প্রিয় আসক্তি পর্ব -১৫+১৬+১৭ ও শেষ

#প্রিয়_আসক্তি
#পর্বঃ১৫
#মাহমুদা_আক্তার_তাহিনা

সময় কারো জন্য থেমে থাকে না। সে তার নিজস্ব গতিতে চলে। কেটে গেছে এক মাস। সবার জীবনেরই মোড় ঘুরেছে। তাহি সুস্থ হয়ে আবার তার কাজের জীবনে ফিরে এসেছে। কয়েকদিন আগে সরকার থেকে পুরস্কার ও পেয়েছে। তীব্র ও দীবার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। যখন তীব্রের মা বাবা নিষ্প্রভদের বাড়িতে আসেন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তখন তাদের অবাক করে দিয়ে দীবার মা বাবা সব হাসি মুখে মেনে নেন। তীব্র তখন শুধু অবাক হয়ে নিষ্প্রভের দিকে তাকিয়ে ছিলো। নিষ্প্রভ তীব্রের কাঁধ চাপড়ে বলেছিলো- আমার বোনের সাথে প্রেম করবি, আর আমি ভাই হয়ে বোন কি করে জানবো না?, আমি সবই জানি, মা বাবাকেও বলে রেখেছি। আমি জানতাম তুই আন্টি আঙ্কেল কে নিয়ে কোনো একদিন চলে আসবি। তাই কেউ অবাক হয়নি। বরং তুই অবাক হয়ে গেছিস।
সেদিন তীব্র নিষ্প্রভকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো- আমি তো ভেবেছিলাম, তুই জানতে পারলে আমাকে ভুল বুঝবি।

নিষ্প্রভ মুচকি হেসে বলেছিলো- ভুল বুঝতে যাবো কেনো? আমি তো জানি তুই কেমন। তোর উপরে আমার বিশ্বাস আছে, তুই আমার বোনকে সুখে রাখবি, নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রাখবি।

অভয় দিয়ে তীব্র বলেছিলো- তুই আমাকে বিশ্বাস করে তোর বোনের দায়িত্ব দিচ্ছিস, এটাই আমার জন্য অনেক, বিয়ের পরে দীবাকে আমি আমার সবটুকু দিয়ে আগলে রাখবো, প্রমিস দোস্ত।




দেখতে দেখতে গায়ে হলুদ চলে এলো, সন্ধ্যা ৬টার উপরে সময়। দীবাকে গায়ে হলুদের লেহেঙ্গা পড়ানো হয়েছে। ইতিমধ্যে হলুদ লাগানো ও শুরু হয়ে গেছে। নিষ্প্রভ গেটের দিকে তাকিয়ে আছে। পড়োনে হলুদ পাঞ্জাবি। মূলত তাহির আসার অপেক্ষায় আছে। তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তাহি বাইক নিয়ে গেইট দিয়ে ঢুকলো। বাইক সাইট করে রেখে নিষ্প্রভের দিকে এগিয়ে এলো। ঠোঁটে হাসি নিয়ে বললো- কি ব্যবহার ডাক্তার সাহেব, গেইটের কাছে দাড়িয়ে কি করছেন? ওদিকে তো আপনার বোনের হলুদ অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে মেবি।

তাহির উপর থেকে নিচ পর্যবেক্ষণ করলো নিষ্প্রভ। হলুদ শার্ট ও হলুদ জিন্স পড়া, পায়ে হলুদ কেডস। কম সুন্দর লাগছেনা৷ বরং শ্যামাঙ্গিনী কে হলুদ রঙে আরো মায়াময়ী করে তুলেছে।পর্যবেক্ষণ করা শেষ করে নিষ্প্রভ বলে- আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম ম্যাম, অবশেষে আপনি আসলেন। চলুন আপনার একমাত্র ননদ আপনি এখনো আসেন নি বলে মুখ ফুলিয়ে রেখেছে।

হালকা হেসে নিষ্প্রভের সাথে ছাদের দিকে এগিয়ে গেলো তাহি। ছাদের মধ্যে স্ট্রেজ বাধা হয়েছে। তাহিকে দেখে মুখটা আরো একটু ফুলালো দীবা, হালকা হেসে নিষ্প্রভ ও তাহি দুইজন একসাথে দীবাকে হলুদ ছোয়ালো। তাহি দীবার দিকে একটা বক্স এগিয়ে দিলো। ইশারা করে বললো তোর গিফট। তবুও দীবার অভিমান ভাঙলো না। তাহি ও নিষ্প্রভ সরে গেলো, সবাই আবারো দীবাকে একে একে হলুদ লাগাতে লাগলো।




বিদায় ঘন্টা বেজে গেছে। হ্যা দীবার বিয়ে হয়ে গেছে। তার ভালোবাসার মানুষের সাথেই। গাড়ির কাছে দাড়িয়ে আছে তীব্র, সে করুন চোখে দীবাকে দেখছে। মেয়েটার কান্না তার ভালো লাগছে না। দীবা একবার নিষ্প্রভ তো একবার নিজের মা বাবা কে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলছে। তখনই বাইক নিয়ে গেইটের পাশে আসলো তাহি। সবার দৃষ্টি তার দিকেই স্থির হলো। তাহি মলিন হেসে এগিয়ে এলো দীবার দিকে। বিয়েতে আসতে পারেনি, কারণ তাহির জরুরি কাজ পড়ে গিয়েছিলো। পড়োনে কালো জিন্স ও সাদা শার্ট, উপরে সিআইডির লেগিন্স কোর্ট পড়া। বোঝাই যাচ্ছে তারাহুরো করে এসেছে। তাহির মুখেও ক্লান্তি ভাব ফুটে উঠেছে। এগিয়ে এসে তাহি দীবার সামনে দাড়িয়ে জড়িয়ে ধরবে, তার আগেই দীবা সরে গেলো। তাহি বুঝতে পারছে দীবা তার সাথে অভিমান করেছে, আর কষ্ট ও পেয়েছে। কিন্তু তাহির ই বা কি করার ছিলো, হঠাৎ করেই কাজ পড়ে গেছে। দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো তাহি। দীবার সামনে গিয়ে দুই কান ধরে ধারালো। উপস্থিত সবাই হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকেই। সবার চোখেই বিস্ময়। নিষ্প্রভের চোখেও বিস্ময়, তাহি কান ধরেছে, তাও সবার সামনে। যে মেয়ের কি না প্রখর আত্মসম্মান বোধ সে মেয়ে বান্ধবীর অভিমান ভাঙানোর জন্য সবার সামনে কান ধরে দাড়িয়ে আছে। দীবা নিজেও বিস্মিত হয়েছে। সাথে মনে মনে খুশি ও হয়েছে, তাহির মতো বেস্ট ফেন্ড পেয়েছে বলে, যার কাছে দীবার অভিমান কে ভাঙানোর জন্য এতো ব্যাকুলতা। দীবা এগিয়ে গিয়ে তাহিকে জড়িয়ে ধরলো। তাহি ও কান থেকে হাত নামিয়ে দুই হাত দিয়ে দীবাকে জড়িয়ে ধরলো।


দীবা চলে গেলো, নিজের নতুন জীবনের যাত্রা পথে। তীব্রদের গাড়ি চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত সেদিকে তাকিয়ে রইলো সবাই। তারপর সবাই আস্তে আস্তে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলো। তাহি নিষ্প্রভের দিকে তাকালো, নিষ্প্রভের চোখ ছলছল করছে। তাহি এগিয়ে গিয়ে নিষ্প্রভকে জড়িয়ে ধরলো- আপনি প্লিজ মন খারাপ করবেন না ডাক্তার সাহেব, এটাতো হওয়ারই ছিলো। বিয়ের পরে সব মেয়েকে এভাবেই চলে যেতে হবে।

নিষ্প্রভ তাহির মাথায় হাত রাখলো, আদুরে কণ্ঠে বললো – তুমি তো কাজ থেকে ডাইরেক্ট এখানে এসেছো, চলো ফ্রেশ হয়ে নিবে। তারপর দুজনে একসাথে খাবো।

মাথা নাড়িয়ে নিষ্প্রভের সাথে বাড়ির ভিতরে ঢুকলো তাহি। খাওয়া দাওয়া শেষ করে তাহি চলে যায়। যদিও নিষ্প্রভের মা বাবা যেতে দিতে চান নি, কিন্তু তাহি জোর করে চলে গেছে।




তীব্রের বুকে মাথা রেখে পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে দীবা। তীব্র দীবার মাথায় হাত ভুলিয়ে দিচ্ছে। সারাদিনের ক্লান্তি তে তারও ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। তীব্রও পাড়ি দিলো ঘুমের রাজ্যে।



দীবা ও তীব্রের বিয়েতে আয়াত ও উর্মিলা উপস্থিত ছিলো। বর্তমানে লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে দুজন। অনেকক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর আয়াত উর্মিলার দিকে তাকিয়ে বলে- আমাকে বিয়ে করবেন মিলা?

উর্মিলা প্রথম দেখাতেই আয়াতকে পছন্দ করতো। আয়াতের কথা শুনে মাথা নিচু করে বললো- আপনার মা বাবাকে নিয়ে বাসায় আসবেন, আমি চাই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে করতে।

আয়াত কিছু বললো না, প্রাপ্তির হাসি ফুটিয়ে উর্মিলার হাত ধরে হাটতে শুরু করলো। নিস্তব্ধ রাত দুজন কপোত কোপতী হাত ধরে হাটতে।


বিছানায় বসে প্রয়োজনীয় কিছু ফাইল দেখতে ব্যস্ত তাহি। তখনই তার ফোন বেজে উঠে। ফোন হাতে নিয়ে মুচকি হেসে কোল রিসিভ করে।

– কি ব্যাপার ডাক্তার সাহেব, আপনি ঘুমান নি এখনো?

– ঘুম আসছে না, একা একা আর কতো ঘুমাবো। কবে যে আমারো একটা বউ হবে,

– আপনার মা বাবাকে বলুন মেয়ে দেখতে। তারপর তাদের পছন্দে বিয়ে করে নিন।

– এই কি বললে তুমি, আমি অন্য মেয়েকে বিয়ে করবো কেনো? আমার তো তুমি আছো, তোমাকেই বিয়ে করবো।

– যদি আপনার ফ্যামিলি আমাকে না মানে?

– মানবে না কেনো?

– আমি তো একা ডাক্তার সাহেব, ছোট থেকে একা বড় হয়েছি। মা বাবা নেই। আপনার পরিবার কি আমাকে মেনে নিবে?

ওপাশ থেকে নিষ্প্রভ কিছুক্ষণ চুপ থাকলো, তারপর বললো- মানবে না কেনো? মানতে হবে। আমি আমার মা বাবাকে চিনি। আর তা ছাড়া আমি চাই তোমাকে মা বাবা উপহার দিতে৷ আমার মা বাবাকে দিয়ে তোমাকে একটু হলেও মা বাবার আদর বুঝিয়ে দিতে। যাতে কখনো বলতে না পারো, কখনো মা বাবার আদর পাইনি।

ওপাশ থেকে তাহি কিছুক্ষণ চুপ থাকলো।

নিরবতায় ভেঙে নিষ্প্রভই বললো- পাখি একটা গান শুনাও।

সবকিছু ছেড়ে গিটার ও ফোন নিয়ে বারান্দায় ছুটলো তাহি৷ ফোনের স্পিকার বাড়িয়ে দিলো। নিকষ কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে গান গাইতে লাগলো–

ওপাশ থেকে নিষ্প্রভও তাহির গানের সাথে তাল মিলিয়ে গাইছে।

চলবে,ইনশাআল্লাহ

[তাহিকে মেরে ফেললে কেমন হবে?🤨]#প্রিয়_আসক্তি
#পর্বঃ১৬
#মাহমুদা_আক্তার_তাহিনা

ভোররাত!, প্রায় সাড়ে চারটার কাছাকাছি সময়। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তাহি। তাহির ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে তার ফোন বিকট শব্দ করে বেজে উঠে। ঘুমঘুম চোখে তাকিয়ে ফোন রিসিভ করে তাহি। ওপাশ থেকে তাহির টিমের একজন অফিসার সালাম দেয়। তাহি সালাম বিনিময় করে। অতঃপর যেটা জানতে পারলো, তা শুনে তাহির ঘুম পালিয়ে গেলো। তারাহুরো করে রেডি হয়ে ছুটলো, যেখানে সব অফিসার রা উপস্থিত রয়েছেন বর্তমানে।

.
সকাল সাতটার কাছাকাছি সময়৷ ফজরের নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ে গেছিলো নিষ্প্রভ। উচ্চ শব্দের চিৎকার কানে আসতেই ধরফরিয়ে উঠে বসে। চিৎকার গুলো মূলত বসার ঘর থেকে আসছে। বিছানা থেকে উঠে চশমা পড়ে নিলো, ফোন হাতে নিয়ে সেদিকেই পা বাড়ালো নিষ্প্রভ। উদ্দেশ্য কি নিয়ে সবাই চিৎকার চেচামেচি করছে তা দেখা।

কি হয়েছে মা, এভাবে সবাই চিৎকার চেচামেচি করছো কেনো?

নিষ্প্রভের প্রশ্নে সকলের দৃষ্টি তার দিকে পড়ে। মূলত দীবার বউভাতের জন্য কিছু আত্নীয় এখনো রয়ে গেছেন নিষ্প্রভদের বাসায়। তাদের মধ্যে থেকেই একজন মহিলা বলেন- বাবা নিষ্প্রভ আজ দীবার বৌভাত হবে না, পেছানো হয়েছে। দেশের যা অবস্থা!

ভ্রু কুঁচকে যায় নিষ্প্রভের,-দেশের অবস্থা মানে?

আরেকজন মহিলা বলেন- আরে তুমি জানো না কিছু?

-জানলে কি আর আপনাদের জিজ্ঞেস করতাম?

মহিলাটি নিষ্প্রভকে টিভির দিকে ইশারা করলেন, নিষ্প্রভ ইশারা অনুযায়ী টিভির দিকে তাকালো। টিভিতে একটা খবরের চ্যানেল দেখা যাচ্ছে। চোখ ফিরিয়ে নিতে যাবে তখনই টিভি চ্যানেলে এক দৃশ্য দেখতে পায় নিষ্প্রভ। কোথাও আগুন লেগেছে। ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা আগুন নিভানোর চেষ্টা করছেন। রিমোট হাতে নিয়ে টিভির ভলিউম বাড়িয়ে দেয় নিষ্প্রভ।
একজন সাংবাদিক বলে উঠেন- আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, ছয়তলা বিশিষ্ট বিল্ডিংটিতে আগুন লেগেছে। কি কারণে আগুন লেগেছে সেটা পরে তদন্ত করে জানা যাবে। তার আগে বিল্ডিং এর ভিতরে থাকা মানুষ গুলোকে উদ্ধার করতে হবে। আগুন ইতিমধ্যেই কিছুটা নিয়ন্ত্রণের ভিতরে চলে এসেছে। তবে দুঃখের বিষয় হলো বিল্ডিংয়ের ভিতরে আটকে পড়া মানুষদের এখনো বের করা হয়নি। সিআইডির কিছু অফিসার ও ফায়ার সার্ভিসের কিছু অফিসার বিল্ডিংয়ের ভিতরে সতর্কতার সাথে ঢুকেছেন তাদের উদ্ধার করতে, কিন্তু আধাঘন্টা হয়ে গেছে তাদের ও কোনো খুঁজ নেই। ভিতরে ঠিক কি হচ্ছে বর্তমানে তা বলা যাচ্ছে না। তবে ভিতরে অবস্থানরত অফিসারদের মধ্যে কয়েকজনের নাম জানতে পেরেছি, তারা হলেন-ফায়ার সার্ভিসের মধ্যে রয়েছেন- নিলয় শেখ, নাহিদ আহমেদ, জীবন আহমেদ। সিআইডি অফিসারদের মধ্যে যারা রয়েছেন তাদের তিনজনের নাম আমরা জানতে পেরেছি- সিয়াম আহমেদ, নোরা সেন, তাহি মাহমুদ।

তাহি মাহমুদ নামটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছে নিষ্প্রভ। তার কানে আর কিছু ঢুকছে না। বিরবির করে বার বার একই নাম আওরাতে লাগলো। মস্তিষ্ক যখন সচল হলো তখনই নিষ্প্রভ বাইকের চাবি নিয়ে বাড়ির বাইরে ছুটে আসে। নিষ্প্রভদের বাসায় উপস্থিত মহিলারা সব আশ্চর্য হয়ে যান, দিয়া হাসানের মুখে রা নেই। যেনো তিনি জানতেন এমনই কিছু হবে। দিয়া হাসান মনে মনে দোয়া করলেন -, আমার ছেলের মুখের হাসি কেঁড়ে নিও না মাবুদ।

.
আরো আধা ঘন্টা পাড় হয়ে গেছে। আগুন নিভাতে সক্ষম হয়েছের ফায়ার সার্ভিস রা। বিল্ডিংটি বাইরে থেকে দেখতে খুবই বিভৎস লাগছে। সেই কবে থেকে পাগলামি করছে নিষ্প্রভ কিন্তু থাকে কোনো অফিসার বিল্ডিংটির আশে-পাশে তো দূর, গেইটের সামনেই দাঁড়াতে দিচ্ছে না। পুলিশ অফিসার রা চারিদিক ঘিরে রেখেছে। সাধারণ মানুষরা ভীড় জমালেও তাদের আশেপাশে আসতে দেওয়া হচ্ছে না।

বিল্ডিংটির পিছন দিকে দিয়ে মানুষ আসতে দেখা গেলো, মুহূর্তেই সকলের দৃষ্টি সেদিকে যায়। কিছু অফিসার রা সেদিকে এগিয়ে যান, উদ্ধারকৃত মানুষদের দড়ি দিয়ে নিচে নামাচ্ছে তাহিসহ বাকি সব অফিসার রা, যারা উদ্ধার করার জন্য বিল্ডিংয়ের ভিতরে ঢুকেছিলেন। আস্তে আস্তে সবাইকে নামানো হয়। সব অফিসারকে নামতে নির্দেশ দেয় তাহি। সবাই নেমে গেলে নিজেও দড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে নামতে শুরু করে। ছয়তলা বিশিষ্ট বিল্ডিং থেকে নামতে উদ্ধার করা মানুষদের কলিজা কেপেছে। তাহির ও ভয় করছে না তেমন নয়। তবে সে এসবে অভস্ত্য হয়ে গেছে। তাহি নিচে নামতেই সবাই সামনের দিকে হাটা ধরে। তাহির পড়োনে আগুন নিয়ন্ত্রিত জ্যাকেট ছিলো। সেটা খুলে হাতে নিয়ে নিজেও সামনের দিকে অগ্রসর হয়। সবাইকে হাসপাতালে পাঠানো হলো। বিল্ডিংয়ের সব চেক করা হয়েছে।বলাবাহুল্য যে ঘর থেকে আগুন লেগেছে সে ঘরের সদস্যরা ছাড়া আর কেউ তেমন দগ্ধ হয়নি। তবে যে ঘর থেকে আগুন লেগেছে সেই ঘরে মোট ছয়জন সদস্য ছিলেন তাদের কে উদ্ধার করে অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে সবার আগেই হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

.
আরো আধা ঘন্টায় সব নিরব হয়ে গেছে। সবাই চলে গেছে। তবে কিছু কিছু সাংবাদিক ও অফিসার রা রয়ে গেছেন।বিভৎস রুপ ধারণ করা বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে তাহি। নিজের বাইকের দিকে এগিয়ে যায়। তখনই নিষ্প্রভের দিকে তার চোখ পড়ে। নিষ্প্রভ একদৃষ্টিতে তাহির দিকেই তাকিয়ে আছে। নিচের ঠোঁট দাত দিয়ে কামড়ে ধরে রয়েছে। চোখ ছলছল করছে। মলিন হেসে তাহি সেদিকে তাকিয়ে। নিষ্প্রভ আস্তে আস্তে তাহির দিকে এগিয়ে আসে। কাঁপা কাঁপা হাতে তাহির গালে হাত রাখে। পর মূহুর্তেই তাহিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। যেনো ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। তাহিও নিজের হাত রাখে নিষ্প্রভের পিঠে। নিষ্প্রভের কান্নার শব্দ একটু একটু তাহির কানে ভেসে আসছে। তবুও কিছু বললো না তাহি৷ ওভাবেই রইলো। চোখের পানি মুছে তাহিকে ছেড়ে দিয়ে তাহির হাত দুইটা ধরে চেক করতে করতে নিষ্প্রভ বলে- তোমার কোথাও লাগেনি তো পাখি?

মাথা নাড়িয়ে না করে তাহি। নিষ্প্রভের চোখ দিয়ে তখনো পানি গড়িয়ে পড়ছে। নিজের হাতে নিষ্প্রভের চোখর পানি মুছে দেয় তাহি। মুচকি হেসে বলে- কি ব্যাপার, আপনি তো দেখি বাচ্চাদের মতো কান্না শুরু করেছেন ডাক্তার সাহেব। আশে পাশে তাকিয়ে দেখুন। অনেকে আপনার কান্না করা দেখে কেমন করে হাসছে।

কোনো উত্তর দিলো না নিষ্প্রভ তাহির হাতদুটো শক্ত করে ধরে রেখেছে।

আমাদের তো এবার যেতে হবে ডাক্তার সাহেব।

তাহির কথায় মুখে কিছু না বলে নিজের বাইকের দিকে হাত ধরে নিয়ে যায় নিষ্প্রভ। লম্বা শ্বাস নিয়ে কিছু দূরে দাড়িয়ে থাকা সিয়ামের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে বুঝায় ওর বাইকটা যেনো ওর বাসার সামনে রেখে তারপর বাসায় যায়। সিয়াম মাথা নাড়ায়।

নিষ্প্রভের বাইকের পিছনে উঠে বসে তাহি। দুইহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে। নিষ্প্রভ হাত দুটোতে আলতো করে ঠোঁট ছুয়ে দেয়। বাইক স্টার্ট দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

.
বাসার কলিং বেল বাজতেই তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে দেন দিয়া হাসান।নিষ্প্রভ ও তাহিকে দেখে সস্থির নিশ্বাস ছাড়েন। দুজনকে ভিতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে ফ্রেশ হতে বলে রান্না ঘরের দিকে চলে যান।

তাহির হাত ধরে নিষ্প্রভ নিজের রুমে নিয়ে যায়, ওয়াশরুমের সামনে দাড় করিয়ে বলে- যাও পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে আসো।
তাহি ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। নিষ্প্রভ দীবার রুমের ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়।

.
খাবার টেবিলে উপস্থিত রয়েছেন দিয়া হাসান, নাইম হাসান। মেহমান রা চলে গেছেন। দীবার বৌভাত পেছানো হয়েছে। নিচের দিকে মাথা নুইয়ে একমনে খেয়ে চলেছে তাহি। নিষ্প্রভ তা দেখে মুচকি হাসে। যতোই সাহসী আর বদরাগী হোক না কেনো, মেয়েরা অনেক সময় না চাইতেও লজ্জা পায়। যা তাহিকে দেখে বুঝা যাচ্ছে।
#প্রিয়_আসক্তি
পর্বঃ১৭[অন্তিম পর্ব]
#মাহমুদা_আক্তার_তাহিনা

তাহির ঘুমন্ত অবস্থায় থাকা নিষ্পাপ মুখের দিকে চেয়ে আছে নিষ্প্রভ। মুখের সামনে পড়া চুল গুলো কানে গুঁজে দিচ্ছে। তার এখনো বিশ্বাসই হচ্ছেনা তার পাখি তার বউ হয়ে গেছে। হ্যা নিষ্প্রভ ও তাহির বিয়ে হয়ে গেছে। কয়েক ঘন্টা আগে খাওয়া দাওয়া শেষ করে নাইম হাসান তাহিকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। যদিও তাহির এখন বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু একবার না একবার তো বিয়ের সময়টা আসতোই। তাহি ছোট বেলায় মা বাবা হারিয়েছে, নিষ্প্রভের মা বাবাকে নিজের বাবা মা’র মতোই সম্মান করে। তাই সে নাইম হাসানের কথা ফেলতে পারে নি। তাহির সম্মতি পেয়ে নাইম হাসান কয়েক ঘন্টার ভিতরে কিছু আত্নীয় ও কাজী ডেকে বিয়ে পড়িয়ে দেন। দীবার বৌভাত শেষ হলে তারপর ধুমধাম করে বিয়ে হবে ওদের।

হঠাৎ তাহি নড়েচড়ে উঠায়, ধ্যান ভাঙে নিষ্প্রভের। তাহি পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। সারাদিনের ক্লান্তি তে ঘুম কাবু করেছিলো তাহিকে, তাই নিষ্প্রভের ঘরে তাকে দেওয়া মাত্রই, নিষ্প্রভের অপেক্ষা না করে ঘুমিয়ে গেছে।

-এমন করে তাকিয়ে কি দেখছেন মিস্টার হাসবেন্ড?

– দেখছিলাম, আজ আমার নতুন বিয়ে করা বউ, স্বামী ঘরে ঢুকেনি, তার আগেই ঘুমে কাবু হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

-তো কি করবো, আমার খুব বেশিই ঘুম পেয়েছিলো, আর আমি এমনিতেই প্রচুর ক্লান্ত ছিলাম। আরো ক্লান্ত হয়ে গেছি শাড়ি পড়ে। তাই তো আপনার ঘরে ঢুকেই আগে শাড়ি চেঞ্জ করে তারপর ঘুমিয়েছি।

– ঘুম শেষ?

– হুম, আপাতত শেষ। কয়টা বাজে?

– সাড়ে ১২টার কাছাকাছি।

– চলুন ছাঁদে যাই।

– চলুন ম্যাম। তবে আমার শর্ত আছে,

– কি শর্ত?

-আমার কোলে করে যেতে হবে। নাহলে যাবো না!

মুচকি হেসে তাহি, নিষ্প্রভের গলা জড়িয়ে ধরে টুপ করে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। নিষ্প্রভ ও বিনিময়ে ঠোঁট প্রসারিত করে তাহিকে কোলে নিয়ে ছাঁদের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।

.
কেটে গেছে ৫বছর। সময় কারো জন্য থেমে নেই। সে তার নিজস্ব গতিতে চলে।

বিকাল সাড়ে চারটার কাছাকাছি সময়, হালকা বাদামী রঙের সিল্কের শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে, নিজের তিন বছরের মেয়েকেও জামা পড়িয়ে তৈরি করিয়ে, কোলে নিয়ে, বসার ঘরে আসে দীবা। তীব্র সেখানেই বসেছিলো। হাত বাড়িয়ে তার মেয়েকে কোলে নেয়। মেয়েটির নাম তিতিয়া। তীব্র মেয়েকে নিয়ে বেড়িয়ে যায়, পিছে পিছে দীবাও। আজ তারা সবাই মিট করবে, একসাথে ঘুরাঘুরি করবে।

একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে তীব্র ও দীবা, সাথে তাদের তিন বছরের মেয়ে তিতিয়া। তীব্র তিতিয়ার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দীবার কপালেও ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। দীবা তাতে কিছু বলেনা, মুচকি হেসে তীব্রর হাত জড়িয়ে ধরে বসে থাকে, বাকি সবার অপেক্ষায়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই রেস্টুরেন্টে উপস্থিত হলো, উর্মিলা ও আয়াত। উর্মিলা সাত মাসের প্রেগন্যান্ট। আয়াত আসতে রাজি ছিলোনা। কিন্তু উর্মিলার জিদের কাছে হার মেনে আসতে হয়েছে।
দীবাও তীব্রের সাথে টুকটাক কথা বলে তারাও আবার অপেক্ষা করতে লাগলো বাকি দুইজনের জন্য।

নিষ্প্রভের পড়োনে সাদা শার্ট কালো প্যান্ট, চোখে চশমা, হাতে ডাক্তারের এপ্রোন নিয়ে, এগিয়ে আসে তীব্রদের দিকে। হঠাৎ করেই থেমে যায়,পিছু ফিরে একটা হাতকে জড়িয়ে ধরে। হ্যা এটা তাহি, তাহির হাত জড়িয়ে ধরেই তীব্রদের সামনে এসে চেয়ারে বসে নিষ্প্রভ। তাহির পড়োনেও তার সিআইডির কোর্ট, তবে সেটা হাতে নিয়ে আছে।

টুকটাক কথা বলে সবাই। খাওয়া দাওয়া করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সবাই লেকের পাড়ে আসার উদ্দেশ্যে আবারো রওনা দেয়।

লেকের সচ্ছ পানিতে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। আর সেদিকেই তাকিয়ে আছে তিন জোড়া কপোত-কপোতী। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে উষ্ণ আলিঙ্গনে।

তীব্র দীবাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে আছে। আরেক হাত দিয়ে তিতিয়া কে কোলে শক্ত করে ধরে রেখেছে। দীবা তীব্রের হাত জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে চাঁদ দেখছে। হঠাৎই তিতিয়া শব্দ করে কেঁদে উঠে। ওর কান্নার শব্দে ভড়কে যায় সবাই। সকলে এগিয়ে এসে তিতিয়াকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু ওর কান্না থামছে না। দীবার মনে কিছু একটা আসতেই চট করে তীব্রের দিকে তাকিয়ে বলে- তোমার মেয়ে মেবি সুসু করেছে, তাই এমন করছে। গাড়িতে তো ওর পেমপাস রাখা আছে। যাও ওকে নতুন পেমপাস পড়িয়ে নিয়ে আসো।

তীব্র হতবিহ্বল, বাসায় নাহয় সে চেঞ্জ করে দেয়, তাই বলে এখানে সবার সামনে তাকে এমন করে বলবে? তীব্রের মুখটা দেখার মতো হয়েছে, যা দেখে সবাই মিটমিটিয়ে হাসছে।

তীব্র তিতিয়া কে নিয়ে গাড়ির কাছে গেলো, নতুন পেমপাস পড়াতেই তার কান্না বন্ধ হলো। মেয়েকে আবারো কোলে নিয়ে সবার সাথে যোগ দিলো তীব্র।

.
চারিদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে, কালো আঁধারে কে কি করছে তা স্পষ্ট নয়। লেকের পাড়ের বেঞ্চটিতে বসে আছে তিনজোড়া কপোত-কপোতী। সবাই একসাথে প্রিয় মানুষকে নিয়ে জোছনা বিলাস করছে।

তীব্র দীবার কোমড় জড়িয়ে ধরে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়,- ভালোবাসি আমার তিতিয়ার আম্মুকে।

-আমিও ভালোবাসি আমার ইন্জিনিয়ার সাহেবকে, আমার মেয়ের আব্বুকে।

.
আয়াতের কাঁধে মাথা রেখে চাঁদ দেখছে উর্মিলা, আয়াত ও উর্মিলা কে জড়িয়ে ধরে একই কাজ করছে। উর্মিলার কপালে ও ঠোঁটে উষ্ণ স্পর্শে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় আয়াত। উর্মিলাও পরিবর্তে একই কাজ করে। আবারো কাঁধে মাথা রেখে চাঁদ দেখতে ব্যস্ত হয় তারা।

.

একইভাবে একে অপরে মত্ত নিষ্প্রভ ও তাহি। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে জোছনা বিলাস করছে। নিষ্প্রভের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে তাহি একটা কার্ড বাড়িয়ে দেয়। নিষ্প্রভ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তাহি ইশারা করে দেখতে। নিষ্প্রভ কার্ডটা ভালো করে দেখে। অবাক হয়ে তাহির দিকে তাকায়, তখনই তাহি বলে উঠে- অভিনন্দন ডাক্তার সাহেব! আপনি বাবা হতে চলেছেন।

নিষ্প্রভ খুশিতে কি করবে ভেবে ফেলো না, তাহিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।- ভালোবাসি পাখি, অনেক অনেক ভালোবাসি।

– আমিও ভালোবাসি আমার শুদ্ধতম পুরুষকে। আমার ডাক্তার সাহেবকে। আমার বাচ্চার বাবাকে।

দূর আকাশের চাঁদ, রাত, নিস্তব্ধতা, লেকের পানি, গাছপালা, সাক্ষী রইলো তিনজোড়া কপোত-কপোতীর ভালোবাসার। ভালোবাসা সুন্দর, তবে সেটা সবার ক্ষেত্রে নেয়। এমন একজনকে ভালোবাসুন, যে আপনাকে তার সবটুকু দিয়ে আগলে রাখতে পারবে। বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও যে ভালোবাসা পুরোনো হয় না, অনুভূতি একই থাকে, সেটাই ভালোবাসা। ভালোবাসা মানে প্রতিদিন একে অপরের সাথে চব্বিশ ঘণ্টা কথা বলা নয়। ভালোবাসা মানে সারাদিনের ব্যস্ততার মাঝে একটু সময় বের করে প্রিয় মানুষকে নিজের অনুভুতি ব্যাক্ত করা।

দিনশেষে সবাই ভালো থাকুক, পূর্ণতা পাক সবার শুদ্ধতম ভালোবাসা।

(সমাপ্ত)

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here