প্রণয়াসিক্ত চিরকুট পর্ব -৫

#প্রণয়াসিক্ত_চিরকুট
#পর্বঃ০৫
#Rifat_Amin

পুরো বিকেলটা কাটলো ছাদের মধ্যে পায়চারি আর গভীর ভাবনায়। তারপর যখন পশ্চিমাকাশের হলদে ভাবটা ক্রমেই টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করলো, তখন ছাদ থেকে নেমে আসার প্রস্তুতি নিলাম। হঠাৎ নাকে হাত দিতেই অনুভব করলাম ব্যাথাটা ক্রমেই বাড়ছে। একটু পর তো আবার প্রণয়কে নিয়ে আমাদের বাড়িতে যেতে হবে। উনি কি যেতে রাজি হবে? নাকি আবারো রাগারাগি করবেন? তখনি মসজিদের মাইক থেকে মাগরিবের নামাজের জন্য পবিত্র ডাক শোনা গেলো। আমি তখন মাথায় ওড়নাটা উঠিয়ে দিতেই হঠাৎ প্রণয় ছাদে এসে আমাকে দেখে বললো,

‘ আপনি এখানে যে! ‘ -প্রণয়

‘ বিকাল থেকেই এখানে আছি। আচ্ছা আপনি কি আমাদের বাসা যাবেন না? আপনি না গেলে হয়তো আব্বু-আম্মু মন খারাপ করবে!’ -আমি

প্রণয়ের পরণে তখন ব্লাক থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। আর শরীরে বার্সেলোনার নিউ কালেকশন জার্সি। উনি ছাঁদের ট্যাপটা ছেড়ে দিয়ে ফুলের গাছগুলোকে পানি দিতে ধরে বললেন,

‘আমার যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু ভাইয়া কড়া নির্দেশ দিয়েছে, আর আব্বুও প্রেসার দিচ্ছে। তাই আর না করতে পারলাম না। তবে আমি শুধু যাবো আর আসবো। ওকে? আর ওখানে কিন্তু থাকতে পারবো না’ -প্রণয়

উনার থেকে পজিটিভ আশ্বাস পেয়ে আপনা-আপনি হাসি বের হলো আমার। উনি আসলেই তেমন কারো সাথে কথা বলেন না। অথচ আমার দেখলেই গায়ে পরে ঝগড়া করতে আসেন। আমি হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়ালে উনি বলেন,

‘ নামাজ পড়তে জানেন নাকি শুধু বন্ধুদের সাথে দৌড়াদৌড়ি করতে শিখেছেন? ‘-প্রণয়

‘ হুম, নামাজ পড়তে জানি। তা নিজে কই নামাজ পড়তে গেলেন? আবার অন্যকে জ্ঞান দিচ্ছেন!’ -আমি

ঠিক তখনি রাস্তা থেকে কিছু আওয়াজ আসলো। মনে হয় কারো কথা-কাটাকাটি হচ্ছে। প্রণয় ফুলের গাছগুলোকে পানি দেয়া অফ করে করে ছাদের কার্নিশ দাঁড়িয়ে নিচে কি হচ্ছে তা দেখার চেষ্টা করলো। আমিও ছুটে গেলাম সেখানে। এখনো সূর্যের সামান্য আলো বিদ্যমান। সন্ধ্যের সেই আলো-আঁধারিতে লক্ষ্য করলাম, নিচে একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মাঝে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। প্রণয় এই দৃশ্য কয়েক সেকেন্ড লক্ষ্য করতেই হঠাৎ ছাদের পাশের আম গাছে তরতর করে উঠে গেলো। আর চোখের নিমিষেই একদম সেই রাস্তায় উপস্থিত! এদিকে আমি ছেলে-মেয়ে দুটোর ঝগড়া লক্ষ্য করছিলাম। প্রণয় যে এমনটা করবে ভাবতে পারিনি। রাস্তাটা একদম চৌধুরী ভিলার পেছনের অংশ দিয়ে চলে গেছে। সেই রাস্তার পাশের আমগাছটা প্রচন্ড রোদে এই সুবিশাল ছাদকে ছায়া দেয়। হঠাৎ প্রণয় ওখানে গিয়ে ওদের কথা কাটাকাটি থামিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলো,

‘ কি হয়েছে আপু? ‘ -প্রণয়

মেয়েটা বোধহয় আমার থেকে বড় হবে না, সবে স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছে। আর ছেলেটা প্রণয়ের বয়সী। ইতোমধ্যে অনেকলোক জড় হয়েছে সেখানে। মেয়েটা ইতস্তত করে বললো,

‘ ভাইয়া, এই ছেলেটা তখন থেকে আমার পিছু নিচ্ছে আর বাজে কথা বলছে। আর হঠাৎ উনি ওড়না ধরে টান দিয়েছিলো। আমি কিছু বলতে গেলেও উনি অস্বীকার করে। আবার হুমকি দিচ্ছে!’ -মেয়েটা

প্রণয় মেয়েটার কথা শুনে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ কথা কি সত্যি?’ -প্রণয়

‘ হ্যাঁ সত্যি। তোর সমস্যা কি বে! এখান থেকে ফুট! ‘ -ছেলেটা

‘ আবার বল দেখি কি বললি! ‘ -প্রণয়

প্রণয়ের ক্ষেপে যাওয়া চেহারা দেখে বুঝলাম আজ কিছু একটা হয়ে যাবে। আমি তৎক্ষনাৎ চিৎকার করে বললাম,

‘ আপনি ওখান থেকে চলে আসুন প্রণয়। কি করছেন কি?- আমি

প্রণয় যে কি লেভেলের ক্ষেপে গিয়েছে। তা উনার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। এই ছেলে আজ শেষ! অতঃপর
প্রণয় একবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ এই আপনি এখানে কি করেন। ভীতরে যান। ‘ -প্রণয়

কথাটা বলেই প্রণয় ছেলেটার শার্টের কলার ধরে সজোড়ে নাক বরাবর একটা ঘু-ষি দিয়ে বললো,

‘ তুই কার সাথে কথা বলছিস! তুই জানিস? এক্ষুণি মেয়েটাকে আম্মা বলে ডাক দে। নাহলে তোর এই মুখ আর হাত আমি ভেঙ্গে ফেলবো ‘ -প্রণয়

প্রণয়ের তীব্র আঘাতেই নাক নিয়ে লুটিয়ে পড়লো ছেলেটা। আশেপাশের অনেকেই তখন জড় হয়ে গেছে। তারা প্রণয়কে ভালো করেই চেনে। তাই ঝামেলাটাকে থামানোর বৃথা চেষ্টা চেষ্টা করলো না। এদিকে আমি ঠিক কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না! আন্টিকে কি একবার ডাক দিবো? কিন্ত ততক্ষনে তো এই ছেলেকে একেবারে মে-রে-ই ফেলবে প্রণয়। আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ ছেলেটা নাক ধরে দাঁড়িয়ে বললো,

‘ ভালো হচ্ছে না কিন্তু। এর শোধ আমি তুলবো’ -ছেলেটা

‘ তোর শোধ তোলার সময় আমি দিলে তো’ -প্রণয়

প্রণয় কথাটা বলেই রাস্তার পাশের মোবাইল শো-রুমে ঢুকে ওখানকার একটা ছেলের থেকে সাইকেলের চেইন বের করলো। আমার চোখ কপালে উঠার জোগাড়! আরে কেউ থামাচ্ছে না কেনো! পাগল নাকি সবাই? আমি চিৎকার করে বললাম,

‘আপনি পাগল হয়ে গেছেন মি. প্রণয়। ভীতরে আসুন প্লিজ। এই যে, কেউ থামাচ্ছেন না কেনো? ‘-আমি

মেয়েটাও ভয় পেয়ে গেছে ইতোমধ্যে। সে কখনো ভাবেনি এত বড় ঝামেলা বেঁধে যাবে। এদিকে ছেলেটা ফোন করে ওর সাঙ্গোপাঙ্গকে ডাকছিলো। ইতোমধ্যে চৌধুরী বাড়ির সব গার্ড বাড়ির পিছনে এসে জড় হয়েছে৷ কিন্তু ভয়ে কেউ এগোচ্ছে না। জানের ভয় আর চাকরির ভয় দুটোই দানা-বাঁধলো মনে। প্রণয় এগিয়ে এসে চেইন দিয়ে মা-রতে মা-রতে ছেলেটার পা ফাটায় দিলো। সাথে শোনা গেলো ছেলেটার করুণ আর্তনাত। আমি তাজ্জব বনে গেলাম। আমি এলোপাতাড়ি কাকে ডাকছি তাও বুঝতে পারছি না। ওনাকে হাজার থামতে বললেও উনি বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য করছেন না আমায়৷ উনার আচরণে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। একটা অচেনা অজানা মেয়ের জন্য এত বড় বিপদ ডেকে আনলেন উনি! একটা কথাবার্তা বলে হয়তো ঝামেলাটা মিটানো যেতো। কিন্তু এবার তো দেখছি বিষয়টা পুলিশ কেস পর্যন্ত এগোবে। আমার কলিজার পানি উবে গেলো। আর একমুহূর্ত সেখানে দাঁড়ালাম না। নিচে এসে দেখলাম বাড়ির সবাই জড় হয়েছে। ছেলেটার অবস্থা কাহিল। প্রণয় ছেলেটার ফোন হাতে নিয়ে এম্বুলেন্সকে ফোন করে এখানে আসতে বললো।

—-

ঘড়িতে রাত ৮ টা বেজে ১০ মিনিট। চারদিকে তখন অমাবশ্যার ঘন কালো অন্ধকার। আর এই ঘন অন্ধকারের মতোই পুরো বাড়ি নিঝুম হয়ে আছে। সবার মনেই হতাশা। চৌধুরী বাড়ির ছোট ছেলের জন্য হাহাকার। ছেলেটা এত পাষাণ কিভাবে হলো!
ড্রাইংরুমে সবার মাথায় হাত দেখে আমি আর সেদিকে এগোলাম না। প্রণয় একটু আগে বাসায় ফিরেছে। এখন ফ্রেস হচ্ছে বোধহয়। আমি রুমে প্রবেশ করতেই হঠাৎ পাশের রুম থেকে কারো কান্নার আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠলাম। তিনদিন থেকে এই বাসায় থাকলেও কখনো এই রুমটা খোলা হয়নি, এবং আমার জানামতে এই রুমে কেউ থাকে না। তাহলে কে আছে ভীতরে। আমি রুম থেকে বেড়িয়ে পাশের রুমটায় প্রবেশ করলাম। নাহহ! কেউ নেই। তবে রুমের লাইট জ্বালানো। কান্নার শব্দটা আর পাওয়া যাচ্ছে না। ওখানে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেই হঠাৎ ওয়াশরুম থেকে পানির আওয়াজ পেলাম। ভয়ে অন্তর-আত্মা শুকিয়ে গেলো আমার। ভুত-টুত নেই তো! ধুর কিসব ভাবছি আমি!
আমি আস্তে আস্তে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গিয়ে কি-হোলে চোখ লাগিয়ে দেখলাম ভেতরে কেউ ঝরনার পানিতে গোসল করছে।
এদিকে দরজায় সামান্য চাপ লাগতেই দরজাটা খুলে গেলো। আর ওমনেই হুরমুর করে পিচলে ভীতরে পড়ে গেলাম ৷ আবারো ভাগ্যের জোরে প্রণয়ের উদম শরীরের উপর পড়েছি। নাহলে আজ আমার বাপের যাওয়া বের হতো! পরে গিয়ে যতটা ব্যাথা না পেয়েছি, তার থেকেও খুশি হয়েছি উনাকে দেখে। এখানে যে ভুত নেই, এটা ভেবে শান্তি পেলাম। প্রণয় আমার পরে যাওয়া দেখে হুট করে উঠে শাওয়ার অফ করে বললো,

‘ আপনি কি দেখে দেখে আমার উপরই পড়েন? আর পরার কোনো যায়গা নাই? ‘ -প্রণয়

ভাবলাম প্রণয় হয়তো আজ আমাকে তুলে আ-ছা-ড় দিয়ে তবে ছাড়বে। কিন্তু উনার এতটা ভদ্র আচরণে সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। কন্ঠটাও কেমন ভাঙ্গা- ভাঙ্গা মনে হলো। উনি কি কাঁদছিলেন নাকি? আমি এমন পরিস্থিতিতে কি রিয়েকশন দিবো বুঝতে পারছিলাম না। হয়তো রিয়েকশন বাটন হ্যাং মেরেছে। তখন উনার উদম শরীর দেখে উনার থেকে নিজেরই বেশী লজ্জা লাগছিলো। শাওয়ারের নিচে সামান্য সময় থাকলেও, এই সময়ের মাঝেই ভিজে একাকার হয়ে গেছি! উনার পরণে তখন শুধু একটা হাফ প্যান্ট। সাথে হাতের মাঝে কিসের যেনো ফ্রেম! প্রণয় চুপচাপ মেঝে থেকে ফ্রেমটা তুলে সামনে ধরতেই একটা সুন্দরী মেয়ের মুখশ্রী সামনে ভাসলো!
কিন্তু গ্লাসটা ভেঙ্গে গেছে। অতঃপর প্রণয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করতেই ভয়ে গলা শুকিয়ে গেলো আমার! রক্তবর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন উনি। অতঃপর কঠোর স্বরে বললেন,

‘এটা কি করলেন আপনি? ছবিটা ভেঙে দিলেন? আর কি ক্ষতি করতে এসেছেন আমার? বলুন! ‘ -প্রণয়

আমি কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বললাম,

‘ সরি! আসলে আমি তো বুঝতে পারিনি। ইনি কি আপনার গার্লফ্রেন্ড? ‘ -আমি

‘তার থেকেও মুল্যবান কিছু। স্টুপিড। এখনো এখানে গাঁধার মতো দাঁড়িয়ে আছেন। আপনি যদি মেয়ে না হয়ে ছেল হতেন৷ তাহলে হয়তো বেঁচে ফিরতে পারতেন না!’ -প্রণয়

কথাটা শুনে কাঁপন ধরলো আমার! আশ্চর্য! এতো রেগে যাওয়ার কি আছে!

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here