প্রণয়াসিক্ত চিরকুট পর্ব -৪

#প্রণয়সিক্ত_চিরকুট
#পর্বঃ০৪
#Rifat_Amin

পরদিন ভার্সিটিতে দুটো ক্লাস শেষ হতে না হতেই আর মনোযোগ বসানো গেলো না। ঘড়িতে তখন দুপুর বারোটার কাছাকাছি। রোদে ভাজাভাজা হয়ে যাচ্ছে পুরো ঢাকা শহর। এই দুপুরে কোথায় যাওয়া যায়? পার্কে কি একটু হাঁটাহাঁটি করবো নাকি ফুচকা খেতে যাবো? আমরা চার মানবী ক্লাস থেকে বেড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেই চিন্তাই করাছিলাম। অতঃপর সিদ্ধান্ত হলো, এখন ফুচকা খাওয়া হবে। অনেকদিন থেকে দলবেঁধে কোথাও ফুচকা খাওয়া হয় না। আমি সবার সামনে দিয়ে হেঁটে বের হচ্ছিলাম। এর মাঝে হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা লাগায় নাকমুখ কুঁচকে গেলো আমার। যেভাবে উড়নচণ্ডী রুপে দৌড়ে দৌড়ে হাটছিলাম তাতে ধাক্কা লাগারই কথা। তীব্র ব্যাথা নিয়ে মাথা নিলে তাকাতেই প্রণয়ের অগ্নি মুখশ্রীটা দেখেই নিভে গেলাম। ভাগ্য আমার এত খারাপ কেনো? ভেবে ছিলাম আজ ধুৃঁয়ে দিবো আগন্তুককেঃ। কিন্তু উনার চেহারা দেখে আর সে সাহস হলো। আমাকে দেখেই বিরক্তিমাখা কন্ঠে উনি বললেন,

‘এই মেয়ে। দেখেশুনে হাঁটতে পারো না। দেখে দেখে কি আমার উপরই এসে পড়তে হবে! ‘- প্রণয়

আমি উনার রাগের কোপানলে পরে মিইয়ে গেলাম। কথা এগিয়ে এসে বললো,

‘ এইযে মি. অভদ্র জিজু৷ আপনার কি চোখ নেই! দেখছেন ভদ্র মেয়েটা শান্তশিষ্টভাবে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে। আর ওমনেই সামনে এসে দাঁড়ালেন! নিজের বউ বলে কি যেখানে সেখানে ধাক্কা খাবেন নাকি! ‘ -কথা

‘শাট-আপ। এই মেয়ে, এত বকবক করা স্বভাব কেনো তোমার? আর কোন বউয়ের কথা বলছো? ও আমার কোনো বউ টউ না। ‘- প্রণয়

প্রণয় রাগীস্বরে এত কথা বললেও কথামালা গায়ে মাখছে না। প্রণয়ের প্রশ্নের জবাবে কথা একটু ভাব নিয়ে বললো,

‘ আমার নাম কথামালা। বেশী কথা বলাই আমার বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আপনার মাঝে প্রণয়ের কোনো ছিটেফোঁটা আছে বলে মনে হয় না’ -কথা

এদিকে আমার নাক গিয়ে উনার বুকে লাগায় প্রচন্ড ব্যাথা করছে। হঠাৎ নাক থেকে তরল কিছু বের হতেই দেখলাম রক্ত! আশ্চর্য, সামান্য একটু আঘাতে রক্ত কেনো বের হলো!
আমি চোঁখমুখ খিঁচে নাদিয়াকে বললাম,

‘ একটা টিস্যু দে তো ‘- আমি

নাদিয়া টিস্যু এগিয়ে দিতেই মেহজেবিন বললো,

‘ হায় হায়! রক্ত বের হলো কেমনে! দেখি তো’ -মেহজেবিন

টিস্যু নাকে ধরতেই ভীষণ যন্ত্রণা শুরু করলো। অধিক জ্বালায় চোখ দিয়ে পানি বের হলে সামনে তাকিয়ে দেখলাম উনি এখনো পাষানের মতো দাঁড়িয়ে আছে। বউ না হই, ফ্রেন্ড না হই, অন্তত মানুষ হিসেবে একটু যদি এগিয়ে আসতো! আমার ভাবনার মাঝেই উনি এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে বললো,

‘ পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে৷ দেখে শুনে তো চলতে পারেন না দেখছি। অথচ আমার থেকে ১৫ দিনের বড় হওয়ায় বেশ ভাব নিচ্ছেন! ‘-প্রণয়

আমার রাগ ক্রমশ বাড়লো। ঝট হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রুদ্ধস্বরে বললাম,

‘ কোন অধিকারে ছুঁলেন আপনি? লাগবে না পানি দেয়া। কথা , সবাইকে নিয়ে চলে যায়। ‘ -আমি

প্রণয় কথা বললো না। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আমার প্রতি! অতঃপর নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করো, ‘আচ্ছা কোন অধিকারে ছুঁয়েছি? প্রণয় চৌধুরী কোনো মেয়েকে ছুঁয়েছে! ‘

ভার্সিটি থেকে পাঁচ মিনিটের পথ হাঁটলে তবে নাদিয়ার বাসা। খুব বেশী একটা দূরে না হওয়ায় সে কখনো রিক্সা নেয় না। হেঁটে হেঁটেই বাসা পৌছে যায়। বাসা যেতেই পাশে একটা বড় বাজার লক্ষ্য করা যায়। সেই বাজারের সাইড দিয়ে ছাতা মাথায় হেঁটে যেতেই হঠাৎ নাদিয়ে লক্ষ্য করলো, একটু দূরে বাইকে বসে কেউ চোখে হাত দিচ্ছে। লোকটাকে দেখেই আর একটুও চিনতে অসুবিধা হলো না নাদিয়ার। এতো তাঁর স্বপ্নের পুরুষ। তাঁর স্বপ্নের আকিব আহমেদ! কিন্তু এই উত্তপ্ত রোদের মাঝে দাঁড়িয়ে কি করছে? চোখে কোনো পোকা-টোকা পড়েনি তো? আর একমুহূর্ত সেখানে না থেকে তারাতাড়ি সেই বাইকের কাছাকাছি গিয়ে বললো,

‘ ভাইয়া আপনি ঠিক আছেন তো? চোখে কি হয়েছে? ‘- নাদিয়া

আকিব একটু চোখ খোলার চেষ্টা করে বললো,

‘ আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না! ‘ -আকিব

নাদিয়া একটু ক্ষুণ্ন হলো। অতঃপর স্বাভাবিক স্বরে বললো,

‘ আমি নাদিয়া ভাইয়া। ফাহমিদার ফ্রেন্ড। দেখি তো আপনার চোখে কি হয়েছে? ছাতাটা মাথায় ধরুন। রোদে একেবারে পুরে যাচ্ছেন তো! ‘ -নাদিয়া

আকিব না চাইতেও ছাতাটা হাতে নিলো। আসলেই এই রোদে টিকে থাকা যাচ্ছে না। মাথার চুল পুরে গেছে কি না সন্দেহ! জীবনে প্রথমবার বাজার করতে এসে ভালোই বুঝতে পারছি, কতধানে কত চাল। অথচ এখনো শুরুই করিনি বাজার। কিভাবে যে কি করবো তাও জানি না! সবসময় তো দারোয়ান-ই বাজার করে দেয়! কিন্তু আজ উনিও আসেননি, আর এদিকে ফাহমিদা আর প্রণয়ের আমাদের বাসায় আসার কথা। ভালোমন্দ কিছু রান্না না করলে হয়! অতঃপর বাবার আদেশে এই কড়া রোদের মধ্যে বাইক নিয়ে বাজারে আসতে হলো। আর এসেই, হুট করে একটা পোকা চোখে পড়ায় দারুণ ফ্যাসাদে পড়ে গিয়েছি! কেনো যে সানগ্লাসটা আনলাম না!
এদিকে নাদিয়া কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না! চোখে হাত দিয়ে কি দেখবে কি হয়েছে! যদি মাইন্ড করে! গায়ে পড়া মেয়ে ভাবে? নাদিয়া পার্স থেকে একটা টিস্যু বের করে বলোো,

‘ ভাইয়া আপনি ছাতাটা মাথায় ধরুন ভালো করে। আমি দেখছি চোখে কি হয়েছে! ‘ – নাদিয়া

আকিব সামান্য ইতস্তত করলেও ভাবলো এই বিপদের সময়ে তাও কেউ জুটলো। শয়তান পোকা আর চোখে ঢুকতে সময় পেলো না! সে হঠাৎ লক্ষ্য করলো, মেয়েটার দেয়া ছাতা শুধুমাত্র নিজের মাথার উপর, অথচ সে কিনা কড়া রোদে দাঁড়িয়ে আমার চোখের সমস্যা দূর করতে উদ্যত হচ্ছে। টিস্যুটা ভাজ করার সময় নাদিয়াকে ভালো করে লক্ষ্য করলো আকিব। একমিনিট রোদে থাকতেই কেমন চোখমুখ লাল করে ফেলেছে। ফর্সা মুখশ্রী হওয়ায় টকটকে লাল একেবারে। অথচ নির্দয়ের মতো শুধু নিজের মাথায় ছাতা রেখেছি আমি। অতঃপর নাদিয়া চোখে হাত দিতেই আকিব ওর মাথায় ছাতাটা ধরে বললো,

‘ সবসময় অন্যের কথা ভাবতে হয় না। আগে নিজেকে রক্ষা করো, তারপর নাহয় মানুষকে হেল্প করো। ‘ -আকিব

নাদিয়া সেই কথা শুনেও শুনলো না। মনোযোগ দিয়ে চোখ থেকে ছোট্ট পোকাটা বের করে একটা লম্বা ফু দিয়ে দিলো। অতঃপর বললো,

‘ দেখুন তো এখন জ্বালা করছে কি না! ‘ -নাদিয়া

‘ আরে একদম না! বাঁচা গেলো বাবা। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে! ‘ -আকিব

নাদিয়া মনে মনে বললো, নিজের বউকে আবার কিসের থ্যাংস? আপনি তো একদিন আমার হবেন। শুধুই আমার। নাদিয়া এসব ভাবতেই আকিব বললো,

‘ বাসা ফিরছো নাকি? তাহলে বাইকে উঠে পড়ো। বাজার করতে এসেছিলাম। যে রোদ, এখন বাজারে ঢুকলে বেঁচে ফিরতে পারবো বলে মনে হয় না। তাঁর থেকে বরং তোমায় বাসায় লিফ্ট দেই। তাহলে তোমারো উপকার হবে। ‘- আকিব

নাদিয়া যেনো স্বর্গসুখ হাতে পেলো। মনতো চাইছে এই বাইকে উঠে পৃথিবী ঘুরে আসি, কিন্তু মানসম্মান বলেও তো একটা কথা আছে। বাইরে সামান্য ইতস্তত ভাব দেখিয়ে বাইকে উঠে পড়লো সে। সাথে সাথেই এক মন মাতানো পারফিউমের সুগন্ধ ওর নাসারন্ধ্রকে প্রভাবিত করলো। এই কড়া সুগন্ধটা একমাত্র উনার কাছাকাছি থাকলেই পাওয়া সম্ভব!

বিকালের শেষ সময়টা বরাবরই অনেক সুন্দর হয়। চারপাশে সুন্দর ফুরফুরে হাওয়া বয়ে যায়! ক্ষণে ক্ষণে আকাশের রং বদলে যায়! আর কেমন একটা বিসর্জনের সুর উঠে, পুরো একটা দিনকে বিদায় জানানোর সুর!
আর এই মহুর্তটাই সব থেকে রোমাঞ্চকর, অনুভূতিপূর্ণ। যদিও সেটা ইট-পাথরের শহর থেকে অনুভব করা খুব শক্ত। প্রণয়দের বাসার ছাদ থেকে টকটকে লাল হওয়া সুর্যটাকে দেখে দেখে নিজের অস্তিস্ত সম্পর্কে ভাবছিলাম আমি। এখন সন্ধার ঠিক আগের সময়টা। সন্ধার পর প্রণয়কে নিয়ে আমাদের বাসা যাওয়ার কথা আছে। তবে প্রণয় যাবে কি না সেটা এখনো নিশ্চিত নই। একটু আগে অর্কের নাম্বার থেকে একটা মেসেজ এসেছে। মেসেজটা দেখার পর থেকে কেমন জানি অসহ্য লাগছে সবকিছু।

‘ ফাহমিদা, তুমি বোধহয় আমার প্রতি রাগ করে আছো। আর রাগ করে থাকবে না প্লিজ।
আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সামানা-সামনি বলার সাহস হয়নি। হয়তো কখনো হবেও না। তাই মেসেজেই বলছি। আসলে বিয়েটা কখনো আমার সাথে তোমার ঠিক হয়নি। বরং হয়েছিলো প্রণয়ের সাথে।
তার আগে বলি, তোমার ভাইয়া আকিব আহমেদ কিন্তু আমার ফ্রেন্ড। সেই সুবাধে ওর সাথে নানান যায়গায় ঘুরাঘুরি, আড্ডা দেয়া হয়েছে। হঠাৎ ওর ফোনে তোমার ছবি দেখে চোখ আটকে যায় আমার। পছন্দ হয়ে যায়। যদিও আমার জন্য না, আমার ছোটভাইয়ের জন্য। আরও একটা কথা বলে রাখি, প্রণয়ের একটা বড় বোন ছিলো। তোমার থেকেও তিনবছরের বড় বোধহয়। হঠাৎ এক দূর্ঘটনায় সে আ-ত্মহ-ত্যার পথ বেছে নেয়। তারপর থেকে প্রণয় কেমন চুপ হয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও ওর মুখ থেকে কথা বের করানো সম্ভব হয়নি। ওকে নিয়ে বিভিন্ন ডক্টরের কাছে ছুঁটে গিয়েছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। বরং ওর রাতবিরাতে বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়ার হারটা ক্রমেই বেড়েছে। কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি, প্রণয় একমাত্র তোমার সংস্পর্শে এলেই কথা বলতে জানে। ঝগড়া করে জানে। আমি প্রথম প্রথম নিজের চোখকেও বিশ্বাস করিনি। তারপর সব পরিষ্কার হয়। যখন আকিবের ফোনে তোমার ছবি দেখি। তখন আব্বুর সাথে কথা বলে ওর বিয়ের ব্যাবস্তা করে দেয়ার চেষ্টা করি। কেননা তুমি ওর পাশে থাকলেই ও কেবল কথা বলতে পারবে। প্রথম প্রথম হয়তো তোমার অনেক সমস্যা হবে ওকে টলারেট করা। কিন্তু ও যদি সুস্থ হয়ে যায়, তাহলে দেখবে, এই ছেলের মতো এত স্নিগ্ধ, এত বিনয়ী, এত ভালোবাসা, তুমি কোথাও খুঁজে পাবে না। প্রণয় আমার অনুগত বলেই হয়তো আমার পালিয়ে যাওয়ার কথা শুনে ও হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো। পরে ওর সাথে অনেক ঝামেলা করে বিয়েতে রাজি করিয়েছি। এই সম্পর্কে তোমার পরিবার সম্পূর্ণ অবগত। আশা করি ওর পাশে থাকবে তুমি। আর প্রণয়ের বড় বোন প্রেয়সী কেনো আ-ত্মহ-ত্যা করেছে তা আস্তে আস্তে জানতে পারবে। নাহলে তুমি নিজেই খুঁজে নিও।
তোমাদের একটা সুখী জীবন কামনা করি।
আল্লাহ হাফেজ। ‘

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here