#প্রণয়ের_পরিণতি
#পর্ব_১৬
#writer_sadia_afrin_nishi
সময়ের নিয়মে সবকিছু এগিয়ে চলেছে। বদলে গিয়েছে আশেপাশের মানুষগুলো। সময়ের সাথে সাথে বদলে গিয়েছে চেনা শহর,চেনা পথ-ঘাট।শুধু থেকে গিয়েছে পুরোনো স্মৃতি।
তৃপ্তি বিদেশে গিয়েছে চার বছর হলো।রিশি সেদিন সোজা তৃপ্তিদের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। গিয়ে দেখে বাড়িতে কেউ নেই। দারওয়ানকে জিজ্ঞেস করলে বলে,সবাই এয়ারপোর্ট গেছে তৃপ্তিকে এগিয়ে দিতে।এই খবর শোনা মাত্র রিশির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরল। সে হন্তদন্ত হয়ে গাড়ি নিয়ে ছুটল এয়ারপোর্টে।কিন্তু রিশির পৌঁছতে বড্ড দেড়ি হয়ে গেল।তৃপ্তির প্লেন ততক্ষণে পারি জমিয়েছে দুর দেশে। রিশি কতক্ষণ হাঁটু ভেঙে বসে রইল এয়ারপোর্টের সামনে। অনেকক্ষণ পর চিৎকার করে তৃপ্তির নাম ধরে ডেকে উঠল।কিন্তু কেউ এলো না তার ডাকে।কেউ এসে বললো না, রিশি আমি আছি।তোমাকে ফেলে কোথাও যায় নি।
তারপর থেকেই রিশির মধ্যে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। এখন আর হাসি-মজা করা প্রানোচ্ছল রিশিকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এখন সেই চঞ্চলতা ঢাকা পরেছে গাম্ভীর্যতার আড়ালে।সবাই রিশির এই পরিবর্তনে প্রথমে অনেক চিন্তিত থাকলেও এখন সবাই বেশ খুশি।কারণ রিশি এখন রিশানের সাথে বিজনেস সামলায়। রিশি এখন একজন দায়িত্ববান পুরুষে পরিণত হয়েছে।সবাই না বুঝলেও রিশির মা তার এই পরিবর্তনের কারণটা কিছুটা হলেও বুঝতে পারে। ছেলের মনের আড়ালে লুকায়িত কষ্টটা সে উপলব্ধি করতে পারে। সে বোঝে তার ছেলে তার তোতাপাখির শোকে প্রাণ হারিয়ে পাথরে রুপ নিয়েছে।
_________
আজ চৌধুরী বাড়িতে বিশাল বিয়ের আয়োজন হচ্ছে। বড় ছেলের বিয়ে বলে কথা কোনো কিছুর কমতি রাখছেন না আতিক চৌধুরী। সারা ঢাকার শহর তোলপাড় করে ভালো ভালো জিনিস মার্কেটিং করেছে ছেলে আর ছেলের বউয়ের জন্যে।ছেলের বউ তো তার ভীষণ পছন্দের। তাই তার আনন্দ আর দেখে কে।তার ছেলে যে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেবে সে কখনোই ভাবতে পারেনি।যখন শুনেছে তার ছেলে বিয়ে করতে চায় তাও আবার তার পছন্দের মেয়ে কে তখন থেকেই সে মহা খুশি। কিন্তু তার স্ত্রী রেহানা চৌধুরী এই বিয়েতে অতটা খুশি হতে পারছেন না। তার মধ্যে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
__________
তৃপ্তি বিদেশে বেশ ভালোই মানিয়ে নিয়েছে সবকিছু। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হতো তারপর আস্তে আস্তে সব ঠিক করে নিয়েছে। সেখানে তার কিছু ফ্রেন্ডও আছে। তাদের মধ্যে একজন ছেলে আছে বাংলাদেশি।ওই ছেলেটিই তৃপ্তিকে সকল কাজে সাহায্য করে।তৃপ্তিরও ছেলেটিকে খারাপ লাগে না।
চাঁদের আলোয় কফির মগ হাতে ছাদের উপর দোলনায় বসে বসে কফি খাচ্ছে আর আকাশের দিকে চেয়ে আছে মেয়েটি।আজ তার মনটা ভীষণ অস্থির লাগছে।মনে হচ্ছে কোনো কিছু ঘটতে চলেছে। কিন্তু যা ঘটছে তা ভালো হবে না।
বার বার মনের এমন ফালতু চিন্তাকে সে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। কিন্তু কীছুই লাভ হচ্ছে না। বারবার সেই একই চিন্তা তাকে ধাওয়া করছে। এক পর্যায় সে বিরক্ত হয়ে ঘরে চলে গেল।
________
হসপিটালের বেডে মায়ের মাথার কাছে বসে আছে তনিমা। মনে তার হাজারো চিন্তা।কী থেকে কী হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারছে না। মা সুস্থ হলে তাকে কীভাবে ঝামলাবে সে?কীভাবে বলবে সেই সব না বলা কথা? মা তো এবার এ সব শুনলে পাগল হয়ে যাবে।নিজের অজান্তেই তার চোখের কোণা বেয়ে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরল।সে সাথে সাথে চোখের পানি মুছে শক্ত হয়ে বসল।যাই হোক না কেন তাকে তো শক্ত থাকতেই হবে। আপু নেই, ছুটকী নেই, তার একার ওপর এখন কতো দায়িত্ব। তাকে তো কিছুতেই ভেঙে পরলে চলবে না।
_________
ভাইয়ের বিয়েতেও রিশির তেমন কোনো হেলদোল দেখা গেল না। তবে এই বিয়েতে সে খুশি নয় এমনটা নয়। বউ তারও খুব পছন্দের। আগে আপু বলতো এখন ভাবি হবে। বিয়ের কোনো কাজেই সে গাফিলতি করছে না। সুনিপুনভাবে সবকিছু সামলাচ্ছে।কিন্তু মুখে তেমন কথা নেই। নেই কোনো হাসির রেখা। আছে শুধু সেই চিরচেনা এক রুপ গাম্ভীর্যতা।
_________
নতুন বউকে সাজাতে খুব নামি পার্লার থেকে লোক এলো।কিন্তু বলা হয়েছে হালকা মেকাপ করতে।ভারী মেকাপে যেন বউয়ের আসল সৌন্দর্য ঢাকা না পরে। সেই অনুযায়ী সাজিয়ে যাচ্ছে তারা। একটু পর গাঁয়ে হলুদ হবে। সময় স্বল্পতার কারণে দুপুরে গাঁয়ে হলুদ দিয়ে রাতে বিয়ে সম্পন্ন করা হবে। ছেলে মেয়ে এক বাড়ি থেকেই বিয়ে হচ্ছে। বিকেলে ছোটখাট মেহেন্দীর অনুষ্ঠানেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।বউ কে এনে বরের পাশে বসানো হলো।বর এক বউকে আড় চোখে দেখল কী দেখল না কিন্তু বউ একবারের জন্য বরের দিকে ফিরেও তাকালো না। দুজনেই বাধ্য হয়ে বিয়েটা করছে।কারো মনেই শান্তি নেই। সবাই যার যার নিজস্ব যন্ত্রণায় পুরছে।
কাব্য এলো হাঁপাতে হাঁপাতে। সেও বিয়ের কাজে অনেক বিজি।কিন্তু বন্ধুর গাঁয়ে হলুদ ছোঁয়াবে না তা কী হয়? সে সেজন্য রিশিকে সবটা দেখিয়ে দিয়ে চলে এলো রিশানের কাছে। রিশান কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার সারা মুুখ ভরতি করে হলুদ লাগিয়ে দিল।রিশান তো রেগে আগুন। পারলে এখনি কাব্যকে খেয়ে ফেলে।
রিশান:শালাহহ তোর সময় আসুক।তারপর তোকে বোঝাব কত ধানে কতো চাল।
কাব্য:কাব্য দাঁত কেলিয়ে হাসেড বলল,আগে আসুক তারপর দেখিস।
তারপর কাব্য একটু হলুদ নিয়ে বউয়ের গালে ছুঁইয়ে দিল।মিষ্টি হেসে বললো, সুখে থেকো বোন আর এই গাঁধাটাকেও সুখে রেখো।বিনিময়ে নতুন কনে কাব্যর উদ্দেশ্য কিঞ্চিৎ হাসল।কাব্য গিয়ে এবার রিশিকে পাঠাল হলুদ দিতে।রিশি এসে তেমন কিছু করল না। ফরমাল ভাবেই দুজনকে হলুদ লাগিয়ে চলে গেল। এতে বর বউ কেউই কিছু মনে করল না কারণ তারা জানে রিশি কেমন।
_________
সন্ধ্যায় খুব সুন্দর মতো মেহেন্দি অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো।বউয়ের হাতে বড় করে লেখা হলো বরের নামের ফার্স্ট লেটার। বউ সেই হাতের দিকে চেয়ে থেকে দু’ফোঁটা চোখের জল বিসর্জন দিল। আবার সাথে সাথেই মুছে নিল কেউ দেখার আগে।
রাত ন’টার সময় কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করল।ছেলে কবুল বলতে বেশি সময় নিল না। মেয়েও তেমন একটা সময় অপচয় করেনি।বিয়েটাও সুষ্ঠুভাবে মিটে গেল।বাড়ি ভর্তি মেহমান কমতে শুরু করল।নতুন বউকে দেওয়া হলো বাসর ঘরে আর শিখিয়ে দিয়ে এলো অনেকরকম নিয়ম।
_________
হাসপাতালে বারান্দায় এদিক ওদিক পাগলের মতো ছোটাছুটি করছে মেয়েটি।পরনের ওরনা কিছুটা নিচে বেঁয়ে বেড়াচ্ছে। এতো রাতে ডক্টরাও হসপিটালে নেই। সকালে আসবে বলেছিল।সে বোনের নম্বরে অবিরত ফোন করে চলেছে অনেক্ক্ষণ যাবত।কিন্তু ফোন কেউ তুলছে না। তার পাগলামি তে নার্সরা এসে তাকে শান্তনা দিতে লাগল।একটু আগেও তো তার মা খুব ভালো ছিল। এখন কেন এমন করে পড়ে আছে? কেন কথা বলছে না?এসব আবল-তাবল বকতে বকতে মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে ঢলে পরল মেঝেতে। সাথে সাথে দুজন নার্স তাকে ধরে বেডে শুয়িয়ে দিয়ে জ্ঞান ফেরাতে চেষ্টা করল।
_________
দিক-বিদিক হারিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে চলেছে মেয়েটি।তার পৃথিবী যেন কেমন হোলাটে মনে হচ্ছে। বার কয়েক হোঁচট খেয়ে পরেছে পিচ ঢালা রাস্তায়।তারপরও আবার উঠে দৌড়ে দৌড়ে ছুটে চলেছে কাঙ্খিত জায়গায়। নতুন বউ বাসর রাত ছেড়ে এভাবে ছোটা সত্যিই অস্বাভাবিক।তবুও মেয়েটি ছুটে চলেছে। তাকে যে যেতেই হবে। যার কারণে সে তার জীবনটা একটা খাঁদের কিনারায় এনে দাঁড় করালো সে কী করে তাকে ফেলে চলে যেতে পারে?তাহলে যে তার সমস্ত ত্যাগ মিথ্যা প্রমাণিত হবে।
চলবে,