পূর্ণশশী পর্ব -০৫+৬

#পূর্ণশশী (রিপোস্ট)
পর্ব-৫+৬
ফারহানা আক্তার রুপকথা
____________________
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আমি অংশদের ল্যাব এর বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে রেখেছি৷ আর বিড়বিড় করে বলছি,

”আয় বৃষ্টি জোরে,, চুমু দেবো তোরে

একটু জোরে এলে
হাত দু’টো মেলে,,

ভিজবো আম…..

“এই পাগলি কি বলছো এগুলো?”

আরো কিছু বলার আগেই অংশ আমার মাথায় পেছন থেকে গাট্টা মেরে সামনে এসে প্রশ্ন করলো।

“উফ, অংশ দিলে তো মাথাটা ফুটো করে আমার।এভাবে কেউ মারে?”

মাথায় হাত ঘষতে ঘষতে বললাম বিরক্তি নিয়ে। এই ছেলেটা সবসময় আমার গুরুত্বপূর্ণ কাজ গুলোতেই সবসময় বাঁধা প্রয়োগ করে। কবে থেকে ভাবছি বৃষ্টিতে ভিজবো কিন্তু একদমই সময়, সুযোগ হয়ে উঠে না৷ আজ আমার ক্লাসও শেষ আবার বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। সূবর্ণ সুযোগ হয়ে যাবে আজকে বৃষ্টিটা একটু বাড়লেই। তাইতো হাত বাড়িয়ে সন্ধি করার চেষ্টা করছিলাম বৃষ্টির সাথে ছন্দ মিলিয়ে। কিন্তু অংশ সাহেব সেটা আর হতে দিলো না।

-কি ব্যাপার শশী ল্যাব এর সামনে এসেছো কেন?

-বাহ রে! এখানে কেন আসি আমি? অবশ্যই তোমার জন্য।

“তোমার ক্লাস শেষ? আর তোমাকে তো বলেছি আমার জন্য অপেক্ষা করতে হলে ক্যান্টিনে করবে। আমায় টেক্সট করে দিলেই তো হতো। তুমি জানো না হৃদয় তোমাকে দেখলেই লাইন মারার চেষ্টা করবে তবুও এখানেই কেন আসতে হবে?”

অংশ রেগে রেগে বলল কথাগুলো। আমার পাগল সাহেব রেগে গেছেন তা দেখে আমি আশে পাশে একবার দেখে নিয়ে হুট করেই জড়িয়ে ধরে পা উঁচিয়ে আলতো করে চুমু খেয়ে নিলাম তার গালে। এমন হুট করে চুমু খাওয়ায় অংশ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গালে হাত দিলো নিজের। আর আমি তো লজ্জায় আবার বারান্দা থেকে বাইরে তাকালাম৷ সামনে একটু দূরে ক্যাম্পাসের শিমুল গাছের নিচে পূর্ণ দাঁড়িয়ে আমাদেরই দেখছে৷

“শশী সরে দাঁড়াও গাড়ি আসছে তো।”

রানু আন্টি আমার হাত ধরে টেনে ফুটপাতে উঠিয়ে আনলেন আমায়। আর তখনি আমার সামনে দিয়ে সাঁই সাঁই করে একটা মাইক্রোবাস চলে গেল। ইশ, আরেকটু হলে গাড়িটা আমার উপর দিয়েই যেত। আজ সকালের নাস্তা শেষ করেই আমি আর রানু আন্টি বেরিয়েছি মার্কেটে যাবো বলে। তিনি ঘরের কিছু প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে যাবেন। প্রথমে মৌশিকে নিয়ে বের হচ্ছিলেন কিন্তু মৌশির ঘরকন্নার কাজকর্ম, জিনিসপত্রের ব্যাপারে একদমই জ্ঞান নেই। আমার যে অনেক আছে তা নয় তবে মায়ের সঙ্গে প্রায়ই কেনাকাটা করতে যাওয়ার দরুন এসব ব্যাপারে কিছুটা ধারণা আছে৷ আর মৌশি তো কোটিপতি বাবার মেয়ে হয়তো গ্লাসে জল ভরাটাও তার আয়ত্বে ছিলো না। আর তাই আমি এসেছি কিন্তু সিগন্যাল এর অপেক্ষা করছিলাম রাস্তা পার হবো বলে। কিন্তু অতীতের ভাবনায় হঠাৎ এতোটাই বিভোর হয়েছিলাম যে কখন ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছি খেয়াল নেই। হয়তো রানু আন্টি না থাকলে এতক্ষণে চাপা পড়তাম। অবশ্য এতে বেশ ভালোই হতো৷ আমার এক্সিডেন্টে অংশের মনে চলা ভাবনারা তো সামনে আসতো। কি করতো অংশ? সে কি কষ্ট পেত আর আমি যদি এক্সিডেন্টে মরে যেতাম, তবে কি কান্না করতো অংশ আমার জন্য? আমার ভাবনারা অবাধ্য হয়ে আবারও অংশকেই নিয়ে ভাবছে৷ আমি আসক্ত অংশের নেশায় আজও তবে কেন করলাম পূর্ণকে বিয়ে? প্রতিশোধ নিতে! ভালোবাসায় কি আদৌ শোধ প্রতিশোধ থাকে? আর এখানে কি অংশের কষ্ট বলে কিছু হবে নাকি ওই বোকার মত ছেলেটা কষ্ট পাবে আমার ভুলের জন্য ।

“চাচা এই গ্লাস সেট এর দাম কত?”

রানু আন্টি এক সেট গ্লাস পছন্দ করেছে আর আমি বলেছি দরদাম আমি করবো। আন্টিও বললেন করো আজ নয় কাল তোমাদেরও করতেই হবে নিজের সংসার গুছাতে। আমি তো আর সারাজীবন পাশে থাকবো না। আন্টির কথায় একটু খারাপ লাগলো তবে আপাতত ইমোশন সাইডে রেখে গ্লাস দাম করবো। দোকানদার চাচা বললেন, “খালা একদাম ছয়’শ তবে নিতে চাইলে পঞ্চাশ টেকা কম দিয়েন’।

“খালা কে?”

চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম দোকানদারকে।

“আপনেরে কইছি।”

আমার দিকে ভয়ার্ত চোখে চেয়ে জবাব দিলো দেকানদার।

“ওই মিয়া ওই আমাকে কোন দিক দিয়া আপনার খালার বয়সি মনে হয়? হ্যা! চোখে কি রঙিন চশমা লাগাইছেন? আমার বয়স এখনও ত্রিশ হয়নি আমাকে বলে আমি এই ষাট বছরের বুইড়ার খালা! কিনবো না আপনার দোকানের গ্লাস। বেহুদা লোক সাহস কত্তো বড় আমাকে বলে খালা।”

রেগে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছি কথাগুলো ওদিকে অন্যান্য দোকানের লোকজন সব হা করে আমার দিকেই চেয়ে আছে। সবাই কেমন বিনোদন নিচ্ছে মনে হচ্ছে। রাগ তো আমার এমনিতেই বাড়তি তার উপর আশেপাশের সবার তাকানো দেখে আগুনে ঘি ঢালা কারবার। আবার চেঁচিয়ে উঠলাম, “ওই কি দেখছেন আপনারা এমন করে? মুভি চলে, নায়ক নায়িকা রোম্যান্স করতেছে যা না দেখলে মিস করে ফেলবেন? একদম চোখ গেলে দেবো ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকলে।”

রাগে আমার মুখ থেকে অসংগত কথাবার্তা চলে সেটা নতুন কিছু না৷ কিন্তু কথা হলো আমি যে হারে সবাইকে মেজাজ দেখিয়ে কথা বলছি তাতে নিজেই নিজেকে পাগল ভাবছি। আশেপাশের মানুষ ধীর স্বরে অনেক কিছুই বলে গেছে সেদিকে আমার খেয়াল নেই। কিন্তু রানু আন্টি যে বেশ লজ্জায় পড়েছেন তা ওনার চুপচাপ দোকান থেকে বেরিয়ে যাওয়া দেখে বুঝেছি। দশ মিনিটের ভেতরে বড়সড় একটা সাইক্লোন তুলে অর্ধেক মার্কেটে তুফান চালিয়ে এখন আমিও চুপচাপ বের হলাম। সবাই এখনও আমার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে।

দুপুরে খাবার খেতে মৌশি আমায় ডেকে গেছে। কিন্তু আমার মোটেও ঘর থেকে বের হতে ইচ্ছে করছে না। মার্কেটে গিয়ে যা করেছি তার পর আন্টি আর আমার সাথে একটা কথাও বলেননি। হয়তো রেগে আছেন আমার স্যরি বলা উচিত৷ আসলে রেগে গেলে আমার আর হুঁশ থাকে না কোন কিছুর। কিন্তু পরে মাথা ঠান্ডা হতেই সবটা ঠিক না ভুল ছিলো তা বুঝতে পারি। কিন্তু ততক্ষণে অনেকটা দেরি হয়ে যায়। এমন করেই তো পূর্ণের জীবনটা নষ্ট করলাম। আমার রাগ, আমার জেদ আর বলি হলো পূর্ণ।
মৌশি আবারও এলো ডাকতে এবার আর বসে না থেকে বের হলাম। রানু আন্টি খাবার সার্ভ করছেন ফুপুকে আর শ্বশুরবাবা কে। আমাকে দেখে কেউ কোন কথা বললো না৷ আমিও না বলে মৌশির সাথে কিচেনে চলে গেলাম। রানু আন্টি ও এলেন কিচেনে ।

“স্যরি আন্টি।”

মাথা নিচু করে বললাম। আন্টি তরকারির বাটিতে তরকারি নিচ্ছিলেন আমার মুখে স্যরি শুনে একটু দাঁড়িয়ে আবার চলে গেলেন। ফুপু আর বাবার খাওয়া শেষ হতেই রানু আন্টি ডাকলেন, “মৌশি, শশী খেতে এসো।”

মৌশি যেতেই আমিও গেলাম। চেয়ার টেনে বসেই আবারও বললাম, “আন্টি স্যরি প্লিজ মাফ করে দেন।”

বাচ্চা বাচ্চা ফেস বানিয়ে বলতেই আন্টি বললেন, “থাক আর বাচ্চা সাজতে হবে না আপনাকে দু’দিন পর বাচ্চার মা হয়ে যাবেন। আর হ্যা স্যরি দরকার নেই শুধু মাথায় রেখো স্থান,কাল, মানুষ সবটা বিবেচনা করে মুখটা চালাতে হয়। সব জায়গায় সব ব্যবহার খাটে না।”

‘হুম ‘ বলেই মাথা নাড়ালাম। বাকিটা আল্লাহ্ জানে কতক্ষণ এই ‘হুম’ বহাল রাখতে পারবো৷ এরপর টুকটাক কথার মাঝে খাওয়ার পর্ব শেষ হলো। পুরো সময় আমি আর রানু আন্টি কথা বললাম কিন্তু মৌশি একটা কথাও বলেনি। মেয়েটার মুখ ভার লাগছে। কিছু কি হয়েছে! আমার সাথে যে কয়বার কথা বলেছে ততবারই মনে হয়েছে নিজ ইচ্ছায় বলেনি বলতে চায় না৷ তবে কি মৌশি কোন কারণে আমার উপর রেগে আছে? উফ, কালরাতে তো মৌশি দাঁড়িয়ে ছিলো জানালার সামনে দেখেছিলো আমাকে অংশের পাশে৷ হুম, এটাই কারণ হবে হয়তো। আমি অপরাধী পূর্ণের ছিলাম এখন আবার মৌশিরও হয়ে গেলাম।

শীতের হিমেল হাওয়া জানালার পর্দায় নিজের দাপুটে থাবা বসাচ্ছে। শীত বুড়ি দেশ ছেড়ে যাবার পথে এই থাবায় জানালায় থাকা পর্দা ততোটা কাবু হচ্ছে না। আজও আকাশে চাঁদ উঠেছে কিন্তু তাতে আলো নেই। হয়তো আছে মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে চোখে লাগছে না আমার। কি জানি, আমার খেয়াল তো প্রকৃতির এসব অনিন্দ্য সুন্দর লুকোচরি, হাওয়ার লুটোপুটিতে নেই। আমার খেয়াল তো এই মুহুর্তে আলমারির কপাট খুলে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটির উপর। সেই কখন থেকে এপাশ থেকে ওপাশে কাপড় রাখছে আবার সরাচ্ছে। আজ অফিস থেকে ফেরার সময় আমার বাবার বাড়ি গিয়েছিলো। মা আমার লাগেজ ভর্তি কাপড়চোপড় আর দরকারি অনেক জিনিস পাঠিয়ে দিয়েছে। পূর্ণের আলমারিটা দু’কপাট এর। কিন্তু দু’পাশের এক পাশ ভর্তি কম্বল কাথা, বিছানার চাদর, পর্দা, কুশন আরো অনেক কিছু আর এক পাশ অর্ধেক ভর্তি তার নিজের স্যুট,কোট, ড্রেস আর অর্ধেকে তার ফাইলপত্র হাবিজাবি। এখন আমার জিনিসপত্র রাখার জন্য জায়গা করতেই বেচারা কখনো নিজের কাপড়চোপড় বের করছে তো কখনো কম্বল, চাদর, বালিশ। তবুও ঠিকঠাক জায়গা করে উঠতে পারছে না। মেজাজ আমার এবার খারাপ হওয়ার পথে। এই ছেলে শুধু কি হাবা এ তো এক নম্বরের গাধা। এরে ইন্জিনিয়ার বানাইছে কে আল্লাহ জানে। অফিস থেকে এসে খাবার খেয়ে লেগেছে এই কাজে। এক ঘন্টা হবার পথে এখনও এনার কাজ হলো না। জাস্ট অসহ্যকর ছেলে একটা।

“এই সরো তো আমার কাপড়ের জন্য জায়গা করবে তো! আমি করছি। এক ঘন্টা ধরে শুধু এখান থেকে ওখানে, ওখান থেকে এখানে করে যাচ্ছে কাপড়কে। অকর্মা ঢেকি কোথাকার” বলেই আমি বিছানা থেকে নেমে সোজা আলমারির সামনে গেলাম। তার কাঁধে হালকা করে ধাক্কা লাগিয়ে মাত্রই কাপড়ে হাত দিচ্ছি আর তখনই পূর্ণ মিনমিন করে বলল, “আমি তো আমার অফিসের একটা ফাইল খুঁজছিলাম।”

কিহ!

চলবে

#পূর্ণশশী
পর্ব-৬
ফারহানা আক্তার রুপকথা
______________________

পৃথিবীতে যা কিছু হয় বা ঘটে তার পেছনে সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই কোন না কোন কারণ রাখেন। আল্লাহ তা’আলা এই যে অংশকে আমার থেকে আলাদা করেছেন তার পেছনেও নিশ্চয়ই কোন কারণ রেখেছেন যা আমি এখনও বুঝে উঠতে পারছি না। আচ্ছা তবে কি পূর্ণ আমার জীবনে আছে তার পেছনেও কি কোন কারণ আছে? উফ, আমি কেন ওর কথা ভাবছি অসহ্যকর ব্যক্তি একটা। এই ফালতু ছেলের কথা ভেবে আমি কেন ঘুম নষ্ট করছি আমার ও তো ঠিকই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। হুহ, আমিও ঘুমাই বলেই ঘরের লাইট অফ করে শুয়ে পড়লাম আর পূর্ণ আজও কিছু কাগজপত্র নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেছে।

সকাল সকাল চিল্লাচিল্লিতে ঘুমটা ভাঙলো। কি আজব বাড়ি রে বাবাহ! এত সকালেই কেউ চেঁচায় এমন করে? কিন্তু কে চেঁচাচ্ছে দেখার জন্য হাই তুলতে তুলতে ঘর থেকে বের হতেই চক্ষু চড়কগাছ। পূর্ণের ফুপু ব্যাগ, বস্তা নিয়ে ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে আছেন। পাশেই আমার শ্বশুরমশাই মুখ ভার করে বসে আছেন। রানু আন্টি ফুপুর সামনেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে পূর্ণ,অংশ আর মৌশিও৷

“লও আইছে তোমাগো নবাবনন্দিনি৷ এবার কও ভাই তুমি কি কইবা। তোমার বউ এট্টু ইজ্জত দেয় কুনুমতন অংশের বউও দেয় কিন্তু তোমার ছুডু পোলার বউ আমারে দুইডা চক্ষে দেখবার পারে না৷ কাইল চা খাইতাম চাইছি দেইখা কত্তাডি কথা হুনাইয়া দিলো।”

আমাকে দেখেই ফুপু ন্যাকা কান্না জুড়ে দিয়েছে আর এসব প্রলাপ বকছে। আর এতে সবার দৃষ্টি আমার দিকে। শ্বশুরমশাই তো সেই লেভেলের রেগে গেছেন তার বোনের অভিযোগ শুনে। কিন্তু আমি তো সহজ সরল বান্দা নই পূর্ণ আর মৌশির মত। ফুপুর কথা শেষ হতেই তেড়ে গেলাম তাদের সামনে। সকাল সকাল ঘুমের মায়রে বাপ করে বুড়ি আমার নামে নালিশ করে। বের করছি নালিশ,,

“কি কি করেছি ফুপু আবার বলেন তো।”

চোখ মুখ কুঁচকে ফুপুর কাছে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করতেই ফুপু এবার বললেন, “দেখছো ভাই তোমাগো সামনেই কেমন কইরা আহে মাইয়া।”

ফুপু আরো আহ্লাদী সুরে তার ভাইকে বলছেন। শ্বশুর মশাই এবার রেগে গেলেন, “এই মেয়ে সমস্যা কি তোমার?নিজের মত করে বিয়ে করে চলে এসেছো কেউ কিছু বলেনি বলে কি যা তা করে বেড়াবে? আমার বাড়িতে থেকে আমার বোনকেই তুমি কথা শোনাও কোন সাহসে? বাড়াবাড়ি করলে এ বাড়ি থেকে বের করে দিতে আমি এক মিনিটও ভাববো না। কথাটা মনে রেখো আর এই মুহুর্তে আমার বোনের কাছে ক্ষমা চাও।”

‘কিহ!’

“কি আবার কি? যা বলছি তা করো। আর পূর্ণ তোমার বউকে বলে দিও এটা তার বাবার বাড়ি নয় এখানে দ্বিতীয়বার এমন বেয়াদবি করলে এর ফল ভালো হবে না।”

শেষের কথাটা শ্বশুরমশাই পূর্ণের দিকে তাকিয়ে বললেন। কিন্তু পূর্ণ মুখ খুলল না তবে অংশ কিছু বলতে যাচ্ছিলো বুঝতে পেরে আমিই আগে মুখ খুললাম, “এই যে শ্বশুর আব্বা শুনুন প্রথমত বিয়ে করে মেয়েরা বাবার বাড়ি থেকে একাই আসে দু’চার জন আরো নিয়ে আসে না সংসার করতে। আর দ্বিতীয়ত, আমি যতদূর জানি অংশ বলেছিলো বাড়িটা আপনার নয় উত্তরাধিকার সূত্রে আপনার বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন যা পরবর্তী কালে আপনার ছেলেরা পাবে।”

এ পর্যায়ে আমার কথা শুনে সবাই অংশের দিকে তাকিয়ে আছে আর অংশ কটমট করে আমার দিকে। পূর্ণ একবার একবার করে নিশ্চয়ই সবাইকে দেখছে কিন্তু এখানে আমার ভাববার মত কিছু নেই আমার কথা শেষ হয়নি তাই আবারও বলতে লাগলাম, “আর তৃতীয়ত, ফুপু কে আমি চা দেইনি কথা সত্যি তবে উনি পুরো কথা বলেননি উনি চা চাইছিলেন আমি বলেছি ফুপু আপনাকে দুধ গরম করে দেই চা পাবেন না। আপনার নাকি কিছুদিন ধরে হাঁটুতে ব্যাথা হয় আবার নাকি রাতে ঘুমও হয় না তাই চা নয় আপনি দুধ, খেজুর আর কিশমিশ খাবেন। কিন্তু উনি তো কথাটাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বললেন।”

আমি কথাগুলো বলার পরও আরো কিছুক্ষণ তর্ক চলল পূর্ণ চুপচাপ আমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে আর ঠোঁটে মুচকি হাসি। কিন্তু অংশ প্রচন্ড রেগে আছে ঠিক আগের মতোই। আমার উপর রাগ করার অধিকার যে তার নেই সেটা হয়তো ও ভুলেই গেছে আর এই সুযোগে মনটা বলছে এই রাগের শেষ দেখতে। আমি আরো করলাম তর্ক তার বাবার সাথে ফুপু অবশ্য চুপ হয়ে আছে অনেকক্ষণ ধরেই। কিন্তু এবার আর অংশ সহ্য করতে পারলো না আমার বেয়াদবি তার বাবার সাথে একের পর এক তর্ক করেই চলছি৷ শেষ পর্যন্ত তাই হলো যা আমি চেয়েছি। অংশ রাগ দমাতে না পেরে আমার সামনে এসে ঠাস করে কষে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিলো আমার গালে। পূর্ণ পেছন থেকে টেনে ধরলো অংশকে। উপস্থিত সবাই হকচকিয়ে উঠলো রানু আন্টি আর মৌশি ভয় পেয়ে গেছে৷ কিন্তু ফুপুর ঠোঁটে ইষৎ হাঁসির আভাস। পূর্ণের বাবাও কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলেন হয়তো তিনি এমন কিছু চান নি। আমার চোখে জল ছলছল করছে কিন্তু গড়িয়ে পড়ছে না আর আমি পড়তে দেবোও না। কিন্তু পূর্ণের গলার স্বর শুনে চোখের জল সরে রাগ ভর করলো।

“শশীকে থাপ্পড় মারলে কেন ভাইয়া?”

অংশ জবাব দিলো না পূর্ণ আবারও বলল “আমার স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার কোন অধিকার নেই তোমার।”

ফালতু হাবা হাশমত মিনমিন করে বলে আমার বউকে মারার অধিকার নেই, হুহ। তোর মত অকর্মা ভেড়াকে যে কেন বিয়ে করতে গেলাম। মন তো চাচ্ছে তোর গলা টিপে এখানেই মেরে ফেলি। তোর জায়গায় অংশ হলে তো এতক্ষণে তোর দু’টো দাঁতই ফেলে দিতো৷ রাগটাও করতে জানে না এই ভেড়া। কি আশ্চর্য ব্যাপার! এই পরিস্থিতিতেও আমার মনে আসছে অংশ কি করতো কি করতে পারে৷তাকে আমি ঘৃণা করি, জাস্ট ঘৃণা। মনের ভেতর রাগ, ক্ষোভ প্রতিশোধ দিনকে দিন বেড়েই চলছে অংশের উপর।

আজ ছুটির দিন বলে সবাই বাড়িতে। ফুপু আর ফিরে যান নি তবে মুখও বন্ধ রাখেননি৷ কিছু না কিছু বলেই চলছে কখনো মৌশিকে কখনো রানু আন্টিকে৷ আমি সকালে সেই যে ঘরে এসেছি আর বের হইনি৷ সকালে পূর্ণ নাস্তা নিয়ে এসেছে খাই নি৷ দুপুরেও খেতে ডেকেছে তখনও খাই নি। সারাদিন চুপচাপ বিছানায় পড়ে ছিলাম। পূর্ণ অনেকবার এসেছে ঘরে কিন্তু খাওয়ার জন্য ডাকা ছাড়া সে আর কোন কথা বলেনি আমার সাথে৷ তবে আঁড়চোখে বহুবার আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো আমি টের পেয়েছি৷ সন্ধ্যার একটু আগে পূর্ণ কোন কাজে বাড়ির বাইরে গিয়েছে৷ মৌশিও বিকেলে বাবার বাড়ি গিয়েছে। আজ হয়তো ফিরবে না। রানু আন্টি ফুপুর ঘরে আছেন মাগরিবের নামায পরে বসেছেন সেখানে৷ গল্প করছে ফুপু হয়তো অনেকটা সময় এভাবেই চলবে। আমি বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে গেলাম পেটে খিদের চাপ টের পাচ্ছি । মুখহাত ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই টুং করে একটা আওয়াজ হলো৷ আমার মেসেঞ্জারে একটা মেসেজ এসেছে। পূর্ণের দেওয়া মোবাইলটা দিয়ে মেসেঞ্জারে ঢুকেছিলাম কাল। ওয়াইফাই কানেক্টে করে দিয়েছিলো পূর্ণ । তাই মেসেজটা আসা মাত্রই পেয়ে গেলাম। হাত মুখ মুছে আলমারি থেকে একটা ড্রেস নিয়ে চেঞ্জ করে আসলাম আপাতত পেটের খিদে মেটানোর উপায় খুঁজতে হবে। পূর্ণ অবশ্য বলেছিলো ঘরেই বাক্স ভার্তি বিস্কিটের প্যাকেট আর ড্রাই কেক আছে। কিন্তু কোথায় সেটাই বলে নি। তাই মন দিয়ে সেটাই খুঁজে চলছি। ইতোমধ্যে আরো কয়েকটা মেসেজ আসার শব্দ পেলাম। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বিস্কিটের সন্ধান করছি। অবশেষে, পেয়েও গেলাম খাটের নিচে। এই ক্যাবলাকান্ত বিস্কিটের বাক্স খাটের নিচে কেন লুকিয়ে রেখেছিলো? এতে কি কোন গুপ্তধন আছে নাকি? থাক ওসব পরে ভাবলেও চলবে আগে দেখি কি কি আছে বলেই বাক্সের মুখ খুলতেই আমার খিদের মধ্যে বালি পরলো। হাহ্ এত্তো পরিশ্রম করছি এই লেক্সাস বিস্কিট খেতে? আমি কি ডায়াবেটিস এর রোগী! মেজাজ চরম পর্যায়ে ক্ষিপ্ত হলো। বিস্কিটের বাক্সটা উঠিয়ে আছাড় মারতে যাবো তখনি মেসেঞ্জারে কল এলো। বাক্সটা বিছানার উপর রেখেই মোবাইল নিলাম। অংশ কল করছে আমায়? গত তিন মাসে ও নিজ থেকে আমায় একটা টেক্সটও করেনি আর আজ কল? ধরবো না আমি। আমার গালে থাপ্পড় মেরেছে সে, আমি বেয়াদব বলেছে৷ অথচ কোন একদিন এই বেয়াদব মেয়েটার জন্যই সে রাতের পর রাত, দিনের পর দিন পাগলের মত ঘুরেছে কলেজ, ক্যাম্পাস এমনকি আমার বাড়ির গেইটের সামনে। দেওয়াল বেয়ে পিঠে ব্যাথা পেয়েছে কতোবার আমার সাথে দেখা করতে। শুধু আমারই জন্য৷ আজ সময়ের ব্যবধানে সেই মেয়েকে সে বেয়াদব বলে আখ্যা দেয়, থাপ্পড়ও মারে। কথা গুলো ভাবতেই আমার গাল বেয়ে তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়লো৷ কল পরপর কয়েকবার বাজার পর রিসিভ করলাম।

“ছাঁদে আসো।”

কেমন যেন ধরে আসা গলায় বলল অংশ। আমি চেষ্টা করেও পারলাম না মুখ থেকে কোন কথা বের করতে। চুপ করে আছি তাই অংশ আবারও বলল, “প্লিজ শশী একটু আসো প্লিজ পাঁচটা মিনিটের জন্য হলেও আসো।”

অংশের কন্ঠ বুকের ভেতর কোথাও একটা তীরের মত বিঁধলো। অংশ কি কাঁদছে!
ঘর থেকে বের হয়ে একবার ফুপুর ঘরের সামনে গেলাম। এখনও গল্প চলছে তাদের তাই সেখান থেকে বের হয়ে সদর দরজায় যেতেই দেখলাম দরজাটা খোলা। এ বাড়ির সিঁড়ি বাইরের দিকে তাই ঘরের মেইন ডোর দিয়েই ছাঁদে যেতে হয়। আমি আগে কখনও যাইনি কিন্তু এ বাড়ির পুরো ইন্সট্রাকশনই মোটামুটি জানা আমার। অংশ গত তিন বছরে তার বাড়ির প্রায় সব কিছু সম্পর্কেই কথা বলেছিলো তাই। আমি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। এক তলা বাড়িটির ছাঁদ একদম লম্বাটে৷ বাড়িটা অবশ্য লম্বাটে নয় এল সিস্টেম। বাড়িটা অনেকটা স্কুলের মত কিন্তু এ বাড়ির ছাঁদ লম্বাটে কারণ এল এর বাঁকা অংশের ঘর গুলোর ছাঁদ পাকা নয়। সেখানে টিনের ছাঁদ৷ ওই টিনের ছাঁদের ঘরগুলো অবশ্য অব্যবহৃত থাকে । ছাঁদে উঠেই থমকে গেলাম আমি। রেলিং ঘেঁষে অংশ দাঁড়িয়ে আছে, আঙ্গুলের ফাঁকে আজও জ্বলন্ত সিগারেট তার । তার একটু সামনে একটা সাদা বাক্স অনেকটা বিরিয়ানি বক্সের মত৷ আমি এসেছি টের পেয়েই অংশ সিগারেটটা নিচে পায়ের কাছে ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে দিলো৷

“থ্যাংক ইউ শশী” বলেই অংশ একটু এগিয়ে এলো এগিয়ে গেলাম আমিও। একদম মুখোমুখি আমরা। ছাঁদে আলাদা কোন বাতি নেই আকাশের চাঁদটা আজ আগের থেকেও ভরাট। আলোও বেশ আজ কালকের থেকে বেশি৷ চাঁদের শুভ্র আলোয় সাদা টি শার্ট পড়া অংশকে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি৷ খুব কাছ থেকে এতোটা স্পষ্টভাবে আজ ঠিক তিন মাস পর দেখছি আমি ওকে। তিন মাস আগে দেখেছিলাম এমন করেই। না না, এমন করে নয় এর চেয়েও গভীর ভাবে। তাকে আলিঙ্গন করে কেঁদেছিলাম সেদিন শুধু তাকে হারিয়ে ফেলেছি বলে। কতো আকুলি বিকুলি করে বলেছিলাম, “অংশ বলো তুমি যা বলছো সব মিথ্যে তুমি বিয়ে করোনি।’ কিন্তু নাহ, সেদিন অংশ আমাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে চলে এসেছিলো। আর আজও ঠিক ততোটাই কাছে পার্থক্য শুধু এইটুকু, আমি তার বুকে পড়ে আজ কাঁদতে পারবো না৷ আমার বিবেক বলছে আমার এখানে আসাই উচিত হয়নি। বেহায়া মন বলছে আজও আবার জড়িয়ে ধরতে তাকে নিজের সকল কান্না এই বুকেই বিসর্জন দিতে৷

‘শশী’ আবারও ডাকলো অংশ আমায় আমার হাতটা ধরে৷ আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হচ্ছি তার ফর্সা চোখ- মুখ রক্তরঙা হয়ে আছে যেন একটু স্পর্শ করলেই চামড়া ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়বে৷

“আমার বুকে কষ্টের একটা নদী তৈরি হয়ে গেছে শশী। তুমি কি সেই নদীর একটা অংশ নিবে? আমি বড্ড অসহায় হয়ে পড়ছি দিন দিন একটু কি আমার কষ্টের নদীতে সাতার কাটবে?”

কি করুণ শোনালো অংশের গলা। ভালোবাসা এত বিষাদময় কেন? কোন কষ্টের নদী হয়েছে তার বুকে? সেই নদীর নামটা কি আমার নামে না কি মৌশির? ভাগ আমায় দিতে চাচ্ছে অংশ তবে কি সেই কষ্টের নদী আমার নামেই! মনে মনে কত কিছুই ভাবছি আমি অথচ আমার ভালোবাসার মানুষটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে সহায় সম্বলহীন মানুষের মত। আচ্ছা অংশ কি আমায় বলবে, “শশী আমি পারবো না তোমায় ছেড়ে থাকতে। চলো আমরা আবার আগের মত হয়ে যাই।”

আজও রাতে পূর্ণ নিজের সব দরকারি জিনিস নিয়ে চলে গেল অন্যরুমে। প্রত্যেক দিন মনে কৌতুহল হয় ও অন্যরুমে কেন যায়। কিন্তু আজ আর হলো না বরং আজ খুব করে চাইছিলাম কখন সে চলে যাবে রুম ছেড়ে আমি দরজা বন্ধ করে দেবো। একা থাকতে চাই একদম একা। একা থাকলেই করা সম্ভব যা আমি চাই। পূর্ণ যেতেই দরজা বন্ধ করে আমার পার্সটা খুলে চেক করলাম। নাহ আমার দরকারি জিনিসটাই নেই এতে৷ আবার দরজা খুলে ড্রয়িংরুমে গিয়ে কর্ণার শো কেস থেকে ছোট্ট বক্সটা বের করে নিজের ঘরে নিয়ে এলাম।

চলবে

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। পুরো গল্প শেষ হওয়ার আগেই ভুলভাল ভেবে নিবেন না দয়া করে কেউ। বুঝতে পারছি কারো ভালো লাগছে না গল্পটা🙂 ভেবেছিলাম নওশাদ আরাধ্যার #সিগারেট গল্পটাও রিপোস্ট করব কিন্তু এত রেসপন্সহীন হলে খারাপ লাগবে পোস্ট করতে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here