এক হাতে আমাকে ছাদের রেলিং এ চেপে আরেক হাতে রিভয়েলবার তাক করে রাগান্বিত দৃষ্টিতে আমাকেই দেখছে আয়ান ভাইয়া। ওয়ান এন্ড অনলি দ্যা গ্রেট আয়ান চৌধুরী! যাকে দেখলে নাকি মেয়েদের হার্টবিট থেমে যায়, তার সাথে এখন আমার মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরত্ব। উনার ঈষৎ লাল বর্ণ ধারণ করা চোখের দিকে তাকানোর দ্বিতীয় বার সাহস পেলাম না। ঢোক গিলতেও যেনো ভয় কাথা মুড়ি দিয়ে আছে। যেকোনো সময় গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দিতে পারে। কিছুক্ষণ আগের কথা ভাবতেই টুপ করে একফোটা জল গড়িয়ে পড়লো আমার চোখ বেয়ে।
.
.
.
আধা হাত ঘোমটা টেনে বসে আছি পাত্র পক্ষের সামনে। যদিও বিয়েতে আমার ঘোরতর অমত। সবার চাপে এক প্রকার বাধ্য হয়ে বসতে হয়েছে। মনে মনে দোয়া-দুরূদ পড়তে লাগলাম। আমার সাথে কি হতে চলেছে শুধু আমিই জানি। রীতি মধ্যে আমার হাত-পা কাপছে। সবাই এক বিবাহিত মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য পাত্রী হিসেবে দেখাচ্ছে। সবাই কি মেনে নিতে পারবে এই ভয়ংকর সত্যি? দম যেনো অবরোধ হয়ে আসছে। সব কথা গলা পর্যন্ত এসে দলা পাকাচ্ছে।
-“দেখি মামনি তোমার মুখখানা। মাশাল্লাহ!! মেয়ে তো ভারী মিষ্টি। তো তোমার বাড়িতে আর কে কে আছে?”
আমি মাথা নিচু করে চুপ রইলাম।
সামনে বসে থাকা ভদ্র মহিলা তার কাঙ্খিত উত্তর না পেয়ে যখনি আবার কিছু বলতে যাবে, তখনি কেও আড়ষ্ট গলায় বলে উঠলো,
-“মেয়ে দেখতে আসছেন আর মেয়ের খোজ-খবর নিয়ে আসেন নি?”
আচমকা অপ্রত্যাশিত পরিচিত কণ্ঠে থতমত খেয়ে গেলাম। খানিকটা মাথা তুলে সামনে তাকাতেই যেনো হার্ট বিট ট্রেনের সাথে পাল্লা দিয়ে দৌড়াতে লাগলো। আয়ান ভাইয়া দুই হাত ভাজ করে আমার দিকে তাকিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু উনার চাহনী স্পষ্ট বলছে, আমাকে সামনে পেলে কেটে কুচি কুচি করে বুড়িগঙ্গায় ভাসাবে।
-“আরে আয়ান ভাই! কেমন আছো? শুনেছিলাম তুমি নাকি এবরোড গিয়েছিলে ”
-“একদম ফাস্ট ক্লাস আছি শালা বাবু” বলতে দেরি গ্লাস ভর্তি পানি আমার মুখে ছুড়ে মারতে দেরি হলো না। উনার এমন এলাহী কান্ডে সবার চোখ যেনো হিমালয় ছুই ছুই। উনি আমার বাহু বেশ শক্ত করে চেপে টেনে তুললেন। আমার মনের মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
-“পাত্র-পক্ষের সামনে এসব কি হচ্ছে, আয়ান” খানিকটা রাগি কণ্ঠে বললো ফুপিমণি।
-“মাম্মাম তুমিও না। এতো আটা-ময়দা মাখিয়ে কেও বসায়? পরে তো বাসর রাতে বউ বদলে দেওয়া হয়েছে বলে মামলা করবে” বলে স্মিথ হাসি দিলো আয়ান। সাথে সাথে হাসির আওয়াজে কেপে উঠলো চৌধুরী ম্যানসন।
আয়ান একটানে দিয়ে খোপায় থাকা পাঞ্চ-ক্লিপ খুলতেই পিঠ ছেয়ে গেলো ঘন কালো কেশরাশি আধারে।
-“মেয়ের চুল দেখি বেশ লম্বা। মামনি একটু হেটে দেখাও তো”
সাথে সাথে বাহুতে আরোও চাপ অনুভব করলাম। এই বুঝি হাড্ডি-গুড্ডি ভেঙ্গে খন্ড-বিকন্ড হবে। ইতিমধ্যে আমার চোখের কোটর অশ্রুমালায় টলমল করছে। যেকোনো সময় অশ্রু কণার বিসর্জন হতে পারে। তবে এটা ব্যথায় নাকি ভয়ে, তার উত্তর আমার জানা নেই। কিন্তু যা হতে চলেছে তা নিতান্তই ভয়ংকর হবে।
-“মেয়ে দেখতে এসেছেন, মেয়ে দেখেন। নাস্তা পানি খান। তারপর সসম্মান নিয়ে বিদায় হোন। আহানার মাত্র ১৮ বছরে পা রেখেছে। এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়া হবে না। দরকার হলে এখানেই পার্মানেন্টলি (Permanently) রেখে দিবো, ধন্যবাদ” বলে আয়ান আর কাওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই এক প্রকার টানতে টানতে ছাদে এনে চেপে ধরলো।
.
.
.
আমাদের মাঝে পিনপন নিরবতা ভেঙ্গে রিভয়েলবার কপালে খানিকটা চেপে ভরাট কণ্ঠে বলে ওঠে,
-“জানেমান! তোমার সাহস দেখি দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। আমার অগোচরে বিয়ের পিরিতে বসা হচ্ছে না? বাহ! গায়ে নতুন জামদানী শাড়ি, মুঠো ভর্তি কাচের চুড়ি, ঠোটে লাল লিপস্টিক, কোমড় অবধি খোলা চুল, পায়ে নূপুর। এভাবে পর-পুরুষের সাথে ঢলাঢলি করার অধিকার কে দিলো শুনি?”
আমি অশ্রুশিক্ত নয়নে উনার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললাম, -“আমি মোটেও ঐ ছেলেটার সাথে ঢলাঢলি করি নি”
আয়ান ভাইয়া তেলে বেগুনের মতো ছ্যাত করে তেড়ে এগিয়ে শক্তভাবে হাতের কব্জি খামচে ধরে। সাথে সাথে নখের আচড়ে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। ব্যথার তীব্রতায় নিচু গলায় “আহ” করে উঠলাম। যা আয়ান ভাইয়ার কান অবদি পৌছাতে সক্ষম হলো না।
-“বাহ! কী মোহাব্বত। আমার তিলে তিলে গড়া স্বপ্ন চুরমার করে অন্যকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে তোর বিবেকে বাধলো না? তোর একবারো বুক কাপলো না? আমাকে? এই আয়ান চৌধুরীকে ধোকা দেওয়ার কথা ভাবতে? কীভাবে পারলি সং সেজে অন্য ছেলের সাথে ঢং করতে একসাথে বসতে? বল? আন্সার মি.. সে সামথিং ড্যামেট!!” বলেই আয়ান শূণ্য আকাশে পর পর ২টা গুলি ছুড়লো। এই বুঝি প্রাণ পাখি ফুড়ুথ করে উড়াল দেউ দেয় অবস্থা। আমি ভয়ের চটে চোখ মুখ খিচে আয়ান ভাইয়া কে ঝাপটে ধরে ডুকরে ডুকরে কেদে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই সারা শরীর একদম নিস্তেজ হতে লাগলো৷ চারপাশটা কেমন জানি আবছা আবছা হতে লাগলো। চোখের সামনে নেমে এলো ঘন কালো অন্ধকার।
_______________
বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের টিম টিম আলোয় ব্যস্ত শহর দেখছে রুহি। সাথে সাক্ষী আছে এক টুকরো কাগজ। যেখানে বড় বড় অক্ষরে “পজেটিভ” লেখা। আজ কেনো যেনো ওর নিজেকে প্রচুর অসহায় লাগছে। তাকে কি মেনে নিবে এই সমাজ? ভাবতেই রুহির ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এই সমাজ যে তাকে কলঙ্কিনী নাম দিতে পিছ পা হবে না। প্রেগন্যান্সির মতো চরম সত্যকে কীভাবে সবার সামনে উত্থাপন করবে? কীভাবে এই সমাজে মুখ দেখাবে? তার সন্তানের কি কোনো পিতৃ পরিচয় থাকবে না? তবে তার সন্তানকে কি গালি শুনতে হবে জারজ হিসেবে? রুহির অজান্তে হাত চলে গেলো পেটে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে যে তার। বুকের মধ্যে এক চাপা আর্তনাদ দেখার মতো কেও নেই যে এই ব্যস্ত শহরে। শেষশ-মেষ হাজারো তারাকে সাক্ষী রেখে কান্না ভেঙ্গে পরলো রুহি। বারান্দার ডিভানে বসে এক পলকে চেয়ে রইলো চাঁদের পানে।
___________________
দূর থেকে ভেসে আসা আযানের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আস্তে আস্তে চোখ খুলতেই চোখ ছানাবড়া। রাত ৮:১৫ টা ছুইছুই। এই সময় এতোক্ষণ ঘুমানো তো কথা না। পরক্ষণে ভাবান্তর ঘটতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো আয়ানের রাগান্বিত চোখ দু’টো। মনের অজান্তেই এক কণা অশ্রু গড়িয়ে পরলো। কাবার্ড থেকে লাল খয়েরী একটা কুর্তি নিয়ে ওয়াসরুমে চলে গেলাম। ঝরণা ছাড়তেই পানির স্রোত ধারায় ভিজে চোখের পানি আর ট্যাবের পানি মিলে একাকার। ওয়াসরুম থেকে গোসল করে টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে বের হলাম। হঠাৎ চোখ পরলো সোফার দিকে। এক সুদর্শন যুবক পায়ের অপর পা তুলে, একদম নবাবজাদা দের মতো স্টাইলে আরামসে মোবাইল স্ক্রলিং এ ব্যস্ত। আমার সাথে উনার চোখে চোখ পরতেই অস্বস্তি হতে লাগলো। হন্তদন্ত হয়ে ওড়না খুজে কোনো মতো গায়ে দিলাম। আয়ান আমার দিকে এক পলক চেয়েও আবারো মোবাইলের স্ক্রিনে মনোযোগ দিলেন।
-“লেটস ট্রাই সামথিং নিউ সুইটহার্ট! আর ইউ রেডি টু গেট পানিসমেন্ট ফোর বিটরে মি? (Let’s try something new, sweetheart! Are you ready to get punishment to betray me)”
একটু আগে সাওয়ার নেওয়ার সত্যেও ইতিমধ্যে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মনে মনে সাহস জুগিয়ে কিছু না শোনার ভান ধরলাম। একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে পাশ কাটাতে….
#প্রেমজাল
সূচনা পর্ব
জান্নাতুল মাওয়া মাহিমুন
সবার ভালোবাসার কি যোগ্য? রেসপন্সের ভিত্তিতে পরের পর্ব দেওয়া হবে।