প্রণয়িনী পর্ব -০২

#প্রণয়িনী
#আফসানা_মিমি
|২য় পর্ব |

হও যদি তুমি নীল আকাশ,
আমি মেঘ হব আকাশে।
হও যদি অথৈ সাগর
আমি ঢেউ হব সাগরে!
হও যদি ওই হিমালয়,
তোমাকে করবো আমি জয়,
তোমাকে!!
চাই তোমাকে!!
তুমি যে আর কারো নও।

বলতে পারি আমি নির্ভয়ে
তুমি আছ হৃদয়ে।

একা একা ঘরে বসে কি করব বুঝতে পারছি না। তাই গুন গুন করে গান গাইছি। এই গানটা আমার খুব প্রিয়। গানটা গাইলে সমুদ্রের আভাস পাই। ইচ্ছে করে ছুটে যেতে সমুদ্রের পাড়ে।

আমার সবকিছু রুটিন অনুযায়ী করি। সকাল থেকে এই পর্যন্ত পেটে কিছুই পরেনি কিন্তু এখন তো আমার ঘুমের সময়। আপাতত সব চিন্তা-ভাবনা একপাশে রেখে শুয়ে পরলাম। এখন আমার একটু ঘুমের প্রয়োজন। হাতের বন্ধনীতে তাকিয়ে দেখলাম আড়াইটা বাজে। এদিকে ক্ষুধা লেগেছে আবার ঘুম পেয়েছে। কোন কিছু না ভেবে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালাম।

– এই মেয়ে উঠো উঠো বলছি। না খেয়ে ঘুমিয়েছ কেন? আমার কি আর কাজ নেই তোমার পিছনে সারাদিন পড়ে থাকব? কতক্ষণ ধরে তোমাকে ডেকে যাচ্ছি, আর কত ঘুমাবে?

কারো ডাকাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। জোরে ডাক দেয়ার কারনে মাথা ব্যথা করছে। এমনভাবে কখনও কেউ আমাকে ঘুম থেকে জাগায়নি। আম্মু তো সবসময় মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতো।

– আপনার মনে কি একটু দয়া মায়া বলতে নেই? এভাবে একজনকে ঘুম থেকে উঠায়? বলুন কি বলবেন।

– এই নাও খাবার, খেয়ে আমাকে উদ্ধার করো।

অনেক ক্ষুধা পেয়েছে। হাত বাড়িয়ে খাবার ধরতে যাবো এমনিই রাদ আমার হাত থেকে খাবার প্লেট সরিয়ে নিলো। রাদের কান্ড দেকে অবাক হয়ে হা করে তাকিয়ে রইলাম। রাদের পানে তাকাতে’ই বিরক্তির সহিত আমার উদ্দেশ্যে বলল,

– হাত মুখ ধুয়ে খেতে বলেছি। একটু আগেই’ই না দাঁত দিয়ে নখ কেঁটেছো? এই হাত দিয়েই খাবার খাবে কিভাবে? যাও হাত ধুয়ে আসো খচ্চর মেয়ে!

আমি ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ কিছুই না ধুয়ে খেতে বসেছিলাম তাই এত ভাষণ শুনতে হলো। নিজের মাথায় নিজেই এক চাঁটি মেরে মনে মনে বলছি,’ আসলে’ই আমি একটা বোকা মেয়ে। এমনি এমনি’ই কি আম্মু আমাকে গাঁধীর মা নাম দিয়েছে? আমার উদ্ভট কাজের জন্য দিয়েছে।

ফ্রেস হয়ে, হাতমুখ ধুয়ে বিছানার উপর’ই খেতে বসলাম। আমার সামনে বসে থাকা বিশাল আকৃতির সাদা বিলাই যতই বড়ো হোক না কেন কিন্তু উনার মন আমার থেকেও ছোট। তাইতো আমাকে মাঠের ন্যায় কামরায় আটকে রেখেছে। মাঠ বলার কারণ হলো, ঘরটি লম্বাকৃতির কিন্তু প্রস্থের দিকে আনেক কম। এসব কামরা মূলত গোপন কক্ষ হিসিবে ব্যবহার করে কিন্তু আমি তো এসেছি সোজা পথে!

আহা কি স্বাদের খাবার। এক এক লোকমা মুখে পুরছি আর আপনা-আপনি চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। কথায় আছে না!
‘ঘুম মানে না ভাঙ্গা খাট,
ক্ষুধা মানে না পান্তাভাত,
প্রেম মানে না জাত বি-জাত!’

আমারও অবস্থা তেমন। মা কখনও আমাকে মুরগির গোস্ত খাওয়াতে পারেনি। ক্ষুধার কারনে যে পান্তাভাতও মিষ্টি লাগে তা এখন প্রমাণ পেলাম। পেট পুরে খেয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি জামাই আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।

– তুমি কোনদিনও কি চিকেন খাওনি? এভাবে মানুষ খায়! খচ্চর কোথাকার!

– আমি এভাবেই খাই। দরকার হলে বাম হাত, দু’হাত ভরে খাবো আপনার কোন সমস্যা?

আমার কথায় সাদা বিলাই ভীষণ চটে গেল। দাঁড়ানো থেকে সোজা আমার কাছে এসে দু’গাল শক্ত কর চেপে ধরে বলল,

– এই মেয়ে ভয় পাও না আমাকে! তুমি জানো আমি কে! ফায়রাজ রাদ। আমাকে দেখলে আমার বাপ-চাচারাও ভয় পায় সেখানে তুমি একজন সামান্য পুচকু মেয়ে।

রাদের রাগান্বিত চেহারা দেখে ভয় পেয়ে যাই। বিছানায় বসে ছিলাম বিধায় রাদের কাছে আসাতে একটু পিছনে ঝুঁকে গিয়েছিলাম। রাদের রাগান্বিত কথা শুনে ব্যালেন্স হারিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ফলস্বরূপ রাদ এখনও আমার উপরে। রাদের জন্য এবার আরো সহজ হয়ে গেল। রাদ এবার আমার দু’হাত বিছানার সাথে শক্ত করে ধরে বলল,

– শেষ বারের মত বলে দিলাম। আমাকে রাগিও না। তোমাকে বিয়ে করেছি বলে ভেবো না সুখে রাখতে বিয়ে করেছি। সারাজীবন এই চার দেয়ালে বন্দি করে রাখতে বিয়ে করেছি। মানুষকে কষ্ট দিতে খুব আনন্দ পাও তুমি তাই না?

রাদের কথা কিছুই মাথায় ঢুকছে না। আসলে ঢুকাতে চাচ্ছি না। আমি তো মনে মনে ফন্দি আটছি কীভাবে রাদের চেহারা দেখবো। এই রাগান্বিত স্বর কোন কন্ঠস্বর দিয়ে আসে তা দেখবো।

– আপনি অনেক ভারী আর শক্ত সাদা বিলাই। আপনার ভর আর এক মিনিট সহ্য করলে বমি করে দিবো।

রাদ হয়তো এখন আমার মুখে এমন অবাস্তবিক কথা আশা করেনি। রাদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ভ্রু যুগল কুঁচকে সরে গেল। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। জোরে জোরে নিশ্বাস ত্যাগ করে রাদের উদ্দেশ্যে বললাম।

– আমি এতদিন জানতাম সাদা বিলাই মখমলের ন্যায় তুলতুলে হয় কিন্তু আপনি এত শক্ত কেন?

আমার কথা শুনে রাদ এবার নিজের মাথার চুল কিছুক্ষণ টানলো। বসা থেকে উঠে প্রত্যুওরে বলল,

– তোমার মত বাচালকে কোন আক্কেলে যে বিয়ে করেছি কে জানে।

– আচ্ছা বাদ দিন এসব কথা, বিয়ে তো হয়েই গিয়েছে। এবার বাসরের কথা চিন্তা করুন।

আমার কথা শুনে সাদা বিলাই আকস্মিক কাশতে শুরু করল। ঘরে পানি নেই কি করব ভেবে পাচ্ছি না তাই সাদা বিলাইয়ের তুলতুলে থুক্কু শক্ত পিঠে হাতের সাহায্যে চাপড়ে দিলাম কিছুক্ষণ। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে সাদা বিলাই ঠিক হলো। আর আমার পানে সিংহের চোখে তাকিয়ে হনহন করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

সাদা বিলাই আবারও আমাকে ঘরে আটকে চলে গেল। এখন আমি পুরো ঘরে নজর দিলাম। লম্বাটে এই ঘরের মধ্যে একটা আলমারি, একটা ফ্রিজ, একটা খাট আর কিছুই নেই। ঘরের উপরে একটা ফ্যান আর কোনায় একটা সিসি ক্যামেরা। বুঝতে পারলাম সাদা বিলাই আমাকে চব্বিশ ঘন্টা নজরে রাখবে।

হঠাৎ মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি চেপে বসল। বিছানা থেকে উঠে সিসিটিভি ক্যামেরার দিকে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলতে লাগলাম।

‘ জামাই ঘর বানাইলা কি দিয়া,
দরজা জানলা কিছু নাই।
কেমনে তোমায় দেখতে পাই,
জামাই ঘর বানাইলা কি দিয়ায়।’

————

ব্রেকিং নিউজ। শহরের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী আশিকুর রহমানের বড়ো ছেলে ফায়রাজ রাদ আগামীকাল থেকে আশিক কম্পানির সি ও এর আসন গ্রহণ করবেন। আমরা আশাবাদী আশিকুর রহমানের মত উনার ছেলেও কম্পানি অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

– আম্মু দেখো, রাদ ভাইয়াকে টেলিভিশনে দেখাচ্ছে। ভাইয়া গতকালই আসলো আর এখন’ই ব্যস্ত হয়ে যাবে। আমার সাথে খেলবে না।

রাদের একমাত্র ছোট ভাই হামি আশহাব। বড়ো ভাইয়ের জন্য মন খারাপ। রাদ পড়াশোনা শেষ করে এতদিন দেশের বাহিরে ছিলো। কিন্তু হঠাৎ গতকাল কাউকে না বলে দেশে চলে আসে আর এসেই বাবার ব্যবসায় হাত দেয়।

– কে বলল, রাদ খেলবে না হামি বাবুর সাথে?
রাদের প্রতি অভিমান করে সোফায় বসেছিল হামি। বড়ো ভাইয়ের কন্ঠস্বর শুনে চমকে গেল। সদর দরজায় তাকিয়ে দেখে রাদ স্বয়ং দাঁড়িয়ে আছে।

ভাইয়া বলে দৌঁড়ে রাদকে জড়িয়ে ধরল হামি।

– আই মিস ইউ সো মাচ ভাইয়া।
– আমিও আমার ভাইটাকে অনেক মিস করেছি।
হামিকে কোলে তুলে গালে একটা আদর দিয়ে বলল।

হামির বয়স ছয় বছর। ক্লাস ওয়ান-এ পড়ে। বড়ো ভাইয়ের পাগল। রাদের বিদেশে চলে যাবার পর আশিকুর রহমান এবং তার স্ত্রী মেহরিন একা হয়ে যায়। তারপর আল্লাহর অসীম রহমতে রাদের জন্মের একুশ বছর পর হামি দুনিয়াতে আসে। হামির জন্মের পর রাদ ছয় মাস অন্তর অন্তর দেশে আসতো আর এক কি দুই সপ্তাহ থেকে চলে যেতো। হামির বুঝ হবার পর থেকে ভাই বলতে পাগল। বেশিরভাগ সময় ভাইকে মিস করত সে। এখন যখন শুনলো ভাই দেশেই রয়ে যাবে তার আনন্দের সীমা নেই।

রাত সাড়ে এগারোটা। রাদ কেবলমাত্র রাতের খাবার খেয়ে রুমে এসে ল্যাপটপ অন করল। তুবার কথা রাদের একপ্রকার মনে নেই। আজ যে আয়মান তুবা নামক একজন মেয়েকে জোর করে তুলে নিয়ে বিয়ে করেছে তার খেয়াল নেই রাদের। ল্যাপটপের স্ক্রিনে তুবার করা দুষ্টুমি দেখে মনে হয় তুবার কথা। সেই বিকেল তিনটায় খেয়েছে মেয়েটা। এখন পর্যন্ত না খাওয়া। রাদ আর অপেক্ষা করল না। গায়ে একটি শার্ট জরিয়ে গাড়ির চাবি নিয়ে রওনা হলো তুবার কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

————-

‘ভুত আমার পুত
পেত্নি আমার ঝি।
হ্যান্ডসাম পুলা বর আমার
তোরা করবি কি।’

– শেষ বারের মত বললাম ছেড়ে দে আমায় শয়তানের নানী! যতই খোঁচাখোঁচি করিস না কেন চোখ থেকে আজ হাত সরাবো না। তোরা তো এটাই চাচ্ছিস, চোখ খুলে তোদের দেখি আর জোরে চিল্লাই। কিন্তু তা আমি করব না। আমি খুব সাহসী মেয়ে। এখন তো সাদা বিলাইয়ের বউ হই। সাদা বিলাইয়ের মায়া-মহব্বত কিছুই নেই। এত রাত হয়েছে খাবার দিলো না। এদিকে মা হয়তো চিন্তা করছে আমায় নিয়ে। কেন যে সকালে আজ ফের হয়েছিলাম আল্লাহ’ই জানে। কথা নাই বার্তা নাই সোজা ঐ খচ্চর মহিলা দুজন আমাকে টেনে গাড়িতে উঠালো আর সোজা কাজী অফিসে নিয়ে আসলো। আর তারপর বিয়ে।

আহা! আমি বিবাহিত। আজ আমার বাসর রাত!

আমার ভাবনার মাঝেই দরজা খুলে কেউ প্রবেশ করল। তাকিয়ে দেখি আমার সাদা বিলাই। সাদা বিলাইকে দেখে মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি আটলো। দুষ্টুমির স্বরে রাদের উদ্দেশ্যে বললাম,

– ও বেবি কাম কাম,
বাসর করমু ধরাম ধরাম।

চলবে……

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here