#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৭
আমি দৌড়ে ভাড়াটা দিয়ে অরন্যের কাছে যেতেই থমকে গেলাম। অরন্য তখন চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। আমি যতই ওর কাছে যাচ্ছিলাম ততই ভেতরটা মুচরে যাচ্ছিল। তবুও নিজেকে সামলে নিলাম। এত বছর পর ওর সাথে এভাবে কথা বলব সেটা কখনও চিন্তাও করি নি। ওর কাছে গিয়েই বলে উঠলাম
– তোমার সাথে আমার কথা আছে।
অরন্য আমার জোরালো কন্ঠ শুনে আমার দিকে তাকাল। অরন্য তাকাতেই যেন আমার কথার জড়তা বাড়তে লাগল। সে চায়ে চুমুক দিয়ে বেশ সাবলীল কন্ঠে বলল
– কী বলতে চাও বলো?
– তুমি বেশ ভালো করেই জানো আমি কী বলতে চাই। কিসের নাটক শুরু করেছো একটু বলবে? আবির তোমার কী হয়? আর কেনই বা অতীতটা সামনে আনতে চাচ্ছ? কী সমস্যা তোমার? সেদিন কোথায় ছিলে যেদিন সব কিছু লুকিয়ে আমাকে ছুরে ফেলে দিছিলে?
অরন্য চুপ হয়ে আছে। আর ঘন ঘন চায়ে চুমুক দিচ্ছে। কী বলবে হয়তো বুঝতে পারছে না। আর এদিকে আমি এক নিঃশ্বাসে সব বলেই যাচ্ছি। এবার অরন্য আমার দিকে তাকিয়ে তার হাতটা দিয়ে থামতে বলল। আমি কথা থামিয়ে চুপ হলাম।সে আমাকে বলল
– অপরাজিতা এত অস্থির হইয়ো না। তোমার মধ্যে অস্থির ভাবটা এখনও কমেনি।
– এ নামে ডাকার অধিকার অনেক আগেই হারিয়েছ। আমি চাইনা তুমি আমায় এ নামে ডাকো।
– এ নামে ডাকার অধিকার হারায়নি। বরং তোমাকে হারিয়েছি।
– এত জোরালো করে বলছো কীভাবে যে অধিকার হারাও নি? তুমি যেদিন সব ছিন্ন করে দিয়েছো সেদিনেই তুমি সব অধিকার হারিয়ে ফেলেছো। এখন কিসের অধিকার ফলাতে চাচ্ছ?
– তুমি হয়তো আমাদের বিয়ের বিষয়টা বেমালুম ভুলে গেছ। তুমি আমার স্ত্রী সেটা ভুলে যেও না। আর তোমাকে এখনও আমি ডিভোর্স দিই নি। তুমিও দাও নি। সব কাগজ পত্র আমার কাছে আছে। একজন স্বামী বর্তমান রেখে কীভাবে কোন মুখে বিয়ে করতে চাইতেছ?
অরন্যের কথা শুনে মন চাচ্ছিল তার গালে কষিয়ে একটা চড় দেই। তবে অরন্য যে খেলা শুরু করেছে সেটার শেষ আমাকেই করতে হবে। রাগের মাথায় তাকে কিছু বললে বিষয়টা হিতে বিপরীত হতে পারে। এ মুহূর্তে অরন্যের মনে কী চলতেছে সেটা জানার সাধ্য আমার নেই। তবে জানার চেষ্টা করা উচিত। আমি হালকা গলায় বললাম
– আমিও চাই তোমার কাছে ফিরে যেতে। আমিও তোমাকে এতদিনে ভুলতে পারি নি৷ আর তুমি জানো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। অরন্য তুমি আর কিছুদিন আগে আসলে এতটা ঝামেলা তো হত না। আবির নামক কোনো বাঁধা আমার জীবনে থাকত না। আমি তো ভেবে নিয়েছিলাম তুমি আর আসবে না। কারণ তুমি তো অন্যত্র বিয়ে করে নিয়েছিলে। কিন্তু তুমি যে আমার জীবনে ফিরে আসতে চাইতেছ সেটা কী তোমার বউ জানে? মানে নাফিসা কী সেটা মেনে নিবে।
– চলো একটু ভেতরের দিকে বসে কথাগুলো বলা যাক। আমি জানি তুমি আমাকে এখনও ভালোবাসো। আর সে ভালোবাসাটা আমি তোমার চোখে এখনও দেখতে পাই বলেই তোমার অতীত সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছি৷ কখনও তোমার সামনে যাওয়ার সাহস পাইনি। যেদিন তোমার মুখোমুখি হলাম সেদিন এমন পরিস্থিতিতে হব চিন্তা করে নি। হয়তো সেদিনেই তোমাকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করার সুযোগ আল্লাহ করে দিছেন। নাহয় তো তোমার সামনে যাওয়ার সাহস আমার হত না।
বলেই দম ছাড়ল অরন্য। অরন্যের কথাটা আন্দাজ করতে পারলেও পুরোপুরি বুঝতে পারছিলাম না। আমি চাপা গলায় বলল
– ঘটনা নাহয় এক জায়গায় বসে শুনা যাবে। এখন একটু শান্ত হও। আবির কেমন আছে?
– আবির ভালো এখন। ওকে বেডে রেখে এসেছি।
– দেরিতে গেলে সমস্যা হবে না তো?
– সমস্যা হবে না।ও এখন ঝুঁকি মুক্ত।আর মোাবইল তো আছে কিছু হলেই কল দিবে।
– তোমার ডিউটি?
– আজকে রাতে ডিউটি, দিনের বেলায় নেই।
– তাহলে চলো মেডিকেলের পাশে শহীদ মিনারটায় বসি।
– চলো যাওয়া যাক।
অবশেষে মনের সকল প্রশ্নের সমাধান আজকে হতে চলল। বেশ প্রশান্তি নিয়ে শহীদ মিনারের দিকে এগুতে লাগলাম। এগুতে এগুতেই পুরনো স্মৃতিতে আবারও ডুব দিলাম।
সেদিন অরন্যকে আমি পাগলের মতো ভালোবাসতাম। সামান্য কথা কাটাকাটি হলেই অরন্যের একটা বদঅভ্যাস ছিল ফোন বন্ধ করে ফেলা। আমি অরন্যের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম ঢাকা মেডিকেলে। অরন্যের সাথে কী নিয়ে যেন ঝগড়া বেঁধে বসে। যার ফলে সে আমাকে রেখে মেডিকেলের ভেতর ঢুকে যায়। এদিকে আমি শহীদ মিনারে বসে আস্তে আস্তে কাঁদতে লাগলাম। রাস্তাঘাট চিনি না বাসায় যাব কী করে সেটা ভাবতে লাগলাম। বেশ কয়েকবার কল দিলাম অরন্যের নম্বরে বারবার বন্ধ বলছিল।অসহায় লাগছিল খুব।সে সাথে অরন্যের উপর অভিমান।সব মিলিয়ে চুপ হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। আধঘন্টা তো হবেই।এবার আর বসে থাকতে ইচ্ছা করছে না।বাসায় যেতে হবে। তবে পথ ঘাট তো চিনি না। শহীদ মিনারের এক কোণে এক ছেলে বসে সিগারেট টানছিল।বেশ ভয় হচ্ছিল তবুও ছেলেটার কাছে গিয়ে বললাম
– এখানে বাস পাওয়া যায় কোথায়? আর এ বাস কী খিলক্ষেত যাবে?
ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলো।বুঝায় যাচ্ছিল ছেলেটা নেশায় ডুবে আছে। আমার তো এদিকে ভয়ে হাত পা কাঁপছিল। কোনো কথা না বাড়িয়ে দৌড়ে রাস্তার পাশে এসে কাঁদতে লাগলাম। এমন সময় কারও হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম পিঠে। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম অরন্য দাঁড়িয়ে আছে। অরন্যকে দেখেই আমার অভিমানটা আরও গাঢ় হলো। রাগে বলে উঠলাম
– ছাড়ো আমায়। একদম কাছে আসবে না। ফেলে গিয়ে মোবাইল বন্ধ করে রেখেছিলে যখন তখন একবারও কী ভেবেছিলে আমার কথা?
– ফেলে রেখে যায় নি। আড়াল থেকে সব দেখছিলাম। কতদূর যেতে পার ভাবছিলাম। এত বোকা একটা মেয়ে। এখন দেখি একটু বেশি পরিমাণ কাঁদছো। তাই আসলাম। একা যেতে দিতাম নাকি। ঠিকেই তোমার পিছু নিতাম। কারণ যত বকা দাও আর রাগ দেখাও আমি তোমায় ছাড়া থাকতে পারব না। বড্ড ভালোবাসি তোমায় অপরাজিতা।
আমি মুহূর্তেই গলে গেলাম। মুখটা ভার করে বললাম
– রাগ দেখাও বকা দাও যা ইচ্ছা করো ফোন বন্ধ করবা না বলো।
– ফোন তো আর ইচ্ছা করে বন্ধ করি না।ফোন বন্ধ করলেই তোমার ত্যাড়ামো কমে। এর আগে না।এবার চোখটা মুছো। নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেলেছে।
বলেই টিস্যু হাতে নিয়ে চোখ চেপে চেপে মুছতে লাগল। এমন সময় অরন্য ডেকে বলল
– অপরাজিতা। কী ভাবছো? বসো এখানে?
সিঁড়িতে বসে ঠিক পাশেই হাতে ইশারা দিয়ে বসতে বলল। অভিমানঘন মধুময় অতীত থেকে বর্তমানের বাস্তবতার সম্মুখীন হলাম পুনরায়। অরন্যের ঠিক পাশেই বসলাম। অরন্য হালকা গলায় বলল
– মনে আছে ঐদিনের কথা যেদিন বাসায় যাওয়ার জন্য কোন বাসে যেতে হয় বুঝতে না পেরে একা একা ঐ জায়গাটায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলে।
অরন্যের কথা শুনে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। আমার মতো সে ও সেই অতীতে ডুব দিয়েছিল। তাহলে কী আমার মনে যা চলছে অরন্যও সেটা ভাবছে নাকি এটা তার মিথ্যা ছলনা মিথ্যা নাটক। আমি কোনো কথা না বলেই অরন্যের পাশে বসলাম। এবার তীব্র কন্ঠে অরন্যের দিকে প্রশ্ন ছুরে বললাম
– তোমার স্ত্রী নাফিসা কোথায়? আর আবির কেন তোমার স্ত্রী এর ব্যপারে কিছু জানে না?
অরন্য দম নিল। চোখ গুলো তার ছলছল করতে লাগল। আমার দিকে তাকাল তারপর অসহায় গলায় বলল
– তুমি আমাকে বিশ্বাস করো কতটা?
সহজ গলায় জবাব দিলাম
– একদম বিশ্বাস করি না। বিশ্বাসের জায়গাটা অনেক আগেই নষ্ট করে দিয়েছো।
– বিশ্বাস না করলে ও এ কথাগুলো শুনে তোমার বিশ্বাস হবে। প্রয়োজনে যাচাই করে নিও।
– কী কথা বলো।
অরন্য চুপ। সে চুপ হয়ে একা একা কথাগুলো স্থিত গলায় আওড়াতে লাগল। হয়তো কথাগুলো সে গুছাচ্ছে। তারপর
#প্রাক্তন
#লেখিকা- শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৮
হয়তো কথাগুলো সে গুছাচ্ছে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল
– নাফিসার সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে আড়াই বছর পার হয়েছে। বিয়ের এক বছর পরেই ডিভোর্স হয়ে যায়।
আমি অবাক হয়ে গেলাম অরন্যের কথা শুনে।নাফিসার সাথে যদি তার ডিভোর্সেই হয়ে থাকে তাহলে এক বছর আগে কেন ছবি আপলোড করেছে। কিছুটা সংশয় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
– তেমার যদি ডিভোর্সেই হয় তাহলে এক বছর আগে কেন নাফিসার সাথে ছবি আপলোড করেছো? কারণটা কী জানতে পারি?
– সে কারণ আমিও জানি না। আমার আগের আইডিটা বিয়ের সাতদিনের মাথায় নাফিসাকে পাসওয়ার্ড দিয়ে দিছিলাম। কারণ নাফিসা তোমার ব্যপারে জেনেই আমাকে বিয়ে করেছিল। সন্দেহ ছিল ওর আমার প্রতি তাই পাসওয়ার্ড দিয়ে দিছিলাম। ডিভোর্সের পর ও আইডিটা পুরোপুরি সব পরিবর্তন করে যার দরুণ আমি আইডিতে ঢুকতে পারি না। আইডিটা দিয়েই নাফিসা ডিভোর্সের পর আমার উপর মিথ্যা অপবাদ চাপায়।
অরন্যের কথাগুলো বুঝতে পারছিলাম না। বরাবরেই কথার বেড়াজালে আটকে পড়ছিলাম। তাই কিছুটা প্রশস্ত গলায় বললাম
– প্রথম থেকে কাহিনি বলো।
অরন্য কাহিনি বলা শুরু করলো। অরন্যের কাহিনি শুনে বারবার মনে হচ্ছিল আমার অতীতের গ্লানি মাখা স্মৃতিগুলো সামনে ভাসছে। অরন্য চাপা গলায় বলল
– আমি জানি না আমার কী হয়েছিল কেন এই ভিমরতি ধরেছিল। আমি তোমাকে ভালোবাসাতাম না এটা ভুল কথা। তোমাকে আমি ভালোবাসতাম তবে সেদিন আমি লোভে পড়ে যাই। তোমার সাথে বিয়ে হওয়ার আগে আমাকে আমার বন্ধু শরীফ নাফিসাকে দেখতে নিয়ে গেছিল। নাফিসা দেখতেও সুন্দর ছিল। ডাক্তার ছিল।
নাফিসাকে দেখে আসার পর শরীফ বলল
– অরন্য…অপ্সরা তোর জন্য কখনও পারফেক্ট না।অপ্সরা দেখতে শুনতে সুন্দর এর বাইরে কিছু নেই ওর।
আমি হালকা গলায় বললাম
– অপ্সরার এমনিতে গুণ আছে। ও অনেক কেয়ারিং, গুছালো। সবচেয়ে বড় কথা ও আমার কথা শুনে। আর চারিত্রিক কোনো সমস্যা ওর নেই। সেই ছোট থেকে ওকে চিনি। বয়স যখন ওর তেরো, তখন ভালোবাসি শব্দটা বলতেও পারত না এর আগেই ও হেসে দিত। সেই থেকে আমাদের ভালোবাসার শুরু। অপ্সরাকে ঠকানো ঠিক হবে না। আর অপ্সরা ভালো একটা সাবজেক্ট নিয়ে পড়তেছে। ও একদিন ভালো করতে পারবে। ও ঘরের সব কাজ করে। গুণ আছে মাশাআল্লাহ। ওর রান্নার হাত ও বেশ ভালো।
– দেখ আমি তোর বন্ধু তোর খারাপ কখনও চাইব না নিশ্চয়। অপ্সরা ভালো তা ঠিক আছে। তবে তোর যোগ্য না। ভালো সাবজেক্টে পড়লেও ভালো কোনো ভার্সিটিতে পড়ে না। আর ঘরের কাজ সেটা সব মেয়েই পারে। নাফিসাকে যতদূর চিনি সেও সব কাজ পারে। নাফিসা ডাক্তার। দেখতেও সুন্দর। আর মেডিকেল, ননমেডিকেল বড় একটা ফ্যাক্ট। তোর ব্যস্ততা অপ্সরা বুঝবে না। ডাক্তারদের জীবন সম্পর্কে তার ধারণা কম। আর নাফিসার সাথে তোর বন্ডিং ও ভালো হবে। দুজন একসাথে চাকুরি করবি। সমাজে একটা পরিচিতিও থাকবে। সবশেষে তোরা ভালো থাকবি। ভেবে দেখতে পারিস।
সেদিন শরীফের কথাগুলো মনে গেঁথে গেছিল। বাসায় আসলাম। আসার পর তোমার কল পেলাম। কেন জানি না সেদিন তোমাকে মনে হচ্ছিল আমার পারফেক্ট না। তোমার কথাবার্তা সেদিন কেন জানি না আমার কাছে মনে হচ্ছিল ইম্যাচুউরের মতো। তোমার পাগলামি গুলো ভালো লাগলেও সেদিন খুব বিরক্ত লাগছিল। তবুও তোমার সাথে হাসিমুখে কথা বলছিলাম। বেশ দুটানা নিয়ে ছিলাম। মাঝে মাঝে তোমার সাথে কথা বলতাম ভালো করে আবার তোমাকে উল্টা পাল্টা বলতাম। তুমি একবার আমার কথা শুনে কাঁদতে আবার হাসতে। আমি তোমাকে এ হাসি, কান্নার খেলায় মাতিয়ে রাখতাম এটা আমি মানতে নারাজ ছিলাম। আমার ধারণা ছিল তুমি সাইকো তাই একবার হাসো একবার কাঁদো। আস্তে আস্তে তোমার দূর্বলতা প্রকাশ পেতে থাকে আর আমার তোমার প্রতি আগ্রহ কমতে থাকে। তবুও দায়িত্ব বলে কথা ছিল,এতদিনের সম্পর্ক নাও করতে পারছিলাম না। এর মধ্যে তোমাকে বিয়েও করেছিলাম। সব মিলিয়ে তোমাকে ছাড়তেও পারছিলাম না। তাই তোমার আর আমার বিয়ের বিষয়টা পারিবারিকভাবে এগুতে লাগল কিন্তু আমি তাতে শান্তি পাচ্ছিলাম না। তোমাকে দেখতাম অনেক খুশি। বিয়েতে কী পরবে, কী করবে সবকিছু বেশ আনন্দ নিয়ে বলছিলে। আমিও তোমার সাথে বেশ নাটক করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু মনে মনে বারবার মনে হচ্ছিল তুমি আমার পারফেক্ট না। তোমার থেকে নাফিসা বেস্ট। আমি অবশেষে কী করব বুঝতে পারছিলাম না। তোমার দূর্বলতা দেখে কেন জানি না আমার আগ্রহ আরও ফিকে হয়ে গেল।
বিয়ের ঠিক আগের দিন মনে হলো আমার পক্ষে তোমাকে বিয়ে করা উচিত হবে না। মানুষের জীবনে কত কিছুই ঘটে, লুকিয়ে বিয়ের কথা কেউ জানে না সুতরাং সেটা তে তো আর কিছু আসবে যাবে না। বিয়ের আগের দিন মনে হয়েছিল তোমার সাথে আমার বিয়ে হলে আমি সারাজীবন আফসোস করব এটা ভেবে যে আমি এর চেয়ে ভালো ডিজার্ভ করতাম। শরীফকে বলার পরও সে ও বুঝাল। সবমিলিয়ে আমি লোভে পড়ে গেলাম। বিয়েটা ভেঙ্গে দিলাম।
পরিবারকে বুঝালাম আমার ভুল হয়ে গেছে ক্ষমা করে দাও। আমি অপ্সরাকে বিয়ে করতে চাই না।পরিবারও আমার মতো যোগ্যতার লোভে অন্ধ ছিল। আমার কথা মেনে নিল। আমিও সাহস পেলাম। যার দরুণ বিয়ে ভাঙ্গতে আমার একদম বিবেকে আটকায় নি।
তার একমাস পর নাফিসাকে বিয়ে করি। নাফিসাকে বিয়ে করার পর তিনমাস বেশ ভালোই ছিলাম। তিনমাস পরেই সব এলোমেলো হতে লাগল। সংসারে অশান্তি শুরু হলো। তখন বুঝতে পরেছিলাম তুমি আমার কী ছিলে। নাফিসার অন্যত্র সম্পর্ক বের হলো। সেও আমাকে বিয়ে করেছিল পরিবারের চাপে পড়ে। আস্তে আস্তে আমাদের সম্পর্কের ভাঙ্গন ধরে। প্রতিদিন অশান্তি, প্রতিদিন ঝামেলা। সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম টাকা পয়সা দিয়ে সংসার সুখের হয় না। সংসার সুখের হয় একজন মানুষের ভালোবাসায়।
তবুও ওকে মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। তোমাকে এত ঝামেলা করে বাদ দিয়েছি। এখন সংসার নষ্ট হলে সবাই হাসাহাসি করবে। সেটা ভেবে নাফিসাকে বুঝাতাম। সে বুঝেনি। আমাকে ছাড়বে কীভাবে সেটার মূখ্য কারণ খুঁজতেছিল। আর তখনই ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্ট দিয়ে আমার ইমেজ নষ্ট করত। বুঝাত আমি নাফিসাকে চাই না,আমার অনেক সমস্যা আছে,আমি পাগল। এসব কারণকে কেন্দ্র করে নাফিসা এক পর্যায়ে পরিবারকে বলে আমাকে ডিভোর্স দেয়। মিথ্যা কতগুলো অপবাদ মাথায় নিয়েছিলাম। সবার সামনে পাগল প্রামাণিত হয়েছিলাম। এক বছর পরেই আমাদের সম্পর্কটা ভেঙ্গে যায়। তোমাকে দেওয়া প্রতিটা আঘাত আল্লাহ আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম তুমি আমার কী ছিলে। কিন্তু সাহস করে তোমার সামনে যাওয়ার সুযোগ হয়নি।
অরন্য কাঁদছে। অরন্যের কান্না দেখে আমার মোটেও কষ্ট হচ্ছে না। কারণ অরন্যের এটা প্রাপ্য ছিল। আমি অরন্যকে হালকা গলায় বললাম
– চার বছর আগের একটা কাহিনি কী তোমার মনে আছে?
অরন্য চাপা গলায় বলল
– কোনটা?
আমি আবার অতীতে ডুব দিয়ে অরন্যকে বলতে লাগলাম। সেদিন বিয়ে ভাঙ্গার খবরটা আমার কানে আসে। আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করব। বাসা থেকে হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে অরন্যকে একরকম জোর করে ধরে আমার বাসায় আনলাম। এর কিছুক্ষণ পর ওর পরিবারও আসলো। দুই পরিবার আলোচনা করতে লাগল বিষয়টা। তাদের একটা কথায় আমি পাগল, আমার মতো পাগল মেয়েকে ঘরের বউ করবে না। আর অরন্যও এমন পাগল মেয়ে বিয়ে করবে না।তবে আমার পাগলামি কী ছিল আমি নিজেও জানি না। অরন্যের প্রতি থাকা ভালোবাসা টা কী আমার সত্যিই পাগলামি ছিল। অরন্যের কাছে গিয়ে বললাম
– শুধু শুধু কষ্ট দিয়ে আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি যদি পাগলামি করেও থাকি তোমাকে ভালোবেসে করেছি। এত বড় অন্যায় আমার সাথে করো না।
অরন্য চুপ কোনো কথায় বলছিল না। হুট করে টেবিলে থাকা ফল কাটার ছুরি নিয়ে সবার আড়াল করে হাতের একটু অংশ কেটে চিল্লায়ে বলল
– এ মেয়ে এখনি আমাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করছে এ পাগল মেয়েকে বিয়ে করলে তো আমাকে বিয়ের পর খুন করে ফেলবে।
আমি অরন্যের কথা শুনে অরন্যের পায়ে ঝাঁপটে ধরে বললাম
– আমাকে ছেড়ে যেও না আমি পাগল না। শুধু শুধু মিথ্যা বলো না।
সবাই আমাকে টানছে ওর পা ছাড়ার জন্য।আর আমি পা টা ধরেই ছিলাম। বাবা,মা ভাই বোন যে আছে সেটা ভুলে গিয়ে শুধু ওর পা ধরেই ছিলাম। মনে হচ্ছিল ওর পা ছেড়ে দিলে আমি ওকে হারিয়ে ফেলব। তাই বেশ জোর করে পা টা ধরে ছিলাম। আর সে ও আমাকে পাগল বলার সুযোগটা আরও পেয়ে গেল। একদিকে পরিবার ওর পা ছাড়ছি না বলে মারতেছে।আরেক দিকে আমি ওর পা ধরে শুয়ে আছি। আমার মা কাঁদতে লাগল। কেঁদে কেঁদে ওরে বলল
– বাবারে আমিও একজন মা। আমার মেয়ের সাথে যা অন্যায় করছো সব তুমি ফিরে পাবে। অভিশাপ দিতে হয় না। তবে কষ্টের দাবদাহ ঠিকেই আল্লাহর কাছে পৌঁছে।
বলেই আমার মা আমাকে টানতে লাগল ছুটানোর জন্য। আমার বড় ভাই আমাকে পিটাতে লাগল পা ছাড়ার জন্য। আর আমি অবুঝের মতো ওর পা টা আকঁড়ে ধরেই ছিলাম। একটা সময় আমার বড় ভাই না পেরে আমার গলা চেপে ধরল। আমি নিস্তেজ হয়ে ওর পা ছেড়ে দিলাম। ও আমাকে বুকে লাথি মেরে চলে গিয়েছিল।
ইশ কত কষ্টটায় না পেয়েছিলাম। অরন্যকে ঘটনা টা মনে করিয়ে দিয়ে বললাম
– নাফিসা তোমাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিল কেন জানো? কারণ এটাই তোমার জন্য নির্ধারণ ছিল। সেদিন বিনা কারণে আমি আর আমার পরিবার অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম। আমাকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করেছিল। একটা মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া স্বাভাবিক কোনো বিষয় না।অনেক কষ্ট সেদিন তুমি দিয়েছো।আমি আল্লাহকে সবসময় বলতাম তোমার কর্মফল যেন তুমি পাও৷ একটা সময় তোমাকে ভুলে গিয়েছি তোমাকে শাস্তি দেবার কথাও বলা বন্ধ করে দিয়েছি। আমি ভুলে গেলেও সেদিন আমার রব ভুলে নি। আজকে যা হয়েছে তোমার সাথে সেটা তোমার কর্মফল।সেদিন তুমি চাপিয়েছিলে আমার উপর মিথ্যা অপবাদ এরপর নাফিসা চাপিয়েছে তোমার উপর। আর এখন নাফিসার মনে কী চলছে সেটা সে জানে। কেন সে আবার তোমার আর ওর পিক আপলোড দিচ্ছে সেই ভালো জানে। তবে আজকে আমার জীবনে ফিরে আসার কথা বলো না। কারণ আমি আবিরকে পাগলের মতো ভালো না বাসলেও সম্মান করি।
কেন জানো?
অরন্যের দৃষ্টি তখন নীচের দিকে। দৃষ্টি নীচের দিক থেকে সরিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি পুনরায় বললাম
– কারণ এই ছেলেটা আমার যোগ্যতা বা সৌন্দর্য দেখে ভালোবাসে নি। আমার মাথার দিকে তাকিয়ে দেখো চিন্তা করতে করতে চুল পড়ে তালু ফাঁকা হয়ে আছে। চোখের নীচে না ঘুমাতে ঘুমাতে দাগ পড়ে গেছে। চামড়াগুলো আগের মতো সজীব না নির্জীব হয়ে আছে। মুখে ব্রণের দাগে লেপ্টে আছে। আবির যেদিন জিজ্ঞেস করেছিল আমি কী করি। বলেছিলাম আমি বেকার। তবুও আবির আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল। কারণ তার চোখে আমাকে আবদ্ধ করেছিল। এ মানুষটাকে কষ্ট দিয়ে তোমার কাছে ফেরা সম্ভব না৷ আর শুনো অতীত যাইহোক আমি ভুলে গেছি। তুমি যা পেয়েছো তোমার কর্মফল পেয়েছো।
আজকে যদি তুমি আর নাফিসা সুখে থাকতে তাহলে ঠিকেই আমার কথা তোমার মনে পড়ত না।তুমি ঠিকেই আমাকে ইমপারফেক্ট ভাবতে। আজকে তুমি সুখী নও বলেই আমাকে অনুভব করতে পেরেছো। আমি কখনও আমার জীবনে এমন মানুষকে চাই না যে তার সুখের সময়ে ভুলে গিয়ে অসময়ে আমাকে খুঁজে মরে। তুমি নিজেও জানো না তোমার এ সামান্য লোভ আমার জীবনটাকে কতটা যন্ত্রণায় ফেলে দিছিল। আজকে আমার সব আছে সেদিন কিছুই ছিল না। কিন্তু আমি তোমাকে সেদিন পাগলের মতো ভালোবেসেছিলাম।
আমার জন্যও তো কম পাত্র আসেনি৷ তারা তোমার থেকে কম যোগ্য ছিল না। আমি তো লোভে পড়েনি। আমি তো তাদের জন্য তোমাকে বাদ দিই নি৷ তবে তুমি কেন বাদ দিয়েছিলে। কারণ তোমার ভালোবাসায় খাত আছে যেটা আমার ভালোবাসায় ছিল না। তুমি কোনোদিন আমাকে ভালোবাসতে পারো নি। এখনও যেটা আছে সেটা শুধু মোহ, মায়া,।
কথাটা বলেই আমি উঠে দাঁড়ালাম। উঠে দাঁড়াতেই অরন্য এমন একটা কাজ করে বসলো যেটা আমি আশায় করিনি। অরন্যকে এতটা অদ্ভুত ভাবে আবিষ্কার করব কল্পনাও করেনি।
চলবে
[কপি করা নিষেধ।চাইলে শেয়ার করে পাশে থাকতে পারেন]
[কালকে গল্পের নতুন মোড়,নতুন জট ছুটবে, সেই সাথে আরেকটা কাহিনির শুরু হবে,গল্পটা আরও রহস্যে ঢুকে যাবে। পরীক্ষা চলে তাই পর্ব ছোট।
কপি করা নিষেধ চাইলো শেয়ার করে পাশে থাকতে পারেন]