প্রাক্তন পর্ব ২৭+২৮+শেষ

#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-২৭

আমিও বসা থেকে হুট করে উঠে হন্তদন্ত হয়ে বাইরে আসলাম। আমাকে বাইরে আসতে দেখে সোহানও বাইরে আসলো। আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল

– কী রে হুট করে বাইরে আসলি কেন? কী হয়েছে? কাউকে কী দেখেছিস?

আমি আশেপাশে খু্ঁজতে লাগলাম। আশেপাশে দেখে লক্ষ্য করলাম কেউ নেই। ভাবুক গলায় সোহানকে উত্তর দিলাম

– মনে হয়েছিল অরন্য বের হয়েছে রেস্টুরেন্ট থেকে।

আমার কথায় বিরক্ত হওয়ার কারণ থাকলেও সোহান তেমন বিরক্ত হলো না৷ আমাকে ধরে বলল

– তুই একটু বেশিই ভাবছিস। এখানে কেউ নেই। অরন্যকে দেখলে সে কী উধাও হয়ে যাবে? মৃত মানুষকে নিয়ে এত চিন্তা করা ঠিক হচ্ছে না। বাবুর উপর প্রভাব পড়বে। সে কখন থেকে একটা কথায় বলে যাচ্ছিস। একটু নিজেকে সামলে নে। আমি জানি তোর সাথে যা হয়েছে এতকিছুর পর নিজেকে সামলানো অনেক কঠিন। তবে নিজের সন্তানের জন্য হলেও নিজেকে সামলে নে। আমাদের জীবন তো সবসময় আমাদের মতো করে চলে না৷ তোর যেটা হচ্ছে সেটা অত্যাধিক চিন্তা থেকে। সিজোফ্রেনিয়া রোগ এটা। যাকে নিয়ে বেশি চিন্তা করা হয় তাকে বাস্তবে দেখেছে বলে মনে হয়। এজন্যই বলেছিলাম একজন মানসিক ডাক্তার দেখাই। তুই তো রাজি না। তবে একটু নিজেকে সময় দে। যেটা হয়েছে সেটা মানতে শিখ। আমার একটা ভুল হয়েছে নাফিসার কাছে নিয়ে গিয়ে। নিয়ে গিয়েছিলাম তোকে একটু স্বস্তি দেওয়ার জন্য। উল্টা নাফিসা তোকে অশান্ত বানিয়ে দিল। যাইহোক যা হবার তো হয়েছেই এখন চল আইসক্রিম খাওয়া যাক। বাসায় টুকটুকি তোর জন্য অপেক্ষা করছে। আমার মেয়েটার দিকে তো তোর লক্ষ্য রাখতে হবে৷ তাকে তোর আদর থেকে বঞ্চিত করিস না।

সোহানের কথা শুনে আমার যেন বোধদয় হলো। সত্যিই তো বিষয়টা নিয়ে আমি একটু বাড়াবাড়ি করছি। আর সোহান আমার স্বামী এটাও আমাকে দেখতে হবে। কোনো স্বামীই তার স্ত্রী এর প্রাক্তনকে সহ্য করতে পারবে না এটাই স্বাভাবিক। অরন্যকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমি সোহানের সাথে একটু অন্যায় করে ফেলতেছি। যেটা একদম অনুচিত। আমি নিজেকে সামলালাম। সোহানের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম। তারপর হালকা সুরে বললাম

– তুই যা বলিস তাই হবে। সত্যিই হয়তো এটা আমার মানসিক রোগ না হয় এমনটা হত না। চল আইসক্রিম খাই। মাথা এলোমেলো লাগছে।

সোহান আমার মাথার চুলে আঙ্গুল দিয়ে হালকা মেসেস করে বলল

– পাগলি একটা।

বলেই দুজন রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম পুনরায়। আইসক্রিম ততক্ষণে চলে আসলো। সোহান আর আমি আইসক্রিম টা খেতে লাগলাম। আমি যত চেষ্টা করছি সোহানের দিকে মনোযোগ দিতে ততই মনোযোগ যেন অরন্যের দিকে যাচ্ছিল। নিজের প্রতি নিজেই বিরক্ত হচ্ছিলাম। তবুও সামলে নিয়ে দুজন আইসক্রিম খাওয়া শেষ করে বাসায় আসলাম।

বাসায় আসতেই টুকটুকি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল

– মা কোথায় গিয়েছিলে?

আমি টুকটুকিকে কোলে তুলতে চাইলে সোহান বাঁধা দিল। সোহানের দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললাম

– কোলে নিতে বাঁধা দিচ্ছিস কেন?

– টুকটুকির বয়স ৫ বছর। ও একটু হেলদি বাচ্চা। এখন কোলে না তোলায় ভালো। আদর কর এমনিতে কর। রিস্ক নিস না কোনো। এ বাচ্চার কিছু হলে আমার মনকেও আমি শান্ত করতে পারব না আর তুই ও আরও ভেঙ্গে পড়বি। আমি চাই না এমন কিছু হোক। সবদিক দিয়ে তুই সাবধানে থাক।

সোহানের কথা গুলো শুনে আমার চোখের কোণে জল জমে গেল। একটা মানুষ এত নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসে কী করে। আমি টুকটুকিকে কোলে তুললাম না। ওর গালে কয়েকটা চুমু দিয়ে রুমে নিয়ে গেলাম। ওর জন্য আনা চকলেটটা ওর হাতে দিলাম। ও আমার পাশে বসে হাজারটা প্রশ্ন করতে লাগল। কোথায় গিয়েছিলাম তাকে কেন নিই নি। আমি হেসে হেসে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলাম। এর মধ্যে সোহানের মা এসে বলল

– মা মেয়ের ভালোবাসা যেন এভাবেই অটুট থাকে। আরেকটা নাতি নাতনির মুখ দেখতে চাই।

আমি লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেললাম। মা আমার লজ্জা দেখে হালকা হেসে চলে গেল। আমি টুকটুকির সাথে এদিকে ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম। টুকটুকিকে গোসল করালাম দুপুরের খাবার খাওয়ালাম তারপর ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। মাথাটা বেশ ব্যথা করছে। টেবিলে হাত রেখে হাতে কপাল ঠেকিয়ে চেয়ারে বসলাম। সোহান হাতে করে তেলের বোতল এনে আমাকে ডেকে বলল

– চল উঠ। মাথায় তেল দিয়ে দিই ভালো লাগবে।

আমি উঠতে চাচ্ছিলাম না। তবুও সে জোর করে আমাকে বসিয়ে মাথায় তেল দিয়ে মেসেস করতে লাগল। মাথার ব্যথাটা যেন আস্তে আস্তে কমছিল। আমি সোহানকে বললাম

-ব্যাথাটা অনেকটায় কমেছে।
– কে তেল দিয়ে দিছে দেখতে হবে তো। চল খাবি।

দুজন একসাথেই খেলাম। মা কল দিয়ে বলল সোহানকে নিয়ে বাসায় যেতে তবে এখন কেন জানি বাসায় যেতে মন চাচ্ছিল না, তাই না করে দিলাম। মাকে বললাম সোহান ব্যবসার কাজে ব্যস্ত পরে আসব। মা ও আর বাড়াবাড়ি করল না। দিন গড়িয়ে রাত নামল সোহানের হাতে মাথা রেখে শুয়ে আছি। সোহান আমার ঘাড়ের গন্ধ নিচ্ছিল। ওর বুকে মাথা রেখে যেন অনেকটা স্বস্তি মিলছিল। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল

– সবসময় এভাবে থাকিস। তোকে আমি অনেক বেশি ভালোবাসি। কখনও ছেড়ে চলে যাবি না।

আমি হালকা হেসে বললাম

– বেশি ভালোবাসাও ভালো না রে। একটু কম বাসিস। যাতে কখনও হারিয়ে গেলেও সহ্য করে নিতে পারিস।

সোহানের ঠোঁট দুটো দিয়ে আমার ঠোঁট জোরা চেপে ধরল। পরক্ষণেই ছেড়ে দিয়ে বলল

– এমন বলিস না। আমি কখনও তোকে হারাতে চাই না। ভীষণ ভালোবাসি তোকে।

আমি আর কিছু বললাম না। তার বুকে মাথা লুকালাম।

পরদিন সকালে উঠেই তৈরী হলাম কলেজে যাওয়ার জন্য। সোহান আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিয়ে বলল

– আমি গাড়ি রেখে যাচ্ছি। তুমি গাড়ি করে চলে যাও। একটা কাজে শহরের বাইরে যাব। রাতের মধ্যেই চলে আসব।

আমিও সোহানের দিকে তাকালাম। তার গালে ঠোঁটের আলতো স্পর্শ দিয়ে কানের কাছে গিয়ে বললাম

– তাড়াতাড়ি চলে এসো। অপেক্ষায় থাকব।

সোহান হালকা করে আমাকে বুকের মধ্যে ঝাঁপটে ধরে বলল

– সে তো আসতেই হবে। প্রিয়তমা যে অপেক্ষা করবে। আচ্ছা আজকে আমরা কত সাবলীল ভাবে তুমি করে বললাম তাই না।

হালকা হাসি টেনে বললাম

– আস্তে আস্তে আরও সাবলীল হয়ে যাবে। যা তো তুই এবার।

সোহান বের হয়ে গেল। আমিও তৈরী হয়ে টুকটুকিকে নাস্তা খাইয়ে দিয়ে মায়ের কাছ থেকে বলে কলেজের উদ্দেশ্যে বের হলাম। ড্রাইভার চাচা গাড়ি চালাচ্ছে। হুট করে গাড়ির আায়না দেখে মনে হলো অরন্য আমাকে বাইক চালিয়ে অনুসরন করছে। তবে এবার উত্তেজিত হলে চলবে না৷ এটা আমার কল্পনা নাকি বাস্তব সেটা আগে নিশ্চিত হতে হবে। আমি ড্রাইভার চাচাকে বললাম

– চাচা দেখেন তো আয়নায় কোনো ছেলেকে দেখছেন কী না কালো শার্ট পরা বাইক চালাচ্ছে।

চাচা আয়নায় তাকিয়ে বলল

– হ্যাঁ দেখতে পারছি। কালো হ্যামলেট ও পরেছে তাই না?

– হ্যাঁ চাচা।

তার মানে এটা আমার কল্পনা না। শার্ট টা অরন্যের সেটা আমি ভালো করেই চিনি। চাচাকে বললাম

– চাচা গাড়িটা একটু থামান।

চাচা গাড়িটা থামাল। সে বাইকটা গাড়িটা থামতেই গাড়িটা পার করে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। বাইকের নম্বরটা আমার খুব ভালো করে চেনা। এটা যে অরন্যের বাইক বুঝতে আর বাকি রইল না। এবার আমি নিশ্চিত এটা অরন্য। চাচাকে বললাম কলেজের দিকে যেতে। আমি সিউর অরন্য আমার পিছু নিবে। চাচা গাড়ি স্টার্ট করে কলেজের দিকে যাচ্ছে। সে বাইকটা এক মোড়ে দাঁড়িয়ে থেকে পুনরায় আমার পিছু নিল। চাচা কলেজের সামনে এসে বলল

– চলে এসেছি।

আমি গাড়ি থেকে নামলাম। নামতেই বাইকটা থেমে গেল। দেখেও না দেখার ভান করে কলেজে ঢুকলাম। কলেজে ঢুকতেই কলিগরা বলতে শুরু করল

– হুট করে বিয়ে করলে বিয়ের দাওয়াত কিন্তু পেলাম না।

আমি এক গাল হেসে বললাম

– দিব। একটু সমস্যার জন্য দেওয়া হয়নি।

– দাওয়াত যেন পেয়ে যাই। যাইহোক কংগ্রাচুলেশনস। আর ফেসবুকে এখনও সিনগেল কেন। রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস চেন্জ করো।

সত্যিই তো আমি সিনগেল না, তাহলে ফেসবুকে সিনগেল দিব কেন। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে সোহানের সাথে ট্যাগ করে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস দিলাম। হুট করে বিয়ের স্ট্যাটাস দেওয়ায় সবাই একটু চমকালো বটে।

আর এদিকে লক্ষ্য করলাম অরন্য নীচে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও হ্যামলেট পরা। তবুও আমাকে নিশ্চিত হতে হবে। ওর একটা ছবি তুলে রাখতে হবে। আমি নীচে গেলাম। কৌশলে অরন্যের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এক পাশে এসে তাকে ভালো করে লক্ষ্য করলাম। লক্ষ্য করার পর শুধু একটু না অনেকটায় চমকালাম আশ্চর্য ও হলাম।
#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-২৮/ শেষ পর্ব

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সেখান থেকে চলে আসলাম। নিজেকে সামলে নিলাম । ভাবতে লাগলাম কী হতে চলেছে। চুপচাপ হয়ে রইলাম। জানতাম কিছু একটা রহস্য আছে৷ আর আমি কলেজ থেকে বের হলেও আমার পিছু নিবে সে। তবে কিছু মানুষ অতি চালাকি করতে গিয়েই ধরা পড়ে। যেমনটা এখন হয়েছে। রোটিনের ক্লাস গুলো শেষ করে কলেজ থেকে বের হওয়ার আগে সোহানকে কল দিলাম। সোহান কলটা ধরে বলল

– কী রে কী করছিস৷ একটু ব্যস্ত ছিলাম তাই কল দেওয়ার সময় হয়ে উঠে নি।

– কল দেওয়ার সময় হয়ে উঠে নি তাহলে এখন কল ধরেছিস কী করে? যাইহোক তোর পরিচিত কোন ফ্রেন্ড পুলিশ, একটু নম্বরটা দে। একটু কল দিব৷ আর এতদিন বলেছিলি না আমি পাগল। আজকে বুঝবি পাগলামির কারণ।

সোহান কিছুটা অবাক হয়ে বলল

– কেন কী হয়েছে আবার। খুলে বল।

– সময় মতো খুলে বলব৷ নম্বরটা দে।

সোহান কথা না বাড়িয়ে আমাকে নম্বরটা দিয়ে বলল

– আমি ওকে বলে দিবনে তুই কল দিবি। যা সমস্যা খুলে বলিস। তবে আমাকে বলা তোর উচিত।

– বলব সময় করে।

ফোনটা রেখে দিলাম। তারপর সোহানের দেওয়া নম্বরে কল দিলাম। পুলিশ অফিসার সাজ্জাদ কলটা ধরলেন। উনি কলটা ধরতেই আমি আমার পরিচয় দিলাম। সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। উনি আমার কথা শুনেই বললেন

– আপনি কী নিশ্চিত উনি আপনাকে ফলো করবে?

– একদম নিশ্চিত। আপনি চাইলে আসতে পারেন। এমন ভাবে আসবেন যেন টের না পাই।

– ঠিকানাটা দিন।

অফিসার সাজ্জাদকে ঠিকানা টা টেক্সট করে দিলাম। আধা ঘন্টার মধ্যেই উনি চলে আসলেন। আমি কলেজ থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠলাম। তখন বাইকটা খুঁজতে লাগলাম আশেপাশে তবে পাচ্ছিলাম না। ভাবতে লাগলাম সে কী কিছু আন্দাজ করতে পেরেছে নাকি চলে গেছে। দোটানা নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। গাড়িটা চলতে শুরু করল। পেছনে বাইকটাও। বুঝায় যাচ্ছে এ বাইকটা আমার গতিবিধি লক্ষ্য করছে। অফিসার সাজ্জাদকে কল দিলাম। উনি আশ্বস্ত করলেন উনি পেছনেই আছেন৷ আমি বাইকের বর্ণনা দিলাম। উনি খুব কৌশলে বাইকটা ধরে ফেললেন। সাথে সাথে চাচাকে গাড়ি থামাতে বললাম। কী ভেবেছিলেন লোকটা অরন্য? না মোটেও না। লোকটা অরন্যের মতো পোশাক পরে আমাকে ফলো করত। আমার মনে দ্বিধা দ্বন্ধ সৃষ্টি করত। লোকটা ছিল সালমান। নাফিসার প্রাক্তন৷ সেদিন নাফিসা এতকিছু বলার পর আমি মেনে নিতে পারছিলাম না নাফিসা খুন করেছে৷ তবে এটা মনে হয়েছিল অরন্য বেঁচে আছে৷ কিন্তু আমার ধারণা আজকে পাল্টে গেল৷ কারণ আমি যখন ছেলেটাকে লক্ষ্য করে দেখলাম সেটা সালমান ছিল। যেহেতু সালমান আর অরন্যের গড়ন একরকম ছিল তাই বুঝতে পারি নি। আমি নাফিসার কাছে যাওয়ার পর থেকেই সে আমার গতিবিধি লক্ষ্য করছিল আমি কী করি না করি৷ নাফিসা বলেছিল সালমান লন্ডন চলে গেছে তবে নাফিসা জানত না সালমান দেশেই ছিল।

সালমানকে অফিসার সাজ্জাদ যখন কড়াভাবে জিজ্ঞেস করল তখন সালমান জানায় নাফিসার সাথে টাকা নিয়ে বেশ কিছুদিন ঝামেলা হচ্ছিল৷ কাবিনের ৩০ লাখ টাকার পুরোটা চেয়েছিল সালমান নিতে। তাই নাফিসার সাথে সব ঝামেলা মিটিয়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু নাফিসা সেটা মানতে চায় নি। সেদিন নাফিসার সাথে তার অনেক ঝামেলা হয়। টাকা নিয়ে কথা কাটাকাটি আরও অনেক কিছুই। এক কথায় বলতে গেলে নাফিসা সালমানকে অনেক বেশিই অপমান করেছিল। যেটা সালমান সহজে নিতে পারছিল না। নাফিসা চলে যাওয়ার পর সালমান বুঝতে পারছিল না কী করবে৷ এমন সময় সে অরন্যকে দেখতে পেল। তার মাথায় নতুন বুদ্ধির সংযোজন হলো। কেউ জানত না অরন্য থাকে কোথায়। তবে অরন্য থাকত আরেকটা নতুন বাসা ভাড়া করে। সালমান সেদিন কাকতালীয় ভাবে অরন্যকে দেখে তার পিছু নেয়। বাসাটা ভালো করে চিনে নেয়। তারপর প্ল্যান করে৷ চিন্তা করল একমাত্র অরন্যকে খুন করলেই সে নাফিসাকে ফাঁসাতে পারবে। যে প্ল্যান সে কাজ। সেদিন সকাল বেলা সে অরন্যের রুমের দরজা নক করে। অরন্য দরজা খুলতেই সালমান চোখে মুখে অজ্ঞান হওয়ার স্প্রে করে। তারপর যখন অরন্য নিস্তেজ হয়ে পড়ে তাকে গলা টিপে হত্যা করে। হত্যার পর এসিড দিয়ে সারা শরীর পুড়িয়ে দেয় যাতে করে চেহারা সহজে বুঝা না যায়। এরপর স্যুটকেসে ভরে নাফিসার বাড়ির পাশেই লাশটাকে ফেলে দেয়। পরবর্তীতে লাশ শনাক্ত করার পর ময়না তদন্ত করলেও সেটা টাকা দিয়ে পরিবর্তন করে নাফিসাকে পুরোপুরি ফাঁসিয়ে দেয়। এবং নাফিসার কাছে বলে সে লন্ডন চলে এসেছে। নাফিসাও বোকার মতো তা বিশ্বাস করে সন্দেহের তীর তার দিক থেকে সরিয়ে নেয়। ফলে কোনোভাবেই প্রমাণ হয়নি সালমান অরন্যকে খুন করেছে।

সালমানের উদ্দেশ্য তো হাসিল হয়েছে। এতে সালমানও ফাঁসার আর কোনো চান্স ছিল না৷ তবে বিপত্তি ঘটে তখন যখন সালমান জানতে পারে আমি নাফিসার সাথে দেখা করতে গেছি। সে ভেবেছিল আমি কিছু একটা করে বসে কী না। এতে যদি সে ফেঁসে যায়। কথায় আছে পাপ বাপকেও ছাড়ে না। সে আমার গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকে। এমনভাবে লক্ষ্য করত যাতে করে আমি ওকে কোনোভাবেই সন্দেহ না করতে পারি বরং উল্টা যেন নিজেই পাগল প্রমাণিত হই। আর সেজন্য অরন্যের ব্যবহার করা জামা কাপড় পরে এমনভাবে আসত সেটা শুধু আমিই দেখতে পেতাম৷ যাইহোক তার এ কাজটায় তার সকল খেলা ধুলোই লুটিয়ে দিয়েছে৷ অবশেষে সে ধরা পড়েছে। খুনের কথা স্বীকারও করেছে৷ এ নোংরা খেলাটা যেন বন্ধ হলো। সালমান আপাতত অফিসার সাজ্জাদের অধীনে আছে।

সন্ধ্যায় সব ঘটনার অবসান ঘটিয়ে বাসায় আসলাম। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে ভবতে লাগলাম। দুনিয়া কত অদ্ভুত আমরা ভাবী এক হয় আরেক। জীবনের ছন্দগুলো একটু বেশিই এলোমেলো। ভেবেছিলাম অরন্য বেঁচে আছে তবে বুঝিনি সেটার পেছনে এত নাটক আছে। অরন্য কী কখনও জানত নাফিসার প্রাক্তনের হাতেই তার খুন হবে। একটা লোভ অহংকার মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে নিল। নাফিসাকে সে বিয়ে করেছিল লোভে পড়ে অহংকারে ডুবে গিয়ে। আর নাফিসা সেও অরন্যকে বিয়ে করেছিল লোভে। নাফিসার জন্য অরন্য আমাকে ছেড়েছিল আর তার মাধ্যমেই নিজের জীবন হারাল। আর নাফিসা সালমানের জন্য অরন্যকে ছেড়েছিল আর তার জন্যই মিথ্যা জেলের মামলায় ফাঁসলো। কথায় আছে যে যতটুকু করে তার জন্য ততটুকুই বরাদ্ধ থাকে। অরন্য যেমনটা করেছিল তার পরিণতিও তেমনটায় হয়েছে। আর নাফিসা জেল থকে ছাড়া পেলেও একটা বড় শিক্ষা পাবে। বুঝতে পারবে লোভে পরে কারও ক্ষতি করে জীবন সুন্দর করা যায় না। বাকি রইল আবির। আবিরের দোষটা ছিল আমাকে নিয়ে খেলা। জেনে শুনে মনটা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা। সেও শাস্তি পেয়েছে।

বাকি রইলাম আমি৷ যে কী না অরন্যকে ভালোবাসতাম পাগলের মতো। তার জন্য সব কিছু বিসর্জন দিতে একটা সময় চেয়েছিলাম। বিনিময়ে কষ্ট ছাড়া কিছু পাইনি৷ তার সাথে বিয়ে হয়েছিল তবে সেটা প্রকাশ করার মতো কোনো উপায় পাইনি। নিজের সন্তানকে শেষ করে দিতে হয়েছিল। সেদিনের পর থেকে জমে থাকা ঘৃনা তাকে দ্বিতীয়বার মানতে বাঁধা দিয়েছিল৷ তবুও মেনে নিতাম যদি না সে আবিরকে দিয়ে নোংরা খেলা না খেলত। তার ভুলগুলো ক্ষমা চেয়ে আমার কাছে আসত। কিন্তু এমন কিছু কাজ করেছে যেটা আমাকে আরও বেশি আঘাত করেছে৷ দুই বার ঠকেছি একবার আরন্যকে পাগলের মতো ভালোবেসে আর দ্বিতীয়বার আবিরকে ভালো না বাসলেও বিশ্বাস করে।

যখন ঠকতে ঠকতে নিঃশ্ব হয়ে গেছি। নিজের গতি হারিয়ে ফেলেছি। কী করব বুঝতে পারিনি। তখন বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সোহান। আমাকে কোনো নোংরা খেলার গুটি বানাই নি৷ বরং এতকিছু জানার পরও বিয়ে করে নিজের স্ত্রী এর সম্মান দিয়েছে৷ যেদিন কবুল বলেছি এর পর থেকেই ওকে আমি আপন করে নিয়েছি৷ ভালোবাসতে হয়তো পাগলের মতো পারিনি৷ তবুও তাকে ভালোবাসার চেষ্টা করেছি৷ তার বুকে মাথা রেখে স্বস্তি খুৃঁজেছি৷ সব কিছুর উর্ধ্বে গিয়ে মানুষটা আমাকে ভালোবেসেছে৷ ভাগ্যিস নতুন কোনো খেলায় জড়ানোর আগে আজকে সে খেলার সমাপ্তি ঘটেছে৷ অরন্য ওপারে ভালো থাকুক৷ ও আমার মোনাজাতে থাকবে। ওর দিয়ে যাওয়া স্মৃতি আমার সাথেই থাকবে তবে নতুন পরিচয়ে।

আনমনা হয়ে এসবেই ভাবছিলাম। কিছুটা অস্থির লাগলেও আজকে নিঃশ্বাস গুলো বেশ স্বস্তিতে ফেলছিলাম৷ এর মধ্যে সোহান আসলো। পাশে দাঁড়াল। আমার কাঁধে হাত রেখে বলল

– কী ভাবছিস?

আমি সোহানের দিকে ফিরে বললাম

– আসলি কখন?

– মাত্রই। তোকে ভুল বুঝার জন্য সরি। বুঝতেই পারিনি সালমান এমন একটা কাজ করবে৷ পুলিশ সালমানকে জেলে নিয়েছে। আর নাফিসাকে ছেড়ে দিয়েছে। নাফিসা আমাকে কল দিয়েছিল বলেছে তাকে ক্ষমা করে দিতে। তোর এ উপকার কোনোদিনও সে ভুলবে না। এখন থেকে জীবনটা সুন্দর করে গুছা। আজকের পর থেকে তোর জীবনে আর কোনো কালো ছায়া নামবে না। এতদিনের পাওয়া যন্ত্রণা সবটা সুখে পরিণত হবে। আর একটা কথা বলি মানুষ চিনে রাখ। তুই বিয়ের স্ট্যাটাস দেওয়ার পর তোরেই কিছু কলিগ বান্ধবী কাছের লোক আজকে আমাকে তোর অতীত নিয়ে মেসেজ করেছে। সব জেনে বিয়ে করেছি কী না। এরাই তোর ক্ষতি করতে চাইবে। সবাইকে চিনে রাখিস আমার মোবাইলটা নিয়ে দেখে। আর এখন এভাবে দাঁড়িয়ে থাকিস না। একটু বিশ্রাম নে। রাত ১১ টার উপর বাজে। আজকে অনেক ধকল গেছে তোর উপর। তবুও স্বস্তি তো মিলেছে। এটাই অনেক।

সোহানের কথায় কিছু বলতে পারছিলাম না। দুনিয়ায় কিছু সুপার হিউম্যান থাকে আর সেটা অতি নগন্য। তার মধ্যে একজন হলো সোহান। আমি চুপ করে ওর দিকে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছি। সোহান আমাকে ধরে তার বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল

– কোনোদিন তোরে কষ্ট পেতে দিব না৷ যা পেয়েছিস সবটা সুখে পরিণত করে দিব।

এর মধ্যেই টুকটুকি উপস্থিত হলো।।টুকটুকিকে দেখেই দুজনেই সরে পড়লাম। টুকটুকি আমার কাছে আসলো। আমি ওকে নিয়ে খাটের উপর বসালাম। ওর গালে সহস্র চুমু একে দিলাম।

সেদিনের পর দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর কেটে যায়। সালমানের শাস্তি হয়। মৃত্যু দন্ড হয়নি তবে কারাদন্ড হয়েছে। নাফিসা মাঝে মাঝে কল দিয়ে খুঁজ নেয়৷ চিনে রেখেছিলাম সেসব মানুষকে যারা বিয়ের স্ট্যাটাস দেওয়ার পর সোহানকে আমার নামে যা তা বলেছিল। পুত্র সন্তানের মা হই। কেউ জানে না বাচ্চাটা অরন্যের। সবাই জানে বাচ্চাটা আমার আর সোহানের। যেসব মানুষ গুলো আমাকে যা তা বলত আজকে তাদের মুখ বন্ধ। তারায় আমার প্রশংসা করে।।তারায় তাদের মেয়ের জন্য সোহানের মতো ছেলে খুৃঁজে।৷ আর সোহান সে কোনোদিনও আমার অতীত নিয়ে কথা তুলে নি। কেউ তুললেও সেটা এড়িয়ে গিয়েছে। নিজের মতো করে আমাকে সাজিয়ে নিয়েছে। তার ভালোবাসায় আমাকে নতুন করে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। টুকটুকি ক্লাস ফোরে পড়ে। আর ছেলেটা ক্লাস প্লে তে। দুটো সন্তান আর স্বামীর সোহাগ নিয়ে আমার সুখের সংসার বেশ ভালো চলছে৷ যে সংসারে নেই কোনো কুটিলতার ছায়া, সেখানে আছে শুধু অকৃত্রিম ভালোবাসা। আজকে অবশ্য আরেকটা বিশেষ দিন কারণ আজকে জানতে পারি আমার ঘরে আরেকজন নতুন অতিথি আসবে। আরেকটা কথা আমাদের সম্বোধনটাও তুই থেকে তুমিতে চলে এসেছে। যদিও মাঝে মাঝে তাকে মজা করে তুই বলি। কারণ সে আগে আমার বন্ধু তারপর আমার স্বামী। তুই থেকে তুমিতে আসার গল্প গুলো একটু বেশিই সুন্দর এবং সাবলীল হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় কিছু কিছু মানুষের ভালোবাসা পাবার জন্যই হয়তো কেউ কেউ #প্রাক্তন হয়ে যায়।

বিঃদ্রঃ

১)প্র্যাগনেন্ট অবস্থায় বিয়ে জায়েজ কী না জানা নেই। এখতেলাফি বিষয় অনেক ফতোয়া আছে৷ যেগুলো আমি বা আপনি দিতে পারব না। তবে গল্পটা ইসলামিক কোনো গল্প না। সামাজিক কিছু বিষয় তুলে ধরে সংযোজন বিয়োজনের মাধ্যমেই গল্পটা সাজানো হয়েছে। সমাজে এমন বিয়ে অনেক হয়েছে। বর মারা গেছে স্ত্রী প্র্যাগনেন্ট দেবর বিয়ে করেছে। আরও শত শত কাহিনি/উদাহরণ আছে প্র্যাগনেন্ট অবস্থায় বিয়ের। সুতরাং সামাজিক সে রকম একটা কাহিনিই ধরে নিবেন৷ সাধারণ এ গল্পে ইসলামিক জটিল বিষয় গুলো না জেনে টেনে এনে তর্কাতর্কি করবেন না।

২) এটা গতানুগতিক কোনো রোমান্টিক গল্প ছিল না। রোমান্টিক থৃলার গল্প বলা যায়। যারা প্রতি পর্বে সাসপেন্সের জন্য বিরক্ত হয়েছেন তাদের জন্য করার কিছু নেই। এরকম গল্পে সাসপেন্স থাকবেই।

৩) অনেকেই বলছেন নায়িকা আবির অরন্যের পর কেন সোহানকে বিয়ে করেছে। একজনের বাচ্চা পেটে নিয়ে আরেকজনকে বিয়ে কীভাবে করল। সেক্ষেত্রে বলব যত কঠিন অতীতেই হোক না কেন আমার মনে হয়েছে অতীত কে আকঁড়ে ধরে না থেকে বর্তমানকে সুন্দর করে গ্রহণ করে সামনে এগিয়ে চলায় শ্রেয়। তাই এরকম ইন্ডিং দেওয়া। কারণ ভুল অন্যায় আবির আর অরন্য করেছে সেটার শাস্তি তো একপাক্ষিক ভাবে নায়িকাকে দিতে পারি না। আর ইন্ডিং সব গল্পেই লেখার শুরুতেই ভাবা থাকে। পাঠকের কমেন্টে আমি কখনও ইন্ডিং পরিবর্তন করিনি আর করবও না।

৪) অনেকে ভাবছেন গল্পটাতে ছেলেদের খারাপ বানানো হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্যে বলছি পুরো গল্পটা গভীরভাবে উপলব্ধি করলে বুঝা যাবে যে অরন্য আর আবির চরিত্রের মধ্যে ছেলেদের খারাপ দিক তুলে ধরলেও সোহান চরিত্রের মাধ্যমে ছেলেদের দায়িত্বশীলতা,যোগ্য স্বামী হওয়া,যোগ্য পিতা,যোগ্য ছেলে হওয়ার দিকটা খুব সুণিপুণভাবে ফুটে উঠেছে।

৫) গল্পটাতে অপ্সরা চরিত্রের মাধ্যমে আমি এটাই তুলে ধরতে চেয়েছি৷ জীবনে বাঁধা আসবেই। ক্ষণে ক্ষণে আশার আলো দেখে নিরাশ হতে হবে। হয়তো কেউ পাশে থাকবে না নিজের পরিবারও না। তবে মনোবল হারানো যাবে না৷ একমাত্র দৃঢ় মনোবলেই সুখের ধার প্রান্তে নিয়ে যাবে। তাই স্বাবাভিক কিছু বিষয়ে নিজেকে শেষ না করে জীবনের শেষ অধ্যায় পর্যন্ত গিয়ে দেখুন সমাপ্তিটা কেমন হয়।

পরিশেষে বলব গল্পে অনেক ভুল ত্রুটি রয়েছে সেগুলো ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন৷ বানানের অসংগতি ভাষার সংমিশ্রণ রয়েছে সেগুলো স্বাভাবিক ভাবে নিবেন৷ হয়তো আবারও নতুন কোনো গল্প নিয়ে হাজির হব। সবাই কমেন্ট করে জানাবেন কেমন লাগল।

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here