#প্রিয়তার_মিষ্টি_সংসার
#তানিয়া
পর্ব:৪
সচরাচর তানি রুমে না আসলে লাইট অফ করেনা কিন্তু তানি রুমে এসে দেখে আজ লাইট অফ। আজকের সবকিছু যেনো অন্য দিনের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন লাগছে।বলতে গেলে কয়েক মুহূর্তের আগের কার্যক্রমসমূহ।তানির সাথে প্রিয়মের সবসময় খুনসুটি থাকে কিন্তু কখনো প্রিয়ম এতোটা রূঢ হয়না।বা কখনো প্রিয়মকে এতো আপসেট লাগেনা।ঝগড়া করলেও ঠিকই তানির সবকিছু পরিমাণ মতো করে।
লাইট অন করতে প্রিয়মকে সোজা শোয়াতে দেখে। মাথায় একহাত বুকে একহাত রেখে শুয়ে আছে। তানি ধীর পায়ে এগিয়ে যায়,
“প্রিয়ম ভাই তুমি কি ঘুমুচ্ছো?”
প্রিয়ম হ্যাঁ হু কিছু করেনা।তানি বুঝতে পারছে যেটাই হোক প্রিয়মের রাগ তানির ওপর।হয়তো রাস্তায় খাবার খেয়েছে বলে রাগ করছে।এটা কোনো কথা? ফুসকাই তো খেয়েছে তাই বলে রাগ করতে হয়?
“প্রিয়ম ভাই তুমি কি আমার ওপর রাগ করছো?আসলে কি বলো তো আমার বান্ধবীরা আমাকে ফুসকা খেতে এতো জোর করলো..”
তানি পুরো কথা শেষ করলো না মানে শেষ করতে দিলো না তার আগে প্রিয়ম শোয়া থেকে উঠে ঠাস করে চড় বসায় তানির গালে।
তানি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে প্রিয়মের দিকে।রাগে চোখ গুলো লাল হয়ে আছে সাথে শরীর কাঁপছে প্রিয়মের।
“মিথ্যুক মেয়ে কোথাকার? এতো মিথ্যা কীভাবে বলিস?বান্ধবীদের সাথে খেতে গিয়েছিলি নাকি নিজের বিএফের সাথে? তার ওপর তোকে কতো যত্ন করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো,পানি খাওয়াচ্ছিলো।আড়চোখে পাবলিক তোদের দেখছে।বাহ্ কি সুন্দর সিন!এমন দৃশ্য কি মিস করা যায়?আমি মাকে নিষেধ করেছিলাম যেনো আমার সাথে তোর বিয়ে না দেয় কিন্তু মায়ের জেদের জন্য তোর মতো মেয়েকে বিয়ে করতে হলো।ছোট থেকে তুই অবাধ্য ছিলি, তোর করা সব উশৃংখলতা সবাই মানতে পারলেও আমি পারতাম না তাই তোর সাথে কথা বলতাম না সেই দেখ তোকে বিয়ে করে রাত দিন তোর সাথে কথা বলতে হয়।আমি বিরক্ত হয়ে গেছি।আমার মনে হয় এবার আমাদের একটা সিদ্ধান্তে আসা উচিত। এ বিয়েটা শুধু তোর সম্মান রক্ষার্থে করার ছিলো।এখন তো বাঁধা নেই। তাছাড়া আমাদের মধ্যে কিছুই হয়নি তাই আমার মনে হয় এবার আমাদের আলাদা হওয়া দরকার।”
প্রিয়ম একনাগাড়ে সবগুলো কথা বলতে থাকে। তানি অশ্রুসিক্ত নয়নে সেসব শুনছে।শুরুর সবটা কান না দিলেও শেষের একটা কথায় তার দম বন্ধ হয়ে যায়। আলাদা হতে চায়। প্রিয়ম ভাই কি তানিকে ছেড়ে দিবে?ছোট থেকে যে মানুষটাকে ভালোবাসে, স্বামী হিসেবে তাকে পাওয়ার পরও তাকে হারিয়ে ফেলবে। এমন কিছু কি সত্যি হবে?
তানি আরকিছুই বলে না।বলার মতো শক্তি বা ইচ্ছে কোনোটা তার শরীরে নেই। কোনোরকমে একটা চাদর আর নিজের বালিশটা নিয়ে মেঝেতে চলে যায়। ভেবেছিলো হয়তো প্রিয়ম আটকাবে কিন্তু তেমন কিছু হয়নি।আসলে যে মানুষটা তাকে ভালোই বাসেনা, পছন্দই করেনা তার কাছ থেকে এমন কিছু প্রত্যাশা করা নিতান্তই বোকামি।চাদরটা বিছিয়ে মাথার নিচে বালিশটা দিয়ে চোখ বন্ধ করে আর শৈশবের সেসব সময়গুলো ভাবে যেখানে তার সাথে প্রিয়মের সম্পর্কটা শুরু হয়।
দুজনের বাবার এক জায়গায় বসবাস হওয়াতে প্রিয়মের সাথে তার বেশ বন্ধুসুলভ সম্পর্ক হয়।যদিও প্রিয়ম তার বয়সে অনেক বড় তবুও তাদের বয়সের ফারাকটা এতোটা বোঝা যেতোনা।যতক্ষণ স্কুলে থাকতো ততক্ষণ পর্যন্ত আলাদা এরপর বাকি সময়টা দুজনে খেলা করতো।সময়ের সাথে সাথে বড় হওয়া দুজন বালক বালিকা নিজেদের শৈশবটা আনন্দে কাটায়।প্রিয়ম সবসময় চাইতো তানি শুধু তার সাথেই খেলুক,অন্যদিকে তানির বাচ্চা মন সবার সাথে হেসে খেলে সময় পার করতে চাইতো।প্রিয়ম একাকি সময় পার করতো তানিকে না পেয়ে আর তানি পাড়ার বাচ্চাদের সাথে খেলতে যেতো।একসময় প্রিয়মের মনে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে।একদিন খেলার মাঠে তানি পড়ে গেলে তার এক বন্ধু তাকে সাহায্য করে।প্রিয়ম থাকতে অন্য কেউ কেনো তানিকে সেবা করবে? তাই প্রিয়ম তাকে সরে যেতে বলে কিন্তু ছেলেটা না সরলে প্রিয়ম তাকে ধাক্কা দেয়। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে ঝগড়া হয়।যার ফলে বাসা অবধি বিচার যায়। বিচারের সত্যতা যাচাই করতে যখন তানিকে জিজ্ঞেস করা হয় তখন তানি সব দোষ প্রিয়মকে দেয়। সেদিন প্রিয়ম বাসার সবার থেকে বকা শুনে।তবুও প্রথমে কথা না বল্লেও পরে কথা বলে।তানিকে নিষেধ করতো যার তার সাথে কথা না বলতে কিন্তু তানি সেসব পরোয়া করতোনা।এভাবে তাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়।একসময় প্রিয়ম তানির সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দেয়। তানি তাও যেচে গিয়ে কথা বলতো কিন্তু প্রিয়ম তাকে এড়িয়ে যেতো।
শৈশবটা পার করে আসতে যখন কৈশোরে পা দিলো তখন কেনো জানি প্রিয়মের এ দূরত্ব তানির কাছে খারাপ লাগতো।তানি বুঝতে পারতোনা কেনো তার প্রিয়ম ভাই তাকে দূরে রাখে।এক ধরনের টান অনুভব করতো তাই ছুটে যেতো কিন্তু প্রিয়ম ওকে পাত্তাই দিতোনা।তানি নিজেকে বুঝাতো হয়তো বয়ঃসন্ধিকালে সবার মধ্যে এমন পরিবর্তন হয়।হয়তো তারও হচ্ছে তাই প্রিয়মের প্রতি টান অনুভব করে।কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে যখন যৌবনে পরলো তখন বুঝলো এটা টান না,কোনো আবেগ না এটা ভালোবাসা। যেটা ছোট থেকে তার মনে লুকিয়ে ছিলো,যাকে আবেগ ভেবে এতোদিন অগ্রাহ্য করেছিলো।তাই সে মন থেকে প্রিয়মকে নিজের স্বামী হিসেবে চাইতো কিন্তু তানির সাথে প্রিয়মের এ দূরত্ব তাকে ধুঁকতো।প্রিয়মকে কিছুতেই তার প্রতি আগ্রহী করা যেতোনা একমাত্র একটা কাজ ছাড়া। যখনই তানি কোনো ছেলের সাথে কথা বলতো তখনি প্রিয়ম রেগে যেতো আর যেদিন থেকে এ বিষয়টা তানি লক্ষ্য করেছে সেদিন থেকে কাজটা সে আরও বেশি করতো যেনো প্রিয়ম তার প্রতি জেলাস হয়।যেদিন তার বিয়ের সম্বন্ধ পাকা হয় সেদিন সে খুব কান্না করেছিলো যেনো বিয়েটা ভেঙে যায়।কিন্তু না বিয়ে ভাঙ্গলো না।তবুও আশাহত হয়নি ভেবেছিলো কোনো আধাত্মিক ঘটনা ঘটবে আর তাই হলো।বিয়ের দিন বর পালালো আর সেই সুযোগে তার সাথে প্রিয়মের বিয়েটা হয়ে গেলো।
প্রিয়মের বোনের জন্মদিনে যখন সকল বন্ধু বান্ধবরা আসছিলো তখন তানি সবাইকে সার্ভ করছিলো।তানিকে মোটামুটি প্রিয়মের সব বন্ধুরা চিনে তাই তাকে নিয়ে দুষ্টমিও করতো।এটা প্রিয়মের পছন্দ হয়নি তাই তানিকে বলে,
“তোর কি আর কোনো কাজ নেয়? সারাদিন ছেলেদের পাশে ঘুরিস কেনো?এখানে এতো মানুষ এতো মেয়ে তাদের চোখে পরে না?যখন দেখবো ছেলেদের দলে আড্ডা।”
“এ কেমন কথা? ওরা তোমার বন্ধু তোমার বাসায় অতিথি হয়ে এসেছে সেবা না করলে তো পরে তোমার বদনাম হবে।তাছাড়া আমি কোথায় সারাদিন ছেলেদের পাশে ঘুরি বরং ছেলেরা যদি ঘুরে তাতে বা আমার দোষ কি?”
“কি এমন বিশ্বসুন্দরী রে যে তার পেছনে ছেলে ঘুরে?তোর মতো মেয়ের পেছনে কোন ছেলে ঘুরে দেখা তো? সব তো বস্তি পাড়ায় ছেলে।যাদের কোনো রুচি নেই। আমার মতো ছেলেরা কখনো তোর আশেপাশেও যাবে না।”
“প্রিয়ম ভাই তুমি আমাকে এতোটা অপমান করে কথা বলতে পারোনা বুঝেছো?আর কি বল্লে বস্তির ছেলেরা ঘুরে তোমার মতো ছেলে না? ঠিক আছে আমি চ্যালেঞ্জ করলাম ঠিক আমার মতোই মেয়েই তোমার বউ হবে তখন দেখবো তাকে কীভাবে সহ্য করো?”
“তোর মতো গবেটকে বিয়ে করার চেয়ে আজীবন চিরকুমার থাকবো তবুও বিয়ে করবোনা!”
“ঠিক আছে দেখা যাবে। ”
শেষ পর্যন্ত সেই গবেটকে প্রিয়মের বিয়ে করতে হলো। তানির মতো খুশি সেদিন আর কেউ ছিলোনা যতই প্রিয়মকে রাগাক না কেনো তানি মন থেকে তার ভালোবাসার মানুষ হিসেবে প্রিয়মকেই চেয়েছিলো যদিও সে জানে প্রিয়ম কখনো তাকে ভালোবাসবেনা।ঝগড়া হোক বা রাগ তবুও ভালোবাসার মানুষের সাথে ছিলো বলে তানির একটা উচ্ছ্বাস ছিলো কিন্তু আজ যখন সে বুঝতে পারলো সত্যি প্রিয়ম তাকে মন থেকে চাই না তার আর কিছু বলার রইলোনা।সিদ্ধান্ত নিলো কালকেই সে হেনা বেগমের সাথে কথা বলবে।প্রিয়মকে আর জ্বালাবে না।সে চলে যাবে একেবারে।
সকালে তানি কলেজ যায় নি।গা গরম লাগছে হয়তো রাতে নিচে শোয়ায় ঠান্ডায় ধরেছে।কোনোরকমে মুখ ধুয়ে হেনা বেগমের রুমে যায়। তানিকে অস্বাভাবিক দেখে হেনা বেগম চিন্তিত মুখে ছুটে আসেন।তানি তাকে ব্যস্ত হতে নিষেধ করে।
“আন্টি তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। আমার মনে হয় আমার আর প্রিয়ম ভাইয়ার এ সম্পর্কটা থেকে বের হয়ে আসা উচিত কারণ এ সম্পর্কে প্রিয়ম ভাইয়া মোটেও খুশি নয়।এতো মাস অতিক্রম হলো তবুও আমি প্রিয়ম ভাইয়ার মুখে কোনো খুশি দেখলান না।বরং সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে
আর কিছু দিন একসাথে থাকলে হয়তো যতটা ভালো ব্যবহার হচ্ছে দুজনের মধ্যে তাও থাকবেনা।।আমরা জানি প্রিয়ম ভাই আমাকে পছন্দ করেনা তবুও বিয়ের দিন আমার সম্মান বাঁচাতে তুমি যা করেছো তা সত্যি অতুলনীয়। তবে এখন তো আর সমস্যা নেয় তাই আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়া ভালো।কাউকে কষ্ট দিয়ে তার জীবনে থাকার চেয়ে তার সন্তুষ্টির জন্য তার থেকে সরে যাওয়া ভালো।”
“তুই এসব কেনো বলছিস তানি?আমরা জানি প্রিয়ম রাগী তবে সে অনেক ভালে ছেলে। আমার ছেলে হিসেবে না তুই নিজে বল আমার ছেলে কি খারাপ? ”
“আন্টি আমি আগেই বলেছি প্রিয়ম ভাইয়া খুব ভালো তবে তার সাথে আমার বনিবনা হচ্ছে না।যেখানে বনিবনা থাকেনা সেখানে বাধ্যবাধকতা ঠিক না।”
“তানি তুই অসুস্থ বোধ হয় তাই এসব বলছিস।আমার মনে হয় তোর রেস্ট দরকার।প্রিয়মের সাথে আমি কথা বলবো।আর এসব ছাড়াছাড়ি বাদ দে।আল্লাহ তোদের ভাগ্য এক করে রেখেছেন বলেই কিন্তু বিয়েটা হয়েছে।যে সম্পর্কটা কালেমা পড়ে নিবন্ধন হয়েছে তা সামান্য কাগজে কলমে ছাড়া যায় না।তাছাড়া কাছা থেকেও অনেক সময় সম্পর্কের মধ্যে ফারাক থেকে যায় আবার দূরে থেকেও গভীর ভালোবাসার ছোয়া পাওয়া যায়। অতএব ভালোবাসা কখন কীভাবে আসবে তা কেউ বলতে পারেনা।আমার মনে হয় তোর প্রিয়মকে আরেকটু সুযোগ দেওয়া দরকার।”
তানি শুকনো মুখে শ্বাশুড়িকে চেয়ে আছে। এখন তার কিছুই বলতে ভালো লাগছেনা।মায়ের মৃত্যুর পর এ মানুষটা তাকে মানসিকভাবে অনেক সাহস যুগিয়েছে তাই হয়তো এ মানুষটার মুখের ওপর কিছু বলতে ইচ্ছে করছেনা তবে প্রিয়মের সাথেও থাকা আর সম্ভব না।তাই যা করতে হবে এ বাসা থেকে বের হয়ে করতে হবে।
সন্ধ্যায় প্রিয়ম বাসায় এসে দেখে কোথাও তানি নেই।কোথায় গেলো তানি?মায়ের রুমে যেতেই হেনা বেগম বই পড়ছিলেন।ছেলের উপস্থিতি টের পেয়েও হেনা বেগম বইয়ে মন দেয়।প্রিয়ম মায়ের কাছ থেকে তানির খবর জানতে এসেছিলো কিন্তু সংকোচ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
“কীরে প্রিয়ম কিছু বলবি?”
“মা আসলে জানতে চাইছিলাম তানি কোথায়?রুমে তো দেখলাম না।কোথাও কি গিয়েছে? ”
“হুমম তানি ওর বাবার বাড়ি গিয়েছে। বলতে গেলে একেবারে চলে গিয়েছে। কারণ তুই নাকি ওকে পছন্দ করিসনা।ওর জন্য তুই কষ্ট পাচ্ছিস।তাছাড়া তুই ওকে নিয়ে খুশি নস তাই হয়তো ও তোকে ডিভোর্সও দিবে।এখন তো তুই খুশি তাই না প্রিয়ম? আসলে আমি ভেবে দেখলাম জোর করে কখনো সম্পর্ক গড়া যায় না। তাই পুরোপুরি নষ্ট হওয়ার চেয়ে মাঝপথে থামিয়ে দেওয়া ভালো।তানি বলেছে তার বাবার সাথে কথা বলে খুব তাড়াতাড়ি ডিভোর্স নিবে।আর যতদিন না হয় ততোদিন সে বাবার বাড়িতে থাকবে।আর কিছু জানার আছে? ”
“মা তুমি কি বলছো?এসব তানি নিজে বলেছে?মা তানি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, মা তানি আমাকে ছেড়ে যাবে? মা আমি তানির সাথে কথা বলতে চাই? ”
এতো প্রশ্ন প্রিয়মের মনের ভিতর ঘুরঘুর করছিলো কিন্তু প্রিয়ম মুখ ফুটে কিছু বলেনি এমনকি হাজার প্রশ্না থাকা সত্ত্বেও সে কিছু জিজ্ঞেস করেনি।নিরবে সে রুমে চলে আসলো।
চলবে…..