প্রিয়ংবদা পর্ব ২৮+২৯

#প্রিয়ংবদা
#লেখনীতেঃমৌশ্রী_রায়

২৮+২৯

পরেরদিন সকালের আলো যখন ফুটলো,নীরব জগৎ সরব হলো সকল জীবের জাগরণে,সূর্য রশ্মি ছিন্ন করলো ধোঁয়াটে কুয়াশার জাল, প্রকৃতিতে জড়িয়ে রাখা ধুসর কুয়াশার চাদর ঘাসের ওপরে ঝরে পড়লো মুক্তবৎ শিশির হয়ে, ঠিক তখনই হৃদিতার বাড়িতে শুরু হলো বিদায়ের গুঞ্জন!
টাপুর দেবী সকাল থেকে কেঁদেকেটে অস্থির হয়েই নিজহাতে করলেন কনকাঞ্জলির সকল আয়োজন!
অথচ এই উনিই কাল হৃদিতাকে বোঝালেন,কাঁদতে বারণ করলেন আর আজ সেই তিনিই হয়ে পড়লেন নিতান্ত অবুঝ! সব যুক্তি-তর্ক ম্লান হয়ে এলো ওনার প্রগাঢ় মাতৃত্বের কাছে!
হৃদিতা তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি!কাল রাতে সবার সাথে আড্ডা-গল্পের তালে ঘুমোতে দেরি হয়ে গিয়েছিল খুবই,সেজন্যই হয়তো নিদকুমারীরা এত দ্রুত তুলে নেয়নি হৃদিতার বদ্ধ নয়নের কোল হতে তাদের আধিপত্য!
বেলা যখন আরেকটু গড়ালো, সকালের নরম রোদের আলো ঝলমলিয়ে বেড়ে গেল আরও কয়েকগুণ,সাথে বাড়ালো নিজস্ব তেজের প্রখরতা হৃদিতার তন্দ্রা কাটলো তখনই!
টাপুর দেবী তখন অথিথি যারা আছেন তাদের জন্য রান্না চড়িয়েছেন চুলোয়, চোখ থেকে তখনও টপটপ জল গড়াচ্ছে অনবরত!
বাড়ি মোটামুটি ফাঁকাই!ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে কিছু নিয়ে গম্ভীর আলোচনা চলছে ঋতমবাবু,আনন্দবাবু ও আশুতোষবাবুর মাঝে।
আদৃত সিঙ্গেল সোফার ওপর বসে একধ্যানে করছে ফোন স্ক্রল!অন্বেষা বসে আছে সেই সিঙ্গেল সোফারই হাতলে!দাভাইয়ের ফোন ঘেটে চলাই পরখ করছে বিরক্ত নয়নে!
এমন সময়েই হৃদিতা বাইরে বেরিয়ে এলো!আদৃত ফোনস্ক্রিন থেকে চোখ তুলে একবার তার দিকে তাকাতেই দৃষ্টি থমকালো সেখানেই!
সদ্য ঘুম থেকে ওঠা ফোলা চোখ-মুখ,সারারাতের শোবার ওলট-পালটে চোখের কোলঘেষে লেপ্টানো কাজল,কপালের হালকা মুছে যাওয়া চন্দন, নাকের ওপরে লেপ্টে যাওয়া সিঁদুর, খোপা ছেড়ে বেরিয়ে আসা এলোমেলো চুল, ভাজ নষ্ট হয়ে যাওয়া অগোছালো শাড়ি, এই ছন্নছাড়া রুপেই যেন হৃদিতার প্রেমবাণে আরও একবার সাংঘাতিক আহত হলো আদৃত!
বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে চোখ বুজে নিল ঝটপট।তারপরে লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করলো খানিকটা!মাথা নিচু করে চোখ মেলে আবারো দৃষ্টি তাক করলো মোবাইলস্ক্রিনেই!
হৃদিতা এসবের কিছুই খেয়াল করলো না, একজোড়া ঘোর লাগা দৃষ্টি যে তাকে দেখে প্রেমের সুখ সুখ যাতনায় ছটফটিয়ে মরলো তা সে বুঝলো না!
সে সোজা গেল রান্নাঘরে। টাপুর দেবী অক্ষিপট তখনও সিক্ত, অশ্রুস্রোত শুকিয়ে গিয়ে ফর্সা গালে ফুটে উঠেছে বিষাদের রেখা!হৃদিতা ভ্রু কুচকালো, মাকে এমন কাঁদতে দেখে অবাক কন্ঠে ডাকলো,
“মা!”
টাপুর দেবী চকিতে তাকালেন!অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে খুব সন্তর্পনে মুছে ফেললেন চোখের জলটুকু, পাছে মেয়েটা দেখে ফেলে!
তবে হৃদিতার চোখের আড়াল হলো না।সে বিচলিত কন্ঠে শুধালো,
“মা?তুমি কাঁদছো?কেন?তুমি না বললে আমি এখুনি যাচ্ছি না!তবে?বোর্ড এক্সাম হতে তো এখনো মাস চারেক দেরি মা!এতগুলো দিন তো তোমাদের সাথেই থাকবো!তবে কাঁদো কেন?কাঁদবে না একদম। আমার ভালো লাগে না!”
টাপুর দেবী এবারে মেয়েকে টেনে নিলেন বুকে। মাতৃহিয়া শীতল করার তরে তাকে আকড়ে ধরেই ফুঁপিয়ে উঠলেন!চেপে রাখা কান্নাগুলোকে উগড়ে দিলেন বাইরে!

তারপর হৃদিতার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে বললেন,
“সরি মা!মা জানতো না!আজই জানিয়েছে তোর বাবা!”

হৃদিতা কপাল কুচকে তাকালো!ভাজ পড়া ললাট রেখা আরও কিছুটা কুঞ্চিত করে শুধালো,
“মানে?কি জানতে না?কি জানালো বাবা?”

টাপুর দেবী কিছু বলার আগেই রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন ঋতমবাবু!মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
“আমার ট্রান্সফার হয়ে গেছে হৃদ!একদম পাহাড়ি এলাকায়!সিলেটে!
ট্রান্সফরমেশন লেটারটা অফিস থেকে পেয়েছি দিন পাঁচেক আগে!ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি কি করবো, তোর মাকেও জানাইনি তাই,এমনকি কাউকেই না!এমন একটা সময় বদলী হতে হবে, যখন তোর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাটা সামনেই!মাস ফুরোলেই টেস্ট!
এমন পরিস্থিতিতে তোকে অন্য কোন জায়গায় শিফট করানো তো সম্ভব নয়, তাও চেনা-জানা শহর ছেড়ে এত এত ক্রোশ দূরে!স্টাডিতে ব্যাড ইফেক্ট পড়বে!মানিয়ে নিতেই তো লেগে যাবে মাস খানেক সময়!
তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বিয়েটা হয়ে যাক!সবাই যেমন জানে জানুক, পরে আস্তে ধীরে বুঝিয়ে বলবো!কাল রাতে তোর মাকে জানিয়েছি সবটা!তারপর থেকেই কেঁদে যাচ্ছে! আজ আদৃতদেরকেও জানালাম।
তুই ও বাড়িতেই যাচ্ছিস হৃদ।তাছাড়া আর উপায় নেই!আমার জয়েনিং ডেট আরও তিনদিন পর!কাল ও বাড়িতে তোর ঘরোয়া করে বৌভাতটা হয়ে গেলেই আমরা রাতের গাড়িতে রওনা দেব!
আমি আবারও নতুন করে বদলী নিতে অ্যাপ্লাই করেছি!যাতে আবারও ঢাকায় পোস্টিং পড়ে!তবে প্রোসেসিং হতেই মাস তিনেক লাগবে!তুই চিন্তা করিস না!আমি যত দ্রুত সম্ভব আবারও তোর কাছে চলে আসার চেষ্টা করব!
তুই কি এখন কাঁদবি হৃদ? বাবার ওপরে রাগ করবি?”

হৃদিতার চোখের জল ছলছল করে,তবে কাঁদেনা!নাক টেনে কান্না আটকে মন খারাপের সুর তুলে বলে,
“আমাকে তোমাদের ছেড়ে একা একা থাকতে হবে বাবা?তোমরা অতদূরে চলে যাবে?আমাকেও নিয়ে যাও না!আজ যদি আমার বিয়ে না হতো, তখন কি করতে বলো?নিয়ে যেতে না আমাকে?”

ঋতমবাবু মৃদু হাসেন। মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলেন,
“তখন কি করতাম তা তো এখন বলা যাচ্ছে না হৃদ!মানুষ বড় অদ্ভুত প্রাণী!পরিস্থিতির তারতম্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মারাত্মক ক্ষমতাটা তাদের জন্মগতভাবে লব্ধ!
যদি পরিস্থিতি তেমন হতো, তোর জীবনে আদৃত না আসতো, তখন কি করতাম তা তো এখন অন্য একটা পরিস্থিতিতে বলা সম্ভব না মা!
তবে এই পরিস্থিতিতে যা করণীয় আমি সেটাই করছি!তুই তো বাবাকে বিশ্বাস করিস তাইনা?তাহলে বিশ্বাস রাখ, বাবা যা করছে, তোর ভালোর কথা ভেবেই করছে!
আদৃতের কাছে ভালো থাকবি তুই! তাই আর মন খারাপ করিস না!তোর মুখভার দেখলে যে বাবার ভালো লাগে না!”

হৃদিতা এবারে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো,আহ্লাদি কন্ঠে বললো,
“তুমি কিন্তু খুব জলদি মাকে নিয়ে আমার কাছে চলে আসবে বাবা!তখন আমি অর্ধেকদিন তোমাদের কাছে আর বাকি অর্ধেকদিন ওই বাড়িতে থাকবো!ঠিকাছে?”

ঋতমবাবু মেয়ের মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে বলেন,
“ঠিকাছে!”
এতক্ষণে হৃদিতার ঠোঁটের কোণে দেখা মিললো একটুকরো ক্ষীণ হাসির রেখার!সে আহ্লাদী হয়েই বাবাকে জড়িয়ে রইলো আরও ক্ষণকাল!

সে দৃশ্য দেখে টাপুর দেবী চোখের জল মুছে নিলেন!
তার চিন্তা তো ছিল মেয়েটাকে নিয়েই!কখনো বাবা-মাকে ছাড়া একা থাকেনি,সে মেয়ে তাদের ছেড়ে একা থাকবে কিকরে?কাঁদবে না খুব!এসব চিন্তাতেই মাতৃমনটা হয়ে পড়েছিল এতটা আকুল!সেই আকুলতাই তো চোখ উপচে কাঁদালো তাকে।
তবে এখন মেয়েটাই যখন বাবার কথা শুনে নিজেকে সামলে নিল,তখন তার যে আর ভেঙে পড়াটা সাজে না!
তাই একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে আবারও রান্নার কাজে মন দিলেন তিনি!বাড়িতে নতুন জামাই,কুটুম!তাদেরকে ভালো মতো রেঁধে খাওয়াতে হবে যে!এখন কি তার কাঁদার সময় আছে?একদমই নেই!
.
হৃদিতা আর আদৃত দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে!এবার তাদের যেতে হবে!
এতক্ষণ নিজেকে সামলে রাখলেও এবার আর নিজেকে সামলাতে পারছে না হৃদিতা। বাবা-মাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে,কথাটা ভাবতেই কেমন বুকের ভেতরটা মুচরে উঠছে বারবার!আদৃতের পাশটাতে দাঁড়িয়েই,এক নাগাড়ে করে যাচ্ছে অশ্রুবিয়োগ!
আদৃত বাঁধা দিচ্ছে না।কাঁদুক!মেয়েটা জানতো একরকম,আর হচ্ছে আরেকরকম।
একই শহরে থাকলে তবু কথা ছিল,কিন্তু তা তো হচ্ছে না।সারাজীবনে বাবা-মার থেকে যে একদিনের জন্যও দূরে থাকেনি তাকে বাবা-মার থেকে এত দূরে থাকতে হবে এটা জেনে কান্না আসাটা স্বাভাবিক, আর স্বাভাবিক ঘটনাতে বাঁধা দিতে নেই!তাকে নিজের নিয়মে ঘটে যেতে দিতে হয়!
টাপুর দেবী এলেন একটু পরেই!জলে ভেজা চোখেই ধান-দূর্বা দিয়ে আশির্বাদ করলেন মেয়ে-জামাতাকে!
এরপর ডাক পড়লো ঋতমবাবুর!
তিনি এককোণে দাঁড়িয়ে নীরবে ফেলছিলেন চোখের জল!চোখের জল মেয়ের থেকে লুকোতেই এই ব্যবস্থা!মেয়েটা যে বড্ড নরম!বাবাকে কাঁদতে দেখলে আর স্থির থাকতে পারবে না যে!
ডাক শুনে ঋতমবাবু চট করে পাঞ্জাবির হাতায় মুছে নিলেন অশ্রুকণা।
তারপর স্বাভাবিক ভাবেই এসে দাঁড়ালেন মেয়ের সামনে।পিতৃহৃদয়ের সবটুকু আদর নিংড়ে দিয়ে মেয়ের কপালে সস্নেহে ঠোঁট ছোয়ালেন! মাথায় হাত বুলিয়ে আবারও বললেন,
“কাঁদবিনা একদম!বাবা,তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে!আচ্ছা মা?আর কাল তো যাবই তোর বৌভাতে!চোখের জল মুছে ফেল!কাঁদবি না কিন্তু!”

হৃদিতা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়লো!হাতের উল্টো পিঠে মুছে নিল চোখের জমা জল!কাঁদলো না আর!

ঋতমবাবু এবার আদৃতের দিকে তাকালেন,মেয়ের হাত তার হাতে তুলে দিয়ে বললেন,
“ও কিন্তু আমার খুব আদরের আদৃত,বরাবরই!ছোট থেকে ওর নিজের গায়ের রঙই ওকে শুনিয়েছে বহু মানুষের বহু কথা, কালো বলে কেউ কখনো ভালোবাসেনি ওকে, বাসতে চেষ্টাই করেনি।
ওর পৃথিবীতে ভালোবাসা,আদর সবই ছিলাম আমি আর টাপুর!
ওর পৃথিবীটা কেবল আমাদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল বাবা!
সময়ের তাগিদে তুমি এলে ওর জীবনে,চিরাচরিত ঘটনার বাইরে বেরিয়ে ওকে ভালোবাসলে, আমাদের কাছে ওর হাত চাইলে।
সত্যি বলতে তোমার ভালোবাসা নিঁখাত মনে হয়েছে বলেই মেয়েকে বিনা সঙ্কোচে দিয়ে যাচ্ছি তোমার হাতে!
আমার এই মনে হওয়ার মান রেখ!যে বিশ্বাস থেকে মেয়েকে তোমার হাতে অর্পন করলাম সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রেখ!আজ থেকে ওর সুখ-দুঃখ সব কিছ তোমার দায়িত্ব। দুঃখগুলোকে পাশ কাটিয়ে ওর জীবনটা সুখময় করে তুল বাবা, মেয়ের বাবা হিসেবে তোমার কাছে এটুকুই চাইবো!
তোমরা দুজন সুখী হও!”

কথার মাঝে ঋতমবাবুর কন্ঠস্বরের কম্পন ঠিকই টের পেল আদৃত।খুব শ্রদ্ধাভরে মানুষটার দিকে তাকিয়ে তার উদ্দেশ্যে বললো,
“আপনার বিশ্বাসভঙ্গ হবে না আঙ্কেল! নিশ্চিন্ত থাকুন!”

ঋতমবাবু যেন এমন কিছু শোনারই অপেক্ষা করছিলেন। তিনি আরেকবার মেয়ের মুখপানে তাকিয়ে মাথায় বোলালেন স্নেহের পরশ!আদৃতের দিকে তাকিয়ে আরেকবার প্রসন্ন হেসে তিনি আবারও সরে গেলেন ভেতরে!
টাপুর দেবী মুখে আঁচল গুঁজে কাঁদছিলেন!স্বামী প্রস্থান মাত্র কোনরকমে সামলে নিলেন নিজেকে। তারপরে একটা পিতলের থালায় করে চাল এনে দাঁড়ালেন মেয়ের সামনে। হালকা হেসে বললেন,
“দরজার বাইরের দিকে মুখ ফিরে দাঁড়াও দুজনেই!হৃদ,হাতে একমুঠো চাল তুলে নিবি,আমি পেছনে আচল মেলে দাঁড়াবো, মুঠোর চাল নিজের কাঁধের ওপর দিয়ে আমার আচলে ফেলে দিবি!আর বলবি,
” মা,তোমার সব ঋণ শোধ করলাম!আচ্ছা? ”

মায়ের কথায় হৃদিতা কপাল কুচকালো!জিজ্ঞাসু নয়ন মেলে শুধালো,
“এটা কেমন কথা মা?একমুঠো চালে মায়ের ঋণ কিকরে শোধ হবে?তুমি যে যন্ত্রণা সহ্য করে আমাকে গর্ভে লালন করেছ,জন্ম দিয়েছো,বড় করেছো, আমার গায়ের রঙ নিয়ে অন্যের কটু কথা শুনেছ সেসব তো সবই তোমার কাছে আমার ঋণ মা। তোমার কাছে আমি আজন্ম ঋণী!আর এতসব ঋণের বদলে এক মুঠো চাল দিয়ে বলবো ঋণ শোধ,তাও নিজের বাবার টাকায় কেনা চাল!
এসব নিয়ম মানা আমার পক্ষে সম্ভব না মা। না মনে না। আমি এসব কিছু বলতে-করতে পারবো না!প্লিজ!”

হৃদিতার কথার উত্তরে টাপুর দেবী আর কথা বাড়ালেন না। তিনি ভালো করেই জানেন, মেয়ে যখন বলেছে এটা করা তার দ্বারা সম্ভব না,তখন পৃথিবী উল্টো হলেও সে যে তা করবে না তা উনি জানেন!তাই আর জোড়ও করলেন না!
আশুতোষবাবুসহ সেন পরিবারের প্রত্যেকেই ভীষণ খুশি হলেন হৃদিতা চেতনার এমন পরিপক্কতায়!
আর আদৃত,সে তো কেবল মুগ্ধতার এক স্তর থেকে অন্য স্তরে উপনীত হতে লাগলো, তার প্রাণেশ্বরীর এমন উচ্চ বোধে!
.
মেঘকুঞ্জ যাবার গোটা পথটা,হৃদিতা আর কাঁদলো না।খুব শান্ত হয়ে স্থির বসে রইলো গাড়িতে!আদৃতও আর বললো না কিছুই! বাবার বারণেই যে কাঁদতে পারছেনা মেয়েটা সেটা বুঝেই তাকে থাকতে দিল একটু নিজের মতো!
মধ্যাহ্নের কড়া সূর্য যখন মাথার ওপর থেকে একেবারে হেলে পড়লো শেষ দিগন্তে,রৌদ্রময় ঝলমলে দিনটা হয়ে এলো ম্লান, তখনই আদৃতদের গাড়ি এসে থামলো মেঘকুঞ্জের সামনে!দারোয়ান ছুটে এসে খুলে দিল বিশাল লোহার ফটকটা!ফুলে ফুলে সাজানো সেই গেটের ভেতর দিয়েই বিয়ের সাজে সজ্জিত গাড়িটা প্রবেশ করলো বাসার ভেতর!ড্রাইভ করছিলেন আনন্দবাবু!তিনি গাড়িটা পার্ক করে রেখে, বাবা-ছেলে-মেয়ে-বৌমা সকলকে নামতে বললেন গাড়ি থেকে!
কথামতো নেমে দাঁড়ালো সকলেই!
গাড়ি ঢোকার আওয়াজ পেয়ে বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন কাদম্বিনী দেবী ও মল্লিকা দেবী! ওনার হাতে বিশাল বরণডালা!
আদৃত-হৃদিতা সেদিকে এগিয়ে যেতেই কাদম্বিনী দেবী জোড়ে শাখ ফুঁকলেন!উলুধবনি দিয়ে উঠলো তাদের পেছনে দাঁড়ানো এ বাড়ির সকল নারী কর্মচারী!
মল্লিকা দেবী ছেলে-বৌমা সামনে এসে দাঁড়াতেই তাদের বরণ করে নিলেন সাদরে!বধূবেশে সজ্জিতা হৃদিতার চিবুক ধরে ছোট করে চুমু খেলেন! তারপর ওদের মিষ্টিমুখ করিয়ে হৃদিতার সামনে রাখা দুধে-আলতার থালটা দেখিয়ে বললেন,
“আমার বন্ধু, আর এই সেন পরিবারের মা লক্ষ্মী!এই দুধে-আলতায় পা দিয়ে আমাদের বাড়িতে তোমার শুভ প্রবেশ ঘটাও মা!এসো!
আগে বাঁ পাটা দেবে কেমন?”

হৃদিতা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়লো। শাশুড়ী মার কথা মতোই বাঁ-পা দুধে-আলতায় ডুবিয়ে নিজের শশুড়গৃহে ফেললো বিবাহোত্তর প্রথম পদক্ষেপ! কাদম্বিনী দেবী শাঁখ বাজালেন পরপর।সকলে যথারিতি উলুধ্বনিতে মুখর করে তুললো মেঘকুঞ্জের অন্দরমহল!
.
বধূবরণের উপাচার শেষে বাদবাকি বিধি বিধান মানতেই হৃদিতাকে নিয়ে যাওয়া হলো রান্নাঘরে!মল্লিকা দেবী দুধ চড়িয়ে এসেছিলেন চুলোয়!হৃদিতা ঘরে পা রাখা মাত্র উথলে উঠলো সে দুধ। কাদম্বিনী দেবী মিষ্টি হেসে বললেন,
“এই দুধের মতো,তোমার সংসারও উথলে পড়ুক সমৃদ্ধিতে দিদিভাই!”
হৃদিতা হাসলো।এরপর তার সামনে রাখা কয়েকটা স্টিলেন বয়াম দেখিয়ে মল্লিকা দেবী বললেন,
“খুলে দেখ তো মা, কি দেখতে পাও!”

হৃদিতা খুললো!দেখলো বয়াম ভরা চাল,ডাল,চিনি,ময়দা! হৃদিতা মায়ের শিখিয়ে দেয়া বুলি আওড়ে বললো,
“সব কিছু ভরা ভরা!”
মল্লিকা দেবী প্রসন্ন মনে বললেন,
“তোমার সংসারও সবসময় ভরে থাকুক সুখ-শান্তিতে!”

তারপর বড় একটা অ্যালুমিনিয়ামের হাড়ি এনে রাখলেন হৃদিতার সামনে।বললেন,
“হাড়ির ভেতরে একটা টাকি মাছ আছে!ধরে দেখাও তো!”
হৃদিতা এবারে চমকে তাকালো!অবাক হয়ে শুধালো,
“মাছ ধরতে হবে?”
মল্লিকা দেবী বিস্তর হেসে ঘাড় দুলিয়ে বোঝালেন,
“হ্যাঁ,হবে!”
হৃদিতা পড়লো চরম বিপাকে।সে ঠোঁট উল্টে অসহায় মুখ করে বললো,
“আমি তো মাছ ধরতে পারিনা দিদার বৌমা!”
এবারে পাশ থেকে কাদম্বিনী দেবী বললেন,
“চেষ্টা করে দেখই না দিদিভাই!”

দিদার কথায় হৃদিতা কিছুটা সাহস পেলেও পরক্ষণেই চুপসে গিয়ে শুধালো,
“যদি কামড়ে দেয়,তখন?”

কাদম্বিনী দেবী হেসে ফেলে বললেন,
“টাকি মাছ কামড়ায় না দিদি!তুমি নিশ্চিন্তে ধরো!”

হৃদিতা খানিক ভরসা পেল!হাড়ির ভেতরে ভয়ে ভয়ে হাত ঢুকিয়ে বার কয়েক হাত ঘোরালো হাড়ির জলে।এপাশ,ওপাশ করতে করতে একটা সময় ধরেই ফেলল মাছ! কাদম্বিনী দেবী হৃদিতার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে বললেন,
“এ সংসারও এই মাছের মতোই তোমার হাতের মুঠোয় থাক দিদিভাই!এমনই নিপুণভাবে সংসারকে সামলে যেও!সংসারের রাশ কখনো সরে যেতে দিওনা নিজের হাত থেকে!”
হৃদিতা হাসলো আবারও!তার চোখে মুখে ফুটে উঠলো তৃপ্তি!
রান্নাঘরের নিয়ম পালন শেষে, এবারে হৃদিতাকে নিয়ে আসা হলো ড্রয়িংরুমে! আদৃতসহ বাকি সকলে বসে ছিল সেখানেই! হৃদিতাকে বসানো হলো আদৃতের পাশে!তাদের সামনে একটা বড় বাটিতে করে দুধ রেখে তাতে ভেঙে দেয়া হলো আদৃত-হৃদিতা দুজনেরই টোপর-মুকুটের এক টুকরো অংশ।অন্বেষা হাত দিয়ে ঘুড়িয়ে দিল তাদের!
এই বিধি পালনের মানে হলো,বরবধূ পরস্পরের কাছাকাছি থাকবে কিনা তা যাচাই করা!
দুধের ওপর আদৃতের টোপরের অংশ আর হৃদিতার মুকুটের অংশ প্রথম থেকেই চললো একদম পাশাপাশি! অন্বেষা ফোড়ন কেটে বললো,
“আহা কি প্রেম!কেউ কারো পাছ ছাড়ছেই না একদম!”

অন্বেষার কথায় হৃদিতা লজ্জা পেল,আনত করলো লাজুক মুখশ্রী!আদৃত চোখ পাকিয়ে তাকালো বোনের দিকে।অন্বেষা অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে তাকিয়ে রইলো!
কিন্তু একটু বাদেই হৃদিতার মুকুটের অংশটা একেবারে দূরে চলে গেল আদৃতের থেকে।কাদম্বিনী দেবী আৎকে উঠলেন,চমকে গেলেন মল্লিকা দেবীও!
আদৃত বিষয়টা খেয়াল করে বললো,
“এসব নিয়ম শেষ করো না এবারে মা,খুব ক্লান্ত লাগছে!এগুলো তো জাস্ট লোকাচার,এসব দেখে এত ঘাবরানোর কিছু নেই!”

কাদম্বিনী দেবীর মন না মানলেও নাতির কথায় সায় জানালেন!
তারপর অন্বেষাকে বললেন,হৃদিতাকে তার ঘরেই নিয়ে যেতে!
বলে দিলেন, হৃদিতা আজ তার সাথেই থাকবে!আজ যে কালরাত্রি,সূর্য ডোবার পরে বর-কনের মুখ দেখা বারন!
অন্বেষা সে মতোই হৃদিতাকে নিয়ে গেল তার ঘরে। আদৃতও উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো!আর বাড়ির বড়রা,সকলে মিলে ব্যস্ত হয়ে পড়লো কালকের আয়োজন নিয়ে, রাত পেরোলেই যে বৌভাত। সবার অনেক কাজ!দম ছাড়ার ফুরসত আছে নাকি তাদের!

২৯.
পরদিন খুব ভোরেই ঘুম ভাঙলো হৃদিতার!অন্বেষা তখন তারই পাশে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে! হৃদিতা তার পাশ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়লো খুব ধীরে,যাতে অন্বেষা জেগে না যায়!
স্বভাবসুলভ নিয়মেই সে আস্তে করে খুলে দিল, দক্ষিণমুখী জানালা।গায়ে কাঁপনধরা শীতল হাওয়া এসে ছুঁয়ে দিয়ে গেল হৃদিতার চোখ-মুখ!হৃদিতা লম্বা একটা শ্বাস নিল ভোরের শুদ্ধ বাতাসে!তারপর তাকালো জানালার বাইরে!আঁধার কেটে গেছে অনেকটাই,তবে আলো ফোটেনি একেবারে!আলো-আঁধারির মাঝে ঘুমন্ত নীরব পৃথিবীটাকে বেশ উপভোগ্য বলে বোধ হতে থাকলো তার কাছে!বাইরে তখনও কুয়াশার রাজত্ব!সেই কুয়াশার আবরণ ভেদ করেই হৃদিতার চোখ পড়লো বাগানে সমহিমায় দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল শিউলি গাছটার দিকে।
হৃদিতা পা টিপে টিপে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভেঙে নেমে সদরদরজা খুলে বেরিয়ে গেল
বাগানের দিকে!
বিশাল বাগানের এককোণ ঘেষে দাঁড়ানো শিউলি গাছটার নিচে গিয়েই হৃদিতার সমস্ত মনে পুলক জাগলো!মাঝারি আকৃতির গাছটার নিচে পড়ে থাকা একগুচ্ছ শুভ্রতার ভীড়ে সে খুঁজে পেল একপৃথিবী ভালোবাসা!মনে পড়লো, জ্বরের ঘোরে আদৃতের থেকে সেই শিউলি মালা প্রাপ্তির স্মৃতি!হৃদিতা কোমল হাসলো!বুক ভরে শুষে নিল সদ্য ঝড়ে পড়া শিউলিফুলের সুমিষ্ট সুবাস!তারপর ঝুকে পড়ে কুড়িয়ে নিল পড়ে থাকা ফুলগুলো,জড়ো করলো নিজের পরণে থাকা টিয়ারঙা শাড়ির আচলটায়!হঠাৎ পিছু ফিরতেই কারো সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যেতে নিতেই কোমড়ে কারো গাঢ় স্পর্শে বাঁধা পড়লো সে!
চোখ মেলে তাকালো পূর্ণদৃষ্টিতে!
সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে মিষ্টি হেসে প্রশ্ন ছুড়লো,
“এত ভোরে আপনি উঠে পড়েছেন?আমি এখানে কিকরে জানলেন?”
আদৃত দুর্বোধ্য হাসলো!হৃদিতার কোমড়ের আলিঙ্গন আরো দৃঢ় করে জবাব দিল,
“ঘুম ভেঙে গেল!ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াতেই দেখি শিউলিতলে টিয়াবউ!তাই সেই বউপাখিকে দেখতে নেমে এলাম!”
হৃদিতা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো!আদৃত বিভোর চোখে দেখে গেল সেই হাসির অপরুপ মাধুর্য!
তারপর হৃদিতার দুহাতে ধরে রাখা আচলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“এত ফুল কুড়োলে যে!কি করবে?”

হৃদিতা আবারো মিষ্টি করে হাসলো।বললো,
“আপনার কিছু মনে থাকে না নাকি?আজ তো মহাপঞ্চমী!মা দূর্গার চরণে দেব!কাল ষষ্ঠি,মায়ের বোধন,আর তারপর সপ্তমী থেকে মায়ের পুরোদমে পুজো শুরু!
আর তারপর!”
হৃদিতার মুখভার হয়ে এলো!আদৃত ব্যস্ত হয়ে শুধালো,
“কি হলো?তারপর কি?”

হৃদিতা ভারমুখেই জবাব দিল,
“তারপর দুদিন পর দশমী,আর দশমীর ঠিক পনের দিন পরে আমার টেস্ট শুরু!বুঝতেই পারছি না কি হবে?নির্ঘাত ফেল করবো বুঝলেন তো!ফেল করলে নাকি পরীক্ষায় বসতে দেবে না।এ বছর আমার বোধায় আর ফাইনাল দেয়া হবেনা!”

আদৃত ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে বললো,
“অত চিন্তার কিছু নেই।কেউ ফেল করবে না। পনের দিন যথেষ্ট আরেকবার সবকিছু রিভাইস করে নেবার জন্য। আমি তো আছিই,আমি পড়াবো। টেনশন করো না।
আমিও দেখবো আমার বউয়ের পরীক্ষা দেয়া কিভাবে আটকে!”

হৃদিতা প্রশস্ত হাসলো!বিশাল একটা চিন্তা নেমে গেল মাথার ওপর থেকে!কিন্তু সে তো আর বুঝলো না, বর বরই ভালো, তার টিচার হতে নেই,তাহলেই সমস্যা!
.
হৃদিতাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে ভাত-কাপড়ের অনুষ্ঠানের জন্য!অন্বেষা নিজের হাতে সাজিয়ে দিয়েছে তাকে!
লাল পাড় কমলা একটা কাতান শাড়ি আটপৌড়ে করে পড়িয়ে দিয়ে মাথায় টেনে দিয়েছে বড় করে ঘোমটা!সিঁথিতে মোটা করে সিঁদুর এঁকে কপালের ঠিক মাঝ বরাবর বসানো হয়েছে ছোট একটা লাল টিপ!চোখে-কাজল আর গা ভর্তি গয়নায় তাকে একদম কোন সাজানো দেবী প্রতিমা বলেই মনে হচ্ছে!
মল্লিকা দেবী পুত্রবধূর বাঁহাতের কড়ে আঙুলটা দাঁত দিয়ে কেটে বললেন,
“কারো নজর না লাগুক!”
হৃদিতা শিশুসুলভ হাসে!তার মায়ের মতো আরেকটি মা পেয়ে মনে মনে তৃপ্তির বাতাবরণ প্রবাহিত হতে থাকে তার!
হঠাৎ একজন প্রতিবেশিনী বলে ওঠেন,
“কিছু মনে করবেন না দিদি,আজকালকার ছেলে-মেয়েগুলোও যেন কেমন ধারা!এরা পছন্দ করেই যখন বিয়ে করবে তখন একটা সুন্দর দেখতে মেয়েকে কেন বিয়ে করে আনেনা বলুনতো!বেছে বেছে কালো মেয়েই পছন্দ করতে হয়?আদৃত আমাদের কত সুদর্শন,ওর কি মেয়ের অভাব হতো!অযথা এই কালো মেয়েকে বিয়ে করার মানে বুঝিনা বাপু!”
কাদম্বিনী দেবী পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।তিনি সবটাই শুনলেন খুব মনোযোগ দিয়ে তবে উত্তর দিলেন না।কিন্তু ফুঁসে উঠলেন মল্লিকা দেবী, তিনি তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললেন,
” দেখুন দিদি,একটা কথা কি জানেন তো?কয়লার খনিতেই হীরে থাকে!আমার বৌমার বাইরের রুপটাই কয়লার খনি,আর ওর মনটা,সেটা একটা খাঁটি হীরে!আর আমার ছেলে হলো পাক্কা জহুরী!তাই তো এ সমাজের আর পাঁচটা মানুষের মতো কৃষ্ণরঙা সেই খনিটিকে দেখে সে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি,বরং দক্ষ চোখে পরখ করেছে সেই খনির মাঝে লুপ্ত হীরকখণ্ড!
সবচেয়ে বড় কথা আমার ছেলে মেয়েটাকে ভালোবেসেছে মন থেকে, বাইরের রুপ,চেহারার চাকচিক্য দেখে তার মোহে পড়েনি!এজন্য নিজের ছেলেকে নিয়ে আমার গর্ব হয়!
আর ওর বউ,সংসারও ওই করবে,সেখানে আমার তো আপনার এত কথা বলার কোন প্রয়োজন মাথায় আসছে না। আপনি অযথাই এত শব্দ খরচ করলেন দিদি!
আপনি আমাদের নিমন্ত্রিত। এসছেন, খাবেন, ওদের আশির্বাদ করে চলে যাবেন!মিছিমিছি আমার সংসারে আগুন লাগাতে না আসলেই খুশি হবো!তিন বছর আগে আমার পিসিমা আমার সোনার সংসারে যে আগুন লাগিয়েছিল, সে আগুন নেভাতে আমার তিনটে বছর লেগে গেছে, আর এই মেয়েটাই ঝলসানো সংসারটাকে আবারও গুছিয়ে দিতে সাহায্য করেছে আমায়!ওর মতো পবিত্র হৃদয়ের মেয়ে আপনি আর একটা খুঁজে দেখবেন দিদি।পেলে তার সাথেই নিজের ছেলের বিয়ে দেবেন। বাইরের রুপটা দেখে আবার নাক সিটকাবেন না যেন। তাহলে কিন্তু পরে পস্তাবেন!”

মহিলাটি আর উত্তর দিলনা। বসে রইলেন মুখ কালো করে।কাদম্বিনী দেবী প্রসন্ন নয়নে দেখে গেলেন নিজের বৌমাকে, আর হৃদিতা!খুশিতে দুচোখে আনন্দাশ্রু চিকচিক করে উঠলো তার!
তাদের কথার মাঝেই আশুতোষবাবু আদৃতকে সাথে নিয়ে উপস্থিত হলেন সেখানে।
হৃদিতা একনজর তার দিকে তাকালো, গাঢ় হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত যুবাটিকে দেখে নিল খুব গোপণে!নিজের মনেই হেসে বললো,
“এই লোকটা শুধু আমার!এনাকে দেখায় আবার এত গোপনীয়তার কিসের!”
হৃদিতার মন-মস্তিষ্ক সবখানে ছড়িয়ে গেল প্রশান্তির পুলক!
কাদম্বিনী দেবী এবারে আদৃতের হাতে ভাত-কাপড় দিয়ে সাজানো থালাটা তুলে দিলেন,শিখিয়ে দিলেন,
“এটা দিদিভাইয়ের হাতে দেবে!আর বলবে আজ থেকে তোমার সারাজীবনের ভাত কাপড়ের দায়িত্ব আমার!”

আদৃত হাসলো।ঠাম্মার কথামতো হৃদিতার হাতে ভাত-কাপড়ের থালাটা তুলে দিয়ে বললো,
“আজ থেকে তোমার সারাজীবনের যাবতীয় সবকিছুর দায়িত্ব নিলাম আমি। তোমার সুখ-দুঃখ,হাসি-কান্না সব কিছুর দায়িত্ব আমার!”

হৃদিতা থালাটা নিজের হাতে নিয়ে প্রসন্ন হাসলো। হাসলো বাড়ির সকলেই।ঘনঘন শঙ্খ আর উলুধ্বনিতে আবারও মুখর হল মেঘকুঞ্জের প্রতিটি কোণ!
.
সারাদিনের সব আয়োজনের ভীড়ে ব্যস্ত দিনটা কেটে গেল খুব দ্রুত!উজ্জ্বল সূর্যের আলো মিঁইয়ে ঢলে পড়লো পশ্চিমাকাশে!ঠিক তখনই মেঘকুঞ্জে পা রাখলেন ঋতমবাবু ও টাপুরদেবী!
এসেই সবার সাথে কুশল বিনিময় করার ফাঁকে খুঁজে গেলেন মেয়েকে!তবে মেয়েটাকে চোখে পড়লো না কিছুতেই।
পড়বে কি করে?হৃদিতা যে তখন দিদার সাথে রান্নাঘরে পায়েস রাঁধতে ব্যস্ত।বৌভাতে সকলের জন্য কিছু একটা রাঁধবে বলে যখন সে দিদার কাছে জেদ করলো,তখন বাধ্য হয়েই কাদম্বিনী দেবী তাকে পরমান্ন রন্ধনের কৌশল শিখিয়ে দিচ্ছিলেন নিজের হাতে!পায়েসের চাল ফুটে যখন তা গাঢ় হয়ে এলো,হৃদিতা তখন দিদার কথামতো তাতে চিনি ঢেলে নেড়ে নিল বার কয়েক। চিনি গলে দুধে উথাল উঠতেই তার ওপরে কাজু-কিসমিস ছড়িয়ে দিয়ে আরও একবার নেড়ে নিল সেগুলো!
হওয়া পায়েস চুলো বন্ধ করে পাশে নামিয়ে রাখতেই বাইরের ঘর থেকে ডেকে উঠলেন মল্লিকাদেবী,

“মা,হৃদিতা বাইরে এসো, ও বাড়ি থেকে বেয়াই-বেয়ান এসেছেন!”

হৃদিতা খুশি মনে বাইরের ঘরের দিকে যেতে নিতেই কি মনে করে যেন আবার থমকালো। কাদম্বিনী দেবী কপালে ভাজ ফেলে শুধালেন,
“আবার কি হল,দিদিভাই!বাবা-মা এসেছেন।দেখা করতে যাবে না?”

হৃদিতা কেবিনেটের ভেতর থেকে বড় একটা ট্রে, ডেসার্ট বোল-চামচ বের করতে করতে বললো,
“যাব তো দিদা! সবার জন্য পায়েসটা বেরে নিয়েই যাই!”
কাদম্বিনী দেবী বিস্তর হেসে বললেন,
“আচ্ছা!”
সকলের জন্য পায়েস বেড়ে নিয়ে হৃদিতা আর কাদম্বিনী দেবী বেরিয়ে এলেন ড্রয়িংরুমে!সেন্টার টেবিলের ওপর ট্রেটা রেখেই বসে পড়লো বাবার পাশে!খুব আদুরে স্বরে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
“কেমন আছো বাবা?”
ঋতমবাবু স্নেহময় পরশ ছোঁয়ালেন মেয়ের মাথায়, গালে।জবাব দিলেন,
“ভালো আছি মা।তোমাকে খুশি দেখে আরও ভালো হয়ে গেলাম!”
হৃদিতা হাসলো। টাপুর দেবী অভিমানী কন্ঠে বললেন,
“আমাকে তো কারও মনেই নেই!”
হৃদিতা বাবার গলা থেকে হাত নামিয়ে তাকালো মায়ের দিকে। মায়ের পাশে সরে গিয়ে তার কাধে মাথা একহাতে মায়ের পিঠ গলিয়ে হাত আকড়ে ধরে বাচ্চাদের মতো করে জবাব দিল,
“তোমাকে কি আমি ভুলতে পারি বলো?তুমি আমার মা না?”
টাপুর দেবী হেসে ফেলেন।মেয়ের সাথে টুকটাক গল্প করার মাঝেই কাদম্বিনী দেবী সকলের হাতে এক এক করে পায়েসের বাটি তুলে দিতে দিতে বলেন,
“খেয়ে দেখ তো সবাই!দিদিভাই নিজের হাতে বানিয়েছে তোমাদের সকলের জন্য!”

সকলে পায়েস মুখে দিতেই তৃপ্তিতে বুজে আসে চোখ। আশুতোষবাবু তৃপ্ত কন্ঠে বলেন,
“বাহ্!দিদিভাই,খুব সুন্দর হয়েছে তো!তোমার দিদার হাতের পায়েসের থেকেও বেশি ভালো!”
হৃদিতা শিশুসুলভ হেসে বলে,
“দিদাই তো শিখিয়ে দিল।আমি কি তবে গুরুমারা বিদ্যা শিখে গেলাম!”

কাদম্বিনী দেবী হেসে ফেললেন।হাসলো বাড়ির সকলেই!গল্প আড্ডায় মেতে থেকেই বেলা কাটলো আরেকটু।
বিকেল যখন আরও একটু গাঢ় হল, দিবালোক ম্লান হলো আরও খানিকটা,তখন বাড়িতে শুরু হল টুকটাক নিমন্ত্রিতদের আনাগোনা!
হৃদিতাকে ততক্ষণে অন্বেষা আবারও সাজিয়ে দিয়েছে বৌভাতের সাজে। খুব সামান্য সাজ। কোন আড়ম্বর নেই। নীলরঙা একখানি বেনারসী,কোমড়ছাড়ানো উন্মুক্ত কেশে দুটো লালগোলাপ,কানে দুল,নাকে ছোট সাদা পাথরের ফুল,সিঁথি ভরা সিঁদুর।কপালে পড়া লাল টিপের পাশে ছোট করে চন্দন আঁকা,গলায় একখানি বড় হার,হাতে শাখা-পলা-বালা!ব্যস্ এটুকুই!

সাজানোর পরে অন্বেষা নিজেই হৃদিতার চিবুক ধরে হালকা হেসে বললো,
“আমারই নজর লাগতে চাইছে,কে জানে দাভাইয়ের কি হবে!”
হৃদিতা লাজুক হাসলো।
নিচ থেকে যখন বৌ নিয়ে নামার ডাক এলো, অন্বেষা হৃদিতাকে নিয়ে গেল সেখানে!বৌভাতের জন্য ছোট করে সাজানো মঞ্চের ওপরে রাখা একটা চেয়ারে বসানো হলো তাকে।আদৃত বসলো তারই পাশে। আড়চোখে একবার প্রেয়সীর নবরুপ দর্শন করে দৃষ্টি সরালো ক্ষণেই!
তাকালেই যে বিপদ। ঘোর লেগে যায়!

বৌভাতের অনুষ্ঠানটা কেটে গেল নির্বিঘ্নেই!সকালে মল্লিকা দেবীর অমন কথা শেনার পর নতুন বৌয়ের গাত্রবর্ণ নিয়ে কেউ আর কোন রুপ কথা বলার সাহস করলো না। সকলেই বর-বধূকে আশির্বাদ করে তাদের জন্য আনা উপহার দিয়ে খেয়ে চলে গেল খুশিমনেই!
সকল নিমন্ত্রিতদের খাওয়া হলে খাবার প্যান্ডেলে বসলো পরিবারের সকলে।
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব মিটিয়ে ঋতমবাবু-টাপুরদেবী যাবার উদ্যোগ করলেন। মেয়েকে জামাইয়ের হাতে তুলে দিয়ে আরেকবার কাতর কন্ঠে বললেন,
“মেয়েটাকে দেখে রেখ!”
হৃদিতা কাঁদতে চেয়েও কাঁদলো না। সামলে নিল নিজেকে।বাবা যে কাঁদতে বারণ করেছেন!
ঋতমবাবু যাবার আগে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“ভালো হয়ে থাকবি মা।সবার কথা শুনবি। সবাইকে ভালোবাসবি!বাবা-মায়ের তো আজ রাতেই বেরোতে হবে!তুই চিন্তা করিস না। বাবা তাড়াতাড়ি ফিরে আসার চেষ্টা করবে!আচ্ছা? ”
হৃদিতা দ্বিরুক্তি করলো না।ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো। তারপর মিনমিনে কন্ঠে বললো,
“দুদিন পরেই তো পূজা বাবা। তোমরা আমার সাথে পূজায় থাকবে না?”

ঋতমবাবু অল্প হেসে জবাব দিলেন,
“এতগুলো বছর তো বাবা-মার সাথেই পূজো দেখলি হৃদ।এবার নাহয় আদৃতের সাথে দেখ।মাঝে মাঝে কিছু ব্যতিক্রম ঘটতে হয়,নইলে যে জীবনের স্বাদ বদল হয়না।মন খারাপ করে না!”
হৃদিতা আর কথা বাড়ালো না।জোড়পূর্বক হেসে বিদায় জানালো বাবা-মাকে।
ঋতমবাবু-টাপুরদেবী বেরিয়ে গেলেন,আর হৃদিতা নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো তাদের যাবার পথপানে!চোখে মুখে ভর করলো পাহাড়সম বিষাদ।
আদৃত তা খেয়াল করলো। প্রিয়তমার পাশে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে ভরসার হাত রেখে বললো,
“মন খারাপ করে না।আমি আছি তো!”
হৃদিতা এবারে অকৃত্রিম হেসে চাইলো আদৃতের মুখপানে!তার ঐ প্রগাঢ় ভরসামন্ডিত মুখপানে তাকিয়ে ক্ষণেই যেন মিলিয়ে গেল সকল বিষাদ।হৃদিতা আপন মনে বিবৃত করলো,
“জানি তো আপনি আছেন।আপনি আছেন বলেই তো ভরসা!”
দিগন্তের বুকে হারিয়ে যাওয়া সূর্য আর সায়াহ্নের আবছা আঁধার প্রত্যক্ষ করে গেল এক প্রেমিকযুগলের পরস্পরের প্রতি থাকা প্রগাঢ় ভরসার!

#চলবে!

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here