পুনর্মিলন পর্ব -২২+২৩

#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_২২

নিকষিত কালো অন্ধকার ঠেলে অর্ধ বাঁকা চাঁদের আলোয় অল্প অল্প গা ভাসাচ্ছে বাতাবরণ। মেঘের পাল্লা ভারী হওয়ায় চাঁদের আলো মুক্ত হতে পারছে না স্বাধীনঅঙ্গে। আকাশে তারা আজ নেই বললেই চলে। সবাই যেনো নভশ্চরের চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে ওই দূর আকাশে। ফাল্গুনী আর জাগ্রত দুজনে ছাঁদের আধো আঁধারে দাঁড়িয়ে আছে মোটামুটি উঁচু রেলিঙটায় খানিক হেলান দিয়ে। প্রথমে জাগ্রত এসেছিলো। তারপর ফাল্গুনী এসেছে। জাগ্রত এসেছিলো সিগারেট এর টানে কিন্তু অকস্মাৎ ফাল্গুনীর আগমনে তা আর হলো না। জাগ্রতর কেমন সন্দেহ হলো। ফাল্গুনী কি সিগারেট হাতে নিয়ে আসতে দেখেছে বলেই এলো কিনা! আর এসেছে পর থেকে কথাও খরচ করছে না। দাঁড়িয়ে আছে কেমন চুপচাপ। কেমন যেনো চোরের মতো ভয় পাচ্ছে জাগ্রতর পুরুষালী হৃদয়। যেনো সিগারেট হাতে বৌ দেখে ফেলা মানেই পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের সূচনা হওয়া। অথবা তার চেয়েও আশ্চর্যজনক!

কিছুক্ষণের নিরবতা ঠেলে ফাল্গুনী ডেকে উঠলো জাগ্রতকে,

“শুনছেন?”

চার অক্ষরের “শুনছেন” শব্দটা জাগ্রতর রন্ধ্রে রন্ধ্রে এক অন্তরিক্ষ সুখানুভূতির জানান দিলো স্বমহিমায়। সিগারেট নামক আতঙ্ক নিভে গিয়ে প্রজ্বলন হলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভূতির প্রকাশ দ্বীপ। এমন আপন আপন অনুভূতি আর এমন সম্বোধন তো একসময় কল্পনায় ধরা দিতো রোজ। আজ তা বাস্তব। জাগ্রত ধরা দিলো না নিজের অনুভূতিদের সম্মুখে। যদি অঘটন ঘটিয়ে ফেলে তাহলে তো সর্বনাশ! সেই ভয়ে মুখাবয়ব রাখলো স্পষ্ট ও স্বাভাবিক। কন্ঠে আনলো মেকি গম্ভীরতা। তারপর উত্তর দিলো,

“শুনবো বলেই তো চুপ করে আছি।”

ফাল্গুনী মিনমিনে স্বরে বলল,

“আমি কিছুক্ষণ একা থাকার কথা বলেছিলাম বলে কি রাগ করে ছাঁদে চলে এলেন?”

জাগ্রত এক মুহুর্তেই মেকি গম্ভীরতা ছেড়ে কেমন বোকা বোকা হেঁসে বলে উঠলো,

“আরে ধ্যাত! আমি তো সিগ্… মানে এমনিই এসেছিলাম। তোমার ওপর রাগ করে কেনো আসবো?”

“তখন কেনো একা থাকতে চাইলাম জিজ্ঞেস করলেন না যে?”

এবার আর মেকি নয়, পরিবেশগত স্বয়ংক্রিয়ভাবে গম্ভীরতার অবস্থান হলো জাগ্রতর মুখমন্ডল জুড়ে। বলল,

“যা জানি তা নিজে বুঝলে যা, তুমি বললেও তাই। জিজ্ঞেস কেনো করবো?”

“সরি।”

“সরি বললে আবারও একই কাজ করবো। তাই কি চাইছো?”

“আমায় ভুল বুঝবেন না। আমাকে দুটো দিন সময় দিন। আমি আপনার সান্নিধ্যে সহজ হতে পারছি না। আমি চাই সহজ হতে কিন্তু শুরুটা কিভাবে করবো বুঝতে পারছি না।”

“আমি বলবো?’

“শুনতেই তো এলাম।”

“হয় আমার উপর ছেড়ে দাও সবটা নয়তো নিজের উপর নিয়ে নাও পুরো দায়িত্ব। নয়তো আমি ভাববো তুমি এগিয়ে আসবে দু কদম, সেই আশায় এগিয়ে না গিয়ে থেমে রবো আমি। অথবা তুমি ভাববে আমি এগোবো তাই থেমে রবে তুমি। এর উল্টোটাও হতে পারে, মনের মধ্যে এগিয়ে আসার চিন্তাটা না এসে পিছিয়ে যাবার চিন্তাও আসতে পারে। এভাবে দুজনেই থেমে থেকে গিয়ে সময়ের পিছনে পরে রবো। তারপর একটাসময় খাপছাড়া মনে হবে সময়ের শুরুটাকেই। তার থেকে বরং এটাই ভালো হবে, তুমি অথবা আমি দুজনের কেউ একজন কাছে আসুক আরেকজন পাশে থাকুক। একজন হোক দায়িত্বশীল, আরেকজন হোক নির্ভরশীল। একজন ছুঁয়ে দিক, আরেকজন অনুভব করুক। তবে সেই ছোঁয়া টা আগে হোক হৃদয়, তারপর শরীর।”

ফাল্গুনীর হৃদয়ের মুগ্ধতা ফুটে উঠলো চোখে। চেহারায় উঁকি দিলো আহ্লাদী আভা। কন্ঠে যেনো কত-শত আবদার এসে জড়ো হয়ে ভীড় জমালো। আত্মবিশ্বাসী মুখাবয়ব নিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল,

“আমি পাশে থাকতে চাই। আপনাকে সঙ্গ দিতে চাই। আপনি দুরত্ব ঘুচিয়ে কাছাকাছি আসার দায়িত্ব নিন, আমি দূরে যেতে চাইলে ধরে রাখার দায়িত্বও নিন। আমি না-হয় নির্ভরশীল হবো আপনার ভালোবাসায়। কখনো কিছুতেই বাঁধা দেবো না আপনাকে। শুধু অনুভব করবো আপনার উপস্থিতি, আপনার এমন হৃদয় নিংড়ানো কথা, আপনার ভালোবাসা, আপনার ছোঁ….”

ফাল্গুনী কথা টা শেষ করলো না। লজ্জা নিয়ে তৃপ্তি ছোঁয়ালো ঠোঁটের কোনে আর হাসলো খানিক। হাসি আড়াল করতে মাথা নিচু করে নিলো। কিন্তু জাগ্রত তা ঠিকই ধরে ফেললো। জাগ্রত তার প্রেয়সীর ঠোঁট ভর্তি হাসি দেখে তার দিকে চেয়ে থেকে বলল,

“আমি কিন্তু তখন শুধুমাত্র মাথা টিপেই দিতাম। ততটুকুনিই ছিলো আমার মাথায়। আর কোন অভিপ্রায় সেই মুহূর্তে ছিলো না আমার। তুমি অযথাই ভয় পাচ্ছিলে।”

ফাল্গুনী একটু দমে গেলো। লজ্জামাখা মুখটা আরও খানিক আড়াল করে বলল,

“ভয় পাচ্ছিলাম তা কে বললো? ভয় পাচ্ছিলাম না মোটেও।”

“একা থাকার কথাটা বলার সময় দুইবার তুতলে উঠেছো তুমি।”

ফাল্গুনী কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। ভাবলো, কিছু কথার উত্তর দিতে নেই।

কিছুক্ষণ দুজনেই নিরব রইলো। দুজনই আকাশ-পাতাল ভাবনায় মগ্ন হলো হিসেব ছাড়া সময়ের উদ্দেশ্যে। বেশ কিছুক্ষণ পর ফাল্গুনী হটাৎ বলল,

“আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতো কতো খুশি হতো জানেন? আমাদের দুজনের বাবা-ই অনেক খুশি হতো।”
“আমাকে এখনও কোনভাবে তোমার বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী মনে করো তুমি?”
“আগেও ভাবতাম না।”
“আমার মায়ের উপর এখনও ক্ষোভ জমে আছে?”
“বেঁচে থাকলে জবাব দিতাম। যে নেই তার প্রতি ক্ষোভ পুষে রাখার মতো অতোটাও পাষাণ নই।”

আবারও কিছুক্ষণ নিরবতায় কাটলো। নিরবতা ভেদ করে ফাল্গুনী বলল,

“আপনার মায়ের মৃত্যুর ব্যাপারে বিস্তারিত যদি জানতে চাই বলবেন আমায়?”
“কি জানতে চাও বলো।”
“এভাবে নয়। আপনি প্রথম থেকে সবটা বলুন আমায়। বিশেষ করে উনার সমস্যা গুলো কখন বেড়ে যেতো আর চিকিৎসা কে করতেন উনার? কোথায় মারা গেছেন? কিভাবে মারা গেছেন? উনার রিপোর্ট গুলো কোথায় আর যিনি চিকিৎসা করতেন সেই ডাক্তারের নাম….”

কথা বলতে বলতে থেমে গেল ফাল্গুনী। আচমকা মনে হলো প্রথম দিন হিসেবে একটু বেশিই বলে ফেললো হয়তো। এভাবে নয়, একদিনে এতোটা জানতে গেলে জাগ্রত সন্দেহ করতে পারে। নিজেকে শান্ত করে পাশ ফিরিয়ে জাগ্রতর দিকে চাইলো। চোখে চোখ পড়তেই কেমন একটা করে উঠলো ফাল্গুনীর বুকে। জাগ্রত কেমন অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। দৃষ্টি থেকে ঠিকড়ে পড়ছে সন্দেহের আলো। জাগ্রত কেমন করে যেনো আবার চোখ ফিরিয়েও নিলো। ভালো লাগলো না ফাল্গুনীর। নিজেকে কথা শুনিয়ে দিলো চারটে। এভাবে প্রশ্ন করা মোটেও উচিত হয়নি। নিজেই নিজেকে শাষালো কিছুক্ষণ। তারপর জাগ্রত কে বললো,

“আমি বোধ হয় একটু বেশি বলে ফেললাম। আসলে ওনার মৃত্যু….”

“মায়ের মৃত্যু নিয়ে তুমি কি আমায় অবিশ্বাস করো ফাল্গুনী?”

“আপনি ভুল বুঝছেন। আপনার মায়ের মৃত্যু সম্পর্কে আমি তেমন কিছু তো জানি না তাই জিজ্ঞেস করেছিলাম। থাক এ বিষয় বাদ দিন। এ মুহুর্তে এর বেশি আর না এগোনোই ভালো। আমার খিদে পেয়েছে। একসাথে খাবো চলুন।”

“ফাল্গুনী”

“বাকি কথা পরে হবে। আগে নিচে চলুন।”

জাগ্রত ফাল্গুনীর হাত ধরে আঁটকে দিলো। হাতে হাত রেখেই একটু কাছে এগিয়ে দাঁড়ালো। তারপর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, “এবার চলো”।

___________________

“ড্রয়িংরুমের শোভাবর্ধক হিসেবে সজ্জিত শুভ্র নির্মল সোফায় বেমানান বসে আছে নিসান বাবু। তার শোভা তো বউয়ের কোলে। সোফায় বড্ড বেমানান লাগছে যে!”

“তুমি চুপ করবে গো! ও তোমার থেকে বয়সে কতো ছোট সে খেয়াল আছে? বুড়ো একটা!”

রাতের খাবার খাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরও নিসান রুমে না গিয়ে সোফায় বসে টিভি দেখছিলো। গৌরব তাই দেখে শা’লা জামাইবাবু সম্পর্কের সদ্ব্যবহার করে টিপ্পনী কাটছিলো দাঁত কেলিয়ে। কথার মাঝখানে বৌয়ের বাঁধ সাধা দেখে বিজ্ঞ মনীষাদের মতো ভঙ্গিমা করে বলে উঠলো,

“ছোট বলেই তো সম্পর্কে শা’লা। আর শা’লা বলেই তো খোঁচা মেরে দিই জ্বালা। আহা কি কবিতা! কেয়া বাত, কেয়া বাত! কিন্তু বুরো যে বলছো, বুরোর সাথে প্রেম কেনো করতে গেছিলে শুনি? আমি কি তোমার গলায় ছুড়ি ধরে বলেছিলাম আমার প্রেমপত্র গ্রহণ করতে? তাও আবার তোমার ভাইয়ের হাত থেকে।”

“কোথায় কি বলতে হয় সেই জ্ঞান কি তোমার কোনদিনই হবে না? এই নিসান যা তো রুমে যা। কাল সকাল সকাল না বের হবি বললি। এখন ঘুমো গিয়ে। আঁখি বেচারি তোর জন্য বসে আছে বোধহয়।”

“তুই তোর বুড়ো গাধা টাকে সামলা। আমাকে নিয়ে তোর ভাবতে হবে না। আর খোঁচাখোঁচি যা করার আমার সামনে থেকে সরে তারপর কর গিয়ে যা। তোদের দুজনকে একসাথে আমার জাস্ট সহ্য হয়না। তোদের দুজনকে একদিন ঠিক আমি ডিভোর্স করিয়ে ছাড়বো দেখিস।”

“আরে শা’লা! আচ্ছা, একটু সম্মান এড করি। আরে শা’লা’বাবু, নিজে হাতে চিঠি আদান-প্রদান করে প্রেম করালে যাদের তাঁদেরই কিনা ডিভোর্স করাতে চাইছো? রীতিমতো হুমকিও দিচ্ছো! যাইহোক, আমি কিছু মনে করলাম না। তোমার মনের অবস্থাটা তো আমি বুঝতে পারছি। নতুন নতুন বিয়ে করেছো কিন্তু না পারছো বউ এর কাছে যেতে, আর না পারছো দূরে সরে থাকতে। তোমার কি আর মাথা ঠিক আছে! বলি অভিমান টা এবার একটু কমাও। রাগ উশুল করে নেওয়ার হলে কাছে থেকে করো। দূরে থেকে তাকে কষ্ট দিতে গিয়ে তো নিজেও কষ্ট পাচ্ছো। বরং তার থেকে বেশিই পাচ্ছো।”

“তুই তোর বুরোটাকে নিয়ে এখান থেকে যাবি দিদি? নাকি আমিই চলে যাবো?”

দোলা গৌরবকে জোর করে টেনে নিয়ে চলে গেলো সাথে সাথেই। নিসান ও উঠে দাঁড়ালো রুমে যাবে করে। দু পা আগাতেই পিছন থেকে আবার গৌরব ফিরে এসে দুষ্টুমি গলায় বলে উঠলো,

“শা’লা দেখছি সোফার কোল ছেড়ে বউ এর কোলে যাচ্ছে। ইশ! আরও একটু আগে চলে আসতাম যদি, তাহলে বুঝি আরও আগেই ঢুকে যেতে বউ এর রুমে? সরি গো শালাবাবু। টাইম ওয়েস্ট করিয়ে দিলাম। যাইহোক, গত রাতটা তো রাগে রাগেই পার করেছো যা বুঝলাম, আজকের রাতটা….”

শেষ কথাটা কোনরকমে মুখ দিয়ে বের করতেই নিসানের তাড়া খেয়ে গৌরব নিজের রুমে গিয়ে দরজা দিয়ে দিলো। তাকে আর পায় কে! যেন হাওয়া হয়ে গেলো এক মুহুর্তে।

____________________

হাসি রাণী পাকঘরের এক কোনে বসে বসে কাঁচা মরিচ এর বোট বেছে রাখছে। রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে হাট থেকে কিনে আনা শাক-সবজি গুছিয়ে রেখে তারপর বসেছে মরিচ এর বোট বাছতে। বোট না বেছে একটা রাত রাখলে মরিচগুলো পঁচে গলে যাবে না। পরের দিন সকালে কাজের ফাঁকে একসময় বাছলেও হবে। কিন্তু গোলাপি রাণী যদি দেখে কোন একটা কাজ অসম্পূর্ণ রেখে ঘুমোতে গেছে তার বড় ছেলের বউ তাহলে পুরো রাতের ঘুম হারাম হবে বাড়ি সুদ্ধো মানুষের। তাই নিজের শরীরের সমস্ত ক্লান্তি ঝেড়ে মুছে এতো রাত করে হলেও শেষ দিচ্ছে খুটিনাটি সব সাংসারিক কাজকর্ম। এর মধ্যেই পাকের ঘরে পদার্পণ করলো সুভাষ চন্দ্র। সাদা পাটখড়ি ভিড়িয়ে বেরা দেওয়া ছোট্ট ঘরটা সুভাষ চন্দ্রের পায়ের ধুলি পেয়ে যেনো ধন্য হয়ে গেলো। ঘরটাও যেনো চেনেনা সদ্য পদার্পণ করা মানুষটাকে।

টিপটিপানো হারিকেনের আধো আলোয় স্পষ্ট হলো হাসির মুখের ভীতসন্ত্রস্ততা। কত বছর পর পাকের ঘরটায় পা রাখলো তার স্বামী তার হিসেব-নিকেশ মনের মধ্যে ঘটে গেলো এক মুহুর্তেই। বিয়ের পর প্রথম বছর পর্যন্ত প্রায়ই এসে বসে থাকতো মানুষটা তার সাথে পাকেরঘরে। একটু একটু আলাপ জমাতো। মুখে সদাসর্বদা লেগে থাকতো কুরুচিপূর্ণ প্রসঙ্গ। শুধু দৃষ্টি দিয়ে হাসির সারা অঙ্গ ঝাঁঝিয়ে কচলেও শান্তি মিলতো না। মুখ নিঃসৃত বিশ্রী বাক্য দিয়ে টলিয়ে যেতো সুযোগ পেলেই। যা হাসির পছন্দ হতো না মোটেও। ঘৃণা হতো মনে। কথা আর দৃষ্টিতে সে খুঁজতো ভালোবাসা কিন্তু তা সে পেতো না। কখনোই পেতো না। তাই তো সে তার স্বামীর সাথে প্রথম থেকেই ভাব জমাতে পারেনি। সেজন্যে গোলাপি রাণীর তোপ-ও বেড়ে গেছে দিনকে দিন। স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক যদি হয় নড়বড়ে তবে কি আর সেই সংসারে কোন কদর থাকে বৌয়ের? থাকে না!

সুভাষকে দেখে হাসির মনে ভয় হচ্ছে। তার মন বলছে ভালো কোন উদ্দেশ্যে তার স্বামী এতো বছর পর এ ঘরে পা রাখে নি। শোবার ঘরে হয়তো অনেক্ক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলো। অপেক্ষার অবসান না হওয়ায় চলে এসেছে এ পর্যন্ত। আজ আচমকা এতো কিসের জন্য অধৈর্য্য হলো তার স্বামী তা বুঝে উঠলো না হাসির ভীতিগ্রস্ত মন। সুভাষ ও এসে দাঁড়ালো তো দাঁড়ালোই। কেমন যেনো চুপ মেরে দাঁড়িয়ে আছে। হাসি হাত না থামিয়ে কাজ শেষ করতে লাগলো। পাত্তা দিলো না সামনে দাঁড়ানো মুর্তিমান অমানুষটাকে। সুভাষ দাঁড়িয়ে থেকে হাসির কাছে পাত্তা না পেয়ে গলা খেঁকিয়ে উঠলো। হাসি দু-হাতে মরিচ এর বোট আলাদা করতে করতেই মাথা তুলে চাইলো উপর দিকে। দু’হাতে মরিচ থেকে বোট তো নয় যেনো সুভাষ এর মাথা থেকে শরীর আলাদা করছে। তারপর মাথা ছুঁড়ে মারছে একদিকে আর শরীর টা ছুড়ে মারছে আরেক দিকে। হয়তো হাসির মনোভাব বর্তমানে তাই!

সুভাষ “হাসি” বলে ডেকে উঠলো। বলল,

“কতা আছে ঘরে নু।”

হাসি মরিচ বাছায় মনোযোগ রেখে বলল

“আপনে ঘরে যান আমি আইতাছি। এইডি বাছলেই কাম শ্যাষ।”

“তুই থুছে! পারলে কাইল করবি নইলে ফালাইয়া দিবি। আমি তরে আবার আইনা দিমু। এহন কি আর আমার টেকার অভাব হইবো রে। তুই আয় দেহি।”

সুভাষ টেনে নিয়ে গেলো হাসিকে। ঘরে নিয়ে খাটের উপর বসিয়ে দিয়ে দরজার কপাট জোড়া লাগিয়ে দিলো। হাসি মনে মনে উপরওয়ালাকে শরণ করতে লাগলো। মন টা বড্ড কু গাইছে।

সুভাষ খুব আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এসে হাসির পাশে বসলো। উথলানো খুশি মুখাবয়ব নিয়ে বলল,

“আমি এহন কয়ডা কতা কমু তুই আগে হুনবি। পুরা কতা হুইনা তারপর চাপা খুলবি। মধ্যেহানে বাউ আত ডুকাবি না। আর আরেকটা কতা, তুই কিন্তু মা***গি ভুলেও এইডা মনে করবি না যে আমি সুভাষ চন্দ্র তোর কাছে অনুমতি নিবার আইছি। ভুলেও না। আমি খালি তরে জানাবার আইছি। হাজার হইক, মেয়াডা তো তুই জন্ম দিছস। তাই কাম হারবার আগে তরে জানাইতে আইছি। বাছ, এইহানিই! তার বাইরে আর কিছুনা।”
#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_২৩

“আমি এহন কয়ডা কতা কমু তুই আগে হুনবি। পুরা কতা হুইনা তারপর চাপা খুলবি। মধ্যেহানে বাউ আত ডুকাবি না। আর আরেকটা কতা, তুই কিন্তু মা***গি ভুলেও এইডা মনে করবি না যে আমি সুভাষ চন্দ্র তোর কাছে অনুমতি নিবার আইছি। ভুলেও না। আমি খালি তরে জানাবার আইছি। হাজার হইক, মেয়াডা তো তুই জন্ম দিছস। তাই কাম হারবার আগে তরে জানাইতে আইছি। বাছ, এইহানিই! তার বাইরে আর কিছুনা।”

“যা জানি তা কওন লাগবো না। যা জানি না হেইডা কন। আমার মেয়ারে নিয়া আপনের কি কতা? আমার মেয়া এহন অন্যের ঘরের লক্ষ্মী। তারে নিয়া আপনের না চিন্তা করোন লাগবো আর না…”

হাসি কে তার কথার ইতি টানতে না দিয়ে মাথায় শক্ত হাতের এক থাবা বসিয়ে সুভাষ হুঙ্কার ছেড়ে বলল,

“হেই চাপা খুললিই মা***গি! কইছি না আগে পুরা কতা হুন। আমি তর বড় মেয়া নিয়া কমু কিরে? ও আমার মেয়া না। ও মরুগগা। মইরা ভাইসা যাইক আমার তাতে ঠেকা না। আমি কতা কমু লাকি রে নিয়া। ওরেও তো আমিই জন্ম দিছি তাই ওরে নিয়া কতা কওয়ার অধিকার আমার আছে। আমি দয়া কইরা ভিক্ষা দিছিলাম তর বোইনেরে। পালবার দিছিলাম তার কাছে আমার ছোট মেয়াডারে। শা/লী আঁটখোড়া! পুলাহান জন্মাইতে না পাইরা পাগল হইছিলো। এদিক আবার তুই মেয়ার পর মেয়া জন্মাইতাছিলি, তাই আমার ঘারের বোঝাও কমাইছিলাম আর ওই শা’লীর ও সংসার বাঁচাইয়া দিছিলাম। এহন আমার মেয়া আমার ফেরত চাই। আমার মেয়া আমি বিয়া দিমু। কাইল যাবি তর বোইনের বাড়ি। লাকিরে নিয়া আবি কাইলকাই। রতনের লগে বিয়া দিমু ওরে। এতো ভালো পাত্র আমি কোনমতেই হাতছাড়া করমু না। সোনার আংটি বেহা হইলেও তা সোনাই। তার দাম কোনহান দিয়া কমে না। রতন অইলো একখান ভাঙা সোনার আংটি। ওই সোনার আংটি আমি ছাড়মু না। হাতে না উঠুক, পকেটে তো উঠপো! আমি পকেটেই উঠামু।”

হাসি হতবিহ্বল দুর্বল নজরে তাকিয়ে রইলো তার স্বামী নামক পশুটার দিকে। একজন পুরুষ মানুষ খারাপ, জঘন্যতম স্বামী হতে পারে কিন্তু বাবা হিসেবেও কি ততটাই খারাপ হবে? কই তার বাবাকেও তো দেখতো তার মায়ের গায়ে হাত দিতে। যখন তখন যার তার সামনে খারাপ আচরণ করতে। কিন্তু বাবা হিসেবে তো তার তুলনা ছিলনা। যতদিন বেঁচে ছিলো প্রাণপণে প্রচেষ্টা করে গেছে তার আদরের কনিষ্ঠা কন্যা হাসির মুখ থেকে যেনো হাসি না দূর হয়। কত আগলে রাখতো তাকে বাবা নামক মানুষটা। তাহলে এ মানুষটা কেনো এমন? নিজের সন্তানদের প্রতিও কোন মায়া নেই, আহ্লাদ নেই, চিন্তা নেই। মনে শুধু নিজের স্বার্থসিদ্ধি করে নেওয়ার সংকল্প মজুদ করা।

সুভাষ পিঠ ফিরিয়ে শুয়ে পড়েছে। তার আর কোন কথা বাকি নেই। সে এখন নিশ্চিন্ত। তার ভাবনা যেভাবেই হোক হাসিকে দিয়ে হাসির বোনের কাছে পালতে দেওয়া তার ছোট মেয়ে লাকিকে আনিয়ে রতনের সাথে বিয়ে দেবে। তাহলে তার রাস্তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। উদ্দেশ্য সফল হতে দেরি হবে না আর। লাকি তো ওর মায়ের মতই আগুন সুন্দরী। আঁখির রূপ তো তার ধারে কাছেও না। আঁখির থেকে বহুগুণ রূপসী আর চুপচাপ-ও বটে। শুধু বয়সটাই যা কম। সবে ষোল বছর পড়লো বোধহয় এই দূর্গা পূজায়। সেসময়ই তো হয়েছিলো মেয়েটা। সুভাষ চন্দ্রের মনে পড়লো দশমীর এক সন্ধ্যায় জন্ম হয়েছিলো লাকির। তাতে কি? হাসিকে তো সে চৌদ্দ বছর বয়সে বিয়ে করে ঘরে তুলেছিলো। সে তো দিব্বি সংসার করে গেছে। লাকি তো সে অনুযায়ী আরও বড়। ও আরও ভালোভাবে পারবে। সুভাষ চন্দ্র এসব আকাশ-পাতাল ব্যবধানের চিন্তা-ভাবনা করতে করতে একসময় নাসিকা ইঞ্জিনচালিত মোটর গাড়ী স্টার্ট করে তলিয়ে গেলো ঘুমে। হাসি বসে রইলো স্তব্ধ হয়ে। উপায় খোঁজার চিন্তা নিয়ে প্রার্থনা করতে লাগলো বিধাতার কাছে নিজের নারী ছেড়া ধন-কে বিপদমুক্ত করার জন্য। রতন নামক বিপদ টা কি তবে জেঁকেই বসবে? কি করে বাঁচাবে মেয়েটাকে?

_____________________

দরজার কপাটে হেলান দিয়ে দু’হাতে দু পকেট দখল করে দাঁড়িয়ে আছে নিসান। শাড়ী পড়া এক রমনীর অবয়ব দর্শন করছে দুনয়ন ভরে। বউটা তার শাড়ী পড়েছে। ভাবতেই কেমন একটা ভালো লাগার হাওয়া বয়ে যাচ্ছে শরীর জুড়ে। এই প্রথম তাকে শাড়ী পড়া দেখলো সে।এতোক্ষণ সে ড্রয়িংরুমে বসে ছিলো আঁখির উপর রাগ করে নয়। আঁখির উপর তার মোটেও রাগ নেই। দু’দিন একটু রাগ দেখিয়েছে আঁখিকে শাস্তি দিতে। যাতে ওমন কথা আর কখনো মাথায় না আনে। আসলে এতোক্ষণ রুমে না আসার কারণ হলো গৌরব। শা’লা জামাইবাবু দু’জনের মধ্যে যা সম্পর্ক তাতে গৌরবের সামনে দিয়ে রুমে এসে দরজা দিতে গেলে যে নিসানকে সে তার কথার পাঁচ মেশালি ডিটারজেন্ট দিয়ে কেচেকুচে ধুয়ে শুকিয়ে তারপর ছাড়বে, তা সে বেশ ভালোই জানতো। তাই অপেক্ষা করছিলো কখন দোলা আর গৌরব রুমে চলে যাবে। তারপর সে ঢুকবে নিজের রুমে। কিন্তু যেই কি সেই! গৌরব মটকা মেরে পড়ে রইলো নিসান এর সাথে। গেলো না রুমে ঘুমোতে। আর খোঁচাতে লাগলো নিসানকে একেবারে কব্জা করে। শেষমেশ এতো সাধনার পর রুমে এসে বউকে শাড়ী পড়ে পিছন ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শরীর আর মন দুয়ের ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। নিসান হাসি মুখে পা বাড়ালো রুমের ভেতর। রুমটাও সল্প পরিমাণে তাজা লাল গোলাপ আর রজনীগন্ধা দিয়ে সাজানো। তবে গতকালকের মতো অতো সাজসজ্জা নয়। পরপর দু’দিন সাজানো হলো রুমটাকে। কাজটা নিশ্চিত গৌরবের-ই হবে। এজন্যই এতো খোঁচাচ্ছিলো।

নিসান এর দুরন্ত পা-এর চলন্ত গতি এসে থামলো একেবারে আঁখির সম্মুখস্থ হয়ে। কিন্তু যেই হাসি নিয়ে সে পা বাড়িয়েছিলো আঁখির পানে, সে হাসি মিলিয়ে গেছে তার পা থেমে যেতেই। আঁখি নতমস্তকে দাঁড়িয়ে আছে। লজ্জা লেপ্টে আছে চোখেমুখে। পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে দু’হাতের নখের সাথে। নখে আঙ্গুলে যুদ্ধ চলছে ছোট পরিসরে। যেনো আজ হাতের নখ গুলো না ভাঙলেই নয়। আঙ্গুল গুলো ভাঙতে পারলো তো যেনো বিশ্বজয় করে নেবে।

নিসান বিরক্তির এক শ্বাস টেনে নিলো। শ্বাস ছাড়লো দ্বিগুন বিরক্তির সহিত। আঁখির দিকে চেয়ে রইলো সময় নিয়ে। তারপর অদ্ভুত মুখ করে বলল,

“শাড়ী পড়েছো ভালো কথা। খোপা করে তাতে গোলাপের বাগান বসিয়েছো তাতো আরও ভালো কথা। কিন্তু দু-হাতে আবার চুরি ভরেছো গিজগিজিয়ে। গলা থেকে শুরু করে পেট পর্যন্ত ঝুলছে গুটিকয়েক পাঁচ মিশেলি হার। কানের দুলের সাইজ দেখে মনে হচ্ছে ওটাও হাতে পড়ে নেওয়া যাবে অনায়াসে। শুধু মাঝের পর্বত সাইজের সাদা পাথরটা খুলে নিলেই আস্ত একটা চুরি হয়ে যাবে। আর চোখে মুখে তো মেক-আপ এর ঢল নেমেছে মনে হচ্ছে। আর চোখের পাপড়ি! ওগুলো তো একেবারে খেজুর গাছের আগাছা বলেই ধরে নেওয়া যায়। যা না কাটলেই নয়। আর সেই আগাছার উপরে আবার শেওলা-ছাতার চর পরেছে মনে হচ্ছে। গাল আর নাকের দুপাশে তো যেনো ‘চিকচিক করে বালি কোথা নাই সাদা’ টাইপ কথার প্রয়োগ করেছো। আর ঠোঁটটাকে তো ব্যবহারের অযোগ্য করে রেখেছো। বলি ওটা কি তোমার ঠোঁট নাকি আমার বাড়ির দেওয়াল? যে এমন ঘষেমেজে পেইন্টিং করে রেখেছো! আমি এসব ছাইপাঁশ গিলতে পারবো না! যাও এক্ষুনি স্নান করে এসো। মুখে কৃত্তিম যেনো একটু কিছুও অবশিষ্ট না থাকে। গলার পাশ দিয়ে ভালোভাবে সাবান লাগাবে। সেখানেও তো ঘষামাজা বাদ যায় নি। আর হ্যাঁ! স্নান করে আবার শাড়ীই পড়বে।”

আঁখি হতবিহ্বল। চোখেমুখে লেপ্টানো অভিমানী আদোল। খানিক বিস্ময়াহত প্রতিবিম্ব নিয়ে চেয়ে আছে। সে তো এক বুক ভরা খুশি-মন নিয়ে বসে ছিলো নিসান এর জন্য। আর সাজগোছ তো সে নিজে নিজে করেনি, সাজিয়েছে তো সিমি। সে সাজ এর অতো কিছু চিনলে তো সাজবে! দেখা তো দূর। আর ঘরটাও সাজিয়েছে গৌরব তার ভাইবোন সৌম্য আর সিমিকে নিয়েই।

আঁখি সোজা হেঁটে ঢুকে পড়লো বাথরুমে। এক মুহুর্তও সময় নষ্ট করলো না নিসান এর সম্মুখস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে। মনটা ভীষন রকমের খারাপ হয়ে গেলো এক নিমিষেই। সাজগোজ কারও এতোটা অপছন্দ হতে পারে নাকি? কেমন উদ্ভট সব বর্ণনা দিলো। যেনো সে সঙ সেজেছে বউ নয়।

______________________

জাগ্রত ফাল্গুনীর এক হাত মুঠোয় ভরে আরেক হাতে ফোন কানে নিয়ে নিসান এর সাথে কথা বলতে বলতে ধীর পায়ে নামছে। নিসান আঁখিকে স্নান করাতে বাথরুমে পাঠিয়ে দিয়ে একলা বসে ছিলো রুমে। তাই জাগ্রতকে ফোন দিয়ে অপেক্ষার সময় টা কোনমতে শেষ করছে।

জাগ্রত ছাঁদের শেষ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে না নামতেই দেখতে পেলো তাদের রুমের দরজার সিটকিনি খোলা। বাইরে আবার দু’জোড়া জুতো রাখা। জাগ্রত নিসান এর সাথে কথা শেষ করে ফোনটা রেখে দিয়ে ভাবুক চেহারায় এগিয়ে গেলো রুমের ভেতরে। ফাল্গুনী পা বাড়ালো না জাগ্রত-এর সাথে। দাঁড়িয়ে রইলো ঠায়। সে বুঝতে পারছে জাগ্রতর কাছের লোকদের মাঝে কেউ এসেছে। নয়তো তালা খুলবে কে। চাবি তো সে হাতে করে নিয়ে গেছিলো ছাঁদে যাওয়ার সময়।

ফাল্গুনীর সংকোচনীয় মনটা কেমন পালাতে চাইছে। মনে হচ্ছে এ জীবনে আর কারও সম্মুখীন না হতে হতো তাহলে জীবন টা সহজ হতো। শুধু সে আর জাগ্রত মিলে কাটিয়ে দিতো পুরো জীবনটা। ফাল্গুনী ভেতরে যাবে কি যাবে না করে পিছু ফিরতেই কেউ একজন পিছন থেকে এসে জড়িয়ে নিলো আপন আলিঙ্গনে। ফাল্গুনী চকিতে পিছু ফিরে দেখতে পেলো ছোট একটা বাচ্চা মেয়ে জাপটে ধরেছে তার কোমর। বয়স আনুমানিক তিন বছর হবে হয়তো। মাথার চুলগুলো দু’পাশে দুই ঝুঁটি করা। পড়নে পা পর্যন্ত রঙীন একটা ফ্রক। মুখে কোন কথা নেই। শব্দগুলো যেনো চোখ উপচে পড়ছে। কি মায়াবি চাহনি।

জড়ো হলো সেখানে আরও তিন জোড়া পা। ফাল্গুনী চেয়ে দেখলো জাগ্রতর সাথে দাঁড়িয়ে আছে জিনিয়া আর একজন অচেনা কেউ। ফাল্গুনী মনে মনে হিসেব কষে নিলো হয়তো জিনিয়ার বর হবে লোকটা। জাগ্রত ফাল্গুনীকে ঘরে আসতে বলল। জেমি তার ছোট্ট হাত দুটো দিয়ে টেনে নিয়ে এলো ফাল্গুনীকে ঘরের ভেতরে। একে একে সবাই ঘরে চলে এলে জাগ্রত দরজা লাগিয়ে দিয়ে ফাল্গুনীর পাশে বসে গেলো সোফায়।

“কেমন আছো বৌমনি?”

জিনিয়ার প্রশ্নে ফাল্গুনী একটু হেসে জবাব দিলো, “ভালো। তোমরা কেমন আছো?’ জিনিয়া খানিক ঠোঁট এলিয়ে শুধু মাথা নেড়ে সায় জানালো।

জবাব দিয়েও যেনো শান্তি মিললো না ফাল্গুনীর। মনে হলো তারই তো প্রথমে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিলো। কিন্তু কথাই তো আসছে না মুখে। জিনিয়ার মেয়ে জেমি আর তার বর পার্থ-এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো জাগ্রত। পরিচয় শেষে জাগ্রত পার্থকে বলল,

“তোমরা এতো রাত করে এলে যে? কাল সকালে আসলেই তো পারতে।”

জবাবে জিনিয়ার আগে আগে পার্থ বলল,

“বৌমনিকে দেখার জন্য আপনার বোন পাগল প্রায় হয়ে গেছিলো। কত করে বললাম কাল সকাল যাবো কিন্তু তাতে সে রাজিই হলো না। ধরে বেঁধে নিয়ে এলো আমাকে এই রাত করে। আর আপনিও আছেন দাদা, সারাদিন পার করে এই সন্ধ্যার সময়ই জানাতে হলো আপনাকে? আরও আগে জানাবেন না এমন সুখবর।”

জাগ্রত ঠোঁটে কিঞ্চিৎ হাসি ধরে রেখে বলল,

“আসলে ফিরে এসেই ছুটতে হয়েছে অফিসে। তাই মাথায় ছিলো না বিষয়টা। সন্ধ্যায় মনে হতেই ফোন করেছিলাম তোমায়। ভেবেছিলাম হয়তো সকালে আসবে তোমরা। পরের দিন শুক্রবার-ও ছিলো আরকি।”

জাগ্রত আর পার্থ আরও কিুছু টুকটাক কথা বলতে লাগলো। মাঝে খাওয়ার কথা বলে ফাল্গুনী। তাতে জানায় তারা তিনজন খাওয়া দাওয়া শেষ করেই এসেছে। জেমি খেতে চেয়েছিলো বাইরে তাই রাতের খাবারের পাট চুকিয়ে তবেই প্রবেশ করেছে জাগ্রতদের বাসায়। পুরো রুমের মধ্যে শুধু জাগ্রত আর পার্থই কথা চালিয়ে গেলো। ফাল্গুনী, জেমি আর জিনিয়া রইলো একেবারেই চুপচাপ।

পার্থ চলে গেলো বিশ মিনিটের আলাপচারিতা শেষ করে। রইলো না কোনভাবেই। জাগ্রতও জোর দিয়ে বলতে পারলো না থাকার কথা। তার বাসায় বেডরুম তো একটাই। থাকতে দেবে কোথায়। আর তাছাড়া মায়ের মৃত্যুর পর কখনোই আর জিনিয়া বা পার্থ আসে নি তার বাসায়। খোঁজ খবরও তেমন নিতো না কেউ কারও। না জিনিয়ার পক্ষ থেকে আর না জাগ্রতর পক্ষ থেকে যেতো খুব একটা ফোন কল। সবাই সবার জীবন নিয়ে বুঁদ ছিলো। জাগ্রত তাই প্রথমে বড় ফ্ল্যাট ভাড়া নিলেও পরে তা ছেড়ে দিয়ে ছোট একটা এক বেডরুমের ফ্ল্যাট খুঁজে নেয়। বড় বাসা পরিষ্কার করতেও ভীষণ জ্বালা যে।

পার্থর হটাৎ আজ জিনিয়াকে নিয়ে তার বাসায় আসার ঘটনার থেকেও বেশি ভাবালো জিনিয়াকে রেখে যাওয়ার ঘটনা। জাগ্রতর মনে একটু খুঁত সৃষ্টি হলো চিন্তাটা নিয়ে।

ফ্ল্যাটে মারা তালাটা আগের বাসায়ও ছিলো। তাই চাবিটাও জিনিয়ার সংগ্রহে ছিলো আগে থেকেই। সেই সূত্রে রুমে ঢুকতেও কোন সমস্যা হয়নি তাদের।

ফাল্গুনী আর জাগ্রত মিলে রাতের খাওয়া শেষ করে ড্রয়িংরুমে বিছানা পাতানোর কাজে নেমে গেলো। বিছানা পাতানো শেষ হলে জিনিয়া জেমিকে নিয়ে বিছানা দখল করে নিলো তৎক্ষনাৎ। জেমিকে শুতে বলে জিনিয়া ফাল্গুনীকে বলল,

“আমি জেমিকে নিয়ে এখানেই থাকবো বৌমনি। তোমরা রুমে যাও। শুয়ে পর।”

কথা বলতে বলতেই শুয়ে পড়লো জিনিয়া। ফাল্গুনীকে কিছু বলার সুযোগ অবধি দিলো না। সে বিছানা করেছিলো নিজেদের জন্য। ভেবেছিলো জিনিয়া আর জেমি তো মেহমান হয়ে এসেছে তাদের কি করে ড্রয়িংরুমে রেখে ভেতর ঘরে ঘুমোবে তারা দুজন। একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলো জাগ্রত। ফাল্গুনী জাগ্রতর মুখপানে চাইলো। সে-ও ইশারা করে বললো চলে আসতে। ফাল্গুনী জেমিকে গুডনাইট বলে চলে এলো নিজ রুমে।

“জিনিয়ার সাথে কি আপনার সম্পর্ক ঠিক নেই?”

রুমে আসার পর কিছুসময় চুপ ছিলো ফাল্গুনী। তারপর আচমকা ভাবুক চেহারায় প্রশ্ন ছুড়লো জাগ্রতর উদ্দেশ্যে। জাগ্রত ফাল্গুনীর দিকে ফিরে না তাকিয়েই বলল,

“সম্পর্কই ছিলো না; প্রায়!”

শেষ শব্দটা অতুল দীর্ঘশ্বাস টেনে নিয়ে বলল। ফাল্গুনী জিজ্ঞেস করল,

“কি বলছেন এসব? আর পার্থ দা কি সত্যি শুধু আমি এসেছি বলেই এতো রাত করে এসে রেখে গেলো জিনিয়াকে? আমার কেনো সবটা স্বাভাবিক লাগছে না?”

“পার্থ যে স্বাভাবিক ভাবে শুধু তোমার উদ্দেশ্যে আসে নি জিনিয়াকে নিয়ে সেটুকু হলফ করে বলতে পারি। কিন্তু কেনো এসেছে তা জানি না।”

~চলবে
~চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here