প্রাণস্পন্দন পর্ব ৩৬+৩৭

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৩৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

নিজের ঘরে বসে আছেন রাশেদ। ডোর বেলের তীক্ষ্ম আওয়াজ কর্ণকুহর হতেই সপ্রতিভ হয় সে। দরজা খুলতেই বিষম খায়। নিষ্প্রাণ দাঁড়িয়ে আছে। অমায়িক চাহনি। ফাঁকা ঢোগ গিলেন রাশেদ। জড়ানো গলায় বললেন—

“আআআপনি?”

নিষ্প্রাণ মুক্ত হাসল। প্রফুল্ল গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে—

“কেমন আছেন?”

পূনরায় সেই ভীত স্বর।

“জিইইইজি ভাআলো। আআপনি এখানে?”

নিষ্প্রাণ আবেগী গলায় বলল—

“আপনাকে দেখতে ইচ্ছে হলো। এক শহরে থাকা সত্ত্বেও কখনো ইচ্ছে হয়নি। আজ বড্ড ইচ্ছে হলো আপনাকে দেখার। ভেতরে আসতে পারি?”

নিষ্প্রাণের প্রতিটি সরল উক্তি রাশেদের কলিজা খামচে ধরছে। বুকের ভেতর অজ্ঞাত ভয়ে চিনচিন করছে। ঘামতে শুরু করল রাশেদ। তার দেহপিঞ্জরে তরতর করে তপ্ত আভা ছড়াচ্ছে। এতকিছু নীরবে ঘটে যাচ্ছে তার সাথে যার কারণে নিষ্প্রাণকে ভেতরে আসার অনুমতি দেওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছেন সে। তার অনুমতির অপেক্ষা করল না নিষ্প্রাণ। ভেতরে ঢুকে কাউচে গিয়ে বসল।

রাশেদের জন্মস্থান পাকিস্তানের করাচি। যেখানে আদি নিবাস ছিল নিষ্প্রাণের দাদুর। কয়েকবছর আগে করাচি গিয়েছিলেন রাজন শিকদার। তার পূর্বপুরুষদের জমিজমা, ব্যবসায়, প্রতিপত্তি ভোগদখল করছিল অন্য কেউ। সেখানেই পরিচয় হয় রাশেদের সাথে। অনেক সাহায্য করেছিলেন রাশেদ রাজন শিকদারকে। সদ্য বিয়ে করেছিলেন তিনি তখন। নিজের স্ত্রীকে নিয়ে পাড়ি জমান বাংলাদেশে। রাজন শিকদারের ছায়াতলে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন।

নিষ্প্রাণকে দেখে রান্না ঘরে থাকা রাশেদের স্ত্রী সৈয়দা সম্পূর্ণ মুখ ঢেকে ফেললেন। পূর্ণ পর্দা করেন তিনি। নিষ্প্রাণ একবার তাকিয়ে চোখ ফেরাল। টুকটুক করে লাগাতার শুষ্ক ঢোক গিলছে রাশেদ। রাশেদের তিন বছরের মেয়ে রুশি দৌড়ে বাবার কাছে এলো। নিষ্প্রাণ মুক্ত ঝরা হাসল। রুশির দিকে তাকিয়ে বলল—

“কী নাম তোমার?”

রুশি ফিক করে হেসে আধো আধো বোলে বলল–

“রুছি।”

নিষ্প্রাণ চোখে হাসে। নরম সুরে বলল—

“এদিকে এসো।”

রুশি বাবার দিকে তাকাল। রাশেদ ইশারা করতেই চট করেই নিষ্প্রাণের পাশে এসে দাঁড়াল। বিগলিত হেসে রুশিকে ক্রোড়ে তুলে নিল নিষ্প্রাণ। ভাবাবেশ ছাড়াই ড্রয়িং রুমের সাথে লাগোয়া খোলা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।

কৃষ্ণগহ্বরে চন্দ্রের ছলাকলা চলছে। মিটিমিটি তারারা লুকোচুরি খেলছে। এই জ্বলছে তো এই নিভে যাচ্ছে। ভেসে যাওয়া কৃষ্ণ কাদম্বিনী খানিক পর পর আড়াল করছে চাঁদেশ্বরীকে। বহ্নিসখে মৃদু দোল। লম্বা শ্বাস নেয় নিষ্প্রাণ। ছয়তলা থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল। তারপর নিগূঢ় হাসল। তার হাসিতে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল রাশেদের। নিষ্প্রাণ অতি স্বাভাবিক গলায় বলল—

“এখান থেকে পড়ে গেলে বেঁচে যাব তো আমি?”

গা গুলিয়ে উঠল রাশেদের। ভীতসন্ত্রস্ত চোখে তাকিয়ে অসহায় গলায় বলল—

“কী বলছেন স্যার?”

“বুঝতে পারেননি?”

“জনাব আমাকে যা বলেছে আমি তাই করেছি স্যার। এতে আমার কী দোষ?”

নিষ্প্রাণ টুপ করে একটা চুমু বসাল রুশির ফুলকো গালে। মেয়েটার গালগুলো কী নরম! একদম হাওয়াই মিঠাই!
রুশিকে রাশেদের কোলে দিলো নিষ্প্রাণ। প্রাণ ফিরে পেল রাশেদ। মেয়ের চোখে, মুখে, গালে অজস্র ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। নিষ্প্রাণ অতরল হাসে। বারান্দার রেলিং এ হাতের ভর দিয়ে হালকা ঝুঁকে দাঁড়ায়। অনুপলেই তার মুখের ধরণ পরিবর্তন হয়। চোয়াল শক্ত করে। দাঁতে দাঁত চেপে ধরে। অশিথিল গলায় বলল—

“দাদুকে বলবেন তিনি যেন আর বাড়াবাড়ি না করে। তারার সাথে যা হয়েছে তার জন্যও কিন্তু সেও দায়ী। ধ্রুবতারা দিকে হাত বাড়ালে আমি আবার সেই দশ বছরের নিষ্প্রাণ হতে বাধ্য হবো। তাকে বলে দিবেন। আসি।”

নিষ্প্রাণ নিজের কথা শেষ করে দ্রুত প্রস্থান করে সেই ঘর। তড়িঘড়ি করে ফোন হাতে কল করে রাশেদ। রাজন শিকদার বিরক্ত হলেন। এতরাতে ফোন করায়।
তাকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন না রাশেদ। ভয়ে জড়োসড়ো গলায় অনর্গল বললেন—

“জনাব, নিষ্প্রাণ এসেছিলেন। তিনি আপনাকে সাবধান হতে বলেছে। কোনো এক তারার কথা বললেন তিনি! বলেছেন তারার সাথে যা হয়েছে তার জন্য আপনিও দায়ী। ধ্রুবতারার দিকে হাত বাড়াবেন না। না হলে সে দশ বছর বয়সী নিষ্প্রাণ হতে বাধ্য হবে।”

রাজন শিকদার গরগর করে উঠলেন। কৌতূহল কমেনি রাশেদের। ভয়ে কেঁপে যাওয়া কন্ঠেই প্রশ্ন করল—

“তারা কে ছিল জনাব? কী হয়েছিল তার সাথে?”

রাজন শিকদার অধৈর্য হয়ে লাইন কেটে দিলেন। রাশেদ ভড়কে যায়। দাদা, নাতির এই খেল সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না।
,
,
,
মোটা রেইনট্রির বেদির উপর বসে আছে নিষ্প্রাণ। তার পাশেই আয়েন্দ্রি। নির্জীব চোখে চেয়ে আছে মাঠের ধূলিকণায়। রৌদ্র তাপে তাপিত ধূলিকণা মিটমিট করে চাইছে। তাতে থাকা স্বচ্ছ বালি কাঁচের মতো চিকচিক করছে।
মৌনতা কাটায় নিষ্প্রাণ। ঠান্ডা স্বরে বলল—

“চুপ করে আছিস কেন?”

আয়েন্দ্রি কথা বলল না। বারকয়েক নাক টেনে নিল। বিস্তর করল চাহনি। ঝরঝরে বালিতে একদল পিঁপড়া হেঁটে যাচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে পরিশ্রমী প্রাণী পিঁপড়া!

নিষ্প্রাণ তরল গলায় বলল—

“এত ভাবছিস কেন? বললাম তো সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“যদি না হয়?”

আয়েন্দ্রির আরেকটু পাশ ঘেঁষে বসল নিষ্প্রাণ। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল—

“তাহলে চল, সেদিন যা তুই শুরু করেছিলি তা আজ আমি কমপ্লিট করি!”

লজ্জায় গাল দুটো ফুলে ওঠে আয়েন্দ্রির! চোখের পাল্লা ঝাঁকিয়ে নিষ্প্রাণের দিকে তাকাতেই তার চোখের দুষ্ট চাহনি যেন দংশন করল আয়েন্দ্রিকে! আয়েন্দ্রি লাজুক গলায় বলল—

“সর এখান থেকে।”

গা দুলিয়ে হাসে নিষ্প্রাণ। একটু জোরে বাতাস বইতেই আয়েন্দ্রির ক’গাছি চুল উড়ে গিয়ে নিষ্প্রাণের মুখে ঢুকে পড়ে। নিষ্প্রাণের নজর থামে দৌড়ে আসা তৃণার দিকে। তাদের দুইজনের সামনে এসে ব্যগ্র গলায় বলল—

“সারক স্যার তোকে ডাকছে। তাড়াতাড়ি চল।”

দুইবার পলক ফেলে আয়েন্দ্রি। ছোট্ট শ্বাস ফেলে অনায়তন গলায় বলল—

“কেন?”

“জানি না তো। তুই চল। স্যার অপেক্ষা করছেন।”

আয়েন্দ্রি স্নেহার্দ্র চোখে তাকায় নিষ্প্রাণের দিকে। মুক্ত গলায় বলল—

“তুই বস, আমি আসছি।”

নিষ্প্রাণ দৃঢ় হয়ে রইল। কোনো কথা বলল না। আয়েন্দ্রি ছোট্ট ছোট্ট কদম ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। নিষ্প্রাণের ধারাল চাহনি।
,
,
,
“কেমন আছো আয়েন্দ্রি?”

“ভালো। আপনি কেমন আছেন স্যার?”

আয়েন্দ্রির করা প্রশ্নে মুচকি হাসল সারক। সারকের চোখের ভারী চশমাটা নড়ে উঠল তাতে। ভরাট কন্ঠে বলল—

“ভালো। ধন্যবাদ তোমাকে। প্রোগ্রামের জন্য রাজি হয়েছ। আর ম্যাম তোমার প্রশংসাও করেছে।”

“আ…।”

চকিতে ফোন বেজে ওঠে আয়েন্দ্রির। বিব্রত হয় সে। নিষ্প্রাণের নাম্বার দেখে একটু অবাকও হয়। রিসিভ করে হ্যালো বলতেই লাইন কেটে দেয় নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি অপ্রস্তুত চোখে চাইল সারকের দিকে। সারকের নিমগ্ন দৃষ্টি আয়েন্দ্রির দিকে। আয়েন্দ্রি যখনি আবার কিছু বলতে যাবে পূনরায় কল করে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির এবার খুব রাগ হয়। ছেলেটা এমন করে কেন!

“জাস্ট অ্যা মিনিট স্যার। আমি আসছি।”

আয়ন্দ্রি টিচার্স রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখে নিষ্প্রাণ দাঁড়িয়ে আছে। তার অধরে বিশ্ব জয়ের হাসি।লম্বা, চওড়া ছেলেটাকে ইচ্ছে করে ঠাটিয়ে এক চড় মারতে!
কিন্তু পারল না। নিষ্প্রাণের সামনে গিয়ে বলল—

“কী শুরু করেছিস তুই? পাগল হয়েছিস?”

করিডোরের দুই পাশে চোখ বোলাল নিষ্প্রাণ। চট করেই একদম আয়েন্দ্রির মুখের সামনে চলে আসে। আয়েন্দ্রি চোখ বুজে ফেলে। বাঁশের পাতার মতো তিরতির করে কাঁপছে তার পাতলা ওষ্ঠাধর। আর সেই তিল! নিষ্প্রাণের ইচ্ছে করছে লুফে নিতে সেই ঠোঁট জোড়া। নেবে সে। এতে শুধু তারই অধিকার। কিন্তু এখন নয়। আয়েন্দ্রি এক চোখ খুলে। এরপর ভয়ে ভয়ে আরেকচোখ। নিষ্প্রান বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। আয়েন্দ্রির এই বেহাল দশা দেখে প্রাণখোলা হাসে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রি নাক, মুখ কুঁচকে হাঁটা ধরে। পেছন থেকে তার হাত টেনে ধরে নিষ্প্রাণ। দুষ্ট হাসি দিয়ে বলল—

“কোথায় যাচ্ছিস?”

“জাহান্নামে।”

“তাহলে আমাকেও সাথে নিয়ে চল।”
#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৩৭
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

রেস্তোরাঁর ছাদে আধুনিকতার ছোঁয়ার বদলে ছনের চাল। চারপাশে ইট, পাথরের পরিবর্তে আছে বাঁশ আর কঞ্চি দিয়ে দাঁড় করানো বেড়া। চেয়ার, টেবিলগুলোও বেতের তৈরি। সন্ধ্যার সাঁঝবাতি জ্বলে উঠেছে অনেক আগেই। ধূসর আকাশ এখন নিকষ তমাসায় সমাহিত। ঘুটঘুটে তমসার চাদোঁয়া ভেদ করে উঁকি দিয়েছে চন্দ্র। তার আশেপাশের রূপালি আভার বলয়ে কেটে যায় অমারজনী। কুচি কুচি অসিত অভ্র অনুপল পরপর ঢেকে দিচ্ছে চাঁদকে। প্রভঞ্জনের গাঢ় মায়ায় বয়ে চলা অভ্র ওই চাঁদকে আড়াল করতে পারে না।

টেবিলের মাঝখানে একটা হ্যারিকেন জ্বালানো। ছনের ঘরটার চারকোনায় চারটা ম্রিয়মান হলুদ বাতি। যার ক্ষীণ আলোয় সবকিছু আবছা আবছা। হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোতো আয়েন্দ্রির নিমগ্ন আননের চিন্তার ভাঁজ ধরা দিচ্ছে সামনে বসা সুদর্শন পুরুষটির চোখে। ছেলেটির লম্বাটে চেহেরায় মায়াময় ভাব। তীক্ষ্ম চোখ জোড়া। ছেলেটির দিকে বেশ সময় পর মুখ তুলে চাইল আয়েন্দ্রি। আহত গলায় বলল—

“প্লিজ, আপনি এই বিয়েটা ভেঙে দিন। বাবাকে গিয়ে বলুন আপনি বিয়ে করবেন না।”

রোমান বিগলিত হাসল। অনুচ্চ গলায় বলল—

“আপনার আরো আগে বলা উচিত ছিল এসব।”

আয়েন্দ্রি ভয় জড়িত গলায় বলল—

“দেখুন, সবকিছু এত দ্রুত ঘটে গেছে যে আমি সময়-ই পাইনি। প্লিজ, আপনি বাবাকে বলুন আপনি বিয়েটা করছেন না।”

“এতে আমার লাভ?”

ভ্রু কুঁচকায় আয়েন্দ্রি। আবেশিত গলায় বলল—

” আমি প্রাণকে ভালোবাসি। ও আমাকে ভালোবাসে। ও বাবার কাছে সময় চেয়েছিল। আপনি বিয়েটা ভেঙে দিলে ও আর কিছুদিন সময় পাবে বাবাকে বোঝাতে। প্লিজ রোমান।”

রোমান মুচকি হাসল। নম্র গলায় বলল—

“তাহলে বলুন তো কী বলে বিয়েটা ভাঙব আমি?”

আয়েন্দ্রির চোখ, মুখ মুহুর্তেই চকচক করে ওঠে। চটপটে গলায় বলল—

” আপনি বাবাকে বলবেন আমাকে আপনার পছন্দ নয়।”

গা দুলিয়ে হেসে ওঠে রোমান। আয়েন্দ্রি বিব্রত হয়। উসখুস চোখে চেয়ে বলল—

“হাসছেন কেন?”

রোমান জোরপূর্বক হাসি থামায়। মৃদু গলায় বলল—

“আপনাকে প্রথম দেখায় আমার পছন্দ হয়েছে। আমি নিজে আমার মামা, মামীকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তা পাঠিয়েছি। প্রথম দেখাতেই আমাদের বিয়ের কথা ভেবে নিয়েছে। ইভেন আমি তো আমাদের বাচ্চাকাচ্চাদের নামও ঠিক করে ফেলেছি।”

আয়েন্দ্রি অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে আছে। বলে কী লোকটা!
প্রফুল্ল হাসল রোমান। ক্ষণপল পরেই বিষণ্ণ চোখে দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে বলল—

“আচ্ছা। আমি কথা বলছি আপনার বাবার সাথে।”

আয়েন্দ্রি যেন আকাশের চাঁদ পেল হাতে! চেয়ার ছেড়ে উঠেই ঝুঁকে গিয়ে টেবিলে থাকা রোমানের হাত চেপে ধরল। উচ্ছ্বাসিত গলায় বলল—

“থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ সো মাচ।”

আয়েন্দ্রির পেলম, মসৃণ, তুলোর মতো হাতের স্পর্শে মৃদু কম্পন শুরু হয় রোমানের শক্ত পোক্ত দেহে। আয়েন্দ্রির দিকে ভালো করে তাকাতেই তার ক্লিভেজে চোখ আটকে রোমানের। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে চেয়ারে বসে আয়েন্দ্রি। ঠান্ডা কফিতে চুমুক লাগায়। অধরে বদ্ধ হাসি। অন্তঃরিন্দ্রিতে তড়িৎ বেগে ছুটছে প্রেমের বহ্নিসখ।

কিন্তু রোমানের কামাতুর দুই চোখে আটকে গেছে আয়েন্দ্রির নিটোল উরজে।
,
,
,
থমথমে মুখ নিয়ে ভাসির্টি আমগাছটার নিচে বসে আছে নিষ্প্রাণ। অভিব্যক্তি শূন্য মুখটায় যেন চৈত্রের খরা। আয়েন্দ্রি নিষ্প্রাণের হাতটা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে তার হাতে মাথাটা শায়িত করে বসে আছে। ক্লান্ত গলায় বলল—

“এমন করছিস কেন? বল না কী হয়েছে?”

নিষ্প্রাণ নিশ্চেষ্ট গলায় বলল—

“কিছু না।”

আয়েন্দ্রি তবুও মানল না। কন্ঠে গাঢ়তা এনে বলল—

“প্লিজ বল না কী হয়েছে? কথা বলছিস না কেন তুই?”

নিষ্প্রাণ নিরুদ্বেগ চোখে তাকাল। আয়েন্দ্রির বিদুর মুখটা দেখে মায়া হলো। চকিতে ঠোঁটটা এগিয়ে নিল আয়েন্দ্রির ঠোঁটের কাছে। কিন্তু ছুঁল না। আজ আয়েন্দ্রি অবাক হয়নি। করেনি কোনো তীব্র প্রতিক্রিয়া। স্বাভাবিকভাবে চেয়ে আছে নিষ্প্রাণের নিষ্কম্প মুখটির দিকে। ঝট করে ঘাড় ফেরাল নিষ্প্রাণ। ভরাট গলায় রাগ মিশ্রণ করে বলল—

“কাল সন্ধ্যায় কোথায় গিয়েছিলি?”

শুকনো ঢোক গিলে আয়েন্দ্রি। এ নির্ঘাত আরিশার কাজ। ও নিশ্চয়ই নিষ্প্রাণকে জানিয়েছে। তবুও কথা কাটাতে কন্ঠ চাপা করে আয়েন্দ্রি বলল—

“কোকোথাও না তো।”

প্রকুপিত চোখে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায় নিষ্প্রাণ। পাশে রাখা ব্যাগটা হাতে নিয়েই হনহন করে চলতে থাকে। অসহায় গলায় ডেকে উঠে আয়েন্দ্রি—

“প্রাণ! প্রাণ!
আমার কথা শোন।”

নিষ্প্রাণ থমকে যায়। আয়েন্দ্রি দ্রুত পা চালায়। নিষ্প্রাণের সামনে গিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় নিরন্তর বলতে থাকে—

“আমি রোমানের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সে বলেছে বিয়েটা ভেঙে দেবে। আমি তাকে সব বলেছি।”

খিঁচতি মেরে ওঠে নিষ্প্রাণের মস্তিষ্কের স্নায়ু। এই বিয়ে এমনিতেও হবে না। তার ব্যবস্থা সে করেছে।

নিষ্প্রাণ হট করেই হিংস্র দানবের মতো আয়েন্দ্রির দুই বাজু চেপে ধরে দাঁতে দাঁত নিষ্পেষণ করে বলল—

“আমি বলেছি তোকে যেতে? বল, আমি বলেছি তোকে? কথা বলছিস না কেন তুই?”

আয়েন্দ্রি কঁকিয়ে ওঠে। নিষ্প্রাণের প্রশ্বস্ত হাতের পাঞ্জার নিষ্করুণ চাপ সে নিতে পারল না। চোখ ভরে এলো তার। নিষ্প্রাণ ফোঁস করে দম ছাড়ল। রঞ্জিত চোখে চেয়ে সংক্ষুব্ধ গলায় বলল—

“তোকে আমার কাছ থেকে যে কেড়ে নিতে চাইবে আমি তার প্রাণ কেড়ে নেবো। তিনি তোর বাবা- ই হোক না কেন!”

আয়েন্দ্রি দাপিয়ে উঠে বলল—

“প্রাণ!

“না। নিষ্প্রাণ। নিষ্প্রাণ আমি। মনে রাখিস।”

আয়েন্দ্রির বুকের মাঝে তড়াক করে ওঠে। এই ছেলের এত রাগ! কখন কী করে বসে! ভয় হয় আয়েন্দ্রির! এই শান্ত মানুষগুলো যখন অশান্ত হয় তখন খুব ভয়ংকর হয়! খুব!

চলবে,,,
চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here