পূর্ণশশী পর্ব ৮

#পূর্ণশশী
(৮)
#ফারহানা_আক্তার_রুপকথা
__________________
‘আপনি কখন ঘুমাবেন’? হঠাৎ করেই পূর্ণ ঘরে ঢুকে প্রশ্ন করলো । আমি হাতে থাকা ফাস্ট এইড বক্সটা বেড সাইড টেবিলের উপর রেখে তাকে দেখলাম। ক্রিম কালার থ্রি কোয়াটার প্যান্ট, চকলেট কালার লুজ টি শার্ট , আলুথালু চুল, চোখে মুখে কেমন যেন এক চিন্তার ছাপ। আমি খুব ভালো করে তাকে পরখ করলাম কয়েক সেকেন্ড নিয়ে পূর্ণের মুখটা অংশের মতোই অনেকটা। গায়ের রং ও প্রায় একই রকম ফর্সা৷ কিন্তু অংশ বেশিরভাগ সময় ক্লিন শেভ এ থাকে আর পূর্ণের মুখে কদম ফুলের মত দাঁড়ি গুলো সবসময়ই একটু মাথা উঁচু করেই থাকে। ছেলেটা দেখতে অতি সুদর্শন না হলেও একজন পুরুষ হিসেবে সব দিক থেকেই পারফেক্ট শুধু হাইট একটু কম৷ তবে খাটো নয় হয়তো আমার চোখে অংশের উচ্চতা পছন্দনীয় বলে পূর্ণের উচ্চতা কম মনে হয়। কিন্তু এখন তো আমার এই ছেলেটার সৌন্দর্য ঠিকঠাক মনে হলেও খুব অসহ্যকর লাগছে । অসহ্য লাগছে তার কন্ঠস্বর ও। আচ্ছা ছেলেটাকে বললে কি আমায় একটু বিষ এনে দেবে? দিলেই তো সব ঝামেলা চুকে যেত। পূর্ণ আবারও ডাকলো ‘শশী’। আমি কথা বলতে চাচ্ছি না কিন্তু পূর্ণ আজ এ ঘরে কেন? ও তো ঘুমুতে গিয়েছিলো সাথে কিছু কাগজপত্র ও ছিলো। তবে কি শুধু অফিসের কাজ করতে গিয়েছিলো! আজ কি এ ঘরে ঘুমাবে? যদি ঘুমাতে চায় আর স্বামী হিসেবে যদি… নাহ আর ভাবা সম্ভব নয় পূর্ণ যদি ভুল করে ও আমায় ছুঁতে চায় তবে আজই খুন হবে পূর্ণ।

‘ঔষধের বক্সে ঘুমের ঔষধ নেই তাই খুঁজে লাভ নেই’। পূর্ণ কথাটা বলতেই আমি তাকালাম তার দিকে। সে আবার বলল ‘ বিরিয়ানি খেয়েছেন এখন তাই আপাতত দুধ ও না খাওয়াই ব্যাটার। আপনি বরং লাইট অফ করে একশ থেকে উল্টৌ গুনুন ঘুম চলে আসবে’। বলেই পূর্ণ আলমারি খুলে একটা কম্বল বের করে বিছানায় রাখলো।

‘আপনার বোধ হয় শীত কম তাই ওরকম ঠান্ডায় ও শীতের কাপড় পড়েন যান নি৷ ঘুমানোর সময় কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে নিয়েন’ বলে পূর্ণ আমার কোন জবাবের অপেক্ষা না করেই চলে গেল। কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত ও মাথায় ছিলো অংশকে হারিয়ে ফেলার তীব্র যন্ত্রণা । কিন্তু এই মুহুর্তে মনে এক নিদারন লজ্জা আর অপমান ঘিরে ধরলো আমায়। পূর্ণ কি বলে গেল ‘বিরিয়ানি খেয়েছি আর ওরকম শীতের মধ্যে গরম পোশাক পড়িনি ‘। আমি যখন ছাঁদে গিয়েছি পূর্ণ বাড়ি ছিলো? কি করে সম্ভব ও বাড়ির বাইরে ছিলো বলেই আমি ছাঁদে গিয়েছি’। তার স্ত্রী হয়ে তার ভাইয়ের সাথে এত রাতে ছাঁদে একা। আমি এতোটাই নির্লজ্জ কেন হয়ে যাচ্ছি নাকি আগে থেকেই এমন ছিলাম? যাই ছিলাম যা আছি সব আজ এই মুহুর্তেই শেষ হবে। মৃত্যু আমায় একবার ধোঁকা দিয়ে গেছে এবার না হয় আমি দেবো৷ থাক না অংশ মৌশির হয়ে৷ চোখ মুছে এই মুহুর্তে কঠিন এক পণ করে নিলাম নিজেই নিজের সাথে। অংশ আমার নয় এটাই অদৃষ্টের লিখন। আমি মানলে ও না মানলেও৷ যা আজ নয় কাল মানতেই হবে তবে আজই কেন নয়৷ খুব শিগ্রই আমায় ফিরে যেতে হবে। এই ঘর এই পরিবার ছেড়ে। এ ঘর আমার নয়। আমার ভুলের জন্য পূর্ণের জীবন ধ্বংস হবে কেন? ছেলেটা আমায় ভালোবেসে কোন অন্যায় করেনি৷ করেছি আমি নিজের জেদকে প্রাধান্য দিয়ে তার সুন্দর সহজ জীবনটায় বিবাহিত নামক একটা দাগ লাগিয়েছি। পূর্ণ ইজ গুড গাই হি ডিজার্ভ ব্যাটার সামওয়ান। কিন্তু আমি কোথায় ফিরে যাবো? বাবা মায়ের ভালো সন্তান তো নই আমি কেন তাদের কাছে ফিরে যাবো। নাহ, এখানে থেকেই আমায় একটা ব্যবস্থা করতে হবে।

শীতের আমেজ শেষের দিকে৷ সূর্য্যিমামা উঠি উঠি করেও যেন আলস্যতায় উঠতে চাইছে না। নাকি পূর্ণেরই ঘুমটা আগে ভেঙেছে পূর্ণ বুঝতে পারছে না। বিছানা ছেড়ে জানালার পর্দা সরিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো বাইরে। পূর্ণ গেস্ট রুমে ঘুমায় আমাকে বিয়ে করে এ বাড়ি নিয়ে আসার পর থেকে। প্রতিদিন সাতটার মধ্যে সে নিজের ঘরে যায় তখন রানু আন্টি ছাড়া কেউ জাগে না তাই কারো জানা নেই পূর্ণ নিজের ঘরে থাকে না। কিন্তু আজ এত জলদি উঠে ঘরে বসতে ইচ্ছে করছে না৷ প্যান্ট চেঞ্জ করা দরকার বাইরে একটু হাটাহাটি করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু শশী তো দরজা লক করে রেখেছে কি করে ঘরে যাবো ভাবতে ভাবতেই ফোনটা নিয়ে রুমের সি সি ক্যামেরার ফুটেজ চেইক করলো। আমার ঘুমন্ত মুখটা দেখেই মন উদাস হয়ে গেল পূর্ণের। তার ধারণা আমার মুখে এক অপার্থিব মায়া ছড়িয়ে যায় ঘুমন্ত অবস্থায়। আর সেই মায়ায় জড়িয়ে পূর্ণ অনন্তকাল পার করে দিবে এভাবে তাকিয়ে থেকেই। সবাই ভাবছেন সিসি ক্যামেরা কি করে এলো? পূর্ণের ঘরে সিসি ক্যামেরা পূর্ণ লাগিয়েছে তার বিয়ের রাতেই। শুধু মাত্র আমাকে চব্বিশঘণ্টা নজরে রাখতেই। থাক আরো বিস্তারিত পরে জানা যাবে।

আমি রাতে দরজা না লাগিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পূর্ণ ঘরে এসে থ্রি কোয়াটার প্যান্ট চেন্জ করে ট্রাউজার আর টি শার্ট এর উপর হুডি পরে মোবাইলটা নিয়েই বের হয়ে গেল। আমি জেগে গিয়েছি তা পূর্ণ বোঝেনি। পূর্ণ যেতেই আমি বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে সোজা কিচেনে চলে গেছি৷ গত তিন দিন এর সংসারে আমার জানা হয়ে গেছে এ বাড়ির সকালের নাস্তা পরোটা আর সবজি সাথে ডিম ও থাকে সেদ্ধ কিংবা ভাজা। ঝটপট আটা নিয়ে পরোটার ডো বানিয়ে নিলাম। সবজি কেটে ধুয়ে আগে সবজিটাই কমপ্লিট করলাম। ডিম সেদ্ধ দিয়ে পুরো ঘর ঝেড়ে মুছে নিয়েছি। ফুপু ভোরেই উঠেছেন বোধ হয় গলার আওয়াজ শোনা গিয়েছিলো কিন্তু এখন কোন সাড়াশব্দ নেই বলে আমি উনার রুমে উঁকি দিলাম। ঘুমিয়েছেন আবার হয়তো ফজর পড়ে আবার একটু ঘুমান৷ অংশের ঘরের দিকে চোখ যেতেই নামিয়ে নিলাম দৃষ্টি । দোর লাগানো ঘুমুচ্ছে এখন ও। কিন্তু আমি কেন ওদিকে তাকাবো? দীর্ঘ একটা শ্বাস টেনে নিলাম আজ শ্বাসপ্রশ্বাস বড্ড অলস হয়ে আছে আমার। ভেতরে টেনে নিলে আর বের হতে চায় না আবার বের হলে টেনে ভেতরে যেতে চায় না৷ কত করুণ পরিস্থিতি আজ আমার নিঃশ্বাসের ও। এটাই শাস্তি নিজের নিঃশ্বাসকে অন্য কারো নাম করে দেওয়ার। হুট করেই খোলা সদর দরজা দিয়ে বাতাস এসে আমায় কামড়ে ধরলো৷ অনুভব হলো শীত আর আমারও দরকার শীতের পোশাক। ঘরে গিয়ে অনেক খুঁজে শাল পেলাম লাগেজেই৷ মা সব কিছুই দিয়েছিলেন লাগেজে আমার প্রয়োজনীয়। আমি নিজে ও ব্যাগ গোছালে এতোটা খেয়াল করে গোছাতে পারতাম না। শালটা পেঁচিয়ে আবার রুম থেকে বের হতেই দেখলাম রানু আন্টি কিচেনে ঢুকছেন আমিও গেলাম। রানু আন্টি এদিক ওদিক দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ‘শশী সবজি, আর ডো কি তুমি তৈরি করে রেখেছো’?

‘জ্বি আন্টি’। আন্টি একটু করে হাসলেন তারপর বললেন সবজিটা কিন্তু খুব ভালো হয়েছে আমি একটু চেইক করেছিলাম’।

‘আন্টি আপনি বসুন আমি পরোটা বানিয়ে আনছি আঙ্কেল তো এখনি বের হবেন বোধ হয়’। হাসি হাসি মুখেই বললাম আমি৷ আজকের সূর্যদয়ের সাথেই আমার জীবনে ও নতুন লক্ষ্য উদয় হয়েছে। যে কদিন এ বাড়িতে থাকবো সব কাজ কর্ম করেই থাকবো। তারপর সঠিক সময় দেখে আর নিজের ও থাকার মত একটা জায়গা করেই চলে যাবো।

আমি পরোটা ভাজতে ভাজতে পূর্ণ ফিরে এসেছে৷ তার বাবাও নাস্তা করেতে টেবিলে আছেন ফুপু আসেননি। রানু আন্টি আমায় ডেকে বললেন ফুপুকে নাস্তা ঘরে দিয়ে আসতে উনার হাটুর ব্যাথা বেড়েছে। আমিও তাই করলাম। সবাই নাস্তা করে নিয়েছে পূর্ণ নিজে খাওয়ার সময় আমায় সেধেছিল আমি পরে খাবো বলেছি৷ পূর্ণ নাস্তা করে ঘরে যেতেই আমিও গেলাম। পূর্ণের শার্ট, প্যান্ট,টাই সব আমি নিজের মত করে বের এগিয়ে দিয়েছি৷ পূর্ণ কিছুই বলেনি আমি সাদা শার্টের সাথে বেগুনি রঙের টাই রেখেছিলাম। আমার আসলে কালার আর ড্রেস সেন্স খুবই খারাপ। কিন্তু পূর্ণ কিছুই বলেনি আমি যা যেভাবে রেখেছি ঠিক সেগুলোই পড়ে নিয়েছে। আবার যাওয়ার বলে গেছে ‘আসি’। কথাটা শুনে আমার মধ্যে কোন ভাবদোয় হয়নি। তবে পূর্ণের মুখের রঙ আজ অন্যরকম ছিলো। খুব খুশি মনে হলো৷ আসলে ভালোবাসা জিনিসটাই এমন। প্রিয় মানুষের থেকে পাওয়া ছোট্ট একটা শব্দ ও খুব প্রিয় মনে হয় আনন্দের হয়।

পূর্ণ চলে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর অংশ এসেছে ডাইনিংয়ে৷ হয়তো আজ অফিসে যাবে না। রানু আন্টি খাবার বাড়ছিলেন আমি যেচে বললাম আমি দিচ্ছি। আন্টি আর কিছু না বলে চলে গেলেন। আমি খাবার নিয়ে অংশের সামনে রেখে চুপচাপ চলে আসছিলাম । অংশ আমার হাত ধরে আটকে দিতেই আমি খুব শান্ত ভাবেই দাঁড়ালাম এবং নিজের হাতটা ও ছাড়িয়ে নিলাম৷

‘ছোট ভাইয়ের বউয়ের হাত ধরা ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু। কথাটা মনে রাখবেন দয়া করে। আর সম্ভব হলে আপনার ওয়াইফকে নিয়ে আসুন। আপনার খাবার দাবারের খেয়াল রাখাটা তারই দ্বায়িত্বের মধ্যে পরে’ । কথাটা বলে আমি আর দাঁড়ালাম না। ইচ্ছে করছে না তার মুখের দিকে তাকাতে। হয়তো সে এত দ্রুত এতোটা পরিবর্তন ও আশা করেনি৷ কিন্তু আমি দেখেছি কাল আলো আঁধারতে তার মুখে কষ্টের ছাপ মৌশির জন্য । অংশের অপরাধবোধ স্পষ্ট ছিলো মৌশির জন্য । এই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত ও করার সুযোগ আছে৷ করুক প্রায়শ্চিত্ত জীবন থেমে যাওয়ার না। চলছে চলুক শুধু বদলে যাক প্রিয় মুখ গুলো৷ অংশ শশী হয়ে উঠুক অংশ শশী। আসমানে নক্ষত্র কোটি কোটি। কিন্তু চাঁদ একাই সঙ্গিবিহীন সে। আমি ও তো শশী তবে আমার কেন সঙ্গী থাকবে?

চলবে

(বানানে ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। গল্পের কাহিনী নিয়ে কোন মন্তব্য, ভালো মন্দ বলার থাকলে গ্রুপে পোস্ট করে জানিয়ে দিবেন প্লিজ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here