প্রীতিকাহন পর্ব ৪২ ও শেষ পর্ব

#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_৪২

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

“কী?” নবাব দাঁড়িয়ে পড়েছিল প্রায়, কিন্তু মিষ্টির ডাকে পুনরায় বসে জবাব দিলো।

“সাবধানে যেও।” নবাব কিছু বলল না মুগ্ধ চোখে মিষ্টিকে দেখে উঠে দাঁড়াল। মিষ্টির দিকে মুখ করে উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করল। নবাবের চোখের তারায় খুশি করছে ঝলমল আর ঠোঁটে লেগে আছে দুষ্ট হাসি। এমনই অবস্থা সে ধীরে ধীরে রুম ত্যাগ করল। এদিকে নবাবের হাসিতে মিষ্টির ক্লান্ত মুখে লজ্জা এসে সূর্যের মতো উদিত হলো। চোখ যেন তার পাতা নামিয়ে নিস্তব্ধ ঘরে বলে উঠল, “হায়!”

.

সারা দিন পর এখন মিষ্টি বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেল। চোখে ঘুম ঘুরঘুর করলেও কিছুতেই ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না তার। কারণ এখনও রাত হয়নি তেমন করে কেবল তো রাত নয়টা। বিছানায় পা তুলে কাঠে হেলান দিতে গিয়ে মিষ্টির মনে পড়ল, “বিয়ের দিন এখানেই মাথায় আঘাত পেয়েছিলাম অথচ সেটা আমার কখনো মনেই আসেনি। ব্যথা করেছিল, কিন্তু নজর দেওয়া হয়নি আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে।”

ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে মিষ্টি চোখ বুজে দিলো। আজকে নবাব জোর গলায় তার বাবা-মাকে জানিয়েছে, “মা, মিষ্টিকে নিয়ে আমি বিদেশে চলে যেতে যাই।”

মিনারা চমকে জিজ্ঞেস করেছিল, “কেন বাপ? কত আর তুই আমাকে পর করে বিদেশে পড়ে থাকবি?”

“না মা। তুমি আমার কথা একটু বোঝার চেষ্টা করো। মিষ্টিকে নিয়ে আমাদের কারোর আপত্তি নেই, কিন্তু এই সমাজের কিছু অসুস্থ মনের মানুষ বার-বার মিষ্টিকে তার অতীত মনে করিয়ে দিবে। যেখানে মিষ্টির কোনো দোষ নেই, সেখানে এসব সহ্য করার কোনো মানে হয় না।”

“কিন্তু বাপ। লোকের সমালোচনার ভয়ে পালিয়ে বেড়ানো কি ঠিক? তাদের মুখের ওপর তো জবাব দেওয়া উচিত।”

“কুকুর আমাদের কামড় দিলে আমরা কি কুকুরকে কামড় দিই মা? তাছাড়া কবিরের বিষয়ে আমি আর কোনো ঝুঁকি নিতে চাই না।” ছেলের কথা শুনে মিনারা আর কথা বাড়ায়নি অবশ্য এতে আরমানও নবাবকে সায় দিয়ে কথা বলেছেন। অন্যদিকে মিষ্টির মা-বাবারও আপত্তি নেই। তাই কালকের অনুষ্ঠান শেষে পরশুদিনই নবাব আর মিষ্টি বাংলাদেশ ত্যাগ করবে।

ক্লান্ত শরীরে জীবনের এতগুলো বছরের কত-শত ঘটনা এখন যেন একত্রে ঘুরপাক খাচ্ছে মিষ্টির মনে। সেসব স্মৃতির ভিড়ে সে কখনো হাসছে সে তো কখনো আঁতকে উঠছে, “সবাইকে ফেলে এত দূরের অচেনা দেশে আমি কি থাকতে পারব?” এমন সব জল্পনাকল্পনার মাঝে হঠাৎ লামিয়া রুমে এসে বলল, “মিষ্টি আপু, তোমার কল এসেছে।”

চোখ মেলে মিষ্টি জিজ্ঞেস করল, “কে?”

“কথা বলেই দেখো না।”

সোজা হয়ে বসে, নিঃশব্দে হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিলো মিষ্টি আর সাথে সাথেই লামিয়া রুম ত্যাগ। মিষ্টি ফোনের স্ক্রিনে তাকাল, কিন্তু নম্বর চিনতে না পেরে আন্দাজে বলল, “হ্যালো।”

“এই মিষ্টি, কী করছ?” আজকে প্রথমবারের মতো ‘এই মিষ্টি’ সম্বোধনে আঁতকে উঠল মিষ্টি। নিশ্চুপ সাগর পাড়ে প্রতীক্ষিত কোনো পক্ষী হঠাৎ উত্তাল ঢেউয়ে যেমন নড়েচড়ে উঠে, তেমন মিষ্টির স্তব্ধ হৃদয়ও যেন চমকে উঠেছে আর সেজন্য অস্বাভাবিক মাত্রায় স্পন্দিত হচ্ছে। হৃদয়ের এই অস্বাভাবিক স্পন্দন একটু একটু করে মিষ্টির চেহারায় লজ্জা ডেকে আনছে আর সেই লজ্জায় গুটিয়ে যাচ্ছে মিষ্টি। এমন অনুভূতি কখনো হয়নি মিষ্টির নবাবের এমন সম্বোধনে অথচ আজ কত বছর ধরে নবাব তাকে এমন করেই ডাকে।

“এই মিষ্টি, কিছু বলছ না কেন? কেউ কি কিছু বলেছে?” বিচলিত হলো নবাব।

“উঁহু।”

“তাহলে চুপ করে আছ কেন?”

“কখন আসবে তুমি?” মিষ্টির কণ্ঠে ছেলেমানুষী আবদারের সুর শুনতে পেয়ে হেসে উঠল নবাব, “একটু আগেই তো দেখলে আমায় এর মধ্যেই মনে পড়ছে আমাকে?” প্রতিত্তোরে মিষ্টি লজ্জায় আরও গুটিয়ে গেল। এপাশের মানুষটার নীরবতায় লজ্জার আভাস পেয়ে নবাব জানতে চাইল, “এই মিষ্টি, ভালোবেসে ফেললে না-কি আমায়?”

লজ্জায় জড়িয়ে ধরা চাদর সরিয়ে মিষ্টি বলবার চেষ্টা করল, “তুমি কথা অন্যদিকে নিচ্ছো নবাব।”

মৃদু হেসে নবাব বলল, “ঠিক আছে, নিচ্ছি না অন্যদিকে। কখন আসব সেটা না-হয় তুমিই বলো।”

“কালকে দশটা নাগাদ চলে আসবে। একদম দশটায়, একমিনিটও যেন দেরি না হয়।”

কিঞ্চিৎ অবাক হলো নবাব, “সকাল দশটা? এখনও তো রাত দশটাই বাজেনি। এত ঘণ্টা অপেক্ষা করতে পারবে?”

“তোমার ওপর দিয়ে অনেক কিছু গেছে নবাব। সারা দিনে আজকে তোমার একটু বিশ্রাম নেওয়া হয়নি। এখন বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নিবে তবে রাতের খাবার খেয়ে নিও।”

“আমি যখন যেতে পারব না বলছ৷ তাহলে তুমি চলে এসো।”

“আমি যাব? কী বলছ এসব?” আঁতকে উঠল যেন মিষ্টি নবাবের কথা শুনে।

“কেন? মেয়েরা কি তার শ্বশুর বাড়ি আসতে পারবে না?”

“দুই পরিবারের সম্মতিতে আগে নতুন করে সবকিছু হোক তারপর ভেবে দেখব।” একটু যেন গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করল মিষ্টি আর সেটা টের পেয়ে গোপনে হেসে নিয়ে নবাব বলল, “ঠিক আছে, আর শোনো আমি এখন বাড়িতেই আছি। এসে আগে তোমাকে কল করলাম কারণ আমি জানি তুমি আমার কথা ভাবছ।”

“আমি তোমার কথা কেন ভাবতে যাব?”

“সেটা না-হয় তোমার মনকে জিজ্ঞাসা করে নিও। এখন খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আর আল্লাহর কাছে চাও যেন কালকের নতুন সকালের সাথে তোমার জীবনের নতুন সূচনা হয়। কালকে থেকে আমি সেই মিষ্টিকে দেখতে চাই, যার একরত্তি মুখে সর্বদা মিষ্টি হাসি ফুটে থাকত ঠিক যেন স্বাতী নক্ষত্রের মতো।”

.

পিটপিট করে চোখ খুলল মিষ্টি। সদ্য ঘুম ভেঙে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না, সে এখন কোথায় আছে? বেশ কিছুদিন বাসার বাইরে থাকার ফলে এমনটা হচ্ছে যখন টের পেল, তখন তার বুঝে এলো সে নিজের ঘরেই আছে। হঠাৎ নবাবের কথা মনে পড়তেই মন কিঞ্চিৎ খারাপ হয়ে গেল মিষ্টির। তার খুব ইচ্ছে করছে নবাবকে দেখতে, কিন্তু ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল এখন কেবল সকাল সাতটা বাজে। নবাব আসবে সেই দশটায়। মিষ্টি ইচ্ছে করেই এতবেলায় আসতে বলেছে যেন নবাব ঘুমিয়ে শরীরের ক্লান্তি দূর করতে পারে।

“এই মিষ্টি।” হঠাৎ চিরচেনা সম্বোধনে তড়াক করে শোয়া থেকে উঠে বসল মিষ্টি। নিজের বদ্ধ ঘরে খুঁজতে গিয়ে দেখতে পেল চেয়ারে নবাবী ভঙ্গিতে বসে আছে নবাব৷ মশারি বাঁধা হয়ে দাঁড়াল পাশাপাশি ঘরেও তেমন আলো নেই। মিষ্টির এক মূহুর্তের জন্য মনে হলো সে স্বপ্ন দেখছে। তাই কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া ছাড়াই সে মশারির ভেতর থেকে বেরিয়ে নবাবের সামনে দাঁড়াল, “দশটা বাজে সশরীরে এলেই হতো। অহেতুক কল্পনায় এসে আমাকে কেন জ্বালানো হচ্ছে?” বলেই মিষ্টি দরজার দিকে হাঁটতে লাগল, কিন্তু কেউ তার হাত ধরতেই সে চমকে ফিরে তাকাল, “তুমি সত্যি এসেছ?”

হালকা হেসে উঠল নবাব, “ঘুমের ঘোরে পাগলামি গেল না তোমার। সেই কখন থেকে বসে আছি অথচ তোমার ঘুম ভাঙতেই চায় না।”

“তার আগে বলো তুমি সত্যি এলে না-কি?”

“হাত ধরে আছি তবুও বিশ্বাস হচ্ছে না?”

একটু লজ্জা পেল মিষ্টি, “হুঁ, হয়েছে। কিন্তু এত সকালে এলে যে বরং।”

“ঠিক আছে, চলে যাচ্ছি।” বলেই উঠে দাঁড়াল নবাব।

“এই না, না। আমি কি তাই বলেছি না-কি?”

“তাই তো বললে। যাক গে, চটজলদি ফ্রেশ হয়ে নাও। এরপর নাস্তা সেরে সবার সাথে বসতে হবে।”

“কেন?” অবাক হলো মিষ্টি।

“বউকে নিতে হলে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে গো। আর আমার মিষ্টি কি সহজলভ্য?” নবাবের কথায় হঠাৎ লজ্জার ছায়া পড়ল মিষ্টির চোখেমুখে, “বেশি বলছ তুমি।”

“তা আর পারলাম কই?… যাও, ফ্রেশ হয়ে এসো।”

“ঠিক আছে।” এই বলে জানালার পর্দা সরিয়ে দিলো মিষ্টি। আলতো হাতে বেলকনির দরজা খুলে দিতেই সকালের মৃদুমন্দ সমীরণ বিনা বাঁধায় ঘরে প্রবেশ করছে। দ্রুত হাতে বিছানাপত্র গুছিয়ে নবাবকে বলল, “তুমি বিশ্রাম নাও এবার।”

পূর্ণ দৃষ্টিতে মিষ্টিকে দেখে মৃদু হাসল নবাব আর এতে কপাল কুঁচকে মিষ্টি জিজ্ঞেস করল, “হাসছ কেন?”

“এমনিতেই।”

প্রায় আধঘন্টা পর ওয়াশরুমের দরজায় শব্দ হতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল নবাব ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে। বিছানায় শুয়ে নবাব ফোন স্ক্রোল করছিল, কিন্তু এখন চোখের সামনে মিষ্টিকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল সে এক নিমিষেই। ভেজা মুখ আর মুখের দুইপাশে খুচরো ভেজা চুল পড়ে আছে। মাথায় সেঁটে আছে সাদা তোয়ালে আর পরনে কালো রঙের থ্রি-পিস যেমনটা সিলেটে দেখেছিল নবাব মিষ্টিকে। সিলেটের হোটেলে বসে মিষ্টিকে দেখে নবাবের মাঝে যেই অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল, আজও একই অনুভূতির দেখা পেয়ে নবাব বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। কিন্তু সিলেটের মতো আজও নবাব সেই অনুভূতির কোনো নাম খুঁজে পেল না কেবল ঘোরলাগা চোখে মিষ্টিকে দেখে ভাবতে লাগল, “একটা তরতাজা কালো গোলাপ জলে ডুবিয়ে ভাসালে যেমন অপূর্ব লাগে, তেমন মিষ্টিকেও লাগছে; অপূর্ব এক ভেজা কালো গোলাপ। আর এই কালো গোলাপকে এক-দুবার নয়, লক্ষ কোটিবার আমি দেখতে চাই। আমার অতৃপ্ত চোখের তৃষ্ণা মেটাতে এই গোলাপকে আমি রোজ দেখতে চাই।”

“নবাব, তুমি নাস্তা করেছ?” মিষ্টি লক্ষ্য করেনি নবাব তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কারণ মিষ্টি তার ভেজা চুলে তোয়ালে চালাতে ব্যস্ত। চুল মোছার কাজ শেষ হতে মিষ্টি ভেজা তোয়ালে ছড়িয়ে দিলো, কিন্তু এখনও নবাব কোনো জবাব দিচ্ছে না। তাই মিষ্টি এবার নবাবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হলো? নাস্তা করেছ কিনা বলছ না কেন?” মিষ্টির কথায় নবাবের সম্বিৎ ফিরতে চোখ নামিয়ে নিলো সে। শোয়া থেকে উঠে বসে নিজের টালমাটাল মনকে স্থির করতে কিছুটা সময় নিয়ে বললো, “না, করার সুযোগ হয়নি।”

“মা তোমাকে নাস্তা খেতে বলেনি?”

“বলেছিল, কিন্তু তোমার সাথে খাব বলে…” নবাবের হৃদয়ে এখনও ঝড় চলছে আর তাই চোখ বড্ড চঞ্চল হচ্ছে। কিন্তু সেসব মিষ্টির দৃষ্টিগোচরে রয়ে গেল বরং সে নবাবকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে, তুমি বসো আমি দেখছি।” মৃদু হেসে ডান দিকে ঘার কাত করল নবাব।

সকাল থেকে একের পর এক বিস্মিত সব কাণ্ড হচ্ছে বিধায় মিষ্টি নবাবকে তেমন করে লক্ষ্য করেনি নবাবকে৷ কিন্তু এখন নিজের রুমের বিছানায় মুখোমুখি বসে নাস্তা করতে গিয়ে, মিষ্টির চোখে পড়ল নবাব সেভ করেছে। ফলে চোখের এককোণে থাকা মিষ্টির মতো তিলটা স্পষ্ট দেখতে পারছে মিষ্টি। মাথার চুলও কেটেছে নবাব, কিন্তু কপালের দিকে আগের মতোই বড় করে রেখেছে ভ্রু অবধি। মাঝ বরাবর সিঁথি করা চুল আর পরিচ্ছন্ন মুখে নবাবকে অন্যরকম লাগছে। আজ অনেকদিন পর নবাবকে দেখে মিষ্টির মন বলে উঠল, “নবাব, তোমাকে অন্যরকম লাগছে। চোখে আটকে রাখতে ইচ্ছে করে তোমাতে, কিন্তু লজ্জায় পারি না যে।” মনের ভাবনায় হেসে উঠে চোখ নামিয়ে নিলো মিষ্টি। মুখে সবজি রুটি পুড়তে গিয়ে শুনতে পেল নবাবের কণ্ঠ, “এই মিষ্টি, হাসছ কেন?”

কিঞ্চিৎ চমকে নবাবের দিকে তাকালেও মিষ্টি, কিন্তু পরক্ষণেই হালকা হেসে জবাব দিলো, “এমনিতেই।”

“আমাকে নকল করছ?”

“জানি না।” বলেই হাসল মিষ্টি আর নবাব মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে বলে উঠল,

“চঞ্চল নদী স্তব্ধ হলো
তোমার ওই হঠাৎ হাসিতে।
নয়ন আমার ব্যাকুল হলো
তার অতৃপ্ত তৃষ্ণা মেটাতে।

মনে আমার ঘোর লাগে
দেখলে তোমার হাসি।
কবে তুমি বলবে আমায়,
এই তো ভালোবাসি?” একটু থেমে নবাব বলল, “বললে না তো ভালোবাসো কি না?”

“একই কবিতা বারংবার শোনালে কেউ ভালোবাসবে বলে আমার মনে হয় না।” দায়সারা ভাব নিয়ে কথাগুলো বলল মিষ্টি। নবাব খানিকটা অবাক হয়ে জানতে চাইল, “একই কবিতা বারংবার মানে? এই মিষ্টি, তোমার তাহলে এই কবিতার কথা মনে আছে?”

“হুঁ, আছে।”

“তাহলে উত্তরটা পাব কি?”

“জানি না।” বলেই হাতে প্লেট নিয়ে রুম থেকে পালাল মিষ্টি এক ছুটে।

“এই মিষ্টি, যাচ্ছো কোথায়? উত্তর কিন্তু আমার চাই, বুঝলে?”

.

একটু পরেই বিমান বাংলাদেশের মাটি ছেড়ে আকাশে উড়তে শুরু করবে। চোখের সামনে সবকিছু কেমন যেন ধোঁয়াশা লাগছে মিষ্টির কাছে। বারংবার মা-বাবার কথা মনে পড়তেই কেঁদে উঠছে মিষ্টি। এদিকে নবাব বুঝিয়ে চলেছে, “এই মিষ্টি, কেন কাঁদছ এমন করে? আমার এতে ভালো লাগছে কী?”

হেঁচকি তুলে মিষ্টি বলতে চেষ্টা করল, “সবাইকে রেখে যেতে যে কষ্ট হচ্ছে।”

“কষ্ট কীসের? আমি তো খুব জলদি মা-বাবাকে আমাদের কাছে নিয়ে আসব আর মামা-মামীও বলেছেন চলে আসবেন। কারণ দেশে থাকার মতো তো কোনো কারণ নেই।”

কালো হিজাবের আড়ালে থাকা মিষ্টির চোখ জলে ভিজে একাকার হয়ে গেছে। এমন ভেজা চোখে নবাবের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “কিন্তু এতে যে অনেক দেরি নবাব।”

মিষ্টির হাত আলতো করে মুঠোয় নিয়ে নবাব নরম কণ্ঠে বলল, “কে বলল দেরি? আমাদের প্রীতিকাহনের ভিড়ে দেখবে সময় কেমন পেরিয়ে গেছে।” প্রীতিকাহন শব্দটা শুনে আচমকা মিষ্টির কান্না থেমে গেছে। চোখের বিস্ময় স্পষ্টত আর জানার ব্যাকুলতা বিরাজ করছে। হালকা নাক টেনে মিষ্টি নবাবকে এবার জিজ্ঞেস করেই বসল, “সেই কবে থেকে এই একটা শব্দ শুনছি অথচ এর মানে আজ অবধি বললে না।”

“শুনবে?”

“হুঁ।”

মিষ্টির হাত ছেড়ে দিয়ে নবাব বলল, “ঠিক আছে, আগে সিট বেল্ট লাগিয়ে নাও এরপর বলছি।” নবাবের কথা মতো মিষ্টি সিট বেল্ট লাগিয়ে স্থির হয়ে বসল। এরপর নবাব বলতে শুরু করল, “শেষবার যখন বিদেশে গেলাম, তখন বাংলা সাহিত্য নিয়ে একটু-আধটু নাড়াচাড়া করেছি। ছোটবেলা থেকে তোমার আমার মাঝে যতগুলো কাহিনি ঘটেছে সব মিলিয়ে কেমন যেন ভালোবাসার গন্ধ পেতে শুরু করি। আর প্রীতি মানেই তো ভালোবাসা। আমাদের মাঝে যেই ভালোবাসাময় কাহিনির সৃষ্টি হতো সেগুলোকেই আমি একত্রে প্রীতিকাহন নাম দিয়েছি।”

“তারমানে তুমি বলতে চাইছ, প্রীতি মানে ভালোবাসা আর কাহন মানে কাহিনি?”

“হুঁ।”

মিষ্টি অনেক আগ্রহ নিয়ে শব্দটার অর্থ জানতে চেয়েছিল, কিন্তু জানতে পেরে এখন তার আগ্রহটা যেন বিলীন হয়ে গেল। বিষয়টা বুঝতে পেরে নবাব জানতে চাইল, “ভালো লাগেনি?”

“জানি না।” এমন উত্তরে হঠাৎ হেসে উঠল নবাব।

“হাসছ কেন?”

“জানি না।” মিষ্টির মতোই উত্তর দিল নবাব এতে মিষ্টির ভ্রু কুঁচকে এলো। কিন্তু এই বিষয়ে জিজ্ঞেস না করে সে জানতে চাইল, “তোমাকে কে কে সাহায্য করেছিল বললে না তো।”

কপালে ভাঁজ পড়ল নবাবের, “সবই তো জানো। মনে হয় না আর কিছু বাকি আছে।”

“নিলয়, জিসান, লামিয়া আর ফুপা বাদেও আরও একজন আছে। এমনটা তুমি জানালেও নামটা বলোনি।”

চুলে হাত চালিয়ে একটু নড়েচড়ে বসে নবাব বলল, “আরেকজন হলো মামী।”

“হোয়াট?” মিষ্টি হকচকিয়ে উঠতেই বিমান চলতে শুরু করল। এতে ভয়ে মিষ্টি চেয়ারের হাতল আঁকড়ে চোখমুখ খিঁচতে শুরু করল। ভয়ের চটে সে নিজের প্রশ্নই ভুলে গেল। এদিকে মিষ্টির এমন কাণ্ডে নবাব শরীর দুলিয়ে হেসে উঠে বলল, “এই মিষ্টি, আমি আছি তো।”

ডান চোখ একটুখানি খুলে নবাবের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি জিজ্ঞেস করল, “তোমার মতো মানুষ এমন একটা বিমান কি সামলে রাখতে পারবে?”

হাড় ভাসা চেহারায় মায়া যেন ভেসে উঠল নবাবের। চোখ নামিয়ে মিষ্টির ডান হাত নিজের হাতের সাথে মিশিয়ে নিলো। মিষ্টির প্রতিটি আঙুলের সাথে নবাবের প্রতিটি আঙুল জড়িয়ে নবাব তাকাল মিষ্টির দিকে। শীতল কণ্ঠে সে মিষ্টিকে বলল, “বিমান সামলে কী হবে? আমি তো তোমায় আমার বুকের মধ্যে সামলে রাখতে চাই।… এই মিষ্টি, আমার ছোট্টো হৃদয়পুরে থাকবে সারাজীবন? সেখানে আমি তোমার নামে ছোট্টো একটা কুঁড়েঘর সাজিয়েছি।”

মিষ্টি চোখ নামিয়ে নিয়ে একটু যেন কাঠ গলায় বলল, “বিমানের মধ্যে এসব কেন বলছ? লোকে শুনলে…” মিষ্টিকে থামিয়ে নবাব কাছে এসে ফিসফিস করল, “কালকে আমাদের পরিবার আমাদের এক করে দেওয়ার পর আমার লজ্জাশরম বোধহয় হাটে বেঁচে দিয়েছি। তাই লোকে শুনলেও আমার কিছু যায় আসে না গো। জানো, কালকে প্রথম নিজের ঘরে শুয়েও শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি। প্রতি মূহুর্তে তোমার কাছে ছুটে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারিনি। তবে আজ থেকে তোমাকে একদম ছাড়ছি না।” এই বলেই মিষ্টির হাতটা বুকে চেপে ধরে নবাব জানতে চাইল, “ভুল বলছি কি?”

“জানি না।” বলেই নবাবের বুকের স্বেচ্ছায় ঠাঁই নিলো মিষ্টি। একদিকে চলন্ত বিমানের ভয়, অন্যদিকে নবাবের লজ্জা মিশ্রিত কথায় মিষ্টি যেন কূল খুঁজে পাচ্ছে না। নবাব তাকে লজ্জায় ফেলছে অথচ সেই লজ্জা আড়াল করতে মিষ্টি নবাবের বুকে মুখ লুকিয়েছে। বিষয়টা অবাক করার মতো হলেও মিষ্টি কিছু ভাবল না বরং নিজের এমন কাণ্ডে লজ্জায় কুঁকড়ে উঠে নবাবের আকাশী রঙের টি-শার্ট এক হাতে খামছে ধরছে। এদিকে আনন্দে তৃপ্ত নবাব মিষ্টিকে আলিঙ্গন করে বলে উঠল,

“আমি দৃষ্টিগোচর হলে যদি
তোমার হৃদয় করে আমায় স্মরণ।
তবে দু-জনার দুর্বোধ্য এবং সুপ্ত অনুভূতিতে
সৃষ্টি হবে অমোঘ প্রীতিকাহন।”

[সমাপ্ত]

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here