#প্রেমনোঙর_ফেলে
#লেখনীতে-মিথিলা মাশরেকা
#পর্ব-৫
একহাতে কুড়োল,আরেকহাতে মাথায় থাকা কাঠের টুকরোর বোঝা ধরে বাড়ির দিকে পা চালাচ্ছে খই। সকালে পুবের কাঠবাগানে গিয়ে কাঠ কেটে,বাড়ি বয়ে এনে তবেই খাবার মুখে তোলে ও। তার আগে না। আজকে কুড়োল নিতে গিয়ে হাড়িভর্তি পান্তা দেখেছে ও। বাড়ির নিচে নামতেই ছোট্ট ভিটেটায় লাউ কুমড়োর গাছের সাথে কয়েকটা মরিচগাছ বুনেছে ওর মা। কাঠবাগানে যাওয়ার সময় চকচকে চোখে গাছের মরিচগুলোতে চোখ বুলিয়ে গেছে খই। বাড়ি ফিরে ওই মরিচ দিয়ে পান্তা সাবার করবে বলে। বাড়ির সামনের ঢালু বেয়ে উঠতে গিয়ে শুকনো এক শামুক খালিপায়ে বিধলো খইয়ের। একটু দাড়িয়ে পা উচিয়ে দেখলো একপলক ও সেটা। কুড়োলটা গলা,কাধে ভারসাম্য করে একহাতে পা থেকে খুলে ফেললো শামুকের টুকরো। বেশ অনেকটা গভীরে থেকে রক্ত বেরোতে লাগলো জায়গাটার।
বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে ঘাসে পা ডলা মারতে শুরু করে দিলো খই। বিরবিরিয়ে বার দুয়েক পড়লো,’কাটা বাধায় শঙ্খিনী,দুব্বাঘাসে কাদম্বিনী। কাটা বাধায় শঙ্খিনী,দুব্বাঘাসে কাদম্বিনী!’ মিনিটখানেকের মধ্যেই জ্বালাটা কমেছে। জ্বালা কমানোর এই অমোঘ মন্ত্র খই ওর মায়ের কাছ থেকে শিখেছে। মায়ের কথা আসলেই মিথ্যে হয়না! ব্যথা পুরোপুরি ভুলে,কাঠ মাথায় করে,হেলেদুলে বাড়িতে উঠলো খই। কাঠ নিচে রেখে মাটির বারান্দায় বসে গেলো। পায়ের উপর পা তুলে দেখার চেষ্টা করলো কতোটা কেটেছে শামুকে। সাহেরা বানু দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা গোবরলাঠিগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিলো। মেয়েকে দেখে বললো,
-কিরে? পায়ে কি হইছে?
-শামুক বিন্দাইছে মা।
সাহেরা তড়িৎবেগে ছুটে আসলো মেয়ের কাছে। পায়ের কাছে বসে গেলো মেয়ের। খই পা সরিয়ে ব্যস্তভাবে বললো,
-আরে আরে মা! করো কি? দুব্বায় ডলা দিছি,ঠিক হইয়া গেছে তো! পা থাইকা উডো তুমি! উডো!
সাহেরা আগে খইয়ের পা টেনে পরখ করে নিলো কতোটা কেটেছে। রক্তক্ষরন নেই। তবে ক্ষতটা গভীর। নিজেও খইয়ের পাশে রোয়াকে বসে গেলো এবার। পুরোনো কাপড়টার ছেড়া আঁচল কোমড়ে গোজা ছিলো। আঁচল কোমড় থেকে ছাড়িয়ে খইয়ের চোখমুখ মুছিয়ে দিয়ে বললো,
-খিদা লাগে নাই? ক্যান যাস সকালে কাঠতলায়? আমিই যাইতাম নয়?
-তুমি তো জানোই মা,কাঠ না বইলে আমার খিদা লাগে না। ওহন খুব খিদা লাগছে। চারডা বিন্দিমরিচ তুইলা আনি গাছ থাইকা?
সাহেরা কপাল কুচকে বললো,
–ক্যান? বিন্দিমরিচ দিয়া ক্যান খাবি তুই? ঘরে তো পটল আর বড়মাছের তরকারী আছে। আমি তর লাগি মাছের মুড়ো রাখছি খই!
-বুবু তো সকালে যাওনের সময় মাছের মুড়োডা আমারে দিয়া দিছে বানু মা!
জ্বিভ কেটে বসে ছিলো খই। এই মরিচের কথা বলা মোটেওউচিত হয়নি ওর। কিন্তু মাকে সামলাতে ওর কিছু বলার আগেই পাশ থেকে বছর ছয়েকের এক মেয়ে কথাটা বলে উঠলো। সাহেরা মেয়েটার দিকে বড়বড় চোখে তাকালো। শব্দ করে নিজের কপালেই চড় লাগালো খই। আজকে আবার শনি আছে পুঁটির কপালে। সাহেরা বিস্মিত কন্ঠে বললো,
-মুড়ো তরে দিছে মানে? তুই না রাইতের বেলা আইলি পুঁটি? তরেও তো একটা বড়মাছের চাকা দিছিলাম আমি! আবার সকালে আইসা বুবুর মুড়ো নিছোস তুই?
সাহেরার গলা শুনে গলা শুকিয়ে গেলো পুঁটির। আশেপাশে মার লাগানোর মতো কিছু খুজলো সাহেরা। একছুট লাগিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো পুঁটি। এবার অগ্নিচক্ষু করে খইয়ের দিকে তাকালো সাহেরা। খই কথা ঘোরানোর জন্য বললো,
-ও্ ও মা! খিদা লাগছে! দেও না বিন্দিমরিচ আইনা! যেই গরম পরছে! পান্তা নেতায়া যাইবো কইলাম!
…
-ক্ কইতাছি যে,আমার পুতুলডার কাইল বিয়া। ব্ বদুকাকারে দাওয়াত দেই?
…
-ও্ ওমন করো ক্যান মা? পুঁটিটার ম্ মুড়ো পছন্দ! তাই দিছি! ওর মা তো এতোবড় মুড়ো দিবার পারবো না ওরে! আমি আরেকদিন খামুনে। না খাইয়া তো মইরা…
সাহেরা তৎক্ষনাৎ চড় লাগিয়ে দিয়েছে খইয়ের গালে। গালে হাত দিয়ে ছলছল চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো খই। আর সাহেরা মুখে আঁচল গুজে কাদছে। গালে ব্যথা না পেলেও মায়ের কান্না দেখে বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠছে খইয়ের। মায়ের দিকে এগিয়ে বসে আদুরে গলায় বললো,
-ও মা? মা? কান্দো ক্যান তুমি? ও মা?
-কতোবার কমু তরে? কতোবার কেমনে কেমনে বুঝামু? আমার কথার অমান্য হইস না খই! আমি যা কই,তর ভালোর লাইগাই কই! মন তো চায় তরে আসমানের তারা দিয়া সাজাই,মন তো চায় তরে জমিদারবাড়ির খাওন খাওয়াই,মন তো চায় তরে রাজকন্যার মতন কইরা কোনো প্রাসাদে রাখি! কিন্তু কি করমু ক? তর মায়ে তো অক্ষম! তর মা তো কিছুই পারে না! এল্লাগাই তো তুই মরার কথা কস তাইনা মুখপুড়ি? তুই ছাড়া তো এই সাহেরাও বাচবো না! তাতেই শান্তি তোর তাইনা? তাইলে হুন! পরেরবার মরার কথা কওনের আগে আমারে কইস! আমি কলস নিয়া শুকমরায় ডুব দিমু! তুইও বাচবি,আমিও মইরা শান্তি পামু!
রোয়াকের বাঁশ জরিয়ে হুহু করে কাদতে লাগলো সাহেরা। খই ফাকফোকর খুজে,শিশুর মতো মায়ের বুকে মুখ গুজলো আস্তেধীরে। সাহেরা কান্না থামিয়ে ফোপাতে লাগলো। এই মেয়ে ওর কোলে মাথা রাখলেই ওর কোল জুড়িয়ে যায়। খই গোজাস্বরে বললো,
-মরার কতাখান আর কোনোদিনও কমু না মা! এইবারের মতো মাফ কইরা দেও?
মুহুর্তেই সব দুঃখ বিলীন সাহেরার। আঁচলে ও চোখমুখ মুছলো নিজের। উঠে গিয়ে পান্তার সাথে নিজের জন্য রাখা মাছ নিয়ে আবারো খইয়ের সামনে বসলো। খই বললো,
-এইডা তো তুমি খাইবা!
-একলগে খাই। নে হা কর!
মেয়েকে খাওয়াতে খাওয়াতে নিজেও খাচ্ছিলো সাহেরা। খই খুশিমনে খেতে লাগলো। সাহেরা বললো,
-কাইল মুন্সীবাড়ি শহর থাইকা লোকজন আইবো। তুই কাইল থাইকা মুন্সীবাড়ির ওইদিক যাবি না। গেরোস্তবাড়িতেও যাইবি না। মনে থাকবো?
খাবার না চিবিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো খই। এই পুরো গ্রামে পাখির মতো উড়ে বেরানোর অনুমতি আছে ওর। কিন্তু মাঝেমধ্যেই যখন কোনো কাছারীবাড়িতে শহুরে কেউ আসে,মা তখনই ওকে ঘরবন্দি করে দেয়। কেনো এমনটা করে, কতোবার জিজ্ঞাসা করেছে ও মাকে। জবাব মেলেনি। আজও মিলবে না। ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে আবারো ভাত চিবোতে লাগলো। মেয়ের মনভারি দেখে সাহেরা বললো,
-গোলাম মুন্সী কইলো,হ্যাগো রান্দনের লোক লাগবো নাকি। ভাবতাছি আমি যামু।
খইয়ের চোখ চকচক করে উঠলো। সাহেরা স্বাভাবিককন্ঠে বললো,
-কেউ যদি চাঁদ দেখা ম্যাশিন আনে,আমি লইয়া আনুমনে তর লাইগা। এবার খুশি?
-হ হ! মেলা খুশি!
চেচিয়ে মাকে খুশিতে জাপটে জরিয়ে ধরলো খই। এই একটাই শখ ওর। যবে থেকে স্কুলের কাজল আপা চাঁদকে কাছ থেকে দেখা যায় ওমন মেশিনের নাম বলেছে,মন প্রান সব ওই মেশিনের নামেই করে দিয়েছে খই। যে করেই হোক,কাছ থেকে চাঁদ দেখা চাই ওর। মেয়ের পাগলামি দেখে মৃদ্যু হাসলো সাহেরা। পরপরই হাসি মিইয়ে গেলো তার মুখ থেকে। এটুকোতেই খুশি হয়ে যাওয়া এই মেয়েকে কিছুই দিতে পারলো না ও। মনে হয় এই আফসোসগুলো আস্তেআস্তে জড়ো হয়ে ওকে দমবন্ধ করে মেরে দেবে একসময়। কঠোর বাস্তবতা আর নিজের মৃত্যুতে ভয় নেই সাহেরার। ভয়টা একজায়গায়। ওর কিছু হয়ে গেলে,তখন খইয়ের কি হবে? কে দেখবে খইকে?
•
সারারাত ভর জেগে জেগে,লিখনের প্রেজেন্টেশন কভার করে,সকাল এগারোটায় বাসায় ফিরলো রাকীন। গাড়ি পার্ক করে কপাল দু আঙুলে চেপে ধরে ভেতরে ঢুকলো ও। ড্রয়িংরুমে রাজীব মাহমুদ পেপারে মগ্ন ছিলেন। ছেলেকে বাসায় ঢুকতে দেখে স্বাচাবিক গলায় বললেন,
-সারারাত ইনিশাতে ছিলে রাকীন?
রাকীন চমকে উঠে সোফার দিকে তাকালো। এ সময় ওর বাবার বাসায় থাকার কথা না! প্রতিদিনই ইনিশায় ন’টার মধ্যে পৌছে যান রাজীব মাহমুদ। আজকে যাননি দেখে বিস্মিত না হয়ে পারলো না রাকীন। শার্টের হাতাটা টেনে বোতামটা লাগাতে যাচ্ছিলো ও। রাজীব মাহমুদ বললেন,
-ফ্রেশ হয়ে নাও গিয়ে। আমি খাবার রুমেই পাঠাতে বলছি তোমার মাকে। খেয়ে ঘুম দেবে। বুঝেছো?
রাকীন ঠোট কামড়ে হাসলো। ও কতোটুকো বুঝেছে,সেটা বিষয় না। বিষয়টা হলো,ওর বাবা ওকে কতোটা বোঝে। বেশ টের পেয়েছে ওর ওপর দিকে ঠিক কতোটা গেছে যার জন্য সারারাত ইনিশাতে থাকতে হয়েছিলো ওকে। আর এজন্যই এসব বললো ওর বাবা। ওর গর্ব হয় ওর বাবাকে নিয়ে। অঢেল সম্পত্তির উত্তোরাধিকার কথার বিপরীতে,মানুষ হতে গেলে যা যা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়,সবটা ওর বাবা ওর জন্য তৈরী করে রেখেছে। এজন্যই রাজীব মাহমুদ এক সম্মানের নাম। এক শ্রদ্ধার নাম। আসছি বলে চলে আসছিলো রাকীন। রাজীব মাহমুদ বলে উঠলেন,
-প্রেমের বয়স পার করে বিয়ের বয়স হয়ে গেলো। প্রেম তো করলে না। বিয়েটিয়ের কথা কি ভেবেছো? নাকি ইনিশাকে নিয়েই সংসারধর্ম পালন করবে?
রাকীন থেমে গেলো। বাবার দিকে না ফিরে হেসে দিলো ও। কপালে হাত রেখে খানিকক্ষন নিশব্দে হেসে পেছন ফিরে বললো,
-আমার যে বিয়ের বয়স হয়েছে,সেটা ইচ্ছে দেশে ফেরার পর কেনো তোমার মনে পরলো তোমার বাবা?
-আমি বিয়ের কথা বলতেই তুমি তার সাথে ইচ্ছের দেশে ফেরাকে কেনো রিলেট করছো রাকীন? তাছাড়া ভুল কি বললাম আমি? সত্যিই কি বিয়ের বয়স হয়নি তোমার?
রাকীন পা বাড়ালো। রাজীব মাহমুদ বললেন,
-উত্তর না দিয়েই যাচ্ছো যে? মৌনতাকে সম্মতির লক্ষ্মন ধরবো?
-ঘুমোতে বললে না? যাই! স্বপ্নযোগে আগে তোমার বউমার সাথে আলোচনা করে আসি। উভয়পক্ষের মতামত তো জরুরী তাইনা?
রাকীন নিজের ঘরে চলে আসলো। শাওয়ার শেষ করে খালি গায়ে শুধু ট্রাউজার পরে বিছানায় বসলো। ভেজা চুল একদমই মোছে নি। মুচকি হেসে আগে মোবাইলটা হাতে নিয়ে টেক্সট করলো ইচ্ছেকে। পরে ফোনটা পাশে ছুড়ে মাথায় তোয়ালে চালিয়ে ব্যালকনির দিকে এগোলো। বাগানের ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে গতি কমে আসলো ওর হাতের। মৃদ্যু হাসি ঝুলিয়ে রাকীন চেয়ে রইলো ফুলগুলোর দিকে। হাজাররঙা রঙিন ফুলগুলোর মতো,সত্যিই জীবনেরও অনেক রঙ। কখনো লক্ষ্যকে চিনতে শেখা,কখনো লক্ষ্যের পেছনে ছোটা,কখনো লক্ষ্যকে ভালোবাসা,কখনো ভালোবেসে লক্ষ্যচ্যুত হওয়া,কখনো বা লক্ষ্যকে খুজতে গিয়ে ভালোবাসা পাওয়া। শেষের দুটোর কোনোটাই ঘটেনি রাকীনের সাথে। এই দুটোর অপেক্ষাতেই আছে ও। তবে দুটোতে কমন যেটা,সেটা হলো ভালোবাসা। এই শব্দকে খুজে পেতে গিয়ে রাকীন প্রথমটায় গা ভাসাবে,নাকি দ্বিতীয়টায় প্রেমনোঙর ফেলবে,সেটা তো নিয়তিই জানে…
•
ঘুমের ঘোরে ম্যাসেজের শব্দ কানে আসলো ইচ্ছের। চোখ তুলে তাকালো ও। বাটন ফোনটায় দুটো কল আর একটা আনরিড ম্যাসেজের নোটিফিকেশন। কলদুটো বাবার। ব্রেকফাস্টের এলার্ম যাকে বলে। আর ম্যাসেজটা রাকীনের। এই মোবাইলে কল ম্যাসেজের সুযোগ হাতেগোনা কয়েকজনের আছে। তারমধ্যে রাকীন একজন। ওয়াইফাই বন্ধ করে অন্য মোবাইল এরোপ্লেন মোডে রেখে ঘুমিয়ে যায় ও। তাই সে সময়টায় এই বাটন ফোনে শুধু কয়েকজনই যোগাযোগ করতে পারবে ওর সাথে। উঠে বসে রাকীনের ম্যাসেজটা ওপেন করলো ইচ্ছে। ওতে সুন্দরমতো লেখা,
‘এইযে ইংলিশ মেম? ঘুম ভাঙেনি আপনার? এদিকে আপনার আর আমার বিয়ের তোড়জোড়ে পাড়া প্রতিবেশীর যে ঘুম হারাম সে খবর কি আপনি রাখেন? ইনিশার পর সেইযে আপনার ইন্জেরী গালির প্রেমে পরলাম,আর কোনোদিকে মন বসাতেই পারছি না! আর আমার বাবা সেটা টের পেয়ে আমাকে সেই গালির রাজ্যের শেহজাদা করে দেবে বলে তালুতে তালু ঘষে চলেছে। এবার আপনিই বলুন,আমার কি করনীয়? দেশে ফিরে তো একবারও দেখা করলেন না। আমার বেচারা হৃদয়খান যে কতোশত টুকরায় টুকরায়িত হয়ে গেলো,তার কি হবে? তো তার দায় নিতে হলেও একবার দেখা করবেন কেমন? এখন আমি ঘুমোতে যাবো। সন্ধ্যায় দেখে হচ্ছে। ততোক্ষন ভালো থাকিয়েন হবু বউটাহ্! আপনার দিনটি সুখময় হোক!’
নিশব্দে হেসে দিলো ইচ্ছে। এই ছেলেটা পারেও। ম্যাসেজ দেখে মন ভালো হয়ে গেছে ওর। খুশিমনে বিছানার পাশে হাত বাড়িয়ে গিটার খুজলো প্রতিদিনের মতো। খুজে না পেয়ে ধক করে উঠলো ওর ভেতরটা। পাশ ফিরে বসলো ইচ্ছে। মনে পরলো,আগেরদিন প্রাপ্ত ওটা ভেঙে ফেলেছে। নিমিষেই বিস্বাদ নেমে আসলো ওর চেহারায়। শক্ত চোখমুখে ফুটে উঠলো প্রতিত্তরের তীক্ষ্মতা।
#প্রেমনোঙর_ফেলে
#লেখনীতে-মিথিলা মাশরেকা
#পর্ব-৬
মোটামুটি আধঘন্টা যাবত রাকীন রেস্ট্রুরেন্টে বসে জুসের গ্লাসের স্ট্র নেড়ে চলেছে। এক চুমুকও দেয়নি ওতে। ইচ্ছের সাথে দেখা করবে বলে এখানে আসা। সে মেয়ের এখনো খবর নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মোবাইল বের করলো ও। ফোনেই নিজের কিছু এক্সপেরিমেন্টাল ডকুমেন্টস্ গোছাতে লাগলো। বেশ অনেকটা সময় পর অনুভব হলো কেউ ওর সামনে এসে দাড়িয়েছে। মুচকি হেসে মোবাইল থেকে চোখ তুলে তাকালো রাকীন। গাঢ় বেগুনি আর সাদা রঙের টপস্ পরে খোলা চুলে ওর সামনে দাড়িয়ে ইচ্ছে। বেগুনি রঙেরই একটা স্কার্ফ গলায় পেঁচানো ওর। চোখের কালো সানগ্লাসটা ফর্সা চেহারায় বেশ মানানসই। ইচ্ছের বরাবর চোকারের প্রতি ঝোঁক। গিটার শেইপের লকেটটা এখনো রইয়েই গেছে ওর গলায়। ওটা দেখে হাসিটা প্রসারিত হলো রাকীনের। উঠে দাড়িয়ে মোবাইল পকেটে পুরতে পুরতে বললো,
-এতোক্ষনে আসার সময় হলো তোর হবু বউ?
-এটুকো অপেক্ষা করতে না জানলে কিসের হবু বর তুই? বাই দ্যা ওয়ে,কল মি আপনি! তোর আপনি সম্বোধনের ম্যাসেজটা মনে ধরেছে!
ভাবলেশহীনভাবে কথাটা বলে ইচ্ছে এর কপালের চুল আটকে রাখা ছোট ক্লিপটা খুলে দিলো। তারপর রাকীনের সামনের টেবিলে দুহাত রেখে দাড়ালো বেশ আরামের ভঙিমায়। রাকীন হেসে দিলো। বিদেশে থেকেও স্বভাব আচরন এতোটুকোও বদলায়নি এই মেয়ের। নিজের মাথার চুলগুলো উল্টে ধরে ভাব নিয়ে বললো,
-আবার আপনিতে যেতে চাস? সেই ছোটবেলা থেকে অপেক্ষায় রেখেছিস ইচ্ছে! এখনো এভাবে অপেক্ষায় রাখলে তোকে কিন্তু বিয়েই করবো না বলে দিচ্ছি!
ইচ্ছে মৃদ্যু হেসে চেয়ার টেনে,পায়ের উপর পা রেখে বসে গেলো। সানগ্লাসটা খুলে টেবিলে রেখে চুইংগাম চিবোতে চিবোতে লাগলো নির্বিকারভাবে। ভাবখানা এমন,তুই বল,তোর মুল্যহীন কথা আমি অতি মনোযোগ দিয়ে শুনছি। রাকীন অবাক হলো না। এই মেয়ের স্বভাবচরিত্র বেশ ভালোমতোই জানে ও। ফু দিয়ে একটা শ্বাস ছাড়লো। ইচ্ছের সামনের চেয়ারটায় বসে গিয়ে বললো,
-আধঘন্টা হলো বসে আছি।
-আধঘন্টাতে একটা জুশও শেষ করতে পারিস নি। আর আমাকে বিশ্বাস করতে বলছিস তোর এই আধঘন্টার কাহিনী? সিরিয়াসলি?
প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বুকে হাত গুজে বসলো ইচ্ছে। আর যুক্তি দেখানোর মন চাইলো না রাকীনের। অতিবেশি আগ্রহ নিয়ে ও দুহাত টেবিলে রেখে তাতে মুখ গুজে বললো,
-ওসব ছাড়! আগে দেখতে দে তোকে! কতো বড় হয়ে গেছিস তুই ইচ্ছে! সেই এইটুক খরগোশের সাইজের দেখেছিলাম তোকে! বিদেশে গিয়ে ভাতের পরিবর্তে হরলিক্স আর কমপ্লান খেয়ে বড় হয়ে আসলি নাকি?
ইচ্ছে আরো আরাম করে হেলান দিয়ে বসলো চেয়ারে। বললো,
-রাজীব আঙ্কেল তো আর কোনো খরগোশের বাচ্চাকে ছেলেবউ করবে না। তাই এই নিন্জা টেকনিক।
চোখ মারলো ইচ্ছে। রাকীন হেসে দিলো। ইশারায় মেনুকার্ড দেখিয়ে বললো,
-আগে খাওয়া। আর বিল আজকে তুই পে করবি ওকে? আমিও তো দেখি,সেলিব্রিটি বউ আমাকে খাওয়াতে পারবে কি না?
-তোর মতো হাজারটা রাকীনকে খাওয়ানোর সামর্থ্য রাখে ইনায়াত নিক্কন। শুধু বিয়েতে একবার রাজি হয়েই দেখনা! একদম ননীর পুতুল করে রাখবো!
রাকীন হেসে দিলো। এই রাজী হওয়া টপিকটা একে ওপরের উপর চাপিয়ে আসছে এতোগুলো বছর হলো। রাজীব মাহমুদ আর নওশাদ সাহেবের কবে কিভাবে পরিচয় কে জানে,তবে সেই ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে আর রাকীনকে একসুত্রে বাধার চিন্তাভাবনা দুজনেরই। মোটামুটি একসাথেই বড় হয়েছে রাকীন ইচ্ছে। আর তাতে ওদের সম্পর্কটা গাঢ় হয়েছে প্রতিনিয়ত। এখনো হচ্ছে। তবুও পরিবারের কথাকে পাত্তা না দেওয়ার দলে ওরা। তবে দুজনেরই বিশ্বাস,ওরা দুজন দুজনে এতোটাই বোঝে,একে ওপরের জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত কাউকে হয়তো কোনোদিন পাবে না। আর সম্পর্কে বুঝতে শেখাটাই বড় বিষয়। তাই বেশ চলে যাচ্ছে এই হবু বর,হবু বউ সম্পর্ক। অনেকটা সময় হাসিখুশির সাথে পার করলো দুজন। এরমাঝে হঠাৎই ফোন বেজে ওঠে রাকীনের। কল রিসিভ করে,ওপাশ থেকে কিছু শুনে রাকীন অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে অনেকটা বেশিই খুশি হয়ে গেলো। খুশি উপচে পরছে ওর চোখমুখে। রাকীন ফোন কেটে তাড়াহুড়ো করে উঠে দাড়িয়ে বললো,
-তুই খুব লাকি ইচ্ছে! দেখনা! তুই আজই আমার সাথে দেখা করতে আসলি,আর আজই হয়তো আমার পেশা আর প্যাশন এক হতে চলেছে! ফাইনালি!
লাকি কথাটা শুনে তাচ্ছিল্য আসলো ইচ্ছের। সেরকম কিছু প্রকাশ না করে বললো,
-হবু বউকে ছেড়ে পেশা এন্ড প্যাশন নিয়ে পরছিস রাকীন? নট ফেয়ার!
-বউকে খাওয়ানোর জন্য তো নিজের রেকোগনেশন থাকা জরুরি তাইনা?
ইচ্ছে কথা বাড়ালো না। ও জানে রাকীন অকারনে এতো খুশি হয়নি। নিজের জীবনে তো কোনোদিন এতো সুখ দেখলো না,রাকীনের খুশি দেখেই ভালো লাগছে ওর। বললো,
-আচ্ছা। আয় তুই!
-তুই এখানে একাকী বসে বসে কি করবি?
ইচ্ছে ইশারা করলো কিঞ্চিত পেছনের টেবিলদুটোর দিকে। আসার পর থেকেই দুটো গ্রুপে আসা ছেলেমেয়েরা ওর দিকে তাকিয়ে কথা বলার সুযোগ খুজছিলো শুধু। হয়তো এগিয়ে কথা বলার সাহস করে উঠতে পারেনি। রাকীন বুঝলো,ওদেরকে সময় দেবে বলে ঠিক করেছে ইচ্ছে। সুটটা হাতে ঝুলিয়ে বললো,
-ওহ্! পাঙ্খাগন্স! থাক তুই তোর বাতাসাপার্টি নিয়ে। আর হবু বরকে এতো সহজে হাতছাড়া করার পরিনাম ভোগ করার জন্য প্রস্তুত থাকিস।
-আমি ছাড়া আর কাউকে নিজের মনে বা তার মনে নিজেকে ধরাতে পারলে বলিস!
নির্বিঘ্নে কথাটা বললো ইচ্ছে। কারন ও জানে রাকীন কেমন। রাকীন টেবিলে হাত রেখে ঝুকে দাড়ালো। বাকা হেসে বললো,
-যদি পেয়ে যাই?
-নিজে দাড়িয়ে থেকে বিয়ে দেবো তোদের।
রাকীন হেসে সোজা হয়ে দাড়ালো। হাটা লাগিয়ে বললো,
-হাজবেন্ড শেয়ারিং কই তুমসে সিখে মেরি জান! অবশ্য তুই ছাড়া মনে হয়না কাউকে ধরতে পারবো! সেদিক থেকে তোর কনফিডেন্স লেভেল হাই থাকা অস্বাভাবিক কিছু না।
-বলছিস আমি শেয়ারিং জানি?
-অভিয়াসলি!
-তাহলে খেয়া যা করেছিলো,সেটাকে কি বলবি তুই?
রাকীন বেরিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু আকস্মাৎ ইচ্ছের এমন কথার জন্য প্রস্তুত ছিলো না ও। পা থেমে গেছে ওর ওই একটা নামে। কাতর চাওনি ফ্লোরের দিকে রেখে ও থেমে রইলো দু দন্ড। ইচ্ছে বললো,
-সত্যিই খেয়ার কথা তোর মনে পরে না রাকীন?
রাকীন পেছন না ফিরে বললো,
-যে মনে রাখেনা,তাকে মনে রাখতে নেই ইচ্ছে। স্মৃতির দরিয়ায় নোঙর ফেলার চেয়ে,বর্তমানের উত্তল স্রোতে গা ভাসানো শ্রেয়। স্রোতের চেয়ে স্মৃতি বেশি ভয়ানক!
রাকীন বেরিয়ে গেলো। বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ইচ্ছের। আজই হঠাৎ এভাবে ওর কথাটা বলা একদমই উচিত হয়নি। তবুও বলে ফেললো। কিছুকিছু ঘটনার সাপেক্ষে আমাদের বুঝে ওঠার ইন্দ্রিয় কাজ করা বন্ধ করে দেয়। আর এমনটাই ঘটেছে ইচ্ছের সাথে। অনেকক্ষন যাবত ও খেয়াল করছিলো,পাশেই একদল মেয়ে বসে ওদের মাঝের খানিকটা চাপা গায়ের রঙের একজনকে ওর গায়ের রঙ নিয়ে মজার ছলে অনেককিছু শুনিয়ে চলেছে। মেয়েটা চুপ করে শুধু শুনছে। কখনো নিজেও জোরপুর্বক হাসছে। আর সেটা দেখেই এক চেনা অনুভুতি শুরু হয়েছিলো ইচ্ছের। ওর কথার পিঠে উত্তর দিয়েই রাকীন চলে গেছে। ইচ্ছে উঠে দাড়ালো। অনধিকারচর্চার জন্য এগোবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো ও। এই গায়ের রঙ নিয়ে বলা কৌতুকের জবাব দেওয়াটা জরুরি। এমনই মজার পরিনতি যে ওদের জীবনে অনেক বাজেভাবে দাগ কেটে গেছে। অনেক বাজেভাবে!
•
দুপুর দুটোর দিকে ডিপার্টমেন্টের মেধাবী মুখগুলো নিয়ে ভাদুলগাঁওয়ে পৌছেছেন সাদিক সাহেব। গ্রামের তুলনামুলক বেশি জমিজমাধারী মানুষটা হলেন সুজন মুন্সী। এখানেই পৌছাতেই ওনাদের আপ্যায়নের জন্য গোটা দশেক জনবল নিয়ে স্টেশন পৌছে গেছে সে। তার বাড়িতে থাকার জন্য অনেক জোরাজুরি করেছে। কিন্তু আতিথেয়তা নিতে নারাজ ছিলেন সাদিক সাহেব। ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে গ্রামের স্কুল বিল্ডিংয়ের সামনে ক্যাম্প করেই আছেন। তার মতে,ক্যাম্পিংয়ে থাকলেই গ্রামের দুর্দশা ভালোমতোন অনুভব হবে সবার। ছাত্রছাত্রীরা বিনাবাক্যে মানলেও এ বিষয়টা বেশ গায়ে লেগেছে সুজন মুন্সীর। তার লক্ষ্য ছিলো শহুরে ছেলেগুলোর সামনে নিজের চার মেয়েকে উপস্থাপন করা। কিন্তু সাদিক সাহেব তা আর হতে দিলো কই? সুজন মুন্সী একেবারে হাল না ছেড়ে কাছারীবাড়িতে একবেলা খাওয়ার জন্য বলেছে ওদেরকে। এদিক দিয়ে আর মানা করতে পারেননি সাদিক সাহেব। ফেরার পর ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাকিসবাই ঘুমোচ্ছিলো ক্যাম্পে। কিন্তু সাদিক সাহেবের ঘুম এলো না। কিছুক্ষন বিশ্রাম শেষে করেই গ্রাম দেখার জন্য বেরিয়ে পরেছেন তিনি।
গ্রামের মুল রাস্তাটা কাচা। রাস্তার একধারে পাড়া গা,আরেকধারে বিস্তৃর্ন ক্ষেত। ঘরগুলো,গাছ আর হলুদ খড়ের গাদা একদম ছবির মতো সাজানো। বসন্তের এ সময় বোধহয় এদিকে ধান বোনার মৌসুম। পুরো সবুজ দিগন্তে একটু বাতাসের দোলেই ঢেউয়ে নুইয়ে পরে ধানের চারার লম্বালম্বা ডগাগুলো। একপাশে ভুট্টা আর গমের আবাদও দেখা যায়। কেউকেউ ভুট্টার শীষ না আসা গাছগুলো কেটে আলগা করে দিচ্ছে ক্ষেত। ওগুলো গো খাদ্য হিসেবে এই কাচা রাস্তা দিয়ে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেটাও আবার গরুর গাড়িতে করে। এটুকো সময়ে চার চারটে গরুর গাড়ির দেখা মিলেছে সাদিক সাহেবের। তার অনুভব হলো,আধুনিকতা আর প্রযুক্তি থেকে সত্যিই অনেকটা পিছিয়ে ভাদুলগাঁও। গাড়ির পেছন থেকে ভুট্টাগাছ নিয়ে,গাড়ির সামনে চালক গরুকে খাইয়ে দিচ্ছে। হেসে দিলেন সাদিক সাহেব। একেই পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় বলে মেকানিজম অফ আ ইন্জিন। তেল খাদক ইন্জিন যেমন তেলেরগাড়িকে এগিয়ে নিয়ে যায়,এখানে ভুট্টাখাদক গরু ওর ভুট্টাবহনকারী গাড়িকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
কেউ কেউ অবশ্য বোঝা মাথায় নিয়েও ফিরছে। তাদের সুঠাম কৃষ্ণবর্ণের দেহের দিকে তাকিয়ে একপা দুপা করে এগোতে লাগলেন সাদিক সাহেব। হঠাৎই কারো সাথে ধাক্কা লাগে তার। সে ব্যক্তি একরকম ঝড়ের বেগে আসছিলো সামনে থেকে। তাই ধাক্কায় জোরটাও বেশি ছিলো। নিজের হাতে খানিকটা ব্যথা পেলেও সরি বলতে বলতে সামনের জনের দিকে তাকালেন সাদিক সাহেব। গায়ে শক্তপোক্তকরে প্যাচানো কাপড়,চুলগুলো ফিতে দিয়ে দুটো বিনুনিতে বাধা,গলায় কালো সুতোর ধানতাবিজ,বেশ চাপা বর্নের এক যুবতী। গ্রাম্য মেয়েদের শ্যামবর্ন চেহারায় আলাদাই মাধুর্য আছে। মেয়েটাকে দেখে মনেমনে কথাটা আওড়াতে ভুললেন না সাদিকসাহেব। আঁচলে বাধা ফলগুলো মাটিতে পরে গেছে মেয়েটার। যুবতী শশব্যস্ত হয়ে মাটিতে বসে ফল কুড়োতে কুড়োতে বললো,
-দিলা তো সব ফালাইয়া? দিলা তো আরো দেরি কইরা? আল্লা! পুঁটিরা জানি ওহন না আসে এইহানে! আল্লা গো! পায়ে পরি তোমার! ওগো এইদিকে আইনো না! আইনো না!
অবুঝের মতো তাকিয়ে রইলেন সাদিক সাহেব। খই চোখ তুলে একপলক তাকিয়ে আবারো নিজের মতো ফল কুড়োতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। সাদিক সাহেব দেখলেন নিচে ডালিমের দানার মতো ছোটছোট টকটকে লাল রঙের ফল,আবার একই সাইজের সবুজ খোলসের ফল,কয়েকটা জগাফল,কয়েকটা পেয়ারা,আর কয়েকটা ঢ্যাঁপ। মুহুর্তেই আরো চারপাঁচটা বাচ্চা কোত্থেকে এসে খইয়ের সাথেই ফল কুড়োতে লাগলো। খই চেচিয়ে বললো,
-একটাও নিবি না কেউ! একটাও নিবি না কইলাম! আইজকার নাটার ভাগ আমি কাউরে দিমু না! সবগুলান বাড়িত লইয়া যামু! বেতুরগুলানও কাউরে দিমু না! পরের তিনদিন ঘরে বইয়া বইয়া এইগুলান খাওন ছাড়া আর কোনো কাম নাই আমার। এগুলান নিস না কেউ! নিস না!
কে শোনে কার কথা! সাদিক সাহেব বিমুঢ় হয়ে দেখলেন শুধু। তুলনামুলক বয়সে বড় এই মেয়েটার এমন বারন,ধমক,কোনো কিছুর পরোয়া করলো না বাচ্চাগুলো। অর্ধেকের বেশি ফল তুলে নিয়ে ছুটে পালালো সবগুলো। খই ঠোট উল্টে আঁচলের অল্পকিছু ফল দেখে তীক্ষ্মচোখে তাকালো সাদিক সাহেবের দিকে। বললো,
-সব দোষ তোমার!
আরো বোকাবনে গেছেন সাদিক সাহেব। মেয়েটা নিজেই তো না দেখে ছুটছিলো। অবশ্য গ্রামের মেয়ে,হরিণীর মতো ছুটবে,এতেই ওকে বেশি মানাবে। একটু মুচকি হেসে আদুরে স্বরে বললেন,
-আচ্ছা। তাহলে এবার কি আমাকে শাস্তি পেতে হবে?
ইচ্ছে ভাষা শুনে ঠিকঠাকমতো তাকালো। সাদিক সাহেবের বেশভুষায় বুঝতে কষ্ট হলো না ওর,মানুষটা শহর থেকে এসেছে। খইয়ের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। ও কি জানতো শহুরের মানুষদের কেউ আজই এই রাস্তায় বেরোবে? সাহেরার কথা মনে করে একটা শুকনো ঢোক গিললো খই। আঁচল ছেড়ে ছুট লাগালো ‘আল্লা বাঁচাইয়ো,আল্লা বাচাইয়ো’ বলতে বলতে। নিচে পরে থাকা ফলগুলোর দিকে একপলক,খইয়ের দিকে একপলক তাকালেন সাদিক সাহেব। কি ঘটলো কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না উনি। এরইমাঝে ফোন বেজে উঠলো তার। প্রাপ্তর নম্বর। মুচকি হেসে কল রিসিভ করলেন সাদিক সাহেব। ছেলের সাথে কথা বলতে বলতে,পা বাড়ালেন ক্যাম্পের দিকে।
#চলবে…
#চলবে…