প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা পর্ব -৪১

#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্ব_৪১

সৌহার্দ্য আজকে খেয়াল করেছে, সকাল থেকেই প্রণয়ী বেশ থমথমে মুখ করে আছে। মেয়েটার মন খুব একটা ভালো তো নেই-ই, তার ওপরে কিছু একটা নিয়ে বেশ চিন্তিতও সে। রাতে ডিনারের পর প্রণয়ীর সাথে এ বিষয়ে কথা বলবে বলে ঠিক করলো সৌহার্দ্য।

খাবার টেবিলে সবাই যখন একত্রে খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত, তখন হঠাৎ প্রণয় মিস্টার রায়হানের দিকে তাকিয়ে বললো,

“দাদু, আজকে খাবারের আইটেম গুলো একদম ভালো না। তুমি জানো না, আমার কোয়ালিটি ফুড ছাড়া খেতে ভালো লাগে না?”

মিস্টার রায়হান ছোটখাটো ঢোক গিলে টেবিলে বসা সবার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, সবাই মিটমিট করে হাসছে। এটা নতুন কিছু নয়! প্রণয় বরাবরই এমন অদ্ভুত। রাগ, বিরক্তি আর অভিযোগ গুলো সে প্রকাশ করে ফেলতেই অভ্যস্ত সবসময়। আর এই পরিবারের সবাই প্রণয়ের এই স্বভাব সম্পর্কে ভালো করেই অবগত। অন্য দিকে, প্রণয়ী একদম প্রণয়ের বিপরীত। সে অনেকটা ধীরস্থির ও কোমল স্বভাবের। এই ভাইবোন দুজনেই আলাদা ও স্বকীয়, তাদের মা-বাবার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন- ভেবেই অবাক হয় সৌহার্দ্য। প্রণয়ের রাগ ও হঠকারী আচরণ লক্ষ করেও সৌহার্দ্য কিছু বলে না কখনো। সে জানে, প্রণয় ওপর দিয়ে যতটা শক্ত, ভেতর দিয়ে তার থেকে কয়েকগুণ নরম। ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে খাওয়ায় মনযোগ দেয় সৌহার্দ্য। মিস্টার রায়হান প্রণয়ের বিরক্তি মিশ্রিত মুখের দিকে তাকিয়ে কপট হাসলেন। বললেন,

“এখানে তো সব আছেই, দাদুভাই! আর সবই তো তোমার পছন্দের খাবার, তাই না?”

“কই? না বিফ আছে, আর না আছে চিকেন! খাবারের মেনুতে এগুলো সবসময় চাই আমার।”

বলেই রাগী দৃষ্টিতে তাকালো মিস্টার রায়হান আর সৌহার্দ্যের দিকে। সৌহার্দ্য চুপচাপ খাচ্ছে। কোনোদিকে তাকাচ্ছে না। মিস্টার রায়হানকে দেখে সুজাতা আর সৌহার্দ্যের দাদী মুখ চেপে হাসছে। প্রহর এখন এই বাড়ির স্থায়ী বাসিন্দা, এই পরিবারের একটা অংশ। সে হাসলো কি, হাসলো বুঝতে পারলো না কেউ। প্রণয় আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ খেয়ে চলে গেল ঘরে।

খাওয়া শেষে সৌহার্দ্য টিস্যু দিয়ে নিজের হাত মুছতে মুছতে বললো,

“আমি আজও প্রণয়ের আচরণের মানে বুঝে উঠতে পারলাম না। ছেলেটা এভানে হুট হাট রেগে যায়। কাছের মানুষদের রাগ দেখিয়ে পরে ঘরে গিয়ে কান্নাকাটি করে। আমি বা তরী কেউ তো এমন ছিলাম না!”

সৌহার্দ্যের দাদী মাথা নাড়িয়ে বিমর্ষ মুখে বললেন,

“আরে ও তো তোদের মতো হয় নাই! ও হইসে আমার মধুর মতো। একেবারে মধুর কার্বনকপি হইসে আমার প্রণয়! মেয়েটার সাথে ঝগড়া না করলে আমার দিন কাটতোই না। আর আজ!!”

সৌহার্দ্যের দাদী আঁচলে মুখ গুঁজলেন। সুজাতা চোখের পানি আড়াল করতে দ্রুত সেখান থেকে চলে গেলেন। মিস্টার রায়হান ভারী নিঃশ্বাস ফেলে প্রহরের দিকে তাকালেন। ছেলেটা নিজের প্লেটের এক-চতুর্থাংশের মতো খেয়েছে মাত্র। বাকি খাবার সামনে নিয়ে নির্জীব হয়ে বসে আছে সে। সৌহার্দ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললো,

“প্রহর, আমার একটা হেল্প লাগবে। তুই কি ফ্রী আ….”

“কাল শুনবো। আজ থাক!”

প্রহর খাবার ফেলে চলে গেল। সৌহার্দ্য হতাশ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো শুধু। মিস্টার রায়হান চোখের কোণের পানি মুছে বললেন,

“আমার দুটো মেয়েকেই আমার জীবন থেকে সরিয়ে দিলো। আমি তো ওর নিজের ভাই, তাই না? কীভাবে পারলো ও আমার পরিবারকে এই ভীষণ কষ্টে পি*ষ্ট করতে!!”

সৌহার্দ্য কিছু বললো না। অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো কোনো এক অজানা, শূন্য কোণে।

প্রণয়ী জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। হঠাৎ কারো আগমন টের পেয়ে পেছন ফিরে তাকালো সে। প্রণয় এসেছে। কিন্তু কোনো কথা না বলেই চুপ চাপ বিছানায় নিজের জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়লো প্রণয়। প্রণয়ী অবাক হলেও কিছু বললো না। সৌহার্দ্য ঘরে এলো আরো ঘন্টা খানেক পর। প্রণয়ী বাবাকে দেখে বললো,

“বাবা, আজকে আমি বড় দিদুনের কাছে ঘুমাবো।”

সৌহার্দ্য হেসে সম্মতি দিতেই প্রণয়ী চলে গেল। সৌহার্দ্য চেয়ে দেখলো প্রণয়ের দিকে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো তরীর ঘুমন্ত মুখ। বেডে হেলান দিয়ে চোখের পাতা একত্রিত করে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলো সেই স্মৃতিগুলো!

🍁🍂
তরী চলে গেছে প্রায় তিনমাস হয়ে গেছে। সৌহার্দ্য হাজারো চেষ্টা করেও তরীর খোঁজ পায়নি। এমন কোনো জায়গা বাদ রাখেনি সে, যেখানে তরীকে খোঁজেনি। কিন্তু ফলাফল শূন্য। তরীর অনুপস্থিতিতে সৌহার্দ্য বুঝতে পারছে, সে আজ কতটা অসহায়! প্রহর নিজের দিক থেকে সব চেষ্টা করেছে, কিন্তু সেও ব্যর্থ। তরী মেয়েটা অদ্ভুত, রহস্যময়ী! ও নিজেকে আড়াল যখন করে ফেলেছেই, তখন আর ওকে খুঁজে বের করা যাবে না। এটা প্রহর ভালো করে বুঝে ফেলেছে। কিন্তু সৌহার্দ্যকে বুঝিয়ে উঠতে পারছে না।

“যে নিজে থেকে হারিয়ে যায়, তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। ও স্বেচ্ছায় নিজেকে আড়াল করেছে। তোর বা আমার সাধ্য নেই ওকে খুঁজে বের করার।”

সৌহার্দ্য নির্জীব ভঙ্গিতে বললো,

“আমারই ভুল ছিল। আমি নিজের দেষে ওকে হারিয়ে ফেললাম। ওর কথা মেনে নিতাম, নয়তো ওকে জোর করতাম। যা কিছু করলেও ওকে নিজের থেকে আলাদা করার সুযোগ না দিলেই আজ এই দিন দেখতে হতো না!”

প্রহর হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে তাকালো সৌহার্দ্যের দিকে। ছেলেটা হসপিটালে যাওয়া বন্ধ-ই করে দিয়েছে বলতে গেলে। মুখ দেখলেই বুঝা যায়, সে কতশত রাত নির্ঘুম কাটাচ্ছে। প্রহর ওকে আশ্বাস দিয়ে বললো,

“এতো ডিপ্রেসড্ হোস না! তরী বলেছে না তোকে যে, ও নিজেই ফিরে আসবে! দেখিস, ও নিজের কথা রাখবে।”

“কিন্তু আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না। ও কোথায় আছে, কীভাবে আছে, কী করছে কিছু জানি না। তার ওপর ওর তো নিজের শত্রুরও অভাব নেই! আর ওর শরীরের অবস্থা….. ”

প্রহর ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,

“শরীরের অবস্থা? মানে তোর এখনো মনে হয়, ও বাচ্চাটা রাখবে? এই বাচ্চা না রাখার জন্য তোর থেকে দূরে সরে গেল আর তুই এসপেক্ট করছিস যে…. হাহ! এতোদিনে এবোরশন করিয়ে ফেলেছে আই গেস।”

সৌহার্দ্য শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

“হ্যাঁ, আসলেই তো! আমি আসলেই বোকা। তবে আমার ওকে লাগবে, প্রহর। চাঁদকে ছাড়া আমি আলোহীন, নিকষ। আমার অসহায়ত্ব তোকে কী করে বোঝাই!”

প্রহর আর কিছু বলে উঠতে পারলো না। সে নিজের দিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। তরীর বাবা মিস্টার আফনাদ সবটা জানেন। তিনি জানেন তরী এখন কোথায় আছে, কিন্তু তিনি কাউকে কিছু জানাতে নারাজ। বারবার রিকোয়েস্ট করেও কিছু জানতে পারেনি ওরা। প্রহর বেরিয়ে এসে মিস্টার আফনাদকে আরেকবার কল দিলো,

“আঙ্কেল! তরীর কোনো খোঁজ লাগবে না আমার। আপনি প্লিজ তরীকে বলুন ফিরে আসতে।”

“সম্ভব না, প্রহর। ও যা করছে, তাতে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। নিজেকে বাঁচাতে হলেও ওকে দূরে সরতে হবে। ওকে জন্ম দেইনি আমি, কিন্তু আমার মেয়ে বলে তো ওকে-ই মেনেছি আমি। কীভাবে ওকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দিতে পারি বলো?”

প্রহর কিছু বুঝতে পারলো না। অবুঝের মতো বললো,

“আপনি এসব কী বলছেন, আঙ্কেল? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

তখনই ওপাশ থেকে মোহনার কর্কশ কন্ঠ শুনতে পেল,

“বুঝতে হবে না। তোমাদের সাথে কোনো কথা নেই আমাদের। আর কখনো ফোন দিবে না। তরী যেখানেই আছে, ভালো আছে।”

বলেই ফোন কেটে দিলো। প্রহর ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে বিরক্ত হলো। বিরবির করে কিছু একটা বলে নিজের গাড়ির দিকে চলে গেল।

কেটে গেল আরো দুটো মাস! সৌহার্দ্য এ কয়েকদিন নিজেকে গৃহবন্দী করে রেখেছে। প্রয়োজনেও ঘর থেকে বের হয়নি। মধু আর প্রহরের এনগেজমেন্টও পেছাতে হয়েছে। মধু বলে দিয়েছে, তরী না ফিরলে সে এনগেজমেন্ট বা বিয়ে কিছুই করবে না। তরী ফিরবেই, এটা মধু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। বাড়ির কেউ বর ওকে কিছু বলেনি এ ব্যাপারে। বছর ঘুরুক! সৌহার্দ্য একটু স্বাভাবিক হলেই মধুর বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেলবে বলে ভেবে রেখেছেন মিস্টার রায়হান।

আজ সকাল সকাল সৌহার্দ্যকে রেডি হয়ে বের হতে দেখে মিস্টার রায়হান বললেন,

“হসপিটাল যাচ্ছো?”

“হুম, সিনিয়র ডক্টর অসুস্থ। আমার টিচার ছিলেন উনি। যেতে হবেই।”

“যাক, ভালো! রেগুলার যাওয়া শুরু করে দাও আজ থেকেই। তরী যেখানে আছে, ভালো আছে। ওকে নিয়ে এতো টেনশন করতে হবে না তোমার।”

সৌহার্দ্য নীরব হয়ে তাকিয়ে রইলো তার বাবার দিকে। মিস্টার রায়হান যে তরীর সব খোঁজ জানেন, এ ব্যাপারে সে শতভাগ নিশ্চিত। কিন্তু তিনিও কাউকে জানাতে চান না। সৌহার্দ্যের আজকাল নিজেকে ব্যর্থ সৈনিকের মতো মনে হয়। সে কাউকে নিজের মনের পরিস্থিতি বুঝাতে ব্যর্থ।

হসপিটালে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামতেই কোথা থেকে হঠাৎ অরুণী সামনে এসে দাঁড়ালো। ব্যাঙ্গাত্মক হেসে বললো,

“এতো দিন পর ঘর থেকে বের হলে তাহলে! বউয়ের শোক কাটিয়ে উঠতে পারছো না মনে হয়।”

সৌহার্দ্য বিরক্ত হয়ে অরুণীর পাশ কাটিয়ে সামনে এগোতেই পেছন থেকে অরুণী বললো,

“তোমার বউ তার নিজের বাড়িতেই আছে। তুমি বোকার মতো সারা দুনিয়া খুঁজে বেড়াচ্ছো!”

সৌহার্দ্যের পা থেমে গেল। হতভম্ব হয়ে পেছন ফিরে তাকাতেই অরুণী বললো,

“কী? বিশ্বাস হচ্ছে না? আফনাদ আঙ্কেলকে কল করে দেখো।”

সৌহার্দ্য দাঁতে দাঁত চেপে ফোন বের করে মিস্টার আফনাদকে কল দিলো। তিনি রিসিভ করতেই সৌহার্দ্য বললো,

“তরী আপনাদের বাসায়ই আছে, তাই না?”

মিস্টার আফনাদ হতভম্ব হয়ে গেলেন সৌহার্দ্যের প্রশ্নে। তাড়াতাড়ি কল কেটে ফোন অফ করে দিলেন। সৌহার্দ্য আবার কল দিলো। কিন্তু ফোন সুইচড অফ শোনাচ্ছে। সৌহার্দ্য অবিশ্বাস্য চোখে অরুণীর দিকে তাকালো। আর কালক্ষেপ না করে দ্রুত গতিতে নিজের গাড়ির দিকে এগোতেই অরুণী ওর হাত আঁকড়ে ধরলো। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,

“তুমি যেভাবে তরীর দিকে এগোবে, তরীও সেভাবে মৃত্যুর দিকে এগোবে। তরীকে বাঁচতে দেবো না আমি, তোমাকেও শান্তি দেব না। তুমি আমার না হলে কারো হতে পারবে না, সৌহার্দ্য। কারো না!”

#চলবে…..

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here