বাসর ঘরে বসে আরোহী নিজের দুহাত সমানতালে কচলাচ্ছে। আজকে সে যা করেছে এতে তার শুভ্র ভাই তাকে কোনোদিনো মেনে নিবে না তা সে জানে। আজকে আরোহীর সাথে তার ফুফাতো ভাই “শুভ্রদ্বীপ মাহতাব শান” এর বিয়ে হয়েছে। শুভ্র এই বিয়েতে একদম রাজী ছিল না। তবে আরোহী, শুভ্র রাজী না জেনেও একপ্রকার জোর করেই বিয়ে করেছে। বাধ্য ছিলো আরোহী শুভ্রকে বিয়ে করতে। নাহলে যে চারটা জীবন নষ্ট হয়ে যেতো!
হঠাৎ দরজা সশব্দে লাগানোতে ধ্যান ভাঙ্গে আরোহীর। শুভ্র এসেছে। আরোহীর হৃদপিন্ডের কম্পন যেন হঠাৎ করে বেড়ে গেল।
” এই মানবটিকে দেখলে তার হৃদপিন্ডের ভেন্ট্রিকলের সিস্টোল ও ডায়াস্টোল যেন অধিকমাত্রায় হয়, যার কারণে লাব-ডাব শব্দ দুটি ছন্দময় ভাবে হতে থাকে। স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হয় হৃদপিন্ডের গতি। কিন্ত এই নিষ্ঠুর মানবটি তা বুঝে না! ”
হঠাৎ শক্ত পুরুষালী কন্ঠে শোনা যায়,
–কাম হেয়ার বেইবী! টুডে ইজ আওয়ার ওয়েডিং নাইট। লেটস মেক সাম লাভ এন্ড মেইক দা নাইট মেমোরেবল!
আরোহী যেনো স্তব্ধ হয়ে যায় শুভ্রর মুখ থেকে এহেনো কথা শুনে। শুভ্র কথাগুলো বলছে আর ফুলে সজ্জিত বিছানায় গুটিয়ে বসা আরোহীর দিকে কদম ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে।
আরোহী বিছানার মধ্যিখানে বসা ছিল এতোক্ষন কিন্তু এখন সে বিছানার কোণে দেয়ালের সাথে মিশে আছে। পেছাতে পেছাতে দেয়ালের সাথে মিশে রয়েছে সে, আর তো পেছোনে যাওয়ার জায়গা নেই!
আরোহী ভরকানো সুরে বলে,
–আপনি এভাবে আমার দিকে এগুচ্ছেন কেনো শুভ্র ভাই?
শুভ্রর মুখে ফুঁটে উঠে বাঁকা হাসি। প্রতিউত্তরে শুভ্র বলে,
–কেন বেইবি! আজকে আমাদের বাসর রাত। বিয়ে করেছি বাসর করবো না? কাম ফাস্ট। আই কান্ট ওয়েট এনিমোর!
আরোহী ভয়ে দরদর করে ঘামতে লাগে। আরোহী শুভ্রর কাছ থেকে চড়-থাপ্পড় আশা করলেও এহেনো লাগামছাড়া নির্লজ্জ কথাবাত্রা আশা করেনি। আরোহী বুঝতে পারছে শুভ্র এসব রাগের মাথায় বলছে। আরোহী শুভ্রকে মনে মনে ভালবাসলেও, আরোহী তো জানে শুভ্র তাকে ভালোবাসে না। আরোহী কখনোই চায় না, শুভ্র তার সাথের রাগের মাথায় এমন কিছু করে বসুক যা শুভ্রকে নিজের কাছে নিজেকে অত্যন্ত ছোট হতে বাধ্য করে।
আরোহী নিজেকে ধাতস্থ করে ঢোক গিলে বলে,
–দেখুন শুভ্র ভাই, আমি জানি আপনি আমাকে ভালোবাসেন না। আর না আপনি আমাকে কখনো ভালোলাগার নজরে দেখেছেন! তাই এসব কথাবার্তা বলা বন্ধ করুন দয়া করে।
শুভ্রকে এবার পায় কে! ক্ষিপ্ত সিংহের মতো আরোহীর কাছে গিয়ে আরোহীর দুই বাহুতে খামচে ধরে আরোহীরে বিছানা থেকে নামিয়ে এনে বলে,
–বিয়ে করার আগে তোমার এই কথাগুলো মনে ছিলনা? আমি তোমাকে ভালোবাসি না! আর না কখনো তোমার দিকে ভালোলাগার নজরে দেখেছি! বিয়ে করার পর তোমার এই কথাগুলো মনে হলো? আর যখন আমি তোমার দিকে স্বামীর অধিকার নিয়ে এগুচ্ছি ঠিক তখনি তোমার কথাগুলো এক নিমিষে মনে এলো? কেনো? বিয়ের আগে যখন মনে এলোই না তখন বিয়ে হয়ে যাবার পর এতো ফুলে ফুলে সজ্জিত রুমে এসে তোমার মনে হওয়াটাও সমীচীন নয়।
শুভ্র কথাগুলো বলে একটু দূরে সরে দাঁড়ায় আরোহীকে ছেড়ে। আরোহী কিছুটা নিচু কন্ঠে চোখ বিছানায় পড়ে থাকা ফুলের পাপড়ির দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলে,
–আমি চাই না আপনি আমার ওপর রাগের বশে নিজের অধিকার ফলান। যেদিন আপনার মনে আমার প্রতি ক্ষুদ্র অনুভূতি জাগ্রত হবে এবং আপনি ধীরে ধীরে আমায় ভালবাসতে শুরু করবেন, সেদিন নাহয় আপনি আপনার অধিকার নিয়ে আমার কাছে আসবেন। সেদিন আমি আপনাকে সানন্দে গ্রহণ করব। কোন বাধা দিব না আপনাকে।
শুভ্র ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠে। শুভ্রকে এভাবে হাসতে দেখে আরোহী চোখ ফেটে কষ্ট গুলো অশ্রু রূপে ঝরে পরতে চাইছে। কয়েক ফোঁটা অশ্রু কণা ইতিমধ্যে চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়েছে। শুভ্রদের সবকটার রুম সাউন্ড প্রুফ হওয়ায় শুভ্রর এই উচ্চস্বরে হাসির শব্দ নিস্তব্ধতার মাঝেও অন্য রুমে থাকা কারো কর্ণকুহর পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। হাসি থামিয়ে শুভ্র গম্ভীর কন্ঠে বলে,
–ওহ রিয়েলি আরোহী! আমি তোমাকে ভালোবেসে কাছে টানবো? তোমাকে ভালোবাসব আমি? এসব দিবা-স্বপ্ন এখন থেকেই দেখতে শুরু করেছ? বাহ ভালো তো!
আরোহী মাথা নিচু শুনে যাচ্ছে শুভ্রর মুখ নিঃসৃত কথাগুলো। সহ্য করে নিচ্ছে তার ভালোবাসার তাচ্ছিল্যতা। শুভ্র একটু থেমে আবার বলে,
–সবাই সবার প্রাক্তনকে ভুলতে পারে না। এমন অনেক স্বামী-স্ত্রী আছে যারা একে অপরকে ভালো না বেসেও কাছে আসছে। দিন শেষে তারা একে অপরের সাথে বাহ্যিকভাবে সংসার করে কিন্তু মন থেকে না। তারা একে অপরের শরীর ছুঁতে পারলেও হৃদয় ছুঁতে পারে না। মনে অন্য কাউকে লালন করে একে অপরের চাহিদা পূরণ করে যায়।
তুমি আবার এটা ভেবে না যে, আমি তোমার কাছে আসতে চাইছি! না। আমি তোমার কাছে আসতে চাইছি না। আমি আমার ভালোবাসা ভুলতে পারবো না আর না পারবো তোমাকে ভালোবাসতে। আমি তোমাকে ওগুলা এজন্যই বললাম যে, হয়তো কোনো এক সময় তোমার আমার সম্পর্কটাও ওই সব স্বামী-স্ত্রীর মতো হয়ে যাবে! দ্বিতীয়বার ভালোবাসা আসে না। তুমি জানো,
“কাক তার প্রথম সঙ্গীর মৃত্যুর পর একাকী বাকি জীবন কাটিয়ে দেয়! কারণ কাক জানে, দ্বিতীয় বার যে তার জীবনে আসবে সে তার স্বার্থের জন্য আসবে। ”
আরোহী শুভ্রর কথায় ব্যাথিত নয়নে তাকিয়ে আছে শুভ্রর মুুখপানে। কিন্তু আফসোস! শুভ্র বুঝলো না তার চোখে ফুটে উঠা স্পষ্ট ব্যাথিত মনের অনুরুক্তি। শুভ্রর দৃষ্টি রুমের ছাদের সাথে ঝুলানো ফুল গুলোর দিকে। কিছুক্ষণ পর এগুলো মুর্ছে যাবে। বিলীন হবে এদের সৌন্দর্য।
কাতর কন্ঠে শুভ্র বলে উঠে,
–কাউকে এতটাও ভালোবেসো না যে, সে তোমার কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই আমাকেই দেখো, পারবো না ভুলতে আমি আমার প্রথম ভালোবাসাকে।
আরোহী নিজের কষ্টকে চাপা রেখে শুভ্রকে কাটকাট গলায় বলে,
–আপনি ভুলতে পারবেন না কিন্তু আপনি আশা করেন অন্য কেউ তার ভালোবাসা ভুলে যাবে! আপনার ভালোবাসাটা সম্পূর্ণ একপাক্ষিক আর আমার বোনের তার ভালোবাসার মানুষটার সাথে ভালবাসাটা দুইপাক্ষিক। বাহ! শুভ্র ভাই বাহ!
” নিজেরটা ষোল আনা কিন্তু অন্যেরটা চার আনাও না! ”
শুভ্র তাকিয়ে আছে আরোহীর দিকে ভাবলেশহীনভাবে। আরোহী এই চাহনী বুঝে তবে সে যে নিরুপায়! আরোহী শুভ্রকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–জানেন শুভ্র ভাই, আপনাদের তিনজনের অনুভূতি সম্পর্কে আমি জ্ঞাত ছিলাম কিন্তু ওদের দুইজনের অনুভূতি দুইজনের প্রতি এতোটাই সুন্দর যে আপনি ছিলেন সেখানে তৃতীয় পক্ষ। আপনার ভালোবাসার গভীরত্ব অনেক থাকলেও আপনি আমার বোনকে বিয়ে করেও কখনো তার থেকে ভালোবাসা পেতেন না। ওই যে একটু আগে বললেন না যে, আমার ও আপনার সম্পর্ক একসময় হয়তো ভালোবাসাহীন স্বামী-স্ত্রীদের সম্পর্ক যেমন হয় তেমন হতে পারে ভবিষ্যতে। আজ আমার জায়গায় আয়ু থাকলেও সম্পর্কটার ভবিতব্য আপনার বলা মতোই হতো।
শুভ্র আর কিছু না বলে ব্যালকনিতে চলে যায়। বাকিটা রাত হয়তো ব্যালকনিতে থাকা একপাশে থাই গ্লাস দিয়ে কিছু অংশ আড়াল করা জায়গায় রাখা ডিভানে কাটাবে।
আরোহী নিজের জায়গায় এখনো স্থির হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আরোহী আপন মনে বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠে,
–একদিন আপনিও আমায় ভালোবাসবেন। আমাকে ভালোবেসেই গ্রহণ করবেন। ততোদিন আমি সেই প্রিয় প্রহরের অপেক্ষায় থাকবো, যেদিন আপনি একান্ত আমায় এসে বলবেন “ভালোবাসি”।
________
পরেরদিন সকালে, শুভ্রর বড় বোন রিয়ানার দরজায় অনবরত করাঘাতে ঘুম ভাঙ্গে আরোহীর। স্বভাবত আরোহী খুব ঘুম কাতুরে আর কালকে সারাদিন শরীর ও মনের উপর অনেক ধকল গিয়েছে তার। কাল দুপুরে যে বেনারসি শাড়িটা পড়েছিল এখনো তার পরনে সেই বেনারসি টাই আছে। কাল রাতে মন ভাল না থাকায় আর চেঞ্জ করা হয়নি। যেভাবে ছিল ওভাবেই একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিল সে।
বিছানা থেকে উঠে দরজার কাছে যেয়ে রিয়ানাকে, “ফ্রেশ হয়ে আসছে” বলে ওয়াশরুমের দরজার নব ঘুরিয়ে দেখে ভিতর থেকে লক করা আর মৃদু পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে। আরোহী বুঝলো শুভ্র হয়তো ভিতরে আছে। আরোহী মনে মনে বলে,
–যাক ভালো হয়েছে! রিয়ানা আপু যদি ভিতরে আসতে চাইতো? আর এসে যদি তার ভাইকে রুমে খুঁজে না পেয়ে ব্যালকনির ডিভানে ঘুমিয়ে থাকতে দেখতো তাহলে কি ভাবতো! ভালোই হয়েছে, আপুও ভিতরে আসেনি আর উনিও আগে ঘুম থেকে জেগে গেছেন।
আরোহী হাতে একটা সুতার কাজ করা সুতির নীল রঙের শাড়ি হাতে নিয়ে বিছানায় বসে আছে। ঘড়িতে সময় দেখে নেয়, সকাল সাতটা দুই বাজে। শুভ্র বের হলে একটা লম্বা ঠান্ডা শাওয়ার নিতে হবে তার। শরীরটা অনেক ম্যাজম্যাজ করছে তার।
ঘড়ির কাঁটা যখন সাতটা দশে এসে ঠেকলো তখন শুভ্র ওয়াশরুমের দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করে। শুভ্র একটা গ্রে রঙের ট্রাউজার ও গলায় টাওয়াল ঝুলিয়ে টাওয়ালের একপাশ দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
#প্রিয়_প্রহর
লেখনীতে: #নুরুন্নাহার_তিথি
#সূচনা_পর্ব
ভূল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।