প্রিয় অসুখ ও একাকিনী, পর্ব:২৯+৩০

0
714

#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||২৯তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
নিশা ঘুম হালকা হতেই বেশ ভার অনুভব করে দেহের উপর। ঘুমের রেশটাই কেটে যায় তাতে। চোখ খুললে বুঝতে পারে অহনের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ সে, একদম আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে তাকে। ছেলেটার দেহ থেকে নির্গত তপ্ত বায়ু আছড়ে পড়ছে তার বুকে। আনমনেই ভাবে,

“কী নিষ্পাপ লাগছে অহনকে দেখতে! একদম সম্পর্কের প্রথম দিকের মতোন। সিধাসাধা, প্যাঁচ ছাড়া, বলদ একটা।”

আপনমনেই হেসে উঠে সে। তখনই মনে পড়ে যায় ঝুমকোর বলা কথাগুলো।

নিশা টিভি দেখতে দেখতে পায়ের নখ কাটছিল। সেই সময় ঘরে কোনো কথা বা শব্দ ছাড়াই প্রবেশ করে ঝুমকো। বিদ্রূপের সুরে বলে,

“বাহ! বাহ! কী সুন্দর টিভি দেখা হচ্ছে! এত বেহায়া কেন মেয়ে তুমি? এত কিছুর পরও ফিরে এলে। তাও আবার এই অবস্থায়। অবশ্য চালচুলোহীন মেয়ে, এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক।”

এমনিতেই অসুস্থ থাকায় নিশার মেজাজ খারাপ থাকে সর্বদা। তার উপর এমন কথায় তেঁতে উঠে সে।

“এই মেয়ে আমি যেভাবেই থাকি তোমার সমস্যা কী? ব্লাডি বিচ!”

“বিচ তো আমি না, তুমি। সাথে উইচও। একদম উইচের মতো লাগছে। না, না, লেসবিয়ান লাগছে। নারী রূপী পুরুষ।”

বলেই হিহি করে হেসে দেয়। নিশা কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারে না। তার সবচেয়ে দুর্বল জায়গায় যে আঘাত করেছে ঝুমকো। তার বাহ্যিকতা নিয়ে আজ তার হীনমন্যতার শেষ নেই। যেমনটা একদিন সামিয়াকে সে হেনেস্তা করত, নিচু করত; আজ সে-ই সেভাবে নত।

“ইস্! কী বিচ্ছিরি লাগছে তোমায়! তোমার জায়গায় আমি হলে তো ডুবেই মরতাম। তুমি কি ভেবেছো অহন তোমায় ভালোবাসে বলে দায়িত্ব নিয়েছে?”

মুখ ভেঙচি কেটে,

“এমন রূপ কোন পুরুষ পছন্দ করে? ও তো শুধু নিজের করা ভুল শুধরানোর চেষ্টা করছে, আর যদি পুলিশে রিপোর্ট করে দাও কোনোভাবে তাই-ই এ বাড়িতে রাখছে তোমায়। আর এই যত্নআত্তি কেন করছে শুনো, তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্য।

নাহলে ওর মতোন পলিটিশিয়ান বংশের ছেলে আর এত বড় গুণ্ডা তোমার পিছে ঘুরে? ওর তো বাকি গুণ্ডাদের মতো রাতে একটা, দিনে আরেকটা লাগে।”

“কীহ্! অহন গুণ্ডা? পলিটিশিয়ান বংশের ছেলে?”

“তা নয়ত কী! ও তো কীভাবে যেন তোমায় ফেসবুকেতে দেখে অনেক পছন্দ করে ফেলে, তবে জীবন কাটানোর জন্য নয়। কিন্তু তোমাকে তো এমনে পাবে না, তাই তোমার সামনে সাদাসিধে হওয়ার ভং ধরে, ভেবেছিল বিয়ে করে ব্যবহার করে ছেড়ে দিবে। কিন্তু তুমি ওর স্বপ্ন ভেঙে দিলে। তাই জেদ করে তোমায় তুলে আনে, শুধুই নিজের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য।

তুমিই বলো, এত টাকা-পয়সা ওর, তোমার চেয়ে সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করতে এক পায়ে রাজি। তোমাকে এমন জোর করে রাখার কি দরকার? তুমিও তুমিই, ঐশ্বর্যের জন্য একজনের রক্ষিতা হয়ে পড়ে আছো। ছিঃ! যত্তসব নষ্ট!”

নিশা কথাগুলো মনে করতে করতে ক্রোধান্বিত হয়ে উঠে। নিজের দেহের সকল শক্তি একত্রিত করে এক ধাক্কায় নিচে ফেলে দেয় অহনকে। অহন হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে কী হয়েছে বোঝার চেষ্টা করে। অতঃপর সব বুঝে উঠে নিশার দিকে একপলক কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে উঠে চলে যায়।

অহনের নিস্তব্ধতা গ্রাস করে তার সুন্দরীকে। সে হয়তো ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ার প্রতীক্ষায় ছিল, অভ্যস্ত যে। তাই তো বড্ড নিরাশ হলো, বড্ড!

___

অহন মেজাজ খারাপ করে লিভিংরুমে বসে আছে। নিনাদ যুবকের ফুলিয়ে রাখা মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে এক গাট্টা মারে।

“উফঃ! নিনাদ, জ্বালাস না তো প্লিজ! এমনেই বহুত মেজাজ খারাপ।”

অত্যন্ত বিরক্তি মাখা গলা তার। নিনাদ তার পাশে বসে জিজ্ঞেস করে,

“এবার কী করল তোর জান?”

অহন অত্যন্ত বিরক্তের সাথে ভ্রুঁ কুচকে তাকায় তার পানে। তারপর সবকিছু খুলে বলে একে একে।

“আরে ব্যাটা টেনশন নিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। বাই দ্য ওয়ে পার্টির মিটিং দশটায়। ব্রেকফাস্ট করা হইলে বের হ।”

“হুম।”

অহন চোখে সানগ্লাস, মুখে মাস্ক, গায়ে কালো কোট জড়িয়ে বের হয় যায়। নিনাদ এক গ্লাস পানি পান করে নিজেও উঠে পড়ে সোফা থেকে।

নিশা আপন চিন্তায় মগ্ন হয়ে চুল মুছছিল, দরজায় করাঘাতের শব্দে ধ্যান ভঙ্গ হয় তার। তাকিয়ে দেখে নিনাদ এসেছে। এই মেয়েটাকেও সে ঠিক চেনে না, শুধু নাম জানে। তবে এই মেয়েটিই একমাত্র যার দৃষ্টিতে ঘৃণা বা তাচ্ছিল্য নেই। হাস্যোজ্জ্বল মুখেই স্বাগতম জানায়।

“আপু আপনি? আসেন, আসেন।”

“হুম, আমি। যাকগে আমি ঘুরিয়ে, প্যাঁচিয়ে কথা বলতে পারি না। সোজাসুজিই বলছি। অহনের সাথে তোমার এমন আচারণ মোটেও ঠিক হচ্ছে…”

ক্ষিপ্ত হয় নিশা। কথার মাঝেই বামহাত দেয় সে।

“আপু, ও যা কিছু করেছে তারপরও আপনি…”

“কথার মাঝে কথা বলা আমার একদম পছন্দ নয় নিশা। মাইন্ড ইট। যাকগে যা বলছিলাম। মানছি ও বেশ বড়সড় ভুল করে ফেলেছে, কিন্তু তুমিও দুধে ধুয়া তুলসিপাতা নয়। বরং, তুমি তোমার করা পাপকাজেরই প্রতিক্রিয়া পেয়েছো। তুমি এখন পর্যন্ত একবারও নিজের দোষ স্বীকার করোনি, খালি ওকেই দুষছো। তাও কিছু বলেনি।

একটা ছেলে তোমার জন্য এতকিছু করেছে, নিজেকে বদলে রেখেছে। শুধু তাই না তোমার রাগ, গালাগালি এমন কী চড়-থাপ্পড় সব সহ্য করেছে, তাকে হুট করেই ছেড়ে দিলে। জাস্ট বিকজ অফ মানি? তাও যেমন তেমন ভাবে ছাড়োনি, ভরা মহফিলে অপমান করে ছেড়েছো।

কোন পুরুষ সহ্য করবে বা শোধ নিবে না? হ্যাঁ, সে এক্সট্রিম লেভেলে চলে গিয়েছিল, কিন্তু সে তো এখন অনুতপ্ত, ভালোবাসে আজও তাহলে…? শোনো মেয়ে, অতীত নিয়ে পড়ে থাকলে জীবন চলে না, স্থবির হয়ে পড়ে। বর্তমান নিয়ে সামনে আগাও, সামনে হয়তো উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তোমার অপেক্ষা করছে।”

নিশা চুপ করে সবটা শুনল। তার চোখজোড়া রক্তিম হয়ে এসেছো।
‘আমাদের আশেপাশে এমন কিছু মানুষ আছে, যারা নিজেদের দোষ জেনেও মানে না, বারবার নিজেকে সঠিক প্রমাণ করার এবং সমর্থন করার চেষ্টা করে। আর অন্যের দোষকেই বড় দেখে।’
নিশা সেই দলেরই একজন। নিজের দোষটা দেখেও এতদিন দেখছিল না সে। বরং, শুধু অহনকেই দোষারোপ করছিল। আজ কেউ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ায় মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।

তবুও নিজেকে সমর্থন করতে মুখ খুলল,

“আমার এমন করার পিছনে পরিস্থিতি, অবস্থান এবং সময় দায়ী ছিল। আমি জানতাম অহন নিম্ন মধ্যবিত্ত, বেকার, সেখানে বিয়ে করতাম কী করে ওকে? কোনো ফিউচারই তো ছিল না। আর ঐ বিয়েতে রাজি না হলে বাড়ি ছাড়াও হতে পারতাম। আই হ্যাড নো ওয়ে। তাছাড়া আমি যা-ই করি। আপনার ভাইয়ের মতোন নাটক তো করিনি। ঝুমকো আমাকে সবই বলেছে।”

“আর ঝুমকো? ও কী বলবে তোমায়? আর কীসের নাটক?”

চিন্তার ভাজ পড়ে নিনাদের মুখশ্রীতে। নিশা একে একে সব খুলে বলে। নিনাদ বুঝল না ঝুমকোর এসব বলার কারণ।

“শুনো এখানে পরিস্থিতির কিছু নেই। তুমি ওকে বলেছিলে বিয়ের কথা? ও বলেছিল তোমার দায়িত্ব নিতে পারবে না? আর তুমি শিক্ষিত মেয়ে, তুমি তো নিজেই পারতে নিজেকে সামলাতে। বিয়ে মানসিক এবং শারীরিক সঙ্গ পাওয়ার জন্য করা উচিত, অর্থনৈতিক সাপোর্ট পাওয়ার জন্য নয়।

ফ্যাক্ট ইজ ফ্যাক্ট, ইউ কান্ত চেঞ্জ দ্যাট। তুমি লাক্সারিয়াস লাইফ পাওয়ার জন্যই ওকে ছেড়েছিল। তুমি ভেবেছিলে ওর সাথে থাকলে তা পাবে না। তোমার সাংকেতিক ভাষায় ফিউচার পাবে না ওর কাছে তাই-ই…

আর না জেনে কারো কথার উপর ভিত্তি করে কিছু বিশ্বাস করবা না। ঝুমকো এসব কেন বলেছে তা তো জানি না, সমস্যা নেই জেনে নেব। তবে সবই মিথ্যে।

অহনের বাবা ছিল এই পাড়ার এমপি, আর ঝুমকোর বাবা মানে অহনের ছোট চাচা ছিল মেয়োর। আমার বাবা ছিল তাদের বিশ্বস্ত লোক। বাপ-দাদার আমল থেকেই এ বংশ রাজনীতি করত, বিচার-আচার করত; বংশপরম্পরাতেই সবটা। দিন যত যাচ্ছিল তাদের নাম-ডাকের সাথে শত্রুও বাড়ছিল।

একদিন অহনের মা-বাবা ও চাচা-চাচী এক গাড়িতে করে অনাথাশ্রমে যাচ্ছিলেন বস্ত্র বিল করতে। এক ট্রাক এসে টক্কর মারে তাদের। সবাই এক্সিডেন্ট ভাবলেও আমার বাবা বুঝেছিলেন এটা কোনো শত্রুর কাজ, অহন-ঝুমকোর জীবনটাও ঝুঁকিতে, যেহেতু তাদের পর পার্টির চেয়ারপার্সন তারা। তাই সে অহন ও ঝুমকো ঐ এলাকা থেকে দূরে এখানে নিয়ে আসে। আর নিজে হয় চেয়ারপার্সন, যাতে ঐ লোকগুলোর টার্গেট সরে যায়।

হলোও তাই। আমাকে আর অহনকে বাবা রাজনীতিতে গোপণ ভাবে শামিল করত, বুঝাতে সবকিছু, এভাবে একই সাথে বড় হচ্ছিলাম আমরা। অহনও রাজনীতিতে বেশ পটু হয়ে যাচ্ছিল, গুণ্ডামিও করত টুকটাক যেখানে দরকার হত, কারণ রাজনীতিতে এসব একটু-আধটু লাগেই। তবে অসভ্যতামি কখনো করেনি। তারপর অহন যখন ভার্সিটিতে পড়ে তখনই বাবার উপর হামলা করে কেউ।

বাবা শেষ শ্বাস নিতে নিতে আমায় বলেছিল, অহনের ছায়া হয়ে থাকতে, বড় বোনের মতোন আগলে রাখতে। রেখেছি, রাখছি, রাখব। আমি চিনি অহনকে, ও যেমনই হোক, কোনো মেয়ের দিকে কোনোদিন চোখ তুলে তাকায়নি। আর এসব যে শুনেই বিশ্বাস করলা। বলো তো অহন কোনোদিন তোমার কাছে আসার চেষ্টে করেছে?”

নিশা মাথা ঝাঁকিয়া না বলে। তার মুখশ্রী সম্পূর্ণ থমথমে। নিনাদ মৃদু হাসে।

“তোমার উত্তর তুমি পেয়ে গেছো। আমি যতটুকু তোমাকে অবজার্ভ করেছি তা থেকেই বলছি। খারাপ লাগলে কিছু করার নেই। আমি মনে করি তুমি খুব স্বার্থান্বেষী মেয়ে, প্রচুর প্রাচুর্য, অর্থ, আরেম-আয়েশেরও খাই তোমার আছে, লোভী মেয়ে তুমি। তুমি এসব কিছুকে সম্পর্ক ও ভালোবাসার উর্ধ্বে মনে করো।

হয়তো এর জন্য দায়ী তোমার অতীত। কারণ তোমার অস্তিত্বের ভিত্তি যে সম্পর্কগুলো তা-ই মজবুত ছিল না। তোমার বাবা যে কি না তোমায় সন্তান তো দূরে থাক বোঝা বৈকী কিছু মনে করত না। মা তো জন্মের পর থেকেই নাই। তোমার জীবনের মূল সম্পর্ক ছিল মূল্য ছিল না, তাই সবই তোমার কাছে এখন মূল্যহীনের মতোন।

তবে আমার মনে হয় তুমি অহনকে ভালোবাসো, তা জেনেও মানতে চাও না। ইগো না কীসের জন্য আমি জানি না। মনে রেখো, মানুষের জীবনের ঠিক নেই, এই বেঁচে আছে, পরমুহূর্তেই মৃত্যু। অহনের জীবনের তো আরও ঠিক নেই, শত্রু চারিধারে। জানো কোনো প্রিয় কিছু সারাজীবনকার জন্য হারিয়ে গেলেই তার মূল্য হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। তখন এই মুখটার দর্শন অবধি করার জন্য পুড়বে, পাবে না।

আবার ধরো তুমি মরে গেলে। শান্তি কি পাবে? আজ পর্যন্ত তো আপন কারো সাথে তোমার জীবনে সুন্দর কোনো মুহূর্তই রচণা হয়নি হয়তো। সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না, সুযোগ হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া যায় না। সুতরাং যতটুকু হাতে আসে আগলে নেও। নাহলে পরে আফসোস ছাড়া কিছুই করার থাকবে না।”

বলেই নিশার দিকে তাকায় নিনাদ। মেয়েটার মুখশ্রী ও চোখজোড়া দেখেই বুঝতে পারছে আঘাতটা জায়গা মতোই লেগেছে। অনেক সময় হৃদয়কে আঘাত করা খুব জরুরি, নাহলে ধোঁয়াশা কাটে না, ভুল ধারণা ভাঙে না। সে আলতো হাসি নিয়েই বের হয়ে যায় বেডরুম থেকে। তার এখন অহনের সাথে কথা বলতে হবে।

___

গৌধূলী লগ্ন, রমণীর গাঢ়া গোলাপি লম্বা আঁচল ছাদের উঁচু-নিচু মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। দেখতে রূপকথার কোনো রহস্যময়ী রাজকন্যা লাগছে। আবরারের দৃষ্টি থমকে গেছে, সকল চিন্তা মুছে গেছে, এক শীতলতা অনুভব হচ্ছে নিজের মাঝে। এই রমণী আর কেউ নয় তার স্ত্রী সামিয়া।

সামিয়া একদৃষ্টিতে আবরারের দিকে তাকিয়ে আছে। অবশ্য আবরার বলবে না কি কাব্য বুঝতে পারছে না। কনিফিউজ সে প্রচুর। তার মনে হচ্ছে কল্পনার কাব্য এসেছে, কারণ আবরারের আসার কথা না সব জানার পর। আবার কাব্য তো এমন রঙিন হয়ে আসে না, আসে আলোছায়ার খেলায়। আপন ঘোরেই বলে উঠে,

“আপনি সত্যি এসেছেন তো আবরার? আপনার তো আসার কথা না, আমাদের তো বিচ্ছেদ হওয়ার শুরুয়াত আজ। তবে কি কাব্য এসেছো এতদিন পর আমার দরবারে?”

আবরারের ঘোর ভাঙে সামিয়ার উদাসীন বোলিতে। সে নারীটির দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকায়। ভাবে,

“না, মেয়েটি কোনো অপরাধ করেনি। আমার ভালোবাসার মানুষটিই ভুল ছিল, নড়বড়ে ছিল ভিত্তি। তাই তো মৃদু এক বায়ুতেই ভেঙে গেছে ঐ ভালোবাসার ঘর। বরং, এই নারীটিই না ভালোবেসেছে সর্বস্ব দিয়ে। এতটাই ভালোবেসেছে যে তার চেয়েও অর্থে, সৌন্দর্যে, আচারণে যোগ্য এক সুপুরুষ পেয়েও তাকেই ভালোবেসে গেছে। তবে সেই পুরাতন ভালোবাসা, মূল্যহীন কিছু অতীতের জন্য এই নারীকে কষ্ট দিতে পারবে না, উচিত না, কখনোই না।”

সে ছুটে যেয়ে ভালোবাসার চাদরে জড়িয়ে নেয় নিজের স্ত্রীকে। ফিসফিসিয়ে বলে,

“আবরার হই, কাব্য হই, দুটোই আমি, আর আমি তো শুধু তোমারই। ভালোবাসি জান, অনেক বেশি ভালোবাসি, তবুও তোমার মতো গভীরভাবে না কি জানি না। জানো থাকতে পারিনি একদিনও তোমাকে ছাড়া, পারবও না কোনো দিন। তাই তো চলে এসেছি তোমার কাছে।”

চলবে…

#প্রিয়_অসুখ_ও_একাকিনী ||শেষপর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
কারো ডাকে কাঁচা ঘুমের ঘোর ভাঙে সামিয়ার। চোখ মেলে দেখে আঁধার হয়েছে, সে ছাদের দোলনাতে শুয়ে আছে। তবে কী সবটাই স্বপ্ন ছিল? আশাহত হয় সে।

“কী রে আপু? আর কত ছাদে থাকবি? তোর বর যে এসে বসে আছে। নিচে আয় তো এখন।”

নাদিরা তড়িৎগতিতে কথাটুকু বলেই আবার এক ছুটে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায়। সামিয়া স্বপ্নের মতোন এখন আবার দ্বিধা বোধ করছে। ভাবছে,

“আবরার সত্যি এসেছিলেন না কি আমি স্বপ্ন ওকে দেখেছি? কিন্তু স্বপ্ন কি এত রঙিন, স্বচ্ছ হয়?”

অন্যমনস্ক হয়েই নিচে নেমে আসে সে। ফ্লাটের সদর দরজা খোলা থাকায় আর বেল বাজাতে হয় না। সোজাই ঢুকে যায়। হাসাহাসির আওয়াজে চোখ তুলে তাকাতেই দেখে তার মিনু ফুপি, মিলন ফুপা, বাবা, মা সহ বাকি সবাই সোফায় ও চেয়ারে বসে আড্ডায় মশগুল। আর সেই আড্ডার মধ্যমণি হলো আবরার।

“ঐখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? জামাইয়ের সাথে বস আয়া। ছেলেটা সেই কখন আসছে।”

সামিয়া মলিন হেসে কোনোরকম “হু” বলে ডাইনিংটেবিল থেকে একটা চেয়ার এনে সেখানে বসে। আবার মেতে উঠে সবাই নানা আড্ডায়। আবরার স্বতস্ফুর্ত ভাবে না অংশগ্রহণ করলেও একদম চুপ করে নেই। তবে ঘরে ঢোকার পর থেকে সামিয়ার দিকে ভুলেও একবার চোখ তুলে তাকায় নেই। রমণীর ম্লান মুখটা আরও বেশি ম্লান হয়৷

“আমার মাথা ব্যথা করছে। আমি ঘরে যাচ্ছি।”
মৃদু গলায় বাক্য দুটো উচ্চারণ করেই বসার ঘর ত্যাগ করে সে।

ঘরে আসতেই দেখে ফোনের স্ক্রিন অন করা, আর তাতে ফাহাদের নামটা জ্বলজ্বল করছে।

“৬৭+ মিসডকল!” অবাক হয়ে বিড়াবিড়ায় সামিয়া। কিন্তু বেশিক্ষণ আর বিস্ময়টা ধরে রাখতে পারেনি। কারণ পরমুহূর্তে আবার ফাহাদের কল আসে। কল রিসিভ করতেই ফাহাদ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠে,

“আর ইউ ওকেহ? কল কেন ধরছিলে না? আই ওয়াজ সো ওয়ারিড।”

সামিয়া আলতো হাসে। মনে মনে ভাবে,

“কারো জন্য আমি উদ্বিগ্ন, কেউ আমার জন্য উদ্বিগ্ন। হদিস সে পায় না আমার, আমি হদিস পাই না আরেকজনের। এরই নাম জীবন। যা তুমি দিবে তা-ই ফিরে আসবে।”

“কী হলো? কথা বলছো না কেন?”

হচকচিয়ে উঠি আমি।

“হ-হ্যা? কিছু বললে?”

“শুনোনি বুঝি? না কি শুনেও না শুনার ভান?”

ছোট্ট শব্দহীন নিঃশ্বাস নির্গত হল দেহ থেকে। বিছানা থেকে উঠে বারান্দার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে উত্তর দিলাম,

“যা মনে করো। যতটুকু কল ধরার বিষয়, ফোন ঘরে রেখে ছাদে গিয়েছিলাম।”

“ওহ।”

ফোনের দু’পাশের দুজনের মাঝেই চলল কিছুটা সময় নীরবতা। সে হয়তো বলার কিছু পাচ্ছে না, আর সামিয়ার মাঝে আগ্রহের বা ইচ্ছের অভাব।

“কেন কল করেছিলে?”

অকপট প্রশ্ন সামিয়ার। ফাহাদ ছোট্ট এক শ্বাস ফেলে। সৃষ্টিকর্তার নিকট তার নীরব অভিযোগ, “এত ভালোবাসার পরও কেন সে আমায় ভালোবাসল না একটুও? আমার প্রতি কেন তার এতই অনীহা?” সে তো জানে একই প্রশ্ন সামিয়ারও।

“বিরক্ত হয়েছো না কী? কাজেই কল করেছিলাম। যাকগে কেমন আছো?”

“এসব অহেতুক কথা না বলে সরাসরি কাজের কথায় আসাই মনে হয় ভালো ফাহাদ। গতকালই তো দেখা হলো এখন বলছো কেমন আছো। যা বলার বলে দেও ওত দ্বিধা কীসের?”

“কিছু না, জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে যাচ্ছি। বিয়ে করতে যাচ্ছি। তোমার উপস্থিতি পেলে আনন্দিত হতাম। শেষবারের জন্য কারো হওয়ার আগে তোমায় একপলক দেখে নিতাম। ভেবেছি বিয়ের পর বাবাকে, স্ত্রীকে নিয়ে বাহিরে সেটেল্ড হয়ে যাব।”

“সিদ্ধান্ত নিয়েছো বটে। যা পাওয়ার নয়, তা নিয়ে পড়ে থাকার কোনো মানে হয় না। ভাগ্যে এসেছে তা-ই আগলে নিয়ে ভালো থাকার প্রচেষ্টাই শ্রেয়।”

“তুমি তো পড়েছিলে, আর পেয়েছোও।”

“তাকে নিজের করে পেতে চাইনি কখনো, শুধু অন্যকারো দেখতে চাইনি। ছেড়েই তো দিয়েছিলাম তাকে নিজের মতোন। ভাগ্যই হয়তো সহায় ছিল।”

“হতেই পারে। আচ্ছা, সামনের বৃহস্পতিবার হলুদ। আমাদের গ্রামের বাড়িতেই মানে এই চট্টগ্রামেই। এসো কিন্তু।”

“চেষ্টা করব আসার। তবে…”

“তবে?”

“তবে আমার আসাটা অনুচিত, অমানানসই। তুমিই বলো আমি কী হিসেবে সেখানে যাব? কেউ যদি জানতে চায় কী বলব? তাছাড়া আবরার…”

তখনই নারী কণ্ঠে কেউ বলে উঠে,

“আপনি আমার বড় বোন হিসেবে আসবেন। আমার প্রিয় কেউ হিসেবে আসবেন। আর আমি জানি আবরার ভাইয়া বুঝবে।”

“কিছু মনে করবেন না। চিনলাম না ঠিক?”

“ও আমার হবু স্ত্রী। মনে আছে একবার এক কাজিনের সাথে পরিচয় করে দিয়েছিলাম।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঐ যে ছোট্ট পরীর মতোন মেয়েটা। মাশাআল্লাহ বাচ্চাটা তাহলে এত বড় হয়ে গিয়েছে যে তার বিয়ে।”

“ফাহাদ যদি কিছু মনে না করো, আমি একটু আপুর সাথে কথা বলি একাকি?”

ফাহাদ সায় জানিয়ে সেখান থেকে চলে যায়।

“কেমন আছো আপু?”

“এই তো, ভালোই বলা চলে, খারাপ না। তুমি কেমন আছো পিচ্চি?”

“আলহামদুলিল্লাহ, খারাপ না, কিন্তু এবার মনে হয় ভালো থাকব, ভালো রাখব।”

যদিও সামিয়া কথা বলছে তারপরও বেশ দ্বিধা তার মাঝে। নিজের প্রাক্তনের সবজান্তা হবু স্ত্রীর সাথে কথা বলা কোনো সহজ কথা নয়। হুট করেই সে বলে উঠে,

“তোমার খারাপ লাগছে না আমার সাথে কথা বলতে? রাগ হচ্ছে না আমার উপর? তুমি ভেবো না ফাহাদ এখনো আমার সাথে কথা…”

“আমি সব জানি আপনার আর ওর বিষয়ে আপু। সবটাই। আমি জানি আপনার আর কাব্যের বিষয়ে, যাকে খাণিক মুহূর্ত ভুলানোর দাওয়া ছিল ফাহাদ। পদে পদে মুগ্ধ কাব্যের প্রতি আপনার অবসেশন, ভালোবাসার ধরন দেখে। তাকে পাওয়ার নয় জেনেও ভালোবাসা দেখে।

জানেন তো আমি ছোট থেকেই ফাহাদ ভক্ত। যখন থেকে প্রেম-ভালোবাসা শব্দ দুটির খাণিক গুরুত্ব টের পেয়েছি তখন থেকেই আমি ফাহাদের ছিলাম। সেই ছোট্ট আমি যখন জানতে পারলাম ফাহাদ আপনাকে… আমি সত্যি ভেঙে পড়েছিলাম। আপনাকে খুব বিরক্ত লাগত।

তারপর যখন আপনার প্রেমকাব্যের কথা শুনলাম ফাহাদের মুখ থেকে তখন থেকেই আবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ভেবে নিয়েছিলাম যে যেহেতু আপনি তার জীবনে নেই আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব তার থেকে ভালোবাসা আদায় করার।”

আরও বেশ কিছু ক্ষণ কথা চলল দুজনার মাঝে। তারপর ফাহাদ এসে ফোনটা নিয়ে নেয় সাথী থেকে।

“দেখো আসতে হবে কিন্তু তোমার বেগম জান। আমার জীবনের এই বিশেষ মুহূর্তে তোমার থাকাটা দরকারী।”

“আচ্ছা, আচ্ছা, যাব তোমার বাসায়। ঠিকানাটা পাঠিয়ে দিয়ো। এখন রাখি এশার নামাজ পড়ব।”

সামিয়া কলটা রেখে পিছনে ঘুরতেই ধাক্কা খেলো কারো শক্ত বুকে। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে আবরার। দৃষ্টি নত করে ফেলে পাশ কাটিয়ে যেতে নেয়।

“কার সাথে কথা বলছিলে এতক্ষণ লাগিয়ে? ”

তীক্ষ্ম কণ্ঠ যুবকের। রেগে যে আছে সে বোঝাই যাচ্ছে। আমতা আমতা করে উত্তর দেয়,

“আ-আমি? আ-আমি ফ-ফাহাদের সাথে…”

বলতে দেরি আবরারের কোলে তুলে নিতে না। ঘটনার আকস্মিকতায় যুবতী স্তব্ধ। যেই না বিস্ময় কাটিয়ে কিছু বলবে তখনই আরেকদফা ধাক্কা খায়। আবরার ঠাশ করে বিছানায় ফেলে তাকে।

তার কিছু বলার আগেই চড়া হয় তার উপর। হুংকার দিয়ে বলে,

“কী এত কথা তোমার ঐ ছেলের সাথে? কই এখানে আসার পর থেকে আমাকে তো একবার কল দাওনি?”

অভিমান হয় সামিয়ার। মুখ ঘুরিয়ে সিক্ত কণ্ঠে জবাব দেয়,

“আপনিও তো দেননি। আপনিও তো অনন্যার আপুর সাথে কথা বলেন।”

“তোমার হিংসা হয় না কি?”

“অবশ্যই, আমার স্বামী দিন নাই রাত নাই অন্য নারীর সাথে কথা বলবে তাও যে সে নারী নয় তার অতি ভালোবাসার এক্স, আমি জ্বেয়ালাস বোধ না করে কি আনন্দ বোধ করব? তাহলে তো আমি যখন ফাহাদের সাথে কথা বলছিলাম, তখন আপনিও বেশ আনন্দ বোধ করছিলেন। এজন্য রোজ রাতে আমার কথা বলা উচিত, তাই না?”

চোখ চোখ রেখে বাচ্চাদের মতোন মুখ ফুলিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল সামিয়া। আবরার হাসছিল স্ত্রীর এমন আচারণে, কিন্তু শেষ দু’বাক্য শুনেই থতমত খেয়ে যায় সে।

“এই না। আমি কি বলেছি না কি আমার ভালো লাগে?”

রমণীর ডান হাত ঠিক বুকে ঠেকিয়ে,

“এইখানটায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলে বটে। সবকিছু জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যায় হৃদয়ের।”

“ভালোবাসেন?”

“হুম।”

“সব জেনেও?”

“হুম।”

“আমি মানি না আপনার উত্তর। ডাহা মিথ্যে বলছেন।”

কোনো এক ঘোরেই ‘হুম’, ‘হুম’ বলে যাচ্ছিল আবরার। হঠাৎ সামিয়ার বেফাঁস কথায় হচকচিয়ে যায় সে।

“মানে? কী বলতে চাচ্ছো?”

সামিয়া হাত দিয়ে আলতো ধাক্কায় আবরার সরিয়ে উঠে পড়ে বিছানা থেকে। বেশ গাম্ভীর্যের সহিত বলে,

“আপনি তো এখন সবই জানেন। সত্যি তো এটাই আমি যদি অনন্যা আপুর বাসায় বড়লোক ছেলের প্রস্তাব না পাঠাতাম তাহলে আপনারা আলাদা হতেন না। এখন আপনি ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে আছেন তাই বুঝছেন, রাগছেন না। আবার এও তো হতে পারে আপনি ভেবেছেন এখন অনন্যা আপু বিবাহিত তাকে পাবেন না বলেই বা সহানুভূতি থেকে আমার কাছে ফিরে এসেছেন। হয়তো ভবিষ্যতে আমাদের মাঝে কোনো কলহ বা ছোটখাটো তর্কাতর্কি লাগলে এ নিয়ে খোঁটা দিয়ে বসলেন। জানেন তো রাগের মাথায় হুশ থাকে মনের কথা, ক্ষোভ জাহির হয়ে যায়।”

“আজ কতটা সময় আমরা একসাথে থাকি, এক ছাদের নিচে থাকি। আর তুমি এই চিনলে আমায়!”

“আমি ছোটবেলা থেকে মায়ের খোঁটা, নিশার খোঁটা, এমন কী স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির রুমমেট সহ ক্লাসমেটদের কথা সহ্য করেছি। এমনে তো সহ্য করেছিই আপনাকে ভালোবাসার জন্যও কম কষ্ট পাইনি। নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব এবং আপনার প্রতি অবসেশন থেকেই মানসিক রোগী হয়ে গিয়েছিলাম আমি।

এরপর নিশা সবাইকে বলে বেড়াতো আমাকে জ্বিনে ধরেছে, সে না কি আমার সাথে জ্বিন দেখেছে। কলেজ-ভার্সিটির মেয়েরা তো বিশ্বাস করতই আমার মাও কম ছিল না। জানেন ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার আগের দিন ও বলেছিল বিসমিল্লাহ বলে শলার ঝাড়ু দিয়ে অনেক পিটালে না কি জ্বিন ছুটে যায়। এজন্য মা আমাকে টানা কয়েক ঘণ্টা শলার ঝাড়ু দিয়ে আয়েশ মিটিয়ে পিটায়, রক্তাক্ত করে ফেলে।

পরদিন সারা শরীর ব্যথা আর জ্বর নিয়ে গিয়েছিলাম ভর্তি পরীক্ষা দিতে। এজন্য হারিয়েছি নিজের স্বপ্ন নগরী ঢাবিকে। আমি ক্লান্ত, প্রচণ্ড ক্লান্ত। কারো কটু কথা আমি আর শুনতে পারব না। সারাটা জীবন সবার কথা শুনে এসেছি, বাহিরের মানুষও শুনিয়েছে, সুযোগটা তো আমার আপন মা-ই করে দিয়েছিল।

আমি এট লিস্ট আমার প্রিয় মানুষের মুখ থেকে কটুবাক্য সহ্য করতে পারব না, এর থেকে দূরে থাকা শ্রেয়, মৃত্যু তুল্য বিচ্ছেদ শ্রেয়। আমি চাইলে আগেই আপনাকে নিজের করে পেতে পারতাম জোর করে, তবে করিনি। কারণ আপনার মুখ থেকে কোনো ভালো ভিন্ন কথা শুনতে আমি পারব না। আমার সহ্য ক্ষমতার বাইরে তা। আমি এখনো আপনাকে নিজের করে চাই না, যদি তা আপনার মাঝে আমার প্রতি বিন্দুমাত্র বিরক্তি, ঘৃণা, ক্ষোভ, অভিযোগ সৃষ্টি করে। ভালোবাসাকে ভালো রাখতে আমি দূরত্বে থাকতেও রাজি, সারাটা জীবন একাকিনী হয়ে থাকতেও রাজি।”

আবরার স্তব্ধ হয়ে শুনল সবটা মেয়েটা কী সুন্দর মিনমিন করে নিজের চাপা কষ্টগুলো গোছালো-অগোছালো ভাবে প্রকাশ করে দিল। মেয়েটা আসলেই কী না সহ্য করেছে তার জন্য! এতটা বিশুদ্ধ ভালোবাসা বুঝি তার পাওয়ার ছিল? হ্যাঁ, তার মৃদু রাগ জমেছিল সামিয়ার প্রতি, হালকা ক্ষোভও সব লুকানোর জন্য। আর অভিযোগ? সে তো বেশ। তবে তা এই মুহূর্তে কেন কখনোই সে বিষয়টা জানাতে চাচ্ছে না। একদম নাকোচ করে দিবে সে। ঐ যে যেকোনো ভাবেই সে এই নারীকে নিজের জীবনে বেধে রাখতে চায়।

‘ভালোবাসাকে ভালো রাখতেই অনেক সময়ই অনেক কথা ঢাকতে হয়, অনেক অনুভূতি লুকাতে, সত্যকে মিথ্যে বানাতে হয়। এটা কি ঠিক না বেঠিক তা কেউ ভাবে কি? হয়তো হ্যাঁ, নয়তো না। তবে সবাই যতটুকু সম্ভব সবই করে ভালোবাসাকে ভালো রাখতে।’

“তোমাকে ছাড়া আমি প্রচণ্ড অসহায়। আমার পরিবার, অতি আপনজন বলতে তুমি আর দাদীই তো আছো। আর কে? তোমার প্রতি আমার শুধুই সীমাহীন ভালোবাসা আছে আর কিছু নয়। ভালোবাসি একাকিনী। নিজের একাকিত্ব বিলাসের সঙ্গি করবে আমায়? আমি যে আকুল হয়ে আছি তোমার অপেক্ষায় একাকিনী।”

রমণীর অশ্রুতে টইটম্বুর চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে দুই হাত নিজের হাত জোড়ার মাঝে নিয়ে অনুভূতিপ্রবণ হয়ে কথাগুলো বলেই ফেলল আবরার। তার কণ্ঠ কাঁপছে। কেন কে জানে? সে নিজেও না। তবে তার একটা কথাই মনে আছে, পুরুষ সে, অশ্রু তার জন্য নয়।

সামিয়া লুটিয়ে পড়ল নিজের জীবনসঙ্গীর বক্ষে। বাধ ভেঙে নোনাজলের বান এসেই পড়ল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল নারী। এ কান্না কোনো দুঃখের অসাধ্য সাধনের সুখের।

কাঁদতে কাঁদতে আনমনেই ভাবল,

“আমাকে ক্ষমা কোরো কাব্য। এর চেয়ে অধিক সত্য জানানোর ক্ষমতা আমার নেই। তোমার চোখে আমি ঘৃণা দেখতে পারব না। কিছু কথা বরং বিকৃতই থাক, অজানাই থাক।”

অপরদিকে আবরারের চোখেও অশ্রু সে চেয়েও ঠেকিয়ে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও প্রেয়সীর কান্নায় সেও কেঁদে দেয়। কী এক অদ্ভুৎ বিষয় না! ভালোবাসা বড়োই অদ্ভুৎ!

___

অহন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে নিনাদের কথা শুনে। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না ঝুমকো এমন কিছু করবে। মেয়েটা তার কাছে সেই ছোট বোনটিই আজও।

দুই হাতে নিজের চুল আঁকড়ে ধরে নত দৃষ্টিতে শুধায় সে,

“নিনাদ, ঝুমকোকে ডাক তো।”

ঝুমকোকে নিনাদ জিজ্ঞেস করে সে কেন এ ধরনের কথা নিশাকে বলেছে। ঝুমকো এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, ঝুঁকে আছে তার মাথা। অহন ভাবতেই পারছে না তার বোন এমন কিছু করতে পারে। তার উত্তর না দেওয়াতে বেশ রেগে যেয়ে অহন ধমকিয়ে উঠে,

“কী হলো? কথা বলছিস না কেন এখন? নিশার সামনে যেয়ে তো ঠিকই ফটর ফটর মিথ্যে বলে আসছিস।”

ঝুমকো কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে যেয়ে জড়িয়ে ধরে ভাইকে। বোনের কান্নায় রাগ ধরে রাগ ধরে রাখতে পারে না অহন। রক্তের বন্ধন বলতে এই মেয়েই তো পৃথিবীতে আছে তার। মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে সে,

“আমি তোকে এই শিক্ষা দিয়েছি বল তো বোনা? এই দুই হাতে তোকে মানুষ করেছি। তোর বলার আগেই সবটা হাজির করেছি। তোকে তো মানুষকে সম্মান করা শিখিয়েছি, এমন নিচু আচারণ করা নয়। তবে আমার লালন-পালনে কি ভুল ছিল? ভুল ছিল আমার শিক্ষাদানে?”

“আ’ম সরি ভাইয়া। আমি কী করে… আমি জানি না ভাইয়া আমার তখন এটাই ঠিক… আমি সরি। তুমি নিশাকে নিয়ে আসার পর সবাই কানাঘুঁষা করত তুমি আমাকে আর ভালোবাসবে না। তুমি যদি আমাকে বের করে দাও আমার তো মা-বাবাও নেই, কোথায় যাব আমি?

সবাই বলত বিয়ে করলে ভাই পর হয়ে যায়, ভাবীর গোলাম হয়ে যায়, এখনো বিয়ে করেনি বলে না কি রেখেছো আমায়। বিয়ে করলেই… কিন্তু আমি তো জানতাম তোমরা বিয়ে করছো তাহলে তুমি যদি আমাকে বের করে দাও আমার তো মা-বাবাও নেই, কোথায় যাব আমি?

আবার বন্ধুদের সব খুলে বললে তারা বলল, নিশা না কি অনেক চালাক। তাই তো বংশহীনা হয়েও তোমার মতো ছেলেকে পটিয়েছে। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম ভিষণ। রোজ রোজ এসব শুনে আমি জানি না কীভাবে ওর প্রতি আমার রাগ চেপে যাচ্ছিল। আমি উঠে পড়ে লেগেছিলাম ওকে চলে যেতে বাধ্য করার জন্য। আমি, আমি…”

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কথাগুলো বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে উঠে ঝুমকো। “শান্ত হ, বোনা। কিচ্ছু হয়নি। ভাইয়া কিছু বলেছি তোমায়?” বলতে বলতে শান্ত করে নিজের পাশে সোফায় বসায়।

পরিবারে প্যাঁচ লাগানোর পিছনে অন্যতম দায়ী হলো আশেপাশের মানুষজন।

ঝুমকোর বয়স খুব বেশি না, সতেরোতে পা দিবে কিছুদিন পর। বাবা-মা হীনা মেয়ে, ভাইটাই একমাত্র আশ্রয়। মানুষজনের অহেতুক কথাবার্তা তার মাথায় রীতিমতো আশ্রয় হারানোত ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। সাথে ঢুকিয়েছে নিশার প্রতি এক অকারণের ঘৃণা।

হয়তো আজ সবকিছুর সমাপ্তি হবে না কি কিছুটা রেশ থেকেই যাবে? মানুষ বড়োই জটিল জীব, আর সবচেয়ে জটিল তাদের হৃদয়। এ নিয়ে নিশ্চয়তার সাথে কিছু বলা যায় না সবকিছুই হতে পারে।

কেটে গেছে দুটো দিন। সেদিন নিনাদের সবকিছু স্বচ্ছ করে দেওয়ার পর নিশা ও অহনের মনমালিন্য অনেকটাই দূর হয় এবং সম্পর্ক এখন অনেক স্বাভাবিক। ভাবা যায়, আগামী দিনে তারা একবারে সেই অতীতের প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে উঠবে।

___

নিশুতি রাত বারান্দার মেঝেতে পা মেলে বসে প্রেয়সী চুল নিয়ে খেলায় মশগুল আবরার। তার পায়েই মাথা এলিয়ে চন্দ্র-মেঘের লুকোচুরি খেলা দেখছে সামিয়া।

“আচ্ছা, বাবা তো বলেছিল আপনি গতকাল আসবেন। তাহলে আসলেন না কেন? আজ আসলেন কেন?”

জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকায় সামিয়া। আবরার একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সত্যি বলবে কী? বস্তুত, গতকাল সে সব জানায় ব্যস্ত ছিল। তার চিন্তা-ভাবনা প্রথমে এখানে আসার থাকলেও, পরে ভাবে সব জেনেই সামিয়ার সামনে আসবে সে। আপন মনেই ভেবে উঠে গতকাল রাতের কথা।

গতকাল রাতে,
সামিয়ার নোটবুক পড়েও আবরারের মনে কিছু প্রশ্ন থেকেই যায় তার প্রথমটি হলো সে কখনো কোনো নারীকে এত বাজে ভাবে প্রত্যাখ্যান করেনি, তবে সামিয়া… হুট করেই তার মনে পড়ে অনন্যা তার পেজে এডমিন ছিল। কল করে তাকে।

অনন্যা কিছুটা পুলকিত হয় আবরারের কল পেয়ে। উদ্বিগ্নচিত্তে কল রিসিভ করতেই আবরার আবেদন করে,

“ঘণ্টা খাণেক সময় লাগত তোমার। জরুরি কথা আছে। সময় হবে এখন?”

“হুম, বলো।”

জড়তা স্পষ্ট অনন্যার কথায়।

“তুমি কি কোনো মেয়েকে আমার পেজ থেকে রিপ্লাই দিয়েছিলে বা খুব বাজে কথা বলেছিল আমি হয়ে? এমন কেউ যে আমাকে প্রপোজ করেছিল এবং আমি মানা করার পরও টেক্সট দিয়ে যাচ্ছিল?”

বেশ পুরনো দিনের কথা হলেও অনন্যার মনে আছে। তবে হুট করেই এমন প্রশ্ন কেন কৌতূহল হয় তার।

“হ্যাঁ, একটা মেয়ে ছিল৷ আইডির নাম ছিল একাকিনী। খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিল তোমায় নিয়ে। তুমি তো জানোই আমি তোমার জন্য কতটা পজেজিভ ছিলাম, রেগে গিয়ে অনেক… কিন্তু এতদিন পর হুট করেই এসব জিজ্ঞেস করছো কেন?”

“না, কিছু না।”

আবরারের মনে হলো একবার জিজ্ঞেস করি, মেয়েটি কি সত্যিই অর্থ, প্রাচুর্য দেখে সব ভুলে এগিয়ে গিয়েছিল লোকটির দিকে। সত্যিই কি এই মেয়েটির লোভের কাছে হার মেনেছিল তাদের এতকালের ভালোবাসা? সে যেই জিজ্ঞেস করতে যাবে আবরার কলে শুনতে পায় পুরুষালি কণ্ঠে কেউ বলছে,

“দেখো বউ তোমার জন্য বকুল ফুলের মালা গেঁথে নিয়ে এসেছি। আজ এই মালা পরে তুমি-আমি চন্দ্রবিলাস করব, কারণ পূর্ণিমা তো আজ নেই। আমার থেকে শান্তি, ভালোবাসা না পেয়েই তো মিথ্যে ডিভোর্সের কথা বলে এগিয়ে যাচ্ছিলে প্রাক্তনের দিকে। এবার থেকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসব, তুমিও ভালোবেসো প্রেমিকাদের মতোন, কেমন ? ঠিক যেমন বিয়ে সাথে সাথে আমরা কপোত-কপোতীর মতোন প্রেমে মত্ত হয়ে থাকতাম।”

আবরার কথাগুলো শুনে নিজেই অনুমান করে নেয় তার প্রশ্নগুলোর উত্তর। সাথে সাথেই কলটা ডিসকানেক্ট করে দেয়। আপন মনেই সে ভেবে নেয়,

“যেই মেয়ে স্বামী থেকে ভালোবাসা না পেয়ে ডিভোর্সের কথা বলে তার কাছে আসতে চাইতে পারে, সেই মেয়ে অবশ্যই টাকার জন্য তাকে ছেড়ে অন্যকোনো পুরুষের কাছেও যেতে পারে।”

তারপর তার মনের দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর খোঁজায় মাথা দেয়। তা হলো সে যত টুকু জানে সামিয়ার মানসিক সমস্যা ফাহাদ চলে যাওয়ার পর থেকে। কিন্তু ডায়েরিতে লেখা তারও বেশ আগে থেকে, মানে স্কুল লাইফ থেকে সমস্যা।

অবশেষে দ্বিধা-দ্বন্দে আবরার কল করে সায়রাজ কবিরকে। তিনি কল রিসিভ করতেই আবরার সালাম দেয়, তিনিও সালামের উত্তর দেন।

“আঙ্কেল আপনার আর আম্মার সাথে একটু কথা আছে পার্সোনাল্লি বলল ভালো হতো। আপনার পাশে কি আন্টি ছাড়া কেউ আছে? ”

“না, না, তোমার আন্টি আর আমিই ঘরে বসে আছি। বলো কী বলবে?”

“আঙ্কেল কলটা তাহলে স্পিকারে দিন। আমার কথা আছে।”

“স্পিকারে দিয়েছি। বলো, আমরা শুনছি।”

“আব্বার আমি আপনার থেকে যতটুকু জেনেছি সামিয়ার সমস্যা ফাহাদ ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে, অর্থাৎ চারেক বছর ধরে। কিন্তু সামিয়ার নোটবুকে লেখা আরও আগে থেকে, ফাহাদের সাথে দেখা হওয়ার আগে থেকে…”

সায়রাজ কবির লজ্জায় আড়ষ্ট হন। মেয়ের জামাইয়ের সামনে নিজের বলা মিথ্যে অকপট স্বীকার করা তো আর যায় না। তার লাজ রক্ষা করতে মাঠে নামলেন আলিফা খাতুন।

“বাবা, আসলে ওর যখন হুট করেই এই মানসিক সমস্যা হয় তখন আমরা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কারণ জানাজানি হলে মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি লাগতে পারে ভেবেই পরিচিত এক শিশু ডাক্তার ঘরে এনে দেখাই। উনার দেওয়া মেডেসিন আর রুটিন লাইফ মেইন্টেইন করার পর ভালোই ছিল মেয়েটা।

কিন্তু যখন ফাহাদ ওকে ধোঁকা দেয় তখন থেকে আবার… আরও বেশি সমস্যা শুরু হয়। কারণ মেডসিন খেতো না। এরপর আমাদের চেনা ডাক্তার মনোবিশেষজ্ঞ শামিম সাহেবকে সাজেস্ট করেন। উনিও তাই শুধু অতটুকু মেডিক্যাল হিস্ট্রিই জানে। বিষয়টা উনারও অজানা।

তারপর গ্রামে গেলে তুমি যখন বিয়ের প্রস্তাব দাও, তখন ও মানা করে দিয়েছিল। কারণ ওর ভাষ্যমতে তুমি ওকে সহানুভূতি, দয়া দেখাচ্ছো। তোমার আঙ্কেলও সায় দিচ্ছিল ওকে। কিন্তু আমি মা হয়ে মেয়েকে কীভাবে এমন অবস্থায় দেখতে পারি। তাই অনেকটা জোরাজুরি করেই…”

ছোট্ট এক শ্বাস ফেলে আবরার। মনে মনে বলে,

“আপনি যদি লোকের কথায় কান না দিয়ে একটু বুঝতেন ওকে তাহলে আর এমন অবস্থা হতো না।”

বর্তমানে,

“কী হলো উত্তর দিচ্ছেন না কেন?”

ঝাঁঝিয়ে প্রশ্ন করে সামিয়া।

“তেমন কিছু না একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তাই ড্রাইভ করা সুবিধার মনে হয়নি।”

“আচ্ছা, শুনুন ফাহাদের বিয়ে সামনে যেতে হবে। ও আর ওর হবু বউ সাথী অনেকবার রিকুয়েস্ট করেছে। আপনি একটু সামনের বৃহস্পতিবার আর শুক্রবারের ছুটি নিয়ে নিয়েন হাসপাতাল থেকে।”

“ওকে।”

আবরার তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাল না। যদিও? ফাহাদকে দেখলে তার বেশ ঈর্ষা বোধ হয়। তবুও ছেলেটা ভালো মনের তা সে মানে।

“আচ্ছা, বালিকা একটা কথা বল তো তুমি ঠিক আমার প্রেমে পড়েছিলা ঠিক কবে?”

সামিয়া খাণিক হাসিমাখা মুখে শুধায়,

“সেভেনের শেষদিকে সাক্ষাৎ, এইটে প্রথম কথোপকথন ও বিচ্ছেদ।”

“আর ফাহাদ কখন এসেছিল তোমার জীবনে?”

“এসএসসি পরীক্ষার ঠিক একমাস আগে প্রথম কথা হয়। কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে রিলেশন এবং এইচএসসি পরীক্ষার পর বিয়ের জন্য চাপ দেওয়ায় পালিয়ে যায়… কিন্তু পুরনো কাসন্দি ঘাটছো কেন?”

“এমনেই জানতে ইচ্ছে হলো।”

___

প্রায় মাস দুয়েক কেটে গেছে, আবরারের এক আত্মীয়ের বাসায় দাওয়াতে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে সামিয়া। পরিধানে কালো জামদানি শাড়ি, হাত ভর্তি কপার গোল্ড চুড়ি, আঙুলে এঙ্গেজমেন্ট রিং, আর ঠোঁটে ডাস্টি পিংক লিপস্টিক দিয়ে হিজাব বাধতে ব্যস্ত সে। ঠিক তখনই শুধু প্যন্ট পরে বাথরুম থেকে বের হয় আবরার। ড্যাবড্যাব করে দেখছে সে তার প্রেয়সীকে।

“পুরো মায়াবতী লাগছে আমার বউটাকে। কিন্তু কোথাও কী একটা যেন নেই…”

ভাবুক বেশে বলতে বলতে সামিয়ার দিকে এগিয়ে আসে আবরার। সামিয়া আয়রন করে রাখা শার্টটা আবরারকে পরিয়ে দিতে দিতে বলে,

“সবই তো ঠিক আছে।”

“হ্যাঁ, পেয়েছি, পেয়েছি। তোমার আজ কাজল দেওয়া বাকি।”

যুবতী হেসে দেয় সামান্য সাজ নিয়ে আবরারের এমন উত্তেজনা দেখে। আবরারের শার্টের শেষ বোতাম লাগিয়ে সে যেই না নীল কাজল হাতে নিয়ে চোখের দিকে এগিয়েছে তখনই আবরার আগলে ধরে তার হাত।

“আজ প্লিজ একটু জমকালো কাজল দিবে? আমার খুব ইচ্ছে আমার প্রাণভোমরাকে কালো কাজলে দেখার।”

বেশ আবেগের সহিত আবেদন তার। এ আবেদন ফেরানোর জো নেই সামিয়ার। যুবকের শেষপর্যন্ত মনোবাসনাই পূর্ণতা পেল। সে অতি অনুভূতি মাখা চুমু খেলো স্ত্রীর ললাটে। ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে সামিয়াও আবেশে চোখ বুজে ফেললে।

“অনেকের দিন ধরে তোমার আসক্তিময় পা জোড়াতে আলতার ছোঁয়া দেও না। সাজাও না একটুও। আজ আমি নিজ হাতে সাজাব।”

অতঃপর প্রেয়সী বিছানায় বসিয়ে ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ার থেকে অজানা এক বাক্স এবং আলতা বের করে সে। মেঝেতে বসে দুই পা রাঙিয়ে দেয় রক্তিম আলতা, ছোট্ট এক ছোঁয়া দেয় পায়ের পাতায়, শিউরে উঠে রমণী অনুভূতির জোয়ারে। আবরার বক্সটি খুলতেই চমকিতা হয় সে। চকচকে রূপার মিনা কাজ করা পায়েল।

“বাহ! বেশ তো দেখতে! কবে আনলেন?”

“গতকাল রাতেই।”

পরিয়ে দিয়ে উঠে পড়ে আবরার।

“এবার আমার বউটাকে একদম সম্পূর্ণা লাগছে। আর তোমার পা জোড়া… আহা! এই পা জোড়াতেই তো আমার দৃষ্টি আটকে যায় সর্বদা! আমার প্রেমের শুরুয়াত এই পা জোড়া। গোলাপজাম ঠোঁট দুটো এমনেই সুন্দর, কেন যে রঙচঙের আড়ালে রাখতে যাও?”

ফিক করে হেসে দেয় সামিয়া।
“হয়েছে, চলেন এবার রেডি হন।”

দুজনে তৈরি হয়ে রওনা হয় গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। বস্তুত আবরারের মামার কাছে যাচ্ছে তারা। সেখানে যেতেই সবাই খুব বেশি সাদরে গ্রহণ না করলেও, আপ্যায়নে তেমন ত্রুটি নেই।

আবরার একটা ফোনকল রিসিভ করতে দূরে যেতেই। কিছু তরুণীর বিদ্রূপ কানে আসে সামিয়ার।

“আমি বুঝিই না আবরার ভাইয়ের মতোন ছেলের কপালে এমন মেয়ে আসলো কেমনে? কোথায় তার মতোন সুদর্শন পুরুষের হবে সুন্দরীশ্রেষ্ঠা বউ। সেখানে এসেছে এক অযোগ্য।”

“তা যে বলেছিস। একটুও মানায় না আবরার ভাইয়ের সাথে। এর চেয়ে আমিই তো কত সুন্দর, আর আমাকেই পাত্তা দেয়নি।”

“হ্যাঁ কথা বলতে গেলে কত ভাব দেখিয়ে চলত। এখন দেখ কেমন দেখতে বউ জুটেছে কপালে! একটুও যোগ্য না তার পাশে দাঁড়ানোর।”

সামিয়ার উচিত নুয়ে যাওয়া লজ্জায়, ছুটে পালানো এখান থেকে, প্যানিক এটাক আসা তো অনিবার্য। কিন্তু অদ্ভুৎ হলেও এমন কিছুই অনুভব করল না সে। বরং, বেশ ক্রোধ বোধ হলো তার। মেয়েগুলোর কাছে যেয়ে বেশ দুঃখের ভঙ্গিমায় বলল,

“শিয়াল আর আঙুর ফলের কাহিনীটা শুনেছো? তোমাদেরও আমার ঠিক শিয়ালটার মতোন লাগছে। আঙুর ফল মানে আমার জামাইয়ের পাত্তা পাওনি দেখে, এখন কত আজেবাজে কথা, বাহানা। সো সেড! কিন্তু জানো তো কী ভালো কিছু পেতে যোগ্যতা লাগে। আমার যোগ্যতা আছে বলেই আমি তার পাশে, তোমার নেই বলেই… আর কী যেন বললে সুন্দরীশ্রেষ্ঠা? আমি আমার স্বামীর নিকট সুন্দরীশ্রেষ্ঠাই। আর তার নিকট যদি নাও হই, আমি আমার কাছে একদম পারফেক্ট একজন। আন্ডারস্ট্যান্ড? ইউ বেটার আন্ডারস্ট্যান্ড!”

শেষ দুটো বাক্য চোখ পাকিয়ে বলে সেখান থেকে সরে আসলো সে। আবরার খাণিক দূর থেকে এ দৃশ্য উপভোগ করল। মনে মনে বলল,

“আমি পেরেছি আমার প্রেয়সীকে তার প্রেমে ফেলতে। সে ভালোবেসেছে নিজেকে গভীর ভাবে, এক্সেপ্ট করেছে নিজেত বাহ্যিকতাকে।”

___

রাতের আঁধারে মত্ত চারিধার। আশেপাশের সবকিছু রাতের রাজ্যে মিশে কালো রঙ ধারণ করেছে, দূরে কিছু স্ট্রিট লাইট এবং বাড়িতে হলদেটে আলোর রেশ দেখা যাচ্ছে। সামিয়া বারান্দায় রকিং চেয়ারর রাত্রির নিস্তব্ধতা উপভোগ করছে।

আজ দেখতে দেখতে কেটে গেছে সামিয়ার জীবনের তেরোটি শীত, গ্রীষ্ম, বসন্ত আবরারকে ছাড়া। করোনার কবলে রোগীদের সেবা দিতে দিতে মৃত্যুর মুখে যাওয়া ডাক্তারদের মাঝে একজন আবরারও। ভাবতেই অবাক লাগে না? মনেই হয় না মানুষটি নেই।

আজকাল চোখে খুব একটা ভালো দেখে না সে। বয়সের ভাজ পড়া চামড়ার বোধশক্তিটাও কমে যাচ্ছে ধীরেধীরে। কত রকম ব্যথা, অসুখ যে হয় বার্ধক্যে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সে। তবে দীর্ঘশ্বাস একটা কথারই পাশে প্রিয় মানুষটি নেই। তবুও খারাপ নেই সে, ভালোই আছে। প্রিয় অসুখের মাঝেই ভালো আছে।

দরজায় করাঘাতের শব্দ পেয়ে ধ্যান ভঙ্গ হয় সামিয়ার। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়ামূর্তিটি মৃদু হেসে বলে উঠে,

“দেখো, তোমার পাগল ছেলে এসেছে হয়তো ঔষধ নিয়ে।”

সামিয়াও হাসে, নিস্তব্ধ রাতের নীরব হাসি। দরজা খুলতে ডাইনিং স্পেসের একঝাঁক আলো এসে পড়ে সামিয়ার শোয়ার ঘরে। ছায়ামূর্তিটির কথাই সত্য, তার ছেলে আসফার এসেছে।

“মা, আজও ঔষধ না খেয়েই চলে এসেছো। এভাবে চললে হবে বলো তো?”

বলেই আফসার মায়ের হাতে ঔষধ আর পানি ভর্তি গ্লাসটা ধরিয়ে দেয়।

“আরে বাবা, কয়দিন-ই বা বাঁচব? কী হবে ম্যালা ম্যালা টাকা দিয়ে কিনে ওসব আজেবাজে ঔষধ খেয়ে?”

“মা আজাইরা কথা বলবা না তো। তুমি ছাড়া আমার কে আছে বলো?”

“আমিও তো আছি, বাবা।”
বারান্দা থেকে ছায়ামূর্তিটি বেশ মিহি কণ্ঠে বলে উঠে। যা সামিয়া ছাড়া আর কারো শ্রবণপথে প্রবেশ করে না।

আফসার মাকে ঔষধ দিয়ে দরজা চাপিয়ে চলে যায়। সামিয়া সব ঔষধ খেলেও আর দুটি ঔষধ খায়। এই দুটো ঔষধ তার কাছে সর্বদাই ঘৃণ্য, নিকৃষ্ট।

“তোমার স্বভাব আজও গেল না একাকিনী। এসব বাচ্চামি কবে ছাড়বে?”

“যখন মৃত্যু হবে।”

“এই মরণের নাম নিয়ো না তো। জানো ছেলেটা কতটা অনুভূতিপ্রবণ তোমায় নিয়ে। তারপরও সবসময় এসব বলো ওকে। তুমি ছাড়া ওর আছেই কে বলো?”

“আমার ছেলে? এমন ভাবে তোমার ছেলে, তোমার ছেলে বলছেন; যেন ছেলেটা আমার একারই আবরার। আপনার ছেলে না?”

“আমার ছেলে হলে কী? আমি তো নেই। খুব আগেই একা করে অসহায় বানিয়ে চলে গেছি তোমাদের। তুমি আবার একাকিনী হয়েই গেলে…”

আফসোসের সুরে বলে ছায়ামূর্তিটি। হ্যাঁ, এই ছায়ামূর্তিটি আর কেউ না, একাকিনীর প্রিয় অসুখ কাব্য বনাম আবরার।

“উহু, কোথায় একা? আপনি আছেন তো। মৃত্যুর আগ অবধি পাশে থাকবেন আমার প্রিয় অসুখ হয়ে। আপনাকে বলতাম না আপনি আমার ক্ষণস্থায়ী সুখপক্ষী নম, আমার চিরসঙ্গি অসুখ আপনি, যা সদা পাশে থাকবে? বলতাম না আপমি আপনার অনুপস্থিতিতে আমার হয়ে আমার পাশে থাকবেন? দেখেন আজ সব সত্যি।”

“হুম, আমি কি কভু অস্বীকার করেছি? আমি তো জানি ‘#একাকিনী ও প্রিয় অসুখ’-এর সঙ্গ থাকবে সদা, তারা আলাদা হওয়ার নয় মৃত্যু অবধি।”

আবরার ও সামিয়ার নানা কথোপকথনের মাঝেই ঘুমের দেশে পাড়ি জমায় সামিয়া। সাথে সাথেই পৃথিবী থেকে মুছে যায় আবরারের অস্তিত্ব কিংবা তার মস্তিষ্ক থেকে।

___

ভোরের এক ফালির আলোর আগমণে ঘুম ভাঙে সামিয়ার। ফজরের নামাজের জন্য আজকাল উঠতেই পারে না সে। কালকে থেকে এর্লাম লাগিয়ে শুবে ভাবছে।

ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলের সামনে যেতেই দেখে পুত্রবধূ তার চা পান করতে করতে তাদের পারিবারিক এলবামটা দেখছে। তাকে দেখেই তার চা নিয়ে আসে সে।

“নেন আম্মা চা খান। আপনার আর আব্বার ছবিগুলো দেখছিলাম। আব্বা কী সুন্দর ছিলেন!”

“হুম, মাটির মানুষ তিনি।”

বলতে বলতেই চোখ ভিজে আসে সামিয়ার। আনমনেই ভাবে,

“এই মাটির মানুষটাকে সর্বদাই সত্যের আড়ালে রেখে গিয়েছি। সত্য তো এটাই আমি অনন্যা আপুকে অনেকটা বাধ্য করেছিলাম বিয়েটা করতে। ঐদিন তোমার আইডিকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর আমি ফেক আইডি খুলে সেটা থেকে খুব ভালো সম্পর্ক গড়েছিলাম অনন্যা আপুর সাথে, খুবই ভালো। আমার বাবা তার বাবা থেকে বেশ মোটে অংকের টাকা পেতো, তার জন্য সে চাপ দেয়। এর মধ্যেই বাবা রাতুল ভাইকে পাত্র স্বরূপ পাঠায় তাদের কাছে এক ঘটকের দ্বারা। মাথা ভর্তি ঋণের সময় এত পয়সাওয়ালা পাত্রের সন্ধান পেয়ে অনন্যা আপুর বাবা বিয়ের জন্য তোরজোড় করে দেয়। যদিও অনন্যা আপু তেমন রাজি ছিল না। কিন্তু আমি বন্ধু বেশে নানা ভাবে তাকে বোঝাতে থাকি টাকাই আসল, টাকা না থাকলে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালাবে, বাবা-মায়ের এমন বিপদের সময় রাতুলই শেষ আশা। সে আস্তে আস্তে কনভিন্স হয়ে যায়। করে ফেলে বিয়ে।

আমি জানি আমি এসব লুকিয়ে ঠিক নেই। কিন্তু ঐ যে তোমার মনে নিজের প্রতি বিন্দুমাত্র দুর্ভাবনা সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই।”

ছেলের বউয়ের ডাকে ঘোর ভাঙে সামিয়ার। আলতো হাতে চোখ মুছে নিয়ে চোখজোড়া। মেতে উঠে গল্পগুজবে। বেঁচে থাকার,,ভালো থাকার তাগিদে কিছু সত্য আড়াল করে এগিয়ে যেতে হয়। একাকিনী ও প্রিয় অসুখের গল্পেও এমনটাই হয়েছে, ভালো থাকাত জন্য একাকিনী সত্য আড়াল করে গেছে।

__সমাপ্ত__

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here