প্রীতিলতা পর্ব -২৪+২৫

#প্রীতিলতা❤️

#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury

#২৪_তম_পর্ব🍂

এমন হটোকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া তো ঠিক না প্রীতি। তুমি আর একটু ভেবে দেখো। এভাবে চলে যেতে চাইলেই যে চলে যাওয়া যায় না। কথাটা সামিরা ভাবি বলে উঠলেন। একই সাথে তাল মিলিয়ে মা বললেন,

— হ্যাঁ সেটাই তো। তুমি এ বাড়ির ছোট বউ প্রীতি। কিভাবে বলতে পারো বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে? মানছি তোমার রাগ হয়েছে তাই বলে এভাবে কেন তুমি সারা জীবনের জন্য চলে যাবে?

একটু সময় দাও আমার ছেলেকে। ধীরে ধীরে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমি জানি আমার ছেলে খারাপ ছাড়া, বেপরোয়া, এই সম্পর্কটা নিয়ে সে উদাসীন। কিন্তু তাই বলে তুমি একেবারে ওকে ছেড়ে চলে যাবে এ কেমন সিদ্ধান্ত।

মা আমার কাছে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

প্রত্যেকটা সংসার এই রকম ছোটখাটো ঝামেলা সমস্যা হয়েই থাকে তাই বলে কি সবাই সংসার ভেঙে চলে যায় নাকি।বরং মানিয়ে নিতে হয়।

আমি শুকনো হেসে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,

— মা মানিয়ে তো আপন মানুষের সাথে নিতে হয়। আপনার ছেলে যে আপন মানুষ হতে চাইনি কখনো। আপনারা ঢাকায় যাওয়ার আগেরদিন রাত্রে উনি ডাইনিং রুমে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন,

* ওনাকে বিয়েটা করতে বাধ্য করা হয়েছিল। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে, উনি আমাকে বিয়েটা করেছিলেন। উনি চাননি এই সম্পর্কটা তৈরি হোক। তাহলে কেন আমি এখানে থেকে তার বিরক্তির কারণ হব।

মা আরো কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু বাবা-মাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

— ও তো ঠিকই বলেছে… প্রীতি কেন তোমার ছেলের বিরক্তির কারণ হবে? একপাক্ষিক প্রচেষ্টা কেন শুধু প্রীতি করবে শুধুমাত্র এবাড়ির বউ বলে।

এখানে যদি তোমার নিজের মেয়ে থাকতো তাকেও কি জামাইয়ের দোষ লুকিয়ে ফেলে মানিয়ে নিতে বলতে। সেই জামাই এর কাছে তুমি কৈফিয়ত চাইতে না যে সে কেন তোমার মেয়ের সাথে এমন আচরণ করছে?

কেন শুধু শুধু তোমার বেপরোয়া ছেলের সাথে মানিয়ে নেবে? রূপে গুনে যোগ্যতায় কোন দিক থেকে কম আছে সে যে এখানে তোমার ছেলের শত অবহেলা শর্তেও মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে।

কি যোগ্যতা আছে তোমার ছেলের, প্রীতির পাশে দাঁড়ানোর। পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষিত বেকার সেজে বসে আছে ঘরে। শুধুমাত্র আমার উপরে জেদ করে।

আমার কথা না শোনার কসম কেটে বসে আছে তো তোমার ছেলে। আমি বুঝতে পেরেছি ও আমার সাথে জেদ করে প্রীতি মামণির সাথে এমন আচরণ করছে।

তোমার ছেলের কাছে শুনো তো আমি তার কি ক্ষতি করেছি? শুধুমাত্র নিজের ছেলেকে বিচারকের আসনে দেখতে চেয়েছিলাম। এটা কি আমার ঘোর অন্যায় হয়ে গেছে।

প্রত্যেক মা-বাবার কি তার সন্তানের কাছে কিছু চাওয়া পাওয়া থাকে না থাকতে পারে না? তাই বলে এমন আচরণ করে কেন তোমার ছেলে?

আর হ্যাঁ ওর মতামত ছাড়াই সাইমার সাথে বিয়ে ঠিক করে আমি ভুল করেছিলাম।আমি স্বীকার করছি।যার জন্য ওকে ভরা আসরে অপমানিত হতে হয়েছিল।

তা আমিও কি কম অপমানিত হয়েছিলাম।
মানুষের ভুল হতে পারে না। আমারও হয়েছিল। তার জন্য কি এখন ওর পা ধরে মাফ চাইতে হবে আমার। তাহলে কী ও আমাকে ক্ষমা করবে?

উপস্থিত সকলে বাবার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে আমি তো যেন আমার বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। বাবা যে এমন কিছু বলবেন আমি ভাবতেও পারিনি।

আর সেই রাগ ভিতরে পুষতে পুষতে তোমার ছেলের সেটা জেদে পরিণত হয়েছে আর তা থেকে একের পর এক ভুল করে যাচ্ছে সে।

আমি বুঝতে পেরেছি ও কেন প্রীতিকে মেনে নেয় নি। ওই যে ও আমার বন্ধুর মেয়ে বলে।এটাই হয়েছে মেয়েটার আসল অপরাধ।আচ্ছা ঠিক আছে।

ও ওর ক্রোধ আর ইগো এগুলো নিয়েই থাকুক। আমার ওই একটা ভুলের জন্য ও যদি সারা জীবন আমার ওপরে রাগ দেখিয়ে শান্তিতে থাকতে পারে ও তাই থাকুক। বাবা হিসেবে আমি সবসময় চাই আমার সকল সন্তানরা ভালো থাকুক।

একাই থাকুক ও সারা জীবন। এই ধরনের মানুষদের কখনো সঙ্গী থাকে না।

আমাদের দুজনের রেষারেষির মধ্যে আমি প্রীতির জীবন নষ্ট করতে পারি না। ওর ও ভালো থাকার পূর্ণ অধিকার আছে। সেই ব্যবস্থা আমি করব।

কথাগুলো শেষ করে বাবা আমার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,

প্রীতি মামনি তুমি আমার একটা কথা রাখো শুধুমাত্র। আমি জানি মামনি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি আমি। তোমার মায়ের মাথায় ভুত চেপে ছিল তার ছেলেকে ঠিক একমাত্র তুমিই পারবে।

আমি নিষেধ করেছিলাম কিন্তু তিনি তা কানে নেননি। এক সময় আমিও বিশ্বাস করেছিলাম যে আমার ছেলেটা হয়তো তোমার সান্নিধ্যে গেলে হয়তো সবকিছু আবার আগের মত হয়ে যাবে। লোভী হয়ে গিয়েছিলাম মা। ছেলেটাকে আবার আগের মতন নিজেদের কাছে ফিরে পাব বলে।

কিন্তু না বড্ড ভুল হয়ে গেছে আমাদের। তোমার মা-বাবা এখনই তোমার বিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন না।এক প্রকার জোর করে তোমাকে চেয়ে এনেছিলাম আমি তাদের কাছ থেকে।

খুব বড় মুখ করে বলেছিলাম যে তোমাকে একদম নিজের মেয়ের মত করে রাখবো। সামান্য কষ্ট স্পর্শ করতে দেব না তোমাকে। কিন্তু না কথা রাখতে পারিনি আমি।

তাকে বাধা দিয়ে বললাম,

— না বাবা আপনি এসব কি কথা বলছেন। এমন শশুর শাশুড়ি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু আমার ভাগ্যে এত সুখ শান্তি লেখা ছিল না। এতে আপনাদের কারোর কোন দোষ নেই।

কিন্তু মা আমি তো নিজের কাছে নিজে অনেক অপরাধী হয়ে গেছি। অপরাধ থেকে সামান্য হলেও মুক্তি দান করো আমাকে। আমার একটা মাত্র অনুরোধ রাখ। তাহলে বুঝবো আমার একটু হলেও অপরাধমোচন হয়েছে।

আমার সাথে সাথে উৎসুক দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালো। পাশে তাকিয়ে দেখলাম আমার বরাবর সোফা সেটের উপরে মাথা নিচু করে বসে আছেন সাফওয়ান।

সেদিক থেকে নজর ঘুরিয়ে বাবার উদ্দেশ্যে বললাম

— কি অনুরোধ বাবা?

বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

— আমি তোমাকে নিজের মেয়ের মত মনে করি। তাই আমাদের ভুলের কারণে তোমার জীবনে যেটুকু সময় নষ্ট হয়েছে সময়টা তো ফিরিয়ে দিতে পারব না কিন্তু তোমার একটা নতুন জীবন উপহার দিতে পারব।

পরবর্তী জীবনটাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে দিতে চাই। তুমি যদি বাড়িতে থাকতে না চাও থাকবে না। আমার মেয়ে বাইরে পড়াশোনা করলে তাকে যেভাবে সবদিক থেকে খেয়াল রাখতাম আমিও তাই রাখবো।

আর দয়া করে তোমার মা-বাবাকে এখন কিছু জানিও না। লজ্জা, আমি তাদেরকে মুখ দেখাতে পারবো না। আগে তোমার একটা যথার্থ ব্যবস্থা করে নেই তারপরে ভাইয়ের কাছে হাতজোড় করে মাপ চেয়ে নেব আমি।

আর তোমার পড়াশোনা শেষ হয়ে গেলে আমি ভালো ছেলে দেখে তোমাকে আবার বিয়ে দিব। তোমার যোগ্য পাত্রই তোমাকে উপহার দিব।

বাবার বলা শেষ কথাটি কানে পৌঁছাতে যেন বজ্রপাত হলো আমার ওপরে। পায়ের তলার মাটিটাও যেন কেঁপে উঠল আমার। এসব কি বলছেন বাবা…!

মা এবার বাবার হাত চেপে ধরে কাঁপা গলায় বললেন,

— এসব তুমি কি বলছো? ও আমার ছোট ছেলের বউ। তুমি আবার ওর বিয়ে দেবে মানে?

বাবা দৃঢ় গলায় বললেন,

— হ্যাঁ। আমার ছেলের সাথে ডিভোর্স করিয়ে আমি প্রীতিকে আমার বিয়ে দেব। ভুল যখন আমি করেছি শুধরে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।

আমার সারা শরীর কাঁপছে। ঘাড় ঘুরিয়ে সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনি চমকে বাবার দিকে তাকালেন। কিন্তু তিনি বরাবরের মতো নিশ্চুপ।শান্ত দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তার চোখ হালকা ছল ছল করছে বাবা ও তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।

সাফোয়ান শুকনো হেসে অন্য দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। সবাইকে পেরিয়ে তিনি সিড়িতে পা রাখতেই

বাবা দ্বিতীয়বারের মতো হুংকার ছাড়লেন। যার ফলে উপস্থিত সবাই হালকা কেঁপে উঠলোও সাফোয়ান আগের মত ভাবলেশহীন ভাবে দাড়িয়ে পড়লো

— আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। প্রীতি তুমি উপরে যাও গিয়ে তোমার সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে পুতুলের রুমে চলে এসো। কাল সকালে আমার মেয়ের জন্য কেনা ফ্লাটে তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবো।

আপাতত কাল থেকে তুমি ওখানেই থাকবে। আর আমি তোমার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেব। তুমি শুধু তোমার ক্যারিয়ারে মনোনিবেশ কর।

আর হ্যাঁ ।সকলের উদ্দেশ্যে বলছি। আমি এখন যে কথাগুলো বললাম এইগুলোই শেষ কথা। এই কথার নড়চড় হলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। এবার যাও সবাই যে যার রুমে যাও।

_______🌺🌺_________

রুমে এসে আলমারির কাছে এগিয়ে গেলাম আলমারির লক খুলে আমার লাগেজটা বের করে নিলাম। আলমারিটা আটকাতে গিয়ে হঠাৎ সেই সাফয়ানের কিনে দেওয়া কালো লং গাউন এর দিকে নজর গেল। হাতে তুলে নিলাম গাউনটা তাতে হাত বুলিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরতেই চোখে দিয়ে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

এই পোশাকটা তার দেওয়া প্রথম উপহার ছিল। ভালোবেসে দিক আর না বেসেই দিক তার থেকে পাওয়া প্রথম উপহার। এটা আমি এখানে রেখে যাব না। ব্যাগের চেইন খুলে ড্রেসটা ব্যাগে রেখে দিলাম। আলমারিটা লক করতে গিয়ে আবারো থেমে গেলাম আমি সাফওয়ানের শার্ট আর ছবি আগে ঢুকিয়ে যেন আটকে পেছনে ঘুরতেই সাফোয়ানের সাথে প্রায় ধাক্কা খেলাম।

তার চোখের দিকে তাকিয়ে যেন থমকে গেলাম। তার মুখটা আজ বড্ড শুকনো আর নির্জীব। শার্টের সামনের দুটো বোতাম খোলা চুলগুলো এলোমেলো চোখটা হালকা লালচে হয়ে আছে।

আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে চোখ ঘুরিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসে হেসে বলল,

— আজকাল কী নিজের পোশাক ছেড়ে আমার শার্ট গায়ে দেওয়াও শুরু করেছেন নাকি?

আমি তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললাম,

— না। প্রিয় মানুষটার বুকে ঘুমানোর অভ্যাস হয়ে গেছে তো তাই রাত্রে যদি ঘুম না আসে তাই ঘুমের ওষুধ হিসেবে নিয়ে যাচ্ছি সাথে করে। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবো আর কি।

সাফওয়ান এক নজরে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন । দেখে মনে হচ্ছে উনি কিছু বলতে চাইছেন। দাঁড়িয়ে থাকে জিজ্ঞাসা করলাম,

— আপনি কি কিছু বলতে চাইছেন?

উনি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন।

আমার মনের মধ্যে কিঞ্চিত আশার সঞ্চার হল। হয়তো ইনি এখুনি বলবেন এই প্রীতি কোথায় যাবে তুমি? এই ঘর থেকে একবার বেরিয়ে দেখো তোমার হাল খারাপ করে দেবো আমি। কোথাও যাবে না বুঝেছ তুমি। এই ঘরে আমার বউ হয়েই সারা জীবন থাকতে হবে তোমাকে।

আমি সাফোয়ানের দিকে আরো কিছুটা এগিয়ে গিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম,

— বলুন না কি বলবেন আমি শুনছি।

তিনি কিছুক্ষণ ইতস্তত করে

হঠাৎ বলে উঠলেন,

— তুমি সত্যিই চলে যাবে প্রীতি?

আমার কিছুক্ষণ আগের ভাবনাগুলো চুরমার হয়ে আমারি চোখের সামনে ভেঙে পড়ে গেল। চোখে পানি নিয়েই জোরে হেসে উঠলাম।

— তো আপনার কি মনে হচ্ছে আমি মজা করছি। আপনি এমন কেন বলুন তো আপনার কেন মনে হয় আমি সব সময় মজা করার মুডে থাকি।

বরং মজা তো আপনি করলেন আপনি চাইলে কিন্তু সবকিছু ঠিক করে দিতে পারতেন। কিন্তু আপনি করলেন না। আমাকে ভালবাসলে কি আপনার খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেত?

আরো কিছুটা আমার দিকে এগিয়ে এসে ধীর গলায় বললেন,

—- উহু আমার না বরং তোমার খুব ক্ষতি হয়ে যেত। তোমার সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পরে আছে। রূপে গুনে যোগ্যতায় কোন দিক থেকে কম আছো তুমি? কেন মিছে আমার মত একটা বেকারের সংসার করবে।

আমি এবার রাগে নিজেকে সামলাতে না পেরে তার শার্টের কলার চেপে ধরলাম,

— আপনি জানেন আপনি কত বড় অমানুষ। নিজ হাতে করে আমার ভালোবাসাটাকে প্রতিনিয়ত গলা টিপে হত্যা করে যাচ্ছেন।

কেন করলেন আপনি আমার সাথে এমন? আপনাকে আমি জীবনেও ক্ষমা করব না। শুধুমাত্র রাগ জেদ আর ইগোর জন্য আপনি কতগুলো সম্পর্ক থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন একবার ভেবে দেখেছেন।

আপনি জীবনের কোন না কোন এক সময় গিয়ে এর জন্য পস্তাবেন আমি বলে রাখলাম। তখন হাজার খুজলেও আর কাউকে আপনার পাশে পাবেন না।

আমার ফ্রেন্ড আমাকে বলেছিল জীবনের প্রথম ভালোবাসা নাকি ভুল মানুষের সাথে হয়ে থাকে। আজ বুঝতে পারছি কথাটা মিথ্যা ছিল না। আপনি আমার জীবনের সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল মানুষ। আর এই ভুল থেকে আমার মনে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে হয়তো সারা জীবনেও তা ঠিক হবে না।

শেষের কথাটা আমি কান্না জড়িত কণ্ঠে চিৎকার করে বললাম। উন্মদের মতো তার কলার ধরে ঝাকাতে লাগলাম,

— কেন করেছেন আপনি আমার সাথে এরকম? কেন কেন বলুন।

আমার হাত দুটো চেপে ধরে নিজের কলার ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন,

কি করছো তুমি প্রীতি এত জোরে জোরে চিৎকার কেন করছো? বাড়িতে সবাই শুনছে।

— শুনুক। এখানে আমি আমার হাজবেন্ডের সাথে চেঁচাচ্ছি । কার কী তাতে। আমাদের মাঝে যে আসবে তাকে আমি মেরেই ফেলবো।

সাফওয়ান আমাকে ধমকে বললেন,

— পাগল হয়ে গেছো তুমি?

—- হ্যাঁ। পাগল হয়ে গেছি আমি।

আর কি বললে তুমি? তুমি বেকার বলে আমি তোমার সংসার করতে চাইছি না? তুমি বেকার জেনেও আমি তোমার সংসার করতেই বাড়িতে এসেছি তোমার হাত ধরে। জেনে শুনেই বেকার ছেলেটাকেই ভালোবেসেছি আমি। ভবিষ্যতেও ভালোবেসে যাবো।

আর কী যেন ও হ্যাঁ যোগ্যতা….! ভালোবাসার জন্য কোন যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না । কেন বোঝনা তুমি এগুলো?

বরং এই বেকার ছেলেটা আমার ভালোবাসাটাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে তার থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে আমাকে।

আপনি জানেন আপনার এই কথাগুলো শোনার পরে আপনাকে আমার খু/ন করতে ইচ্ছা করছে। আমি না আপনার এই খাপ ছাড়া আচরণে এই এক মাসে ক্লান্ত হয়ে গেছি। আর নিতে পারছি না আপনার এই আচরণ।

এমনিতেই আজ সারা দিনের শারীরিক পরিশ্রম আর কিছুক্ষণ আগে মানসিক চাপের মুখে পড়ে শরীরটা একদম ক্লান্ত হয়ে গেছে। আমার গলার স্বর ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে আসলো।

মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠল আমার। সাফওয়ানের কলার থেকে হাত সরিয়ে দু হাত পিঠের কাছে নিয়ে গিয়ে শার্টটা আঁকড়ে ধরে আমার মাথাটা দিয়ে তার বুকে জায়গা করে নিলাম।

চোখ বুজে ঝিমিয়ে আসা গলায় তাকে বললাম,

—আমি তোমাকে সত্যি সত্যিই ভালোবেসেছি। আমার ভালবাসাটা মিথ্যা ছিল না সাফওয়ান। এমনটা না করলেও পারতেন। আপন….

বাকি কথাগুলো মুখের মধ্যেই হারিয়ে গেল। ঢলে পড়লাম তার বুকে…!
#প্রীতিলতা❤️

#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury

#২৫_তম_পর্ব🍂

পিটপিট করে চোখ খুলেই প্রথমে নজর গেল ছাদের দিকে।বড্ড বেশি অপরিচিত লাগলো। কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ মানসপটে সব ঘটনা একের পর এক ভেসে উঠলো।

ধরফর করে উঠে বসলাম আমি। চারিদিকে খুব সূক্ষ্মভাবে নজর ঘোরালাম। না এটা সাফওয়ানের রুম নয়। সম্পূর্ণ অন্য একটা ঘর। সম্ভবত সেই ফ্ল্যাট।
বাবা যেখানে আমাকে রাখতে চেয়েছিলেন। ভাবতেই চোখ জোড়া অশ্রুতে টই টুম্বুর হয়ে গেল।

আমাকে তার জীবন থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার এতই তাড়া। যে আমার অচেতন অবস্থায় এই ফ্লাটে এসে রেখে গেছে আমাকে। এতটা পাষাণ, হৃদয়হীন! মানুষ কিভাবে হতে পারে? এতগুলো দিন একই ছাদের নিচে তার সাথে থেকেছি ভালোবাসা দূরে থাক একটু কি দয়া মায়া জন্মায়নি আমার উপরে।

কথাগুলো নিজ মনে ভাবতেই ঠোঁট ভেঙ্গে কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমি। দুই হাতের তালু মাথার চুলের মধ্যে চালিয়ে চুলগুলো মুঠো করে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠলাম।

কান্নার চাপে দম নিতেও কষ্ট হচ্ছে আমার।ফোপাতে ফোপাতে বলে উঠলাম,

— কম চেষ্টা তো করিনি সাফওয়ান তোমার মনে জায়গা করার জন্য। একটু কেন বুঝলে না তুমি আমাকে? আমাকে একটু ভালোবাসলে তোমার কি এমন ক্ষতি হয়ে যেতো?

তুমি যদি বলতে যে তুমি আমাকে ঘেন্না করো তাহলে আমি নিজের মনকে বোঝাতে পারতাম । কিন্তু তুমি তো শুধু সব সময় নীরবতা পালন করে এসেছো আমি থেকে গেলেও তোমার কিচ্ছু যায় আসেনা চলে গেলেও যায় আসে না। তোমার এমন উদাসীন আচরণ আমি মেনে নিতে পারি না।

কেন এমন করলে তুমি আমার সাথে?কেনো?

বলে পাশে রাখা ডেক্সের ওপর ফুলদানি টা হাত দিয়ে আছাড় মেরে ভেঙে ফেললাম। ফুলদানিটা কয়েক টুকরো হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে আর ফুলগুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে।

কাঁচের ফুলদানি হওয়ায় ভাঙার সময় বেশ জোরে শব্দ হয়েছে। তৎক্ষণাৎ দরজার লক খুলে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করল কেউ। দরজা খোলার শব্দ হতেই মাথা তুলে সেদিকে তাকালাম।

আমার বয়সে একটি মেয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে ব্ল্যাক সালোয়ার কামিজ কিন্তু পোশাকটা দেখে কেমন uniform এর মত লাগছে। আমি ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে কিছুটা এগিয়ে এসে আমার উদ্দেশ্যে বললো,

— এনিথিং রং ম্যাম?

কথা না বলে তার দিকে তাকিয়ে আছি এক নজরে। আমার কোন রেসপন্স না পেয়ে আরো কিছুটা এগিয়ে আসতে দেখে কাছের ফুলদানিটা নিচে ভেঙ্গে পড়ে আছে। সে ওটা পা দিয়ে ডিঙিয়ে আমার কাছে এসে হাত ধরে দেখে বলল,

— আপনার লাগেনি তো ম্যাম?

আমি না বোধক মাথা নাড়ালাম তা দেখে মেয়েটা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপরে জায়গাটা পরিষ্কার করে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

— আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন ম্যাম। আমি আপনার জন্য খাবার আনছি।

এবার আমি মুখ খুললাম তাকে প্রশ্ন করলাম,

— তুমি কে?

— আমি মিতা। আপনার দেখাশোনা করার জন্য এসেছি। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন ম্যাম আমি আসছি।

বেরিয়ে যাচ্ছিল প্রায় তখনই আমি ওকে প্রশ্ন করলাম,

— কতক্ষণ আগে নিয়ে এসেছে আমাকে এখানে?

পেছনে ফিরে আমার উদ্দেশ্যে বলল,

— দুই ঘন্টা আগে ম্যাম।

আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। চোখ মেলে তার উদ্দেশ্যে বললাম,

— চলে গেছে তাই না।

মেয়েটি হাত দুটো সামনে রেখে অনুগত ছাত্রের মত উত্তর দিল

— জ্বী ম্যাম। কিছুক্ষণ আগে।

— আচ্ছা তুমি যাও। আমার জন্য এক কাপ আদা চা বানিয়ে আন। মাথাটা খুব ব্যথা করছে।

— ওকে ম্যাম। আর এই যে আপনার লাগেজ। এখানে আপনার সবকিছু আছে।

আমি মাথা নাড়াতেই মিতা রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
চাদরটা সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আরেকবার ঘরটায় চোখ বুলিয়ে লাগেজ এর কাছে এগিয়ে গিয়ে খুলে জামা কাপড় আর তোয়ালে বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।

প্রায় ৪৫ মিনিটের মত একটা শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে আসলাম ওয়াশরুম থেকে। বের হতে ই মিতাকে দেখলাম ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ সেন্টার টেবিল এর উপরে রাখছে। আমাকে দেখে বলল,

— এই নিন ম্যাম গরম গরম চা। আগেরটা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। খেয়ে নিন তাড়াতাড়ি।

আমার হাত থেকে টাওলটা নিয়ে বারান্দায় মেলে দিয়ে এসে বলল,

— আমি খাবার আনছি ম্যাম। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন।

— তাড়াতাড়ি কেন?

মেয়েটা কিছুটা দমে গেল। কিছুক্ষণ পরে বলল,

— না ম্যাম ।আপনি নাকি রাত থেকে কিছু খান নি তাই বললাম।

— ওহ। খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি যাও। আর হ্যাঁ, তুমি আমাকে আপু বলে ডাকতে পারো।ম্যাম বলো না । শুনতে ভালো লাগছে না।

মেয়েটা খুশি খুশি আমাকে বলে উঠলো,

— তাহলে ভাবি ডাকি।

কথাটা কানে যেতেই আমার যেন সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠলো। আমি বেশ জোরেই বলে উঠলাম,

— মোটেও না। আমাকে একদম ভাবি বলে ডাকবে না। আপু ডাকতে বলেছি।তাই ডাকবে। বুঝতে পেরেছো।

মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ের সম্মতি জানালো।তারপর চলে গেল। আমি বিরক্ততে “চ” এর মত উচ্চারণ করে বললাম,

— কার রাগ কার উপরে ঝাড়ছি আমি। ধ্যাত…!

রুমে রাখা সোফার উপরে বসে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চা খেতে লাগলাম। মাথাটা সত্যি বড্ড ব্যথা করছে।

__________🌺🌺________

কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ পর সে আবার ঘরে চলে আসলো। হাতে খাবারের ট্রে।

কিছু বলতে যাব তার আগেই মেয়েটা সেন্টার টেবিল এর উপরে খাবার পরিবেশন করলো। ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, কালোজিরা আর শুঁটকি মাছের ভর্তা, আর মুরগির মাংস ।

আমি খাবারের উপর চোখ বুলিয়ে মিতার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও মুখভরা হাসি দিয়ে বলল,

— আমি জানি আপু। এগুলো আপনার খুব পছন্দের খাবার এবার তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন।

আমি মিতার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম ও জানবে কিভাবে যে এই খাবারগুলো আমার খুব পছন্দের। কেউ তো জানেনা। আমি মিতাকে প্রশ্ন করলাম,

— কে বলেছে এগুলো আমার পছন্দের খাবার?

মেয়েটি অকপটে জবাব দিল,

— কেন স্যার বলেছে।

আমি মনে মনে ভাবলাম বাবা বাবা জানলেন কিভাবে মেয়েটার ডাকে আমার হুস ফিরল আর কিছু না ভেবে খাবারের মনোযোগ দিলাম সত্যি বড্ড খিদে পেয়েছে আমার।

খাওয়া-দাওয়া শেষে এখন একটু শরীরটা ভালো লাগছে মেয়েটা মাথা যন্ত্রণার ওষুধ আর পানি আমার হাতে ধরিয়ে দিল মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ওষুধটা খেয়ে নিলাম সত্যি এটুকু সময় মেয়েটাকে আমার বড্ড ভালোই লেগেছে মেয়েটা আমার মাথার দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে বলল,

— এ কী আপু। তোমার চুলগুলো তো দেখি একেবারে ভেজা। এসো আমার সাথে

বলে হাত ধরে টেনে বেড সাইড ড্রেসিং টেবিলের সামনে চেয়ারে বসিয়ে দিল আমাকে প্রথমে তোয়ালে দিয়ে চুলগুলো মুছে তারপর হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল গুলো ভালো করে শুকিয়ে ঝরঝরে করে পিঠে ছড়িয়ে দিল ।

হঠাৎ এর মধ্যে মেয়েটার ফোন বেজে উঠলো মেয়েটার ফোন নিয়ে কথা বলতে বাহিরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর মেয়েটা ফিরে এসে ওয়াল আলমারি থেকে হ্যাঙ্গারে ঝুলানো একটা লং ড্রেস ব্যাগ বের করল।

হাতে করে নিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে চেন খুলে ড্রেসটা বের করল। ওশান ব্লু কালারের লং জর্জেট গাউন। এক কথায় অসাধারণ একটা গাউন চোখ ধাঁধিয়ে গেল আমার।

আমি ড্রেস থেকে চোখ সরিয়ে মিতার দিকে তাকালাম। মিতা আমার হাতের ড্রেসটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,

— এটা পড়ে নিন আপু।

আমি অবাক হয়ে তাকে প্রশ্ন করলাম,

— ড্রেস পড়বো মানে? এই ড্রেস কেন পড়বো আমি? আর কোথায় যাব এটা পরে?

মেয়েটা ড্রেস আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

— তা আমি বলতে পারব না ম্যাম সময় হলে আপনি বুঝতে পারবেন কিন্তু তাড়াতাড়ি এটা পড়ে আসুন বেশি সময় নেই হাতে।

— আমি পড়বো না।

— প্লিজ আপু স্যার বলেছে আপনাকে তাড়াতাড়ি রেডি করে দিতে। আধা ঘন্টার মধ্যে আপনাকে তৈরি করে দিতে না পারলে স্যার আমাকে বকা দেবেন।

কখন থেকে মেয়েটা খালি স্যার স্যার করেই যাচ্ছে।আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,

— তোমার স্যার কে এখানে আসতে বল। এই ড্রেস আমি পড়বো না।

— প্লিজ আপু।

— বললাম না তোমার স্যারকে আসতে বল।

মেয়েটার উপায় না পেয়ে কাকে যেন ফোন করল। ফোনটা কেটে দেওয়ার পরে হঠাৎ আমার ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনে নাম্বারটা দেখতে সাথে সাথে রিসিভ করলাম আমি।

— হ্যাঁ বাবা।

— ””””

— কিন্তু বাবা কেন?

—- “”””””

— আচ্ছা ঠিক আছে।

ফোনটা কেটে দিয়ে ড্রেসটা হাতে নিয়ে মিতার দেখানো চেঞ্জিং রুমে চলে গেলাম আমি। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসলাম গাউটা পড়ে । গাউনটা অনেক লং তাই ঘের ধরে উঁচু করে হাঁটতে হচ্ছে। আমাকে বেরিয়ে আসতে দেখে মেয়েটা বলল,

— মাশাল্লাহ। আপনাকে একদম বার্বি ডলের মত লাগছে। স্যারের পছন্দ সত্যিই অসাধারণ।

ভুরু কুঁচকে মেকার দিকে তাকালাম সে কখন থেকে খালি স্যারের গুনগান করেই যাচ্ছে।কে এই স্যার?

মিতার কথায় ধ্যান ভাঙল।

— আপু আপনার বেশি সাজগোজের প্রয়োজন নেই এমনিতেই অপ্সরীর মত লাগছে।

আমাকে নিয়ে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসালো। চুল খোলাই রাখল সে। শুধু বাম দিকে থেকে শিথি করে চুলগুলো কপালের ডান সাইট থেকে নিয়ে গিয়ে পেছনে ওশান ব্লু কালারের পাথরে ক্লিপ দিয়ে আটকে দিল।

ঠোঁটে হালকা মিষ্টি কালারের লিপস্টিক, চোখে কাজল , আইলাইন ার আর হালকা মেকআপ দিয়ে সাজিয়ে দিলো আমাকে। তারপর সামনে রাখা সাদা পাথরের একটা নেকলেস আমার গলায় পরিয়ে দিল হাতে দুই জোড়া করে পাথরের চুরি আর কানে পাথরের কানের দুল পরিয়ে দিল।

— ব্যাস। আপনার সাজ কমপ্লিট। কি লাগছে আপু আপনাকে। আমারিতো চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। তার কি হবে কে জানে?

আমিও আয়নায় নিজেকে দেখলাম। তারপর চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মিতা আমার হাত ধরে উঠে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল,

— চলুন আপু আমাদের এবার যেতে হবে।

— কোথায় যাব আমি?

— গেলেই দেখতে পাবেন।

রুম থেকে বাইরে বের হতে কেমন খটকা লাগলো। এটা তো কোন ফ্লাট নয়। দেখে তো মনে হচ্ছে কোন রেসর্ট। মিতা আমার হাত ধরে ক্রমশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ড্রয়িং রুমে পৌঁছাতেই দেখলাম সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে তৈরি করা একটি ঘর।

আমি মিতার হাত ছাড়িয়ে বললাম,

— এটা কোথায় মিতা?

মিতা থেমে গিয়ে পিছনে ঘুরে আমার উদ্দেশ্যে বলল,

— আপু আপনি কুয়াকাটায় আছেন।এটা একটি কটেজ

আমি চমকে উঠলাম। অবাকের শীর্ষে চলে গিয়েছি যেন। মৃদুস্বরে চিৎকার করে বললাম,

কীহ…! কুয়াকাটা! এখানে আমি আসলাম কি করে?কে এখানে নিয়ে এসেছে আমাকে ?

— এটা আমি আপনাকে বলতে পারবো না আপু। আপনি চলুন আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

— না আমি কোথাও যাবো না।কারা তোমরা?

— আপনি আমার সাথে চলুন সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। নিশ্চিন্তে আসুন আপনার কোন ক্ষতি হবে না।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। মনের মধ্যে একরাশ কৌতূহল নিয়ে মিতার পেছন পেছন যেতে লাগলাম। মেইন ডোর পেড়িয়ে সামনে এগোতেই দেখতে পেলাম সাগর কন্যাকে।

ঢেউ এসে পাড়ে আছড়ে পড়ছে। মেইন গেটের কাছে গিয়ে দাড়াতেই দেখতে পেলাম জায়গাটা কেমন একটা দ্বীপের মত। কিন্তু সমুদ্রের সৌন্দর্য দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছে যে কিছুক্ষণ আগের ব্যাপার গুলো মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে।

মিতা আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,

— এবার আপনাকে একাই যেতে হবে আপু। আপনি সোজা এগিয়ে যান।

আমি পেছনে ঘুরে মিতার দিকে এক নজর তাকিয়ে সামনে এগোতে লাগলাম। দু হাতে লং গাউনটা উঁচু করে ধরে ধীরপায়ে এগিয়ে গেলাম। বেশ কিছুটা যেতেই একটা জিনিসের চোখ আটকে গেল।

সামনে চাওনা একটা ফুলে বিছানো রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। সে রাস্তার দুই ধারে স্টিক পুতে তাতে রংবেরঙের বেলুন ঝুলিয়ে খুব সুন্দর একটা সেতুর মতো তৈরি করা হয়েছে। দেখতে এত সুন্দর হয়েছে যে আমার মাথায় আর প্রশ্ন আসলো না যে এটা কার জন্য তৈরি করা হয়েছে?

আমি সোজা তার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। মনের মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভূতি সৃষ্টি হতে লাগলো। আপন ইচ্ছায় ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। দূর থেকেও সেই হাসিতে একজন তাল মেলালো।

বেশ অনেকটা পথ হাঁটার পর সেই ফুলে বিছানো রাস্তার শেষ প্রান্তে এসে থামলাম। এবার হঠাৎ মাথায় আসলো যে রাস্তাটা কার জন্য ছিল পেছনে ঘুরে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সামনে তাকাতেই দেখলাম পাড় থেকে ঢেউ সরে গেছে। আর সাথে সাথে আমার চোখগুলো যেন বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। কারণ

সমুদ্রের পাড়ে মাঝারি সাইজের ঝিনুক দিয়ে খুব সুন্দর করে খোদাই করে লেখা ,

🐚শুভ জন্মদিন আমার প্রিয়তমা🐚
প্রীতিলতা।

লেখাটা পড়তেই বুকের মধ্যে কেমন হাতুড়ি পেটানো শুরু হল।আমার মনে হল এগুলা আমার চোখের ভুল। তাই আরো কিছুটাই এগিয়ে গিয়ে দেখলাম। না ঠিক আছে। উত্তেজনা, আনন্দ, ভয় তিনটাই কাজ করছে আমার মধ্যে।

ভাবনার মধ্যে দুই কদম পিছিয়ে গেলাম গাউনের ধরে পেছনে ঘুরে দৌড় দিতে থেমে গেলাম আমার সামনে এক হাটু গেড়ে বসে থাকা মানুষটাকে দেখে।

ফর্সা শরীরে ব্ল্যাক সুট দারুন মানিয়েছে তাকে। গলায় ওশান ব্লু রঙের টাই ঝুলানো। চুলগুলো জেল দিয়ে খুব সুন্দর করে সেট করা। আজ তাকে দেখতে অন্যদিনের তুলনায় বেশি আকর্ষণীয় লাগছে।তার থেকে বেশি আকর্ষণীয় লাগছে তার চোখ জোড়া আজ তা পুরোটাই মাদকতায় পরিপূর্ণ।

তাকে এভাবে দেখে ভিতরের সমস্ত আবেগ অশ্রু হয়ে চোখে ভিড় জমালো।

মুখ থেকে অস্পষ্ট সরে বেরিয়ে আসলো,

— স্ সাফওয়ান। আপনি…!

সাফওয়ান ওভাবেই বসে থেকে আমার দিকে তার বা হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

—- many many happy returns of the day my prettiest lady.

কথাগুলো কানে আসতেই আবেশে চোখ বুজে ফেললাম। শিরদাঁড়া দিয়ে যেন শীতল স্রোত বয়ে গেল। আহা আজ আমার জন্মদিন ।আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।

ডান হাতে টান পড়তেই চোখ মেলে তাকালাম। দেখলাম ডান হাতের অনামিকা আঙ্গুলে একটা আংটি পরিয়ে দিলেন সাফওয়ান। তারপর তালুর উল্টো পিঠে ঠোঁট ছুঁয়েও উঠে দাঁড়ালেন।টান দিয়ে আমাকে তার সাথে মিশিয়ে নিলেন। বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে নেশাক্ত স্বরে বলে উঠলেন,

— I thought a different type gift for you. May I sweetheart…

শেষের শব্দটা ফিসফিস করে বললেন।

আমি অশ্রু সিক্ত নয়নে তার দিকে তাকালাম। সে যেন আরেকটু বেশি মাদকতাই ডুবে গেল। বাঁ হাতে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে তার সাথে আরো একটু গভীর ভাবে মিশিয়ে নিলেন ।ডান হাতটা আমার চুলের মধ্য গলিয়ে দিয়ে মাথার পিছনে হাতটা রেখে মুহূর্তের মধ্যে আমার ওষ্ঠদ্বয় দখল করে নিলেন।

এমন হটোকারী কান্ডে আমি হকচকিয়ে গেলাম। প্রথমে হালকা কেঁপে উঠলাম।পরক্ষণে চোখ বুজে নিলাম। হয়ে গেলাম তার দুই বাহুর মধ্যে বন্দি ।কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ইশ্ এ কেমন যেন এক অন্য রকম অনুভুতি।

#চলবে…..❣️

[ কেমন লাগলো সারপ্রাইজ টা…😃 অবশ্যই জানাবেন কিন্তু।আর আজ কিন্তু প্রত্যেকে গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। আপনাদের রিএ্যাকশন এর জন্য অপেক্ষায় আছি। বিদায়ের ঘন্টা বাজতে আর কিছু মুহূর্ত বাকী। হ্যাপি রিডিং 😊]
#চলবে….❣️

[ দুঃখিত ।কালকে দেওয়ার কথা বলেও গল্পটা দিতে পারিনি। তো আজ পর্ব টা বেশ বড় করেই দিয়ে দিলাম। আশা করি যারা গল্পটা পড়বেন সবাই আপনাদের মূল্যবান মন্তব্য জানাবেন। হ্যাপি রিডিং।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here