প্রেমজাল পর্ব ৩১+৩২

#প্রেমজাল
পর্ব ৩১ + ৩২ [ রহস্য উন্মোচন ]
জান্নাতুল মাওয়া মাহিমুন

পুরোটা সম্পূর্ণ করার আগেই স্বজোরে রিয়ানের বুক বরাবর লাথি মারে। পরিপ্রেক্ষিতে সাথে সাথে দূরে ছিটকে পরে। আয়ান তেড়ে গিয়ে দুই হাতে রিয়ানের কলার ধরে টেনে তুলে চিৎকার করে বলে,

-‘ তোর সাহস কি করে হয়? আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমারই বউ এর দিকেই চোখ তুলে তাকানোর, তার গায়ে হাত দেওয়ার মতো দুঃসাহস দেখানোর ইউ ব্লা’ডি বা’স্টার্ড” বলে এলোপাথাড়ি কিল ঘুষি মারতে থাকে।

উপস্থিত সবাই আয়ানের কথায় বিস্মিত!! এক অপরের দিকে অনড় তাকিয়ে আছে। বড় কাকিমণির চোখ দু’টো দেখার মতো। পুরাই রসগোল্লা টাইপ। মনে হচ্ছে এই চক্ষু কোটর থেকে ছিটকে পরে হামাগুড়ি খাবে। এতো চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে এবার ফুপিমণি, আদ্র ভাই, দাদিমণিসহ সুপ্পুর হবু শ্বশুরবাড়ির কিছু মানুষ এসে দেখে আয়ান রিয়ান স্যারকে মারতে উন্মাদ হয়ে গেছে।

ঐ বাড়ির একজন মহিলা আতংক মিশ্রিত কণ্ঠে বলে উঠলো,

-‘ আয় হায়!! এই ছেলে দেখি আমাদের রিয়ানরে মেরেই ফেলবে। কেও থামাও এই ছেলেকে’

ক্ষণিক আগেই ফুপিমণি উপস্থিত হওয়ায় তৎক্ষণাত কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। যেই না আয়ান রিয়ান স্যারকে ঘুষি মারতে যাবে তখনি ফুপিমণি তড়িঘড়ি করে এসে উনাকে আটকায়। আয়ান যতই ত্যাড়ামি দেখাক না কেনো তার সবচেয়ে ভালো দিক হলো সে তার মায়ের সব কথা মেনে নেয়। আয়ান বাধ্য ছেলের রিয়ানকে ছেড়ে দিতেই রিয়ান স্যার মাটিতে লুটিয়ে পরে। রিয়ান স্যার অস্ফুট স্বরে ‘আহ-উহ’ বলে গোঙাতে লাগে। নির্ঘাত নাক মুখ ফেটে থুবড়ে গেসে। আয়ানের হাতের মুঠীয় লালচে বর্ণের তরল তা জানান দিচ্ছে।

ফুপিমণি চাহনিতে অবাকের চিহ্ন ফুটে ওঠে আছে। সে আহত গলায় জিজ্ঞেস করলো,

-‘ আয়ান থাম!! তুই পাগল হয়ে গেছিস? একে তুই এভাবে মারছিস কেনো? তোর এমন নিষ্ঠুতার কারণ কি? এমন হলে তো মরেই যাবে’

আয়ান প্রতিত্তরে চোয়াল শক্ত রাগ দমন করতে করতে বলে উঠলো,

-‘ আজকে তো আমি এই জানো’য়ারের বাচ্চা কে মেরেই ফেলবো। বুকের পাঠা কতো আমার জিনিসের দিকে নজর দেয়’

দাদিমণি জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,

-‘ আমারে কো দেহি নানাভাই। তুই এমন ক্ষেপতাসোস ক্যান? এই হতছেড়া পোলা তোর কিসের দিকে চাইসে? বল খালি। একদম জ্যা’ন্ত পুইত্তা দিমু’

তখনি প্রথমে আসা কিছু সদস্য কানাকানি করতে শুরু করলো তেল মশলা মিশিয়ে যা আমার কর্ণগোচর স্পষ্ট ভাবে হলো,

-‘ আহারে বেচারা বাচ্চা মেয়েটার এতো অল্প বয়সে ইজ্জতটা গেলো’

-‘ হায় গো ভাবি দেখো না নিজের বাড়িতেও মেয়েদের নিরাপত্তার কি হাল। ইসশ এখন এই মেয়ের আর সংসার করা হলো না’

ফুপিমণি ও দাদিমণি আমার দিকে দৃষ্টিপাত করলো। ঘটনার তাৎক্ষণিকে হয়তো আমাকে লক্ষ্য করে নি। আমি এখনো সুপ্পুকে জরিয়ে ধরে ঠোঁট কামড়ে কান্না করছিলাম। আমি দাদিমণির দিকে একপানে চেয়ে রইলাম। ঠিক সেইদিনের মতো ভাবমূর্তি ফুটে ওঠেছে তার। আশপাশের কথা শুনে মরে যেতেই আমার ইচ্ছা হচ্ছে। কেনো সবসময় আমার সাথে এমন হবে? এক বার নয় দুই বার পুরো তিন তিন বার আমার সাথে এমন হলো। একবার গ্রামের বাড়ির অনুষ্ঠানে, আরেকবার ক্লাবে মাধুরীর সাথে গিয়ে, আজকে আবার। কেনো এক কালো আধার থেকে বের না হতেই আবার আমাকে ঘিরে ধরে? কেনো ঘৃণ্য অতীতের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে বারবার? কেনো আমার কপালে একটু ভালো থাকা নেই? কেনো একটু সুখ খুজে পাই না আমি?

বড় কাকিমণি এগিয়ে এসে দাদিমণিকে কৌতুহলতার সাথে গরগর করে বলে উঠলো,

-‘ আম্মা!! দেখেন ছেলেটাকে আয়ান কেমন বেধারাম পিটিয়েছে আবার জানেন আহানাকে বউ বলে স্বীকারও করেছে। আমি আগেই বলেছিলাম এই মেয়ে দেখতে যেমন মায়ের মতো তেমন চরিত্রের দিক দিয়ে মায়ের মতোই হবে। ঠিক দেখেন মায়ের মতোই রূপের মোহে ফাসিয়ে আমাদের আয়ানের মতো ছেলে ভুলিয়ে বালিয়ে ফাসিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে। এরও লোভ আছে সম্পত্তি…’

ফুপিমণির কথা শেষ না হতেই দাদিমণি চোখ রাঙিয়ে বললো,

-‘ আহ!! বড় বৌমা, বাইরে মানুষের সামনে কি যাতা বলছো’

বড় কাকিমণি মুখ বেকিয়ে থেমে যায়।

নিলয় ভাইয়া এক প্রকার দৌড় এসে আয়ানের হাত আকড়ে ধরে নতজানু হয়ে দাঁড়ায়। হয়তো এই ঘটনার জন্য তিনি নিজেকে দায়ী করছেন। নিলয় ভাইয়া নরম গলায় বলতে শুরু করলো,

-‘ সব কিছুর জন্য আমি দায়ী। আজ যদি আমি আমার দূর সম্পর্কের কাজিন এই রিয়ানকে ইনভাইট না করতাম তাহলে এমন পরস্থিতি হয়তোবা কখনো আসতো না। আমার বেখায়ালিপনার জন্য আজ এমন হলো। আমার একটু সতর্ক থাকার দরকার ছিল।…… (একটু থেমে) আসলে রিয়ান আগে থেকেই এমন ছিলো, এর আগেও তিন চারটা মেয়েকে রেপের মামলা আছে তার বিরুদ্ধে। কিন্তু বেশ সুনামধন্য ঘরের ছেলে হওয়ার সুবাদে ছাড়া পেয়ে গেছে। পরবর্তীতে সে সবার পায়ে ধরে ক্ষমা চায় আর কখনো মেয়েদের সম্মান নিয়ে খেলবে না। গত কয়েক মাসে সে খুব ভালো আচরণ করতে থাকে। আমার আশস্ত্ব হই সে ভালো পথে ফিরে এসেছে। কিন্তু হঠাৎ এতোদিন পর আমি কখনো ভাবিনি যে রিয়ান আহানার সাথে এমনটা করতে চাইবে’

আয়ান তাচ্ছিল্য হাসি টেনে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

-‘ আজ যদি আমার স্ত্রীর সাথে অপ্রীতিকর কিছু ঘটে যেতো তাহলে এর দায় কি আপনি নিতেন মিস্টার নিলয়? উত্তর আছে কি আপনার কাছে? হাহ!! সেই আপনার কাছেই আমি আমার বোন সুহাকে বিয়ে দিবো ভেবে দিবা স্বপ্ন দেখবেন না’

তারই মধ্যে একজন মহিলা ব্যঙ্গাত্মক স্বরে আয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

-‘ হেহ কথা ছিরি দেখো৷ আসছে বিয়ে দিতে। মানলাম রিয়ানের মধ্যে একটু গোলমাল থাকায় এই মেয়ের কাছে এসেছে। কিন্তু এই মেয়ে যে ধোয়া তুলসী তা তো আর নয়। নিশ্চয় আগে পরে ইশারা ইঙ্গিত দিয়েছে নাহলে আমাদের রিয়ান এমন করতো না। শুনেছি তুমি নাকি মেয়ের আপন ফুপাতো ভাই। স্বামী-স্ত্রী হলে আগে থেকেই জানতাম বাপু, হুহ। আর মেয়ের চাচি নিজেই তো বলছে যে মেয়ের চরিত্র কিংবা স্বভাব কোনোটাই ভালো না। ভালো হলে কি না জানিয়ে নিজের ফুপাতো ভাই এর সাথে বিয়ের পিরিতে বসে’

এবার ফুপিমণি মৌনতা কাটিয়ে জোরালো কণ্ঠে বললো,

-‘ ব্যাস!! অনেক হয়েছে। অনেকক্ষণ ধরে অনেকের অনেক হাবিজাবি অনেক কথা শুনছি। কার সাথে কি সম্পর্ক এখানে কেনো প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে? এখানে মেইন ভিক্টিম (Victim) হলো আহানা। একবারো ভেবেছেন কেও? তার মধ্যে কিরূপ প্রভাব ফেলছে? তার শারীরিক ভাবে কোনো ক্ষতি নাহলেও মানসিক ভাবে কি সে আদৌ ক্ষতিগ্রস্থ হয় নি বা হচ্ছে না? আমি আরোহী। আয়ান আমার সন্তান। সন্তান বলেই যে সে অপরাধ করে ছাড় পাবে তা কিন্তু নয়। আমি জানি আমার সন্তানের মন মানসিকতা কাজ কর্ম কেমন। সে যাই করুক না কেনো অবশ্যই তার পিছনে কোনো ভ্যালিড রিজন আছে। সে কখনোই তার মাকে না জানিয়ে বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিবে না। আর যদি নিয়েও থাকে তাহলে নিশ্চয়ই সে পরিস্থিতির শিকারে নিয়েছে। এইটুকু বিশ্বাস বলেন কিংবা ভরসা, তা আমার সন্তান আয়ানের প্রতি অঢেল আছে। আর এমনেও আয়ান বা আহানা কেউই ছোট না। তারা সাবালক-সাবালিকা। অবশ্যই তাদের নিজেদের পছন্দ মতামত আছে। আহানাকে কার কেমন লাগে জানি না। কারোর সাথে হয়তো মনমালিন্য বা ভুল বোঝাবুঝির জন্য হয়তো সহ্য করতে পারে না। তবে আমার ব্যাক্তিগত ভাবে খারাপ লাগে না। আমার মেয়ে তুল্য হলো আহানা। যদি বিয়ে হয়েই থাকে আমার ঘরের লক্ষ্ণী করতে কোনো সমস্যা নেই। এমনকি আমার পরিবারের কোনো সদস্য এরো থাকবে না, আমার দৃঢ় বিশ্বাস। সুতরাং, বাইরের মানুষের এসব চিন্তা করে চুল পাকানোর কোনো দরকার নেই। আর বাকি রইলো সুহার সাথে নিলয়ের বিয়ে সেটা নাহয় পরে দেখা যাবে। আপনাদের মতো নিচ মানসিকতার পরিবারের কাছে আদৌ আমাদের মেয়েকে বিয়ে দিবো কিনা পরে না হয় ভেবে দেখবো। আপাতত আপনারা আসতে পারেন। ঘরটা খালি করে দিলে ভালো হয় আরকি’

ফুপিমণির প্রতিত্তোরে মহিলাটির আর বেশি কথা বাড়ায় না। তবে শুধু ছোট করে বলে,

-‘ একজনের শাস্তি আরেকজনকে দিবেন না। নিলয় আর সুহা একে অপরকে অনেক ভালোবাসে। আর যা বোঝা গেলো আপনার ছেলে আয়ানও তার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসে’ বলে আলতো হাসি দিলো।

আমার যেনো দম বন্ধ হয়ে আসছে। শ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। চারদিক খানিকটা ঘোলাটে দেখতে পারছি। শরীর আমার নিস্তেজ হয়ে আসছে। কিছু বলতে চেয়েও কোনো শব্দ বের হলো না। কেবলমাত্র শুনতে পেলাম সুপ্পু বার বার ~ “আহানা..আহানা..” বলে ডাকছে…..

#চলবে… গল্প প্রায় শেষের দিকে তাই আমার অনুরোধ সাইলেন্ট রিডার্সরাও সাড়া দিবেন।

#প্রেমজাল
পর্ব ৩২ [ রহস্য উন্মোচন ]
জান্নাতুল মাওয়া মাহিমুন

হাতে কারোর শক্ত করে এটে সেটে মুষ্ঠিবদ্ধ করা বন্ধন অনুভব করতে পারছি। হয়তো ছেড়ে দিলেই দূর দেশে পাড়ি দিবো৷ তবে স্পর্শটা আমার খুব পরিচিত কিন্তু চিনে উঠতে পারছি না। কৌতূহল আর দমন করতে না পেরে ধীরগতিতে পিট পিট করে চোখ খুললাম। আমি হতভম্ব!! মুখে আমার অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। হাসপাতাল হাসপাতাল আবেশ বিদ্যমান। আশ্চর্য!! আমি হাসপাতালে আসলাম কীভাবে? আমি অস্থির হয়ে পরলাম। যার পরিপ্রেক্ষিতে আমার শ্বাস নিতে প্রচন্ড রকমের কষ্ট হচ্ছে। পাশে তাকাতেই দৃষ্টিপাত করলাম নীল রঙের মধ্যে কালো সুতোর পাঞ্জাবী পরিহিত যুবকটি উতলা হয়ে নার্সকে ডাকছে। তার কপালের ধারে সন্তপর্ণে গোছালো চুলগুলো অগোছালো হয়ে গেছে। আমি স্মিত হাসলাম। আমার ক্যানেল লাগানো হাতটি তারই দখলে। দ্রুত দৌড়ে ডাক্তার নার্স সহ দাদিমণি, ফুপিমণি, কাকিমণিরা এলো। নার্স এসে কতোক্ষণ আমার মাস্কে হাত দেয় আবার কপালে আবার গলার দিকে। নার্স পালস চেক করার জন্য হাত ছাড়াতে চাইলেও আমার সাইকো বর দিলো না। নার্স বাধ্য হয়ে ওইভাবে চেক করতে লাগলো। অন্যদিকে দাদিমণি পাশেই ডাক্তারকে বিভিন্নভাবে হুমকি দিচ্ছে। তার নাকি চাকরি খেয়ে দিবে, হাসপাতাল আর চালাতে দিবে না হেন তেন আরো কতো কিছু। আমি সবার কান্ডে যেনো বেকুব বনে রইলাম। কিছুই বুঝতে পারছি না। সব মাথার ৯০° ডিগ্রি কোণে চলে যাচ্ছে।

কিছু ক্ষণিক পর নার্স ব্যাকুল হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

-‘ আপনার কি কোথাও কষ্ট হচ্ছে? না মানে খারাপ লাগছে?’

আমি আস্তে আস্তে ডানে বামে মাথা এলিয়ে না করলাম। নার্সটি তপ্ত শ্বাস ফেললেন।

বড় কাকিমণি ককর্শ গলায় বললেন,

-‘ এই মেয়ে খারাপ লাগছে না মানে কি? তাহলে অজ্ঞান হলি কেমনে? কিছু হলে বলে ফেল। তোকে হয়তো আমি দেখতে পারি না তবে আমার বুকে রেহেম দেহেম আছে বুঝলি’ বলে মুখ বাকালো।

আমি আনমনেই ফেস করে হেসে দিলাম। আমি স্বভাবত এমনি। মাঝে মাঝে সিরিয়াস সময় হেসে ফেলি। কিন্তু এই হাসিটা ছিলো প্রশান্তির। বড় কাকিমণি কড়া করে কথাগুলো বললেও তার কথায় আমার প্রতি ঢের স্নেহের প্রকাশ পেয়েছে।

বড় কাকিমণি চোখ রাঙিয়ে বললো,

-‘ বিয়ে হয়েছে গেছে বলে অন্যের ঘরের বউ। আমার বাড়ি বয়ে এসে অপমান হওয়ার ইচ্ছে নেই বাপু। তাই আর কিছু বললাম না, হুহ। নাহলে কড়া কানমলা দিতাম। বেহায়া মেয়ে কোথাকার’ বলে দূরে গিয়ে সোফায় আয়েশ করে বসলো।

ফুপিমণি স্নান হেসে এগিয়ে আসলো। আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

-‘ এখন কেমন লাগছে আহুপাখি? তুই ঠিকাছিস তো? কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো? শুন যখন এতোই হাসি তখন এমনে থাকবি কেমন। কেদে কেটে বাণ ভাসাস কেনো? এখন কিন্তু তুই শুধু আমার মেয়ে না ছেলের বৌও। আয়ান আর মা আমাদের সব বলেছে। আর পুনরাবৃত্তি করে আর তোকে তোর ভয়ংকর অতীত মনে করাতে চাই না রে। নিজেকে কখনো খোলা বইয়ের মতো প্রকাশ করতে নেই। মানুষ পৃষ্ঠা ছিঁড়ে নিতে দ্বিধাবোধ করবেনা। বুঝলি? দুর্বলতা থাকলেও সব সময় শক্ত থাকার চেষ্টা করবি। কারণ তোর কাছে যা দুর্বল তা অনেকের তোকে আঘাতের হাতিয়ারও হতে পাতে। সো বি স্ট্রং অলওয়েজ’ বলে আলতো করে কপালে চুমু খেলো।

ডাক্তার গলা খাকারি করে বলে উঠলো,

-‘ কেবিনটা খালি করে দিলে ভালো হয়। পেসেন্টের বিশ্রাম প্রয়োজন’ বলে নার্সকে নির্দেশনা দিয়ে বেরিয়ে গেলো। কেও আর কথা না বাড়িয়ে একে একে সবাই প্রস্থান করলো কেবলমাত্র আয়ান আর নার্সটা বাদে। নার্স তার কাজে মগ্ন হলো।

আমি লক্ষ্য করলাম যে সুপ্পু আসেনি। তাহলে কি সুপ্পু আমার অপর অভিমান করলো? আমার জন্য যে তার বিয়ে ভাঙ্গনের পথে।

আমি সরু গলায় ছোট করে আয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম,

-‘ সুপ্পু কই?’

আয়ান রাশভারী কন্ঠে বললো,

-‘ সবাই কি আর আপনার মতো মিসেস চৌধুরী? জামাই ছেড়ে সারা দিন-রাত অন্যদের নিয়ে পরে থাকবে’

আমি উনার দিকে থমথমে চাহনিতে চেয়ে রইলাম।

আয়ান বিরক্তমিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো,

-‘ একজনের অপরাধের দায় কেনো আরেকজন নিবে? অই ড্যাফারকে শাস্তি দেওয়ার জন্য অন্যদের সম্পর্ক নষ্ট হবে কেনো? রিয়ানের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে। অবশ্য কার্যকর হয়েও গেছে। যেটার জন্য শালার এতো তেজ, কামনা, তাড়না অইটাই ছাটাই হবে। সুহা-নিলয়ের আগের নির্ধারিত দিন মাফিকেই সব অনুষ্ঠান হবে শুধু’

আয়ান সম্পূর্ণ কথা ব্যক্ত না করায় উনার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম।

আয়ান আমার কাছে এগিয়ে ফিসফিস করে বললো,

-‘ শুধু ওদের না আমার আর আমার মিসেস এরও বিয়ে হবে সেটাও ঘটা করে আয়োজনে। সাথে হানিমুনও’ বলে চোখ টিপ মারলো।

আমি মুখ ডান পাশে ফিরিয়ে চোখ-মুখ শক্ত করে বিড়বিড় করে বললাম,

-‘ এক নাম্বারের ম্যাডেল পাওয়া অসভ্য লোক’

আয়ান আমার হাতে রিং জাতীয় কিছু একটা পরিয়ে দিয়ে গভীর চুম্বন দিয়ে বললো,

-‘ কনগ্রেচুলেশন, আমার লজ্জাবতী লাজুকলতা। এবার ঘুমাও’

আমি মৃদু হাসলাম। চোখে যেনো রাজ্যের ঘুম এসেছে পরেছে। হয়তো এটা ঘুমের ইনজেকশনের প্রভাব। আমি আমার চোখ জোড়া নিমজ্জিত করে নিলাম পরম আবেশে।

——————–

একগুচ্ছ গুমোট গন্ধ শ্বাস রুদ্ধ করে দিচ্ছে আমার। প্রাণ নাশের উপক্রম!! মনে হচ্ছে ঘুমের মধ্যে কেও গলা চেপে ধরে আছে। মাথাটাও বেশ জিম জিম করছে। আমি আর সহ্য করতে না পেরে ছটফট করতে করতেই চোখ খুলে তাকাই।

নিজেকে একটা চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় দেখে খানিকটা হতবিহ্বল হই। হাত-পা রশি দিয়ে এটে সেটে লাগানো। রশির তীব্র বাধনের ফলে হাতে লাল লাল আভা দৃশ্যমান। আমি তো হাসপাতালে ছিলাম। তাহলে এখানে কেনো? আমি কোন অজানা-অচেনা জায়গায় আবদ্ধ? না দৃঢ়তা পালন করলে চলবে না। আমাকে যেই করে হোক এখান থেকে পালাতেই হবে। আমি নিজেকে আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকি।

-‘ কীরে, জেগে গেছিস দেখি’

যখন আমি রশি খুলতে বহাল আচমকা পরিচিত মেয়েলি কণ্ঠ কর্ণপাত হতেই ভড়কে গেলাম। পরিচিত হলেও কণ্ঠ অধিকারিণীকে চিনতে পারি না। আমি তৎক্ষণাৎ তার দিকে তাকাতেই সামনে থাকা মেয়েটা তাচ্ছিল্য স্বরে বললো,

-‘ কী হয়েছে জান্টুস? আমাকে ভুলে গেছিস নাকি?’

আমি কাপা কাপা কণ্ঠে বলে উঠলাম,

-‘ ম..মধু..’

মাধুরী বাকা হাসি দিয়ে বললো,

-‘ যাক বাবা!! তাহলে ভুলে জাস নি তাহলে। আর ভুলে গেলেও আমি তো আছিই। তোর জন্য কতো কাঠ খড় পুড়াতে হয়েছে জানিস? তোর জন্য আজ পুলিশের কাছে ধরা খেয়ে পালিয়ে বেচেছি। তবে এর ক্রেডিট তোকে দেওয়া দরকার। কারণ তোরেই তো ভাই এর সহায়তায় পালাতে পেরেছি। তাই না বেইবি’

পুরো কথাটা আমাকে বলে পিছনে তাকালো মাধুরী। একজন কালো মুখোশ পরা লোক এগিয়ে আসতেই মাধুরী ঝাপটে ধরে আবার বলতে শুরু করলো,

-‘ তুমি কোথায় ছিলে? তোমাকে কত মিস করেছি জানো আদ্র?’

আমি হতভম্ব!! আদ্র ভাই এর সাথে মাধুরী? এদের সম্পর্ক কি? তাহলে কি মাধুরীর করা ঘৃণ্য কাজের সাথে আদ্র ভাই জড়িত?

আমি উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠি,

-‘ আদ্র ভাই? আমাকে এভাবে আটকিয়ে রাখার মানে কি?’

আদ্র ভাই তার মুখে পড়া মুখোশ খুলতে খুলতে বললো,

-‘ কেন রে আহানা। সবসময় সবকিছুতে আয়ানকে আশা করিস নাকি?’ বলতে বলতে আদ্র ভাই এগিয়ে আসলো। তার মুখে নিষ্ঠুরতা হিংস্রতা ফুটে আছে।

আদ্র ভাই আমার দুই গাল শক্তভাবে চেপে ধরে। আমি ব্যথা কুকড়ে উঠলাম। আদ্র ভাই চোয়াল শক্ত করে জোরালো ভাবে বললো,

-‘ সবসময় এতো আয়ান আয়ান করতে হবে কেনো? হ্যা বল? ছোট বেলা থেকেই দেখছি যাকে দেখি সেই বলে আয়ান, আয়ান আর আয়ান। কেনো আমাকে আয়ানকে দেখিয়ে বলবে আয়ানের মতো হতে? আমি আয়ানের থেকে কম কীসে? আমার কি নিজের কোনো ভিত্তি নেই? বল? আমি কি বোকা? আমার কি বুদ্ধি নেই?’

-‘ তুই বোকা না, অনেক চালাক। তোর মাথায় অনেক বুদ্ধি আছে। তবে এই আয়ান চৌধুরীর থেকে কম রে আদ্র’

আচমকা কণ্ঠ স্বর আমাদের কর্ণকুহর হতেই উপস্থিত আমি, মাধুরী, আদ্র আমরা তিনজনের বেশ চমকালাম। কারণ এটা তো আয়ান।

আদ্র ভাই আমাকে ছেড়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-‘ আয়ান তুই?’

আয়ান হাসতে হাসতে বললো,

-‘ কেন? কি ভেবেছিস? আমার সাথে ডাবল গেম খেলতে চাইবি আর আমি বুঝবো? আমি জানতাম তুই আহানার অপর ঠিক আঘাত করবি। নাহলে চেলেঞ্জে হেরে যাবি যে। হেরে যাবি তোর ইগোর কাছে। তাই তো ওর হাতে রিং এর সাথে জিপিএস চিপ স্টিচ করে দিয়েছি’

আদ্র ভাই আফসোসের স্বরে বললো,

-‘ হাহ!! আমার সবচেয়ে বড় ভুল কি জানিস আয়ান? যদি সেদিন ওর মার অক্সিজেন সিলিন্ডার বন্ধ করে মারার সাথেই ওকেও খালাস করে অইপাড়ে পাঠিয়ে দিতাম তাহলেই বেটার হতো। পদে পদে আমার জন্য কাটা হয়ে দাড়িয়েছে। শালীর ভাগ্যও আছে বলতে হয়। কম তো আর মারতে চাই না। কিন্তু সবসময় তুই ঢাল হয়ে দাড়িয়েছিস। মনে আছে তোর? একবার বর্ষাকালে পুকুর ঘাটলায় আহানা পরে যেতে নিয়েছিলো। সেদিন ও পিছলিয়ে নয়, আমি নিজেই অগোচরে ধাক্কা দিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে তোর জন্যই পেরে উঠিনি। শুধু মাত্র তোর দেওয়া চেলেঞ্জের চুক্তির কারণে এতোদিন চুপ ছিলাম। কবে তুই দেশে আসবি আর কবে আমার প্রতিশোধ নিবো। বাট না ফরচুনেটলি, না পারলাম প্রাণে মারতে, আর না পারলাম না মেরেও জীবন্ত লাশ করতে’

আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম আদ্র ভাই এর দিকে। আমার মাকে আদ্র ভাই মেরেছে? কেনো মেরেছে? তাহলে আদ্র ভাই এর জন্য আমি মা মারার জন্য ট্যাগ পেয়ে এসেছি এতকাল? কিভাবে পারলো তার মায়ের থেকে নিষ্পাপ একটা শিশুকে নৃংস্রতার সাথে আলাদা করতে? আমার আর আমার সাথে আদ্র ভাই এর কীসের শত্রুতা? আর আদ্র ভাই এর সাথে আয়ানের কীসের চেলেঞ্জ? কিছুই আমার মাথায় ধরছে না। দু’ চোখ অশ্রুমালা অলক্ষ্যে স্রোতধারা উপছে পরছে।

আমি নয়ন অশ্রুসিক্ত গলায় আদ্র ভাইকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলাম,

-‘ আপনি এতোটা নিষ্ঠুর হলেন কীভাবে, আদ্র ভাই? আমার আর আমার মায়ের সাথে কি এমন শত্রুতা আপনার যে আপনি তাকে প্রাণে মেরে ফেললেন? কেনো করলেন এমন?’

-‘ হয়তো এর উত্তরের কিছুটা আমি জানি’

দরজার দিক থেকে আচমকা কন্ঠ স্বর ভেসে আসতেই আমরা সকলে সেই পানে দৃষ্টিপাত করি। আমি বিস্মিত!!

#চলবে…..

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here