প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব -৩৫

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্ব_৩৫

“সৌহার্দ্যকে এনে দাও, বাবা! ওকে ছাড়তে পারবো না আমি। সৌহার্দ্যকে এনে দাও!!!”

অরুণীর অস্বাভাবিক আচরণ বেশ সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পরখ করছেন আরমান সাহেব। মেয়ের এমন আচরণ-ই তার প্রত্যাশিত। মনে মনে ক্রূর হেসে তিনি ভাবলেন,

“তোমাকে তো এমন এগ্রেসিভ রূপেই দেখতে চেয়েছিলাম আমি, অরুণী। আমার দীর্ঘায়ুর জন্য হলেও তোমায় গুটি হিসেবে ব্যবহার করতে হলো আমায়। বাট আই ডোন্ট হ্যাভ এনি রিগ্রেট ফর দিস।”

আরমান সাহেব স্বাভাবিক ভাবেই তাকিয়ে আছেন অরুণীর দিকে। কিন্তু অরুণীর চোখ দুটো র*ক্তি*ম বর্ণ ধারণ করেছে। থেমে থেমে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে সে। চোখের কোণে জমে থাকা নোনাজল গুলো কনিষ্ঠা আঙুল দিয়ে মুছে সে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,

“আমাকে এমন কেন বানিয়ে দিলে, বাবা? তুমি… তুমি আমার শরীরে কীসের ইনজেকশন পুশ করেছো এতো দিন? তুমি নাকি আমাকে ড্রা*গ*স দিতে? এটা কি সত্যি?”

আরমান সাহেব অরুণীর দিকে বি*স্ফো*রিত চোখে তাকালেন। তড়িৎ গতিতে নড়েচড়ে বসে বললেন,

“এসব কী বলছো তুমি, অরুণী? আমি তোমার সাথে এমনটা কীভাবে করবো? আমি তোমার বাবা! বাবারা কখনো পারে নিজের সন্তানের সাথে এমন করতে?”

অরুণী তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,

“সেটা তো আমার ভাবনাও ছিল, বাবা! একজন বাবা কীভাবে তার মেয়ের সাথে এমনটা করতে পারে? আমি বিশ্বাস করতে পারিনি, জানো? স্যারের মুখে এমন কথা শুনে আমি ওনার সাথে প্রচুর খারাপ আচরণ করে এসেছি। স্যার কয়েকটা টেস্ট দিয়ে বললেন, নিশ্চিত হয়ে নিতে। আজকে আমি জানতে পেরেছি যে, উনি ঠিকই ছিলেন। ভুল তো আমি ছিলাম! তোমায় অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছি। আর অন্য দিকে, আমার সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা তুমিই করলে!”

আরমান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। কী বলা উচিত, সেটা ভেবে পাচ্ছেন না তিনি এই মুহুর্তে। অরুণী ওনার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

“তোমার এমন কাজের পেছনে কী উদ্দেশ্য আছে, আমি জানি না। তবে তোমার এই কাজের জন্য আমার জীবনের স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়ে গেছে। নিজের ওপর কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছি আমি। এখন নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি না আমি। আজ বিকেলে যখন অরিত্রী আর সৌহার্দ্য একে অপরের হাত ধরে ক্যাম্পাসে হাঁটছিল, ওদের মধ্যকার প্রেম, খুনসুটি, কেয়ারিং সহ্য হচ্ছিল না আমার। আমি বুঝে গিয়েছি, সৌহার্দ্য আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ওকে কারো সাথে শেয়ার করা আমার পক্ষে ইম্পসিবল। ওদের জীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চেয়েও পারছি না আমি। ‘ভালোবাসা’ আজ আমার মধ্যে প্র*তি*হিং*সার আ*গু*ন জ্বা*লি*য়ে দিয়েছে। তাতে অরিত্রী আর সৌহার্দ্য, দুজনকেই পু*ড়*তে হবে। সৌহার্দ্যের জীবনে শুধু আমার আধিপত্য থাকবে। ড. সৌহার্দ্য রায়হান! তুমি চাইলেও তুমি আমার, তুমি না চাইলেও তুমি আমার! হয় তুমি আমার হবে, নয়তো কারো নয়। হা হা হা!”

অরুণী ভ*য়ং*ক*র ভঙ্গিতে হাসছে। আরমান সাহেব শিউরে উঠলেন অরুণীর এমন হাসি দেখে। অরুণীর চোখ দুটোতে আজ কোনো মায়া দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। অরুণীর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ধীরে ধীরে হাসির মাত্রা কমে গেল। অরুণী শব্দ করে কেঁদে দিলো। আরমান সাহেবের হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করলো সেই কান্না। তিনি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন সেই ভ*য়ং*ক*র কান্নার দিকে। অরুণী কান্নার তোড়ে গর্জে উঠে বললো,

“সৌহার্দ্য শুধু আমার হবে। নয়তো ওকে মরতে হবে। তার আগে আমি তোমাকে মারবো। এরপর অরিত্রী আর সৌহার্দ্য। তারপর নিজেকে মা*র*বো। প্রেমের সৌন্দর্য দেখে এসেছো সারাজীবন। এখন থেকে দেখবো প্রেমের সবচেয়ে কুৎ*সি*ত রূপটা! যেখানে থাকবে শুধু কান্না, মৃ*ত্যু ও ধ্বং*স!! ”

“নিকষ কালো আকাশ, আর আকাশ জুড়ে তারার মেলা! কেমন লাগছে দৃশ্যটা?”

প্রহর হালকা হেসে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো মধুর দিকে। মধু আশে পাশে তাকিয়ে সবটা অবলোকন করায় ব্যস্ত। একটা রেস্টুরেন্টের রুফটপে বসেছে ওরা দুজন। পুরো রুফটপ বেশ সুন্দর করে সাজানো আর তার মাঝে একটা টেবিলে শুধু ওরা দুজন বসেছে। কাঁচা ফুলের সুগন্ধ মধুর নাকে এসে লাগছে। অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠলো মধুর। অস্ফুটস্বরে বললো,

“এতো সুন্দর! এতো কিছু আয়োজন করেছো কেন আজকে? কোনো স্পেশাল ডে আছে নাকি? আমার তো মনে পড়ছে না!”

প্রহর মুখ বাকিয়ে বললো,

“স্পেশাল ডে লাগে নাকি? তোমার সাথে কাটানো সব ডে-ই স্পেশাল আমার জন্য। শুধু তুমিই বুঝলে না!”

মধু মনে মনে হাসলো। কিন্তু সেটা প্রহরকে বুঝতে না দিয়ে বললো,

“আমাকে এসব বলে পাম্পিং করে লাভ নেই। আমি গলছি না! যাইহোক! এখানে কি শুধু এসব সৌন্দর্য দেখাতেই নিয়ে এসেছেন? নাকি কিছু খাওয়ার মতো আছে? আমার প্রচুর খিদে লেগেছে!”

প্রহর বিরক্তিতে কপলা কুঁচকে বললো,

“হ্যাঁ, সেই! সকল রোম্যান্টিক মোমেন্টে-ই তোমার ক্ষুধা লেগে যায়। এতো পেটুক কবে থেকে হলে? আশ্চর্য!”

মধু চোখ পাকিয়ে তাকালো। বললো,

“কী বললে? আমি পেটুক?”

প্রহর কপট হেসে বললো,

“জি। শোনো! আমি না এখানে তোমার সাথে প্রেম করতে এসেছে! খাওয়া-দাওয়া পরে হবে।”

“কিন্তু খিদে আটকে রাখা দায় হয়ে যাচ্ছে। পেটের ভেতর থেকে অদ্ভুত ডাকাডাকি শুরু হয়ে গেছে!”

প্রহর অবাক হয়ে বললো,

“হোয়াট?”

মধু অসহায় কন্ঠে বললো,

“হ্যা! দুপুরে লাঞ্চ করতে পারিনি ক্লাস ছিল বলে। সেই সকালে খেয়েছিলাম!”

প্রহরের প্রচন্ড রাগ লাগলো। ফোস করে একটা উত্তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,

“স্টুপিড! কবে মানুষ হবে তুমি?”

মধু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,

“মানে কী বুঝালেন? আমি মানুষ না?”

প্রহর রাগমাখা মুখে নাটকীয় হাসি টেনে বললো,

“না, কোনো মানুষ কখনো এতো বেলা পর্যন্ত না খেয়ে থাকে না।”

প্রহর কল দিয়ে খাবার অর্ডার করলো। মধু আশে পাশে তাকাচ্ছে আর পা দোলাচ্ছে। প্রহর মধুকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে মনে মনে হাসলো আর ভাবলো,

“আই উইশ, তুমি সারাজীবন এমনই থাকো! তোমার এই শিশুসুলভ মনটাকেই আমি ভালোবাসি আর এরোগেন্ট রূপটাকেও!!”

কেটে গেছে মাস খানেকের মতো সময়। দিনকাল স্বাভাবিক গতিতেই চলছে। তরীর রোজকার ক্লাস, সংসার আর সৌহার্দ্যময় প্রেম! সারাটা দিন কীভাবে এসবে মত্ত থেকে কাটিয়ে দেয়, তরী বুঝেই উঠতে পারে না।

“কী রে, নাতবউ! আজকে ক্লাস করতে যাইবি না? তোর তো পারলে শুক্র-শনিবারও যাইতে মন চায় ভার্সিটি!”

দাদীর দিকে তাকিয়ে সুন্দর একটা হাসি দিলো তরী। বললো,

“আজকে যাবো না, দাদী! মধু একাই গেছে।”

দাদী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,

“ক্যান যাবি না? কী হইসে বল তো? তোর মুখটা এমন ফ্যাকাসে হয়ে যাইতেছে ক্যান? চোখ দুটো তো গর্তে চলে গেছে একেবারে! চোখের নিচে এতো কালি পড়সে!! ঘুমাস না রাতে?”

তরী মলিন হেসে বললো,

“রাত জাগতে হয় একটু! প্রতিদিন পড়তে না বসলে পড়াশোনার খেই হারিয়ে ফেলি আমি। এজন্যই!”

“তোর শরীর ভালো আছে তো?”

“আরে হ্যাঁ! সুস্থ-ই আছি আমি। আজকে একটু রেস্টের জন্য বাসায় আছি। এই আর কি!”

দাদী তরীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

“তাহলে যা! ঘরে গিয়ে শুয়ে থাক। বাইরে বসে থাকার দরকার নাই। যাহ্!”

তরী ধীরে ধীরে পা ফেলে ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। মাথাটা ঝিমঝিম করে আসছে ওর। সৌহার্দ্যের দাদী পেছন থেকে জহুরি নজরে পরখ করছেন তরীকে। কেন যেন সবটা স্বাভাবিক লাগছে না! তরীকে তো মোটেই না।

বিছানায় বসা মাত্রই তরীর সারা শরীর ঝিমঝিমিয়ে উঠলো। বুক ভার হয়ে ভেতর থেকে মুচড়ে সব বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গেল সে। বেরিয়ে এলো প্রায় আধা ঘণ্টা পর। দুই হাত দিয়ে মাথার দুইপাশের চুল খামচে ধরে বিছানায় আসে পড়লো তরী। হাত গলিয়ে সাদা রঙের প্রে*গ্ন্যা*সি কিটটা ফ্লোরে পড়ে গেল! সেটা গায়ে লাল বর্ণের দাগ স্পষ্ট। নিজের পেটের ওপর সযত্নে হাত রাখলো তরী! চোখ থেকে ছিটকে জলরেখা গড়িয়ে পড়ছে। কেন এমনটা হলো? কীভাবে এমনটা হলো? এমনটা না হওয়ার জন্য তরী নিজের সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল। তবুও ভাগ্য কেন এমন নির্মম খেলায় নামালো তরীকে। কাঁদতে কাঁদতে নিজের পেটে হাত বুলিয়ে তরী বললো,

“কেন এলি তুই? এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে একটা অ*ভি*শ*প্ত জীবন দিতে চাই না আমি তোকে। এখন কীভাবে কী করবো আমি?”

কান্নায় মুষড়ে পড়ার এক পর্যায়ে তরী নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। নিজেকে শক্ত করলো। তার নিষ্ঠুর রূপটা আর আড়াল করা যাবে না। আর এই নিষ্ঠুরতার শুরুটা মিজের অনাগত সন্তানকে দিয়েই হবে, ভাবতেও পারেনি সে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজের চোখের জল মুছে ফেললো সে। চোখ বুজে নিজেই নিজেকে বললো,

“তোর মাকে ক্ষমা করে দিস! হয়তো আমি পৃথিবীর নি*কৃ*ষ্ট মা হবো। কিন্তু নিজের সন্তানের খু*নী হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় রইলো না আমার!”

#চলবে….

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here