প্রেমনোঙর ফেলে পর্ব ৭+৮

#প্রেমনোঙর_ফেলে
#লেখনীতে-মিথিলা মাশরেকা
#পর্ব-৭

রেস্ট্রুরেন্টে সবার সাথে কুশলবিনিময়,সেলফি আর অটোগ্রাফ পর্ব সেরে বেরিয়ে আসছিলো ইচ্ছে। সবাইকে অনেক কষ্টে মানিয়েছে ওকে ছাড়ার জন্য। খোলা চুলগুলোর একগোছা সামনে দিয়ে যেইনা দরজা ঠেলে খুলেছে,একঝাক বাচ্চা হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢোকা শুরু করে দিলো। একেবারে আচমকাই এতোগুলো বাচ্চা সামনে থেকে দৌড় লাগানোতে খানিকটা ভরকে গিয়েছিলো ইচ্ছে। পরপরই ঘটনা বুঝতে নিজেকে সামলে বাচ্চাগুলোর দিকে তাকালো ও। মোটামুটি জন বিশেক হবে। জীর্ণশীর্ণ দেহ,ময়লা ছেড়াতালির পোশাক,খালি পায়ে,গায়ে নোংরা,উশকোখুশকো চুল সবমিলিয়ে বোঝাই যাচ্ছে এরা পথশিশুর দল। এতোবড় রেস্ট্রুরেন্টে ওদেরকে এতো সাচ্ছন্দ্যে ঢুকতে দেখে বেশ অনেকটাই অবাক হলো ইচ্ছে। বেরোনোর পরিবর্তে বিস্ময়ে দেখতে লাগলো ছেলেমেয়েগুলোর কাজ।

ওরা ভেতরে ঢুকতেই পাঁচজন ওয়েটার মিলে দ্রুতগতিতে চারটে টেবিল পরিষ্কার করে দিলো। হুলস্থুল বাধিয়ে বাচ্চাগুলো যে যার মতো যেখানে খালি চেয়ার পেয়েছে,টেনে নিয়ে টেবিলগুলোর সামনে বসে যেতে লাগলো। রেস্ট্রুরেন্টে আসা বাকি সব নামিদামি লোকজন থ হয়ে বসে দেখছে সবটা। ওয়েটারেরা ছোটাছুটি করছে খাবার নিয়ে। মেনুকার্ডের ছবি দেখিয়ে একের পর এক ওর্ডার ছুড়ছে বাচ্চাগুলো। যেনো এখানকার রাজা ওরা। বিষয়টা কিছুতেই মাথায় বসাতে পারছিলো না ইচ্ছে। হোটেল ম্যানেজার কাছেরই ডেস্কে বসে কোনো হিসাব মেলাচ্ছিলেন মনোযোগ সহকারে। ইচ্ছে একপা এগিয়ে বললো,

-এক্সকিউজ মি?

ম্যানেজার চোখ তুলে ইচ্ছেকে দেখে দাড়িয়ে গেলেন। ইচ্ছেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলেন উনি। হিসাবের চক্করে ও যে মাঝপথে থেমে গেছ,খেয়ালই করেনি তা। ম্যানেজার উৎসুকভাবে বললেন,

-ইয়েস ম্যাম? আপনার কি আর কিছু…

-নো,রিল্যাক্স। দাড়িয়েছেন কেনো আপনি? আমি আপনার বয়সে ছোট। এভাবে দাড়িয়ে গিয়ে আমাকে নিচু করে দেবেন না প্লিজ! বসুন।

ম্যানেজার বসে গেলেন। ইচ্ছে বললো,

– ইফ ইউ‌ ডোন্ট মাইন্ড,কিছু জানার ছিলো আমার।

-শিওর ম্যাম! বলুন প্লিজ!

-একচুয়ালি,এই বাচ্চাগুলো…

-ও! ওরা? ওরা সবাই রাস্তার ছেলেমেয়ে। এখানকার কিছু ছেলেমেয়ে মিষ্টিঘর নামের একটা অনাথআশ্রম তৈরী করেছে। সেটা এদের জন্যও উন্মুক্ত। মিষ্টিঘরের ফাউন্ডার যারা আছে,তারাই সপ্তাহে একবার দুইবার এইসব বাচ্চাদের খাওয়াতে এখানে নিয়ে আসে। ওরাই টাকা দিয়ে দেয় সব খরচের।

ইচ্ছের মুখে হাসি ফুটলো। পৃথিবীতে মানুষের মাঝে মায়া, মনুষত্ব্য এখনো আছে। আরেকবার মুগ্ধ হয়ে তাকালো ছেলেমেয়েগুলোর দিকে। ওদেরকে খাবার ভাগাভাগির আনন্দ করতে দেখে মন ভরে গেছে এর। সেদিক তাকিয়েই বললো,

-ওদের বিল আজকে যদি আমি পে করি?

-সরি ম্যাম। প্রাপ্…

ইচ্ছে খেয়াল করলো বছর পাঁচেকের একটা বাচ্চা মেয়ে শুধু চুপচাপ এর ওর দিকে তাকাচ্ছে। চেহারায় তীব্র অভিযোগ,ওর সঙ্গীরা এতোটাই ব্যস্ত যে ওকে পাত্তাই দিচ্ছে না। উচু চেয়ারটায় বসতেও পারছে না ও। মুচকি হেসে ম্যানেজারের কথা না শুনেই ও মেয়েটার কাছে চলে গেলো। ওকে নিজে কোলে করে বসিয়ে দিলো চেয়ারে। সবাই বিস্ময়ে তাকিয়ে ইচ্ছের দিকে। যেখানে সবাই অবজ্ঞায় সরে বসছিলো বাচ্চাগুলো থেকে,ইচ্ছে এতোবড় একটা রকস্টার হয়েও নোংরাপোশাকের মেয়েটাকে এভাবে কোলে তুলে নিলো? ইচ্ছে মেয়েটার সামনে হাটু গেরে বসে বললো,

-কি খাবে তুমি?

-দ্যাটস্ নান অফ ইউর বিজনেস মিস রকস্টার।

পুরুষালি কন্ঠে ইচ্ছে ঘাড় পেছনে ঘুরালো। প্রাপ্ত হাত পেছনের চেয়ারে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে। ওর পাশে অরিত্রা বসেবসে আইসক্রিম খাচ্ছে। সাফোয়ান,মাহীমও আছে। ওদের আগমনে রেস্ট্রুরেন্টের পরিবেশেও থমথমে একটা ভাব।আর প্রাপ্তর গা ছাড়া ভঙিমা দেখেই ইচ্ছের বিষাক্ত লাগতে শুরু করেছে সবটা। মিষ্টি ইচ্ছের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,

-কেমন আছো ইচ্ছে? এ্ এলার্জী একেবারে সেরেছে?

-জ্বী।

সোজাভাবে জবাব দিলো ইচ্ছে। তারপর প্রাপ্তর দিকে তাকিয়ে বললো,

-এন্ড ইউ! আই নো মাই বিজনেস ভেরি ওয়েল মিস্টার। সেটা তোমাকে বলে দিতে হবে না! ইফ আ’ম নট রং,তুমি নিশ্চয়ই এখানে নিজের বিজনেস দেখাবে বলেই এসেছো রাইট? তো কাকে মারবে আজ?

প্রাপ্ত সোজা হয়ে দাড়ালো। চোখমুখ শক্ত করে এগিয়ে গেলো ইচ্ছের দিকে। ইচ্ছে ভাবলেশহীন। ওর সবচেয়ে মুল্যবান জিনিসটা আগেই নষ্ট করে দিয়েছে প্রাপ্ত। আর কিছুই হারানোর ভয় নেই ওর। তাই‌ নির্বিকারচিত্ত্বে দাড়িয়ে রইলো শুধু। তবে প্রাপ্তর ভঙিমা দেখে মাহীম কিছুটা জবুথবু হয়ে বসলো। প্রাপ্তকে দেখে বেশ অনেকটাই ভয় পায় ও। অরিত্রা আইসক্রিমে কামড় দিতে গিয়ে থেমে গেছে। বিরবিরিয়ে বললো,

-এ মেয়ে আজও প্রাপ্তর সাথে এভাবে কথা বলছে? এত্তো সাহস কিভাবে পায় ও? আজকে যে কি কপালে আছে ওর!

মিষ্টি কিছুই বলছে না। ওর‌ চেনা প্রাপ্ত নির্দোষকে কোনোদিনও সাজা দেয়নি। ইচ্ছের কিছু না জেনে এইসব কথা বলাটা দোষের কিছু না। প্রাপ্তকে নিয়ে নিজের ধারনা পরখ করতে দাড়িয়ে রইলো ও। আশেপাশের সবাই ফিসফিসিয়ে বলাবলি করা শুরু করেছে। প্রাপ্তকে চেনে বেশিরভাগই। তাই ওর রাগটাও চেনে। ইচ্ছে বুঝলো ব্যাপারটা। তাই সবরকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত,এমনভাবেই দাড়িয়ে। ওকে অবাক করে দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো প্রাপ্ত। সোজা গিয়ে সার্ভ করতে ব্যস্ত এক ওয়েটারকে কলার ধরে টেনে দাড় করিয়ে সশব্দে চড় লাগিয়ে দিলো ওর গালে।
জায়গাটার থমথমে ভাব আরো বেড়ে গেছে শতগুনে। চোখ বন্ধ করে শ্বাস ফেললো মিষ্টি। ইচ্ছে বুঝে উঠতে পারলো না,ওর উপরের রাগটা ওই ওয়েটারের উপর দিয়ে গেলো,নাকি ওর প্রশ্নের জবাব দিতেই ওয়েটারকে চড় লাগালো প্রাপ্ত। এগোতে যাবে,প্রাপ্ত শার্টের হাতা টান মেরে আরো একটা চড় লাগালো ছেলেটাকে। এবার ছেলেটা টেবিলের উপর গিয়ে পরেছে। ইচ্ছে রাগ নিয়ে চেচিয়ে বললো,

-স্টপ ইট!

প্রাপ্ত শান্তদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো। ইচ্ছে উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে বললো,

-এই গুন্ডাটা ছেলেটাকে এভাবে মারছে,আর আপনারা সবাই চুপচাপ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন? মিনিমাম মনুষ্যত্ববোধ নেই আপনাদের?

নিরবতা ভাঙলো না কেউই। অরিত্রা বললো,

-এইযে মেমসাব? ভাষন পরে! আজ নতুন এসেছেন নাকি এই রেস্ট্রুরেন্টে?

-হ্যাঁ প্রথম আসলাম। এখানে এসেও তোমাদের উশৃঙ্খলা দেখতে হবে,জানতাম না!

উত্তর দিয়ে রাগী শ্বাস ফেলতে ফেলতে ইচ্ছে ম্যানেজারের কাছে গেলো। চড়া গলায় বললো,

-এই গুন্ডাটা আপনার এখানকার ওয়েটারকে এভাবে মারছে,এভাবে বিশৃঙ্খলা করছে,সেটা দেখেও আপনি চুপ করে আছেন?

-আসলে ম্যাম…

-কিসের এতো ভয় আপনাদের? হোয়াই ডোন্ট ইউ কল দ্যা পুলিশ? ওকে ফাইন! আমিই‌ কল করছি পুলিশকে! অনেক দেখেছি ওর গুন্ডামো! অনেক সেজেছে গ্যাংস্টার! আর না!

ইচ্ছে ফোন বের করে কল করতে যাচ্ছিলো পুলিশকে। পাশ থেকে সাফোয়ান বলে উঠলো,

-ও হ্যালো? এখানকার ইনচার্জের নম্বর লাগবে?

ইচ্ছে একবার তীক্ষ্মদৃষ্টি ছুড়ে ডায়াল করতে যাচ্ছিলো। সাফোয়ান ওর সামনে একটা কার্ড তুলে ধরলো। ওটা দেখে একপ্রকার হতভম্ব হয়ে রইলো ইচ্ছে। আইডিকার্ডটা সাফোয়ানের।ইচ্ছের কান থেকে ফোন,হাত নেমে আসলো স্বয়ংক্রিয় ভাবে। তীব্র অবিশ্বাসে ইচ্ছে আশেপাশে তাকালো ও। মুখ থেকে কোনোমতে বেরোলো,

-হ্ হাউ ক্যান ইউ বি দ্যা…

-আগেরদিন তমা খেতে এসেছিলো এখানে। ও তোকে ওর পরিবারের জন্য খাবার প্যাক করে দিতে বলেছিলো। আর তার জবাবে তুই ওকে কি বলেছিলি,বলতো আরেকবার? আমিও একটু শুনি?

প্রাপ্তর কথায় ইচ্ছে তাকালো ওর দিকে। টেবিলের উপর উঠে চেয়ারে পা রেখে বসেছে প্রাপ্ত। দুহাতের কনুই হাটুতে ঠেকিয়ে বেশ আগ্রহ নিয়ে ওয়েটারকে জিজ্ঞাসা করলো ও কথাটা। ওয়েটার ছেলেটা টালমাটাল হয়ে দাড়িয়ে। প্রাপ্তর দেওয়া চড়দুটো ওকে এলোমেলো করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো। তার উপর এই প্রশ্ন! ছেলেটা গালে হাত রেখে কম্পিকন্ঠে বললো,

-আ্ আমি কাউকে কিছু বলি নি প্রাপ্ত ভাই! ক্ কে তমা? আমি ওদের কারো নামটা অবদি জানিনা ভাই! কিছুই বলিনি!

-শিওর তুই? তমাকে‌ চিনিস না?

জোরেজোরে মাথা নেড়ে না বুঝালো ছেলেটা। প্রাপ্ত এককোনে দাড়িয়ে থাকা বছর পনেরো‌ ষোলোর এক মেয়েকে ইশারা করলো। পুরোনো জামা গায়ে পরা মেয়েটা মাথা নিচু করে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো ওর দিকে। ওয়েটারের চেহারায় ভয়। প্রাপ্ত কিছু বলার আগেই‌ হুড়মুড়িয়ে ওর পায়ে পরে গেলো ছেলেটা। বললো,

-ভ্ ভুল হয়ে গেছে ভাই! ভুল হয়ে গেছে! আপনি তো সবার ভাই হন! তমারও ভাই হন! আমি যা বলেছি,ভুল বলেছি ভাই! এবারের মতো ক্ষমা করে দেন! আর কোনোদিনও এমন হবে না ভাই! কোনোদিনও বলবো না এমন কিছু!

ইচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না। কি হয়েছে,কি হচ্ছে কিছুই না। প্রাপ্ত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো,

-ও কি বলেছিলো তমা?

তমা কেদে দিলো এবার। মিষ্টি গিয়ে ওকে‌ ধরে দাড়ালো। তমা কান্না থামিয়ে চোখমুখ মুছে বললো,

-সেই ছোট থাইকা দেহি সাদিক কাকা সবাইরে এম্নে খাওয়ায়। প্রাপ্ত ভাইয়া খাওয়াইতে লাগছে কয়বছর হইলো। আমি আসি নাই মেলাদিন। আগেরদিন মা বলছিলো তার নাকি ভালোমন্দ খাইতে মন চাইছে। তাই আইছিলাম। আর এই নোংরা লোক আমারে…আমারে বলে এইসব খাওনের টাকা তো প্রাপ্ত ভাই দেয়,তার বিনিময়ে আমি তারে কি দেই। এই বদ লোকটা আরো মেলা‌‌ জঘন্য কথা শুনাইছে আমারে প্রাপ্ত ভাই!

ইচ্ছের বিস্মিত চাইনি বিস্ফোরিত চাইনিতে রুপান্তরিত হলো। বুঝতে কোনো অংশে বাকি রইলো না ওর,এই বাচ্চাগুলোর খাবারের দায়ভার সামলানো মানুষটা অন্য কেউ নয়,স্বয়ং প্রাপ্ত! ছেলেটাকে মার লাগানোরও যথেষ্ট ঘৃন্য কারন আছে। প্রাপ্ত পা সরিয়ে উঠে দাড়ালো। ছেলেটার কাধের টিশার্ট মুঠো করে তমার পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে বললো,

-প্রাপ্ত কেনো,কিসের বিনিময়ে কি করে,তা জানতে চাওয়ার তুই‌ কেউ‌ নস! আগে ওর কাছে ক্ষমা চা!

হাটুরবয়সী মেয়েটার পা ভিক্ষুকের মতো জরিয়ে ধরলো ছেলেটা। অস্থিরভাবে বললো,

-যা বলেছি,ভুল বলেছি বোন! ক্ষমা করে‌দাও আমাকে! আর কোনোদিনও বলবো না! ক্ষমা করে দাও! প্লিজ ক্ষমা করে দাও!

তমা সরে দাড়ালো। প্রাপ্তকে‌ বললো,

-ভাই,ওরে কিছু কইরো না। ওর কিছু হইলে ওর মায়ের কষ্ট হইবো। আর মাগো কষ্ট আমার সয় না।

মুচকি হাসলো প্রাপ্ত। তমার বিনুনি করা চুলে টান মেরে বললো,

-কপাল করে তোর মা তোর মতো‌ মেয়ে পেয়েছে তমা। ভালোভাবে পড়াশোনাটা শেষ কর। মাকে নিয়ে দেখা সব স্বপ্ন পুরন হবে তোর। দেখিস।

তমাও হাসলো। প্রাপ্ত ওয়েটারকে তুলে দাড় করিয়ে দিলো। টিশার্টের ধুলো ঝেড়ে দিয়ে‌ বললো,

-এরপর এমন কিছু শুনলে কৈফিয়ত দেওয়ার সুযোগ দেবো না তোকে। মনে রাখিস!

কথাদুটো বলে প্রাপ্ত একপলক ইচ্ছের দিকে তাকালো। তারপর সোজা গিয়ে বাচ্চাগুলোর সাথে খেতে বসে গেলো। এরওর প্লেট থেকে নিয়ে,দিয়ে আনন্দ করে খেতে লাগলো ওদের সাথে। সাফোয়ান,অরিত্রা,মাহীমও গিয়ে বসলো সেখানে। স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো ইচ্ছে। ওর ধারনার সবটা কেমন যেনো উল্টে‌ গেলো না?

-সেদিনও তোমার ধারনা আজকের মতোই‌ ভুল ছিলো ইচ্ছে।

মিষ্টির কথায় ইচ্ছে পাশ ফিরলো। মিষ্টি মৃদ্যু হেসে বললো,

-মিষ্টিঘরের ফাউন্ডার প্রাপ্তর বাবা সাদিক আঙ্কেল। ওই অনাথ আশ্রমের প্রথম দিকের অনাথ শিশুদের দলের মধ্যে আমি,অরিত্রা,সাফোয়ান, মাহীন আমরাও ছিলাম।

ইচ্ছের বিস্ময় বাড়লো আরো। এই মেয়েটা অনাথ! ওরা চারজনই‌ বাবা মা হারা। ভাবতেই কোথাও দম থেমে আসছে ওর। মিষ্টি বললো,

-জানিনা কেনো যেনো আঙ্কেলের আমার নামেই‌ আশ্রম খোলার ইচ্ছে ছিলো। এখনো অবদি মিষ্টিঘর আমার নামেই। আমরা অনাথ। তবে সাদিক আঙ্কেলের জন্য কোনোদিনও বাবামায়ের কমতি মনে হয়নি। অরি,সাফোয়ান,মাহীম আমরা একে অপরকে পুর্ন করেছি। এইযে সাফোয়ান? ও কিন্তু পুলিশে আছে। আর অফডিউটিতে আমাদের সাথে রাস্তায়। এইযে অরি? কলসেন্টারে জব করে। বাকিটা বকবক আমাদেরই‌ সাথে। ওই মাহীম! এই ব্যাটা৤ মোবাইল কোম্পানিতে চাকরি করে। আমিও এজ আ নার্স,ডিউটি পালন করি এখানকার হসপিটালেই।

এটুকো বলে থামলো মিষ্টি। তারপর প্রাপ্তর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টি আটকে বললো,

-আর এইযে সাদমান ইনাব প্রাপ্ত! ভার্সিটির আমাদের ব্যাচের টপার ও। রেজাল্টের গোল্ডমেডেলও আছে ওর। ইউএস থেকে চাকরির অফার এসেছিলো ওর জন্য! আর সে? সে সেই সব সোনালী ব্যাকগ্রাউন্ডকে পিশে,হীরকোজ্জ্বল ভবিষ্যতকে অবজ্ঞা করে দিয়ে,আমাদের সাথে এখানে! বাবার তৈরী মিষ্টিঘর চালাবে আর বাবার আদর্শের জন্য সমাজের অপকর্ম থামাবে বলে এখানেই পরে আছে।

কাধের ব্যাগের ফিতাটা শক্তকরে ধরলো ইচ্ছে। প্রাপ্তর ব্যাকগ্রাউন্ড এমন হতে পারে,কল্পনাতেও ছিলো না ওর। মিষ্টি বললো,

-সেদিন ওই বয়স্ক লোকটা এক ফুলকুড়োনিকে বাজে স্পর্শ করেছিলো বলে প্রাপ্ত তাকে মারছিলো। দোষটা ওই লোকের ছিলো ইচ্ছে। ওনার কাজ সহ্য হয়নি প্রাপ্তর। তাই…আ্ আসলে প্রাপ্ত ওর কাজে কারো ইন্টারফেয়ারেন্স পছন্দ করে না। তাই সেদিন ওভাবে তোমাকে ধাক্কাটা দিয়েছিলো। অবশ্য যদি বুঝতে পারতো তুমি কোনো মেয়ে,তাহলে ঘটনাটা এভাবে ঘটতো না। এজন্য তুমি সবার সামনে ওর কলার ধরেছো,দু দুবার ওর গায়ে হাত তুলেছো। সেটাও ওর ইগোকে হার্ট করেছে। তাই তোমার গিটারটাও…ওকে ভুল বুঝো না প্লিজ! পুরোটাই মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের জন্য ঘটেছে! দোষ হয় তোমাদের দুজনেরই। নয় তোমাদের কারোরই নয়! ডোন্ট মেক ইট মোর! প্লিজ ইচ্ছে? প্লিজ?

ইচ্ছে আস্তেধীরে ঘুরে প্রাপ্তর দিকে তাকালো। প্রাপ্ত লেগপিস নিয়ে খাইয়ে দিচ্ছে ওর পাশে বসা বাচ্চাটাকে। ইচ্ছে সোজা গিয়ে ওর পাশে দাড়ালো। ইচ্ছে আবারো অপমান করতে এসেছে ভেবে প্রাপ্ত টিস্যু দিয়ে হাত মুছে উঠে দাড়ালো। ওকে অবাক করে দিয়ে ইচ্ছে বললো,

-ভুল বুঝে তোমার কাজে বাধা দেওয়ার জন্য সরি। তোমার অনিচ্ছাকৃত স্পর্শের দায়ে চড় লাগানোর জন্যও সরি। কিন্তু তার বিনিময়ে আমার গিটার ভেঙে ঠিক করোনি তুমি প্রাপ্ত। তখন তুমি আমাকে যদি উল্টে দুটো চড়ও মারতে,তোমার প্রতি আজকে এই রাগটা হয়তো থাকতো না। কিন্তু তুমি যা করেছো,তাতে এই রাগ মেটার নয়! প্রতিত্তর ব্যতিত অন্য কোনো কিছুতেই তা পোষানোর নয়! আসছি।

ইচ্ছের স্পষ্ট ভাষায় সবাই তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। কথা শেষ করে চলে গেলো ইচ্ছে। মিষ্টি প্রাপ্তর পাশ থেকে বললো,

-কারো আবেগকে আঘাত করতে নেই প্রাপ্ত। জানি না কেনো যেনো মনে হচ্ছে,তুই ওর সবচেয়ে বড় আবেগে আঘাত করেছিস। আর এর পরিনতিও ও তোকে একদিন না একদিন ঠিক ফিরিয়ে দেবে। তোর সবচেয়ে বড় আবেগে আঘাত করে। দেখিস!

দুহাত মুঠো করে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো প্রাপ্ত। ওর দৃষ্টি ইচ্ছের চলে যাওয়ার দিকে স্থির। ইচ্ছের বলা কথায় বিন্দুমাত্র বিচলিত নয় ওর। বরং অজানা কারনে আটকে আছে প্রাপ্ত। গতদিনও হৃদয়ের অবয়বকে ভাবতে গিয়ে এই মেয়েটার চেহারা ওর সামনে ভেসেছে। ভাবনাটা সেখানেই! দিনের পর দিন এই ইচ্ছে নামের মেয়েটা ওর জীবনে ঠিক কি হয়ে জড়াচ্ছে? কাঙ্ক্ষিত প্রতিহিংসা? নাকি অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিচ্ছবি? কোনটা?
#প্রেমনোঙর_ফেলে
#লেখনীতে-মিথিলা মাশরেকা
#পর্ব-৮

গ্রামের সবুজ প্রান্তরের সুর্য একেবারে রক্তিম আভা ছড়িয়ে ডুবতে শুরু করেছে। সে সুর্যের অতি নিকটবর্তী হয়ে ঝাকের পর ঝাক বকের দল উড়ে চলেছে নিজ নিজ নীড়ের পানে। দুর মসজিদ থেকে মাগরিবের আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে মিহিভাবে। খইদের বাড়ির পাশের মসজিদে কোনো মাইক নেই। জমির হুজুর ওযু করে কেবলামুখী হয়ে দাড়িয়েছেন খালি গলায় আযান দেবেন বলে। দুর থেকে সাদা জুব্বা পরিহিত রোগাপাতলা লোকটাকে খইয়ের চোখে পরলো ঠিকই। গতি বাড়িয়ে,দেখেশুনে দৌড়ে এগোতে লাগলো ও বাড়ির দিকে। আজকে যদি আযানপর বাড়ি ফেরে,মা ওর গর্দান নিতে ভুলবে না। পরনে থাকা কাপড়টা উচিয়ে ধরে দৌড়ালো আরো জোরে। বাড়ির সামনের ঢালু বেয়ে উঠতেই কলপাড়ে মায়ের কাশির শব্দ কানে আসলো ওর।

খই দাড়িয়ে গেলো। হরিণীর মতো কান খাড়া করে আরেকবার পরখ করে নিলো খই,ঠিক শুনলো কিনা ও। আবারো কাশির শব্দ! ভুল শোনেনি ও। মায়ের আজ আবারো কাশি শুরু হয়েছে। খই সর্বোচ্চ দ্রুতিতে ছুট লাগালো এবার। বাড়িতে ঢুকে সোজা এলো কলপাড়ে।
সাহেরার আবারো রক্তবমি হচ্ছে। কাশির সাথে ঘলঘল করে রক্ত বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে। চাপারঙের চেহারায় কালশুটে ভাব এসে গেছে ওর কাশতে কাশতে। চোখমুখ উল্টে টিউবওয়েল ধরে কোনোমতে নিজেকে সামলাচ্ছে সাহেরা। পাশেই বাটিসহ পান্তাভাত পরে আছে মাটিতে। দশবারোটা হাসমুরগী তা খুটে খাচ্ছে বেশ আনন্দ নিয়ে। খই বেশ বুঝতে পারলো মায়ের অসুখটা আবারো জেগেছে। দৌড়ে গিয়ে মাকে জাপটে জরিয়ে ধরে বললো,

-মা? ও মা? কি হইছে তোমার মা? হইলো ডা কি? ও মা? কথা কওনা ক্যান? মা?

সাহেরা টালমাটাল চোখে মেয়ের দিকে তাকালো। ঠোটে এখনো রক্ত লেগে আছে ওর। শরীর ধুকছে। তবুও বেশ কড়াকন্ঠে কথা বলার চেষ্টা করে বললো,

-এই…এই ভরসন্ধ্যায় কই গেছিলি তুই মুখমুড়ী? তুই জানোস না? তর মারে মারনের লাইগা তর বাড়িত না থাকোনই যথেষ্ট! জানোস না তুই?

জোরেজোরে শ্বাস ফেলে বললো সাহেরা। খই‌ উত্তর না দিয়ে মাকে টানতে টানতে কলপাড় থেকে উঠোনের নিয়ে আসলো। রোয়াকের দিকে এগিয়ে বসিয়ে দিয়ে একছুটে গিয়ে মাটির কলসি থেকে পানি নিয়ে এলো গ্লাসে করে। পানি সরিয়ে দিয়ে সাহেরা আরেকদফায় কাশতে কাশতে বললো,

-তর হাতের কিছু খামু না আমি! কই গেছিলি কই তুই? আ…আগে হেইডা ক! তরে আমি কইছিলাম গেরোস্তবাড়ির দিকে না যাইতে! কই ছিলি তুই? উত্তর দে খই! কই আছিলি?

-শুকমরার উত্তরের ঘাটে গেছিলাম মা! নাটা আর বেতুর কুড়াইতে। ঢ্যাপও পাইছিলাম! সামনের কদিন তো বাড়ি থাইকা বাইর হমু না! তাই…তুমি ওহন পানিডা খাও‌ মা! কষ্ট হইতাছে তো তোমার! জলদি খাইয়া লও! লক্ষ্মী মা আমার!

আবারো পানি এগিয়ে দিলো খই। ও জানে,ওর জবাব ছাড়া সাহেরা থামবে না। তাই আগে জবাবটাই দিলো। জবাব শুনে সাহেরা মেয়ের আঁচলের গোছায় তাকালো। একটা নাটা,বেতুর,ঢ্যাপ নেই ওর গোছায়। মিথ্যে বলছে ধরে নিয়ে খইয়ের হাতে থাকা গ্লাস ফেলে দিলো রাগে। তারপর আকস্মাৎ ওর বেনুনি করা চুল মুঠো করে ধরলো সাহেরা। চেচিয়ে বললো,

-তুই আমারে মিছা কথা কইলি খই? তারমানে তুই সত্যই কাছাড়িবাড়ি গেছিলি? কার কার লগে দেখা হইছে তর? জবাব দে খই! কেডায় দেখছে তরে? তুই কার কার লগে কথা কইছোস? উত্তর দে খই! ক কইতাছি!

ব্যথায় চোখমুখ খিচে বন্ধ করে নিলো খই। মায়ের হাতে হাত রেখে অস্ফুটস্বরে সবে আহ্! বলেছে,তৎক্ষনাৎ ওকে ছেড়ে দিলো সাহেরা। নিজেই হতভম্ব হয়ে গেছে ও। যে হাতে খইকে রাজকন্যা সাজানোর স্বপ্ন দেখে,সে হাতই খইয়ের গায়ে তোলার মতো বড়সর পাপ আর হয়না। নিষ্পলকভাবে হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো ও। খই অবুঝের মতো তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে। সেকেন্ড পাঁচেক পরে আবারো কাশি শুরু হয়ে গেলো সাহেরার। আরেকবার পানি এগিয়ে দিলো খই। বললো,

-মাগো! সব ফল দৌড়াইতে গিয়ে রাস্তায় পইরা গেছে। পুঁটিরা সব কুড়াইছে। আমি যাইনাই কাছারিবাড়ির দিকে। আমারে বিশ্বাস করো মা! যাইনাই আমি কাছাড়িবাড়ি! তুমি তো আছিলা ওইহানে! আমি গেলে তো শুনতাই!

সাহেরা থামলো। কারন খই ওর যুক্তিতে ভুল করেনি কোনো। কাশিটা কিছুটা ধীরে হচ্ছে,তবে একেবারে কমেনি। রক্তও বেরোচ্ছে কমবেশি। খই কাতরভাবে বললো,

-ও মা? পানিডা খাও?

আর মানা করলো না সাহেরা। পানি নিয়ে শেষ করলো কয়েকঢোকে। কাশিটা নেই। তবে অস্থিরতা কমেনি। খই কাপড়ের আঁচল বের করে মায়ের চোখমুখ মুছিয়ে দিয়ে বললো,

-ওমা? বরুনকাকার দাওয়াখানায় নিয়া যাই তোমারে চলো! আইজকা মেলা রক্ত পরছে। আইজ মানা কইরো না মা! চলো যাই! চলো?

-লাগবো না!

এতোক্ষন শক্ত থাকলেও এবার কেদে দিলো খই। কোনোদিনও ওর এই দাওয়াখানায় যাওয়ার কথা রাখলো না সাহেরা। মাকে নিয়ে ভয় হয় ওর,সেটা এই কঠোর মানুষটা বোঝেই না। সাহেরা কপাল কুচকে বললো,

-কাদছিস কেনো?

-তোমারে লইয়া আমার ভয় হয় মা! ক্যান তুমি দাওয়াখানায় যাইতে চাও‌ না? এমন অসুখ নিয়া ক্যান কষ্ট দাও নিজেরে? ক্যান এতো চিন্তায় রাখো আমারে? কি হইবো দাওয়াখানায় গেলে? আর কতোদিন তোমার এমন রক্তবমি দেখুম মা? আমার কষ্ট লাগে তো!

মেয়ের কথা আগ্রহভরে তাকালো সাহেরা। বললো,

-আমার কষ্ট হইলে,সত্যই তোরও কষ্ট হয় খই?

তীব্র অভিযোগ নিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো খই। এ কেমন প্রশ্ন? যেই মাকে ঘিড়ে ওর পৃথিবী,সেই মায়ের কষ্টে ওর কষ্ট হয় কিনা,সেটা ওকে বলে দিতে হবে? সাহেরা বললো,

-কিরে? কইলি না? আমার কষ্টে তোর‌ কষ্ট হয়? আমি মইরা গেলে…

মাকে‌ জাপটে জরিয়ে ধরে হুহু করে‌ কেদে‌ দিলো‌ খই। বললো,

-এমনে কইয়ো না মা! কইয়ো না! তোমার কিছু হইলে,আমি কি নিয়া বাচুম? মানুর মা মইরা গেলে‌ পরে ওর বাজান‌ আবারো বিয়া কইরা নতুন মা আইনা দিছে। আমার তো বাজান নাই‌ মা! তুমিই আমার মা,তুমিই‌ আমার বাজান! তোমার কিছু হইলে,আমিও মইরা যামু মা! মইরা যামু!

-যামু না! তোরে ছাইড়া আমিও থাকতে পারুম না খই! কোত্থাও যামু না তোরে ছাইড়া! কোত্থাও না!

খইকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো সাহেরা। এই বুকের শুন্যতা ভরে দেবে বলেই উপরওয়ালা ওর কাছে খইকে পাঠিয়েছিলো। সব ছেড়েছুড়ে,কোলজুড়ে খই আর বুকজুড়ে শান্তি নিয়ে তাইতো এতোদিন বেচে আছে ও। নইলে অনেক আগেই মৃত্যু অবধারিত ছিলো ওর। মারনরোগে স্বামী,সংসার হারালেও সৃষ্টিকর্তা ওকে বাচার কারন হারাতে দেয়নি। খইকে দিয়েছে বাচার অবলম্বন হিসেবে। কিন্তু এভাবে কতোদিন? মরতে তো হবেই একদিন না একদিন! খইকে আজীবন নিজের সাথে এভাবে বেধে রাখতে পারবে না ও! মৃত্যু ওকে সে সুখ থেকে বঞ্চিত করে দেবে যখনতখন! তখন খইয়ের কি হবে? কে দেখবে ওকে? কে আগলে রাখবে ওকে? হাজারটা চিন্তায় ভয়ে অসাড় হয়ে আসতে লাগলো সাহেরার শরীর। সুর্য ডুব দিলো। আর আশার আলো খুজতে থাকা কাকপক্ষীদের রেখে গেলো,কোনো এক অন্ধকার অতলে…

মাকে ডাক লাগাতে লাগাতে বাসায় ঢুকলো রাকীন। ইনিশা থেকে সবে বাসায় ফিরলো ও। তবে প্রতিদিনের মতো ক্লান্ত দেহ নিয়ে নয়! আজকে ওর চেহারায় আলাদাই এক ঝলকানি,আলাদাই এক উদ্দীপনা। মিসেস মাহমুদ রান্নাঘরে ছিলেন। ছেলের ডাক শুনে বেরিয়ে এলেন। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বললেন,

-কি হয়েছে রাকীন? এভাবে ডাকছিস যে? সব ঠিকাছে তো ইনিশায়?

রাকীন হেসে এগোলো। মাকে জরিয়ে ধরে রাখলো খানিকক্ষন। হেলিয়েদুলিয়ে বললো,

-সব ঠিক আছে মা! ইনফ্যাক্ট বেশিই‌ ঠিক আছে! জানো মা? আজ আমি অনেক খুশি! অনেক!

-হঠাৎ এতো খুশির কারন জানতে পারি?

বাবার আওয়াজে মাকে ছেড়ে ঘুরে দাড়ালো রাকীন। সিড়ির‌ সামনে‌ই রাজীব মাহমুদ‌ দাড়িয়ে। একছুটে বাবাকেও‌ জরিয়ে ধরলো গিয়ে। আনন্দঅশ্রু চোখে নিয়ে বললো,

-ইউ আর দ্যা বেস্ট!

-আমায় বেস্ট বলছো যে? আমি যতোদুর জানি,তুমি তো ইচ্ছের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে! খুশির‌ কোনো সংবাদ থাকলে,সেটার কারন ওই হওয়ার কথা রাইট?

রাকীন হাসলো। মিসেস মাহমুদ অধৈর্যের মতো করে বললেন,

-তোমরা বাবা ছেলে কি বলছো,কি বুঝছো,আমাকেও একটু বলবে আর বুঝাবে প্লিজ? আমার মাথা ঘুরছে তোমাদের কথা শুনে! কি ঘটেছে রাকীন? আর তুই ইচ্ছের সাথে দেখা করে এলি,ওকে নিয়ে এলি না? বলেও তো যাসনি যে ওর জন্য ক্ষীর বানিয়ে দেবো! হ্যাঁ গো? তুমি যখন জানতে ছেলে ইচ্ছের ওখানে গেছে,আমাকে বলতে পারতে একবার? পারোও তোমরা বাপ ছেলেতে!

রাকীন এগিয়ে গিয়ে মায়ের গলা জরিয়ে ধরলো আবারো। তার গোমড়ামুখ দেখে কাদোকাদো গলায় বললো,

-মা? বাবা না হয় জানে কি ঘটেছে আজ। কিন্তু তুমি তো আর জানো না! ছেলের জীবনের এতোবড় সুখবরটা শোনার আগ্রহ না দেখিয়ে ইচ্ছেকে নিয়ে পরে আছো। ইজ ইট ফেয়ার?

-হয়েছে হয়েছে! অনেক এদিকওদিক বলেছিস! এবার বলতো বাবা? এতো খুশি কেনো তুই? ইচ্ছের জন্য?

রাকীন সামনে এসে মায়ের হাত মুঠো করে নিলো। বললো,

-ইচ্ছের ফেরা নিয়ে আমি যথেষ্ট খুশি মা। তবে খুশির আরেকটা কারন আছে। বলতে পারো, সেটাই প্রধান কারন। আমার আর আই ডি এর প্রজেক্টটা গভার্মেন্ট পাশ করে দিয়েছে মা! আজ সন্ধ্যায় কল করেছিলো ওরা! ওখান থেকে সবটা কনফার্ম করেই বাসায় ফিরছি।

মিসেস মাহমুদ বুঝে উঠলেন না বিষয়টা। বললেন,

-আর আই ডি মানে? ইনিশার প্রজেক্টে গভার্মেন্টের পাশ লাগে বুঝি? আগে কখনো শুনিনি তো!

রাকীন আবারো হেসে মাকে এনে সোফায় বসিয়ে দিলো। মায়ের সামনে হাটুগেরে বসে বললো,

-রুলার ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট মা। গ্রামীন অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্দেশ্যে নেওয়া একটা ছোট্ট পদক্ষেপ। এটা বেসরকারীভাবে করা যেতো না। তাইতো এতোদিন সরকারী পাশের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম।

কিঞ্চিত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন মিসেস মাহমুদ। ইনিশার বাইরেও রাকীন কিছু ভেবে রেখেছিলো,এটা ধারনায় ছিলো না তার। রাজীব মাহমুদ এসে সোফায় বসলেন। রাকীন বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,

-এতো তাড়াতাড়ি তোমার অনুমতি পাবো,ভাবি নি বাবা।

রাজীব মাহমুদ ফাইল থেকে চোখ তুলে ছেলের দিকে তাকালেন। মৃদ্যু হেসে বললেন,

-তুমি যথেষ্ট বড় হয়েছো রাকীন। বাবা পরে,আগে একজন গাইডলাইন আর বন্ধু হতে চেয়েছি তোমার। আমার সব কাজের উদ্দেশ্যে এটাই। নিজের স্বপ্ন ছুয়ে দেখো রাকীন! ইটস্ হাই টাইম!

আরেকবার বাবাকে জরিয়ে মনপ্রান ঠান্ডা করে নিলো রাকীন। তারপর চলে এলো নিজের ঘরে। বিছানায় ডিলের ফাইল রেখে মুচকি হাসলো ও। কিছু একটা ভেবে আলমারির একদম নিচের ড্রয়ার থেকে কিছু একটা বের করলো ও। মোমরঙে আকা ছবিটা দেখেই মিইয়ে গেলো ওর হাসি। মেঝেতে বসে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলো রাকীন। গ্রামের চিত্রপট আঁকা ছবিটা দেখতে দেখতে ধরা গলায় বললো,

-জানিস? ইচ্ছে ফিরে এসেছে। তোর স্বপ্নও পুরন হতে চলেছে। এখন আমার চারপাশে শুধু তোর অভাব খেয়া। এতোগুলো বছর হলো এই অভাব সইতে সইতে আমি ক্লান্ত রে! দমবন্ধ লাগছে! কোথায় হারিয়ে গেলি তুই বলতো? কোথায় হারিয়ে গেলি? এতো অভিমান তোর? ছোট্ট একটা ঘটনায় এভাবে সবাইকে ছেড়ে চলে গেলি তুই? আর আসবি না খেয়া? সবাই কি তাহলে সত্যিই বলে? তুই সত্যিই আর ফিরবি না? আমাদের কাছে? আমার কাছে? এভাবেই আজীবন তোর স্মৃতি বইতে হবে আমাকে? কি করে বুঝাই তোকে বল? যে যাই কিছু বলুক না কেনো,আমার অনেকটা জুড়ে এখনো তুই। তোকে হারিয়ে এখন অনুভব হয়,তোর স্মৃতি না,তোকে আগলে বাচতে চাই আমি! শুধুই তোকে আগলে বাচতে চাই খেয়া! শুধুই তোকে!

#চলবে…
#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here