#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_১
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
একজোড়া সুসজ্জিত, কিন্তু ক্লান্ত চোখ ধীরে ধীরে মনি ভাসিয়ে সামনে তাকালো। সেই চোখজোড়া চারদিকে তাকিয়ে চকচকে বালি আর দূরদূরান্তে গাছপালা ছাড়া কিছুই খুঁজে পেল না। চোখের মালিক সোজা হয়ে বসবার জন্য যেই শরীর নাড়াচাড়া করল, হঠাৎ মাথায় যন্ত্রণা অনুভব করে কাতরে উঠল, “আহ্!”
চুড়ি ভর্তি আর মেহেদী রাঙা হাতে মাথা চেপে ধরতে অনুভব করল অন্য হাতে হ্যান্ডক্যাপ পড়া। একটা কালো জিপ গাড়িতে নিজের অস্তিত্ব অনুভব করে ভয়ে চারপাশ দেখতে শুরু করল। আর পাশের ড্রাইভিং সিটে কাত হয়ে শোয়া ব্যক্তির দুটো হিংস্র চোখ এবং ঠোঁটে ভয়ংকর হাসি দেখে তার আত্মা কেঁপে উঠতে কাঁদো কাঁদো গলায় জিজ্ঞেস করল, “আমাকে তুমি এখানে কেন নিয়ে এলে?”
চোখ আগুনের ফুলকি আর ঠোঁটের ভয়ংকর হাসিতে নিজেকে মত্ত করে, ছোট্ট করে জবাব দিলো, “আমার রানী করতে।”
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল বধূ রূপে সজ্জিত রমণী। কান্নার বেগ থামছে না তবুও সে বলছে, “তুমি পাগল হয়ে গেছো নবাব, পাগল হয়ে গেছ।”
অতি শান্ত কিন্তু গম্ভীর কণ্ঠে, “হ্যাঁ, আমি পাগল হয়ে গিয়েছি, শুধু তোমার জন্য।”
“আমাকে বাসায় নিয়ে চলো। আমি হাতজোড় করে মিনতি করছি তোমার কাছে।”
দায়সারা ভাব নিয়ে, “তোমার মিনতি কে শুনছে বলো?”
“কেন আমার আর তোমার পরিবারের কথা ভাবছ না? আমার মা… আমার মা তো মরেই যাবে। দয়া করে আমাকে নিয়ে চলো।” কেঁদে কেঁদে বলা কথাগুলো ঢুকলো না নবাবের কানে বরং সে এখন ব্যস্ত তার হাতের পিস্তল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে। নবাবের হাতের পিস্তল দেখে আচমকা রমনীর কান্না বন্ধ হয়ে গেলে নবাব মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল, “ভয় পাচ্ছো আমায়?”
লাল বেনারসি পরিহিত রমনী তার ঘোমটা মাথা নাড়ালো মৃদু গতিতে। রমনীর কাছ থেকে জুতসই জবাব পেয়ে ভেতরে ভেতরে খুশি হয়ে নবাব বলল, “তুমি না তোমার নামের মতোই, আস্ত একটা মিষ্টি। তোমার নামের সাথে তোমার জব্বর মিল আছে। মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়ে বড্ড চিন্তা হয়, তোমায় ভালোবেসে আমার না আবার ডায়বেটিস হয়।” নিজের বলা কথায় নবাব যেন আমোদ খুঁজে পেল আর সেই আমোদে শরীর দুলিয়ে হেসে উঠল, কিন্তু তার কথাবার্তায় অঝোরে কাঁদতে লাগল মিষ্টি। ওর কান্না দেখে নবাব বিরক্ত হয়ে জানতে চাইল, “কাঁদছ কেন এত?”
“তুমি বুঝতে পারছ না? আমার এত বড় সর্বনাশ করে আবার জানতে চাইছ? কালকে খবরের কাগজে ছবি ছাপা হবে, মেয়ের শোকে গর্ভধারিনী মা মারা গেছে। সমাজের চোখে তুমি আমাকে খুনী বানিয়ে দিবে।”
মুখে ডান হাত চেপে অঝোরে কাঁদছে মিষ্টি আর তা দেখে মৃদুস্বরে নবাব বলল, “তুমি তো আগে থেকেই খুনী, নতুন করে আর খুনী হবার কী আছে?” নবাবের কথায় অশ্রুতে ভেজা চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। কান্না থেমে গেলেও কাঁদো গলায় মিষ্টির প্রশ্ন, “কী যা তা বলছ তুমি?”
হঠাৎ রাগে অগ্নিমূর্তি ধারণা করে নবাব ঝুঁকে এলো মিষ্টির সিটের ওপর। মাথায় মাঝ বরাবর সিঁথি করা নবাবের স্লিকি চুল এলোমেলো হয়ে কপাল এবং চোখ ঢেকে দিলো মূহুর্তে। এখনও সন্ধ্যা নামেনি তাই ওর অগ্নিদৃষ্টি এড়াতে পারেনি মিষ্টি। ভয়ে সে কেঁপে উঠছে বারবার আর এই মূহুর্তে ভয়ে দরুন যেন নড়তে ভুলে গেছে মিষ্টি।
দাঁতে দাঁত চেপে নবাব জানতে চাইল, “আমার মনকে খুন করে এখন জানতে চাইছ? আমার ভালোবাসা প্রত্যাখান করে এখন নাটক করছ? এতসব করেও তোমার মনে হয় না মিষ্টি, তুমি একজন খুনী?”
কয়েক মূহুর্ত খুব কাছ থেকে মিষ্টিকে দেখে সোজা হয়ে বসলো নবাব। ঝাঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে পিস্তল লুকিয়ে ফেলল পিঠের দিকের শার্টের তলায়। গাড়ি চালাবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে সে। এদিকে থ মেরে বসে থাকা মিষ্টি একহাতে নবাবের হাঁটু ধরে বলল, “আমি তোমার পায়ে পড়ছি নবাব। আমার মায়ের কথা ভেবে, দয়া করে আমাকে বাসায় নিয়ে চলো।”
অনুরোধের সুরে বলা মিষ্টির কথায় নিজের মাঝে অস্বস্তি অনুভব করে একটু হাসবার বৃথা চেষ্টা করল। একমুহূর্তও সময় ব্যয় না করে মিষ্টির হাতটা নিজের দু-হাতের মুঠো নিয়ে নবাব আদুরে গলায় বলল, “এই, কী করছো মিষ্টি? আমার পায়ে কেন ধরছ? বিয়ের পর হয়তো স্বামী হিসেবে তোমার চেয়ে আমার দায়িত্ব বেশি থাকবে, কিন্তু বিয়ের আগে ভুলে যেও না তুমি আমার চেয়ে চার বছরের বড়।”
নবাবের কথার প্রেক্ষিতে যেন থমকে গেল মিষ্টি। ওর চোখ মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে ও স্তব্ধ হয়ে গেছে। তবে এই মূহুর্তে নড়ে উঠবে, কিন্তু সেই নড়ে উঠা হবে তীব্র ভাবে। এ যেন ঝড় আসার পূর্বে থমকে থাকা প্রকৃতিকে দেখছে নবাব মিষ্টির মাঝে। সত্যিই মিষ্টি কাল বৈশাখী ঝড়ের মতো গর্জে উঠলো, “তুমি পাগল হয়ে গেছ। তোমার মাথা কাজ করতে ভুল গেছে নবাব। তাই তুমি এমন অদ্ভুত কথাবার্তা বলছো।”
গর্জের উঠবার আগে মিষ্টি নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়েছিল নবাবের কাছ থেকে। এখন সে মুক্ত হাতে অশ্রু ঝরা মুখ চেপে আর্তনাদ শুরু করল আর মিষ্টির এমন কথায় নবাবও খেঁকিয়ে উঠল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি পাগল হয়ে গিয়েছি। বললাম তো, তোমার জন্য আমি পাগল হয়ে গিয়েছি।… আল্লাহ সাক্ষী, যদি তোমাকে আমার করতে না পারি তাহলে…” শার্টের পিছনে লুকিয়ে রাখা রিভলবার বের করে মিষ্টিকে দেখিয়ে আবার বলতে লাগল, “এই রিভলবারের সবকটা বুলেটে আমার আহত হৃদয়কে আমি চিরতরে থামিয়ে দিবো।”
ক্রন্দনরত মিষ্টি তার ভেজা এবং ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে দেখলো নবাবকে। সে এখন মাথা নুইয়ে গম্ভীর হয়ে আছে। নবাবের গোছানো চুল আবার এলোমেলো হয়ে কপাল দখল করেছে। মিষ্টি এখন নবাবের একপাশের চেহারা দেখলেও আন্দাজ করতে পারছে, নবাব কষ্টের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। নবাবের দিকে কিছুটা এগিয়ে মিষ্টি করুণ গলায় বলল, “নবাব, আমি চাই না তোমার কোনো ক্ষতি হোক। তুমি আমাকে বাসায় নিয়ে চলো।”
নবাব নিশ্চুপ হয়ে আছে। কোনোরকম প্রতিক্রিয়া ওর মাঝে দেখতে না পেয়ে মিষ্টি বলল, “কেন আমার জন্য নিজের জীবনকে শেষ করতে চলেছ? তুমি কেন বুঝতে পারছ না নবাব?”
চোখ তুলে তাকাল নবাব মিষ্টির দিকে। অগ্নি চোখে জল টলমল করছে যেন এক্ষুনি তা গড়িয়ে পড়বে। কিন্তু সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নবাব বলল, “বিশ্বাস করো মিষ্টি, আমি তোমাকে নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসি। তোমাকে পাওয়ার পর যদি আমার জীবন শেষও হয়ে যায় এতে আমার কোনো আপত্তি নেই কিন্তু তোমায় না পেলে আমি যে জীবন্ত লাশ হয়ে যাব। পাগল হয়ে যাবো আমি মিষ্টি, একদম পাগল হয়ে যাবো।”
চলচ্চিত্রের চিরাচরিত বক্তব্য নিজের জীবনে শুনতে পেয়ে মিষ্টির অস্থিরতা উবে গেল। এমন কথার পরিপ্রেক্ষিতে কী বলা উচিত সেটাও যেন মিষ্টি বুঝতে পারছে না। আমতা-আমতা করে তাই কিছু বলার চেষ্টা করল, “একটু বুঝার চেষ্টা…” মিষ্টির কথার মাঝে একগাল হেসে উঠল নবাব। মিষ্টির দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “মিষ্টি, তোমার কি আমাকে বাচ্চা মনে হয়?”
নবাবের প্রশ্নের জবাব দিলো না মিষ্টি। ওর থেকে জবাবের আশা ছেড়ে দিয়ে নবাব পুনরায় রিভলবার স্বস্থানে লুকিয়ে ফেলল। গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরাতে গিয়ে মিষ্টিকে বলল, “আই অ্যাম নট অ্যা চাইল্ড। নাউ আই ক্যান টেক কেয়ার অফ মাইসেল্ফ।” এমনিতেই নবাবের কথা শুনে মিষ্টি শব্দহীন হয়ে পড়ছে। কী বললে নবাব মানবে এবং তাকে বাসায় নিয়ে যাবে, সেই ভাবনায় নিজের মাঝে অস্থিরতা কাজ করলেও উত্তেজিত হওয়ার দরুণ মিষ্টি এখন বড্ড ক্লান্ত অনুভব করছে। তাই নবাবকে কিছু বলার আশা ছেড়ে দিয়ে গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিলো। নবাব গাড়ি চালানোর কাজে মশগুল হতে মিষ্টি তার দু-চোখ বুজে দিলো আর সাথে সাথে দুটো মুক্তোর দানা ওর গাল ভিজিয়ে গড়িয়ে পড়ল।
…চলবে কি?