প্রীতিলতা পর্ব -২২+২৩

#প্রীতিলতা ❤️

#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury

#২২_তম_পর্ব🍂

দরজা খুলতেই সেই চির পরিচিত প্রিয় মুখগুলো ভেসে উঠল আমার চোখের সামনে। আমাদেরকে দেখে বাবা মা মুচকি একটা হাসি দিলেন। এতদিন পরে দেখলাম তাদেরকে। সত্যি বলতে ভেতর থেকে আলাদা রকমের একটা স্বস্তি ও শান্তি অনুভব করছি।

পুতুল মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আর পেছনে সাফোয়ান, সাকলাইন আর সায়েম ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে বাবা মায়ের জিনিসপত্র নিয়ে।

আমি তাড়াতাড়ি দরজার সামনে থেকে সরে আসলাম । উনারা ভেতরে ঢুকলেন।ড্রয়িং রুমের সোফা সেটের উপরে এসে বসলেন। দীর্ঘ পথ জার্নি করে যে তারা মারাত্মক ক্লান্ত সেটা তাদের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সামিরা ভাবি সবার জন্য লেবুর শরবত বানিয়ে আনলেন। ভাবিও আজকে শাড়ি পড়েছে।

মা বাবা খুশি মনে ভাবীর হাত থেকে শরবত নিয়ে খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। চলে গেলেন ফ্রেশ হওয়ার জন্য। সাথে সাফওয়ান সায়েম ভাইয়া এবং সাকলাইন ভাইয়া ও চলে গেলেন রুমে ফ্রেশ হওয়ার জন্য। আমরাও চলে আসলাম তাড়াতাড়ি খাবারগুলো গরম করে ডাইনিং এ সাজানোর জন্য।

কিছুক্ষণের মধ্যে উনারা সবাই চলে আসলেন ডাইনিং এ। আমি আর ভাবি সবাইকে খাবার পরিবেশন করলাম। তারপর মা-বাবা একপ্রকার জোর করেই আমাদেরকে তাদের সাথে খেতে বসিয়ে দিলেন। আগেই বলেছি বাবা খাওয়ার সময় কথা বলা পছন্দ করেন না তাই সবাই যে যার মত খাওয়া-দাওয়ায় মনোযোগ দিলাম।

খাওয়ার মধ্যে বাবা হঠাৎ বলে উঠলেন। কতদিন পরে বাসার খাবার খাচ্ছি। তার ওপর খাবারগুলো স্বাদ ও অসাধারণ।

খালা পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সবাইকে টুকটাক খাবারের পাত্র গিয়ে দিচ্ছিলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন,

— বড় সাহেব রান্নাবান্নাগুলো আজ আপনার দুই বৌমা মিলে করেছে।

বাবা উজ্জ্বল মুখে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,

— সেই জন্য খাবারের স্বাদ আজকে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। দুই মায়ের হাতের ছোঁয়া যে আছে এই খাবারে।

আমি আর ভাবি বাবার দিকে কৃতজ্ঞতা পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম তারপরে একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে খাবারে মনোযোগ দিলাম।

হঠাৎ পাশে আর চোখে তাকিয়ে দেখলাম সাক্লাইন ভাইয়া ভাবির দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে কিছু একটা ইশারা করছে, একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখলাম হাত দিয়ে ইশারায় ভাবির রান্নার প্রশংসা করছে।

ভাবি আবার ভাইয়ার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে নিষেধ করছে এরকম না করার জন্য। সত্যি ভাবির পোলাও রান্নাটা আজ অনেক সুন্দর হয়েছে।

তাদের দুজনের মধ্যে ভালোবাসায় পরিপূর্ণতা আছে বলেই হয়তো একে অপরের সামান্যতেই তারা একজন আরেকজনকে প্রশংসা করে। কিন্তু আমার মানুষটা তার কি একটুও ইচ্ছা করে না আমার রান্নার প্রশংসা করার।

আমি সাফওয়ানের দিকে নজর দিলাম। আর তার নজর তার প্লেটের দিকে। আপন মনে খাওয়া-দাওয়া করছেন। তাকালে দেখতে পেতেন আমার কৌতূহলী দৃষ্টিতে তার চেহারায় বিচরণ করছে।

ভেতরের সত্তাটা উদগীব হয়ে বসে আছে প্রিয় মানুষটার কমপ্লিমেন্ট শোনার জন্য। কিন্তু না ভাগ্য আমার সহায় হলো না।

পাশে তাকিয়ে দেখলাম ডাক্তার ভাইয়া ইশারায় বোঝালেন রান্না বরাবরের মতো অসাধারণ হয়েছে।

প্রিন্সেস ডায়না একটা কথা বলেছিলেন,

” আমি যাকে ভালবেসেছিলাম সে বাদে সারা পৃথিবী আমাকে ভালোবেসেছিল।”

এখানে আমারও বলতে ইচ্ছা করছে,

” আমি যার প্রশংসা শুনতে চেয়েছিলাম সে বাদে সবাই আমার প্রশংসা করেছে।”

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম।নিজের খাবারে মনোযোগ দিলাম। সবার কপালে সব সুখ থাকে না।

_________🌺🌺_________

যেহেতু সবাই ক্লান্ত ছিল তাই দ্রুত খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিশ্রামের জন্য যে যার রুমে চলে গেল। পুতুলকে আজ বেশ চঞ্চল দেখাচ্ছে। অনেকদিন পরে মা বাবাকে দেখতে পেয়েছে তো আজ ওর মনের ভেতরটা যে আনন্দে ভরে গেছে সেটা ওর বাহ্যিক রূপ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

কিছুক্ষণ ড্রয়িং রুমে লম্বা ঝম্প করে এখন সোফা সেটের উপরে বসে টিভিতে মটু পাতলু দেখতে লাগলো। আমি ওর পাশে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,

— কি আজ এত এনার্জি আসছে কোথা থেকে শুনি‌ দুপুরে ঘুমাবে না।

পুতুল আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

— ঘুম আসছে না। আমি এখন কার্টুন দেখব। তুমি দেখবা প্রীতিলতা?

আমি আলসেমি ঝেড়ে বললাম,

— না রে আমার শরীরটা আজ খুব ক্লান্ত লাগছে। আমি একটু রেস্ট নিয়ে আসি। আর ঘুম আসলে রুমে গিয়ে ঘুমাবি এখানে ঘুমালে কিন্তু ঘাড়ে ব্যথা হবে। তখন রোবটের মত হাঁটাচলা করতে হবে।

পুতুল আমার কথা শুনে হেসে সোফায় হেলে পরলো।

— আচ্ছা, তুমি যাও রেস্ট নাও প্রীতিলতা। আমি এখানে ঘুমাবো না।

— ওকে সোনা।

গাল টিপে দিয়ে রুমে চলে আসলাম আমি। রুমে এসে দেখি সাফওয়ান বিছানার উপরে এক পা ভাজ করে আরেক পা লম্বা করে নিজের কোলের উপরে ল্যাপটপ রেখে খাটের হেডবোর্ডের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। খুব মনোযোগী সহকারে কি যেন একটা করছে ল্যাপটপে।

তাকে দেখতেই মনের ভেতরে অবুঝ অভিমান গুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।এই মানুষটা একদম আমার মনের মত নয়।

আমি সে দিক থেকে নজর সরিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে শাড়ির আঁচলটা মাথার উপর থেকে সরিয়ে দিলাম।

মাথা থেকে যাতে আচলটা না সরে তার জন্য মাথায় একটা পিন লাগিয়েছিলাম।
ভেজা চুল থেকে পাঞ্চক্লিপ ছাড়িয়ে চুলগুলো ছেড়ে দিলাম।। এখন একটু রিলিফ লাগছে নিজেকে।

আয়নার দিকে নজর যেতেই দেখলাম সাফওয়ান বিছানা বসে থেকেই আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি হাতের চুড়ি গুলো খুলে রেখে আলমারির দিকে এগিয়ে গেলাম ঢিলেঢালা গোল ফ্রক আর নিচে চুড়িদার সালোয়ার নিয়ে ওয়াশরুমে যাব এমন সময় সাফওয়ান বললেন,

— যা পড়ে এতই অস্বস্তি হয় তা পড়ার কি দরকার তোমার।কেউ তো তোমাকে জোর করে না এগুলো পরার জন্য।

আমি সাফায়ানের দিকে ক্লান্ত মাখা সরে বললাম,

— ভাবি বলেছিল আজ ভাবি শাড়ি পরবে, আমাকেও বলেছিল শাড়ি পরার কথা। তাই পরলাম।

কথা শেষ করে তাকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লাম।

ফ্রেশ হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে বের হলাম কিছুক্ষণ পরে টাওয়ালটা বারান্দায় মেলে দিয়ে এসে বিছানার এক কোনায় শুয়ে পড়লাম। তার সাথে আর কোন ধরনের কথাবার্তা বললাম না।

সাফওয়ান এর উল্টোদিকে শুয়ে আছি। বেডরুমের পরিবেশটা আজ বড্ড নীরব অন্য সময় হলে বকবক করে তার কান ঝালাপালা করে দেই আমি। কিন্তু না এখন আমি আর তাকে বিরক্ত করবো না।

কিছুক্ষণ পরে সাফওয়ান নিজেই মুখ খুললেন। গলাটা বেশ ভালোভাবে পরিষ্কার করে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন,

— আজ এত চুপচাপ তুমি তোমার কি মন খারাপ?

কথাটা কানে আসতেই না চাইতেও নিঃশব্দে হেসে উঠলাম আমি। উনার কথাটা কেমন শোনালো জানেন,

নিজেই ব্যথা দিয়ে আবার নিজেই জিজ্ঞাসা করছে তুমি কি ব্যথা পেয়েছো?

তার কথার প্রতিউত্তরে আমি বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে ঘাড় কাত করে তার দিকে তাকিয়ে বললাম,

— না। সব সময় একতরফা বকবক করতে কার ভালো লাগে বলুন।

আমার বিপরীত পাশের মানুষটিকে সবসময় বিরক্ত করতে ভালো লাগে না।

আপনার দরকারি কাজের অনেক ব্যাঘাত ঘটিয়েছি আমি। এরপর থেকে আর এমন করবো না।

সব কয়টা কথাই চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছি আমি। সেও বরাবরের মতো নীরব শ্রোতা সেজে কথাগুলো শুনলো। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাদরটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিলাম।

তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম গাল বাঁকিয়ে হালকা হাসলেন তিনি। ল্যাপটপটা বন্ধ করে পাশের ডেক্সের এর উপরে রাখতে রাখতে বললেন,

— সম্মোধন টাও বাদ দিয়েছো তাহলে?

— কুমড়ো পটাশ নামটা আমি আপনাকে মজা করে দিয়েছিলাম। পরে বুঝেছি আপনার সাথে আমার ঠাট্টার সম্পর্ক নয়। তাই ওই সম্মোধন টাও নিজের কাছে ফিরিয়ে নিলাম।

পাশে তাকিয়ে দেখলাম সাফওয়ান আমার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমিও তৎক্ষণা ৎ উত্তর দিলাম,

আর অন্তত আপনার বিরক্তির কারণ হতে চাই না আমি।

__________🌺🌺________

একেবারে মাগরিবের নামাজ শেষ করে সবাই ড্রয়িং রুমে জড়ো হয়েছে। মা একেবারে কোমরে আঁচল গুঁজে সন্ধ্যার নাস্তা তৈরি করতে লেগে পড়েছে। তার এত শখের রান্নাঘর। কতদিন রান্না করতে পারেননি এখানে । এ নিয়েও তার যেন আফসোসের শেষ নেই।

মায়ের চেহারা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কতটা তৃপ্তি সহকারে নাস্তাগুলো বানাচ্ছে। পিঁয়াজি গুলো তেলে ভাজতে ভাজতে আফসোসের সুরে বললেন,

— ওখানে কি আর আমার রান্নাঘরের মত সবকিছু গোছানো-গোছানো ছিল নাকি। প্রথমে গিয়ে খাবারের কষ্ট হয়েছে একটু। রেস্টুরেন্টের অভাব নেই কিন্তু ওদের রান্নাটা যেন কেমন একটা।

তোমাদের বাবা যাও একটু খেতে পারতো আমি তো মোটেও পারতাম না আর ঝাল বলতে তো কিছু খায় না ওরা। পরে হোটেলেই তোমাদের বাবা আমাকে রান্নার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সেখানে কোন রকম রান্না বান্না করে খাওয়া দাওয়া করেছি।

কথা বলতে বলতে পেঁয়াজি, বেগুনি , আলুর চপ গুলো সব ভাজা হয়ে গেছে। মা আর ভাবি নাস্তাগুলো নিয়ে গেছে আর আমি পরে চা আর কফি বানিয়ে নিয়ে এসেছি। ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই সায়েম ভাইয়ের কথা কানে আসলো।

— আরে বাহ! আজ দেখি খাবারে ধামাকার উপরে ধামাকা অফার চলছে। দুপুরে অত সব মজার মজার খাবার খেয়ে এখন আবার তোমার হাতের এই লোভনীয় তেলেভাজা ।

উফ! কোনটা রেখে কোনটা খাব। খালামণি তুমি তো আজকে আমার দিনটাকে স্পেশাল করে দিলে। থ্যাঙ্ক ইউ।

মা সায়েম ভাইয়ার দিকে চপের বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বলল,

— এই নে । আমি তো ভাবতেই পারিনি এয়ারপোর্টে নেমে তোকে দেখতে পাবো। কতদিন পরে দেখলাম তোকে।

পেঁয়াজি চিবাতে চিবাতে উত্তর দিলেন,

গতকালকে তোমার দুই ছেলের কাছ থেকে শুনলাম তোমরা আসছো তাই ভাবলাম কাজের চাপ যখন কম আছে আমার বদন খানা তোমাদের একটু দেখিয়ে আসি।

সাকলাইন ভাইয়া বলে উঠলেন,

— ডাক্তারি পেশার কাথাঁয় আগুন দিয়ে তুই যে এখানে বসে এসব ওয়েলি খাবার গিলতেছিস তোর রুগীরা জানতে পারলে তোর মুখও দেখবে না আর।

— ধুর রোগী ওরা আমি নই ‌। একদিন খেলে তেমন কিছুই হয় না।

সায়েম ভাইয়ের কথা শুনে সবাই হেসে উঠলেন। সাফওয়ান এবার সায়েম ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,

— এই হচ্ছে টুকে পাশ করা ডাক্তারের নমুনা।

বাবা এবার সকলের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন। আচ্ছা এবার থাম তোরা। সকলের জন্য যে জিনিসপত্র গুলো নিয়ে এসেছি এবার একে একে দিতে হবে।

পাশে থেকে বড় দুটো লাগেজ বের করলেন। লাগেজ খুলে টেবিলের উপরে রাখলাম এক এক করে সবাইকে উপহার সামগ্রী দিতে লাগলেন। এবং দুটো বড় ব্যাগে তাদের বেয়াই বেয়ানদের জন্য উপহার আলাদা করে রাখলেন।

ভাবিকে ডেকে পাশে বসিয়ে হাতে তার জন্য আনা সব উপহার তুলে দিলেন। ভাবি খুশি মনে উপহারগুলো নিয়ে সরে আসতেই বাবা হাতের ইশারায় আমাকে ডাকবেন তার কাছে।

আমি গিয়ে তার পাশে বসলাম। বাবা আমার হাতে কয়েকটা ব্যাগ ধরিয়ে দিলেন। ব্যাগ থেকে জিনিস কতগুলো বের করে দেখলাম একটা জায়নামাজ , পাথরের তসবি, আতর, দুটো বোরকা এবং স্বর্ণের কানের দুলও গলার চেন। ভাবি ও আমার একই উপহার।

সবকিছু দেখে বাবার দিকে তাকাতেই বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন পছন্দ হয়েছে মামনি।

আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম। উপহারগুলো ব্যাগের মধ্যে রেখে বাবার উদ্দেশ্যে বললাম,

আমার আরও একটা জিনিস চাই বাবা।

বাবা মুচকি হেসে ইশারায় জিজ্ঞাসা করলেন কি?

সকলে দেখলাম বোধক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি জোরে একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বাবাকে বললাম,

— বাবা আমি কাল সকালে বাবার বাড়িতে যেতে চাচ্ছি।

বাবা মুচকি হেসে আবার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন অবশ্যই তুমি এবার যতদিন কয়েক দিন ্ ওই বাড়ি থেকে ঘুরে আসবে। আর আমরাও তো যাব বেয়াই বেয়ান কে দেখতে। তাদের সাথে কতদিন দেখা হয় না‌। না হয় আমাদের সাথে আবার চলে আসবে।

এবার বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে নিজের কন্ঠ টাকে সর্বোচ্চ স্বাভাবিক রেখে বললাম,

— না বাবা আমি আর ফিরবো না। আগামীকাল সকালে আমি সারা জীবনের জন্য ওই বাড়িতে যাচ্ছি….!

#চলবে…..❣️#প্রীতিলতা ❤️

#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury

#২৩_তম_পর্ব🍂

মুহূর্তের মধ্যেই পুরো ড্রয়িং রুমটা নীরবতা এসে গেল কিছুক্ষণ আগে সেই গমগমে ভাবটা এখন আর নেই ড্রয়িং রুমে উপস্থিত সকলের প্রশ্নবোধক দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে বসে আছি আমি সকলের মনে হয়তো একটাই প্রশ্ন জেগে উঠেছে যে আমি হঠাৎ এমন কিছু কেন বললাম?

কিন্তু না এদের মধ্যে বাবা আগের মতোই শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু কিছুক্ষণ আগে সেই প্রাণোচ্ছল হাসিটা ঠোঁট থেকে মিলিয়ে গেছে মা-বাবার পাশেই বসে ছিলেন অস্থির কন্ঠে বলে উঠলেন,

—- এসব তুমি কি বলছ প্রীতি তুমি আর ফিরবে না এর মানে কি তুমি এই বাড়ির ছোট বউ এই বাড়িতে ফিরবে না তো কোথায় যাবে তুমি?

মায়ের কথায় তার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে মাথা নিচু করে তার উদ্দেশ্যে বলে উঠলাম,

—- আপাতত বাবার বাড়িতে কিছুদিন থাকব তারপর ভালো একটা ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স এর জন্য চান্স হয়ে গেলে সেখানে চলে যাব। আমি আর কারোর ঘাড়ের বোঝা হয়ে থাকতে চাই না ।

শেষের কথাটার চোখের সামনে দিকে তাকিয়ে বললাম। আর চোখে যেটুকু দেখলাম তাতে বুঝলাম সে আমার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ।

মা যেন আমার কথা শুনে আরও বেশি অস্থির হয়ে উঠলেন সামনের দিকে এগিয়ে এসে বললেন কিন্তু কে….

বাবা মাকে থামিয়ে দিলেন। আমি এখনো মাথা নিচু করে বাবার সামনে বসে আছি কিছুক্ষণ পর বাবা অতীব স্নেহের কন্ঠে বলে উঠলেন,

— মামনি মাথা উঠাও বাবার দিকে তাকাও।

কন্ঠটা কানে আসতে ভেতরে এতক্ষণে চেপে রাখা কষ্টগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠল ঠোট ভেঙ্গে নিঃশব্দ থেকে দূরে উঠলাম যার ফলশ্রুতি গাল দিয়ে দুই ফোটা নোনা জল গড়িয়ে গেল ।

বাবা এবার নিজের হাত আমার মাথায় ভুলিয়ে দিয়ে বললেন কি হলো তাকাও না আমি এবার আর তার কথা অমান্য করলাম না বাবার দিকে তাকালাম।

আমার ছল ছল চোখ জোড়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাবা আমাকে প্রশ্ন করলে,

— তোমার এই মা-বাবা কী তোমাকে খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে মা যার জন্য তুমি আমাদেরকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছ?

আমি না বোধক মাথা নাড়ালাম। তা দেখে বাবা আবার বললেন,

—- তাহলে কেন তুমি চলে যাবে মা তুমি জানো না পুতুল তোমাকে ছাড়া থাকতে পারে না?

পুতুলের কথা ভাবতে বুকের মধ্যে কেমন যেন করে উঠলো সত্যিই তো আমার এই বাড়িতে এত দিনের একমাত্র সঙ্গী ছিল আমার পুতুল সোনা ।

ওই একমাত্র ব্যক্তি যে আমাকে নিঃস্বার্থভাবে এতদিন ভালোবেসে গেছে ও আমাকে ছেড়ে থাকবে কি করে তার থেকে বড় কথা ওকে ছাড়া আমিও তো থাকতে পারবো না

কিন্তু আমি যে নিরুপায়। ওর সাথে যে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই কিন্তু তৎক্ষণাৎ আমার মন বিদ্রোহ করে বলে উঠলো,

তাতে কি হয়েছে রক্তের সম্পর্কের বাইরে এমন অনেক সম্পর্ক আছে যা সকল রক্তের সম্পর্কের উর্ধ্বে হয়ে থাকে। যেমন আমার আর পুতুলের সম্পর্ক।

আমি বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম,

পুতুলকে কখনো আমার ননদের চোখে আমি দেখিনি ও আগেও আমার ছোট বোন ছিল এখনো আছে আর ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। আমি যেখানে থাকি না কেন প্রতিদিন আমি ওর সাথে দেখা করব।

ওর সাথে দেখা না করে আমি থাকতে পারবো না বাবা এছাড়া ও খুব বুঝদার মেয়ে ওকে বুঝালে ঠিকই বুঝবে। আমি আমার মাস্টার্স কমপ্লিট করতে চাইছি আর মোট কথাই বাড়ি থেকে চলে যেতে চাইছি।

মা যেন আর চুপ করে থাকতে পারলেন না আমার কথা শেষ হতেই মা পাল্টা প্রশ্ন করলেন,

— এই বাড়ি থেকেই কেন চলে যেতে হবে তোমাকে তুমি চাইলে মাস্টার্স কমপ্লিট করে চাকরিও করতে পারো তাতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। তাহলে এসব বলার মানে কি তোমার?

আমি মার দিকে তাকিয়ে বললাম,

— আপনি হজ্বে যাওয়ার সময় আমার কাঁধে বড় একটা দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন মা । আপনাদের এবং আপনার ছেলের মধ্যকার সম্পর্ক ঠিক করা। কিন্তু যেখানে তার সাথে আমার মধ্যকার সম্পর্কই ঠিক নাই সেখানে এ দায়িত্ব আমি পালন কীভাবে করব।

কথাগুলো একনাগাড়ি বলে আমি থামলাম। কিছুক্ষণ দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করলাম ,

— বাবা এই বাড়িতে যার হাত ধরে ঢুকেছিলাম। বিয়ের এতদিন পরেও তাকে আমি নিজের আপন করে তুলতে পারিনি একই ছাদের নিচে থাকলেও দুজনের মধ্যে যোজন যোজন দূরত্ব রয়েই গেছে আমাদের।

সে ছাড়া এবাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য আমার আপন হয়ে উঠেছে। কিন্তু যার বেশি আপন হওয়ার কথা ছিল সেই বরাবরের মতো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে আমার থেকে।

এতে আমি তার দোষ দেব না। আসলেই তার কোন দোষ নেই।মন এর উপরে কখনো জোরজবরদস্তি চলে না। নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কখনো সুখে থাকা যায় না। মন থেকে না চাইলে কারোর কাছ থেকে জোর করে ভালোবাসা আদায় করা যায় না বাবা। যেটা পাওয়া যায় সেটা হচ্ছে সহানুভূতি।

উনি এই কয়দিনে আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন। আমার পরিবারের জন্য করেছেন। আমার পরিবারের চোখে উনি একজন আদর্শ জামাই আমার মা-বাবাকে এতটা সম্মান জন্য আমি সারাজীবন তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আমি জানি আমি না বললেও উনি সারা জীবন এরকম দায়িত্ব পালন করে যাবেন। কিন্তু আমি শুধু ওনার দায়বদ্ধতা হয়ে থাকতে চাই না।

মন চাইনি সে আমাকে ভালোবাসে নি।
তাই বলে জোর করে এই অনিশ্চিত সম্পর্কের দোহাই দিয়ে আমি তাকে আটকে রাখতে পারি না। তার ও স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার আছে সাথে আমারও ।তাই এই মিথ্যা সম্পর্কটা এখানে সমাপ্তি হোক।

যার কোন ভিত্তি নেই সেই সম্পর্কের বোঝা আমি আর বইতে পারছি না। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার মানসিকভাবে এই ব্যাপারটা আমাকে খুব পীড়া দিচ্ছে বাবা। আর এই বাড়িতে থাকলে প্রতিনিয়ত আমার এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে তাই আমি এখান থেকে চলে যেতে চাইছি।

মা বাবা আপনারা আমাকে মাফ করবেন। আপনাদের কথা আমি রাখতে পারব না। একবার যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছি তখন আমি তার পরিবর্তন করতে চাই না।

মা থম মেরে সোফায় বসে রইলেন। বাবা আমার কথাগুলো শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

আর সাফওয়ান তিনি তো মনে হয় কথা বলতেই ভুলে গেছেন। এই পুরোটা সময় তিনি একটা কথা বলেননি। আর দিকে না তাকিয়েও যতটা বুঝেছি তিনি পুরোটার সময় আমার দিকে ই স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। হয়তো তিনি ভাবতে পারেননি যে আমি এভাবে চলে যাওয়ার কথা বলব।

কিন্তু কি আর করার এটা তো হওয়ারই ছিল।

চলবে….❣️

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here