#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_৫
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
“দেখি, কোথায় যাওয়া যায়?”
জিসান জানতে চাইলো, “আমরা কি থাকবো ততক্ষণ?”
প্রতুত্তরে নবাব বললো, “নাহ, তোরা দেরি করিস না। এখনই চলে যা।”
একটু ভেবে নিলয় বললো, “ঠিক আছে।” এরপর নবাবকে জড়িয়ে ধরে হালকা চাপড়ে আবার বলে উঠলো, “নিজের আর ভাবীর খেয়াল রাখিস।”
“হুম।”
.
দ্বিপ্রহরে সূর্য মাথার উপরে ঝলমল করছে। সাদা ভবনের এই বাড়ি হরেকরকমের গাছপালা ঘেরা তাই সূর্যের প্রখরতা তেমন অনুভব হয় না। বিরামহীন চলছে আমার উপরে ফ্যান, পেটে ক্ষুধার রাজ্য কিন্তু চিন্তায় সেদিকে মিষ্টির নেই ধ্যান।
গতকালকে পরা বেনারসি জড়িয়ে বিছানার কাঠে পিঠ ঠেকিয়ে ভাবনার রাজ্যে বিচরণ করছে মিষ্টি। দুই পায়ের হাঁটু উঁচু করে রেখেছে। এক হাত তার হাঁটুতে অন্য হাত তার কুঁচকানো কপালে। অনাহারে আর চিন্তায় দুই চোখের পাতা বুঁজে আছে। হঠাৎ পায়ে পাতায় কিছু একটা অনুভব করতে চোখ মেলে সোজা হয়ে বসলো মিষ্টি। মেঝেতে হাঁটু গেঁড়ে বসা নবাবকে দেখে বলে উঠলো, “নবাব, তুমি এ…” মিষ্টি নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল। নিখুঁত নকশায় ভরপুর দু’টো রুপোর নূপুর একে একে পরিয়ে দিচ্ছে নবাব। মিষ্টি বাঁধা দিতে গিয়েও কেন যেন বাঁধা দিলো না। নবাবের গম্ভীর মুখ আর শরীর নড়ে উঠতে গিয়ে নড়ছে কপালের চুল। মাঝ বরাবর সিঁথি করা চুলে কপাল ঢেকে আছে কিন্তু এতে আড়াল হচ্ছে না নবাবের গাম্ভীর্য।
কালকে থেকে প্রতি মূহুর্তে মিষ্টি দেখছে অন্য এক নবাবকে। নবাবের নতুন রূপে মিষ্টি চমকিত হওয়ার পাশাপাশি বিচলিতও হচ্ছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মিষ্টি দেখছে নবাবকে। নিজের কাজে ব্যস্ত নবাবের নিচু দৃষ্টি এখন মিষ্টির পায়ে আবদ্ধ আর হাত ব্যস্ত নূপুর পড়াতে। হঠাৎ নবাব চোখ তুলে তাকাতে মিষ্টি বিস্মিত হয়ে বললো, “এ কি? কাঁদছো কেন?”
শক্ত চোয়ালে অথচ ছলছল করছে নবাবের চোখ। হাড় ভাসা মুখে নবাবের অতি সুন্দর চোখ রক্ত বর্ণের হয়ে আছে। এ যেন চোখ নয় আগুনের ফুলকি। সেই আগুনের ফুলকিতে আবার জমে আছে শ্রাবণ ধারা। এই চোখ হাজারও কথা বলছে আর সেই কথা সুখের নয়, হৃদয়ের ব্যথার। কয়েক সেকেন্ড চোখাচোখির পর নবাব তার উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের মুখ নেড়ে উঠলো, “মিষ্টি, আমি তোমার সাথে এতটা বাজে ব্যবহার করতে চাইনি। আমি চাইনি তোমায় এভাবে বিয়ে করতে, জোরজবরদস্তি করে আমার বউ বানাতে।… বিশ্বাস করো, তোমাকে আবার হারালে আমি সত্যিই বেঁচে থেকেও মরে যেতাম। এবার যেই সুযোগটা চোখের সামনে হাতছানি দিয়ে আমায় ডাকছিল, আমি সেই সুযোগ হাতের মুঠোয় বন্দী করে নিয়েছিলাম তোমায় পাবার তীব্র আশায়।” ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে নবাব মাথা নুইয়ে নিলো এরপর বলতে লাগলো, “নিজের অবাধ্য আর সুপ্ত আশাকে বাস্তব জীবনে নিজের করে পেতে আমি তোমায় জোর করে বিয়ে করেছি। কিন্তু আল্লাহকে সাক্ষী করে বলছি, তোমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমি কখনও জোর করবো না। তুমি আমাকে অজস্র ঘৃণার ভিড়ে ছুঁড়ে ফেললেও আমি কোনও প্রতিবাদ করবো না। কারণ আমার ভালোবাসা যদি সত্যি হয় তবে তোমার ভালোবাসা আমি নিশ্চয়ই পাবো। তুমি শুধু আমায় ফাঁকি দিও না, আমায় ছেড়ে চলে যেও না।” ফিকে হাসিতে নবাব বলে উঠলো, “আমার কথাগুলো চিরাচরিত চলচ্চিত্রের সংলাপ বলে মনে হচ্ছে, না?”
নবাব পূর্ণ দৃষ্টিতে মিষ্টির দিকে তাকালো। মিষ্টি নবাবকে দেখে চোখ নামিয়ে নিলো। এতে নিজের মাঝে অস্বস্তি অনুভব করে নবাব অন্য প্রসঙ্গে বললো, “কালকে থেকে কিচ্ছু খাওনি। এখন কিছু খেয়ে নাও।”
তীক্ষ্ণ চাহনিতে মিষ্টির প্রশ্ন, “কেন এমন করলে?”
নবাব বুঝতে পারেনি এমন ভঙ্গি মুখে ফুটিয়ে তুলতে মিষ্টি দ্বিতীয় প্রশ্ন করলো, “আমার এবং আমার পরিবারের কথা অন্যপাশে রেখে যদি তোমার পরিবারের কথা জানতে চাই?”
এবার প্রশ্ন নবাবের বোধগম্য হলেও সে মাথা নুইয়ে নিলো। নিজেকে অপরাধী ভেবে অন্য জবাব দিলো, “খেয়ে নাও।” এতে চোয়ালে সংকোচন হলো মিষ্টির, “নবাব, দুইদিন ধরে যেই মেয়ে চোখের সামনে এতকিছু দেখছে তার গলা দিয়ে একটা দানাও নামবে না।”
“যে এতোকিছু করেছে, তার গলা দিয়েও তো নামেনি।” বাচ্চাদের মতো মুখ করে নবাব জবাব দিলো মাথা নুইয়ে।
অবাক চোখে তাকিয়ে, “তুমি খাওনি?”
মিষ্টি তার প্রশ্ন উত্তর পেল না তাই আবার জানতে চাইলো, “কিছু বলছো না কেন?”
“নাহ।”
“কেন?”
“ইচ্ছে করেনি।”
“কিন্তু তুমি তো বলেছিলে, তোমার খাবার খাওয়ার প্রয়োজন আছে। আমি না খেলেও তুমি খাবে।” এক গাল হেসে মিষ্টি বলে উঠলো, “আমার সাথে তাল মিলিয়ে না খাওয়ার অভ্যাস যাইনি তোমার।”
চোখ তুলে তাকালো নবাব, “যেই অভ্যাস আমার স্নায়ুতে নিমজ্জিত, সেই অভ্যাস কভু যাওয়ার মতোন?”
নবাবের প্রশ্নের উত্তর দিলো না মিষ্টি, “উঠে বসো।” এরপর বিছানায় অনাথের মতো পড়ে থাকা খাবারের প্যাকেটগুলো দেখিয়ে মিষ্টি বললো, “খেতে শুরু করো।”
“তুমি খাবে না?”
এক গাল হেসে মিষ্টি বললো, “খেতে ইচ্ছে না করলেও খেতে হবে আমায়।”
হঠাৎ কী যেন ভেবে নবাব জানতে চাইলে, “মৃত্যুর আগে কি ক্ষমা শব্দটা আমার কানে পৌঁছাবে?” নবাবের প্রশ্নে আচমকা ফুঁসে উঠলো মিষ্টি, “ক্ষমা!… কীসের ক্ষমা? কবুল বলে বিয়েটা গ্রহণ করলেও তোমাকে আমি গ্রহণ করেছি, সেটা তুমি ভাবলে কী করে?”
মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ালো নবাব। চাপা কান্নাকে আরও চাপা দিয়ে নিজের মনটা শক্ত করে জবাব দিলো, “এমনটা আমি ভাবিনি সেটা শুরুতেই বলেছি।”
“সব জেনে আর বুঝে তবে কেন ক্ষমার কথা জানতে চাইছো?”
“অতি সহজে কবুল বললে তো তাই ভাবলাম হয়ত আমার প্রতি তোমার…”
“অতি সহজে? সহজে কোথায় পেলে? আমার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তুমি আমায় কবুল বলতে বাধ্য করেছো।”
কপট রাগে হাত নাড়িয়ে বলতে লাগলো, “হ্যাঁ, আমি জোর করে বিয়ে করেছি কিন্তু মিষ্টি, তোমার কি সত্যিই মনে হয়েছে আমি তোমার মাথা গুলিতে ঝাঁঝরা করতে পারি?”
চোখ বুঁজে ঘরময় ঘুরতে থাকা বাতাস শুষে নিয়ে চোখ মেলে তাকালো মিষ্টি। সাধারণ গলায় উত্তর দিলো, “তোমাকে আমি কতটা চিনি তা আমার অজানা কিন্তু আমি জানি, তুমি কখনও আমার রক্তবিন্দু মাটিতে পড়তে দিবে না।”
মিষ্টির কথায় নবাব এখন চাপা কান্নার ভিড়ে মৃদু সুখ অনুভব করলো। এতকিছুর পরও নবাবের প্রতি মিষ্টির তীব্র বিশ্বাসে ওর মাথা নুইয়ে এলো।
জোরপূর্বক একটু হেসে মিষ্টি বলে উঠলো, “তুমি স্মৃতিহারা হলেও হয়ত আমাকে মারতে সাহস করবে না।”
“এত যখন বুঝো তাহলে তো কবুল বলা নিয়ে আরও আপত্তি করতে পারতে।”
“এতে তুমি মানতে? জানি তো মানতে না। কোনও না কোনও উপায়ে আমাকে কবুলে বলিয়ে ছাড়তে। আমি তোমার সাথে পেরে উঠতে পারবো না ভেবেই… যা-ই হোক, আমার কপালে যদি বিধবা লেখা থাকে তাহলে আমি শত চেষ্টা করলেও কাজ হবে না।”
“তুমি বারবার এককথা কেন বলছো?” প্রশ্ন শেষে মিষ্টির দিকে তাকালো নবাব।
“ভবিষ্যৎ সত্যি বলতে দোষ কোথায়?”
“ভবিষ্যৎ বিধাতা জানেন, আমরা না। এমনও তো হতে পারে ভবিষ্যতে সুন্দর কিছু লেখা আছে।” এসব নিয়ে মিষ্টির আর কথা বাড়ানোর ইচ্ছে নেই, “এখন খেয়ে নাও। ভবিষ্যতে কথা পরেও ভাবা যাবে।”
“তুমি?”
“আমিও খাবো, এক প্রকার জোর করে।”
.
দুপুর তিনটা নাগাদ শপিং ব্যাগ হাতে মিষ্টির রুমে ঢুকলো নবাব। নাস্তা সেরে বেরিয়েছিল সে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা করতে। এবারও বাসা থেকে বের হওয়ার আগে মিষ্টিকে তালাবদ্ধ করে রেখে গিয়েছিল। জানালার পাশে মিষ্টিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নবাব ওকে ডেকে উঠলো, “মিষ্টি, তৈরি হয়ে নাও। আমাদের বের হতে হবে।”
মুখ ঘুরিয়ে মিষ্টি জানতে চাইলো, “কোথায়?”
“বাসায় যাচ্ছি না এটা নিশ্চিত। এর বেশি কিছু জানতে চেয়েও না।”
“আমি যাবো কোথায় সেটা কি আমি জানি পারি না?”
“না, পারো না।”
“ওহ।” আবার জানালার দিকে মুখ করে দাঁড়ালো মিষ্টি আর ধীর গলায় বললো, “তাহলে আমারও যাবার প্রশ্ন আসে না।”
“অসময়ে জেদ করো না তো। বড় হয়েও কি আশু বিপদের আভাস পাচ্ছো না তুমি?”
নবাবের দিকে মুখ ফেরালো মিষ্টি, “আমি যে বড় সেটা তাহলে মনে আছে তোমার। ভাবলাম হয়ত ভুলে গেছো।”
“এখন এসব কেন বলছো?”
চেঁচিয়ে উঠলো মিষ্টি, “কারণ আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। তোমরা সবাই মিলে আমাকে পাগল করে দিচ্ছো।”
শপিং ব্যাগ বিছানায় রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালো নবাব। মিষ্টির দিকে তাকিয়ে নরম কন্ঠে বললো, “সবার খবর আমি জানি না। তবে আমি অন্তত তোমার জীবনটা ধ্বংস হোক, সেটা চাইবো না।”
…চলবে কি?
(এটা কাল্পনিক এবং সিনেম্যাটিক লেখা। তাই সেভাবে গ্রহণ করার আশা রাখছি। ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন)