প্রীতিকাহন পর্ব ৩৬

#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_৩৬

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

“গায়েব হইনি মিষ্টি। আমার পরিবারকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। নিলয়ের পরামর্শে প্রথমে স্থির হয়েছিল আমি বাসায় কথা বলে রাজি করাবো। বাবা প্রথমে অমত করলেও পরে রাজি হয়েছিল কিন্তু মাকে রাজি করাতে পারিনি। মায়ের একটাই কথা, তোর মামা-মামী রাজি হবে না। আমি আর বাবা মিলে অনেক বুঝিয়েও মাকে রাজি করাতে পারিনি। এদিকে আমি তো আর নিজের বিয়ের প্রস্তাব নিজে দিতে পারি না। তাই ঐসব করে তোমাকে বিয়ে করতে হলো। বাবা হয়ত মামার সাথে কথা বলতে পারতেন কিন্তু জল অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। তাছাড়া বর সেজে বিয়ে করার মতো পরিস্থিতি যে হতো না তা তুমি ভালো করেই জানো।”

“কিন্তু এসব করেও কি তেমন কোনও লাভ হলো বলো? জীবন-মরণ দাঁড়িপাল্লায় রেখে এগিয়ে যেতে হচ্ছে।” হা-হুতাশ ভাসলো মিষ্টির কথায়।

“এই মিষ্টি, এত কেন ভাবছো? তোমার নবাবকে তুমি কি বিশ্বাস করো না?”

“বিশ্বাস?… হুম, এই একটা শব্দের ওজনে সব পিছনে ফেলে তোমার পথে হাঁটছি নবাব।”

“তাহলে চিন্তামুক্ত হয়ে হাঁটো না। তোমার আর আমার মাঝে ওইসব এনো না। যেই কয়দিন দেশে আছি শুধু তোমায় ঘিরে থাকতে চাই৷ তোমাকে মিষ্টি করে হাসাতে চাই আর একটু রাগাতে চাই।”

শব্দ করে হাসলো মিষ্টি, “রাগাতে?… কেন? তোমার কি যেচে ঝগড়া করতে ভালো লাগে?”

নবাব কন্ঠ নরম করে বললো, “তোমার নাকের ডগায় জমা মিষ্টি রাগ,
তোমার দাঁতে দাঁত চেপে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি
আমি বড় ভালোবাসি, বড়ই ভালোবাসি।”

“কাব্য করো না তো আমার সাথে।” কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল মিষ্টি।

ফিসফিস করলো নবাব, “তবে কার সাথে করবো? তুমিই বলে দাও। তোমার মতো কাউকে তো আমার চোখে পড়লো না।”

কপট রাগে মিষ্টি বললো, “আমি তোমার জন্য মেয়েদের নিয়ে বসে নেই যে বললেই দেখিয়ে দিবো।”

“তাহলে যতদিন দেখাতে না পারছো, ততদিন না হয় সহ্য করো।”

“আমার বয়ে গেছে।” হো-হো করে হেসে উঠলো নবাব। ঝুঁকে এলো মিষ্টির দিকে আর কন্ঠে অন্য সুর টেনে বললো, “এমন লজ্জায় আমাকে করো না বিভোর,
তোমার আরক্ত লজ্জায় আমার চিত্তে লাগে ঘোর।”

.

চার ঘন্টা পর কক্সবাজার ছেড়ে দিতে হবে মিষ্টি আর নবাবকে। তাই শেষবারের মতো বালুচরে রাখছে তারা পায়ের চিহ্ন। মিষ্টির মাথার ওপর চকচকে নীল আকাশ, ডান পাশে উত্তাল সমুদ্র আর বাম পাশে নিশ্চুপ নবাব। নবাবের পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে মিষ্টি হাঁটছে কিন্তু হৃৎস্পন্দনের তাল মিলছে কই?

কালকে মাথিনের কূপ থেকে ফেরার পর মিষ্টির কাছে জীবনটা খুব সুখকর মনে হয়েছিল। তার মাঝে ভাবনা এসেছিল, “আমি কি খুব বেশি ভাগ্যবতী?” কিন্তু রাতে স্বাতী নক্ষত্রের নিচে বসে যখন নবাব নিজের হৃদয়ের সব ব্যথা মিষ্টির সম্মুখে উথলে দিলো, তখন মিষ্টির নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হয়েছিল, “একটা মানুষ কেন আমার জন্য এত কষ্ট সহ্য করলো? কেন আমার জন্যই তাকে কষ্ট সহ্য করতে হবে? আমার কথা রাখতে গিয়ে জীবনের তোয়াক্কা না করে বাড়ি ফিরছে আবার বিদেশ ফিরে যাওয়ার জন্যও রাজি হয়েছে। আমাকে এতটা স্বার্থপর কেন বানিয়ে দিচ্ছে নবাব?” এমন সব ভাবনায় মিষ্টি সারারাত নির্ঘুম কাটিয়েছে।

হাঁটতে গিয়ে নিজের ডান হাতে চোখ পড়লো মিষ্টির। একের পর এক অবাক করার মতো কাহিনি শুনে আর নতুন নতুন জায়গা পরিদর্শন করে মিষ্টি ভুলেই গিয়েছে তার অনামিকা আঙুলে একটা সোনার আংটি ছিল। সোহেলের সাথে বাগদান অনুষ্ঠানে তাকে আংটি পড়িয়ে ছিল সোহেলের মা। নবাব যেদিন মিষ্টিকে তুলে আনলো, সেদিন সব গহনা খুললেও আংটি তার হাতেই ছিল এমনকি নবাব যখন তার বন্ধুদের কাছে সমস্ত গহনা গচ্ছিত রেখেছিল, তখনও আংটিটা ছিল। কিন্তু এখন সেটা আঙুলে দেখতে না পেয়ে নবাবকে ডাকলো মিষ্টি, “নবাব?”

মিষ্টির ডাকে দাঁড়ালো নবাব, “কী?”

“আমার হাতের আংটি কোথায় রেখেছি মনে করতে পারছি না। যার আংটি, তাকে ফিরিয়ে দিলে…” মিষ্টির কথা বলার মাঝে নবাব বলে উঠলো, “যার আংটি এখন সেটা তার কাছেই অবস্থান করছে।”

“মানে?” বুঝতে না পেরে।

“সোহেলের সাথে যেদিন দেখা হলো, সেদিনই ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।”

“কিন্তু তুমি সেটা নিলে কখনও? ওটা তো আমার হাতেই ছিল।”

একটু কাছে এলো নবাব। আশেপাশে মানুষ থাকা সত্ত্বেও তোয়াক্কা করলো না সে। উত্তাল ঢেউয়ের ছন্দ উপেক্ষা করে নরম সুরে মিষ্টিকে বললো, “যখন ঘুমের রাজ্যে বিচরণ করছিলে, তখন আমার অবাধ্য মন তোমার রাজ্যের খোঁজে পথিক হয়েছিল। যখন তোমার চোখের তারায় ঘুমের ছড়াছড়ি, তখন আমার নির্লজ্জ চোখ তোমার আবেশে হয়েছিল ভারী। আমার মাথার ওপর রাখা ছিল তোমার হাত আর সেটা সরাতে গিয়েই আহত হয়েছিল মন ঐ আংটি দেখে। রাগ-ক্ষোভ নিয়ে সেটা খুলে ফেলেছিলাম তোমার অজান্তেই।”

“তার মানে তুমি সিলেটে…”

“হ্যাঁ, সিলেটের প্রথম সকালেই আমি এটা খুলে নিয়ে ছিলাম। তোমাকে কাছ থেকে দেখা হয়নি বলে সেটা আমার দৃষ্টিগোচরে রয়ে যায় নয়ত আর আগেই আংটিটা ছুঁড়ে ফেলতাম।” নবাবের কথায় মিষ্টি চোখ নামিয়ে নিলো। হিজাব খোলা মুখে তার চিন্তার সাথে কিঞ্চিৎ রাগ ভেসে উঠতেই নবাব জিজ্ঞেস করলো, “রাগ করলে না-কি অভিমান?”

“এসব করবো কোন কারণে?” মিষ্টির চোখে ঘনঘন পলক পড়লো।

“ঐ যে, তোমার অজান্তেই তোমাকে দেখেছে আমার নির্লজ্জ চোখ।” এবার মিষ্টির মুখাবয়বে সমস্ত প্রতিক্রিয়া মুছে গিয়ে নতুন প্রতিক্রিয়ার আবির্ভাব হলো। কিঞ্চিৎ লজ্জায় চেহারা যখন লাল বর্ণ হচ্ছে, তখন মিষ্টি অন্য প্রসঙ্গ টানলো, “দুপুর হয়ে এসেছে। হোটেলে চলো।”

“প্রসঙ্গ বদলে দিলে? তুমি কি ভেবেছো আমি বুঝবো না?” একটু রাগী কন্ঠে নবাব কথাগুলো বলেই হাঁটতে শুরু করলো আর মিষ্টি বিচলিত হয়ে নবাবের হাত ধরে বললো, “এ কি! রাগ করছো কেন?” তেমনই রাগী কন্ঠে নবাব বললো, “হাত ছাড়ো আমার।” বুঝতে না পেরে মিষ্টির কপাল কুঁচকে এলো, “কী?”

“হাত ছাড়ো আমার।” এবার হালকা হেসে নবাব একই কথা বলতে মিষ্টিও হেসে উঠলো, “এই, তুমি আমাকে নকল করছো কেন?”

“বাহ! অতি সহজেই দেখছি সব বুঝে যাও।”

একটু লজ্জা পেয়ে মিষ্টি হাত ছেড়ে দিতে নবাব বললো, “এখন চলো ঝগড়াটা না হয় পরে করবো।” মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো মিষ্টি।

এয়ারপোর্টে এসে অটোরিকশা থামতেই মিষ্টি আর নবাব নেমে দাঁড়ালো। চোখ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে মিষ্টি ভাবলো, “কক্সবাজারের এয়ারপোর্ট এত সাধারণ কেন? কত শান্ত আর জনমানবহীন! অথচ ঢাকার এয়ারপোর্ট ঠিক এর বিপরীত হয়ত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বলে।” মিষ্টির প্লেনে চড়ার অভিজ্ঞতা না থাকলেও বিমানবন্দরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে৷ মিষ্টির বিপদের কথা শুনে নবাব যখন তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন আবার বিদেশে ফিরে যাবার সময় মিষ্টি এসেছিল ঢাকা এয়ারপোর্টে। ছলছল নয়নে নবাবকে বিদায় দিয়েছিল যা প্রথমবার মিষ্টি করতে পারেনি৷ নবাব প্রথম যখন বিদেশে যায়, তখন বন্ধুদের ছাড়া কাউকে নিজের সাথে এয়ারপোর্টে আনেনি।

“মিষ্টি, তুমি চেয়ারে গিয়ে বসো আমি এখানকার কাজ শেষ করে আসছি।” প্রতিত্তোরে মিষ্টি মৃদু মাথা নাড়িয়ে ধীর পায়ে হাঁটতে লাগলো। এয়ারপোর্টে বসার জন্য বসার ব্যবস্থা আছে। সেখানেই নিজের আসন বুঝে নিলো মিষ্টি পাশাপাশি একটা সিট নবাবের জন্যও বরাদ্দ করলো।

সকালে নাস্তা করতে গিয়ে নবাব যখন বললো, “নাস্তা শেষ করে একটু বিচে যাবো৷ আর এখানে আসা হবে কিনা কে জানে? এরপর দুপুরের খাবার খেয়ে নিতে হবে।”

“এত তাড়াতাড়ি দুপুরের খাবার?” অবাক হয়েছিল মিষ্টি।

“হ্যাঁ, কারণ দেড়টায় আমাদের ফ্লাইট।”

“ফ্লাইট? আমরা বাসে যাচ্ছি না?”

“নাহ।”

“নবাব, হঠাৎ প্লেনে কেন যাচ্ছো? বাসে কি যাওয়া যেত না?”

“যাওয়া যেত কিন্তু বাসে যেতে সতেরো/আঠারো ঘন্টা লাগবে যেখানে প্লেনে মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিটে ঢাকা এয়ারপোর্টে চলে যাওয়া যাবে। এরপর সেখান থেকে একটা প্রাইভেট গাড়িতে দুই আড়াই ঘন্টায় বাসায় পৌঁছে যাবো। এত কম সময়ে যেখানে পৌঁছে যাবো, সেখানে বাসের ঝামেলা কেন পোহাতে যাবে কেউ? আর হাতে সময় কম আমাদের মিষ্টি অথচ এখনও অনেক কাজ করা বাকি।” নবাবের কথায় অনেককিছুর ইঙ্গিত ছিল। মিষ্টি জানার জন্যও ব্যাকুল ছিল কিন্তু চিন্তিত নবাবকে অহেতুক প্রশ্ন করে অপ্রস্তুত করতে চায়নি মিষ্টি। তাই বিনা বাক্য ব্যয় চুপ করে থেকেছে। তাছাড়া কক্সবাজারের এয়ারপোর্ট এবং প্লেনের ভ্রমণ সবকিছুই তার নতুন বিধায় সে আর আপত্তি করেনি।

“প্লেন এসে এখনও পৌঁছাতে পারেনি। আমাদের একটু দেরি হবে মিষ্টি।” মিষ্টির পাশে বসে নবাব ক্লান্ত কন্ঠে বললো৷ মিষ্টি কেবল নবাবের দিকে তাকালো কিন্তু মুখে কিছু বললো না।

নবাব জানতে চাইলো, “কিছু খাবে?”

“উঁহু।” আর কোনও কথা হলো না দু’জনার মাঝে। প্রায় মিনিট পাঁচেক পর হঠাৎই মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো, “আমার কাগজপত্র তুমি কোথায় পেলে নবাব?” আচমকা মিষ্টির এমন প্রশ্নে নবাব খানিকটা ভড়কে গেল। জবাব না দিয়ে যখন নবাব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, তখন মিষ্টিই বলতে শুরু করলো, “আমি জানি তুমি এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা পছন্দ করো না৷ কিন্তু আমার এসব জানতে ইচ্ছে করছে কারণ তুমি না বললেও বুঝতে পারছি এসব একদিনের পরিকল্পনায় হয়নি। দিনের পর দিন আর মাসের পর মাস তোমরা নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা করেছো। তাই তো একটা আঁচও পড়েনি এতদিনে। আমি অনেককিছুই বুঝতে বা ধরতে পারছি না কিন্তু এটা ভালোই বুঝতে পারছি তুমি আর তোমার বন্ধু ব্যতীত অনেকে এই পরিকল্পনার শামিল।”

নবাব মাথা নুইয়ে নিলো। আশেপাশে মানুষ আছে তবে সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। নবাব প্রথমে স্থির করলো মিষ্টিকে কিছুই বলবে না কিন্তু পরক্ষণেই মন বদল করলো, “হ্যাঁ, আমার বন্ধু ব্যতীত আরও তিনজন এতে শামিল আছে।”

“তিনজন?”

তাকালো নবাব, “হুম, তবে এখন একজনের নাম বলছি কারণ বাকি দুইজনের নাম এখন নয়, পরে বলবো।”

মিষ্টির বিষয়টা অপছন্দ হলেও সে আপত্তি করলো না, “একজনটা কে?”

“লামিয়া।”

“হোয়াট? কী বলছো তুমি এসব?” বিস্মিত হলো মিষ্টি।

“ঠিকই বলছি। আমার কাছে তোমার কাগজপত্রের ছবি ছিল যা তুমি আমাকে বিভিন্ন সময়ে পাঠাতে বিভিন্ন ছোটখাটো কাজের জন্য কিন্তু মূল কপি ছিল না। আমি লামিয়াকে বলে সেসবের ব্যবস্থা করেছিলাম। সোহেলের সাথে তোমার বাগদান নিয়ে সবাই খুব ব্যস্ত ছিল আর আমি সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ছিলাম।” সবটা শুনে মিষ্টির চোয়াল শক্ত হলো, “তাহলে নিশ্চয়ই হলুদের রাতে লামিয়াই সব ব্যবস্থা করেছিল যেন তুমি আমাকে হলুদের ছোঁয়া দিতে পারো, তাই না?”

…চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here