে চমকে গেল সবার। শুধুমাত্র পরীই স্থির দাঁড়িয়ে রইল। কুসুম থালাবাসন উঠিয়ে চলে গেল। মালা আর রুপালি আগের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। পরী আফতাবের নিকটে গিয়ে বলে, ‘আমাকে বলুন কি হয়েছে? আম্মা তো সুস্থ আছে। তাহলে জুম্মান মিথ্যা বলল কেন? সব সত্যি আমি জানতে চাই?’
-‘তোমাকে সব বলা হবে। এবং আজ রাতেই সব জানতে পারবে তুমি। সব জানতে হলে এখন ঘরে যাও।’
পরী নিজ ঘরে গেলো না। আজ তার সব প্রশ্নের জবাব চাইই চাই। তাই সে কড়া গলায় বলল,’আমি কোথাও যাবো না। আমাকে বলুন কি হয়েছে?’
আফতাব এগিয়ে গেলো মালার দিকে। একহাতে গলা চেপে ধরে মালার বলে,’মেয়েকে থামা। শেষ সময়ে ওর এতো কথা সহ্য হচ্ছে না।
পরী বিষ্মিত নয়নে তাকালো নিজের জন্মদাতার দিকে! এ কোন রূপ দেখাচ্ছে আফতাব!!রুপালি দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে কাঁদতেছে। মালার শ্বাস আটকে আসছে। পরীর এতক্ষণে হুশ ফিরল। সে দৌড়ে গিয়ে নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিলো আফতাব কে। ছিটকে দূরে সরে যায় আফতাব। মালাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে,’আম্মা আপনি ঠিক আছেন তো?’
মালা ঘনঘন শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে মাথা নাড়লো। পরী আফতাবের দিকে তাকিয়ে বলে,’আপনার হয়েছে কি আব্বা? আম্মার গায়ে হাত তুলছেন কেন?’
আফতাব কথা বলে না। পরীর সাথে এখন তিনি পেরে উঠবেন না তাই তিনি অন্দর ত্যাগ করলেন। আফতাব যেতেই রুপালি মালার কাছে এসে জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। আর বলতে লাগল,’কোন অভিশাপ লাগলো আম্মা? আমাদের জীবনটা এমন কেন হলো? সত্যি গুলো চোখের আড়ালে থাকলে কিই বা হতো আম্মা?’
রুপালি কাঁদছে আর পরী দেখছে। সে প্রশ্ন করতে করতে হাঁপিয়ে গেছে। তাই অবুঝ নয়নে মা আর বোনকে দেখছে সে। রুপালি হঠাৎ কান্নার বেগ কমিয়ে পরীকে বলে,’তুই না প্রশ্ন করেছিলি কি হয়েছে? সবচেয়ে সত্যি কথাটা আজ তোকে বলবো।’
পরীর চাহনিতে রুপালি চোখের পানি মুছলো তারপর বলল,’যে সুখান পাগল কে তুই চিনিস সে আর কেউ নয়,সে হচ্ছে রাখাল। পরী আমাদের সোনা আপার রাখাল।’
মালাকে আলতো করে ধরে বসেছিল পরী। রুপালির কথা শুনে শরীরের সম্পূর্ণ ভর ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল।
-‘সোনা আপা রাখালের সাথে পালাতে পারেনি পরী। আর না পেরেছে সংসার করতে। সোনা আপা তো রাস্তার ধারের কদম গাছের নিচে ঘুমিয়ে আছে পরী। আপার রাখাল ওকে এখনও পাহারা দিচ্ছে। আব্বা তার নিজের হাতে তার মেয়ের ভালোবাসা আর মেয়েকে কবর দিয়েছে।’
কথা বলার শক্তি পরী হারিয়ে ফেলেছে। ওর জানামতে সোনালী রাখালের সাথে দূর অজানায় চলে গেছে। কিন্ত সোনালীর গল্প টা যে এখনও নূরনগরের রয়ে গেছে তা আজ জানতে পারলো পরী। বারবার ওর চোখের সামনে সোনালীর হাসি মুখটা ভেসে উঠল। পরী সবচাইতে বেশি ভালোবেসেছিল সোনালীকে। তাই ওর মৃত্যুর খবর টা আঘাত হানছে পরীর বুকে। সে অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,’ওই কবরটা সোনা আপার!!আর সুখানই রাখাল!!’
রুপালি পরীর কথাটা শুনে মালাকে জড়িয়ে ধরে। মালাও একসাথে দুই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। তবে কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলে না। সন্ধ্যা নেমে এসেছে ততক্ষণে। তখনই অন্দরে ছয় সাত জনের মতো পুরুষ প্রবেশ করল। তাদের মধ্যে আফতাব ও আখির আছে। আফতাব কে দেখে মালা পরীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। চিৎকার করে বলে,’দোহাই লাগে আপনের। আমার পরীরে ছাইড়া দেন? ও আপনের কোন ক্ষতি করবো না। ওরে আমি শায়েরের কাছে পাঠাইয়া দিমু। ও কোনদিন এই গ্রামে আসবো না।’
-‘হুম তোর মেয়েকে ছেড়ে দেই আর ও আমাদের কে শেষ করুক? আমি কি আর ভুল করি?’
আফতাব হুকুম করলো পরীকে দড়ি দিয়ে বাঁধতে। পরী শুধু হতবিহ্বল হয়ে সব দেখতে লাগল। ওর নিজেরই পিতা ওকে মারার জন্য লোক এনেছে! কিন্ত ওর অপরাধ টা কি?? মালা শক্ত করে পরীকে ধরে আফতাবের কাছে অনুরোধ করছে। রুপালি বাবার পা ধরে মাফ চাইছে বারবার। দুজন লোক এগিয়ে এসে মালার থেকে পরীকে ছাড়িয়ে নিলো। তারপর হাতদুটো দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধলো। বাধা দিলো না পরী। সে একবার মালাকে দেখছে আরেকবার রুপালিকে ও আফতাব কে। লোকটা টেনে তুলল পরীকে। পরী এবার বাধা দিলো বলল, ‘আমাকে টেনে নিয়ে যেতে হবে না। আমি নিজেই যাচ্ছি।’
পরী মালার সামনে গিয়ে বলে,’কাঁদবেন না আম্মা। জানিনা কোন কারণে আপনার স্বামী আমাকে মারতে চাইছে? আজ তো সব উত্তর আমি পেয়ে যাবো। আমি আসি।’
যাওয়ার আগে পরী রুপালিকে ওর নেকাব টা নামিয়ে দিতে বলে। রুপালি তাই করে এবং জড়িয়ে ধরে পরীকে। লোকগুলো সময় না দিয়ে পরীকে নিয়ে গাড়িতে তোলে।
গাড়ি থেকে নামার পর পরী বুঝতে পারে এটা ওদের বাগান বাড়ি। বড় বড় পাঁচিল দেওয়া চারপাশে। বাইরেও কড়া পাহারা। ভেতরে সাধারণ কারো ঢোকা নিষেধ। পরী এও বুঝতে পারল যে আজ এই বাড়ির ভেতর থেকে ওর জীবিত ফেরা অসম্ভব। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ভেতরে পা রাখে পরী।
একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো পরীকে। তারপর একটা চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হলো। পরী চারিদিকে চোখ বুলায়। ঘরটাতে একটা লম্বা টেবিল আর কয়েকটা চেয়ার ব্যতীত আর কিছুই নেই। নিশ্চুপ রইল পরী।
লাঠির ঠকঠক শব্দে চোখ তুলে সামনে তাকালো পরী। নওশাদ কে সামনে দেখে অবাক হলো না। সব চাইতে অবাক হওয়ার কথা হলো ওর বাবা ওকে মারতে চায়। সেখানে নওশাদ কি? নওশাদ চেয়ার টেনে পরীর মুখোমুখি বসলো। হাতের লাঠিটা মেঝেতে রাখলো। তার পর পরীর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,’বাহ এখনও দেখছি মুখটা ঢেকে রেখেছো। রূপটা কি শুধু শায়ের কে দেখাবে? আমিও তো অপেক্ষা করছি। আমাকে একটু দেখাবে না? নাহ থাক,একটু পর আমি এমনিতেই দেখতে পাবো। তোমার লাশটা তো আমাকেই কবর দিতে হবে!!’
পরীকে চুপ থাকতে দেখে নওশাদ মাথা চুলকে বলল, ‘সাহসী পরী!! আজকে চুপ কেন? খুন করবে না? শশীল কে তো এক নিমিষেই শেষ করে দিলে। সাহস আছে তোমার। কিন্ত তোমার বড় বোন সোনালীর খুনিকে শাস্তি দেবে না? শুধু সোনালীর খুনি কেন? পালক আর বিন্দুর খুনিকে শাস্তি দেবে না?’
পরী সোজা হয়ে বসে। বলে,’পালক!!ডাক্তার আপা পানিতে ডুবে মরেনি?’
ঘর কাঁপিয়ে হাসে নওশাদ বলে,’তুমি কি বোকা পরী। কিছুই দেখছি জানো না। ঠিক আছে আমি সব বলছি। অন্তত মরার আগে তোমার সব জানার অধিকার আছে। পালকের কথা পরে বলি। আগে আসি বিন্দুর কথায়। বিন্দুর মৃত্যুর রহস্য কিছুটা তো জানা তোমার।’
পরী বসা থেকেই গর্জে ওঠে বলে,’কারা মেরেছে বিন্দুকে?’
-‘কারা নয় বলো কে মেরেছে? কে মেরেছে জানো!!
সম্পান মাঝি।’
-‘মিথ্যা কথা,সম্পান মাঝি আমার বিন্দুকে ভালোবাসতো। সেজন্য সে আত্মহত্যা করেছে।’
এবার নওশাদ আরো হাসতে লাগল যেন কোন কৌতুক বলেছে পরী। হাসি থামিয়ে সে বলে,’ওহ আচ্ছা!!সম্পান আত্মহত্যা করেছে বুঝি??’
#চলবে,,,
উপন্যাসের মোড় ঘুরবে এবার। সবার সব প্রশ্নের উত্তর এখন থেকে পেয়ে যাবেন।
#চলবে,,,
#চলবে,,,