প্রিয়দর্শিনী,পর্ব:১০+১১

#প্রিয়দর্শিনী
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_১০
🍁
গাড়ি থামার আওয়াজ পেতে যূথী নড়েচড়ে বসল।মাথাটা প্রচন্ড ভার হয়ে আছে।তাঁর ইচ্ছে করছে পুকুরের ঠান্ডা পানিতে দু তিনটে ডুব দিয়ে আসে।একদিকে শরীর চিটচিটে হয়ে আছে অন্যদিকে মাথা ব্যথা।পিটপিট করে চোখ খুলে বুঝতে পারল গাড়ি কোনো নিরিবিলি জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।সে কি এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল?নিশান ভাইয়া তাঁকে একগাদা খাবার দাবার এনে দেওয়ার পর সে অল্প কিছু খেয়েছিল এতটুকু মনে আছে।আজ এত ঘুম কোত্থেকে উদয় হলো।অতিরিক্ত ঘুমানোর কারণেই বোধ হয় মাথাটা এমন ঝিম মেরে আছে।

‘ অবশেষে ঘুম ভাঙলো?’

পাশ থেকে অতি পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে ঘাড় ঘুরাল যূথী।নিশান ক্লান্তিভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে।গায়ের আকাশী কালার শার্টটা এখন পুরোপুরি ভেজা।এই লোক এত ঘামে কেনো কে জানে।অতিরিক্ত সুদর্শন মানুষের গরম বেশি লাগে বোধ হয়।

নিশান বের হয়ে যূথীর পাশের দরজাটা খুলে দিলো।যূথী ধীরগতিতে বাইরে আসলো। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন তাঁর মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল।গাড়ির দরজাটা ধরতে গিয়েও ধরতে পারল না।তবে নিশানের হাতটা শক্ত করে খামচে ধরল।

যূথীর এমন অবস্থা দেখে নিশান তাড়াতাড়ি ওকে হাত বাড়িয়ে আগলে নিল।যূথী পুরোপুরি জ্ঞান হারায় নি তবে শরীর ভীষণ দুর্বল যার জন্য চোখ দুটো নিভু নিভু হয়ে আছে।
নিশান যূথীর গালে হালকা চাপড় মেরে বলল,

‘ যূথী! ঠিক আছো?শরীর খারাপ লাগছে?’

যূথী প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিশানের বাহু থেকে নিজেকে ছাড়ানোর কিন্তু শরীরে বল পাচ্ছে না।রাস্তার মধ্যে এভাবে কোনো ছেলের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে লোকে কি ভাববে?
যূথী দুর্বল গলায় বলল,

‘ ঠিক আছি।আমরা কি এসে গেছি?তাহলে আমাকে ভেতরে নিয়ে যান প্লিজ।’

নিশান যূথীকে বাড়ির গেইট পেরিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল।যূথী ভালো করে তাকাতেও পারছে না।আবছা দৃষ্টিতে দেখল সুবিশাল দোতলা একটি বাড়ি পাহাড়সম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।শরীরে দুর্বলতা না থাকলে এতক্ষণে নিশানকে হাজারো প্রশ্ন করে ফেলত কিন্তু এখন সম্ভব নয়।

ডোরবেল চাপতে একটি সুন্দরী তরুণী দরজা খুলে দিল।নিশান অস্থির গলায় বলল,

‘ মনীষা ওকে উপরে নিয়ে যা।শরীর মে বি খারাপ করছে।আম্মু কোথায়?’

মনীষা উত্তর দেওয়ার আগেই নীলুফা চৌধুরী হন্তদন্ত হয়ে নেমে আসলেন।নিশানের কাঁধে যূথীকে মাথা হেলানো অবস্থায় দেখে তিনি ভয় পেয়ে গেলেন।মেয়েটা আসতে না আসতেই কি অসুস্থ হয়ে পড়ল?
তিনি নিশানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘ অতিরিক্ত গরমের কারণে শরীর দুর্বল হয়ে গেছে।আমি ওকে উপরে নিয়ে যাচ্ছি। তুইও নিজের রুমে যা।তোকেও তো ক্লান্ত লাগছে।অনিক হিমেশ ওরা কোথায়?ওঁরা না তোদের সাথেই আসবে বলেছিলি?’

‘ ওরা মেইন রোডে নেমে গেছে।ওখান থেকে নিজেদের বাসায় ফিরে যাবে।’

.

মনীষা এবং নীলুফা চৌধুরী যূথীকে গেস্টরুমে নিয়ে আসলেন।যূথী বহুকষ্টে শক্তি জুগিয়ে বিছানায় বসে পড়ল।নীলুফা চৌধুরী এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে ধরলেন ওর সামনে।
যূথী পানির গ্লাস হাতে নিয়ে বলল,

‘ আমি গোসল করব নীলু চাচী।তাহলে শরীর ঠিক হয়ে যাবে।’

‘ হ্যাঁ ওখানে ওয়াশরুম আছে।যা ঢুকে পড়।’

আধাঘন্টা সময় নিয়ে যূথী গোসল শেষ করে বের হলো।মনে হচ্ছে শরীর থেকে শ কেজি ওজনের বস্তা নেমে গেছে।ছোট ছোট চোখ নিয়ে সে রুমে নজর বুলাল।রুমের প্রত্যেকটা আসবাবপত্র পরিপাটি করে সাজানো।এখানে সেখানে ফুলসহ ফুলদানি উঁকি মারছে।বিছানার চাদর টানটান।এমন মখমলের মত বিছানা দেখে যূথীর ঘুমঘুম ভাবটা আরো বেড়ে গেল।সব চিন্তা বাদ দিয়ে সে ধপ করে শুয়ে পড়ল বিছানায়।

কিছুক্ষণ পর নীলুফা চৌধুরী হাজির হলেন রুমে।তিনি এসেছিলেন যূথীকে ডিনার করার জন্য ডাকতে
কিন্তু যখন দেখলেন মেয়েটা গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে তখন আর ডাকলেন না।বেচারি বোধ হয় এত লম্বা জার্নির ধকল সহ্য করতে পারেনি। ঘুমোচ্ছে যখন আর না জাগানোই ভালো।তিনি নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে।

.

ডিনার শেষে লম্বা করিডোর দিয়ে হেঁটে নিজের রুমে যাচ্ছিল নিশান।বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা যার যার ঘরে।তাই একতলা দোতলা এখন নিস্তব্ধ।এই সময়টা নিশানের বেশ পছন্দ। কোনো হৈচৈ নেই,কোনো হল্লা নেই।গভীর মনযোগে কাজ করা যাবে।এমন উদ্দেশ্য নিয়েই হেঁটে যাচ্ছে সে।হঠাৎ করে গেস্ট রুমের দরজা খোলা দেখে সেখানে নজর গেল তাঁর।অন্যদিন তো এই রুমের দরজায় তালা মারা থাকে।আজ দরজা হা করে খোলা সাথে আবার টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে।

কোনোকিছু না ভেবে নিশান সটান রুমে ঢুকতেই থমকে গেল।ছোট্ট বেড়াল ছানার মত ঘুমিয়ে আছে যূথী।লম্বা ভেজা চুলগুলো বিছানা ছাড়িয়ে মেঝে স্পর্শ করছে।চুল থেকে টপটপ করে গড়িয়ে পড়া পানি বিন্দু বিন্দু হয়ে জমা হচ্ছে ফ্লোরে।সাধারণ এই দৃশ্য নিশানের চোখে অসাধারণ হয়ে ঠেকছে।
নিশান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যূথীর দিকে।সারাদিন বকবক করা মেয়েটা এখন কেমন শান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে। কাল সকাল হতে না হতেই নিশ্চয়ই আবার কথা বলার মেশিন চালু করে দিবে।
মুচকি হেসে বেরিয়ে গেল নিশান।সে তো এক মুহূর্তের জন্য ভুলেই গেছিল যূথী এই বাড়িতে আছে।নাহলে গেস্ট রুমের দরজা খোলা দেখে সেখানে আর উঁকি দিত না।

__________________________

পরদিন সকালে আড়মোড়া ভেঙে চোখ খুলল যূথী।হঠাৎ কালো কুচকুচে রঙের দুটো মাথা দেখতে পেয়ে বিকট এক চিৎকার দিয়ে বিছানা থেকে নেমে গেল সে।ওর ভয়ানক চিৎকারে মাথা দুটোও তাঁর থেকে দূরে ছিটকে গেল।
যূথী আতঙ্কিত চেহারা নিয়ে সামনের দুজন ব্যক্তিকে দেখে যাচ্ছে। কালো রঙের মাথার মালকিনরা বলল,

‘ কুল কুল যূথী! আমরা ভুত…সরি পেত্নী নই।আমরা এই বাড়িরই মানুষ।’

যূথীর অস্থির চাহনি এবার শান্ত হলো।গায়ের উড়না ঠিক করতে বলল,

‘ মানুষ তো বুঝলাম কিন্তু মুখে এমন কালি মেখে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?তোমাদের বাড়িতে কি সকালবেলা কালি মেখে ঘুরঘুর করার নিয়ম আছে?’

যূথীর কথায় খিলখিল করে হেসে উঠল মেয়ে দুটো।যূথী নাক সিটকে বলল,

‘ থেমে যাও।কালো কুচকুচে চেহারায় সাদা ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসছো এতে আরো বিশ্রি দেখাচ্ছে। ‘

‘ যূথী আমরা ফেইস প্যাক লাগিয়েছি তাই আমাদের মুখ এমন কালো দেখাচ্ছে।আর তুমি কিনা……’

মেয়ে দুটো আবার হাসিতে ফেটে পড়ল।দেখে মনে হচ্ছে বহুদিন পর তাঁরা এমন প্রাণখোলা হাসি হাসছে।যূথীর একটু রাগ হলো।মেয়ে দুটো তো একটু আগে তাঁকে জানে মেরে ফেলতে যাচ্ছিল।ঘুম থেকে উঠেই যদি কেউ এমন আলকাতরার মত মুখ দেখে তাহলে কি হার্ট অ্যাটাক করার কথা নয়?

‘ যূথী আমরা তো তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম কখন ঘুম থেকে উঠবে।কাল রাতে তুমি ঘুমিয়ে গেছিলে তাই আর পরিচয় হয়নি।বায় দ্যা ওয়ে, আমি মনীষা আর ও হলো বিদীষা।বিদীষা আমার এক বছরের জুনিয়র।আমরা নিশান ভাইয়ার চাচাতো বোন।’

‘ তোমাদের নাম গুলো খুব সুন্দর। কিন্তু এমন ভয়ানক চেহারা নিয়ে পরিচিত হলে যে আমি একটুর জন্য জ্ঞান হারাই নি।’

‘ সিরিয়াসলি যূথী!হাহাহা…’

যূথী কিছু বলতে নিবে এমন সময় রুমে নিশান প্রবেশ করল।সে যূথীর দিকে একঝলক তাকিয়ে মনীষা এবং বিদীষার দিকে তাকাতেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল।ধমকে উঠে বলল,

‘ তোদের বলেছিলাম না এই চেহারা নিয়ে আমার সামনে কখনো আসবি না!তোদের এই মুহূর্তে কেমন লাগছে জানিস?দুই দুটো জলজ্যান্ত বন্য প্রাণী।’

প্রত্যক্ষভাবে এমন গা জ্বালানো অপমান শুনে দুবোনের ভাবভঙ্গি কেমন হলো তা ফেইসপ্যাকের জন্য ঠাওর করা যাচ্ছে না।কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই মনীষার তীক্ষ্ণ কন্ঠ শোনা গেল।

‘ আমরা তোমার সামনে যাই নি বরং তুমিই এসেছো আমাদের সামনে।’

‘ তাহলে আজ থেকে মাথায় ঢুকিয়ে নে মুখে এইসব ছাইপাশ লাগিয়ে রুম থেকেই বের হবি না।আর এই যে মিস যূথী!’

যূথী এতক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল নিশানের দিকে।হঠাৎ করে নিশান ডেকে উঠায় অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল।নিশানের এমন ঘুমঘুম ভরা চেহারা দেখে সে দ্বিতীয়বারের মত অভিভূত হলো।যূথী ভেবে পায় না ঘুম থেকে উঠার পরই কি এই লোকের মুখে দুনিয়ার সব মায়া এবং সৌন্দর্য এসে জমা হয়!

‘ জ্বি..জ্বি নিশান ভাইয়া!’

‘ নাশতা করে রেডি থাকবে।খালামণি আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিল আমি নিজে গিয়ে যেন তোমাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে তোমার জন্য ভালো হোস্টেলের ব্যবস্থা করে দিই।সো কুইক নিচে গিয়ে নাস্তা শেষ করো।’

যূথী মাথা নাড়তে নিশান বেরিয়ে গেল।তাঁর মন কিছুটা খারাপ হয়ে গেল।হোস্টেলে গেলে তো নিশান ভাইয়াকে সে প্রতিদিন দেখতে পাবে না।নিশান ভাইয়ার গলার কন্ঠ শুনতে পারবে না।কি করে থাকবে সে?এ কেমন দোটানায় ফেঁসে গেল ?নাফিজ ইমতিয়াজ নিশান’কে নিয়ে তাঁর এই ছোট্ট হৃদয়টাতে প্রতিনিয়ত কেমন অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে এগুলো?এই অনুভূতির নাম কি?

চলবে…

#প্রিয়দর্শিনী
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_১১
🍁
মনীষা এবং বিদীষার সাথে সিড়ি দিয়ে নামছে যূথী।কাল রাতে শরীর খারাপ থাকার কারণে তো বাড়িটা ভালো করে দেখাই হয় নি।কিন্তু এখন সে অবাকের উপর অবাক হচ্ছে। নিশান ভাইয়ারা এত সুন্দর বাড়িতে থাকে এটা সে জানতো না।বাড়ির প্রতিটা দেয়াল শুভ্র হওয়ায় তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে।
মনীষা এবং বিদীষার দিকে তাকাল যূথী।দুই বোন দেখতে নায়িকাদের মত।অবশ্য হবে নাই বা কেনো!শহরের মেয়ে বলে কথা।ফেইসপ্যাক হতে শুরু আরো কি কি শরীরে মাখে কে জানে।
ফেইসপ্যাকের কথা মনে হতেই যূথী মনীষাকে প্রশ্ন করল,

‘ আচ্ছা নিশান ভাইয়া তখন তোমাদের কালো মুখ…মানে ফেইসপ্যাক দেখে এত রেগে গেল কেনো?’

‘ রাগবেই তো।আজ সকালে তোমার সাথে যে কাজটা আমরা করেছি অর্থাৎ ভয় দেখানোর জন্য যেভাবে তোমার উপর ঝুঁকে ছিলাম এই কাজটা ভাইয়ার সাথেও করেছি।তুমি জানো ভাইয়ার চেহারার রিয়্যাকশন কেমন ছিল!যদিও বেশি ভয় পায়নি কিন্তু সমস্ত মুখ আতঙ্কে সাদা হয়ে গেছিল।সে নিশ্চিত ভেবেছিল কোনো আত্মা ওকে আক্রমণ করেছে।এরপর থেকেই আমাদের ফেইসপ্যাক লাগানো অবস্থায় দেখলে ভাইয়া রেগে যায়।’

যূথী হা হয়ে রইল।দুই বোন তো ভীষণ বিচ্ছু।এমন হাস্যকর আইডিয়া ওদের মাথায় আসলো কিভাবে?যূথী জিজ্ঞেস করল,

‘ নিশান ভাইয়া কি খুব রাগী মানুষ?’

‘ অতটাও রাগী নয়।যখন মন ভালো থাকে তখন ওর সাথে সব ধরনের মজা মাস্তি করা যায়।কিন্তু যেদিন মেজাজ খারাপ থাকে ওইদিন তো চোখের দিকেও তাকানো যায় না।কিন্তু যূথী তুমি হোস্টেলে কেনো থাকতে চাইছো?তুমি আমাদের সাথে থাকছো না কেনো?’

যূথীর ভেতরের জ্বালাপোড়ার ক্ষতটা আবার নাড়াচাড়া দিয়ে উঠল।তাঁর মন যে এভাবে পাল্টি খেয়ে নেবে তা তো বুঝতেই পারেনি।হোস্টেলে সে কি করে থাকবে!কেনো সে এমন সিদ্ধান্ত নিতে গেল?নিশান ভাইয়াকে একদিনও না দেখে থাকতে পারবে না।ওই লোকটা তাঁকে অজানা এক মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছে।দূরে যাওয়ার কথা মনে হলেই কেমন একটা চাপা কষ্ট হয় হৃদয়ে।কিন্তু এখন সে কি করবে!

.

নাস্তা শেষে নিশান বেরিয়ে পড়ল যূথীকে নিয়ে।কলেজের স্টাফ নিশানের পরিচিত হওয়ায় খুব সহজেই ভর্তির ঝামেলা মিটে গেল।এবার ভালো কোনো হোস্টেল দেখার পালা।এটাও নিশান বেশ দক্ষতার সাথে সমাধা করে ফেলল।যূথী শুকনো মুখে চুপচাপ সব দেখে যাচ্ছে। মুখ ফুটে যে কিছু বলবে সেই উপায়ও নেই।

যূথীকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে গাড়ি স্টার্ট দিল নিশান।কিছুদূর যেতেই আটকে পড়ল চিরায়ত জঞ্জাল ট্রাফিক জ্যামে।নিশানের মেজাজ বিগড়ে গেল।এমনিতেই অফিসে কাজ জমে আছে প্রচুর।কাজের প্রেশারে তাঁর মাথা হ্যাং হয়ে যাবার জোগাড়।

যূথী আড়চোখে নিশানের আপাদমস্তক দেখে নিল।লোকটার চোখেমুখে একঝাঁক বিরক্তি।মনে হচ্ছে যেন এক্ষুনি গিয়ে জ্যামে আটকে থাকা গাড়িগুলোকে ভেঙে চুরমার করে দিবে।মলিন হাসলো যূথী।ভাবছে এই লোকটা কি শুধু অপরাধীদের কর্মকান্ড বিশ্লষণ করতে পারে? পাশে বসে থাকা নিশ্চুপ মেয়েটা যে তাঁকে ভেবে প্রতি মুহূর্তে ধুঁকে ধুঁকে মরছে সেই মেয়েটার মন বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা নেই কেনো উনার?
নিশানের থেকে মাথা ঘুরিয়ে নিল যূথী।ওইদিকে তাকিয়ে থাকার শক্তি নেই তাঁর।চোখ দুটো বড্ড জ্বালা করছে।

‘ মন খারাপ?’

পাশ থেকে নিশানের ভারী গলার প্রশ্ন শুনে আবার সেদিকে তাকাল যূথী।নিশানের চোখের দৃষ্টি সামনের দিকে।বলিষ্ঠ হাত দুটো গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে আছে শক্ত করে।
যূথী চরম সত্য কথাটিকে অস্বীকার করে কৃত্রিম হেসে বলল,

‘ নাতো! মন ভালো আছে আমার।’

‘ আজ রাতেই সবকিছু গোছগাছ করে রাখবে।কলেজ থেকে যেহেতু আমাদের বাড়ি অনেকটা রাস্তা তাই তোমার কালকেই হোস্টেলে উঠে গেলে ভালো হবে।’

যূথী চোখ বন্ধ করে তপ্ত শ্বাস ফেলল।কিছুক্ষণ নীরবতার পর হঠাৎই বলে উঠল,

‘ কাল আপনি আমাকে হোস্টেলে দিয়ে আসবেন।’

নিশান ভ্রু কুঁচকে তাকাল যূথীর দিকে।কিন্তু যূথী পুনরায় নির্লিপ্ত গলায় বলল,

‘ না মানে অফিস যাওয়ার পথে আমাকে না হয় হোস্টেলে নামিয়ে দেবেন।’

নিশান কোনো উত্তর দিল না।জ্যাম ছেড়ে দিতেই গাড়ি স্টার্ট করল।যূথী অনুভব করল নিশান প্রচন্ড স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে। বোধ হয় কোনো কারণে রেগে গেছে।যূথীর মন খারাপের পাল্লা আরেকটু ভারী হয়ে গেল।

গাড়ি থামল একটা বড় শপিং মলের সামলে।নিশান নেমে এসে যূথীর পাশের দরজা খুলে দিল।চারদিকে অবাক দৃষ্টি ছড়িয়ে যূথী জিজ্ঞেস করল,

‘ এত বড় শপিংমল। কিন্তু আমরা এখানে কেনো আসলাম।’

‘ খালামণি বলেছিল ঢাকায় ফিরেই যেন তোমাকে ফোন কিনে দেই।কথা না বলে শুধু ফলো করো আমায়।’

এটা বলেই নিশান সামনের দিকে হাঁটা দিল।যূথীও বাধ্য মেয়ের মত নিশানের পিছুপিছু চলতে লাগল।শহরের রঙঢঙ সে বিস্ময় নিয়ে দেখছে।চারদিকে এত মানুষজন। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না।সবার চেহারায় কেমন যেন একটা ছটফটে ভাব।শহর বুঝি এমনই হয়।

________________________

রাতে ডিনার করার পর মনীষাদের রুমে বসে আছে যূথী।তাঁর হাতে নতুন মোবাইল। অন্যসময় হলে এই ফোন নিয়ে বাঁধ ভাঙা খুশিতে মেতে উঠত।কিন্তু আজ তা চেয়েও পারছে না।

তাঁর পাশেই মনীষা বিদীষা ভিডিও কলে মাহিরের সাথে কথা বলছে।মাহির হলো নিশানের ছোট ভাই। সে এবার চিটাগং মেডিকেলে থার্ড ইয়ারে পড়ছে।
ওরা তিন ভাইবোন মিলে কিছু একটা নিয়ে হাসতে হাসতে গলে পড়ছে।শুধু যূথীই চুপচাপ বসে আছে এককোণে।

বিদীষা বলল,
‘ মাহির ভাইয়া মিট উইথ যূথী।তোমার খালাতো বোন।সে এখানে মনীষা আপুর কলেজে এডমিট হয়েছে।’

যূথী এবার নড়েচড়ে বসে মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে থাকা সুশ্রী ছেলেটার উপর মনযোগ দিল।সৌজন্যের সাথে বলল,

‘ হ্যালো ভাইয়া! কেমন আছেন?কখনো তো আমাদের বাড়িতে যান নি।আমাকে বোধ হয় চেনেন না।’

.
মাহিরের সাথে দুয়েকটা কথা বলে যূথী মনীষাদের রুম থেকে বেরিয়ে এল।রাত প্রায় বারটার মত বাজে।উপরতলা নিচতলা অনেক আগেই ফাঁকা হয়ে গেছে।ডিনার করার পর কেউ আর বাইরে থাকে না।যূথী ভারিক্কি চালে হাঁটতে হাঁটতে নিজের রুমে পৌঁছালো।হঠাৎ করেই কিছু একটা মনে পড়তেই আবার বের হল রুম থেকে।কাল তো চলে যাবে হোস্টেলে।তখন চাইলেও আর নিশান ভাইয়াকে দেখতে পারবে না সে।

করিডোরের শেষ মাথায় নিশানের ঘর।পা টিপে টিপে হাজির হলো প্রিয় মানুষটার রুমের সামনে।দরজা খোলা দেখে মনটা আনন্দে নেচে উঠল যূথীর। সতর্কতার সাথে উঁকি মেরে দেখল নিশান রকিং চেয়ারে মাথা হেলিয়ে চোখ বুজে আছে।সস্তির নিঃশ্বাস ফেলল যূথী।যাক লোকটা তাহলে ঘুমাচ্ছে।
সে নিশানের সামনে এসে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল নিচে।অপলক তাকিয়ে রইল নিশানের ঘুমন্ত চেহারার দিকে।একসময় বিড়বিড় করে বলতে লাগল,

‘ আমি ফেঁসে গেছি আপনাতে।আপনার সবকিছুতেই আমি বাজেভাবে ফেঁসে গেছি।জানি না এটা কি করে হলো।এমন তো হওয়ার কথা ছিল না।এত অল্প সময়ের মধ্যে কি করে আমার মনে আপনাকে নিয়ে এই উচাটন তৈরি হলো!নিজের থেকে কোনো জবাব পাই না আমি।বলুন এবার আমার কি করা উচিত!’

যূথীর চোখ প্রায় ভিজে উঠল।তাঁর খুব ইচ্ছে করছে নিশানের হাতটা একবার স্পর্শ করতে।কিন্তু কিছু একটা বাঁধা দিচ্ছে তাঁকে।ইস যদি এখানে সারারাত বসে থেকে এই লোকটার ঘুমন্ত মুখটা দেখে কাটিয়ে দিতে পারত তাহলে মনের অস্থিরতা ভাবটা হয়তোবা কমে যেত।মনের বিরুদ্ধে গিয়ে উঠে পড়ল যূথী।হোস্টেলে যাওয়ার জন্য এখনো কিছুই গোছগাছ করা হয়নি।

যূথী বেরিয়ে যাওয়ার আওয়াজ পেতে চোখ খুলল নিশান।মুহুর্তেই চেহারায় ফুটে উঠল কঠোরতার ছাপ।চোখে রক্তিম আভা দেখা যাচ্ছে। চেয়ার থেকে উঠে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে লাথি মারল বেডে।বড় বড় শ্বাস ফেলে মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া রাগটাকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here