প্রিয়দর্শিনী,পর্ব:২৩+২৪

#প্রিয়দর্শিনী
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_২৩
🍁
নিশান তাঁর বন্ধুদের খপ্পর থেকে কোনোরকমে ছাড়া পেয়ে রুমের দিকে রওনা দিল।ছেলেগুলো শয়তানের হাড্ডি।এগুলা এত ঝামলো করবে জানলে ইনভাইট না করলেই ভালো হত।হারামির দল সব।

সিড়ি দিয়ে উঠে নিজের রুমের সামনে যেতে আবার থমকে দাঁড়িয়ে যেতে হলো।দরজার একপাশে মনীষা অন্যপাশে বিদীষা প্রহরীর মত ওঁত পেতে আছে।কি জন্য সেটা নিশান ভালোই বুঝে গেছে।হতাশায় ভরা নিঃশ্বাস ফেলল সে।আজ বউয়ের কাছে পৌঁছতে পারবে কিনা কে জানে।বন্ধুদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে এখন বোনেদের জালে পা দিতে যাচ্ছে।

নিশানকে এগিয়ে আসতে দেখে মনীষা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠল,

‘ অবশেষে তোমার দেখা পাওয়া গেল ভাইয়া।এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমাদের পা শক্ত হয়ে যাচ্ছিল।’

‘ তোদের এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছি আমি?বাড়িতে এত জায়গা থাকতে আমার রুমের সামনে কেনো দাঁড়িয়েছিস?চুপচাপ দুইজন নিজেদের রাস্তায় যা।’

‘ যাব তো।তাঁর আগে আমাদের কিছু টাকা পয়সা দিয়ে দাও।নাহলে কিন্তু তোমার বউয়ের কাছে যেতে দেব না।’

‘ হাউ ফানি।বিয়ে করেছি আমি আর আমাকেই বলছিস বউয়ের কাছে যেতে দিবি না।’

নিশান দুবোনের সাথে বেশ কিছুক্ষণ তর্ক যুদ্ধ চালিয়ে গেল।কিন্তু হার মানতে হলো শেষমেশ।প্রাণপণ চেষ্টা করেও পকেটের তাগড়া নোটগুলোকে বাঁচাতে পারল না।মনীষা বিদীষার হাতে চালান করে দিতে হলো।
রুমে ঢুকতে ঢুকতে নিশান বিড়বিড় করে বলতে লাগল,

‘ মেয়েরা কি করে এত ঝগড়ুটে হতে পারে!’

ফুলে সাজানো বিছানার কাছে এসে তাঁর চোখেমুখে একঝাঁক অবসাদ এসে ভীড় করল।যার জন্য এত যুদ্ধ করে রুমে হাজির হয়েছে সেই মানুষটিই ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে আছে।তাঁর ফুলশয্যার রাত যে এমন পানসে
হবে তা কি আগে ভাবতে পেরেছিল।
শেরওয়ানী খুলে ট্রাউজার্স নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল নিশান।

ঘড়িতে রাত প্রায় একটা বাজতে চলেছে।রুমে জ্বলতে থাকা ক্যান্ডেল গুলো নিভিয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে দিল নিশান।বিছানায় এসে যূথীকে আস্তে করে শুইয়ে দিল ।যূথী কিছুটা নড়েচড়ে উঠল।দেখলেই বুঝা যাচ্ছে মেয়েটা গভীরে ঘুমে কাদা হয়ে আছে।
নিশান যূথীর হাতের মোটা চুরি এবং গলার ভারী গয়না দুয়েকটা খুলে রাখল বেড সাইডের টেবিলে।

যূথীর ঘুমন্ত চেহারা দেখে প্রশান্তির হাসি দিল নিশান।কি মায়াবী লাগছে মেয়েটাকে! যূথীর সাথে প্রথম দেখা এবং এরপর কি কি ঘটনা ঘটেছে সব স্মৃতিচারণ করতে লাগল নিশান।কখনো ভেবেছিল কি এভাবে কাউকে ভালোবাসবে?কি এক অজানা মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছিল তাঁকে।সেই সূত্র ধরে মেয়েটা এখন বউ হয়ে বসে আছে তাঁর ঘরে।সত্যিই মানুষের জীবন এক নিমিষেই পাল্টে যেতে পারে এই কথাটার সত্যটা খুব উপলব্ধি করছে সে।

যূথীর উপর ঝুঁকে এসে কপালে চুমু খেল সে।আস্তে করে বলে উঠল,

‘ আমার বউ!’

কিন্তু পরক্ষনেই আবার অভিমানের বশবর্তী হয়ে মনে মনে বলতে লাগল,

‘ না ঘুমালে চলতো না তোমার!ফুলশয্যার রাতে কেউ জামাইকে ফেলে রেখে এভাবে নাক ডেকে ঘুমায়?’

_________________________

সকালে আলস্যে ভরা আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠল যূথী।শরীরটা বেশ ভার ভার লাগছে।চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসল সে।চারদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে বসে রইল।
কালরাতে রেস্ট নেওয়ার জন্য বিছানায় হেলান দিতে গিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে টেরই পায়নি।গায়ে এখনো বিয়ের লেহেঙ্গা। এজন্যই এত ভারী ভারী লাগছিল।
যূথী রুমের চারদিকে ভালোভাবে নজর দিল।নিশানকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।লোকটা কি রাতে রুমে আসে নি?ধুর এটা কি করে ফেলল সে?নিশান না জানি কি ভেবেছে।বর রুমে না আসতেই সে ঘুমিয়ে পগার পা।কাজটা একদমই ভালো হয় নি।ফুলশয্যার রাত নিয়ে সে কত প্ল্যান করে রেখেছিল।শুধুমাত্র ঘুমের জন্য ভেস্তে গেল সব।

যূথী বিছানা থেকে নামতে যাবে এমন সময় নিশান রুমে ঢুকল।নিশানকে দেখতে পেয়ে আবার স্ট্যাচু হয়ে বসে পড়ল যূথী।হাতে কফির মগ নিয়ে নিশান যূথীর সামনের সোফায় বসল।ভ্রু উঠিয়ে বলল,

‘ ঘুম হয়েছে মহারানী?’

যূথী কি বলবে ভেবে পেল না।কালরাতের জন্য তাঁর বর কি রেগে আছে?মনে মনে সে ঘুমের উদ্দেশ্যে গালি ছাড়ল কয়েকটা।
যূথী মেকি হেসে বলল,

‘ হয়েছে।আপনি কালরাতে কখন রুমে এসেছিলেন?’

‘ যখন তুমি বেঁহুশ হয়ে ঘুমাচ্ছিলে।’

‘ আমি…আসলে কিভাবে যে ঘুমিয়ে ফেললাম…স্যরি।’

‘ স্যরি বলতে হবে না।আজ থেকে প্র্যতেকটা রাতই হবে আমাদের ফুলশয্যার রাত।ভালো হয়েছে না আইডিয়াটা?’

নিশান যূথীর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে চোখ মারল।
যূথী মুখ ভেঙচিয়ে বলল,

‘ অসভ্যমার্কা কথাবার্তা! ‘

‘ তোমার সাথে অসভ্যতামির কিছু করেছি?’

নিশানকে উঠে আসতে দেখে শুকনো ঢোক গিলল যূথী।সে কি আবার রাগিয়ে দিল?
আমতাআমতা করে বলল,

‘ না..আমি বলতে চাইনি।আমি তো…’

নিশান যূথীকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিল।যূথীর উপর ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বলল,

‘ অসভ্যতামি করি?’

যূথীর চোখ বড়বড় হয়ে গেল।হঠাৎ কি থেকে কি হয়ে গেল সে বুঝতে পারছে না।
নিশান যূথীর ঠোঁটে আলতো করে চুমু খেতেই কেঁপে উঠল যূথী।তাঁর ছোট্ট প্রাণটা ধুকপুক করতে করতে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
কোনোরকমে বলল,

‘ সরুন না!’

নিশানের ছোট উত্তর,

‘ না।’

এমন সময় দরজায় কারো নকের শব্দ পেয়ে হুঁশ ফিরল দুজনের।দরজায় ধুমধাম শব্দে কানে তালা লাগানোর উপক্রম।নিশান মুখ অন্ধকার করে উঠে এল বিছানা থেকে।দরজা খুলে মনীষা বিদীষাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ রাঙিয়ে বলল,

‘ আসার আর টাইম পেলি না বিচ্ছুর দল! এভাবে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিলি কেনো?’

দুবোন নিশানকে পাত্তা না দিয়ে পাশ কেটে রুমে ঢুকে গেল।ততক্ষণে যূথী উঠে বসেছে।নিশান খালি কফির মগ নিয়ে চলে যেতেই বিদীষা বলে উঠল,

‘ আমরা কি অসময়ে এসে পড়েছিলাম নাকি ভাবী?ভাইয়া যেভাবে রেগে তাকাচ্ছিল আমাদের দিকে মনে হচ্ছে ওর রোমান্টিক মোমেন্টে এন্ট্রি নিয়েছি আমরা।’

যূথী লজ্জায় লাল নীল হয়ে উঠছে বারবার।ভাগ্যিস ওরা এসে পড়েছে নাহলে কি হতে চলেছিল তখন।

মনীষা যূথীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে ভাবুক হয়ে বলল,

‘ কাল তোমাকে যেভাবে সাজিয়েছিল ঠিক সেভাবেই আছো তুমি।মুখের মেকাপি তুলোনি।কাল ফুলশয্যার রাতে কি করছিলে তোমরা দুজন? কিছু করোনি?’

মনীষার কথায় যূথী হা করে তাকাল।এ কাদের পাল্লায় এসে পড়ল সে।এরা কি মানুষ নাকি এলিয়েন!
বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে মনীষার দিকে ছুড়ে যূথী বলল,

‘ দূর হও অসভ্য ভাইয়ের অসভ্য বোনেরা।’

__________________________

বিয়ের প্রায় এক সপ্তাহের মত কেটে গেছে।নিশানের ছুটি এখনো বাকি আছে।তাই আপাতত সে বাড়িতেই অবস্থান করছে।
যূথীও কলেজ যায় না অনেকদিন হলো।বিয়ের পর তাঁর সবকিছু এত রঙিন লাগে যে পড়ালেখাতে মন বসতেই চায় না।কিন্তু কলেজ যাওয়া দরকার।পড়ায় অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে সে।বিকেলে রুমে বসে এসবই চিন্তা করছিল যূথী।তখনই নীলুফা চৌধুরী হাজির হলেন।শ্বাশুড়িকে দেখতে পেয়ে যূথী বিনয়ের সাথে হেসে বলল,

‘ আম্মু আসো।তুমি ডেকেছিলে আমায়।এখনই যেতাম।তারআগেই তুমি এসে পড়লে।’

নীলুফা চৌধুরী ছেলের বউয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

‘ কোনে ব্যাপার না।কি করছিস বসে বসে?নিশান কোথায়?’

‘ ও বোধ হয় গার্ডেনে আছে।আমি ডেকে দেব?’

‘ না। তোর সাথে কথা ছিল আমার।নিশানের বাবা বলছিল তোদের বিয়ের এক সপ্তাহ কেটে গেছে তোরা বরং কোথাও ঘুরে আয়।এটা নিয়ে নিশানের সাথে কথা বলেছি সকালে।সে বলেছে তোর সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিবে।’

‘ কই তোমার ছেলে আমাকে কিছু বলেনি তো!’

‘ সময় পায় নি বোধ হয়।তুই যেখানে যেতে চাস বলিস নিশানকে কেমন!’

‘ ঠিক আছে আম্মু।’

নীলুফা চৌধুরী চলে গেলেন।যূথী আনন্দে আটখানা হয়ে সারা রুমে পায়চারি করতে লাগল।সে আর নিশান তাহলে হানিমুনে যাবে।ইস! কি মজা হবে তাহলে! যূথী মনে মনে তাঁর শ্বশুরকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালো।

এমন সময় নিশান রুমে ঢুকল।যূথীকে একা হাসতে দেখে অবাক হলো কিছুটা।অতি আদরে মেয়েটা বোধ হয় পাগল হয়ে গেছে।সারাক্ষণ খিলখিল করে হেসে বেড়ায়।এখন তো একা একাই হাসছে।

‘ যূথী!’

নিশানের গলার আওয়াজ পেতে সেদিকে ফিরল যূথী।একলাফে নিশানের সামনে এসে বলতে লাগল,

‘ আমরা ঘুরতে যাব।আম্মু একটু আগে এসে বলে গেছে আপনি আর আমি ঘুরতে যাব।’

নিশান মুচকি হাসলো।এই তাহলে কাহিনী।
যূথীর মাথায় চুমু খেয়ে বলল,

‘ অবশ্যই। কোথায় যেতে চাও বলো!’

‘ আমি কক্সবাজার যাব।কখনো যাই নি।সবাই নাকি দু তিনবার করে গেছে। আর আমি একবারও যায়নি।’

‘ বেশ তো।লাগেজে কাপড়চোপড় রেডি করে রেখো।আমরা কালই রওনা দিব।’

চলবে…

#প্রিয়দর্শিনী
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_২৪ (শেষ পর্ব)
🍁
পরদিন বিকেলের দিকে নিশান এবং যূথী কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে গাড়িতে উঠল।বাড়ির সকলে মেইন গেইটে উপস্থিত হয়েছে ওদের বিদায় জানাবার জন্য। নীলুফা চৌধুরী চাইছিল ওরা সাথে ড্রাইভার নিয়ে যাক।কিন্তু নিশান রাজি হয়নি।সে একাই সবটা সামলে নেবে।অন্যদিকে যূথীর উত্তেজনা দেখার মতো।গতরাতে সে নিজেও ঘুমায় নি নিশানকেও ঘুমাতে দেয়নি।সমুদ্র দেখা নিয়ে বিভিন্ন সাহিত্য ভিত্তিক বক্তব্য শুনতে শুনতে নিশান ক্লান্ত হয়ে গেছিল।কিন্তু যূথীর চঞ্চল চেহারার দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারে নি।

গাড়ি কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর যূথী হঠাৎ বলে উঠল,

‘ একটু গাড়িটা থামান তো! আমরা একটা সেলফি তুলে নিই।’

যূথীর কথায় নিশান চোখ রাঙাল।কিন্তু যূথী তা পাত্তা না দিয়ে বলল,

‘ সেলফি তোলার পেছনে একটা যুক্তিযুক্ত কারণ আছে।প্লিজ থামান না গাড়িটা।’

নিশান গাড়ি থামাল।যূথী নিশানের কাছে ঘেষে ফটাফট সেলফি তুলে নিল কয়েকটা।খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,

‘ এই সেলফি এখন আমি ফেসবুকের স্টোরিতে দিব।জানেন তো আমার ফ্রেন্ড যাদের বিয়ে হয়েছে ওরা হানিমুনে যাওয়ার সময় এভাবে ছবি তুলে আপলোড দিত।এগুলো দেখে আমি হতাশায় ভুগতাম।ভাবতাম আমারও একটা বর থাকলে আমিও এভাবে ঘুরতে যেতে পারতাম।অবশেষে বর তো পেয়ে গেলাম।এখন আমিও ছবি আপলেড দিব। সবাইকে দেখাতে হবে না যে আমিও ঘুরতে যাচ্ছি! এবার বলুন আমার কথাগুলো যুক্তিযুক্ত কিনা!’

নিশান কিছুক্ষণ মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল।কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল তাঁর পাশে বসে থাকা মেয়েটা যূথী।ওর দ্বারা এসব বাচ্চা টাইপের কাজকর্ম অসম্ভব কিছু নয়।কোনোরকমে হাসি চেপে পুনরায় গাড়ি স্টার্ট দিল।

.

ওরা যখন কক্সবাজারের মাটিতে পা রাখল তখন ঘড়িতে প্রায় একটা বাজতে চলেছে।এতক্ষণ ড্রাইভ করে ভীষণ টায়ার্ড লাগছে নিশানের।হোটেলের রুম আগেই বুক করা ছিল তাই এটা নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই।এখন চটজলদি রুমে উঠে যেতে পারলেই হলো।
ঘুমন্ত যূথীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল নিশান।যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন চারপাশ নির্জনতায় ভরপুর।বহুকষ্টে যূথীকে উঠিয়ে হোটেলে ঢুকল নিশান।

পরদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে বিচের উদ্দেশ্যে বেরোলো দুজন।বিচ থেকে হোটেলের দূরত্ব বেশি নয়।তাই পায়ে হেঁটে চলছে ওরা।হোটেলের রুমের বারান্দা থেকে সমুদ্রের দৃশ্য অনেকটাই দেখা যায়।নিশান অনেকবার যূথীকে ডেকেছিল বারান্দায় যাওয়ার জন্য। কিন্তু সে যায়নি।দূর থেকে সমুদ্র দেখে মনের উত্তেজনা নষ্ট করতে চায় না।তাই সকাল হতে না হতেই নিশানের হাত ধরে বেরিয়ে পড়েছে।

সমুদ্রে পৌঁছতে চোখ জুড়িয়ে গেল যূথীর।ঢেউয়ের উথালপাতাল শব্দ মধুর হয়ে কানে বাজছে।শরীরে শিহরণ জাগিয়ে দেওয়ার মত বাতাস চারদিকে।সূর্যের আভা ছড়িয়ে আছে সোনালি চাদরের মত।সকাল হওয়ায় তেমন একটা লোকজন দেখা যাচ্ছে না।তাই সমুদ্রের সবটা ভিউ ভালোমত দেখতে পাচ্ছে।
যূথী চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,

‘ সুন্দর! অসম্ভব সুন্দর। সত্যিই অসম্ভব সুন্দর..! ‘

নিশান মৃদু হেসে যূথীর কর্মকান্ড দেখে চলেছে।বুকের উপর দুইহাত ভাঁজ করে বলল,

‘ অসম্ভব হলে আবার সুন্দর হয় কিভাবে?তোমার বলা উচিত ছিল সম্ভব সুন্দর! ‘

‘ উফ্ থামুন।চলুন না ওইদিকে হাঁটি।’

.

বিচ থেকে ফিরে ওরা দুজন নাস্তা করে হিমছড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল।প্রায় চল্লিশ মিনিটের মত লাগল পৌঁছতে।সেখানে পৌঁছে নিশান যূথীকে একপাশ দাঁড় করিয়ে বলল,

‘ এখানে একটু ওয়েট করো।আমি টিকিট নিয়ে আসছি।’

যূথী বাধ্য মেয়ের মত মাথা নাড়ল।হিমছড়ি আসার তেমন ইচ্ছে ছিল না তাঁর।মন পড়ে আছে সমুদ্রের পাড়ে।যদি আজ সারাদিন সেখানে বসে কাটিয়ে দেওয়া যেত!
নিশান ফিরে এল টিকিট নিয়ে।যূথীর দিকে ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

‘ অনেক উঁচুতে উঠতে হবে কিন্তু! পারবে?’

‘ না পারলে আপনি কোলে তুলে নিবেন।’

‘ তোমাকে কোলে নিতে গেলে হাত-পা ভেঙে এখানেই পড়ে থাকতে হবে।’

‘ একদম ইনসাল্ট করবেন না।রোজ সকালে উঠে মর্নিং ওয়াক জিম এগুলো কিসের জন্য করেন?বউকে কোলে তোলার জন্যই তো নাকি?’

‘ বউকে কোলে তোলার জন্য কিন্তু কোনো আলুর বস্তাকে নয়।’

যূথী রাগে তেতে উঠল।ঘুরতে এসে এভাবে ইনসাল্ট কি মানা যায়?ধপধপ পা ফেলে সে নিশানকে ফেলে এগিয়ে চলল।
নিশান জোর গলায় বলে উঠল,

‘ হ্যালো মিসেস আমাদের এদিক দিয়ে যেতে হবে।ওদিক দিয়ে নয়।’

.

প্রায় বিশ মিনিট ধরে ওরা পাহাড়ের উপর সিড়ি দিয়ে উঠেই চলেছে।যূথীর অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে।জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। একসময় বিরক্ত হয়ে বলে উঠল,

‘ আমার দ্বারা আর হচ্ছে না।উপরে আছেটা কি যে হাজার হাজার সিড়ি দিয়ে রেখেছে?’

নিশান ফিট বডি নিয়ে সিড়ি ভেঙে উঠছিল।যূথীর কথায় পেছন ফিরে বলল,

‘ উপরে ম্যাজিক আছে।দেখতে চাইলে জলদি এসো।আর এত অল্প সিড়ি উঠেই হাঁপিয়ে গেছো তুমি।দেখো ওই যে বাচ্চাটা সে কিরকম লাফাতে লাফাতে উঠছে।’

যূথী মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইল।বজ্জাত লোকটা কি বুঝতে পারছে না তাঁর সত্যিই কষ্ট হচ্ছে।সে কি আর তাঁর মত বডিবিল্ডার যে রোবটের মত ধপাধপ সিড়ি দিয়ে উঠে যাবে।

নিশান যূথীর দিকে হাত বাড়িয়ে কোমল গলায় বলল,

‘ হাত ধরে স্লোলি উঠে আসো বউ। কোনো তাড়া নেই।’

নিশানের মুখে বউ ডাকটা শুনে যূথীর মনের কালো মেঘ নিমিষেই দূর হয়ে গেল।যেন নতুন প্রাণশক্তি ফিরে পেয়েছে।বউ শব্দটায় এত পাওয়ার তা তো জানা ছিল না।তাই দেরি না করে খপ করে নিশানের হাত ধরে পা মেলাল।

উপরে উঠতেই যূথীর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।চারদিকে গাছপালায় ঘেরা পাহাড়ের উপর উথালপাতাল বাতাস।দূর থেকে নীল সমুদ্রের কিনারা নজরে আসছে।নীলের বুকে মুক্তোর মত সাদা জলরাশির ঢেউ।প্রকৃতি এত সৌন্দর্য ধরে রাখে তাঁর মাঝে সেটা এখানে না আসলে সে বুঝতেই পারত না।এতক্ষণ পায়ের হাড়-গোড়ের তেরটা বাজিয়ে এখানে এসেছে সেই কষ্টটা আর মনেই রইল না।

পাশ থেকে নিশান বলে উঠল,

‘ ম্যাজিক দেখলে তো?চলো ওই বেঞ্চে কিছুক্ষণ বসে রেস্ট নাও তারপর চারদিকটা ঘুরে দেখো।’

যূথী হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘ আপনি এখানের সব জায়গা চেনেন।আগে কয়বার এসেছিলেন?’

‘ ভার্সিটি লাইফে বন্ধুদের সাথে প্রায়ই আসতাম।’

যূথী ভাবতে লাগল সে -ই তাহলে একমাত্র ব্যক্তি যে এই প্রথম এখানে পা রেখেছে।সবাই কক্সবাজার হিমছড়ি ঘুরে শেষ করে ফেলেছে।

__________________________

দুপুরে রেস্টুরেন্ট থেকে লাঞ্চ শেষ করে ওরা হোটেলে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিল।বিকেল হতে না হতেই আবার হাজির হলো সমুদ্রের পাড়।সকালে যেমন অপরূপ দৃশ্য দেখেছিল এখন তা আরো মনোমুগ্ধকর!
সূর্য হেলে পড়তে চাইছে নিজ গন্তব্যে।সমুদ্রের পাড় জুড়ে মানুষের চেঁচামেচি, হৈ হল্লা।অনেকেই সমুদ্র স্নানে মেতে আছে।কেউ কেউ আবার ভেজা বালির উপর মনের মাধুরী মিশিয়ে আলপনা আঁকছে।পাশের দোকানগুলোতে অগুনিত মানুষের ভীড়।

যূথী নিশানের হাত ধরে ঢেউয়ের পানিতে সিক্ত হয়ে উঠা বালুর উপর খালি পায়ে হাঁটছে।দূর থেকে উথলে আসা ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে আছে উজ্জ্বল চোখে।মুগ্ধ হয়ে দেখছে সবকিছু। হঠাৎই বলে উঠল,

‘ দেখুন ঝিনুক! ‘

যূথীর কথায় নিশান নিচের দিকে তাকাল।হেসে বলল,

‘ এগুলো অহরহ ঢেউয়ের সাথে আসে।এরচেয়েও বড় আছে।মাঝেমধ্যে জীবিতও দেখতে পাবে।’

যূথী নিচু হয়ে গুটিকয়েক ঝিনুক কুড়োতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।এগুলো সে যত্ন করে রেখে দেবে স্মৃতি হিসেবে।নিশান পকেট থেকে ফোন বের করে যূথীর অজান্তেই কতগুলো ছবি তুলে নিল।সমুদ্রের পাড়ে মায়াবতী এক কন্যা ঝিনুক কুড়োচ্ছে এই দৃশ্যটা তাঁর চোখে আটকে যাচ্ছিল বারবার।

.

কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্য পশ্চিম দিকে ডুবে যেতেই চারদিকে অন্ধকার নেমে আসতে লাগল।নিশান এবং যূথী হাঁটতে হাঁটতে চলে এল অনেক দূর।এখানে তেমন লোকজন নেই।শুধু সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে। সাথে এলোমেলো বাতাস।যূথীর খোলা চুল বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ছে।গলার স্কার্ফটাকে ভালোভাবে পেঁচিয়ে নিল সে।
নিশান বলল,

‘ চলো আরেকটু সামনে যাই।’

‘ কি জোরালো ঢেউ দেখছেন! পড়ে গেলে?’

‘ আমার হাত ধরে থাকো।’

যূথী নিশানের বাহু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পা বাড়াল।ঢেউয়ের স্রোত এবার ওদের হাঁটুর উপর পর্যন্ত উঠে আসতে চাইছে।
নিশান যূথীর কোমড় ধরে মাঝখানের ইঞ্চিখানেক ফাঁকা জায়গাটা পূরণ করে ফেলল।যূথী মিষ্টি হেসে বলল,

‘ জানেন ইচ্ছে করছে এখানে দাঁড়িয়ে আপনার হাত ধরে কয়েকযুগ কাটিয়ে দিই।উপরওয়ালাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই আপনাকে আমার জীবনে এনে দেওয়ার জন্য। ‘

‘ তাই?’

‘ হ্যাঁ।ওই যে কিছুক্ষণ আগে সমুদ্রের বুকে লালচে সূর্যটা ডুবে গেছে তেমনিভাবে আমিও আপনার ভালোবাসায় ডুবে থাকতে চাই সারাজীবন। ‘

নিশান যূথীর কপালে চুমু খেয়ে বলল,

‘ ভালোবাসি বউ।’
যূথী চোখ বন্ধ করে নিশানের কাঁধে মাথা রাখল।

রাতের সমুদ্রের এমন মনোমুগ্ধকর স্বর্গীয় পরিবেশে দুজন ভালোবাসায় মগ্ন নর-নারী তাঁদের প্রেম উজাড় করে দিচ্ছে।দূর থেকে গর্জে উঠা ঢেউয়েরা নিজেদের ছন্দে সিক্ত করে চলেছে তাঁদের।আকাশ জুড়ে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে জোৎস্নার লুটোপুটি খেলা।শোঁ শোঁ করে বয়ে যাওয়া শীতল হাওয়া জানান দিচ্ছে তাঁদের উপস্থিতি।

সমুদ্র এমন ভালোবাসাময় হাজারো দৃশ্যের সাক্ষী হয় প্রতিনিয়ত। কখনো আবার কারো মনভাঙার গল্প শুনে নীরবে নিভৃতে।কারোর চোখের নোনা অশ্রুকে নির্দ্বিধায় মিশিয়ে নেয় নিজের বুকের নোনাজলে। কেউ কখনো তা জানতে পারে না।কিন্তু সমুদ্র ঠিকই তাঁর প্রাণবন্ত ছোঁয়ায় রাঙিয়ে দেয় সকলকে।

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here