প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব -৩৪

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্ব_৩৪

প্রহর আজ বিকেলে ক্যাম্পাসে এসেছে। সারাদিন অফিসে থাকতে হয়েছে আজকে। কিছু ফর্মালিটি আর একটা ইনভেস্টিগেশনের জন্য মিটিংয়ে ঐদিকের ব্যস্ততা বেড়ে যাচ্ছে। তাই ক্যাম্পাসে তিনদিনের বেশি ক্লাস রাখেনি সে।

আজ কোনো ক্লাস নেই প্রহরের। এই অসময়ে ক্যাম্পাসে আসার প্রধান কারণ হলো মধু। মেয়েটার সাথে একবার দেখা না করে থাকা-ই যাচ্ছে না আর। আর মেয়েটাও অদ্ভুত! একটু বুদ্ধিও হলো না এখন পর্যন্ত! ও নিজে রাগ করে চলে এলো গত রাতে। একবার রাগ ভাঙানোর চেষ্টাও করলো না। না ফোন দিয়েছে আর না তো কোনো টেক্সট! ভেবেই গাল ফুলালো প্রহর। গাড়ি নিয়ে আর গেইটের ভেতর ঢুকলো না। একসাইডে পার্ক করে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। গাড়ির ভেতরে রিয়াদ আর ড্রাইভার আছে। প্রহর রিয়াদকে বললো,

“তুমি গাড়িটা নিয়ে যাও। বাসায় পৌঁছে আবার গাড়িটা পাঠিয়ে দিও না হয়!”

রিয়াদ অসম্মতি জানিয়ে বললো,

“দরকার নেই, স্যার! আমি রিকশা নিয়ে চলে যেতে পারবো। আমার বাসা তো কাছেই!”

“আমি যা বলেছি, সেটাই হবে। যাও!”

প্রহরের শক্ত কন্ঠ শুনে রিয়াদ আর কথা বাড়ানোর সাহস পেল না। চুপচাপ মাথা নাড়িয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল।

প্রহর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে তাকাতেই ওর ভ্রু আপনাআপনি কুঁচকে গেল। কপালে ভাজ ফেলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে আর মেয়েটার দিকে। মেয়েটা তো অরুণী! কিন্তু ছেলেটা কে? এই ছেলেকে প্রহর কখনো দেখেছে বলে মনে হয় না।

অরুণী ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বেশ গুরুতর ভঙ্গিতে কথা বলছে। দেকে বোঝা-ই যাচ্ছে, বেশ গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছে ওরা। প্রহর শোনার চেষ্টা করলো। কিন্তু এতো দূর থেকে কিছু শোনা যাচ্ছে না। স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে এগিয়ে গেল ওদের দিকে প্রহর। অরুণী চোখ ঘুরাতেই প্রহরকে এগোতে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো। প্রহর এক দেখায়-ই বুঝে ফেললো সেটা! অরুণী ঢোক গিলে আশেপাশে তাকাতে লাগলো।

প্রহর অরুণীর কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে সূক্ষ্ম নজরে দেখলো দুজনকে। ভ্রু উঁচিয়ে অরুণীর দিকে তাকিয়ে বললো,

“কী রে? তুই হঠাৎ আমাদের ক্যাম্পাসের সামনে। এদিকে তো তোর আসার কথা না! তুই তো এখন তোর ইন্টার্নশিপ নিয়ে ব্যস্ত আমি যত দূর জানি।”

অরুণী আমতা আমতা করে বললো,

“ঐ তো! আসলে এমনি একটু ঘুরতে এসেছিলাম। কখনো এখানে আসা হয়নি তো, তাই!”

প্রহর বুঝতে পেরেছে এমন ভঙ্গি করে বললো,

“ওহ! আই সি! তো তোর সাথে এই ছেলেটা কে? রিলেশন চলছে নাকি ওর সাথে আবার?”

অরুণী রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

“মানে পাশে কোনো ছেলেকে দেখলেই সেটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে এক জায়গায় নিয়ে বসাও কেন তোমরা সবাই? ও আমার বয়ফ্রেন্ড কেন হবে?”

“তাহলে কে?”

অরুণী কন্ঠে চাপা রাগী কন্ঠে বললো,

“সেটা তোমার না জানলেও চলবে! মাইন্ড ইয়র অয়্যুন বিজনেস!”

বলেই আবার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললো, “অর্ণব! চলুন।”

অরুণী উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলো। অর্ণবও ওর পিছু পিছু গেল। প্রহর ওদের যাওয়ার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে ভাবলো,

“অর্ণব! এই ছেলে কোত্থেকে এসে জুটলো আবার? নাহ্! ব্যাপারটা তো স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না! নিশ্চয়ই কোনো ঘাপলা আছে। খোঁজ লাগাতে হবে।”

প্রহর ভেতরে ঢুকে মধুর ডিপার্টমেন্টের দিকে গেল। মধু একটা ছেলেকে প্রচুর গালিগালাজ করছে। মাঝেমধ্যে ঠুস-ঠাস চড়ও দিচ্ছে। তরী পাশে দাড়িয়ে ওকে আটকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু মধু তো কারো কথা শোনার মেয়ে-ই না! প্রহর হতভম্ব হয়ে মধুর দিকে এগিয়ে গেল।

“অনেক দিন ধরে খেয়াল করছি আমাকে ফলো করিস তুই। একবার ওয়ার্নিং দেওয়ার পরও শুনিসনি। এই তোকে বলেছি না আমার বর আছে, বিবাহিত আমি। তবুও আমাকে ডিস্টার্ব করিস!”

ছেলেটা কিছু বলতে নিলে মধু ধমকে ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

“আব্বে চুপ! আরেকটা কথা বললে আজ তোর একদিন নয়তো আমার। তোর সাহস হয় কী করে আমার দিকে তাকানোর, তাও আবার ঐ রকম নজরে!! তোর চোখ দুটো যদি আজকে না তুলসি, তাহলে… তোকে তো আমি….”

মধু আরেকটা চড় দেওয়ার জন্য হাত তুলতেই প্রহর ওকে আটকে দিয়ে বললো,

“হোয়াট দ্য হ্যাল! কী করছো তুমি এসব, মধু?”

মধু নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,

“ছাড়ো তুমি আমাকে। ওকে তো আমি আজকে দেখে নিবো! ছাড়ো!!”

প্রহর মধুকে টেনে নিয়ে অন্য দিকে চলে গেল। তরী ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এই মেয়ের হুটহাট হাত চলার অভ্যাস এ জীবনে যাবে বলে মনে হয় না।

প্রহরকে এভাবে মধুর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে দেখে আশেপাশের স্টুডেন্টরা কানাঘুষা শুরু করে দিলো। প্রহর বিব্রত হলো ব্যাপারটা খেয়াল করে। মধু ফোঁস ফোঁস করছে। রাগী দৃষ্টিতে প্রহরের দিকে তাকিয়ে বললো,

“তোমাকে কে বলেছে আমাকে এভাবে টেনে নিয়ে আসতে? ঐ বদটাকে আরো দুটো লাগিয়ে দিয়ে আসতে পারলে আমার শান্তি হতো।”

প্রহর বিরক্ত হয়ে বললো,

“শাট আপ, মধু! এভাবে মানুষের ওপর হুটহাট হাত তোলা ঠিক না। মুখে বলেও অনেক কিছু বোঝানো যায়। ভুলে যেও না, তুমি একটা মেয়ে। আর মেয়েদের সবসময়ই ভদ্রতা মেইনটেইন করে চলতে হয়। এভাবে মানুষের গায়ে হাত তোলা কখনো কোনো ভদ্র মেয়ের কাজ হতে পারে না। ইউ শ্যুড আন্ডারস্ট্যান্ড দিস ফ্যাক্ট, ওকে?”

মধু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,

“শোনো, আমি নিজেকে বদলাতে পারবো না। আর না আমি চাই নিজেকে বদলাতে। আমি কোনো ভদ্র মেয়ে নইও! আর তোমারও সেটা ভালো করে জানা থাকা উচিত।”

প্রহর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,

“আমি তোমাকে বদলাতে চাইছি না, মধু। তুমি ভুল বুঝছো আমায়। আশেপাশের সবাইকে দেখো কী ভাবে দেখছে আমাদের? আজকে তুমি এসব না করলে এরকম একটা পরিস্থিতিতে অন্তত পড়তে হতো না।”

“তোমাকে তো আমি বলিনি আমাকে আটকাতে! বাঁধা কেন দিয়েছো আমায়? আর সবাই এভাবে দেখছে তো দেখুক! ওদের চোখ আছে ওরা তো দেখবেই! দু’দিন পরে তোমার আমার বিয়ে হলে জানতেই পারবে সবটা। এতে এতো হাইপার হওয়ার কী আছে? ”

প্রহর হতাশ হয়ে বললো,

“তোমাকে কোনো কিছু বুঝানো-ই বেকার! কোনো কথার সোজা মানে বুঝতেই চাও না। চলো, একটা জায়গায় যাবো তোমায় নিয়ে।”

প্রহর এগিয়ে যেতে লাগলো। মধু প্রহরের পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে গাল ফুলিয়ে বললো,

“এখন তো আমাকে ভালোই লাগবে না। আমি পুরনো হয়ে গিয়েছি না? আবার আমি তো ভদ্রও না! হুহ্!!”

প্রহর সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মিটমিট করে হাসলো। মেয়েটা আসলেই পাগল!

তরী বুঝতে পারলো, মধু প্রহরের সাথেই বাসায় যাবে। ওদেরকে আর ডিস্টার্ব করলো না তাই। একা একা চলে যাওয়ার জন্যই গেইটের দিকে পা বাড়ালো। হঠাৎ সামনে কারো সাথে ধাক্কা লাগলে তরী চমকে উঠলো।

“কী, রে? কেমন আছিস, তরী? ভুলেই তো গিয়েছিস আমাকে মনে হয়!”

তরী চোখ তুলে সামনে তাকালো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

“ওহ! অর্ণব ভাইয়া, তুমি? আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম!”

অর্ণব ভ্রু বাকিয়ে তাকিয়ে হেসে বললো,

“তুই আবার ভয় পাওয়া শুরু করলি কবে থেকে? মনে ভয়-ডর আছে নাকি তোর!”

“সব মানুষের মনে-ই ভয় আছে , বুঝলে? যাইহোক! তুমি এখানেনকী মনে করে হঠাৎ?”

“কিছু মনে করে না। বাবার কোম্পানিতেই জয়েন করেছি আমি। এইদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম একটা কাজে। তোর সাথে তো অনেকদিন দেখা হয় না! কথা বলার পর মাত্র একবার ফোনে কথা বলেছিলি আমার সাথে। আজকে কাছে দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম, দেখা করে যাই!”

তরী হালকা হেসে বললো,

“ওহ! ভালো করেছো। চলো না? সামনে গিয়ে বসে কথা বলি।”

অর্ণব মলিন হেসে বললো,

“নাহ! বসবো না। তোকে দেখার ইচ্ছে ছিল একটু। দেখা শেষ। যদিও তোকে দেখার সাধ এজীবনে ফুরাবে না আমার! কিন্তু এখন তোকে নিয়ে এসব ভাবাও পাপ আমার জন্য।”

তরী চোখ নামিয়ে ফেললো। হাতে হাত ঘষে কিছু মুহুর্ত নীরব রইলো। পুণরায় অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বললো,

“কেন আমাকে নিয়ে এতো ভাবো, অর্ণব ভাই? ভুলে যাও না আমাকে! আমার জীবন তো অন্য কারো সঙ্গে বাঁধা পড়ে গেছে। এই বন্ধন ছিন্ন হওয়ার নয় আর ছিন্ন করার ইচ্ছেও নেই আমার। তুমি তোমার জীবনটা গুছিয়ে নাও!”

অর্ণব ম্লান কন্ঠে বললো,

“গুছিয়ে নিবো নিজেকে আমি। তুই আমাকে নিয়ে ভাবিস না। শুধু আমাকে এটা বল যে, তুই ভালো আছিস তো? সুখে আছিস তো?”

“তরী সুখেই আছে। ভালোও আছে। ড. সৌহার্দ্য রায়হান বেঁচে থাকতে আর যা-ই হোক, তার চাঁদের জীবনে ভালোবাসার কোনো অভাব পড়তে দিবে না। বুঝতে পেরেছেন, মিস্টার অর্ণব?”

বলেই সৌহার্দ্য তরীর পাশে দাড়িয়ে ওর হাত নিজের হাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরলো। অর্ণবের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

“বেটার হয় যে, আপনি তরীকে নিয়ে আর মাথা না ঘামান! ও আমার বউ। আমার বউকে নিয়ে আমি প্রচন্ড পজেসিভ। ওর সুখের কোনো কমতি আমি রাখবো না। কাজিন হিসেবে তরীকে নিয়ে আপনি একটু কনসার্ন হতেই পারেন। কিন্তু সেটার কোনো প্রয়োজন নেই। চলো, চাঁদ!”

সৌহার্দ্য তরীর হাত ধরে নিজের সাথে নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। পেছন থেকে অর্ণব স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠলো,

“আমি মানি যে, তুমি আর তরী একে অপরের জন্য তৈরী। তবে আগেও বলেছি, আজও বলছি! যেদিন তরীর চোখের এক ফোঁটা অশ্রুর কারণ তুমি হবে, সেদিনই তুমি ওকে হারাবে। আই সোয়্যার, দুনিয়ার যেই প্রান্তেই আমি থাকি না কেন! তরীর চোখের জল মোছাতে ছুটে আসবো-ই!”

-চলবে…..

👉👉

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here