পারবো না ছাড়তে তোকে পর্ব ১৪+১৫

পর্ব ১৪+১৫
পারবো না ছাড়তে তোকে
পর্ব-১৪
রোকসানা আক্তার

জেরিন আপুদের বাড়ির সামনে গাড়ি এসে থাকে।তারপর, জেরিন আপু,নিলয় ভাইয়া এবং আমি গাড়ি থেকে নামি।
জেরিন আপু ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠেন,
——ড্রাইভার চাচা,গাড়িটা পার্ক করা লাগবে না।আপনি গাড়ি নিয়ে“করিম উল্লাহ মার্কেটে” যান।মায়ের কেনাকাটা শেষ অলরেডি।
—–আচ্ছা,মামণি।
তারপর ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে গেইট দিয়ে বেরিয়ে যায়য়।
—–জেরিন,আন্টি কোথায় গেছেন??
—–মার্কেটে গিয়েছেন কিছু কেনাকাটার জন্যে।
—–ওহ,এমন সময় তোদের বাসায় আসলাম আন্টিও বাসায় নাই।
—–টেনশন নিস না।ড্রাইভার চাচা গেছে একটুপর মা চলে আসবে।আচ্ছা বাসায় চল এবার..
—-চল…
তারপর আমরা সদররে দিকে হাটা ধরি।বাড়িটির বর্ণনা যদি শুধু“সুন্দর” বলে সম্বোধন করি,তাহলে ভুল হবে।বাড়িটি অতুলনীয় সুন্দর।দেওয়ালের ফাঁকে ফাঁকে গ্লাস।আর এই গ্লাসের উপর সবুজ ঘাসের বিচরণ।সামনের সাইডটা এিকোণা আকৃতির,আর বেলকনির ছাদে ঝুলন্ত ফুলগাছের টব।বাড়িটির বামদিকে শুধুই ফুলের বাগান।রজনীগন্ধা,কৃষ্ণকলি,গাদা, শিউলি,বকুল ফুলে ফুলে ভরা।এই ফুলগুলোর উপর নানান প্রজাপতির আনাগোনা। আর ডানদিকে লতাফুল যুক্ত বড় বড় গাছে দোলনা লটকানো।সত্যি আকস্মিক একটা প্ল্যাস যেন কোনো স্বপ্নপুরী।

জেরিন আপু হাই তুলতে তুলতে বলেন,
—-আমাদের গরীবের বাড়িতে আসছিস।তোদের লাক্সারি বাড়ির মতো আমাদের বাড়িটা ওত সুন্দর নয়।
—-এসব কেমন কথা,জেরিন!!!
—-হিহিহিহি।গাদা একটা ফান করে বললাম।তাও বুঝিস না!
—-আচ্ছা ভাই,ক্লান্ত এখন।আগেতো বাসায় ঢুকি তারপর নাহয় কথা বলি??
—ওকে…
আমরা জেরিন আপুদের বাসার মধ্যে ঢুকি।পুরো বাড়িটার লে-আউট মাশাল্লাহ,ভালোভাবে সবটা পরখ করলে চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মতো।তবে,এই মুহূর্তে বাড়িটিতে লোকজন কম মনে হচ্ছে।ফাঁকা ফাঁকা অনুভূতি হতেই জেরিন আপুকে বলে উঠি,
—-আচ্ছা আপু,এ বাড়িতে তোমরা কে কে থাকো??
—- আমি,মা এবং আমার বড় ভাইয়া।বলতে গেলে সারাদিন আমি এবং মা-ই বাসায় থাকি।আর ভাইয়া ব্যাংকে,তাও বাসায় ফেরতে ফেরতে রাত ১১টায় বেঁজে যায়।বাসায় এসে ডিনার সেরেই ঘুম।সকালে রেডি হয়ে ব্যাংক।সময়টা উনার হাতেগোনা।
—-ওহহ।
—-যাইহোক,আসো তোমাদের রুমটা দেখিয়ে দিই।
তারপর আমরা জেরিন আপুকে অনুসরণ করে গেস্ট রুমে আসি।রুমটা দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার মতো।পুরো রুম জুড়ে ওয়াল প্রিন্ট। রুমের একসাইডে জীবন্ত একটি সবুজাভ গাছ মাটিরঘেরা টবে।গাছের পাতাগুলো সুগন্ধি সুভাসে ভরা।গাছ পেরিয়ে তার কিছুক্ষণ পর বড় বড় দু’সেট সোঁফা,আর টি-টেবিলের উপর সজ্জিত প্লাস্টিক কিছু ফুল।
তারপরই একটা বক্স খাট। খাটটির ডিজাইনও অনেক নিঁখুত।খাটটিট চারপাশ সারি সারি ডল সাঁজানো।।
—–কি ব্যাপার,জেরি?এত্ত ভালো রুম আমাদের দেওয়া কি প্রয়োজন ছিল??আমরাতো জাস্ট একটু আশ্রয়ের জন্যে এসছি।

উনার কথায় জেরিন আপু খিলখিল হেসে দেন।আর বলেন,
—-ইনসাল্ট করছিস নাতো??তোদের আভিজাত্যের তুলনায় আমাদেরটা সামান্য।আর আশ্রয়—সে কেমন কথা!!তোর মতো একটা ফ্রেন্ড আমার বাসায় যে আসছে এতেই তো আমি ধন্য।
—-হইছে রাখ এখন বকবকানি। আগে ফ্রেশ হওয়ার জন্যে কিছু দে।
জেরিন আপু আমাদের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবেন।তারপর আবার বলেন,
—-তোরা তো আসার সময় জামাকাপড় নিয়ে আসিস নি।আচ্ছা শোন??আজ সন্ধের পর আমরা মার্কেটে যাবো।
—-হু,সেটা তো পরে।এই ঘামভেঁজা জামাকাপড় নিয়ে আর দাড়িয়ে থাকতে পারতেছি না।
—ওকে,তোকে ভাইয়ার গাবাড়ি থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট দিচ্ছি এবং একটা ব্লু কালার গেন্জি দিচ্ছি।যেহেতু নিয়লের সাথে মিল রেখে আমি তোর নামটা নীল রেখেছি।
—-আচ্ছা বাবা একটা দিলেই হবে।
—আর ভাবী তোমাকে একটা টপস আর জিন্স দিচ্ছি।
টপস এবং জিন্সের কথায় শুনে আমি থতমত খেয়ে যাই।আমি হালচোখে একবার আপুর দিকে,একবার নিলয় ভাইয়ার দিকে তাকাই।নিলয় ভাইয়া আমার ভ্যাবাবেগ বুঝতে পেরে মুখে আলতো হাত রেখে মিটিমিটি হাসছেন।তারপর উনি বলেন,
—-আচ্ছা শোন,টপস এবং জিন্স লাগবে না।তুই পারলে একটা থ্রী-পিস দে।
—-দোস,আমিতো থ্রী-পিস পড়ি না তা তো তুই ভালো করেই জানিস।ভাবীর টপস,জিন্স পড়তে আপওি কোথায়..
—আসলে ও এসব পড়ে না।
আপু নিলয় ভাইয়ার কথায় আবার হট্রহাসি দেয়।
—-আচ্ছা,আচ্ছা বুঝলাম।লাজুক বউ তোর।হুমম এটাই ভালো।আই লাইক ইট….থ্রী-পিস তো নাই,তাহলে মায়ের একটা শাড়ি দিচ্ছি ভাবীকে।ওকে??
—-আচ্ছা দে।

জেরিন আপু চলে যায় ড্রেস আনতে।আমি আর দাঁড়িয়ে না থাকতে পেরে বিছানার উপর বসে পড়ি।নিলয় ভাইয়া আমার ক্লান্তিভাব দেখে বলেন,
—-এসি টা কি আরো বাড়িয়ে দিব মিথি?
—-না,না লাগবে না।
মুঁচকি হেসে আমার মাথায় হাত নেড়ে বেলকনির দিকে যান।
এরইমধ্যে জেরিন আপু জামাকাপড় নিয়ে আসেন।
—-ভাবী,এই শাড়ি পড়তে যদি অস্বস্তিকর বোধ লাগে তাহলে আমাকে বলবে।
—–আচ্ছা আপু।
—–এই যে নীল?বেলকনি পরে দেখিস আগে তোর ড্রেস নে।
নিলয় ভাইয়া মাথা ঘুরিয়ে মুখে হাসি টেনে বলেন,
—-আমিতো তোদের বেলকনি দেখছি না।তোদের এখানের পরিবেশটা দেখতেছি।
—-আচ্ছা,আচ্ছা পরে মনভরে দেখে নিস।।এই যে নে আমি গেলাম।

জেরিন আপু যাওয়ার পর নিলয় ভাইয়া দরজাটা অফ করে পেলেন।তারপর আমায় উদ্দেশ্য করে বলেন,
—-তুমি আগে বাথরুমে যাবা নাকি আমি যাবো??
—-আপনি যান।
—-তোমার অস্বস্তি বোধ লাগবে নাতো??
—নাহ,নাহ আমি ঠিক আছি।
—ওকে।।
ভাইয়া বাথরুমে ঢুকে পড়েন। বিছানা ছেড়ে আমিও বেলকনিতে গিয়ে নিলয় ভাইয়ার মতো পরিবেশটা দেখতে থাকি।মুখটা যখন রেলিং দিকে এগিয়ে দিই…আহা!!মৃদু মৃদু বাতাসের হিমেল হাওয়া পরশ মেখে যায়।এই পরিবেশে সারাক্ষণ মুখটা গুঁজে রাখলেও ধ্যান ভাঙ্গবে না,এতটাই নেশা।।
নিলয় ভাইয়া বেলকনিতে এসে আমার পাশে দাড়ান।বোধহয় উনার গোসল শেষ।আমার কোমরে আলতো স্পর্শ করে বলে উঠেন,
—-মিথি?যাও এবার গিয়ে গোসলটা সেরে আসো।
আমি প্রকৃতির মোহের উপরে আরেকটা মোহের প্রেমে পড়ি।দিশেহারা হয়ে চোখটা এখনো নিমজ্জে স্থীর।উনি আমার সাড়াশব্দ না পেয়ে কোমরে সুড়সুড়ি দিয়ে উঠেন।আমি “আউ” করে চিৎকার দিয়ে উঠি।ভালোভাবে তাকিয়ে দেখি এই অসভ্য ছেলেটা।
—-লজ্জ্বা-সরম নেই নাকি??
—বউকে সুড়সুড়ি দিতে এখানে আবার লজ্জ্বা-সরমের প্রশ্ন কেন!

আমি আর কিছু না বলে মুখব্যাঙ্গ করে জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ি।জেরিন আপু পিছলা একটা শাড়ি দেওয়াতে বার বার খুলে যাচ্ছে কুঁচিগুলো।তাছাড়া ভাঁজ হয়েও আসছে না।অনেকক্ষণ শাড়ি নিয়ে ঘাটাঘাটি করে রাগের মাথায় বাথরুম থেকে বাহিরে বেরিয়ে আসি।নিলয় ভাইয়া তা পরখ করে হামাগুড়ি দিয়ে বসেন।আমার নড়নচড়ন নাটক দেখো মুঁচকি হেসে তাকিয়ে থাকেন।
উনার চাহনির অসহ্যতা এবং এই শাড়ির অসভ্যতা মাথায় আরো বেশি রাগ ছটে বসে।মনচায় শাড়িটা একবারে খুলেই ফেলি।দাৎৎ…
ভাইয়া আমার মুখের অবয়ব বুঝতে পেরে আস্তে আস্তে পা ফেলে আমার দিকে আসেন।আর দেয়াল আয়নার সামনে আমায় ঘুরিয়ে শাড়ির আঁচল স্পর্শ করেন।আমি লজ্জ্বায় কাবু হয়ে চোখবুঁজে থাকি।উনি আলতোহাতে কুঁচিগুলো ভাঁজ করে কুঁচে দেন।।
অনেকক্ষণ পর বলে উঠেন,
—-এভাবে চোখবুঁজে আছো যে?চোখ দুটো খুলো??
আমি আস্তে আস্তে চোখের পাতা ফাঁক করি।আর ফাঁকের কোণে আয়না সামনে পা থেকে বুক অব্দি শাড়ির ভাঁজ দেখে আকস্মিক।আর কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলি,
—–আপনি শাড়ি পড়াতেও জানেন??
—–হু ইউটিউব থেকে শিখে নিয়েছি। কারণ,আমার বউ যদি কখনো অত্যক্তি বোধ করে শাড়ি পড়তে; তখন আমি তাকে পড়াতে যেন সংকোচ বোধ না হয়।সো,এবার আমায় একটা মাম্মি দাও??
—-ঢং!!আপনি কি ছোটববাবু??
—-য়ু-হু সবার জন্যে নয়।অনলি ফর ইউ।।

আমি এবার উনাকে এড়িয়ে দরজার কাছে আসতেই উনি হাতটা ধরে ফেলেন।
—-কোথায় যাচ্ছো??
—-জেরিন আপুর সাথে দেখা করতে….
—-এখনই দেখা করবা??
—-হু,,কেন??!
—ইয়ে মানে আসলে….

আমি বুঝছি উনার মনের ব্যক্ততা।উনি এখন আমার থেকে আদর চাইছেন।এখন এই আননউন প্লেসে আদরের সন্ধি বেশিক্ষণ থাকবে না।কাজেই কেটে পড়া উওম।কিন্তু কেটে পড়বো কিভাবে ভাবতে থাকি।জেরিন আপু এখন রুমে আসলে একটা ওয়ে পেয়ে যেতাম।দাৎ,তাও হচ্ছে না।এই আপুটা সেই যে গেল গোসলের আগে,এরমাঝে একটু উঁকি দিলো না।এরইমধ্যে,
দরজার ওপাশ থেকে জেরিন আপুর করাঘাত…খুশিতে আমি লাঁফিয়ে উঠি “ইয়াহু”….
তড়িঘড়ি দরজাটা খুলে দিই…।
নিলয় ভাইয়া চোখগুলো কুঁচকে তাকিয়ে আছেন আমার এমন ভঙ্গিমা দেখে।আসলে সত্যিইতো,আমিতো এখন বাচ্চামো স্বভাব করে ফেললাম।

—ওহহ,যাক বাবা.. তোমাদের গোসলটা শেষ হলো।আচ্ছা,তাড়াতাড়ি নাস্তা করতে আসো তোমরা দু’জন।আমি সেই কখন নাস্তা রেডি করে রাখলাম।
—আচ্ছা,আপু যাও। আসছি….

উনি সামনের দিকে মাথাটা ঘুরিয়ে আবার বেখেয়ালে আমার দিকে সরু দৃষ্টি এঁটেন।
—-বাব্বাহ,তুমি তো দেখছি ভালোই শাড়ি পড়তে জানো।সুন্দর করে শাড়ি পড়া কে শেখালো শুনি??
—–না-মানে ইয়ে আ-আমি…
তোতলাতে তোতলাতে আমার কথার জবাব উনি পাশ থেকে দিয়ে ফেলেন।
—–নারীদের হচ্ছে শাড়ি।বিশেষ করে বিয়ে করা বউদের জন্যে।সো,শাড়িটা পড়াটা তাদের কাছে সিম্পল।এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই চিকু।
—–আচ্ছা, আচ্ছা বুঝলাম।তবে, তুই আমায় চিকু বলছিস কেন??

আমার মুখে চাপা হাসি চলে আসে।।
—আচ্ছা ঠিক আছে।রং-তামাশা বহুৎ দেখছি।এখন আয়তো কথা না বাড়িয়ে…?
তারপর আমরা জেরিন আপুর সাথে ড্রাইনিং এ আসি।
চেয়ার টেনে বসতেই আপু প্লেটে নাস্তাটা বেড়ে দেন।খাওয়ার ফাঁকে আপু বলে উঠেন,
—-ভাবী,সেই কখন তোমার সাথো দেখা হলো কিন্তু
এখনো তো তোমার নামটা জানা হলো না…
আমি খাওয়ার মধ্যে মাথাতুলে তাকিয়ে বলি,
—জ্বী আমার নাম মিথিলা জাহান মুন।
—অনেক সুন্দর নাম,ঠিক তোমার মতো।বায় দ্য ওয়ে,নীল?তোর বাবা তোদের বিয়েটা মানলো মানতে পারলো না এই জিনিসটাই আমার মাথায় আসছে না।এত্ত সুন্দর একটা মেয়ে একবার দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়।।আজকাল মা-বাবার এসব একঘেয়েমিতার কারণে ছেলে-মেয়েরা ভুল ডিসিশন নেয়।উনারা নিজেদের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে ভেঙ্গে ফেলে হাজারো স্বপ্ন।
—-আমিতো আর স্বপ্ন ভাঙ্গতে দিই নি।দেখিস না?সোঁজা তোদের বাড়ি?
—হুম,একদম উচিত কাজ করেছিস।। আচ্ছা পরে কথা বলবো কথার জন্যে তো আবার খায়ায় প্রবলেম হচ্ছে সবার।
আমি হিহিহি করে হেঁসে উঠি উনার কথায়।উনি হেসে দেন আমার সাথে তাল মিলিয়ে….

আমাদের খাওয়া শেষ হলে চেয়ার ছেড়ে দাড়াতেই জেরিন আপুর মা বাহিরে থেকে বাসায় ঢোকেন…
উনার মুখের দিকে তাকাতেই আমার চোখগুলো ঝলসে উঠে….!!!!
চোখগুলো আর কচলাতে থাকি,জেরিন আপুর মাকে পরখ করার জন্যে।কিন্তু বার বার মনে হচ্ছে,ইনাকে আমি কোথায় যেন দেখেছি!কোথায় যেন দেখেছি।ঠিক স্মৃতিতে ভাসছে,মাথায় আসছে না।।
চলবে….

পারবো না ছাড়তে তোকে
পর্ব-১৫
রোকসানা আক্তার

জেরিন আপু আমাদের ইঙ্গিত করে তার মাকে বলেন,
—-মা?এই দ্যাখো, আমার ফ্রেন্ড এবং তার ওয়াইফ চলে এসছে।

উনি মুখে মুঁচকি হাসির রেখা টেনে আমাদের দিকে তাকিয়ে চোখগুলো কপালের দিকে তুলেন।উনার এই তাকানোর চাহনি আমার বুকের মধ্যে হৃদযন্ত্রের মতো ধুকধুক শব্দ হতে থাকে।গলার পানিটুকু যেন শুকিয়ে আসছে।সম্ভবত উনি আমায় দেখেই এমন ভাব এনেছেন।
নিলয় ভাইয়া সালাম করে উঠেন এবং সাথে আমিও।তাও তোতলে তোতলে।উনি আমার দিকে সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সালামের জবাব নেন।
——–ওয়ালাইকুম-আসসালাম।কেমন আছো তোমরা??
——–সকাল থেকে মনমরা ছিল।এখন মরামন প্রাণোচ্ছলে নেচে উঠলো।

উনি ভ্রু কুঁচকে বলেন,
——–সাডেন এমন অনুভূতি কেন বাবা?
——–এই যে আপনি ছাড়া সকাল থেকে পুরো ঘর খা খা।এখন বোধহয় সময়টি ভালোমল কাটবে,যেহেতু আপনি বাসায় এসছেন আন্টি।

উনি নিলয় ভাইয়ার কথাশুনে শতানীর হাসির ছলে আমার দিকে একনজর ফেলে আবার নিলয় ভাইয়াকে বলেন,
——-বুঝলাম বাবা,বুঝলাম।আসলে,আমার বোনের মেয়ের আগামী-মাসের ১০ তারিখে বিয়ের এরেন্জ হবে,সেই সুবাদে বাসার সবার জন্যে কেনাকাটা করলাম।জেরিনেরও আজ মার্কেটে আমার সাথে যাওয়ার কথা ছিল,তোমরা যেহেতু আজ আসবে সেজন্যে ও আর যায়নি।
——–বুঝলাম,আন্টি।
——–ওকে,যাইহোক বাবা…আমিও ভীষণ ক্লান্ত এবং তোমরাও।যাওও রেস্ট নাও।।

জেরিন আপু ড্রাইভারের হাত থেকে ড্রেসগুলো নিয়ে রুমে চলে যায়।আর,আমি এবং নিলয় ভাইয়া আমাদের রুমে চলে আসি।আমার মনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভয়ের কণা ঢুকতে থাকে।এই মহিলার চাহনি যেন কোনো বিষাক্ত স ছোবলের ন্যায়।কোনো এক আশঙ্কা মুহূর্ত যেন এই মহিলার সাথে আমার ঘটেছিল।কিন্তু ঠাহরে আসছে না।নিলয় ভাইয়া আধশোয়া শরীর বিছানার উপর এঁটে দিয়েছেন।আর আমি পায়চারি তে মর্ত জেরিন আপুর মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে।নিলয় ভাইয়া গলা পরিষ্কার করে বলেন,
———কিছু ভাবছো,মিথি?
উনার কথায় আমি থমকে দাড়িয়ে মাথা নাড়ি।
——–বাড়ির কথা খুব বেশি মনে পড়ছে??

এবার আমি উনার দিকে দু’চোখ তুলে তাকাই।আর পাশে গিয়ে বসি।টানা টানা চোখে বলতে থাকি।
——–আচ্ছা,আমরা এখান থেকে চলে গেলে ভালো হতো না খুব!?

উনি আমার কথাশুনে চোখগুলো সরু করেন।আর বলেন,
——–আজ মাএ আসলাম,আর আজই চলে যাবে??
——–না মানে…আমার কেনজানি এ বাড়িতে ভালো লাগতেছে না।মনটা খুব আনচান করতেছে।
——-বুঝলাম বুঝলাম,,বাসার সবার কথা যে মনে পড়ছে এজন্যে এমনটি বোধ হচ্ছে।আর ক’টা দিন থাকো,দেখবে পরে সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমি কিছুক্ষণ অব্দি চুপসে থাকি।উনি আধশোয়া থেকে আমার সামনে পা গেঁথে বসেন।আমার দু’উরুতে হাত রেখে বলেন,
———যেখানে আমি আছি সেখানে ভরসা রাখো।আই গড প্রমিস,এই জীবন থাকতে কখনোই তোমার কিছুটি হতে দিবনা।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে মুঁচকি হাসি দিই।উনিও মুঁচকি হেসে আমার মাথায় সুড়সুড়ি দিতে থাকেন।
——–উফস,কাতুকুতু লাগছে—-সুড়সুড়ি দেওয়া কি আপনার অভ্যেস??
——–উ-হু,বদভ্যাস।
———লজ্জ্বা-সরম নেই।
উনি আমার কথাশুনে আমাকে উনার দিকে টেনে নিয়ে বলেন,
——–লজ্জ্বা কি আরো পেতে চাওও

এবার আমি বেশি লজ্জ্বা পেয়ে যাইই।মুখটা লাল হয়ে ওঠে আমার।তড়িঘড়ি উনাকে ছাড়িয়ে আয়নার সামনে এসে হাঁপাতে থাকি।উনিও আমার পিছন পিছন এসে আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেন।আর আমার মুখটাকে আয়নার সামনে কাঁত করে বলেন,
———দেখো,তোমার লজ্জ্বার লাল আভাসে তোমায় আরো সুন্দর দেখাচ্ছে।
এ বলে আমার দু’কোমড় আরো বেশি চেপে ধরেন।উনার এই স্পর্শের অনুভূতি আমার মনে শিহরণ জাগে।শরীরের প্রতিটি লোম খাড়া হয়ে ওঠে ক্ষণিকে।এই মানুষটির প্রতিটি ভালোবাসার বিন্দু খুব অমৃত মনে হয়।সত্যি এতটাই ভালোলাগে এই মানুষটিকে।
আমাকে উনার দিকে মিশিয়ে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে ঘাড়ে উনার মুখটা গুঁজেন।আমি থমকে উঠি।মন বলতে চায়,আরো বেশি ভালোবাসেন আমায় মনটা উজার করে দিয়ে।।

দরজা ঠক ঠক আওয়াজ পড়তেই আমি নিলয় ভাইয়ার থেকে সরে দাড়াই।দরজার দিকে মুখ করে তাকাতেই জেরিন আপু মুঁচকি হেসে উঠেন।আর গলা খেচকি দিয়ে বলেন,
——–খা খা দরজা খোলা রেখে কেউ কাউকে ভালোবাসে??
আমি থতমত খেয়ো যাই।আর নিলয় ভাইয়াকে মনে মনে একশ’টা গাল দিতে থাকি।এই মানুষটির লজ্জা-সরম আসলেই কমতি।দরজা বন্ধ না করে বউকে সোহাগ দিতে আসে,ঢং–যত্তসব।আর মাঝখান দিয়ে বিপাকে ফেলে আমায়।পাশ থেকে নিলয় ভাইয়া আবার কড়া গলায় বলে উঠেন,
——-তো দরজা খোলা ভালো কথা।তুই আমাদের দেখামাত্রই দরজাটা ওপাশ থেকে বন্ধ করে আমাদের ভালোবাসার সুযোগ টা করে দিবি না??তুইতো হচ্ছিস উল্টো গর্দভ!!

আমি রাগ,লজ্জায় দাঁতগুলোকে কটমটাতে থাকি ভাইয়ার কথায়।
জেরিন আপু রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলেন,
——–তোদের প্রেম হলো কিভাবে রে??
———হয়েছে আর-কি!যেভাবে হওয়ার….
——–এমন পর পর ভাব দেখাচ্ছিস যেন আমি তোর শএু!! তুইতো একসময় আমায়ও পছন্দ করতি
চোখটিপে জেরিন আপু কথাগুলো বলেন।আমায় ঘায়েল করার জন্যে।উনি চোখগুলো বড় করে জেরিন আপুকে ধুঁইতে থাকেন।
——–তুই তো আমার খাতায় একবার “আই লাভ ইউ” লিখে চোরের মতো সাধু সাজছিস।
——–য়ু…এগুলোতো সেই স্কুল লাইফের দুষ্টমি।জাস্ট তোকে পঁচানোর জন্যে,হিহিহি। তাওও সিরিয়াস ভাবছিস??
——-আরে নাহ নাহ… আমি চিকুর কথায় সিরিয়াস হইনা।চিকুর কথায় সিরিয়াস হলে সেদিনই তো তোর প্রেমে পড়তাম।
——-হিহিহিহি।রাখ তোর ফান।

আমি এরমাঝে বলে উঠি,
——–আপনি কি উনার স্কুল-লাইফের ফ্রেন্ড?
——–য়ু-হু!!অনলি স্কুল লাইফের না।কলেজ লাইফেরও।বাট ভার্সিটি আলাদা।ওর বিদেশ,আর আমার বাংলাদেশ।
——–হু,বুঝলাম।আপনারা আগে ঢাকায় ছিলেন??
——-হ্যাঁ।সিলেট ব্যাক করছি দেড় বছর হবে প্রায়ই।আমার এবং ভাইয়ার স্টাডি শেষ হলেই আমরা ঢাকার ফ্ল্যাটটি বিক্রি করে সিলেটে চলে আসি।কারণ,নিজের জন্মস্থান ছাড়া আর কোথাও ভালো লাগে না তাইই।

——ওহহ, আচ্ছা।বুঝলাম।

সন্ধে ৭ঃ০০,
আমি,নিলয় ভাইয়া এবং জেরিন আপু শপিং-এর জন্যে বাহিরে বের হই।জামাকাপড় যা কেনাকাটা সবটাই উনি পছন্দ মতো কেনে নেন।আমার পছন্দের প্রায়োরিটি দিলেও সবটা উনার উপর ছেড়ে দিই।জানি না,কেমন ড্রেস,শাড়ি কিনেছে।আর জেরিন আপু সব প্যাকেট করে শপিং ব্যাগে ঢুকচ্ছেন।আমি মার্কেটটির চারপাশটা মননান্দে দেখতে থাকি।সিলেটের মার্কেট গুলো দেখে আসলেই বোধগম্য হয় সিলেট হলো বাংলাদেশের লন্ডন।অনেকটাই সুন্দর এখানের পরিবেশ যেন বিদেশ।

তারপর কেনাকাটা শেষ হলে জেরিন আপু বলে উঠেন,
——নীল??চল, রেস্টুরেন্ট থেকে হালকা কিছু খেয়ে নিই আমরা।

আমি অদূর পথের মোড়ে ঝালমুড়ি, পুচকার দোকান দেখতে পাই।ওদিকে ইঙ্গিত করে জেরিন আপুকে বলে উঠি,
——আপু?আমরা আজ রেস্টুরেন্টে না গিয়ে বাহিরের খাবার খাবো,প্লিজজ??
——বাহিরের খাবার পছন্দ হবে তো??
——নো প্রবলেম আপু।আমি সবটা মানিয়ে নিতে পারি।প্লিজজ…

উনি বেখেয়ালি হেসে বলেন,
——-আমার জোনো আপওি নেই,যদি না নীলের থাকে।
আমি নিলয় ভাইয়ার দিকে চোখগুলো সরু করে বাচ্চামো ভঙ্গিতে বলি,
——-প্লিজ,আজ আমরা পুচকা,ঝালমুড়ি খাবো।আমার এই আবদার টুকু আজ অন্তত রাখুন…প্লিজজ??

আমার বায়নার ছল দেখে উনি আর না বলে পারোননি।তারপর সম্মতি দেন,
——-আচ্ছা ঠিক আছে।আমরা বাহিরেরই খাবো আজ।নো রেস্টুরেন্ট।

তারপর,ফুচকাওয়ালা আমাদের তিনজনের হাতে তিনটা প্লেট ধরিয়ে দেয়।।
আমার ফুচকায় টক,ঝাল বেশি ছিল।আর জেরিন আপু এবং উনার প্লেটে হালকা।কারণ,উনারা টক,ঝাল খেতে তেমন পছন্দ করেন না।নিলয় ভাইয়া আমার দিকে চামচ এগিয়ে দিয়ে বলে,
——এই নাও, চামচ নেই।
——নাহ,নাহ আমার চামচ লাগবে না।আমি হাত দিয়েই খেতে পারবো।
জেরিন আপু অবাক হয়ে বলেন,
——-তুমি হাত দিয়ে খেতে পারো??
নিলয় ভাইয়া জেরিন আপুর কথায় পাল্টা জবাব তুলেন,আর বলেন,
——-চামচ দিয়ে খাওয়াটা একটা শৌখিনতা,বাট হাত দিয়ে খাওয়ার মজাটাই আলাদা।সব পরিবেশে সবকিছু চাইলেও করা যায় না,তা মানিয়ে নিতে হয়।
——-বাব্বাহ, পাঁচ বছর স্টার্ন থেকে এখনতো পুরাই বাঙ্গাল হয়ে গেলি রে….সবটা কি এই টুকটুকি বউটার জন্যে নাকি??
জেরিন আপুর কথায় উনি মাথা হেলেন।আমি অনেকটা অবাক হয়ে যাই,উনি যে আমাকে এতটা সাপোর্ট দিচ্ছেন।সত্যি,সোনার চামচ মুখে তোলা মানুষগুলোও যখন সাদামাটা জীবন পছন্দ করে ওদের মনের অজান্তেই ভালো লাগে।আল্লাহর কাছে হাজারো শুকরিয়া,এমন একজন মানুষ আমার লাইফে পেয়েছি।

তারপর খাওয়াদাওয়া শেষ হলে আমরা বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা করি।বাসায় আসার পর উনাদের ড্রাইনিং উনার ভাইয়া এবং মাকে দেখতে পাইই।জেরিন আপু চমকে বলে উঠেন,
—–ভাইয়া দ্যাখো,এই কারা??
জেরিন আপুর ভাই আমার দিকে তাকায় এবং আমি উনার চোখের দিকে লম্বালম্বি তাকাতেই চোখগুলো আমার ধাঁধিয়ে উঠে।এখন আমার সবটা বিষয় আমার খোলাসা হতে থাকে।আমার দু’হাত,দু’পায়ে কাঁপুনি ধরে যায়য়য়।আমি ফ্লোরের উপর দাড়িয়েও যেন শূন্যে ভাসছি।হায়য়,আল্লাহ এ আমি কোথায় চলে এসছি।নিলয় ভাইয়া এখানে আমায় কোথায় নিয়ে এসছেন।

তারপর জেরিন আপুর ভাইয়া নিলয়ের সাথে কুশল বিনিময় করেন।আর নিলয় ভাইয়া আমার এবং উনার পরিচয় দিতে থাকেন।কথার ফাঁকে জেরিন আপুর ভাইঅ বলেন উঠেন,
——বাহহ,অনেক লক্ষী বউ পেয়েছেন।লাইফে,আরো হ্যাপী হোন আপনার প্রিয় স্ত্রীকে নিয়ে সে দোয়াই করি।

উনি কথাগুলো বলছেন যেন আমার বুক কাপছে।আমি যেন এখানেই কেদেই দিই।আমি আর দাড়িয়ে না থেকে মাথা ঘুরানোর নাম করে পা ফেলে নিজের রুমে চলে আসি।জানিনা,এই চলে আসার মুহুর্তে উনার মা এবং উনি কি ভেবেছেন!!
!!
কিছুক্ষণ পর নিলয় ভাইয়া রুমে এসে শপিং ব্যাগগুলো সোফার উপর রেখে ওয়াশরুমে চলে যান।আমি বেলকনিতে দাড়িয়ে শান্ত বাতাসের গতির পরিসীমা মাপতে থাকি।পরক্ষণে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে নিলয় ভাইয়া আমার কাছে এসে বলেন,
——শরীরটা এখন কেমন লাগছে তোমার??

আমি চমকে উঠে বুকে থুতু দিয়ে বলি,
——ন-না,ভালো লাগছে।
——আচ্ছা,এখন সবাই একসাথে ডিনার করবো, চলো…

এখন আমি ডিনার করতে গেলে জেরিন আপুর ভাইয়ার মুখোমুখি হওয়া লাগবে। নাহ,নাহ আমি ডিনার ওখানে করবো না।যে-করেই হোক এখন একটা উপায় খুঁজে বের করতে হবে ডিনার রিজেক্টের জন্যে।তারপর কেঁপে কেঁপে বলি,
——-বাহিরের খাবার খেলে আমার এ-একটা প্রবলেম… পরে আর কিছু খেতে পারি না।
——কিন্তু শরীরতো আরো খারাপ করবে,মিথি?
——নাহ সত্যি করবে না।

আমার তালবাহানা দেখে উনি আর কিছু বলেননি।পরে মাথা হেলিয়ে চলে যান।
আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলি,
—–যাক বাবা বাঁচলাম!
যেই ভাবা,সেই মুহূর্ত একটা কন্ঠস্বর উপলব্ধি করতে পারি পেছন থেকে। কেউ একজন বাঁধা বাঁধা কন্ঠে বলে উঠে,
—–খাওয়াদাওয়া আপওি করা ভালো নয়।ডিনারটা করে পরে নাহয় আপওি করো…??
আমি থমকে পেছন ফিরে তাকাই। এখনই যেন কেদে ফেলি।কারণ,কথাগুলো জেরিন আপুর ভাইয়া বলছেন।উনি আমার ভাবভঙ্গি দেখে বলেন,
——ভেবো না এখন আর তোমায় আগে মতো ভালোবাসি!!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here