#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ২১
তারপর থানায় গেলাম। থানায় যাওয়ার পর শুরু হলো নতুন নাটক। আমি চেয়ারে বসে মামলাটার কথা জিজ্ঞেস করতেই সামনের চেয়ারে বসা পুলিশ মহাশয় আমার দিকে তাকিয়ে ব্যাঙ্গ করে বলল
– স্বামীর সাথে শারিরীক সম্পর্ক হলে ধর্ষণ হয় কোন যুক্তিতে?
আমি কিছুটা রাগান্বিত হয়ে উত্তর দিলাম
– মানে?
পুলিশ মাহাশয় একটা চোখের ভ্রূ উঁচু করে তাকিয়ে বললেন
– অরন্য সাহেব তো আপনার স্বামী হয়। চার বছর আগে বিয়ে করেছিলেন। আবির সাহেব আপনাদের বিয়ের কাগজ আমার কাছে দিয়েছে। এখন কথা হচ্ছে অরন্য আপনার স্বামী হলে সে তো আপনার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতেই পারে তাতে তো কোনো দোষ দেখছি না। স্বামী, স্ত্রীর সহিত মিলিত হলে সেটা তো ধর্ষণ হবে না। ধষর্ণের মামলা কেন করলেন। এক্ষেত্রে নারী নির্যাতনের মামলা গ্রহণ যোগ্যতা পাবে তবে ধর্ষণের না। আজকাল মনে হয় মেয়েরা বেশি মর্ডান সাজতে গিয়ে স্বামীর সাথে মিলন বিষয়টাকে ধর্ষণ বলে উঠে।
আমি বেশ জোরেই বলে উঠলাম
– না জেনে এত কথা কেন বলছেন? আমার বিরুদ্ধে গিয়ে আমার সাথে মিলিত হলে সেটা ধর্ষণের সামিলেই। স্বামী স্ত্রী এর সম্পর্ক হয় মধুর। আর আমাদের সম্পর্ক ছিল বিষাক্ত। আর যাকে এত সাপোর্ট দিয়ে কথা বলেছেন সে কী করেছে জানেন? বিয়ে করে বিয়ের প্রমাণ লোপাট করে অন্যত্র বিয়ে করেছিল। সেখানে যখন শান্তি মিলছিল না তখন আমার কাছে এসেছিল ফিরে। আমাকে যখন পাচ্ছিল না তখন জোর করে ধরে নিয়ে আমার সাথে অন্যায় ভাবে এ সম্পর্ক গড়ে তুলে তাহলে সেটাকে আমি ধর্ষণ কেন বলব না? যাকে আমি স্বামী মানিই না সে তো আমার সাথে মিলিত হলে বিষয়টা নিশ্চয় আমার জন্য সুখকর হবে না। তাই ধর্ষণের মামলা করেছি। আর বাকি রইল বিয়ের ব্যপার। আজ থেকে এ সম্পর্ক থেকে আমি মুক্ত। ডিভোর্স দিয়ে এসেছি। এখন থেকে অরন্য আমার স্বামী না। সুতরাং আমার জায়গায় আমি ঠিক আছি।
– আপনি মনে হয় নিজেকে খুব বেশি স্মার্ট মনে করেন। শুনেন ডিভোর্স আজকে দিলেও যেদিন আপনার সাথে এমন হয়েছিল সেদিন অরন্য আপনার স্বামাী ছিল। আপনাদের মতো কিছু মহিলাদের জন্য ছেলেরা বিগরে যায় তখন ছলেরা অন্য জায়গায় সুখ খুঁজে। আপনাকে দেখে মনে হয় আপনার চরিত্রে যথেষ্ট গড়বড় আছে। পাশে এ ছেলেটা কে শুনি? তার জন্যই কী স্বামীর নামে এমন মামলা করেছেন।
কথাটা শুনে নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলাম না। কেন জানি না বেশ জোরসোরেই চেঁচিয়ে উঠে বললাম
– আপনার সাহস কী করে হয় এমন কথা বলার। প্রতিটা কথা আমি রেকর্ড করে রেখেছি। একটা মেয়ের মামলা নেওয়ার নামে কীভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে সেটা আমি তুলে ধরব। আপানাকে মামলা নিতে হবে না। মামলা অন্য জায়গায় গিয়ে করব। দরকার হলে নিজের জীবন দিয়ে লড়ব তবুও হারব না। আর শুনেন নিজের ঘরে মেয়ে থাকলে তার কথা চিন্তা কইরেন একটু। ভেবে দেইখেন তার সাথে এমন হলে আপনি কী করতেন। আমার যতদূর মনে হচ্ছে আপনাকে মোটা অংকের টাকা খাওয়ানো হয়েছে। তবে চিন্তা নেই আপনি আপনার গতিতে চলুন আমি আমার গতিতে চলব। এর শেষ আমি দেখেই ছাড়ব।
বলেই টেবিল থেকে সকল কাগজ গুলো টেনে নিয়ে সোহানকে নিয়ে বের হলাম। সোহান শুধু আমার দিকে বিস্ময় হয়ে তাকিয়ে ছিল৷ থানা থেকে বের হতেই সোহান বলে উঠল
– আমি বিশ্বাস করতে পারছি না তুই এত স্ট্রং হয়ে গেছিস। যে মেয়ে কথা বলতে পারত না সহজে।।অল্পতে ভয় পেয়ে যেত। সে কী না পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে এত কথা বলে আসলো। আর তুই কথাগুলো রেকর্ড করে রেখেছিস। বাহ এত ভলো বুদ্ধি তোর মাথায় আসলো কী করে? মানুষ তো বিপদে পড়লে বিবেক দিয়ে কাজ করার শক্তি হারিয়ে ফেলে আর তুই তো পুরো কাজটা সুন্দর করে গুছিয়ে করছিস।
আমি হালকা দম ছেড়ে বললাম
– পরিস্থিতি মানুষকে অনেক শেখায়। প্রতিটা পদে পদে বাঁধা পেয়েছি। আর শিখেছি। এখন কী করব বুঝতে পারছি না। ঐ পুলিশ অফিসারটা মনে হয় ঘুষ খেয়ে টাল হয়ে আছে তাই এসব আবোল তাবোল বলে ধামা চাপা দিতে চাচ্ছে সব।
সোহান নিজের চিবুকে হাত দিয়ে চেপে ধরে বলল
– আমার একটা বন্ধু পুলিশ ক্যাডার। ঢাকাতেই পোস্টিং হয়েছে। চল একবার তার কাছে যাওয়া যাক। পরামর্শ তো নিতে পারব। আর এ পুলিশের বিরুদ্ধে ও স্টেপ নিতে পারব।
শত রুক্ষতার মধ্যেও যেন একটু শীতলতা পেলাম। আমি সাবলীল সজীব নিঃশ্বাস টেনে পরক্ষণে তা ছেড়ে দিয়ে বললাম
– চল যাওয়া যাক।
গাড়িতে উঠলাম। সোহান গাড়ি চালাতে লাগল। আর আমি ভাবতে লাগলাম আজকে সোহানের মতো কেউ পাশে আছে বলে সংগ্রামটা সহজ মনে হচ্ছে। আজকে আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছি বলে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারছি। অথচ সেসব মেয়েদের অবস্থা চিন্তা করছি যারা কোনো চাকুরি করে না। যাদের কোনো বড় পুলিশ অফিসারদের সাথে পরিচয় নেই। যাদের দুনিয়ায় টাকাও নেই বড় কোনো হাত ও নেই। তাদের সংগ্রামটা কত কঠিন। ভাবতেই গা টা শিউরে উঠল। মনে মনে কয়েকবার আলহামদুলিল্লাহ বললাম। অন্তত আমার দশা তাদের থেকেও তো ভালো। সেসব মেয়েরা না পারে লড়াই করতে না পারে নিজের কথা কাউকে বলতে। এভাবে না বলতে বলতেই মেয়েগুলো একটা সময় পাথর হয়ে যায় আর না হয় দম বন্ধ করে বিলীন হয়ে যায়। কাফনের কাপড়কে আপন করে নেয়। মাটির সজীবতায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়। সত্যিই তাদের জীবন বড্ড কঠিন। তাদের কথা ভেবে যেন একটু প্রশান্ত পাচ্ছিলাম। ছোট বেলায় একটা বান্ধবী ছিল নাম মিলি। তখন আমি নবম শ্রেণীতে পড়তাম। সে সবসময় বলত দুনিয়া দেখলে সবসময় নীচের দিকে দেখতে হয়। মানে কে কত কষ্টে আছে সেটা আবিষ্কার করতে হয় তাহলে নিজেকে সুখী মনে হবে। কিন্তু অন্যের সুখ আবিষ্কার করলে কষ্ট ছাড়া কিছুই মিলবে না। আজকে তার বাস্তব উদাহরণ গুলো পাচ্ছি। মিলিকে প্রচন্ড রকম মিস করছি। মনে হচ্ছে ওর দেখা যদি পেতাম। কিন্তু সেটা আর সম্ভব না। কারা যেন মিলিকে হত্যা করেছে। কলেজে উঠার সাথে সাথে আমার কাছের বান্ধবীটাকে আমি হারিয়ে ফেলি। মিলিকে কারা হত্যা করেছে জানি না। তবে খুব ইচ্ছা হয় মিলির হত্যাকারীকে খুঁজে বের করে জিজ্ঞেস করতে কেন এমন করেছে সে উপায় আর নেই। মিলির আবছা মুখটা চোখে ভাসছে। হালকা হাসির রেখা যেন তার মুখে সবসময় ফুটে উঠত। না জানি মেয়েটা পরকালে কেমন আছে। দোআ করি সে যেন অনেক ভালো থাকে। আর তার জীবনের সমস্ত কষ্টগুলো যেন সেখানে সুখে পরিণত হয়। গাড়ির সিটে হেলান দিতেই যেন চোখটা লেগে আসলো। সারা রাতের ঘুম যেন এখন চোখে ঝেঁকে বসলো। চোখটা মেলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। খানিকক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠতেই লক্ষ্য করলাম আমি হাসপাতালে শুয়ে আছি। নিজেকে হাসপাতালে দেখে অবাক হলাম। সোহান আমার পাশে বসে আছে। আমি বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
– হাসপাতালে আসলাম কখন? আমার কী হয়েছিল?
সোহানের ক্লান্ত মুখটা বলে উঠল
– জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলে।প্রেসার একদম কমে গেছিল। এতক্ষণ পর জ্ঞান ফিরল তোর। তিন ঘন্টা হয়ে গেছে। যাইহোক স্যালাইন চলছে সবকিছু স্বাভাবিক। ডাক্তার বলল ঘুম থেকে উঠলে যেন কিছু খেতে দিই। ফুড পান্ডায় খাবার অর্ডার করেছি। কিছুক্ষণের মধ্যে গরম স্যুপ চলে আসবে। এসময় তো খাওয়া দাওয়া একটু বেশি করবি। সারাদিন এত চাপ নিলে শরীর তো চলবে না। মনের জোরের সাথে তো শরীরের জোরও দরকার।
আমি বুঝতেই পারি নি যে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। আমার কাছে মনে হয়েছিল আমি ঘুমিয়ে গেছিলাম। শরীরটা যদিও অসাড় লাগছিল। তবে বুঝতে পারি নি। আমি সোহানকে মৃদু গলায় বললাম
– বাবা, মা কে কী বলেছিস? তারা কী আসবে?
সোহান চুপ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
– এখন এসব চিন্তা করতে হবে না। একটু বিশ্রাম কর।
– বাবা, মা কী কিছু বলেছে? লুকাস না। আমাকে বল।
– তারা তো তোর উপর একটু রেগে আছে জানিসেই। কল দিছিলাম। স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে তোর কোনো ব্যপারে তারা আর নেই। যদিও এটা অভিমান থেকে বলেছে। সময় মতো অভিমান কেটে গেলে ঠিক হয়ে যাবে। এসব নিয়ে ভাবিস না।
সোহানের কথা শুনে কেন জানি না বুকটা মোচড় দিতে লাগল। শুধু ভাবছিলাম আমি কী এমন করেছি যে বাবা মা আমাকে এভাবে ভুল বুঝলো। তাদের কত ভালোবাসি আমি। যা কিছু করছি সবকিছু একেবারে শেষ করার জন্যই। তাহলে কেন সবাই ভুল বুঝে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। মাথাটা ভার লাগছে। চোখটা বন্ধ করে রাখলাম। সোহান উঠে যেন কোথায় গেল। মিনেট পাঁচেকের মধ্যে আবার ফিরেও আসলো হাতে একটা স্যুপের বাটি নিয়ে৷ আমার পাশে বসে স্যুপটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল
– চিন্তা রেখে হা কর। নিজের দিকে একটু খেয়াল রাখ। আর আমার বন্ধুর সাথে কথা হয়েছে। সে বলেছে সব ব্যবস্থা করবে। যতটুকু সাহায্য লাগে করবে। আর ঐ অফিসারের বিরুদ্ধে ও স্টেপ নিবে৷ এখন একটু খেয়ে নে। আস্তে আস্তে একটু একটু করে আমরা শান্তির দিকে যাচ্ছি। একদিন ঠিকই কাঙ্ক্ষিত শান্তির দেখা মিলবে। কী রে কথা শুনেই যাচ্ছিস। হা কেন করছিস না। হা কর।
আমি সোহানের কথায় যেন সম্ভিত ফিরে পেলাম। হা করে মুখে স্যুপ টা নিয়ে গিলতে লাগলাম। এর মধ্যেই সোহান বলে উঠল
– মনে আছে অপ্সরা কলেজে পড়ার সময় যখন তুই পরীক্ষায় লিখতে পারতি না আমি তোকে লিখে দিতাম। কী জ্বালানোই টা ‘না, তুই জ্বালিয়েছিস। নিজে তো কিছু পড়তিই না তবুও খবরদারি করতি। না দেখালেই পরীক্ষা হল থেকে বের হয়ে আমার চুল টেনে ধরতি। তোর জন্য কলেজের ফাস্ট বয় হয়েও কান ধরে বেঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে৷ বাবারে কি ডেন্জারাস ছিলি। আর কারও সাথে তো এমন করতি না। আমাকে বোকা পেয়ে আমার সাথেই এমন করতি।
সোহানের কথা গুলো শুনছিলাম। তবে চোখে যেন সে স্মৃতিগুলো সব ভাসছিল। মধুময় স্মৃতি গুলো আজ বড্ড দীর্ঘ নিঃশ্বাস হয়ে বের হয়। হালকা হেসে বললাম
– সে জীবনটায় অনেক ভালো ছিল।কোনো দায়িত্ব ছিল না। যতই বড় হচ্ছি ততই যেন সব ঘিরে ধরেছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যেন বড় দায়।
– ভাবিস না জীবনটা আবার নতুন করে গড়ে উঠবে।
– আচ্ছা তুই এখনও বিয়ে কেন করিস নি? কাউকে কী পছন্দ করিস?
সোহান আমার কথা শুনে গম্ভীর হয়ে গেল। মনে হচ্ছে তার মনে কোনো ঝড় এসে ঝাঁপটা দিচ্ছে।
#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ২২
সোহান আমার কথা শুনে গম্ভীর হয়ে গেল। মনে হচ্ছে তার মনে কোনো ঝড় এসে ঝাঁপটা দিচ্ছে। চুপ রইল বেশ কিছুক্ষণ। আমি তার নীরবতা দেখে বললাম
– কথা কেন বলছিস না? এত চুপ কেন আছিস? কোনো সমস্যা?
– নাহ! এমনি। তোকে আজকে আমার বাসায় নিয়ে যাব। তারপর বলব কী হয়েছে। এখন কিছুই বলব না। আগে তুই খাবার খা। তারপর বিশ্রাম কর। সন্ধ্যায় আমার বাসায় নিয়ে যাব তারপর রাতে তোর বাসায় তোকে দিয়ে আসব।
– না রে সোহান। সরাসরি বাসায় যাব তারপর পরদিন কোনো এক সময় তোর বাসায় যাব। আপাতত কলেজ থেকে ছুটি নিয়েছি কিছুদিন। সব ঠিক ঠাক হোক আগে।
– তোর ইচ্ছা। আর যেদিন বাসায় যাবি সেদিন নাহয় তোর উত্তরটা দিব। আর এখন একটু বিশ্রাম নে। বিকেলে তোকে বাসায় পৌঁছে দিব।
আমি খাওয়া শেষ করে চোখটা বন্ধ করলাম। কেন জানি না শুধু অরন্যকে চোখে ভাসছিল। এমন কেন হচ্ছে বারবার। মনে হচ্ছে সে কিছু বলতে চায় বলতে পারছে না। যদিও আমি তাকে ঘৃনা করি প্রবল। তবে এ মূহুর্তে অরন্যকে বারবার মনে পড়ছে। এতকিছুর পর তার প্রতি বিন্দু পরিমাণ ভলোবাসা অবশিষ্ট নেই। যেটা আছে সেটা রাগ,ক্ষোপ আর প্রখর ঘৃনার স্তূপ। চোখটা ভয়ে বন্ধ করেও খুলে ফেললাম। সোহান আমাকে বারবার চোখ খুলতে বন্ধ করতে দেখে বলল
– অপ্সরা এনিথিং রং?
– নাথিং সোহান। তবে অস্বস্তি হচ্ছে। মাথাটা ভার হয়ে আছে নাহয় বাসায় চলে যেতাম এখনি। এত খারাপ পরিস্থিতিতে পড়ব পুনরায় বুঝতে পারে নি।
– একটু বিশ্রাম নে। শরীরটা ভালো লাগলেই বাসায় দিয়ে আসব। এত চিন্তা করিস না। পরিস্থিতি সবসময় অনুকূলে থাকবে না। একটু তো প্রতিকূলতা আসবেই।
আমি হালকা হালকা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম। চুপ হয়ে শুয়ে রইলাম। অবচেতন মন শুধু বারবার অতীতে ঘুরপাক খাচ্ছে। সময় মানুষকে কতটা বদলে দেয় সেটা নিজেকে দেখেই বুঝতে পারতেছি। একটা সময় অরন্যকে পাগলের মতো চাইতাম। তাকে পাওয়ার জন্য জীবনে কত কিছুই না করেছিলাম৷ আর আজকে অরন্যের থেকে নিজেকে ছাড়াতে এত কিছু করছি। আচ্ছা আমি কী অরন্যকে ফিরিয়ে দিতে পারতাম যদি সে বিনয় নিয়ে আমার সামনে আসত। হয়তো পারতাম না। কিন্তু মিথ্যা নাটকের বেড়াজালে আটকে দিয়ে আমাকে যেভাবে আঘাত করা হয়েছে তারপর তাকে মেনে নিতে পারছি না। সম্পর্ক ভাঙ্গে সে সম্পর্ক আবার গড়ে। অরন্য তিনটা বছর আমাকে নিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করেছে সেটা আমি জানি। তবে তারপর সে আমাকে যেভাবে চেয়েছে তাতে আমার মন বিগড়ে গেছে।
মাথাটা টনটন করে ব্যথা করছে। শরীরের ক্লান্তি ক্রমশ বাড়ছে ক্রমশ কমছে। কেমন যেন ছটফট করছে সারা শরীর। আমি হালকা তাকালাম। সোহান নিজের হাতে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। ক্লান্ত চেহারা সে সাথে মলিনতার ছাপ। এ হাসপাতালে থাকতেও ভালো লাগছে না। তাই সোহানকে বললাম
– আমাকে বাসায় নিয়ে দিয়ে আয়। ভালো লাগছে না এখানে থাকতে। ডাক্তারের সাথে একটু কথা বল। বাসায় গিয়ে একটা লম্বা ঘুম দিলেই ঠিক হয়ে যাবে।
সোহান আমার কথা শুনে উঠে গিয়ে বাইরে গেল ডাক্তারের সাথে কথা বলতে। আমি শুয়ে শুয়ে অতীতেই বারবার ডুব দিচ্ছিলাম। জীবনের অধ্যায় গুলো বরাবরেই ছন্নছাড়া। কখনও কষ্ট কখনও মলিনতা আবার কখনও সুখে পরিতৃপ্ত।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সোহান চলে আসলো। আমার হাতটা ধরে বলল
– আমাকে ভর দিয়ে উঠ। উঠতে পারবি তো নাকি একটু বিশ্রাম করবি,নাকি হুইল চেয়ার আনব?
আমি সোহানের হাতটা শক্ত করে ধরে উঠে বললাম
– উঠতে পারব। সমস্যা নেই।
সোহান কে ধরে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গাড়ি দিয়ে বাসায় এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজা নক করলাম। আমার কন্ঠ শুনতেই বাবা বললেন
– এতক্ষণ যেখানে ছিলে সেখানে যাও। এ বাসায় তোমার কোনো জায়গা নেই। আমাদের মেয়ে মরে গেছে। যে মেয়ে আমাদের কথা শুনবে না তাকে আমাদের মেয়ে হিসেবে পরিচয় দিতে ঘৃনা হয়। এ ঘরে তোমার কোনো জায়গা নেই।
বাবার কথা শুনে সোহান বাবাকে বুঝাতে লাগল। তবে বাবার একটা কথায় আমি যেন বাসায় ঢুকতে না পারি। আমি তাদের মেয়ে না। সোহান বেশ কতক্ষণ বুঝিয়ে আমাকে বলল
– এভাবে তো তোকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না। তুই আপাতত আমার বাসায় চল তারপর আংকেল আন্টিকে বুঝিয়ে যা ব্যবস্থা করার করব।
আমি আর কী করব। সোহানের প্রস্তাব মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। কোনো দোষ না করেও আজকে নিজের বাসায় উঠতে পারলাম না। নিজের পরিবারের কাছে মৃত হয়ে গেলাম। হায়রে জীবন। এত ভয়ানক না হলেও পারত। এত ভয়ানক কেন জীবনটা?
সোহানকে নিয়ে তাদের বাসায় গেলাম। বাসায় ঢুকতেই একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে সোহানকে দৌড়ে এসে বাবা, বাবা বলতে লাগল। আমি বেশ বিস্মিত হলাম। সোহান তো বিয়ে করে নি বলেছিল তাহলে এ বাচ্চা কার? বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলাম
– বাচ্চা টা কী তোর? আর তুই তো বলেছিলি তুই বিয়ে করিস নি। তাহলে বাচ্চা এলো কোথায় থেকে?
সোহান বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে দুগালে চুমু দিয়ে বলল
– এর জন্যই আমি এতদিন বিয়ে করে নি। বাচ্চাটা আমার না আমার বড় ভাইয়ের। ওর মা ওর যখন এক বছর ছিল তখন ছেড়ে চলে যায় অন্য একজনের হাত ধরে। এরপর থেকে ভাইয়া পাগল হয়ে গেছে। পাঁচ বছর সম্পর্কের পর বিয়ে। ভালোবাসার পূর্ণতা পেয়ে যখন হারিয়ে ফেলে সেটা আর মেনে নিতে পারে নি। ভাইয়া পাগলা গারদে আছে। ভাইয়ার ঘটনার পর থেকে কেন জানি না কোনো মেয়েকে বিশ্বাস করতে পারিনি৷ বারবার মনে হয়েছে মেয়েরায় পারে একটা সাজানো স্বপ্ন ভেঙ্গে দিতে। এর পর থেকে টুকটুকি কে নিজের সন্তানের মতো দেখে এসেছি। নিজের চেয়েও বেশি ওকে ভালোবাসি৷ তোর যেমন ছেলেদের নিয়ে বাজে অভিজ্ঞতা ঠিক তেমনি আমার মেয়েদের নিয়ে। তোর কাছে একটা ছেলে মানেই অনেক খারাপ আর আমার কাছে একটা মেয়ে মানেই অনেক স্বার্থপর। দুজনের ঘটনা ভিন্ন তবে মূলপাঠ এক।
এর মধ্যেই টুকটুকি বলে উঠল
– বাবা উনি কে? উনি কি আমার মা? প্রতিদিন তোমাকে মা এনে দিতে বলি আজকে তো সত্যি সত্যিই নিয়ে এসেছো। আমি মায়ের কোলে যাব।
টুকটুকির কথা শুনে সোহান জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল
– আরে মামনি কী বলছো। উনি তোমার…
বাকি কথা সোহানকে বলতে না দিয়ে আমি সোহানের কথা কেড়ে নিয়ে বললাম
– আমিই তোমার মা আসো আমার কোলে।
সোহান আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি সোফায় বসে সোহানকে বললাম টুকটুকিকে কোলে দিতে। শরীরটা এত ভালো না তবুও টুকটুকিকে কোলে নেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমি টুকটুকিকে কোলে নিয়ে বললাম
– টুকটুকির বয়স কত?
– পাঁচ বছর।
আমি টকটুকিকে জড়িয়ে ধরে রইলাম। মনে হচ্ছিল নিজের সন্তান এটা। আমার সন্তানটা পৃথিবীতে আসলে হয়তো টুকটুকির মতোই কথা বলত। টুকটুকিকে কোলে নিয়ে একটা স্বস্তি পাচ্ছিলাম। এর মধ্যেই সোহানের ফোনে কল আসলো। সোহান কলটা ধরতেই কেমন জানি আনমনা হয়ে গেল। আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল।
– তুই একটু স্থির হয়ে বস। একটা কথা আছে। নিজেকে আগে সামলে নে।
আমি বুঝতে পারছিলাম না সোহান কী বলবে। তাই শান্ত গলায় বললাম
– কী বলবি বল।
( কপি করা নিষেধ)
(কপি করা নিষেধ)