প্রিয়দর্শিনী,পর্ব:১৭+১৮

#প্রিয়দর্শিনী
#সামান্তা_সিমি
(#পর্ব_১৭+ #পর্ব_১৮)
🍁
নিশানের রুমের বন্ধ দরজার সামনে যূথী দাঁড়িয়ে আছে।তাঁকে সাহস দেওয়ার জন্য পাশে আছে মনীষা এবং বিদীষা।যূথীর চেহারা এই মুহূর্তে ভীত সঙ্কিত।কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ভয়াবহ একটি মিশনে নামবে।মনীষা যূথীর হাত ধরে বলল,

‘ মন খারাপ করো না যূথী।আশা করি সব ঠিক হয়ে যাবে।আমরা জানি একমাত্র তুমিই ভাইয়াকে মানাতে পারবে।আমার খুবই খারাপ লাগছে যে তোমাকে এই ব্যাপারে কোনো সাহায্য করতে পারছি না।কি করব বলো।ভাইয়ার সামনে গেলেই হাঁটু কাঁপে।’

যূথী মনে সাহস জুগিয়ে নিশানের রুমে প্রবেশ করল।নিশান তখন সোফায় বসে ল্যাপটপে কিছু কাজ করছিল।বলা কওয়া ছাড়া কাউকে রুমে ঢুকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকাল।কিন্তু যূথীকে দেখতে পেয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া না করে পুনরায় কাজে মনযোগ দিল।

যূথী ধৈর্য্য না হারিয়ে এগিয়ে এল নিশান মুখোমুখি। নিশান নির্লিপ্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

‘ কি চাই?’

‘ আপনাকে।’

নিশান ভ্রুকুটি নিয়ে দেখল যূথীকে।

‘ কি উদ্দেশ্য নিয়ে আমার রুমে এসেছো?’
যূথী কাঁদকাঁদ হয়ে বলল,

‘ আপনি কিভাবে পারলেন বিয়েতে রাজি হতে?আপনি জানেন আমি কতটা ভালোবাসি আপনাকে।এরপরেও আপনি আয়োজন করে বিয়ের পিড়িতে বসতে যাচ্ছেন? ‘

নিশান ল্যাপটপ পাশে রেখে দুইহাত একত্রে মুষ্টিবদ্ধ করে বসল।ভাবলেশহীন গলায় বলল,

‘ আমি কি তোমাকে ভালোবাসি?’

যূথী এবার দমে গেল কিছুটা। মাথার ভেতর সাজিয়ে রাখা বাক্যগুলো জট পাকিয়ে যাচ্ছে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

‘ আমার ভালোবাসা কি আপনার চোখে পড়ছে না?’

‘ পড়ছে।যখন থেকে আমার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছো তখন থেকেই চোখে পড়ছে।কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারছি না।এটা বুঝতে পেরেও তুমি জোর করে আমার জীবনে ঢুকতে চাইছো।ভালোবাসা জোর করে হয়?জোর করে যদিও বা তুমি আমার জীবনে আসলে এরপর কি ভালো থাকতে পারবে তুমি?নিজের মাথার বুদ্ধি দিয়েই বিচার করে দেখো যূথী।আই হোপ তুমি সঠিক উত্তর পেয়ে যাবে।’

যূথী মুহূর্তেই নিভে গেল।তাঁর মনে যে আশার আলো ছিল তা ঝাপসা হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। কিছু বলতে চেয়েও নিশানের শক্ত জবাবের কাছে নত হয়ে যাচ্ছে।ভেজা কন্ঠে বলল,

‘ আপনি ঠিকই বলেছেন।জোর করে সব হাসিল করা গেলেও ভালোবাসা পাওয়া যায় না।শুরু থেকেই আমি ভুল ছিলাম।আমার আগেই বুঝা উচিত ছিল ভালোবাসাটা একতরফা হলে কোনো ফায়দা হয় না।’

যূথী বহু কষ্টেও চোখের পানি আটকাতে না পেরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।সামনের সবকিছু ঝাপসা দেখছে খুব।তাঁর বুকে জমানো সব কষ্ট আজ ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে।ভেবেছিল নিশান একদিন না একদিন তাঁর ভালোবাসার কাছে হার মানবেই। কিন্তু সে ভুল ছিল।এখন তো নিজেই নিজের কাছে হার মেনে বসে আছে।

যূথীর চোখে পানি দেখে নিশানের শরীরে হঠাৎ যেন শীতল বাতাস বয়ে গেল।মনে হচ্ছে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এতবড় একটা মেয়ে এভাবে কান্না করলে খারাপ লাগারই কথা।নিশান কিছুক্ষণ ইতস্তত করে কিছু একটা বলতে নিবে এমন সময় যূথী বলল,

‘ আপনাকে আর কিচ্ছু বলতে হবে না নিশান ভাইয়া।আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।আমি আপনার রাস্তায় একটা ঝামেলা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম এতদিন কিন্তু এখন সরে যাব।একতরফা ভালোবাসাটা না হয় একতরফাই থাকুক।এটা আমার কাছে যত্নে তোলা থাকবে।আপনি নিশ্চিন্ত মনে বিয়ে করুন।আমি আর কখনো আপনাকে জ্বালাতে আসব না।কখনো আসব না ভালোবাসার দাবি নিয়ে।বিগত দিনগুলোর জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত নিশান ভাইয়া।কারণে অকারণে অনেক বিরক্ত করেছি আপনাকে।কিন্তু আর নয়।আসছি। ‘

যূথী আর কোনোদিকে তা তাকিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল।দরজার বাইরে দেয়ালে হেলান দিয়ে মনীষা বিদীষা যূথীর জন্য অপেক্ষা করছিল।যখন দেখল যূথী পাগলের মত ছুটে বেরিয়ে এসেছে তখন তাঁরা ভয় পেল কিছুটা।হঠাৎ এমন কি হলো যে মেয়েটার চোখে পানি টলমল করছে !!ওরা দুবোন দ্রুত পা চালিয়ে অনুসরণ করল যূথীকে।

যূথী যাওয়ার পর খোলা দরজার দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইল নিশান।তাঁর মনটা হঠাৎ বিষাদে ছেয়ে গেল।কেন জানি মনে হচ্ছে কোথাও একটা ভুল হয়ে গেছে।বিরাট কোনো ভুল।কিন্তু তা কি করে হতে পারে?যেটা সত্য এবং সঠিক সেটাই তো যূথীকে জানিয়েছে।তাহলে এমন উচাটন লাগছে কেনো।বারবার চোখের সামনে যূথীর কান্নাভেজা চেহারাটা ফুটে উঠছে।যূথী তো বলেছে সে আর কখনো বিরক্ত করতে আসবে না।তবুও কেন এমন জ্বালাপোড়া হচ্ছে হৃদয়ে।
কোনো উপায় না পেয়ে নিশান দুইহাতে মাথার চুল মুঠ করে ধরে থাকল।ভুলটা কোথায় হয়েছো তা সে ধরতে পারছে না।একারণেই মাথার ভেতরটা দপদপ করছে।

অন্যদিকে মনীষা বিদীষা যূথীকে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে পৌঁছল।সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে চারদিকে।ছাদের লাল নীল বাতিগুলো জ্বলছে মিটমিট করে।ক্যাচক্যাচ শব্দ হতেই ওরা দোলনার দিকে তাকাল।যূথী বসে আছে আকাশের দিকে মুখ করে।দুবোন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এগিয়ে গেল সেদিকে।যূথীর কাছ ঘেষে বসে পড়ল।
যূথী শীতল গলায় বলল,

‘ আমি নিজেই নিজের কাছে হেরে গেছি মনীষা।উনার মনে আমার জায়গা নেই একফোঁটাও।এতদিন বৃথা চেষ্টা করে গেছি।উনি আমাকে আজ স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে উনি ভালোবাসে না আমায়।জানো আমিও বলে দিয়েছি উনার রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াব আমি।’

‘ যূথী মন খারাপ করো না।আমার মন বলছে সব ঠিক হয়ে যাবে।মন বলছে তোমরা কোনো না কোনোভাবে এক হবেই।’

‘ না মনীষা। উনি বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন।আমার জন্য যদি একটুও ফিলিংস উনার মধ্যে থাকত তাহলে সেটা আমার চোখে পড়ত।উনার চোখের ভাষা অস্পষ্ট। সেই ভাষা পড়তে সক্ষম না আমি।’

যূথী আবার নীরব হয়ে বসে রইল।দুবোন যূথীকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো বাক্য খুঁজে পাচ্ছে না।তাঁরা কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়ে নি তাই বুঝতে পারছে কোনটা বললে যূথীর মনের ব্যথা কিছুটা কমবে।ওরা দুইপাশ থেকে যূথীকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল।

___________________________

রাতে ডিনার করার জন্য নীলুফা চৌধুরী যূথীকে ডাকতে এসে দেখলেন যূথী হাত-পা গুটিয়ে শুয়ে আছে বিছানায়।তিনি আলতো করে যূথীর মাথায় হাত বুলিয়ে ডেকে বললেন,

‘ ভাত খাবি না?উঠ।সারাদিনের ব্যস্ততায় তোর খবর নেওয়া হয় না।সবাই খাবার টেবিলে হাজির হয়ে গেছে।কিন্তু তুই এখনো শুয়ে আছিস কেনো?শরীর খারাপ করেছে নাকি?’

যূথী মাথার এলো চুলগুলো ঠিক করে উঠে বসল।তখনই নীলুফা চৌধুরী চাপা স্বরে বলে উঠলেন,

‘ একি! চোখমুখ এভাবে ফুলে আছে কেনো?কান্নাকাটি করেছিস তাই না?কি হয়েছে তোর বলতো!’

যূথী বসে রইল চুপ করে।

‘ কিরে বল না।কেউ কিছু বলেছে নাকি।’

‘ চাচী আমি কিছুদিনের জন্য বাড়ি যেতে চাই।তুমি ব্যবস্থা করে দিবে?’

‘ তুই কি বাড়ি যাওয়ার জন্যই এভাবে কান্না করছিলি?’

‘ হ্যাঁ।গ্রামের কথা খুব মনে পড়ছে।আমি কালকেই যেতে চাই।আর একমুহূর্তও এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না আমার।’

‘ আচ্ছা যাবি।কিন্তু আমার কথাটা শোন।সামনের শুক্রবার নিশানের এঙ্গেজমেন্ট ঠিক হয়েছে।মেয়ের পরিবার চাইছে তাড়াতাড়ি বিয়েটা হয়ে যাক।তাই এঙ্গেজমেন্ট হওয়ার কয়েকদিন মধ্যেই বিয়ের তোড়জোড় শুরু করতে হবে।তাই বলছি বিয়ের ঝামেলাগুলো শেষ হয়ে যাক তারপর না হয় বাড়ি থেকে ঘুরে আসবি!আর বিয়েতে তোর চাচী তো আসবেই।তুই চাচীর সাথেই চলে যেতে পারবি।’

নিশানের এঙ্গেজমেন্ট এবং বিয়ের কথা শুনে যূথীর ভেতরের না বলা কষ্টগুলো আবার নাড়াচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে।কোনোরকমে বলল,

‘ নাহ্ আমি কালই বাড়ি যেতে চাই।আমি না হয় দুচারদিন থেকে এঙ্গেজমেন্টের আগেই চলে আসব।’

নীলুফা চৌধুরী অবশেষে যূথীর জেদের কাছে হার মেনে পরদিন বাড়ি পৌঁছে দেওয়ায় রাজি হলেন।

যূথী নীলুফা চৌধুরীর পিছু পিছু ডাইনিং টেবিলের কাছে হাজির হলো।সেখানে সকলের মাঝে নিশানকে বসে থাকতে দেখে খাওয়ার ইচ্ছেটাই মরে গেল।পরক্ষণেই মনে হল আজকের রাতটাই তো এরপর আর এই চেহারাটা দেখতে পারবে না।এই চেহারা এবং চেহারার মানুষটা হয়ে যাবে অন্যকারোর।প্রিয় মানুষটাকে অন্যকারো হতে দেখা এরচেয়ে আফসোসের ঘটনা বোধ হয় প্রকৃতিতে নেই।বেছে বেছে এই ঘটনা কি তাঁর সাথেই হওয়ার ছিল?

_______________________

পরদিন বিকেলে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসল নিশান।তাঁর মনে মাথায় খুব অস্থিরতা বিরাজ করছে।অফিসে সমস্ত কাজ ফেলে বাড়িতে কেন অকারণে হাজির হলো তা বুঝতে পারছে না।মন চাইছিল বাড়ি যেতে হবে তাই সেও ছুটতে ছুটতে চলে এসেছে।কিন্তু বাড়িতে আছেটা কি?

নিশান দশমিনিটের মত রকিং চেয়ারে ঠায় বসে রইল।একটু পর পর কপাল ঘষে যাচ্ছে বাম হাতের মধ্যমা এবং তর্জনী আঙুলের সাহায্যে।একপর্যায়ে পকেট থেকে ফোন বের করে মনীষার নাম্বারে ডায়াল করল।তিনবার রিং হতেই মনীষা কল রিসিভ করে বলল,

‘ ভাইয়া তোমাকে তো কিছুক্ষণ আগে বাড়িতে ঢুকতে দেখলাম।তুমি বাড়িতে থেকেও কল দিচ্ছে কেনো?আমি তো আমার রুমেই আছি।’

মনীষার প্রশ্ন গুলো এড়িয়ে নিশান দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করল,

‘ যূথী কোথায়?’

‘ কেনো ভাইয়া হঠাৎ যূথীকে…’

‘ তোকে জিজ্ঞেস করেছি যূথী কোথায়?’

‘ যূথী আজ সকালে গ্রামের বাড়ি চলে গেছে।তুমি অফিসে যাওয়ার পর ড্রাইভার আঙ্কেল ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে। ‘

নিশান কল কেটে হাতের ফোনটাকে আছড়ে ফেলল বিছানায়।

.

রাতের আঁধারে বারান্দায় সিগারেট হাতে বসে আছে নিশান।সিগারেটে একেকটা টান দিয়ে শূণ্যে ধোঁয়া ছেড়ে দিচ্ছে। আজ বহুদিন বাদে এই জিনিসটা হাতে নিয়েছে।টানা তিনটে সিগারেট শেষ করে ফেলেছে তবুও মনের অস্থিরতা কমছে না।চারদিকে সবকিছু কেমন শান্ত লাগছে।যেন তাঁকে ঘিরে বিরাজ করছে একরাশ শূন্যতা।কি যেন একটা নেই।
তাঁর চোখগুলা হয়ে আছে টকটকে লাল।রাগে জিদে এবার জলন্ত সিগারেটটাকে দুমড়ে মুচড়ে হাতের মুঠোয় পুরে নিল।বিরবির করে বলে উঠল,

‘ আমার যা ঠিক মনে হয়েছে আমি সেটাই করেছি মিস যূথী।এখান থেকে চলে গিয়ে ভালোই করেছো।ইন্টেলিজেন্ট গার্ল!’

…………..

#প্রিয়দর্শিনী
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_১৮
🍁
#প্রিয়দর্শিনী
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_১৮
🍁
দুধারে সুপারি গাছে ঘেরা চিকন মাটির রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে যূথী।উদ্দেশ্য শেফালীর সাথে দেখা করবে।গ্রামে এসেছে আজ দুদিন হয়ে গেল এখনো প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর সাথে দেখা করা হয় নি।
বাড়িতে ঢোকার মুখেই শেফালীর সাথে দেখা হয়ে গেল।শেফালী যূথীকে দেখতে পেয়ে আনন্দের সাথে চিৎকার দিয়ে বলল,

‘ তুই কবে এলি রে যূথী?এই মুহূর্তে তোকে দেখে ভীষণ সারপ্রাইজড্ হয়ে গেছি। কিন্তু তুই গ্রামে এসেছিস এই খবরটা আমাকে জানাবি না?’

যূথী মুচকি হেসে চেফালীর হাত ধরে পুকুরপাড়ের দিকে হাঁটতে লাগল।

‘ আমার কথা ছাড়।এখন বল অনিক ভাইয়ার সাথে তোর ব্যাপারটা কতটুকু এগিয়েছে?’

যূথীর কথা শুনে লাজুক ভঙ্গিতে হাসল শেফালী।এমন হাসি দেখে যূথী নিমিষেই বুঝে গেছে ওদের সম্পর্ক অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
শেফালী বলল,

‘ আর বলিস না! ওই ছেলে সারাক্ষণ ফোন দিয়ে জ্বালিয়ে মারে আমায়।ফোনে না পেলে মেসেজের উপর মেসেজ।তুই বল আমি কি সারাদিন ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকি?কথা বলতে গিয়ে কয়েকদিন তো আম্মুর কাছে ধরাও খেয়ে ফেলেছিলাম।সেদিন খুব ভয় পেয়েছিলাম জানিস!ভেবেছি আম্মু হয়তোবা মানতে চাইবে না।কিন্তু অনিকের ভাইয়ার ব্যাকগ্রাউন্ড জানার পর আর অমত করেনি।এখন শুধু আব্বুকে মানানোর পালা।’

‘ কি বলিস!ঘটনা তাহলে অনেকদূর এগিয়েছে।কিন্তু তুই বুঝি এখনো অনিক ভাইয়া বলে ডাকিস্?’

শেফালী উত্তর না দিয়ে দাঁত বের করে হাসল।হঠাৎ যূথীর মনে কালো মেঘ হানা দিল।নিশানের চেহারাটা চোখে ভেসে উঠতে চাইছে বারবার।ওই মানুষটাকে ভোলার জন্যই তো সে গ্রামে এসেছে।কিন্তু গত দুই রাত চোখের পাতা এক করতে পারে নি।

শেফালী যূথীর উদাসীনতা লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করল,

‘ সত্যি করে বলতো কি হয়েছে তোর?হঠাৎ এমন মনমরা হয়ে গেলি কেনো?’

‘ কই কিছু হয়নি তো?চল দীঘির পাড় থেকে হেঁটে আসি।’

‘ মিথ্যে কেনো বলছিস আমায়?এতদিন ধরে তোকে চিনি আমি।তোর চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি কিছু একটা হয়েছে।তাই ভনিতা না করে ফটাফট বলে ফেল।’

যূথী তপ্ত শ্বাস ফেলল।ধীরে ধীরে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল সে।নিশানের বিয়ের খবরটাও খুলে বলল।

সব ঘটনা শুনে শেফালীর মনের ফুরফুরে আমেজটা নষ্ট হয়ে গেল মুহুর্তেই।যূথীকে কি বলে সান্ত্বনা দেওয়া উচিত বুঝতে পারছে না।করুণ চেহারা নিয়ে যূথীর কাঁধে হাত রাখল সে।

‘ তোর মনের বিধ্বস্ত অবস্থাটা বুঝতে পারছি যূথী।কষ্ট পাস না প্লিজ।মনে আশা রাখ।নিশান ভাইয়ার তো এখনো বিয়ে হয়ে যায় নি তাই না?এমনও তো হতে পারে উনি খুব তাড়াতাড়ি তোর ভালোবাসা টা উপলব্ধি করে ছুটে আসবে তোর কাছে।’

‘ তোর কথা শুনে হাসি পাচ্ছে আমার।তোকে তো বললামই আসছে শুক্রবার উনার এঙ্গেজমেন্ট। উনার সময় কোথায় আমাকে নিয়ে ভাবার?’

তখনই মিষ্টি একটা আওয়াজ তুলে যূথীর ফোন বেজে উঠল।ওদের দুজনের আলোচনায় ভাঁটা পড়ল।মোবাইলের স্ক্রিনে মনীষা নামটা দেখে যূথী রিসিভ করল।

‘ হ্যালো যূথী! তুমি আমাকে এভাবে ভুলে যেতে পারলে?সকালে একবার কল দিয়েছিলাম তুমি রিসিভ করোনি।দুপুরেও দিয়েছি বাট নো রেসপন্স! ‘

‘ আসলে গ্রামে থাকলে মোবাইল সারাক্ষণ নিজের সাথে থাকে না তো তাই।’

‘ থাক আর বাহানা বানাতে হবে না।তোমাকে একটা কথা বলার জন্য বারবার কল দিচ্ছি।জানো নিশান ভাইয়া গতকাল…..’

‘ স্টপ মনীষা! তুমি সব জেনেও কেনো উনার ব্যাপারে আমার সাথে কথা বলছো?আমি উনার সবকিছু মন থেকে মুছে ফেলতে চাই।কিন্তু তুমি যদি এভাবে আমাকে মনে করিয়ে দিতে থাকো তাহলে খুব কষ্ট পাব আমি।তুমি কি এটাই চাও?’

‘ আরে যূথী আমার কথাটা শোনো আগে।নিশান ভাইয়া….’

যূথী তড়িৎ গতিতে ফোন কেটে দিল।ভীষণ রাগ হচ্ছে ওর।ওই লোকটা থেকে সে দূরে যেতে চায়।অনেক দূরে।যতটা দূরে গেলে উনার চেহারা ভুলতে পারবে।

শেফালী এতক্ষণে সমস্ত ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পেরে কোমল গলায় বলল,

‘ তোর এমন আচরণ স্বাভাবিক বলে আমি মনে করি।কিন্তু একটাবার মেয়েটার কথা শুনলেও তো পারতি।’

‘ আচ্ছা তুইও তাহলে এখন ওদের দলে চলে গেছিস তাই না?ঠিক আছে গেলাম আমি।তোরা থাক তোদের দল নিয়ে।’

শেফালীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই যূথী বাড়ির উদ্দেশ্যে হনহন করে হাঁটা দিল।শেফালী যূথীর মনের অবস্থা বুঝতে পারছে ভালোভাবে।যূথীর মন এবং মাথা কোনোটাই এখন স্বাভাবিক নেই।তাই মেয়েটাকে কিছুসময় একা থাকতে দিলে ভালো হবে।

.

রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় যূথী মোবাইল চেক করে দেখল মনীষার নাম্বার থেকে চার-পাঁচটা মিসডকল এসেছে।সাথে আননোন একটা নাম্বারও দেখা যাচ্ছে। মনীষার কল সে ধরবে না এটা যেন পণ করে নিয়েছে। মনীষা কি বুঝতে পারছে না যে নিশান নামটা শুনলেই তাঁর প্রচন্ড মন খারাপ হয়।না পাওয়ার কষ্টটা মনের ভেতর জেঁকে ধরে!নাহ্ সে আর কখনোই মনীষার কল ধরবে না।সবচেয়ে ভালো হয় মোবাইলটা সুইচড্ অফ করে রাখলে।যেই ভাবা সেই কাজ।যূথী সাতপাঁচ না ভেবে মোবাইল অফ করে দিল।

___________________________

আরো দুটো দিন কেটে গেছে।যূথী সকলের সাথেই হাসিমুখে কথা বলে।কাউকে তাঁর মনের অবস্থাটা বুঝতে দেয়না।বাইরে থেকে যে কেউই দেখলে বুঝবে এই মেয়েটার জীবনে কোনো দুঃখ নেই।সদা প্রফুল্ল হাস্যরত একজন ছটফটে মেয়ে।

আজ বিকেলে শেফালী জোর করে যূথীকে নিয়ে গেল দীঘির পাড়। যূথী মোটেও আসতে চায় নি।কারণ শেফালীর সাথে থাকলে সর্বদা সে নিশানদের বাড়ির কথা তুলে। কথা গড়াতে গড়াতে একসময় নিশান পর্যন্ত পৌঁছায়।এটা যূথীর মোটেও ভাল লাগে না।খুব রাগ হয় তাঁর।

শেফালী যূথীকে টেনে দীঘির পাড়ের উঁচু ঢিবিটার উপর বসল।দীঘির পানির অর্ধেক কচুরিপানায় ভর্তি।কচুরিপানার ফাঁক গলিয়ে গৃহপালিত হাঁসেরা ভেসে বেড়াচ্ছে শামুক খোঁজার আশায়।পাশের মাঠে ছেলেরা ক্রিকেট গোল্লাছুট খেলায় মত্ত।ওদের চিৎকার চেঁচামেচিতে আশেপাশের পরিবেশ মুখরিত।মাঠ এবং দীঘির মাঝের উঁচুনিচু মাটির রাস্তা দিয়ে দুজন বয়স্ক ব্যক্তি থলে হাতে হাঁটছে।ওরা কিছুক্ষণ কৌতূহলী চোখে ঢিবির উপর বসা মেয়ে দুটোকে পর্যবেক্ষণ করে আবার নিজেদের গন্তব্যে হাঁটা দিল।

শেফালী নীরবতার চিড় ভেঙে সরাসরি জিজ্ঞেস করল,

‘ কি শুরু করেছিস এসব?আর কতদিন এরকম চলবে?’

যূথীর দৃষ্টি টলমলে পানির উপর নিবদ্ধ। হালকা ঝিরিঝিরি বাতাস তাঁর ঘেমে উঠা মুখে শীতল স্পর্শ দিয়ে যাচ্ছে।

‘ কি বলতে চাইছিস?’

‘ এই যে তুই সবার সামনে হাসি হাসি চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস।আর কেউ না বুঝুক আমি বুঝি তোর মনের অবস্থাটা।’

‘ তো তুই এখন আমাকে কি করতে বলিস?মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদাকাটা করব?’

‘ তুই ফোন বন্ধ রেখেছিস কেনো বল।নিশান ভাইয়ার বোন মনীষা আমার সাথে ফেসবুকে কানেক্ট হয়েছে।বলল তোকে নাকি ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না।সে তোর সাথে কথা বলতে চাইছে।আমি এখন আমার ফোন দিয়ে কল দিচ্ছি। নে কথা বল।মনে হয় কোনো জরুরি ব্যাপার।’

‘ দরকার নেই।সে কি বলবে আমি জানি।’

‘ ঘোড়ার ডিম জানিস। এত জেদি কেনো তুই যূথী?সবসময় এত জিদ ভালো নয়।ভালো লাগছে না তোর সাথে কথা বলতে।থাক তুই।’

এটা বলে শেফালী বাড়ির রাস্তার দিকে হাঁটতে লাগল।যূথী অবুঝের মত কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সেদিকে।মেয়েটার হঠাৎ কি এমন হলো।এভাবে রিয়্যাক্ট করল কেনো কে জানে।
মাঠ থেকে হৈচৈ শব্দ আগের চেয়ে তীব্র হয়ে আসছে।ক্রিকেট খেলায় চার ছক্কা জমে উঠেছে বোধ হয়।
যূথীর বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না।চারদিকের কলরব ভালো লাগছে তাঁর।
হঠাৎই,

‘ মোবাইল কি দিয়েছি বন্ধ করে রাখার জন্য? ‘

পরিচিত কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে যূথী চমকে উঠল।এটা কি করে হতে পারে?সেই কন্ঠ এখানে আসবে কোত্থেকে?
পরক্ষণেই অনুভব করল তাঁর পাশে এতক্ষণ যেখানে শেফালী বসেছিল সেখানে কেউ একজন বসেছে।বাতাসের সাথে সেই পরিচিত স্মেলটা নাকে প্রবেশ করছে।যূথীর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার সাহস হচ্ছে না।এই সাঁঝের বেলায় এসব কি ঘটছে তাঁর সাথে?তবে কি কোনো অশরীরী? যূথী ধীরে ধীরে চোখ ঘুরিয়ে পাশে বসা মানুষটার দিকে তাকিয়ে মুহূর্তেই আবার সামনে তাকিয়ে ফেলল।গলা শুকিয়ে আসছে তাঁর।কপালে ঘামের বিন্দুগুলো বড় আকার ধারন করছে।সে কি কোনো হেলুসিনেশন দেখছে নাকি।
কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করল,

‘ আপনি কি সত্যিই আছেন?নাকি আপনি আমার কল্পনা? নাকি কোনো অশরীরী?’

পাশে বসে থাকা ব্যক্তিটি ভ্রু কুঁচকে এতক্ষণ তাকিয়ে ছিল যূথীর ভীত চেহারার দিকে।এবার বাঁকা হেসে বলল,

‘ কল্পনা নই,অশরীরীও নই।তোমার পাশে এই মুহূর্তে মানুষ নিশান বসে আছে।লুক অ্যাট মাই আইজ ডিয়ার।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here