#প্রণয়ের_পরিণতি
#পর্ব_১৫
#writer_sadia_afrin_nishi
ছাঁদের কোণে রেলিংয়ে মাথা ঠেকিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছে মেয়েটি।চোখগুলো অসম্ভব ফোলা আর রক্তিমবর্ণ ধারণ করেছে।মাথার চুলগুলো এলোমেলো ভাবে হালকা হালকা বাতাসে উড়ছে। এই মুহুর্তে তাকে খুবই বিভৎস দেখাচ্ছে। চোখের কার্ণিশ বেয়ে অবিরত বেঁয়ে চলেছে জলের ধারা।সেদিকে তার কোনোই ভ্রুক্ষেপ নেই।সে একটি বার মোছার চেষ্টাও করছে না সেই জল।আকাশের ওই হাজার তারার মাঝে চেয়ে চেয়ে সে ভেবে চলেছে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য। কী ভয়ংকর ছিল সেই দৃশ্য। এক মুহুর্তে তার পৃথিবীটা থমকে দেওয়ার দৃশ্য। সে কী খুব বড় ভুল করে ফেলেছে ওই মানুষটিকে চিনতে?সে কী ওই মানুষটির চোখের ভাষা পরতে পারনি?নাকি ওই মানুষটির চোখের ভাষা দুরকম ভাবে লেখা,একটা মেয়েটির চেনা আর একটা অচেনা?সে তো চেয়েছিল ছেলেটিকে আঁকড়ে ধরে এদেশে থেকে যেত। কিন্তু সবকিছু কেমন এক নিমেষেই বদলে গেল। ছেলেটিও পাল্টে গেল।এখন তার আর কোনো বাঁধায় রইল না। সে নিশ্চিতে বিদেশে পারি জমাতে পারবে।বোনদের স্বপ্ন পুরোন করতে পারবে।আচ্ছা খুব কী বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যেত যদি এই ভয়ংকর দৃশ্য তার চোখে না পরত?সে তো চলেই যেত তাহলে কেন এই দৃশ্যের মুখোমুখি তাকে হতে হলো?তার যাওয়ার পর কী এমনটা ঘটতে পারত না?এখন থেকে ওই দুর দেশে তার সঙ্গী হবে রাতের আকাশ,তারা,চাঁদ,মিষ্টি বাতাস,ভোরের মিষ্টি স্নিগ্ধ রোদ, পরন্ত বিকেলের গোধুলী,হঠাৎ অসময়ে উঠা বৃষ্টি, আর একাকিত্ব।প্রিয় মানুষগুলো হয়ে যাবে অচেনা। পাঁচ পাঁচটা বছর তো আর কম সময় না। সবকিছু ততদিনে পুরোপুরি পাল্টে যাবে।তার মনের মানুষও ততদিনে হারিয়ে যাবে বহুদুরে।তবে সে চায় তার মনের মানুষ সুখে থাকুক, ভালো থাকুক,সে শুধু দুর থেকে তার শান্তি কামনা করবে।কখনো ভুলতে না পারুক তবুও পাবার আশা করবে না। যন্ত্রণায় শেষ হলেও কখনো দীর্ঘঃশ্বাস ফেলবে না কারণ সে শুনেছে, ”প্রেয়সীর দীর্ঘঃশ্বাস নাকি প্রিয় মানুষটির যন্ত্রণার কারণ”।তাই সে চায় না তার প্রিয় কষ্টে থাকুক।সে চায় তার প্রিয় সারাজীবন সুখে থাকুক, ভালো থাকুক।যন্ত্রণাগুলো না হয় তারজন্যই বরাদ্দ থাক।
_________
বোনের ঘরের সব জিনিসে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দেখছে তনয়া। বোনটা তার কত্তবড় হয়ে গেছে। সেই সেদিনেও তো ফ্রক গাঁয়ে ছোট্ট তৃপ্তি আপু আপু করে সারা ঘরে দৌড়ে বেড়াত।আর এখন নাকি সে কয়েকদিন পরে বিদেশে যাবে।বিশ্বাসই হচ্ছে না তনয়ার তার আদরের বোনটা এতটা বড় হয়ে গেছে। তার এই প্রাণপাখিটা ছাড়া সে কী করে থাকবে?
তৃপ্তির পাসপোর্ট আর ভিসা আসতে সময় লাগবে মাত্র এক সপ্তাহ। পাসপোর্ট, ভিসা তৈরির কাজে রিশান তনয়াকে অনেকটা হেল্প করেছে।তনয়া তো এ ব্যাপারে তেমন কিছুই জানত না সবকিছু এ্যারেন্জ রিশানই করেছে। তনয়া শুধু সাথে সাথে থেকেছে।
কোনোরকম কোমড়ে হাত দিয়ে পাঁ টেনেটেনে হেঁটে এসে বোনের পেছনে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রাখল তনিমা।কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে পেছনে তাকালো মেয়েটি।চোখমুখের অবস্থা এখনো আগের মতোই আছে। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চেয়ে রইল তৃপ্তি তনিমার দিকে।
বোনের এমন অবস্থা দেখে ভড়কে গেল তনিমা।নিমেষেই কিছুটা দুরে সরে গেল। সে ভাবল হয়তো তাদের ছেড়ে যেতে হবে বলে বোনের এমন অবস্থা। আস্তে আস্তে সে এগিয়ে এসে বোনের পাশে বসে পরল।বোনের মাথাটা আস্তে করে নিজের কাঁধের উপর জড়িয়ে নিল পরম আবেশে। কিছুসময় ওভাবেই কাঁটল। কেউ কোনো কথা বললো না। তারপর তনিমা বোনের মুখটা দুহাতে আগলে ধরে নিজের দিকে ফেরাল।তৃপ্তিও চেয়ে রইল তনিমার দিকে সেই একই দৃষ্টিতে। তারপর তনিমা বোনের কপালে এঁকে দিল স্নেহের পরশ।তারপর তৃপ্তিকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে নানাভাবে নানা কথা বলে বোঝাতে লাগল।যাতে তার মন ভালো হয়ে যায়। সে যাতে মন খারাপ না করে। কষ্ট না পায়।ঠিক সেই ছোট্ট তৃপ্তি ব্যথা পেয়ে মুখ ভার করে বসে থাকলে তনিমা যেভাবে তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বোঝাত আজও ঠিক তেমনই করছে।সত্যিই তার বোনটা আজ অনেক অনেক বড় হয়ে গেছে। এতটা বড় কখন হলো বুঝতেই পারে নি।
__________
হাতে,মাথায় ব্যান্ডেজ করা ছেলেটি হসপিটালের বেডে পরে আছে অচেতন হয়ে । তাকে ঘুমের ইনজেকশন পুস করা হয়েছে।সারা রাত পাগলামির পর এখন একদমই শান্ত হয়ে পরে রয়েছে।তার মাথার কাছে বেডে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে তার মা। তার বাবা একটু আগেই অফিসে জন্য বেড়িয়েছে।রিশান ডক্টরদের সাথে কথা বলছে মেডিসিন সম্পর্কে।
কালকের ঘটনার পর রিশি কী করবে বুঝতে পারছিল না। সে একটা ঘোরের মধ্যে ছিল।ঘোর কাটতেই সে আর এক বিন্দু দেরি না করে তৃপ্তিকে খুঁজতে লাগল।কিন্তু কোথাও আর তৃপ্তিকে দেখা গেল না। তারপর সে তৃপ্তিকে অনেক বার ফোন করে কিন্তু বার বারই ফোন সুইচড অফ বলে।সে চেয়েছিল তৃপ্তির বাড়ি যাবে কিন্তু কী করে যাবে? গিয়ে কী বলবে?ওকে যদি ঢুকতে না দেয়?রিশি অনেক রাত অব্দি তৃপ্তির বাড়ির সামনে গাড়ি নিয়ে দাড়িয়ে ছিল কিন্তু একবারও তৃপ্তির দেখা মেলেনি।মাঝ রাতে রিশি আর টেনশন নিতে না পেরে ওখান থেকে সোজা বারে চলে যায়। প্রচুর পরিমাণে নেশা করে।বারে তার এক বন্ধু ছিল সে তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যায়। বাড়িতে ফিরে দেখে তার মা এখনো তার জন্য জেগে আছে। কিন্তু ছেলের এ অবস্থা দেখে তো তার মাথায় আকাশ ভেঙে পরল। তার ছেলের এ কী হাল হয়েছে। তার ছেলে তো এমন নয়। তাহলে এমনটা কী করে হলো?সে কাঁপা-কাঁপা পাঁয়ে হেঁটে ছেলের কাছে এগিয়ে এলো।
মাকে দেখে রিশি জাপটে জড়িয়ে ধরে এলোমেলো ভাবে কান্না জুড়ে দিল।ছেলেরাও কী কাঁদতে জানে?
তার মা তো অবাক তার ছেলের এমন পরিবর্তনে।রিশি ছোটো থেকেই খুব একটা কাঁদত না। সবসময় হাসি মজা করত।তাকে খুব একটা মন খারাপ করে থাকতেও দেখা যায় নি।মাঝে মাঝে রিশান বকলে তখন একটু মনমরা হয়ে থাকত।তবে একটু পর আবার ঠিক হয়ে যেত।কিন্তু আজকে কী এমন হলো যে তাকে এভাবে কাঁদতে হচ্ছে? রিশির মা অনেকবার ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছে কী হয়েছে সে কেন এমন করছে কিন্তু সে কিছুই বলে নি।এক সময় কান্না থামিয়ে শান্ত হয়ে টলতে টলতে নিজের রুমে চলে যায়।রিশির মা তখন চলে যায় রান্না ঘরে ছেলের জন্য লেবুর শরবত করতে এই অবস্থায় যদি বাবা ভাইয়ের সামনে পরে তাহলে আর রক্ষে নেই। শরবতে চিনি গুলতে গুলতে বিকট আওয়াজে তার আত্মা কেঁপে ওঠে। সাথে সাথে সে সব ফেলে ছুট লাগায় ছেলের ঘরে। সেখানে গিয়ে তো দেখে এলাহি কান্ড।সে এক চিৎকার দিয়ে ছেলের কাছে দৌড়ে যায়।সারা ঘরে কাঁচ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। রিশি মেঝেতে পরে আছে প্রায় অজ্ঞানের মতো। তার মাথা, হাত বেঁয়ে নামছে রক্তপ্রপাত। ছেলেকে বুকে নিয়ে সে আর এক চিৎকার দিতেই ছুটে আসে রিশান ও তার বাবা।রিশিকে এভাবে দেখে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছে।রিশান তাড়াতাড়ি করে রিশিকে কাঁধে তুলে নিয়ে হসপিটালে চলে যায়। ওদের বাবা
মা ও সাথে যায়।রিশি পুরোপুরি জ্ঞান হারানোর আগে শুধু বিড়বিড় করে এটুকুই বলেছিল,”আমার সাথে কেন এমন হলো?আমি কী তোমাকে আর খুঁজে পাবো না তোতাপাখি? আমি কী তোমাকে হারিয়ে ফেললাম তোতাপাখি?তার এই বলা কথা শুধু তার মা শুনেছিল কিন্তু পুরোটা নয় শুধু ”তোতাপাখি”।তার মা মনে মনে আওড়াতে লাগল তোতাপাখি তোতাপাখি।কে এই তোতাপাখি? তবে কী তার জন্যই তার ছেলের আজকে এই অবস্থা? তার ছেলে কী তবে ভালবাসতে শিখে গেল নাকি?তবে কী তার ছেলের ভালোবাসা শুরুর আগেই শেষ পরিণতি পেল?অজানা ভয়ে তার বুক কেঁপে উঠল?
রাতে রিশিকে এখানে এনে ট্রিটমেন্ট করানোর পর এখন কিছুটা সুস্থ। তবে মেন্টাললি ডিপ্রেশড হওয়ায় তাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পারিয়ে রাখা হয়েছে। মাথা থেকে অনেক রক্তক্ষরণের ফলে শরীর অনেক উইক।তাই তাকে এক সপ্তাহ বেড রেস্ট দেওয়া হয়েছে।
_________
আজ সেইদিন। আজকের দিনে রিশি ডাক্তারি মতে সম্পুর্ন সুস্থ তাই তার মা তাকে বাহিরে যাবার অনুমতি দিয়েছে। এই এক সপ্তাহ তার মা তাকে একবারের জন্যও বাহিরে পাঁ রাখতে দেয়নি।ঘর থেকে লিভিংরুম অব্দিও বেশি বেরতে দেয়নি।আজ সে ছাড়া পেয়েছে। আজ সে তার তোতাপাখির সাথে দেখা করবেই করবে সেজন্য সে খুব তাড়াতাড়ি নাস্তা করে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরল।
মা,বোন আর রিশানের সাথে এয়ারপোর্টে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছে তৃপ্তি। আজ তো তারও বিদায়ের দিন।তার মা তো তাকে কোনো ভাবেই ছাড়তে চাইছে না। তনিমা,তনয়া আর রিশান তাকে অনেক বুঝিয়ে তারপর এখানে এনেছে। তার খুব কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন কেউ তার কলিজাটা আলাদা করে দিচ্ছে। তনিমা,তনয়া বোনকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছে। তাদেরও তো কলিজা কাঁটা যাচ্ছে।রিশানও তৃপ্তিকে ছোট বোনের মতো অনেক কিছু বুঝিয়ে বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বলিয়ে বিদায় দিল।এতোকিছুর মধ্যে তৃপ্তি একদমই চুপ ছিল।তার চোখে দিয়ে এক ফোঁট পানিও পরল না। হয়তো পানি সব শুকিয়ে গেছে। এই এক সপ্তাহ এমন একটা মুহুর্ত নেই যে সময়টা তৃপ্তি চোখের পানি বিসর্জন না দিয়েছে। সে ভেবেছিল রিশি একটাবার অন্তত তার খোঁজ নিবে।কিন্তু না তার সব অপেক্ষা মিথ্যে প্রমাণিত হল।তার সব ধারণা ভুল ছিল।রিশি এলো না। কিন্তু এই না আসার পেছনের কারণটা আর তার জানা হয়ে উঠল না। অজানা রয়ে গেল কতশত কথা, কতশত অভিযোগ,কতশত সরযন্ত্র, কতশত চাওয়া-পাওয়া, কতশত অভিমান।
এক বুক অভিমান নিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তৃপ্তি পারি জমাল সেই সুদুর দেশে।যাওয়ার শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তৃপ্তি প্রত্যাশা করে গেছে সেই কাঙ্খিত মানুষটির। কিন্তু কোথাও দেখা মেলেনি তার।
একবুক আশা নিয়ে রিশি আজ আবার ছুটল তার তোতাপাখির খোঁজে। কিন্তু সে কিছুতেই শান্ত হয়ে গাড়ি চালাতে পারছে না। একটা অস্বস্থি কাজ করছে মনের মধ্যে। অজানা কোনো কিছুর ভয়ে মনটা কেঁদে উঠছে বারবার।তবে কী সে কোনো মুল্যবান জিনিস হারাতে চলেছে।তার বারবার শুধু মনে হচ্ছে, খুব দেড়ি হয়ে যাচ্ছে।তার আরও আগে পৌঁছাতে হতো।কিন্তু কেন এমন মনে হচ্ছে কারণটা রিশির অজানা।
চলবে,