#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্ব_৪২
“অরুণীকে শীঘ্রই বিয়ে করছি আমি। তাই এখন থেকে ও এই বাড়িতেই থাকবে।”
সৌহার্দ্যের এমন কথায় উপস্থিত সকলের মাঝে বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো যেন! মিস্টার রায়হান বসা থেকে ঝড়ের গতিতে উঠে দাঁড়ালেন। সুজাতা দ’হাতে নিজের মুখ চেপে ধরলেন। মধুর চোয়াল ঝুলিয়ে মুখ হা হয়ে গেল। সৌহার্দ্যের দাদী তো চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছেন। সকলকে অবাকের চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য সৌহার্দ্যের এই একটা কথা-ই যথেষ্ট ছিল।
মিস্টার রায়হান এগিয়ে এসে নিজের ছেলের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। সৌহার্দ্যের ঝুঁকে যাওয়া মুখটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললেন,
“বাড়ির পরিবেশ স্বাভাবিক নয়, মূলত তোমার জন্যই অস্বাভাবিক। তোমার স্ত্রী নিখোঁজ। তোমার অনাগত সন্তান সম্পর্কে তুমি অনিশ্চিত। কোনো খোঁজ পাচ্ছি না এখনো মেয়েটার। এই পরিস্থিতিতে তুমি এই মেয়েটাকে এনে বলছো যে, তুমি ওকে বিয়ে করবে? ওর নিকৃষ্ট বাবার সাথে থেকে ও কতটা মানুষ হয়েছে, আমি জানি না। কিন্তু ওর ছায়া এ বাড়িতে পড়ুক, সেটা আমি চাই না। আশা করি, তুমি বুঝতে পারছো আমি কী বলতে চাইছি!”
মিস্টার রায়হানের কাটকাট বক্তব্য শুনে সৌহার্দ্য মাথা তুলে তাকালো। বললো,
“তুমি সব জানো, বাবা। সবটা জানতে তুমি, তাই না? সব জেনেও আমাকে কিছু জানতে দাওনি। এই দিকে আমি তরীর চিন্তায় দুই চোখের পাতা এক করতে ভুলে গিয়েছি, দম বন্ধকর একটা সময় পার করেছি এতো দিন! অন্য দিকে, তোমরা ওকে ওর বাড়িতেই লুকিয়ে রেখেছো সবাই মিলে। আমি সারা দুনিয়া ওকে খুঁজতে খুঁজতে নিজেই হারিয়ে গিয়েছি মনে হচ্ছিল, আর তোমরা এভাবে আমাকে হয়রান করলে!”
“যা করেছি, সবার ভালোর জন্যই করেছি। তুমি বুঝবে না এতো কিছু। আমি তোমাকে যতটা বুঝদার মনে করতাম, ততটাও তুমি নও।”
“এজন্যই তো এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাবা। তোমাদের কারো মনে আমার জন্য কোনো চিন্তা নেই। কেউ পরোয়া করো না আমার ভালো থাকা, খারাপ থাকা নিয়ে। সবাই নিজে ভালো থাকার কথা চিন্তা করে। তরীকে ছাড়া আমি থাকতেই পারবো না, এটা তোমরাও ভালো করে জানো। তরীও জানে। তবুও নিজের ভালো থাকাকে বেশি প্রায়োরিটি দিয়েছে ও। ওর কাছে ওর জেদ সবার আগে, আমি নই। যার কাছে আমার ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই, তার জন্য যে আমাকে ভালোবাসে তাকে এতো দিন দূরে ঠেলে রেখেছি আমি। কিন্তু আর না! অরুণী-ই আমার জন্য বেস্ট হবে, তাই ওকেই বিয়ে করছি আমি।”
সৌহার্দ্যের দাদী এমন কথায় নিজের বুকে হাত দিয়ে বসে পড়লেন। চোখ মুখ খিঁচে বললেন,
“আল্লাহ এই দিন দেখানোর আগে আমারে উঠায় নিলো না ক্যান? কী রে, রায়হান? ও বউমা! তোমার ছেলে কি পাগল হইয়া গেল? এমন না-জায়েজ কামকাজ কেমনে করবে ও? নিজের বউয়ের বড় বোনকে…… ছি ছি! এই দিন দেখার জন্য এতো দিন বাঁইচা ছিলাম?”
সৌহার্দ্য বললো, “সমস্যা নেই, দাদী! অরুণীকে বিয়ের আগে তরীকে ডিভোর্স দিয়ে দেব আ….”
কথা শেষ হওয়ার আগেই সৌহার্দ্যের বাঁ গালে সশব্দে একটা চড় পড়লো। প্রতিটি দেয়ালে সেই শব্দ প্রতিধ্বনিত হতেই সবাই চমকে উঠলো। সৌহার্দ্য গালে হাত দিয়ে অবাক চোখে তাকালো নিজের বাবার দিকে। মিস্টার রায়হান গুরুতর ভঙ্গিতে বললেন,
“এতোক্ষণ সহ্য করছিলাম তোমায়। দেখছিলাম যে, তুমি ঠিক কতটুকু নিচে নামতে পারো। কিন্তু তুমি তো সকল সীমা-ই পেরিয়ে ফেলেছো! আর নয়। তরীকে জানাচ্ছি আমি সবকিছু। ও আসবে নিশ্চয়ই। এরপরেও যদি তোমার সিদ্ধান্ত না বদলায়, তাহলে ভুলে যাবে যে তোমার কোনো বাবা ছিল।”
মিস্টার রায়হান নিজের ঘরে চলে গেলেন। সুজাতা সৌহার্দ্যের দাদীর পাশে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন। মধু চরম বিরক্তি নিয়ে সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে বললো,
“এই মেয়েটা নিশ্চয়ই কিছু বলে তোমাকে আবারও ফাঁসিয়েছে, তাই না? আজকে যদি তরী আর ভাইয়ার মধ্যে কোনো ঝামেলা হয়, তাহলে এই জঘন্য মেয়েটাকে এখানেই পুঁ*/তে ফেলবো আমি বলে দিলাম।”
মধু অরুণীর দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে চলে গেল। অরুণী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্যের দিকে। ও ভাবতেও পারেনি, সৌহার্দ্য এমনভাবে সবার সামনে কথা বলবে! সৌহার্দ্য অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। কী করবে ও? কেন তরীকে এতোটা ভালোবাসে, সেটা ও নিজেও জানে না! কেন অরুণী নামক অভিশাপকে নিজের জীবনে জড়িয়েছিল? আজ ওদের জীবন শেষ করার জন্য অরুণী উঠে-পড়ে লেগেছে। এখন আফসোস হচ্ছে। বাধ্য হয়ে অরুণীর কথা শুনতে হচ্ছে ওর। নয়তো তরীকে বাঁচতে দেবে ওরা। কিন্তু সৌহার্দ্য এতো কাঁচা কাজ করবে না। মনে মনে অনেক বড় একটা দাবার ছক এঁকে রেখেছে সে। সেই অনুযায়ী-ই কাজ করবে। অরুণী আর ওর বাবাকে জব্দ করার জন্য বেশ বুদ্ধি খাটিয়েই কাজ করতে হবে ওকে। কিন্তু এখন তরী এলে ওকে কীভাবে হ্যান্ডেল করবে, সেটা মাথায় আসছে না। নিজে তো বাবার হাতে থাপ্পড় খেয়ে বসে আছে! তরী তো সৌহার্দ্যের মুখে এসব কথা সহ্য-ই করতে পারবে না! ওকে সবটা বুঝিয়ে বলাও যাবে না। নাহ! কাউকেই বলা উচিত হবে না নিজের প্ল্যান সম্পর্কে। শুধু প্রহরকে জানাবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো সৌহার্দ্য।
ভাবনার মাঝেই বাইরে গাড়ির হর্ণের আওয়াজ শুনতে পেল সৌহার্দ্য। তরী চলে এসেছে! এতো তাড়াতাড়ি! তরীর মুখোমুখি হবে ভাবতেই গলা শুকিয়ে এলো ওর। অরুণী মনে মনে কুটিল হেসে ভাবলো,
“এখন জমবে আসল খেলা! তোর মন ভাঙতে দেখার তাড়া সহ্য হচ্ছে না আমার, অরিত্রী!! আরেকটু তাড়াতাড়ি আয়।”
“তরী, আস্তে হাঁট! এ সময়ে এভাবে ছোটাছুটি করিস না। ধীরে সুস্থে চল। কোনো বিপদ ঘটলে…….”
অর্ণবের কথা কানে ভেসে আসতেই সৌহার্দ্য পেছনে ফিরে তাকালো। অরুণী আর উপস্থিত সবাইও মেইন দরজার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। মিস্টার রায়হান আর মধু ছুটে এলো নিজেদের ঘর থেকে।
নিজের শ্রান্ত, দূর্বল দেহটা নিয়ে তরী দরজার পাশের দেয়ালে হাত ভর দিয়ে সবার সামনে এসে দাঁড়ালো। মিস্টার রায়হান বাদে সবাই চমকে উঠলো তরীকে দেখে। সৌহার্দ্য বিস্মিত চোখে তাকিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। তরী আগের মতোই সাধারণ একটা সুতি শাড়ি পড়ে এসেছে। অসাধারণত্বের কিছু নেই ওর সজ্জায়। কিন্তু তরীর উঁচু উদরটা তাকে গর্ভধারিণীর এক মর্যাদাবান সত্তায় পরিণত করেছে। সৌহার্দ্যের বিস্ময় মাখানো চোখ দুটো অশ্রুপূর্ণ হয়ে গেল মুহুর্তেই। এটা কীভাবে সম্ভব! তরী বাচ্চাটা নষ্ট করেনি! তরীর উঁচু এই গর্ভ তো এটাই প্রমাণ করছে যে, সে ছয় বা সাতমাসের গর্ভবতী।
তরী নিভু নিভু চোখে সবার দিকে একবার তাকাতে তাকাতে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। ক্লান্ত ভঙ্গিতে জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগলো। অর্ণব ওর বাহু ধরে বললো,
“কথা শুনতে বলেছিলাম। এভাবে ছুটে আসার কী দরকার ছিল? নিজের না হলেও তোমার অনাগত বাচ্চাটার কথা তো ভাবতে পারো?”
“তুমি…. তুমি সরো আমার সামনে থেকে। আমি সৌহার্দ্যের সাথে দেখা করতে এসেছি। ওর সাথে কথা বলবো আমি।”
বলেই অর্ণবকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো তরী। সবার মাঝখান থেকে
ওর দৃষ্টি সৌহার্দ্যের ওপরই পড়লো সবার আগে। সেটা বুঝতে পেরে সৌহার্দ্য নিজের চোখের পানিগুলো আড়ালে মুছে ফেললো। তরী এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
“কী বলেছিলে তুমি? আমাকে ডিভোর্স দিবে? এই অরুণীর জন্য? এইবার কোন জাল ফেলেছে ও আবার? আমাকে মেরে ফেলবে বলেছে, তাই না?”
“মুখ সামলে কথা বল, অরিত্রী!”
অরুণীর কথায় কপট হেসে তরী বললো,
“তুমি তা ডিজার্ভ করলে বলতাম। এতো নিচে না নামলেও পারতে। জোর করে কখনো কোনো সম্পর্ক তৈরি করা যায় না। সৌহার্দ্যের জীবন থেকে পর চাঁদকে সরানোর চেষ্টায় তুমি কোনোদিনও সফল হবে না।”
তরীর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কম্পিত কণ্ঠে সৌহার্দ্য বললো,
“অরুণীর কোনো কথা শুনে আমি কিছু করছি না। যা বলেছি, আমি জেনে বুঝে নিজের ইচ্ছায় করছি। আর অরুণীকে বিয়ের সিদ্ধান্তও আমি স্বেচ্ছায় নিয়েছি। ওর কোনো কথা শুনে নয়।”
তরী ভ্রু কুঁচকে তাকালো সৌহার্দ্যের দিকে। তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,
“তুমি আমাকে ভুলতে পারো না, সৌহার্দ্য। তোমার জীবন আমি ছাড়া শূন্য। আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা প্রতিটা মুহুর্তে অনুভব করি আমি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবোরশন করার। কিন্তু আমি পারিনি। আমার দ্বারা সম্ভব-ই হয়নি, জানো? তাই নিজেকে আড়াল করে রেখেছি সবার থেকে। শুধু মাত্র তোমার সন্তানটাকে বাঁচাবো বলে। নয়তো এই অরুণী বা ওর বাবা আমাদের বাঁচতে দেবে না। আর আমার বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজেকে প্রটেক্ট করতে পারবো না আমি। তাই ভীতুর মতো গা ঢাকা দিয়েছি তোমার বাবার কথায়। তোমার সাথে শেষবার কথা হওয়ার সময় আমি বলেছিলাম, আমি ফিরে এলে তুমি আমায় ফিরিয়ে দিতে পারবে না। কারণ আমি তোমার সন্তানকে নিয়ে তোমার কাছে ফিরে আসতাম। তখন ওরা আমার ক্ষতি করতে পারতো না। আর তুমি এই অরুণীকেই এখন বিয়ে করতে চাইছো?”
সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, তরী। এখন তোমার আর আমার মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সেটা এই বাচ্চার দোহাই দিয়ে মেটানোর চেষ্টা করো না। সেটা কখনো সম্ভব নয়।”
সৌহার্দ্য যত সহজে এই কথাটা বললো, তত দ্রুতই এই কথাটা তরীর হৃদপিণ্ডে আঘাত করলো। সেকেন্ডেই চোখ ফেটে পানি গড়িয়ে পড়লো ওর। অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো সৌহার্দ্যের দিকে। সৌহার্দ্য ওকে এই কথাটা কীভাবে বলতে পারলো? সৌহার্দ্যের বাহু চেপে ধরে তরী দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“এটা তুমি কীভাবে বললে আমায়? আমি আমার বাচ্চার দোহাই দিচ্ছি? তুমি পাগল হয়ে গেছো, সৌহার্দ্য!”
সৌহার্দ্য নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
“সবার সামনে এসব সিনক্রিয়েট করো না। অসুস্থ তুমি। বাসায় চলে যাও। গিয়ে রেস্ট নাও। নিজের খেয়াল রেখো।”
তরী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্যের থমথমে স্বাভাবিক মুখটার দিকে। তার বিশ্বাস-ই হচ্ছে না, সৌহার্দ্যের এমন পাষাণ রূপ। নিজের চোখ মুছে বললো,
“তুমি মুখে যত যা-ই বলো না কেন, সৌহার্দ্য! তোমার ঐ মনের ভেতর শুধু আমারই রাজত্ব। আর ঐ জায়গাটা কেউ নিতে পারবে না কোনো দিন। এটা আমার বিশ্বাস। আর এই বিশ্বাস যদি ভেঙে যায়, তাহলে আমিও সেদিন ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবো। বলে দিলাম!!”
#চলবে……..
(