#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-৪৭+৪৮
ড. আরমান মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। চোখের সামনে নিজের সারাজীবনের লালিত স্বপ্ন মুহুর্তেই ভেঙে ছারখার হয়ে যাবে, তিনি কল্পনাও করেননি হয়তো! টিভির পর্দায় নিজের সকল কুকর্মের সম্প্রচার দেখে তিনি বুঝতে পারছেন যে, তার নাম ধুলোয় মিশে গেছে মুহূর্তেই।
সৌহার্দ্যের চোখে মুখে আনন্দ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে প্রহর। দেখে ওর স্বস্তি লাগছে, আবার ভয়ও হচ্ছে। হঠাৎ রিয়াদ এসে বললো,
“স্যার, মাধুর্য ম্যাম এসেছেন।”
প্রহর ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
“মধু এসেছে? তাহলে পাঠিয়ে দাও ওকে! পার্মিশন নেওয়ার দরকার নেই।”
রিয়াদ মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। কয়েক মিনিটের মাথায়ই মধু ভেতরে এলো। সৌহার্দ্য চোখ বন্ধ করে সোফায় আরাম করে বসে আছে আর প্রহর কপালে আঙুল ঘষছে যেন কোনো এক গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। মধু ওদের দুজনকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বললো,
“তোমরা করেছো এসব, তাই না?”
সৌহার্দ্য চোখ খুলে একবার তাকিয়ে আবার আগের মতো বসে রইলো। প্রহর এক ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
“কী করেছি?”
মধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“কী করেছো বুঝতে পারছো না? টিভিতে কী দেখাচ্ছে এগুলো? তোমরা ছাড়া এসব কে-ই বা করবে? তরীর দ্বারা এসব করা পসিবল না। তোমরা কেন করেছো এসব?”
সৌহার্দ্য সোজা হয়ে বসলো। মধুর দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো,
“তরী সবসময় চেয়েছে ওর মায়ের সাথে অন্যায়কারী যথাযথ শাস্তি পাক। ড. আরমানের ক্ষমতার জোর বুঝতে পেরে তরী নিজে ওনাকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু সেটা করা উচিত ছিল না। আজ যেটা হয়েছে, এখন যেটা হচ্ছে, এগুলোই যৌক্তিক। সারা পৃথিবীর সামনে আজ ওনার ভালো মানুষের মুখোশ খুলে দিয়েছি আমি। এখন শুধু ওনার ওপর লিগ্যাল একশন নেওয়া বাকি!”
মধু থমথমে মুখে বসে পড়লো। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে বললো,
“তোমরা এসব কীভাবে পেলে? এই ভিডিও দুটো কোথা থেকে পেয়েছো?”
প্রহর পেনড্রাইভটা হাতে নিয়ে সেটার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইলো। কন্ঠে খানিকটা কৌতুক মিশিয়ে বললো,
“ভেবেছিলাম এই পেনড্রাইভে ইম্পর্ট্যান্ট কিছু থাকবে হয়তো! কিন্তু ভাবতেও পারিনি এটাতে তরীর মায়ের মা*র্ডা*রে*র পুরো ভিডিওটা থাকবে। আজাদ চাচা লুকিয়ে সবটা ভিডিও করে রেখেছিলেন! কিন্তু আজকে সৌহার্দ্য ড. আরমানের সামনে বসে বসে যেভাবে ওনার বলা সব কথা ভিডিও করেছে, সেটাও কম ছিল না। তুই কিন্তু ডাক্তার না হয়ে ভালো ক্যামেরাম্যান হতে পারতি, ইয়ার!”
সৌহার্দ্য পেছন থেকে কুশন নিয়ে প্রহরের গায়ে ছুঁড়ে দিয়ে বললো, “মানুষ হ!”
মধু ওদের হাসি-ঠাট্টায় তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। বরং চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে বললো,
“কিন্তু তরী? ওর কী হবে? তরী তো নিজের বাচ্চার কথা চিন্তা করে হাল ছেড়ে দিয়েছিল। কালকে ওর ফ্লাইট অস্ট্রেলিয়ার। এখন কীভাবে কী হবে?”
সৌহার্দ্য আর প্রহর দুজনেই অবাক হলো তরীর ফ্লাইটের কথা শুনে। সৌহার্দ্য বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে বললো ,
“অস্ট্রেলিয়ার ফ্লাইট মানে? তরী চলে যাচ্ছে? কেন যাচ্ছে? ওকে যেতে দেব না আমি। সব সমস্যার সমাধান তো হয়েই গেছে! এখন আমার আর তরীর মাঝে কোনো বাঁধা নেই। ওকে আমি আবার নিজের কাছে ফিরিয়ে আনবো।”
মধু কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে বললো,
“কিন্তু ড. আরমান? উনি কি এতো সহজে হার মানবেন? তরীর কোনো ক্ষতি করে দিলে কী করবো আমরা?”
প্রহর হেসে বললো,
“কিছু হবে না। ওনার বাসায় পুলিশ ফোর্স পাঠিয়ে দিয়েছি আমি। এতোক্ষণে হয়তো জেলে চলে গেছেন উনি। চলো, আমরা এখন তরীদের বাসায় যাই। ওর সাথে দেখা করাটা এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি।”
প্রহরের কথায় সম্মতি জানিয়ে ওরা তিনজনই একসাথে বেরিয়ে গেল।
এদিকে, ড. আরমান নিজের ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন পুলিশ, প্রেস, মিডিয়া হুড়মুড়িয়ে তার বাড়ির গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকছে। এমন বাজেভাবে ফেঁসে যাবেন, কখনো কল্পনাও করেননি তিনি। সৌহার্দ্য তাকে এমনভাবে ফাঁসিয়ে দিলো যে, একদম মাটির সাথেই মিশিয়ে দিলো।
কিন্তু তিনি এতো সহজে কাউকে ছাড় দিবেন না। যখন ধ্বংস হয়েছেন, তখন নিজের সাথে সাথে সবাইকে ধ্বংস করে ছাড়বেন তিনি। জেদ করেই বাড়ির পেছনের গোপন দরজা দিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন। কেউ বুঝতেও পারলো না। কিন্তু একজোড়া চোখে ঠিকই তিনি ধরা পড়লেন। সেই চোখে ছিল শুধুই হিং*স্র*তা ও বি*না*শ!
*
মধু ফোন কান থেকে নামিয়ে সামনে তাকালো। সৌহার্দ্য ড্রাইভিং করছে আর প্রহর তার পাশে বসে ফোনে কিছু একটা করছে। মধু সৌহার্দ্যকে বললো,
“ভাইয়া, তরী বাসায় নেই। অর্ণবের সাথে হসপিটালে গিয়েছে ফাইনাল চেকআপের জন্য।”
সৌহার্দ্য গাড়ি থামিয়ে চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। সৌহার্দ্যকে পরখ করে প্রহর কিছু বলার আগেই ওর ফোন বেজে উঠলো। প্রহর ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ব্যস্ত কন্ঠ শোনা গেল,
“স্যার, ড. আরমান ওনার বাড়িতে নেই। পুরো বাসা খুঁজেও ওনাকে আর ওনার মেয়ে পাইনি আমরা।”
প্রহর অতি বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে বললো,
“হোয়াট? ওনার বাড়ি থেকে বের হওয়ার ওয়ে বন্ধ রেখেছিলাম আমি। উনি বের হলেন কী করে?”
“আই ডোন্ট নৌ, স্যার! ওনাকে খুজে বের করার চেষ্টা করছি আমরা।”
প্রহর ফোন নামিয়ে পেছন ফিরে মধুর দিকে তাকিয়ে বললো,
“তরী কোন হসপিটালে গেছে চেকআপের জন্য? আরমান আহমেদ পালিয়েছে। আমাদের তরীর কাছে যাওয়াটা এখন সবচেয়ে জরুরি।”
সৌহার্দ্য চোখ খিঁচে স্টেয়ারিং-এ একটা আঘাত করলো। মধু রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম আমি। এখন কী হবে? গাড়ি ঘোরাও। হাসপাতালটা শহরের শেষ মাথায়!”
সৌহার্দ্য মধুর কথা মতো তাড়াতাড়ি গাড়ি ঘোরালো।
*
ড. আরমান নিজের বাড়ি থেকে বেশ দূরে এসে গাড়ি থামালেন। অরুণীর ফোনটা সাথে এনেছেন তিনি। সেটা থেকে অর্ণবের নাম্বারটা নিজের ফোনে তুলে নিলেন। ছেলেটার সাথে কথা বলার প্রয়োজন এখন সবচেয়ে বেশি। নাম্বারে কল করার পর রিং হলেও কেউ রিসিভ করলো। আরমান আহমেদ বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করে উঠতে পারলেন না। বেশ কিছুক্ষণ ভেবে তিনি অর্ণবের লোকেশন ট্রেস করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সে অনুযায়ী একজনকে অর্ণবের নাম্বার পাঠিয়ে দিলেন।
অর্ণব হাই স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে। এই মুহুর্তে যত তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছানো যায়, ততই মঙ্গল। তরী ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“আর কতক্ষণ, অর্ণব ভাই? একটু তাড়াতাড়ি চলো, প্লিজ!”
অর্ণব ড্রাইভিং-এ মনযোগ রেখে বললো,
“লোকালয়ের কাছাকাছি চলেই এসেছি আমরা। হাইওয়েতে উঠে গেলেই আর কোনো রিস্ক নেই।”
“জানি না কেন যেন মনটা অনেক উশখুশ করছে! আমার শুধু একটাই প্রার্থনা, অর্ণব ভাই। আমি মরে গেলেওআমার বাচ্চা দুটোর যেন কিছু না হয়! আল্লাহ আমার জীবনের বদলে হলেও ওদের জীবন বাঁচাক।”
তরীর চোখ বেয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। অর্ণব অবাক চোখে ওর দিকে একপলক তাকালো। এই মেয়েটাই সেদিন নিজের সন্তানকে পৃথিবীতে আসার আগেই মেরে ফেলতে চেয়েছিল। আর আজ? মানুষের মনে মায়া নামক জিনিসটা এতো তাড়াতাড়ি জন্মায় কী করে? বুঝে উঠতে পারে না অর্ণব।
হঠাৎ একটা গাড়ি মুখোমুখি আসতেই গাড়ি থামায় অর্ণব। তরী চমকে সামনে তাকিয়ে থাকে। তার চোখে ভীতি, বিস্ময় ও আশঙ্কা।
সামনের গাড়ি থেকে সৌহার্দ্য, প্রহর আর মধু বেরিয়ে আসে। চারপাশে অন্ধকার, এক ফালি চাঁদের আলো। তবুও সামনের গাড়িতে বসা মানুষটাকে সৌহার্দ্যের চিনতে অসুবিধা হলো না। সৌহার্দ্য ছুটে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে তরীর কাছাকাছি গিয়ে দাড়ালো। চোখ থেকে ছিটকে পানি বেরিয়ে আসতে চাইছে ওর। কিন্তু কান্না করলো না সে। বরং তরীর হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে কম্পিত কণ্ঠে বললো,
“তুমি ঠিক আছো?”
তরী অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। হঠাৎ সৌহার্দ্যের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
“বেশ ভালো আছি। তুমি কেন এসেছো? তুমি তো আমার সাথে কোনো সম্পর্ক অবশিষ্ট রাখতে চাও না, সৌহার্দ্য!”
“আমি তোমাকে সবটা বুঝিয়ে বলবো। তুমি শুধু আমার সাথে চলো একবার!”
তরী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
“বুঝতে চাই না আমি। আমি তোমাকেও চাই না। তোমাকে ছাড়া বাঁচতে শিখে গিয়েছি আমি, সৌহার্দ্য। তোমার নামটা আমি আমার অতীতের খাতায় লিখে ফেলেছি অনেক আগেই। আর এখন আমার পেছন ফিরে তাকানোর কোনো ইচ্ছে বা প্রয়োজন নেই।”
সৌহার্দ্য হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তরীর দিকে। ওর চাঁদ এতো কঠিন মনের কবে থেকে হয়ে গেল? ওর প্রতি ভালোবাসা কি ফুরিয়ে গেল? নাকি অভিমানের চাদরে ঢাকা পড়ে গেল? সৌহার্দ্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেল মুহুর্তেই!
হঠাৎ গাড়ির হর্ণের শব্দে হুশ এলো সৌহার্দ্যের। চোখ ঘুরিয়ে সামনে তাকালো সে। তাদের গাড়ির পেছনেই আরেকটা গাড়ি এসে থেমেছে। সেটা থেকে ড. আরমান বেরিয়ে এলেন। সবার দিকে তাকিয়ে ক্রুর হাসি দিলেন তিনি। তরী বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো ওনার দিকে।
“আমার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে নিজেদের জন্য অহেতুক রিস্ক নিলে তোমরা! বয়স ও অভিজ্ঞতা, দুটোতেই আমি তোমাদের থেকে এগিয়ে। তোমাদের এভাবে জিততে দেই কীভাবে বলো তো?”
আরমান আহমেদের কথা শুনে সবাই হতবিহ্বল হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলো ওনার দিকে। উনি যে এভাবে এই পর্যন্ত চলে আসবেন, ভাবতেও পারেনি কেউ।
তরী গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ওনার মুখোমুখি দাঁড়ালো। আর পালানোর কোনো পথ নেই, ইচ্ছেও নেই। তাই তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে দুই হাত একত্রিত করে তালি দিতে দিতে তরী বললো,
“বাহ্! প্রশংসার দাবি রাখেন আপনি। র*ক্তে*র প্রতি আপনার তৃষ্ণা সম্পর্কে আগেই জানতাম আমি। কিন্তু নিজের র*ক্তের জন্য এতোটা তৃষ্ণার্ত আপনি, সেটা ভাবতে পারিনি। এক সন্তানকে তো মে*রেই দিয়েছেন! আরেক জনকে মা*রার ব্যর্থতা ঘুচতে এখন আবার চলে এসেছেন!! বাহ্! বাহ্!!”
আরমান আহমেদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
“এক সন্তানকে মে*রেছি মানে?”
তরী হেসে বললো, “বিষয়টা এতোটাও কমপ্লিকেটেড না, ড. আরমান। ওটা আপনার অনাগত সন্তান ছিল, যার অস্তিত্ব পৃথিবীতে আসার আগেই আমার মায়ের সাথে মিটিয়ে দিয়েছিলেন আপনি। ঐ দিন তিনটা খু*ন করেছিলেন আপনি। নিজের স্ত্রী আর দুই সন্তান। আমি তো নিয়তির খেলায় বেঁচে গিয়েছিলাম।”
আরমান আহমেদ বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলেন। এতো বড় সত্যিটা তিনি এতো বছরেও জানতে পারেননি! নিজের প্রতি নিজেই অবাক হলেন তিনি। তবুও তার মধ্যে মনুষ্যত্ব জাগলো না। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললেন,
“যা হওয়ার হয়েছে। ওসব পুরোনো জিনিস ঘেঁটে আর কী হবে! তোমাদের জন্য আজ আমার যেই দুর্নাম হয়েছে, সেটার হিসেব বরাবর করতে এসেছি আমি এখানে।”
“হিসেব তো আমি তোমার সাথে মেটাবো, বাবা। আমার সাথে করা প্রত্যেকটা প্রতারণা ও ধোকার হিসাব নেব আমি আজ।”
অরুণীর গলা শুনে আরমান আহমেদ পেছন ফিরে তাকালেন। তার সাথে সাথে বাকি সবাইও অরুণীর দিকে তাকালো। অরুণীর চুলগুলো এলোমেলো, ওড়নাটা গায়ের ওপর অগোছালো হয়ে পড়ে আছে আর ডান হাতে থাকা বড় দা-টা মাটিতে থাকা ঘাস স্পর্শ করছে। অরুণীকে এই মুহুর্তে ধ্বংসাত্মক রূপে দেখা যাচ্ছে।
অরুনীর হাতে দা দেখে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে উঠলো সবার। ড. আরমান ভীত চোখে তাকালেন। তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন অরুণীর হিং*স্রতা। ওর মধ্যে এই হিংস্রতা তিনিই সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু নিজের জালে নিজেই এভাবে ফেঁসে যাবেন কখনো ভাবেননি তিনি।
অরুণীকে এগিয়ে আসতে দেখে ড. আরমান হালকা পিছিয়ে গেলেন। পকেট থেকে কিছু একটা বের করতে করতে অরুণীকে থামতে বললেন। কিন্তু অরুণী থামলো না। মধু ওদের দুজনকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করছে। ও বুঝতে পারছে ড. আরমানের মাথায় কিছু একটা চলছে। হঠাৎ আরমান আহমেদ নিজের হাতে থাকা বোতল থেকে তরল কিছু তরীর দিকে ছুঁড়ে দিলেন। কিন্তু মধু তরীকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ায় সেটা মধুর ওপর পড়লো আর তরী ছিটকে দূরে পড়ে গেল। দুজনের গগন-বিদারী চিৎকারে আকাশ-পাতাল এক হয়ে গেল যেন!
আকস্মিক ঘটনায় অরুণী পা থামিয়ে দিলো। তরীর দিকে তাকিয়ে দেখলো, তরী পেট চেপে ধরে কাতরাচ্ছে। আর মধুর মুখ আর গলার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। হাউমাউ করে চিৎকার করছে ও।
কিন্তু আরমান আহমেদকে দেখা যাচ্ছে না। নিজেকে বাঁচানোর জন্য এমন একটা ঘৃণিত কাজ করে লোকটা পালিয়ে গেল! অরুণী চারপাশে তাকাতে লাগলো।
অর্ণব ছুটে গিয়ে তরীকে ধরলো। প্রহর মধুর কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। ওকে বুকে আগলে ধরে কান্না করতে করতে কোলে তুলে নিলো।
সৌহার্দ্যের পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে। একদিকে বোন, আরকদিকে স্ত্রী! দুজনকে কি একসাথে কেড়ে নিলো আল্লাহ! সৌহার্দ্য নিজের চুল খামচে ধরে ওদের দিকে এগিয়ে গেল। সবাই এক গাড়িতে উঠে বসলো।
*
হসপিটালে ওটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে সৌহার্দ্য আর তরীর পরিবার। ওটিতে তরীর অপারেশন চলছে। পাশেই মধুর কেবিন। সেখানে ওকে ডাক্তাররা ট্রিটমেন্ট করছে। সৌহার্দ্য কোনো রুমেই ঢুকতে পারছে না। এতো বছর ডাক্তারি পেশায় থেকেও সাহসে কুলাচ্ছে না ওর। নিজের আঙুল কামড়ে ধরে কাঁদছে ও।
প্রহর একদম পাথরের মতো বসে আছে। ও ভাবতেও পারেনি, মধুকে ও এভাবে দেখবে কোনোদিন। সৌহার্দ্য গিয়ে ওর পাশে বসলো। হঠাৎ প্রহর বলে উঠলো,
“মধু বেঁচে থাকলেই চলবে, সৌহার্দ্য! ওর মুখ, চেহারা, কিছু লাগবে না আমার। আমার শুধু মধুকে লাগবে। ও আমার সাথে দু’বেলা ঝগড়া করবে। আমার বেঁচে থাকার জন্য এটাই যথেষ্ট।”
সৌহার্দ্য কী বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। এই দিন দেখার চেয়ে তো মৃত্যুও কম যন্ত্রণার ছিল। প্রহর আবার বললো,
“মধু না থাকলে তো ম*রেই যাবো আমি। ও না থাকলে আমায় গালাগালি কে করবে? প্লিজ, তুই ডক্টরদের বল, ওর যেন কিছু না হয়।”
বলেই সৌহার্দ্যকে ঝাপটে ধরে কান্না করে দিলো প্রহর। নিজের বুকে পাথর চেপে কান্না আটানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো সৌহার্দ্য। ওদের দুজনকে দেখে সবার চোখে অশ্রুর রেখা আরো দীর্ঘ হলো।
তরীর অপারেশন শেষে ওটি থেকে দু’জন নার্স বেরিয়ে এলেন। তার সাথে সাথে ডক্টর বের হতেই সৌহার্দ্য এগিয়ে গেল। ডক্টর সৌহার্দ্যকে দেখে বললো,
“ড. সৌহার্দ্য রায়হান! আপনার এক ছেলে আর এক মেয়ে হয়েছে।”
সৌহার্দ্য হাসতে গিয়েও হাসলো না। ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“আমার ওয়াইফ!”
ডক্টর হতাশ কন্ঠে বললেন,
“ওনার কন্ডিশন অনেক ক্রিটিক্যাল। প্রচুর আঘাত পেয়েছেন, প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে। ধাক্কার কারনে মাথায় বেশ আঘাত পেয়েছেন। আগে থেকেই ওনার প্রেগ্ন্যাসিতে কমপ্লিকেশন ছিল। আমরা ওনাকে বাঁচাতে পেরেছি, তবে উনি অনির্দিষ্টকালের জন্য কোমায় চলে গেছেন। আ’ম সো সরি, ড. সৌহার্দ্য!”
সৌহার্দ্য হতবাক তাকিয়ে রইলো। চোখ বেয়ে পানি পড়তেই কয়েক কদম পিছিয়ে গেল সে। মধুর কেবিন থেকে ডক্টর বেরিয়ে এলেন। সৌহার্দ্যের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ড. সৌহার্দ্য, আপনার বোনের ফেস পুরোটাই ঝলসে গেছে। প্লাস এসিডের এমাউন্টও অনেক বেশি ছিল। গলায় বেশ ডিপ ইনজুরি হয়েছে বলে আমাদের কিছু করার ছিল না। উই আর এক্সট্রিমলি সরি টু স্যায় দ্যাট আমরা ওনাকে বাঁচাতে পারিনি। শি ইজ নো মোর।”
সপ্তাহ খানেক পর,
শোকের ভারী ছায়া থেকে বের হতে না পারলেও সৌহার্দ্য হসপিটাল থেকে নিজের বেবি দুটোকে নিজের বাড়ি নিয়ে গেল। রোজ তরীর সাথে দেখা করতে এসে তরীর সাথে কথা বলতো। তরীর থেকে কোনো উত্তর আশা না করে সে নিজেই কথা বলতো। বাচ্চা দুটোর খেয়াল রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করতো।
একদিন সকালের দিকে তরীর সাথে দেখা করতে এসে সৌহার্দ্য ওর কেবিন ফাঁকা দেখলো। ডক্টর বললো,
“স্যার, পেশেন্টের বাবা-মা ওনাকে নিয়ে গেছেন ডিসচার্জ করে।”
সৌহার্দ্য অবাক হয়ে বললো,
“নিয়ে গেছেন মানে? কোথায় নিয়ে গেছে? ”
“সেটা তো জানি না! হয়তো অন্য হসপিটালে শিফট করেছেন।”
সৌহার্দ্য মিস্টার আফনাদ আর অর্ণবের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারলো না। ওদের বাড়িও তালাবদ্ধ পেল। কোথায় কীভাবে খুঁজবে বুঝে উঠতে পারলো না। প্রহরও এখন ওকে কোনো সাহায্য করার মতো পরিস্থিতিতে নেই। সৌহার্দ্য বুঝতে পারলো, তার চাঁদ তার থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। কিন্তু যত দূরেই যাক! ধরাছোঁয়ার বাইরে যাওয়ার সাধ্য তার নেই। আজ না-হয় কাল, তরীকে সে খুজে বের করবেই!
🍁বর্তমান🍁
সৌহার্দ্য ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো, সূর্য উঠতে চলেছে প্রায়ই। সেই ঘটনার প্রায় সাত বছর কেটে গেছে। আরমান আহমেদকে সেই রাতেই কু*পি*য়ে হ*ত্যা* করেছে অরুণী। আপাতত সে কারাদন্ড ভোগ করছে। সে সত্যি-ই অনেক খুঁজেছিল তার চাঁদকে। কিন্তু চাঁদ এদেশের কোথাও নেই। তবে তার মন আজও বলে, চাঁদ বেঁচে আছে। সে ফিরে আসবেই।
“বাবা, তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ঘুমাবে না?”
প্রণয়ের ঘুমঘুম কন্ঠ শুনে চোখের পানি মুছলো সৌহার্দ্য। ওকে শোয়া থেকে টেনে তুলে বললো,
“ঘুমানোর সময় নেই আর! সকাল হয়ে গেছে। উঠে পড়ো। আর প্রণয়ীকেও ডেকে তোলো গিয়ে।”
প্রণয় গাল ফুলিয়ে বিছানা ছেড়ে বাইরে চলে গেল। সৌহার্দ্য দুজনকে স্কুলের জন্য রেডি করে দিলো। প্রণয়ের গলায় টাই বেঁধে দিতেই প্রণয়ী এসে বললো,
“বাবা, আমার চুলে বেনী করে দাও।”
সৌহার্দ্য নিজের হাতে ঘড়ি পড়ে প্রণয়ীর চুলে বেনী করে দিলো। এতো বছর এসব করতে করতে অভ্যাস হয়ে গেছে ওর। দুজনকে ব্রেকফাস্ট করিয়ে স্কুলে ছেড়ে দেওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়লো সৌহার্দ্য।
-চলবে….
(ভুলত্রুটি মার্জনীয়)#প্রণয়াসক্ত_পূর্ণিমা
#Writer_Mahfuza_Akter
পর্ব-৪৯
ড. অরিত্রী সেহরীশ!
দরজার ওপর লেখা নামটায় নিজের আঙুল স্পর্শ করিয়ে আনমনেই হাসলো অর্ণব। নব ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখলো, পুরো ঘর বেশ অন্ধকার। জানালার মোটা পর্দা ভেদ করে ক্ষীণ আলো ভেতরে প্রবেশ করছে। নিজের হাতে কপাল চাপড়ালো অর্ণব। বিরবির করে বললো,
“নাহ, এই মেয়ে শুধরাবে না!”
ঘরের দুপাশের দুটো জানালার পর্দা টেনে দিতেই পুরো ঘর আলোয় ঝলমল করে উঠলো। শুভ্র দেয়ালে পেশাগত ডাক্তারি পোশাকের হাস্যোজ্জ্বল মেয়েটির দিকে কিছুক্ষণ অপলক চেয়ে রইলো অর্ণব। ভ্রম কাটতেই সপ্রতিভ চোখে তাকালো সে। দুরন্ত পায়ে বেডের দিকে যেতে বললো,
“ঘুম থেকে কি আজ উঠবি না? বেলা কয়টা বাজে খেয়াল আছে? আংকেল আর আন্টি ডেকে হয়রান হয়ে গেছে তোকে ডাকতে ডাকতে!”
বেডে থাকা ঘুমন্ত দেহটা হালকা নড়েচড়ে কম্বল মুড়ে উল্টো ঘুড়ে শুয়ে পড়লো। অর্ণব প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। হঠাৎ কম্বল টেনে সরিয়ে বললো,
“ডিউটি আছে না তোর? পেশেন্টরা তোর জন্য ওয়েট করবে? আমারও মিটিং আছে। উট তাড়াতাড়ি!”
ঘুমন্ত মেয়েলি সুর ভেসে এলো হঠাৎ,
“কাম অন, ইয়ার! কাল সারাদিন ওটি-তে ছিলাম। আ’ম সো টায়ার্ড। আজ সারাদিন ঘুমাবো আমি!”
অর্ণব ঘড়ি দেখলো। নাহ্, আর দেরি করা যাবে না! তাহলে সে নিজেই লেইট হয়ে যাবে। তাই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
“আচ্ছা, ঘুম ভাঙলে আফনাদ আঙ্কেলের বিপিটা একটু চেক করিস। প্রেশার বেড়েছে মনে হয় ওনার! বারবার তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল, বলছিলো অরিত্রীকে ডেকে দিতে। বেশ অসুস্থ লাগছে বলছিলো আমাকে।”
অরিত্রী কম্বল সরিয়ে এক ঝটকায় উঠে বসলো। অক্ষিগোলক বড় করে তাকিয়ে চকিত কন্ঠে বললো,
“হোয়াট? এটা তুমি আমাকে আগে বলোনি কেন?”
উত্তর এলো না। অর্ণব মিটমিট করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। অরিত্রী তড়িৎ গতিতে বিছানা ত্যাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ছুটে এলো ডাইনিং রুমে। এলোমেলো দীর্ঘ চুলগুলো মুখে গায়ে লেপ্টে যেতেই সেগুলো ঠিক করার চেষ্টা করলো সে। সামনে তাকিয়ে দেখলো, মিস্টার আফনাদ হেসে হেসে মোহনার সাথে কথা বলছেন আর খাচ্ছেন। অরিত্রী ভ্রু যুগল একত্রিত করে বললো,
“বাবা, তুমি অসুস্থ?”
মিস্টার আফনাদ সামনে তাকালেন। অরিত্রীর পোশাক দেখে বুঝার বাকি নেই যে, সে মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। নিশ্চয়ই অর্ণব ঘোল খাইয়ে ঘুম থেকে উঠিয়েছে। মোহনা নিজের হাসি লুকানোর বৃথা চেষ্টা করে বললেন,
“তোমার বাবা তোমাকে দেখেই সুস্থ হয়ে গেছেন। এখন ফ্রেশ হয়ে এসে খেয়ে নাও!”
বাবা-মাকে ওভাবে মিটমিট করে হাসতে দেখে অরিত্রী বুঝতে পারলো, অর্ণব ওকে মিথ্যে বলেছো। দাঁতে দাঁত চেপে বিরবির করে সে বললো,
“অর্ণব ভাই! বাজে লোক একটা! আমি তোমাকে ছাড়বো না।”
হসপিটাল থেকে বারবার কল আসছে। অরিত্রী কুর্তির ওপর এপ্রোন পরে কল রিসিভ করলো,
“ম্যাম, দেয়ার ইজ এন এমারজেন্সি! আ পার্সন ইজ ভেরি ব্যাডলি ইনজিওর্ড।”
“আ’ম কামিং উইথিন টেন মিনিট’স!”
অরিত্রী ফোন রেখে নিজের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল। গাড়িতে বসতেই বললো,
“আঙ্কেল, একটু ফাস্ট ড্রাইভ করবেন, ওকে?”
“কীভাবে ফাস্ট ড্রাইভ করবো, ম্যাডাম? কালকে সারারাত স্নোফল হয়েছে, আর কানাডার স্নোফল নিয়ে তো তোমার এতো বছরে বেশ ভালো আইডিয়া হয়ে গেছে আই হোপ!”
মেয়েলি কন্ঠ শুনে অরিত্রী ভ্রু কুঁচকে পাশে তাকাতেই চমকে উঠলো। চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। খুশিতে ঝাপিয়ে পড়লো মেয়েটির ওপর,
“অর্থী আপি!! হোয়াট আ সারপ্রাইজ! তুমি আসবে আমাকে আগে বলোনি কেন?”
অর্থীও অরিত্রীকে জড়িয়ে ধরলো। আহ্লাদী গলায় বললো,
“বলে দিলে তোর এই খুশিটা দেখতাম কীভাবে, হুম?”
“এজন্যই কয়েকদিন তোমাকে অনলাইনে পাচ্ছিলাম না। খুব রাগ হচ্ছিল! আমি ভাবছিলাম, তুমি বাংলাদেশ গিয়ে আমাকে ভুলে গেছো।”
অর্থী হেসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। বললো,
“তোকে তো ভুলতে পারি না! কিন্তু বিডিতে গেলে মনটাই খারাপ হয়ে যায়, ইয়ার। ভাইয়াকে দেখলেই চোখে পানি চলে আসে আমার। একটা এক্সিডেন্ট আমার হাসিখুশি ভাইটাকে কী বানিয়ে দিলো! এখন তো সে কথাও বলে না কারো সাথে ঠিক মতো।”
অরিত্রীর মন খারাপ হয়ে গেল। বিষণ্ণ মুখে বাইরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললো,
“ভালোবাসার মানুষ দূরে সরে গেলে অনেক কষ্ট হয়, আপি। মনে হয় যেন ভেতর থেকে প্রাণটাই বেরিয়ে এলো!”
অর্থী ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে হাসলো। বললো,
“তোর কথা শুনে মাঝে মাঝে মনে হয়, তুই এসবে বেশ এক্সপেরিয়েন্সড!”
অরিত্রী মলিন মুখে হাসলো। আনমনে বললো,
“এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে তো জানি না! বাট কেন যেন মনে হয় বাবা-মা যা বলে, সেসব বাদেও আমার জীবনে আরো কিছু আছে। সাত বছর আগে সব অচেনা হয়ে গেলেও কিছু কিছু জিনিস আমার মস্তিষ্কে গেঁথে আছে। এই দেশটা আমার কাছে বড্ড অচেনা লাগে, জানো? কোনো আকর্ষণ কাজ করে না আমার মধ্যে। বাবা-মা ছাড়াও আমার কাছের কেউ ছিল। হয়ত এখনও আছে! মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে অনেক কিছু আমার সামনে ভেসে ওঠে, যেগুলো নিছকই স্বপ্ন বা কল্পনা নয়। কিন্তু আমি আসলে কিছুই মিলিয়ে উঠতে পারি না!”
“আমার মনে হয়, তোর একবার বাংলাদেশে যাওয়া উচিত। হয়তো এতে তোর সাথে পজিটিভ কিছু ঘটতে পারে।”
অরিত্রী হতাশ গলায় বললো,
“কোনো লাভ নেই! আমি নাকি ছোটবেলা থেকেই এখানে বড় হয়েছি। বিডি-এর সাথে আমার কোনো যোগসূত্র আছে বলে মনে হয় না! তাছাড়া মা আর অর্ণব ভাই আমাকে যেতে দিবে না কখনো।”
অর্থী ক্ষীণ বিরক্তি মিশ্রিত সুরে বললো,
“সবার কথা ছাড়! তোর যাওয়ার ইচ্ছে নেই, সেটা বল।”
অরিত্রী বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো নীরব মুখে। এসব নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে না একটুও। ভাবলেই ভয়ে, আশঙ্কায় গলা শুকিয়ে যায় একদম!
মিস্টার আফনাদ বারান্দায় বইয়ে চোখ রেখে বসে আছেন। কিন্তু তার মনযোগ বইয়ে নেই। একটু অবসর পেলেই পুরনো অপরাধবোধ যেন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তিনি কি ঠিক করেছেন? অরিত্রীর হাসি মুখটা দেখলে মনে হয়, মেয়ের সুন্দর জীবনের জন্য তিনি যা করেছেন একদম ঠিক করেছেন। সেদিন মোহনার কথা না শুনলে আজ অরিত্রী একজন সফল ডক্টর হয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারতো না। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার মনে হয়, তিনি প্রতারণা করেছেন। সৌহার্দ্যকে ঠকিয়ে সদ্যোজাত দুটো নিষ্পাপ প্রাণকে মাতৃহীন করেছেন। সেদিন মোহনার সাথে ওনার কথোপকথন ও কার্যকলাপ এখনো চোখে ভাসে তাঁর!
~সাত বছর আগে~
“আফনাদ সাহেব, আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি! আমার মেয়ের জীবনে আমি আর কারো কালো ছায়া পড়তে দেব না। ওকে একটা সুন্দর জীবন দেওয়ার জন্য হলেও আমাদের এই দেশ ছাড়তে হবে।”
মিস্টার আফনাদ চিন্তিত মুখে বসে ছিলেন। মোহনার মুখে এমন কথা শুনে তিনি অবাক চোখে চাইলেন,
“মাথা ঠিক আছে তোমার? মেয়েটা জীবন-মৃত্যুর মধ্যে বসে আছে, আর তুমি….. পাগলামি করো না এসব নিয়ে আর!”
মোহনা চোখ মুছলেন। আজ তরীর এই অবস্থার জন্য তিনিই কোনো না কোনোভাবে দায়ী। সেদিন যদি জোর করে তরীকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে না লাগতেন, তাহলে আজ তরীর সাথে সৌহার্দ্যের বিয়ে হতো না। এগে তরীর জীবনও এমন বিপর্যয়ে পড়তো না! ভেবেই তিনি বিরস মুখে বললেন,
“আমার কারণেই আজ মেয়েটার এই অবস্থা। ওর জীবনে এতো দুঃখের জন্য আমিই তো দায়ী। আমার জন্য ওর বিয়ে সৌহার্দ্যের সাথে হলো, আর…. ”
অর্ণব ওনার কথার মাঝে দাড়ি টেনে দিয়ে বললো,
“আরেহ্ বিয়ে তো ভাগ্যের ব্যাপার! এটা নিয়ে নিজেকে দোষ দিচ্ছো কেন? তবে বিয়ের আগে ওর জীবনটা আরো সুন্দর হতে পারতো।”
মোহনা আঁচলে চোখ মুছে বললেন,
“আমার জন্য ওর কপালে কোনো সুখ জুটলো না। জন্ম দেইনি বলে ওর মা হতে পারিনি আমি। কিন্তু আর না! আমার করা ভুল আমি শুধরে নেবই। ওর জীবনে আমি আর দুঃখের ছায়া পড়তে দেব না। অর্ণব তুই সব ব্যবস্থা কর। আমরা এই দেশ ছেড়ে চলে যাবো।”
আফনাদ আর অর্ণব দুজনেই চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। অর্ণব অবাক কন্ঠে বললো,
“তরীর এই অবস্থায় কীভাবে যাবো আমরা? আর সৌহার্দ্য মানবে না কোনোদিন! ওদের দুটো বাচ্চা আছে, আন্টি!”
“তরীর চিকিৎসা বিদেশে করার ব্যবস্থা করতে হবে। অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা সবাই জেনে গেছে, তাই ওখানে যাওয়া যাবে না। আমার এক বান্ধবী কানাডায় সেটেল্ড। আমরা সেখানে যাবো। আর সৌহার্দ্য বা অন্য কাউকে কিছু জানানো যাবে না। সবটাই লুকিয়ে করতে হবে।”
মিস্টার আফনাদ তেতে উঠে বললেন,
“পাগল হয়েছো? তুমি যেমন তরীর মা, তেমনি তরীও দুটো সদ্যোজাত বাচ্চার মা। ওদের থেকে তরীকে আলাদা করতে কীভাবে চাইছো তুমি?”
মোহনা কারো কথা কামে নিলেন না। নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থেকে অর্ণবকে সবটা করতে বাধ্য করলেন। হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ নিয়ে রাতের প্রাইভেট ফ্লাইটে কানাডা পাড়ি জমালেন তারা।
প্রায় মাসখানেক পর তরী কোমা থেকে বেরিয়ে এলো। চোখ খুলতেই নিজেকে নিজেই চিনতে পারলো না সে। সে এরকম কীভাবে হলো? তার বয়স তো মাত্র সাত বছর হওয়ার কথা ছিল! তার মা কোথায়? মাকে কি সত্যি সত্যিই মেরে ফেলেছে? নাকি ওটা একটা দুঃস্বপ্ন ছিল? তরীর অস্বাভাবিক আচরণ দেখে ডক্টর ক্লারা বললেন,
“উনি কি এর আগে কখনো কোনো এক্সিডেন্ট বা বাজেভাবে আহত হয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ, অনেক ছোট ছিল তখন ও। ওর মায়ের মৃত্যু নিজের চোখে দেখেছিল। এরপর ওর বাবা ওকে…..”
মিস্টার আফনাদ সবটা খুলে বলতেই ডক্টর চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালেন। বললেন,
“আসলে এরকম কেইস অনেক রেয়ার। কিন্তু এটাই আপনাদের পেশেন্টের সাথে ঘটেছে। ওর সাত বছর বয়সের এক্সিডেন্টের পরবর্তী সময় থেকে রিসেন্ট এক্সিডেন্ট পর্যন্ত সময়টা ওর মেমোরি থেকে হারিয়ে গেছে। ওর এখন শুধু মনে আছে সেই এক্সিডেন্টের আগের সময়টুকু। খুবই ক্রিটিক্যাল স্টেজে আছে মেয়েটা। আপনারা সবাই ওর কাছে অচেনা।”
অর্ণব আর মিস্টার আফনাদ নির্বাক হয়ে বসে রইলেন। মোহনার মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
“এক্সিডেন্ট দুটোর মধ্যবর্তী সময়ের স্মৃতি কি ওর আর কখনো মনে পড়বে না?”
“পড়বে। হিস্ট্রি রিপিট’স ইটসেল্ফ! যদি কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়, পুরনো জায়গা ও মানুষগুলো ওর চোখে ধরা দেয়, তাহলে ধীরে ধীরে তরীর সবটা মনে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।”
মোহনা সিদ্ধান্ত নিলেন, তরীকে তার আগের জীবন থেকে সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে ফেলবেন। একটা নতুন জীবনের সাথে পরিচয় করাবেন, যার প্রতিটি প্রভাত হবে ভালোবাসায়। সারাজীবন যতটা ভালোবাসার ঘাটতি তরী অনুভব করেছে, তার সবটা পুষিয়ে দিতে হবে তাকে।
দুর্বলতার খোলসে আবৃত কঠিন সত্তার সেই তরী নামটা চিরতরে হারিয়ে গেল সেদিনই! কোমল, মিষ্টি ও প্রাণবন্ত অরিত্রীকে নিজের হাতে গড়ে নিলেন মোহনা। নিজের স্বপ্ন পূরণের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে একবারও পেছন ফিরে তাকানোর সুযোগ দিলেন না ওকে।
বর্তমানে অরিত্রী একজন সফল কার্ডিওলজিস্ট। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন তার পূরণ হলেও কেন যেন মনে হয় এর জন্য বেশ বড় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তাকে। সৌহার্দ্য, মধু, দাদী, রায়হান, সুজাতাকে সে ভোলেনি। নিজের বাবার করা সেই নিষ্ঠুরতাও মনে আছে। কিন্তু সবটা সে এখন ভুলে থাকতে চায়। তবুও মনে একটা প্রশ্ন জাগে! সাত বছর বয়সের সেই এক্সিডেন্টের পর তারা কানাডায় চলে এলে এই দেশ তার কাছে এতো অচেনা লাগে কেন? তার মা-বাবা কি মিথ্যে বলছে নাকি এটা তার মনের ভুল? হয়তো সে-ই ভুল ভাবছে!
*
সৌহার্দ্য বেশ তাড়াহুড়ো করে হসপিটালে ঢুকছে। একটা সার্জারি আছে আজকে। কিন্তু প্রণয়-প্রণয়ীকে স্কুলে দিয়ে আসতে গিয়ে জ্যামের কারণে লেইট হয়ে গেছে। চেম্বার থেকে ড্রেস চেঞ্জ করে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলো সে। হাতে গ্লাভস পরতে পরতে হাঁটার সময় সিনিয়র ডক্টরের সাথে ধাক্কা লাগলো। ডক্টর হেসে বললেন,
“বি কেয়ারফুল, মাই বয়! এতো তাড়াহুড়োর কি আছে?”
“স্যার, অপারেশন ছিল একটা। তাই….”
“সেটা আরো আধাঘন্টা পিছিয়ে দিয়েছি। অন্য একটা ইমার্জেন্সি পড়ে গেছে হঠাৎ!”
“আচ্ছা? এটা তো আমাকে কেউ জানায়নি!”
“তুমি এলে আমিই জানাবো ভাবলাম। তোমার কিউট বাচ্চা দুটো কেমন আছে?”
সৌহার্দ্য মলিন হেসে বললো,
“বুঝে উঠতে পারি না, স্যার! মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার ভালোবাসা ওদের জন্য যথেষ্ট না।”
“মায়ের অভাব পূরণ করা কি এতো সহজ? তুমি সেকেন্ড ম্যারেজ করছো না কেন? আই হাইলি রেকমেন্ড ইউ টু ম্যারি এগেইন!”
সৌহার্দ্য ম্লান কন্ঠে বললো,
“আপনি কখনো কাউকে ভালোবেসেছেন, স্যার?”
ডক্টর চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো, “আমার স্ত্রী আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমি বোধহয় ততটা ভালোবাসি না।”
সৌহার্দ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“কখনো ভালোবাসবেনও না। ভালোবাসা একটা ভুল, যা আমি করে ফেলেছি। হয়তো সারাজীবন এই ভুলের মাশুল গুনতে হবে আমায়।”
সৌহার্দ্য সামনের দিকে চলে গেল। ডক্টর ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার এতো বছরের জীবনে ভালোবাসার চেয়ে রহস্যময় জিনিস আর দ্বিতীয়টা দেখেছেন বলে মনে পড়ছে না। সৌহার্দ্য তারই ছাত্র ছিল। কিন্তু সৌহার্দ্যকে আজ নিজের থেকে বেশি অভিজ্ঞ মনে হচ্ছে। হয়তো ও জীবনবোধ বেশি করে অনুভব করেছে বলেই!
-চলবে…..
(এই পর্ব লিখতে পাঁচ ঘন্টা লেগেছে 🙂)