#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্ব_৪৩
তরী চলে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরও সৌহার্দ্য নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সৌহার্দ্যের ভাবলেশহীনতায় মধু যার-পর-নেই অবাক হলো। এগিয়ে এসে কটাক্ষের সুরে বললো,
“তরী চলে গেল, ভাইয়া! ও চলে গেছে। তুমি ওকে আটকাবে না? এতোদিন তো ওর জন্য কতো কি করলে! এখন যে ওকে এতো কষ্ট দিয়ে এখান থেকে খালি হাতে চলে গেছে বাধ্য করলে, তোমার কি খারাপ লাগছে না? ও তোমার স্ত্রী, ভাইয়া! তোমার অনাগত সন্তানের মা ও। আই কান্ট বিলিভ দিস যে, তুমি……”
“আমি কিছু শুনতে চাই না। কিচ্ছু শুনতে চাই না আমি… কিচ্ছু না!!!”
সৌহার্দ্য কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। ভেতর থেকে চাপা বিরক্তিগুলো নাভিশ্বাস আকারে বেরিয়ে এলো মধুর। তার ভাইয়ের মাথায় কিছু একটা ঘুরছে। কিন্তু সেটা সৌহার্দ্য প্রকাশ করছে না। এদিকে সবটা সামলিয়ে ওঠার জন্য সৌহার্দ্যের কার্যকলাপও ওর নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছিল। তরীর অবস্থার কথা মনে পড়তেই চেপে রাখা রাগগুলো তরতরিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো মধুর। অরুণীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিস্ফোরিত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
“আর কত ধ্বংস চাও তোমরা বলো তো? আর কত? ছোটবেলা থেকে তোমার হিংসুটে স্বভাব নিজের চোখে দেখে এসেছি। এই হিংসা তোমায় এখন এতোটাই হিংস্র করে তুলেছে যে, তোমার বিবেকবোধ-ই নষ্ট হয়ে গেছে। আর তোমার এই নষ্ট রুপটাই তোমার বাবা ব্যবহার করেছে। এখনও করছে। বড্ড বড় ভুল করছো তুমি! এখন বুঝতে পারছো না। কিন্তু যখন বুঝতে পারবে, তখন এই ভুলের মাশুল গোনারও সুযোগ পাবে না তুমি।”
অরুণী ভ্রু কুঁচকে মধুর দিকে তাকিয়ে বললো,
“জ্ঞান দিচ্ছিস? এসব কথা অরিত্রীকে গিয়ে বললেই তো পারিস! কিন্তু ওর দোষ তো তোদের চোখে পড়বে না! এই যে, একটা ছেলেকে সাথে করে নিয়ে এলো, ছেলেটার সাথে এতো মাখামাখি করলো, এসব তো…..”
কথা শেষ হওয়ার আগেই অরুণীর গালের ওপর সপাটে পরপর দুটো চড় বসিয়ে দিলো মধু। অরুণী গালে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকালো। ঘটনাটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটে গেছে যে, অরুণী অবাক হওয়ারও সুযোগ পায়নি। মধু রক্ত চোখে তাকিয়ে বললো,
“তোর মতো মেয়ের মুখে অন্য কারো চরিত্রের সার্টিফিকেট মানায় না। আমার সামনে অন্তত মুখ সামলে কথা বলিস। আমার হাত দু’টো অন্যদের তুলনায় একটু বেশিই চলে তুই হয়তো জানিস না।”
“তুই আমাকে থা*প্প*ড় মা*র*লি?”
“আরো আগেই মা*রা উচিত ছিল। কিন্তু দেরি করে হলেও তোর লিমিট বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য হাত তুলতেই হলো। এখন বের হ এইবাড়ি থেকে! নয়তো জা*নেই মে*রে দিবো তোকে।”
“এই থাপ্পড়ের চরম মূল্য চুকাতে হবে তোকে।”
বলেই অরুণী বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।
মিস্টার রায়হান, সুজাতা আর সৌহার্দ্যের দাদী এতোক্ষণ নীরব দর্শকের মতো চেয়ে রইলো শুধু। তাদের এখন কিছু বলার ইচ্ছেও নেই, আগ্রহও নেই। তবে সামনের দিনগুলো খুব একটা ভালো যাবে না, এটা সবাই বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে।
৪২.
জানুয়ারির এই তীব্র শীতেও হঠাৎ হালকা ঝিরঝিরে এই বৃষ্টিতে উত্তরে হাওয়ার বয়ে চলা যেন আজ তীব্রতর রূপ ধারণ করেছে। প্রতিটি লোমকূপে হিমশীতলতা অনুভব করতেই শিউরে উঠলো অর্ণব। অস্ট্রেলিয়ার শীতের চেয়ে এখানকার শীতে ওর নাজেহাল অবস্থা, কারণ এই অসময়ের বৃষ্টি। দুই হাতে দুই মগ ধোঁয়া উঠানো কফি সাথে নিয়ে তরীর ঘরে ঢুকলো সে। নক করে বললো,
“আসবো?”
তরী ফিরে তাকালো না। কোনো উত্তরও দিলো। জানালার ফাক গলিয়ে ওর দৃষ্টি অজানা কোনো গন্তব্যে ঘুরঘুর করতে লাগলো। অগত্যা হতাশ মুখ নিয়ে অর্ণব বিনা অনুমতিতেই ভেতরে ঢুকলো। তরীর গায়ে একটা ফিনফিনে সুতি শাড়ি। এই কনকনে ঠান্ডায় ও শীতের হাত থেকে রেহাইয়ের জন্য নেই কোনো উষ্ণ আবরণ। অর্ণব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
“একটা চাদর অন্তত গায়ে জড়িয়ে নে। শোকে কি পাথর হয়ে গেলি নাকি? কাইন্ড আ ফিলিংলেস লাগছে তোকে!”
তরীর নির্জীব কন্ঠ শোনা গেল,
“তোমার মনে হয় আমি অনুভূতি শূন্য হয়ে গিয়েছি?”
“না, সৌহার্দ্যের বাড়ি থেকে আসার পরও তোর মধ্যে কষ্ট পাওয়ার কোনো লক্ষণ তো দেখলাম না! আগের মতোই খাচ্ছিস, ঘুমাচ্ছিস। মানে বুঝলাম না! এতো স্বাভাবিক কীভাবে আছিস তুই?”
তরী মলিন হাসলো। বললো,
“সবসময় আমরা চোখে যা দেখি, সেটা সত্য হয় না।এটা ভেবে কষ্ট পাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও সেরকম খারাপ লাগছে না। মনে মনে অনেকটা আন্দাজ করতে পারছি আমি। এতোটা আত্মবিশ্বাসের জন্যই আমার মন খারাপ লাগছে না। আর নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চাচ্ছি শুধুমাত্র আমার বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে।”
অর্ণব ভ্রুকূটি করে তাকিয়ে বললো,
“বাচ্চাদের? মানে?”
“হ্যাঁ। ডক্টর আজকে জানিয়েছেন আমায়। টুইন বাচ্চা হবে।”
“এটা তো ভালো খবর! এতোক্ষণ জানাসনি কেন আমায়?”
“মনে ছিল না। এখন আমাকে একটু একা থাকতে দাও। কিছু ভালো লাগছে না আমার।”
অর্ণব কথা বাড়ালো না। তরীর সাথে এখন কথা বলতেই নিজের গলায় কম্পন অনুভব করে সে। সে তো চেয়েছিল অরুণীর কথা শুনে তরী আর সৌহার্দ্যের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টি করতে। কিন্তু তরীর জীবনে তার প্রবেশের পথ অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। তরীর শৈশবেই তো ওর প্রিয় মানুষ ওর জীবনে প্রবেশ করেছিল, ওর মনে পাকাপোক্ত স্থান তৈরি করে ফেলেছিল। সে জায়গা পাওয়ার আর কোনো রাস্তা তো নেই! তার ওপর এখন তরীর মধ্যে সেই মানুষটার অংশ বেড়ে উঠছে। ওপর দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখলেও ভেতরে ভেতরে তীব্র জ্বলুনি অনুভব করে অর্ণব। তরীর দিকে তাকালেও এখন চোখ জ্বলে ওর। নিজের ভালোবাসাকে অন্যের অর্ধাঙ্গিনী, সন্তানধারিণী আকারে দেখার সমান কষ্ট পৃথিবীতে আছে কিনা ওর জানা নেই। এর থেকে তো মরণও ভালো!
৪৩.
সৌহার্দ্য বিরক্ত হয়ে নিজের চেম্বারে বসে আছে। প্রহরের সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না কোনোভাবেই। এই মুহুর্তে ওর সাহায্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তাও ও-ই নেই। চরম বিরক্তি নিয়ে নিজের চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেল সৌহার্দ্য। পিয়ন ওকে ওভাবে চলে যেতে দেখে অবাক হয়ে বললো,
“স্যার, কোথায় যাচ্ছেন? অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে আজকে অনেকগুলো।
সৌহার্দ্য ছোট করে বললো, ” অল ক্যান্সেল!”
পিয়ন অবাক চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সৌহার্দ্যের যাওয়ার দিকে। এই ছেলের হঠাৎ হঠাৎ কী হয়ে যায় কে জানে?
সৌহার্দ্য প্রহরের বাড়িতে এসে জানতে পারলো, প্রহর কানাডা গেছে গত পরশু। রিয়াদকে রেখে গেছে ওর বাড়িতে। সৌহার্দ্য হতভম্ব হয়ে বললো,
“কানাডা? হঠাৎ? কিন্তু কেন?”
রিয়াদ বললো, “অর্থী ম্যাম নাকি অসুস্থ! তাই খবর পেয়েই স্যার তাড়াহুড়ো করে চলে গেছে।”
সৌহার্দ্য হতাশা নিয়ে বেরিয়ে এলো। বোনের জন্য ছেলেটা এখনো এতো পাগল! দেশের বাইরে গেছে ভালো কথা! অন্তত অনলাইনে তো থাকতে পারে! বিরক্ত হয়ে গাড়িতে বসতেই সৌহার্দ্যের ফোন বেজে উঠলো। অরুণী কল দিয়েছে। সৌহার্দ্যের ইচ্ছে হলো, ফোনটা দিয়ে নিজের মাথাটা ফা*টিয়ে দিতে। বাধ্য হয়ে ফোন রিসিভ করতেই অরুণী কোনো হেয়ালি না করে বললো,
“বাবা তোমার সাথে দেখা করতে চাইছে।”
“আমি আসছি।”
ছোট করে উত্তর দিয়ে ফোন কেটে দিলো সৌহার্দ্য। এই মুহুর্তটা এতো দ্রুত এসে পড়বে ভাবেনি ও। আরমান আহমেদের সাথে কথা বলার কোনো সুযোগই হাতছাড়া করা যাবে না।
সৌহার্দ্য গাড়ি স্টার্ট দিয়ে অরুণীর বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। অরুণীদের বাড়িতে এর আগেও কয়েকবার এসেছে ও। কলিং বেল বাজাতেই কাজের লোক এসে দরজা খুলে দিলো। বললো,
“ম্যাম ঘরেই আছে।”
সৌহার্দ্য অরুণীর রিডিং রুমে বসলো। বেডরুমে ঢুকলো না৷ চেয়ার টেনে বসে আসে পাশে তাকাতেই দক্ষিণ দিকের একটা বুকশেলফের ওপরের দিকে ওর নজর আটকে গেল। এটা তো ঐ ব্যাগটা, যেটা ও আজাদ চাচার সিন্দুক থেকে নিয়েছিল। এটা অরুণীর কাছে কী করে এলো। সৌহার্দ্য ব্যাগটা হাতে নিলো। ভেতরের জিনিসগুলো দেখে নিশ্চিত হলো, এটা সেই ব্যাগটাই!
সৌহার্দ্য অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে ব্যাগটার দিকে, এমনসময় অরুণী সৌহার্দ্যের কাছে এসে বললো,
“আরে! তুমি এখানে বসেছো কেন? তোমাকে না বললাম, বাবা…..”
কথা শেষ হওয়ার আগেই সৌহার্দ্যের হাতে থাকা ব্যাগটার দিকে চোখ পড়তেই অরুণী চমকে গেল। হতভম্ব হয়ে বললো,
“এই ব্যাগ….. তুমি…”
সৌহার্দ্য বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে অরুণীর দিকে। ওর চোখের শুভ্র অংশটুকুতে লাল বর্ণের রেখা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। অরুণীর বুক ধ্বক করে উঠলো সেটা দেখে। সৌহার্দ্য দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“অরুণী, তুমি এসব করেছো এতোদিন? সেদিন তুমিই আমার এক্সিডেন্ট করিয়েছিলে? আজাদ চাচা, আমার পিয়ন, বাবার অফিসের কর্মকর্তা এতোগুলো খু*ন তুমি করেছো? মানে সিরিয়াসলি!!”
অরুণী চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। আমতা আমতা করে বললো,
“নাহ! আমি…. আমি কিছু করিনি!”
“শাট আপ। এতোদিন আমি আর প্রহর তরীকে সন্দেহ করে এসেছি। তোমার কথা তো আমরা ভাবতেই পারিনি! কারণ তোমার এসবে ফোবিয়া ছিল। আর তুমি এতোদিন ভয়ের নাটক করে আসছিলে? যেন আমরা তোমাকে সন্দেহ না করি ! আমিও গাধা ছিলাম। তোমার ফোবিয়া তো কেটে যাওয়ার কথা এতো বছরে! এভাবে সবার চোখে ধুলো দিয়ে এতোগুলো খু*ন কী করে করলে, অরুণী? কেন করেছো এসব?”
সৌহার্দ্যের চিৎকার শুনে কেঁপে উঠলো অরুণী।
#চলবে…..
(