শেষ দুপুরে আফসারপুর গ্রামের খুব পুরাতন এই পুকুরে গোসল করতে নেমেছে ৬জন কিশোরী মেয়ে। সবার সঙ্গে হৈচৈ করে গোসল করছে নুপুর। হঠাৎ সে অনুভব করলো পানির নিচ থেকে একটা শক্ত হাত চেপে ধরলো তার পা। সে আতঙ্কে নিয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখল তার সাথীদের সবার মাথাই উপরে। তাদের কেউ দুষ্টমি করছে না তার সাথে। শক্ত হাতটা তার পা টেনে তাকে পানির নিচে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। অন্য কেউ কী আগে থেকে পানিতে ডুব দিয়েছিল তাদের ভয় দেখানোর জন্য! হাতটার চাপ হঠাৎ খুব বেড়ে গেল। একটানে তার সালোয়ার খুলে নিল ওটা। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল মেয়েটা। পাশের সাথীরা বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকালো। এক মুহূর্তের জন্য শুধু নুপুরের আতঙ্কে ভরা মুখটা দেখতে পেল সবাই। এরপরেই তলিয়ে গেল সে পানির নিচে।
সকলে আতঙ্কে চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিল। আশেপাশের লোকেরা ছুটে এলো। পুরো দিন ভরে সারা পুকুরে খোঁজ করা হলো মেয়েটাকে। কিন্তু তার বিন্দুমাত্র চিহ্নও খুঁজে পাওয়া গেল না । গ্রামের সকলের ভেতর সৃষ্টি হলো অদ্ভুত এক ভয়। এই পুকুর খুব প্রাচীন হলেও এমন দিনে-দুপুরে পুকুর থেকে একটা মেয়ের নিখোঁজ হয়ে যাওয়াটার মতো ঘটনা এর আগে কখনোই ঘটতে শুনেনি কেউ। প্রায় তিন দিন কেটে গেল। নুপুরের পরিবার এবং খেলার সাথীরা তার শোকে প্রায় পাগল হয়ে এলো। এক সকালে পুকুরে চাল ধুতে এসে আসমা নামের এক মহিলা আবিস্কার করে মাথা বিহীন একটা মেয়ের নগ্ন লাশ ভেসে রয়েছে পুকুরের মাঝ বরাবর। ভয়ে চিৎকার শুরু করলে অনেক মানুষ চলে আসে সেখানে। এটা যে নুপুরের লাশ তা মাথা না দেখেও কারো বুঝতে আর বাকি থাকে না। কিন্তু কে মারলো এমন বীভৎস ভাবে মেয়েটাকে! কেউই কিছু বুঝতে পারছে না।
পুলিশ এমন বীভৎস মৃত্যুর খবর পেয়ে হাজির হলো সেদিনই। লোক দিয়ে পুকুর থেকে তুলে নিয়ে যায় নুপুরের মাথা বিহীন লাশটা ময়নাতদন্তের জন্য। নুপুরের পুরো শরীর রক্তশূন্য অবস্থায় পায় তারা। কিছু একটা যেন কিশোরী মেয়েটার মাথা দাঁত দিয়ে কামড়ে ছিড়ে ফেলেছে, ধারালো দাঁতের চিহ্ন পাওয়া গেল ধড় থেকে মাথা যেখানে ছিড়ে গেছে সেই কাটা অংশে। এরপর কেউ যেন শুষে নিয়েছে মেয়েটার শরীরের সব রক্ত। কিন্তু কী ওটা! কোনো মানুষের কাজ যে এটা নয় ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে। এই পুকুরে কুমির থাকার প্রশ্নই ওঠে না। তাছাড়া তন্নতন্ন করে খুঁজেও যেখানে পুকুরে মেয়েটার লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি সেখানে তিন দিন পর কী করে লাশটা ভেসে উঠল! এমন শত প্রশ্ন মনে জাগলেও কোনো উত্তর পেল না কেউ। পুলিশের উপস্থিতিতে সপ্তাহ খানেক পর গ্রামের গোরস্থানে দাফন করা হয় মেয়েটার লাশ।
এরপর কেটে গেল কয়েক সপ্তাহ। গ্রামের অনেকেই সেই প্রাচীন পুকুরটিকে ত্যাগ করলো। বিশেষ করে কম বয়সী মেয়েরা।
তুলি তার ছোট ভাইয়ের সাথে এক বিছানায় ঘুমিয়ে রয়েছে রোজকার মতো। হঠাৎ চকিটা কেঁপে উঠতেই তার ঘুম ভেঙে গেল। গাঢ় অন্ধকারে মৃদু করে জ্বেলে রাখা হারিকেনটা ঝাপসা আলো দিচ্ছে। সেই আলোতে সে ছোট ভাইয়ের দিকে পাশ ফিরে শুতে গিয়েই চমকে উঠল। তার ছোট ভাই নেই। তার জায়গায় শুয়ে আছে অন্য একটা মেয়ে। তার মুখোমুখি হয়ে সেই মুখটা বড় চোখ করে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মেয়েটাকে চিনতে পেরে শরীরটা মোচড় দিয়ে উঠল তার। নুপুর! কিন্তু! নুপুর একটু হেসে বলল, কিরে তুলি, কেমন আছিস? তুলি পুরো শরীরে ভয়ানক শিহরণ অনুভব করলো। নুপুর তো মারা গেছে সেদিন। সে কী ভুল দেখছে! তার ভাই কোথায়! ভয়ে ভয়ে সে নুপুরের শরীরের একটু নিচের দিকে তাকাতেই দেখল কাঁধ থেকে নুপুরের শরীরের নিচের অংশটি নেই। তার সাথে শুয়ে আছে নুপুরের কাটা মাথা। যাতে কিনা প্রাণ আছে! সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠল সে। ধড়ফড় করে বিছানা থেকে নেমে গেল। ঘুরে সোজা হলো কাটা মাথাটা। করুণ দৃষ্টিতে তাকালো তুলির দিকে, অবিকল নুপুরের কণ্ঠে বেরিয়ে এলো, ‘খুব কষ্টে আছিরে তুলি, তুই কেন সেদিন আমাদের গোসল করাতে নিয়ে গেলি! এবার বাঁচা আমাকে! একা আর আমার ভালো লাগে না!’
চেচাতে চেচাতে ছুটতে ছুটতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল তুলি। বাবা-মা ছুটে এলেন। কিন্তু তারা ঘরে বড় বাতি জ্বেলে তুলির ছোট ভাই ছাড়া আর কাউকেই দেখতে পেলেন না। তুলিকে বোঝাতে লাগলেন, এটা কেবল একটা দুঃস্বপ্ন ছিল। কিন্তু অজানা এক আতংক অনুভব করে তুলি। তার বিশ্বাস এটা কিছুতেই স্বপ্ন হতে পারে না! ভোর পর্যন্ত দুশ্চিন্তায় তার ঘুম হলো না।
সেদিন পার হলো। নেমে এলো রাত। ভাইকে নিয়ে এক বিছানায় ঘুমিয়ে রয়েছে তুলি। মাঝরাতে খট করে দরজা খুলে যাওয়ার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তার। চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসলো সে। পাশে ছোট ভাই নেই। দেখল তার ছোট ভাই দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ঘুমের ঘোরে হাঁটছে যেন ও। দ্রুত চারদিকে ভালো করে তাকিয়ে সে বুঝলো এখন গভীর রাত। তার ছোট ভাইয়েরতো ঘুমের ভেতর হাঁটার অভ্যাস নেই! এত রাতে তাকে না ডেকে একা একা কোথায় যাচ্ছে! আৎকে উঠে বিছানা থেকে ভাইকে ডাকতে লাগলো তুলি, পেছন থেকে। ভাই বোধ হয় কিছুই শুনলো না। দ্রুত ঘর থেকে বের হলো সে, অবাক হয়ে দেখল এত কম সময়ে অনেকটা দূর চলে গেছে ভাই। ঝাপসা আলোয় ভাইকে ডাকতে ডাকতে তার পিছু নিল তুলি। যতই দ্রুত ছুটছে সে ভাই যেন আরও দূরে চলে যাচ্ছে। নাগাল পাচ্ছে না সে কিছুতেই।
প্রায় ১৫ মিনিট সে ঝাপসা আলোতে মনে আতংক আর ভয় নিয়ে ভাইকে অনুসরণ করে চললো। এত জোরে সে ডাকছে যে কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ এতক্ষণে তন্দ্রা জেরে পেছনে ঘুরে তাকাতো। আর এত ক্ষিপ্র গতিতে হাঁটছে কী করে ছেলেটা! হঠাৎ খেয়াল করলো সে , হাঁটতে হাঁটতে সেই প্রাচীন পুকুরের কাছাকাছি চলে এসেছে তারা। ভয়ে সমস্ত শরীর আরেকবার মোচড় দিয়ে উঠল তার। নুপুরের লাশ সেদিন দেখার পর থেকে আর এদিকে আসেনি সে। তাছাড়া গত রাতের সেই ঘটনাটা! তার ভাই একদম পুকুরের পাড়ে চলে গিয়েছে। কেঁদে ফেলল তুলি। ‘ভাই আর যাসনে, ফিরে আয়!’ সে আর এগোতে সাহস পাচ্ছে না।
হঠাৎ পুকুরের পাড় থেকে একটা মেয়ের হাসির শব্দ যেন ভেসে এলো। আচমকাই খেয়াল করলো তুলি, পুকুরের পাড়ে তার ভাই নয় , একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওই হাসছে। নুপুর! পরনে সেই ডুবে যাওয়ার দিনের জামা। তার ভাই কোথায় গেল! ভয়ে চিৎকার করে উঠল সে। নুপুর ঘুরে তাকালো তুলির দিকে। তুলি চিৎকার করে উল্টো ঘুরে দৌড় দেয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলো। কিন্তু! এত দ্রুত কিছু চলতে পারে! এক মুহূর্তে তার মুখোমুখি চলে এলো নুপুর। শক্ত করে চেপে ধরলো তার হাত, বলল, ‘কিরে তুলি, আমাকে ভয় পাস কেন তুই? এই পুকুরে কত গোসল করেছি আমরা এক সাথে, এখন আমাকে একা করতে হয়। আয় আমার সাথে। দেখবি কত মজা হয়!’
শক্ত হাতটা টেনে নিয়ে যেতে থাকে তুলিকে পুকুরের দিকে। সর্বশক্তি দিয়ে সে চেঁচাচ্ছে আর হাত ছাড়াতে চেষ্টা করছে। কিন্তু কোনো লাভই হচ্ছে না। একদম পুকুরের পাড়ে নিয়ে এসেছে ওকে নুপুর। আতঙ্কে চোখ মুখ বিকৃত হয়ে এলো তুলির। হচ্ছেটা কী এসব! চিৎকার জুড়ে দিল সে সাহায্যের জন্য। দূর থেকে হৈচৈ এর শব্দ কানে আসছে। তার চেঁচামেচি শুনে ছুটে আসছে গ্রামের লোকেরা। মুখে ক্রুর হাসি ফুটে উঠল নুপুরের। বলল, ‘চল আমার সাথে তুলি, একসঙ্গে মিলেমিশে খেলবো আমরা।’……………………………………….
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.
#পুকুরের_সেই_আতঙ্ক
১ম পর্ব
লেখা: #Masud_Rana