প্রেমনোঙর ফেলে পর্ব ৯+১০

#প্রেমনোঙর_ফেলে
#লেখনীতে-মিথিলা মাশরেকা
#পর্ব-৯

ডাইনিং টেবিলের সামনে,এক চেয়ারে বসে আরেক চেয়ারে দুপা তুলে দিয়ে বসে আছে প্রাপ্ত। টেবিলে ডানহাতের কনুই ঠেকিয়ে একধ্যানে দরজার কাছে থাকা ফুলদানিটার দিকে তাকিয়ে আছে ও। মোটামুটি রাগী দৃষ্টিতে ভস্ম করে‌ দিচ্ছে ওই কৃত্রিম ফুলগুলোকে যেনো। হাত জ্বলছে প্রাপ্তর। ডানহাতে দু জায়গায় কেটে গেছে,বা হাতের কবজির দিকে ছেকা লেগে কালচে দাগ পরে গেছে একদম। রান্নাঘরে গিয়ে এই প্রথমবার এভাবে লেগেছে ওর। অন্যমনস্ক থাকার জন্য। টেবিলে রাখা কয়েকপদের রান্না ওর নিজহাতে করা। সাজিয়েছেও ও নিজেই। মা মারা যাবার পর রান্নাটা সাদিক সাহেবই সামলেছেন। তবে প্রাপ্ত নিজেও শিখে গেছে বাবার দেখাদেখি। পিয়ালী এসবে ছিলো না কোনোদিনই। থাকতে দেয়নি প্রাপ্ত। সাদিক সাহেবেরও ঘোর বারন! তার অনুপস্থিতিতে তাই রান্নাঘরে প্রাপ্তই ঢুকেছিলো। কিন্তু মনের মাঝে চলা অস্থিরতার জন্য নিজের শরীরেও ক্ষত বসিয়ে নিয়েছে। পিয়ালী পড়া শেষ করে এসে চেয়ারে বসে গেলো। উপুর করে রাখা প্লেট সোজা করতে করতে বললো,

-কি রান্না করেছিস ভাইয়া? খুব খিদে পেয়েছে রে!

-পাবদা মাছ,গোশ,শাঁক। টমেটোর চাশনিও আছে দেখ।

প্রাপ্ত শান্তস্বরে বললো। পিয়ালী ভাত বাড়তে গিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালো। প্লেট না উল্টে ওভাবেই বসে আছে সে। মাথা নেড়ে একটা হতাশার শ্বাস ফেলে,পিয়ালী নিজেই প্রাপ্তর সামনের প্লেটটা সোজা করে দিলো। ভাত বেড়ে দিতে দিতে বললো,

-এমন কেনো তুই বলতো ভাইয়া? এমন বাচ্চাদের মতো কেনো করিস বলতো? বাবা বাসায় না থাকলে প্রতিবার এইরকম সেন্টি খেয়ে বসে থাকিস। তোর জন্যই বাবা কোথাও যেতে চায়না! এমন করলে চলে? বড় হয়েছিস না তুই?

প্রাপ্তর দৃষ্টি নিমিয়ে এলো। একপলক বোনের দিকে তাকিয়ে পরপরই এদিকওদিক চোখ সরিয়ে নিজের বেখেয়ালীপনার এই অভূতপুর্ব নজিরকে অনুভব করতে লাগলো ও। পিয়ালী যা বললো,এমনটাই তো হওয়ার কথা। কিন্তু তা তো নয় আজ! আজ ওর অন্যমনস্ক থাকার কারন ওর বাবার অনুপস্থিতি নয়! এর কারন ওর কল্পকন্যাও নয়! সে জায়গাটা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে অন্যকেউ নিজের করে নিয়েছে। ওর অগোচরেই ওর ভাবনায় অন্যকিছুই জুড়ে বসেছে আজ। রেস্ট্রুরেন্ট থেকে ফেরার পর একমুহুর্তের জন্যও ইচ্ছের নামকে মাথা থেকে সরাতে পারে নি ও। একটা গিটারের জন্য মেয়েটা কেনো এতোটা হাইপার,এই একটা প্রশ্নই ওকে পাগল করে রেখেছে এখনো অবদি। প্রাপ্ত এতোবেশি মত্ত্ব হয়ে এই একটা কথাই ভাবছিলো যে,হাতের আঘাতের কথাও ভুলে গেছে ও। পিয়ালী বললো,

-নিজেই খাবি? নাকি খাইয়ে দেবো?

টেবিলের উপর থেকে হাত নামিয়ে নিলো প্রাপ্ত। কপাল ভালো এইটা পিয়ালীর চোখে পরেনি। নিজেহাতে খেতে তো পারবে না। রুমে গিয়ে ওয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে নেবে না হয়! এখন কোনোমতেই এগুলো পিয়ালীর চোখে পরতে দেওয়া যাবে না। পিয়ালীর দিকে ঠিকঠাকমতো ঘুরে বসে বললো,

-দে খাইয়ে দে।

কথা না বাড়িয়ে ওকে খাওয়াতে লাগলো পিয়ালী। নিজে হাতে খাবার কমই খায় প্রাপ্ত। সাদিক সাহেব বাসায় থাকলে দুজনকেই খাইয়ে দেন। আর তার অনুপস্থিতিতে পিয়ালীই বাধ্য হয় প্রাপ্তকে খাইয়ে দিতে। দুবার ভাইয়ের মুখে খাবার তুলে দিয়ে বললো,

-আর কতোদিন এভাবে বাবা আর বোনকে জ্বালাবি বলতো?

-এক্সকিউজ মি? জ্বালাই মানে?

-তো তোর মনে হয় তুই জ্বালাস না?

পিয়ালী খাবার এগিয়ে দিচ্ছিলো প্রাপ্তর মুখের দিকে। ওর হাত ধরে ওরই মুখের দিকে ঠেলে দিয়ে বললো,

-নিজেও খা আর আমাকে অপবাদ দেওয়া বন্ধ কর!

খাবার মুখে নিলো পিয়ালী। কিন্তু বিরক্তিভাব কমার বদলে বেড়ে গেছে ওর। প্রাপ্ত বললো,

-এতো ভালো রান্না করি,এই তোর হাতে খেতে হচ্ছে বলে কোনো স্বাদ নেই খাবারে!

-তো খাচ্ছিস কেনো?

-তো তোর কি মনে হয়? আমি কষ্ট করে রান্না করবো,আর তুই বসেবসে খাবি? তা তো হচ্ছে না! তোকে খাটানোর জন্যই এভাবে খাইয়ে দিতে বলি। নইলে তোর হাতে খেতে গেলে মনে হয় আমার স্বাধের স্বাদগ্রন্থি অক্কা পেয়েছে।

-তাহলে এক কাজ কর। বিয়েটা করে নে এজ সুন এজ পসিবল। বউয়ের হাতে খেতে গেলে আর স্বাদগ্রন্থি অক্কা পাবে না দেখিস!

প্রাপ্ত নির্বিকারভাবে বললো,

-জানি সেটা আমি! তোকে বলতে হবে না! তবে এতো সহজে তোর ছুটি নেই।

-আমিও সেটা জানি! এতো সহজে ভাবি পাচ্ছি না আমি! যা এটিচিউডে বাইরে চলিস তুই! মাঝেমধ্যে তো মনে হয় কোনো গ্যাংস্টারের বোন আমি!

গ্যাংস্টার শব্দটা শুনে প্রাপ্ত কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো বোনের দিকে। চোখ সরিয়ে নিয়ে টেবিলের নিচে রাখা হাতের ক্ষতর দিকে তাকালো। এই শব্দটা একমাত্র ইচ্ছেই ওর সামনে ব্যবহার করেছে। তাও একবার না! বেশ কয়েকবার! পিয়ালী ভাইকে আবারো অন্যমনস্ক দেখে কপাল কুচকে বললো,

-কিরে? আবার কি হলো?

-আচ্ছা পিয়ালী? আবেগ তো শুধু জীবন্ত কারো প্রতি হয়,তাইনা? কোনো প্রানহীন জিনিস কি করে কারো আবেগ হয় বলতো? এমনটা হতে পারে? এমনটা হওয়ারই বা কি কারন বলতো?

পিয়ালীর কুচকানো কপাল আরো কুচকে এলো। এতো ভারী কথা এর আগে প্রাপ্তর মুখে শুনেছে বলে মনে পরে না ওর। প্রাপ্ত অন্য কোনো দুনিয়ায় হারিয়ে আছে,এটা বুঝলো ও। নিজের ক্ষুদ্র জ্ঞানকে বারদুয়েক ধাক্কা মেরে উত্তরে বললো,

-হয়তো প্রানহীন জিনিসটা জীবন্ত কারো সাথে সম্পর্কিত। তাই জীবন্ত মানুষটার সাথে ওই প্রানহীন জিনিসটাও আবেগ হয়ে গেছে।

প্রাপ্ত তৎক্ষনাৎ ওর দিকে তাকালো। কিছুটা চমকে উঠেছে পিয়ালী। ভ্রু নাচিয়ে ভাইকে জিজ্ঞাসা করলো কি হয়েছে। জবাব না দিয়ে উঠে‌ দাড়ালো প্রাপ্ত। গ্লাসের পানিটা শেষ করে বোনের দিকে ফিরে বললো,

-খাওয়া শেষ কর। আমি মিষ্টিকে আসতে বলছি। পড়া শেষে ওর সাথেই ঘুমিয়ে যাস। আসতে দেরি হবে।

রুমে গিয়ে পরনে থাকা টিশার্টের উপরে একটা শার্ট পরে নিলো প্রাপ্ত। বোতাম লাগালো না একটাও। দুহাতা ফোল্ড করে কনুই অবদি রেখে,বাইকের চাবিটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো ও। কিছুই‌ বুঝে উঠতে পারলো না পিয়ালী। তবে ভাইয়ের স্বভাব বেশ ভালোমতোই‌ জানে ও। বাসার সামনের রোডের ওপার থেকে মিষ্টির আসতে দুমিনিটও লাগবে না। নিজের মতো করে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো ও।

রাত ২.৪৫। কিচেন ড্রয়িংরুমের মাঝামাঝি কাউচে বসে ইচ্ছে বেশ মজা নিয়ে কাপ নুডুলস্ খাচ্ছে। বাসায় ফেরা অবদি যে বাসার খাবার থাকবে না,নাফিজা বেগম রাখবেন না,এটা বেশ ভালোমতোই জানে ও। তাই কিচেনের সবচেয়ে আপন জায়গায় কয়েকবক্স কাপ নুডুলস্ এনে রেখেছে আগেই। বেশিরভাগ রাতেই না খেয়েই ঘুমিয়ে পরে ও। প্রোগ্রাম,পার্টি এসবের তাগাদায় মাসে এক দুইবার বাসায় রাতে খাওয়া হয় হয়তো। তখন নিজ হাতে পানি গরম করে কাপ নুডুলস্ খায়। রান্নাবান্নার দক্ষতা এই অবদিই ওর। আর এতে নিজেকে নিয়ে গর্ব করতেও ভোলে না ইচ্ছে। একদম ওর পায়ের নিচেই,ফ্লোরে একটা বিদেশী কুকুর শুয়ে। ওটা এনেছিলেন নাফিজা বেগম। নিজের মেয়েকে হারিয়ে,সৎ মেয়ের প্রতি প্রতিশোধস্পৃহা জমিয়ে, কুকুর পুষতে চেয়েছিলো সে। বেশ আদরযত্নও করতো কুকুরটাকে। নাম দিয়েছে টমি। তবে টমি আবার তার চেয়ে ইচ্ছেকেই বেশি ভালোবাসে। এজন্য ওকেও বাসাছাড়া করতে চেয়েছিলেন উনি। কিন্তু নওশাদ সাহেবের জন্য হয়ে ওঠেনি। ইচ্ছে কাটা চামচে নুডুলস্ প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বললো,

-টমি? আর ইউ আস্লিপ? ঘুমিয়ে গেছিস? টমি?

টমি চোখ মেলে উঠে দাড়ালো। সাদা ধবধবে লোমশ শরীরটা ঝাড়া মেরে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়াতে থাকলো। ইচ্ছে মুচকি হাসলো। তারপর নিচে নেমে হাটু গেরে‌ বসে গেলো। টমি ইচ্ছের পায়ে গা ঘষতে শুরু করে দিয়েছে। ইচ্ছে ওর গায়ে হাত বুলিয়ে‌ দিয়ে বললো,

-এস এম তোকেও খেতে দেয়নি?

টমি হেটে গিয়ে ওর খাবারের পাত্র দেখালো। ওতে এখনো খাবার রয়ে গেছে। ইচ্ছে বুঝলো আজকে নওশাদ সাহেব হয়তো খাইয়েছে টমিকে। টমি আবারো এসে গা ঘেষলো ইচ্ছের সাথে। ইচ্ছে বললো,

-তাহলে জেগে আছিস কেনো? ঘুম আসেনি সোফায়? এখানেই বা চলে আসলি কেনো? আমাকে নামতে দেখে?

ইচ্ছের বা পায়ে থাকা কালো সুতাটা কামড়াতে লাগলো টমি। যেনো বোঝাতে চাইছে, ফর্সা পায়ে কালো রঙটা একটু বেশিই নজরকাড়া। সিড়ি দিয়ে নামার সময় ওই পা চোখে পরতেই চলে এসেছে ও। ইচ্ছে হেসে দিয়ে ওকে কোলে তুলে‌ নিলো ওকে। তারপর পা বাড়ালো রুমের দিকে।
রুমে এসে টমিকে ছেড়ে হেডফোন,ফোন,গিটার,একটা ছোট্ট নোটপ্যাড আর পেন্সিল হাতে নিলো। তারপর সোজা গিয়ে রাখলো বারান্দায় রাখা বিনব্যাগের সামনে। টমি
মেঝে শুকে এদিকওদিক হাটছে। ইচ্ছে আগে গিয়ে দেওয়ালে আটকানো সেই গিটারভাঙা টুকরোতে লেখা মা শব্দটাতে চুমো দিলো। আলতোভাবে ছুইয়ে দিয়ে বললো,

-লাভ ইউ মা।

দুবার জোরে ডেকে উঠলো টমি। ইচ্ছে ওর দিকে ফিরলো। এভাবে ডাকার মানে কারো উপস্থিতি অনুভব করছে টমি। কিন্তু এখানে কারো থাকার সম্ভবনা নেই। ইচ্ছে এগিয়ে গিয়ে বললো,

-ডোন্ট মেক নয়েজ টমি। এস এম শুনলে সমস্যা হবে। বাবার ঘুমেও ডিস্টার্ব হবে। সো কিপ কাম। ওকে?

টমি থামলো। কিন্তু মেঝে শোকা আর পাইচারি থামালো না। ইচ্ছে বিনব্যাগে বসে কানে হেডফোন গুজে দিলো। চোখ বন্ধ করে গিটারে কিছুক্ষন এমনই টুংটাং করতে লাগলো। তারপর সুর তুলতে লাগলো নিজের মতো করে। সে সুর মিলিয়ে গাইলো,

‘ইচ্ছেনদী বড্ড বেসামাল
হুম…খেয়াহীন সে অপ্রাপ্তির খাতায়…
হৃদয়তীরে কষ্টের তরী ভিড়লো
হুম…কেউতো কড়া নাড়লো,মন মোহনায়…
অনুভবে মুড়িয়ে নাও,ভালোবাসায় ডুবে যাও
ভেসে যাওয়ার চেষ্টাও করো
সাতরঙা পাল তুলে…
নয়তো,মনগহীনে আটকে যাবে
প্রেমনোঙর ফেলে..
হুম…প্রেমনোঙর ফেলে…’

গানের পরেরটুকোর পরিবর্তে টমির জোরালো শব্দে আঁতকে উঠলো প্রাপ্ত। এতোটাই চমকে‌ গেছে যে,জানালার তাকের উপর দেয়ালের সাথে লেপ্টে দাড়িয়ে থেকেও লাভ হলো না। ওখান থেকে সশব্দে নিচে পরে গেছে ও। আর গিয়ে পরেছে একেবারে সোজা বাগানের ইট বিছানো মাটিতে। মৃদ্যু আর্তনাত করে হাতের কনুই চেপে ধরে চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো প্রাপ্ত। দাতে দাত চেপে টমিকে গালি দিতে গিয়েও দিলো না। টমি তো অবুঝ প্রানী। ও ডাক লাগিয়ে নিজের কাজ করছে মাত্র। এখানে সব দোষ ইচ্ছের। ওর জন্যই একের পর এক আঘাত সহ্য করতে হচ্ছে ওকে।

পিয়ালীর কথা শুনে সাতপাঁচ না ভেবেই বাইক ছুটিয়ে ইচ্ছের বাসায় চলে এসেছে ও। পৌছানোর পর মনে হয়েছে,এভাবে আসার কোনো মানে নেই। কিন্তু আবার এটাও ভেবেছে,এসেছে যখন,পরখ করেই যাক,এই গিটারের জন্য এতো বেশি রিয়্যাক্ট কেনো করছে ইচ্ছে। বেশ অনেকক্ষন বাসার নিচেই রাগ নিয়ে হাটাহাটি করার পর,একটা দম ছেড়ে দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকেছে প্রাপ্ত। দোতালার শুধু দুইটা ঘরই খোলা ছিলো। একটাতে পিয়ানো,তানপুরা এইসব মিউজিকাল ইনস্ট্রুমেন্ট আর মেডেল,অ্যাওয়ার্ডে ঠাসা। পরে এই ঘরে ঢুকে বুঝেছে,এটাই ইচ্ছের ঘর। ভাঙা গিটারটা কি করেছে,সেটা খুজতে ময়লার ঝুড়িতে অবদি হাত দিয়েছিলো প্রাপ্ত। কিছুই পায়নি। এরইমাঝে টমিকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে যায় ইচ্ছে। পালানোর জায়গা না পেয়ে জানালায় চড়ে‌ দাড়িয়েছিলো ও। নিচে নামলেও শব্দ হতো বলে লাফ দেয়নি। টমি ওরই‌ উপস্থিতি টের পেয়েছিলো বলে প্রথমবার ডেকে উঠেছিলো।

ইচ্ছেকে সেই মা লেখাটাকে চুমো দিতে ঠিকই দেখলো প্রাপ্ত। বুঝতে বাকি রইলো না,ঠিক কেনো গিটারটাকে‌ আবেগ বলেছে ইচ্ছে। অপরাধবোধটা কাটানোর জন্য বারবার করে ইচ্ছের চড়দুটোকে মনে করতে লাগলো ও। কিন্তু ততোক্ষনে ইচ্ছে গান শুরু করায়,আর‌ কিছু মাথাতেই আসেনি ওর। টমি মেঝে শুকে এগিয়ে ব্যালকনির ধারে চলে এসেছে। দেখেই নিয়েছে জানালার উপরের দেয়ালে লেপ্টে দাড়িয়ে থাকা প্রাপ্তকে। আর তাই এবারে আরো জোরে চেচিয়েছে। ইচ্ছের গানে প্রাপ্ত নিজেও চোখ বন্ধ করে ছিলো। অনুভব করছিলো কিছু একটা হয়তো। তাই টমির আকস্মাৎ আওয়াজটায় আতঙ্কের রেশ এসেছে ওর মাঝে। একটু বেশিই হচকিয়ে নিচে পরে গেছে বেচারা। টমি এখনো ডাকছে। হেডফোন কানে বলে প্রাপ্তর পরে যাওয়ার শব্দ বা টমির ডাক,কোনোটাই‌ কানে পৌছায়নি ইচ্ছের।

প্রাপ্ত স্বস্তির দম ছাড়লো। এভাবে কারো সামনে ইহকালে অপদস্ত হওয়ার মতো ইমেজ ওর না। ইচ্ছের সামনে তো কোনোকালেই না! তীক্ষ্ম চোখে তাকালো ও টমির দিকে। ভাবখানা এমন, ‘দেখে নেবো তোকে!’ টমি ডাক থামিয়ে জিহ্বা বের করে ওরই‌ দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চাওনিতেও যেনো বলা, ‘তুই দেখে নিস,সাদমান ইনাব প্রাপ্ত’র এই হ্যাংলা রুপ,ডাক ছুড়ে ছুড়ে,আমিও দেখিয়ে দেবো সবাইকে!’ প্রাপ্ত হাতা গুটিয়ে তেড়ে এগোতে যাচ্ছিলো। কি বুঝলো,মনেমনে এই উত্তরটার জন্যও ইচ্ছেকে দায়ী করলো ও। ওর কাছ থেকেই নির্ঘাত এভাবে তাকাতে শিখেছে এই কুকুর। এই মেয়ের সবকিছুতেই ওর জন্য ঝামেলা তৈরীর উপায় আঁকা। পায়ের কাছে থাকা ইটের টুকরোতে লাথি মেরে রাগ আর বিরক্তি নিয়ে চলে যাচ্ছিলো প্রাপ্ত। কি ভেবে ঘাড় ঘুরিয়ে একপলক ইচ্ছের দিকে তাকালো ও। ইচ্ছে আর গান গাইছে না। চোখ বন্ধ করে গিটারে সুর তুলছে শুধু। নিকষ রাতে কালোমেঘে ঢাকা চাঁদের সাথে অনেকটা মিল এই মেয়েটার। অজান্তেই তুলনা একে দিয়ে নিজেই থমকে গেলো প্রাপ্ত। এগুলো তো ইচ্ছের জন্য বরাদ্দ নয়! এগুলো তো ওর বিপরীত বৈশিষ্ট্যের কোনো এক কল্পকন্যার জন্য! সেই চেনা অনুভূতিগুলো আজ এ কার নামে করে‌ দিলো ও? কেনো করে দিলো? #প্রেমনোঙর_ফেলে
#লেখনীতে-মিথিলা মাশরেকা
#পর্ব-১০

আকাশে চাঁদ তার সর্বোচ্চ আকৃতি নিয়ে উঠেছে আজ। তারার অভাব নেই পুরো আকাশ জুড়ে। দু এক টুকরো কালোমেঘ অন্ধকারে দেখা যায় না। দিনের তুখোড় রৌদ্রাণীর‌ দাহ করার ছন্দটা কেড়ে নিয়েছে রাতের শীতল‌ বাতাস। আলপথের ওপারে সবুজ ধানক্ষেত রাতেরবেলা আর সবুজ নেই। অন্ধকারের জন্য তৈরী হওয়া কালচে ভাবটা সুন্দরই লাগছে। বাতাসের সাথে তার তরঙ্গরুপ,সৌন্দর্যের অন্য এক‌ জগতেই‌ নিয়ে যায়। চারপাশে জোনাকির মিটিমিটি আলো। যেনো তারা খসে বাতাসে ভাসতে শুরু করেছে। কি মায়াবী পরিবেশ! প্রানখুলে শ্বাস নেওয়ার জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত পরিবেশ হয়তো সম্ভব না। চোখ বন্ধ করে মৃদ্যু বাতাসের সাথে গা ভাসাতে মন চায় বারবার।

জসীমদ্দীনের রুপসী বাংলার প্রতিটা বর্ননা চাক্ষুস দেখার জন্য ভাদুলগাঁ যথেষ্ট। রাতের শহরের ব্যস্ততার উল্টোপিঠে গ্রামের স্তব্ধতা কি অমায়িক! মুগ্ধ চোখে আশপাশ দেখে চলেছে রাকীন। ওর নেওয়া প্রজেক্টটা কোনো এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের জন্য বরাদ্দ ছিলো। এলাকার নাম ভাদুলগাঁ শুনেই রাকীন বুঝেছিলো,অনেকটাই পিছিয়ে পরা অঞ্চল হবে এটা। কিন্তু তা বলে এলাকার আর্থসামাজিক পরিবেশ,মতবাদগুলো এতোটাও আদিম হবে,ধারনা করেনি ও। গ্রাম থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দুরের স্টেশনটায় যখন রাকীন পৌছায়, মাগরিবের আযান পরেছে ততোক্ষনে। এসে উঠেছে পাশের গ্রামের এক বন্ধুর বাড়িতে। সেখানে রাকীনের বন্ধু,ওর ছোট ভাই,আর বাবা মা। বন্ধুর আতিথেয়তায় কেটে গেলো সারা সন্ধ্যা। রাতে ঘুমোনোর জন্য রাকীনকে যে ঘর দেওয়া হয়েছিলো,তার জানালা দিয়ে চাঁদের আলোটা পুরোপুরি ঘরে ঢুকছিলো। সেটা দেখে আর ঘুম আসেনি রাকীনের। এমনিতেও দিনের বেলা ফ্রেমওয়ার্ক,স্কেচ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। তাই ভাবলো রাতের আধারে একঝলক দেখে নেবে ভাদুলগাঁও।

যেমন ভাবা,তেমন কাজ! ড্রোন ক্যামেরাটা নিয়ে বেরিয়ে পরলো রাকীন। গ্রামে বিদ্যুতায়ন ঠিক কতোখানি,সেটা বোঝার জন্য পুরো গ্রামের রাতের ছবিটা তুলবে বলে। রাত খুব একটা গভীর হয়নি। তবুও চারপাশ শুনশান। দিনভর খাটাখাটুনির পর সন্ধ্যের পরপরই বিছানায় গা এলিয়ে দেয় এখানকার লোকজন। কাচা রাস্তার একপাশে বড়সর একটা শিমুল গাছের নিচে দাড়িয়ে আগে খালি চোখে চারপাশ পরখ করে‌ নিলো রাকীন। রাস্তায় মানুষের আনাগোনা একেবারেই নেই। অবশ্য এমনটা হওয়াতে ওরই‌ সুবিধা হয়েছে। এমনিতেও ও চায়না ওর প্রজেক্টটা নিয়ে এখানকার কেউ এখনই কিছু জানুক। এক পাড়ার ছোটছোট ঘরগুলোর কয়েকটাতে হলুদ বাল্বের আলো দেখা যায়। বাকিগুলো বেশিরভাগই অন্ধকার,নয়তো জানালা দিয়ে প্রদীপের শিখার দেখা মেলে। মানে সে ঘরগুলোতে এখনো বিদ্যুৎ সুবিধা পৌছেনি।একটা ছোট শ্বাস ড্রোন ক্যামেরা ওড়াতে শুরু করলো রাকীন। হাতের ডিসপ্লে তে ঠিকঠাকমতো বোঝার চেষ্টা করলো সবটা।

শুকমরার তীরে বাঁশ আর কাঠের তক্তা তৈরী ঘাট। পানিতে পা ডুবিয়ে,বাঁশ জরিয়ে তাতে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে খই। মন খারাপ করে একধ্যানে তাকিয়ে আছে পানিতে পরা চাঁদের প্রতিবিম্বের দিকে। আজ সারাদিন বাড়ির বাইরে বেরোয় নি ও। সাহেরা ঘুমিয়েছে বেশ অনেকক্ষন হলো। আর ঘুম আসছিলো না বলে মায়ের কোল থেকে চুপিসারে উঠে এসেছে খই। প্রচন্ড অভিমান হয়েছে,এমন ভঙিমায় সাহেরার সাথে ঠিকমতো কথাও বলেনি ও আজ। সাহেরা কিছু বললো না। দিনভর পাখির মতো সারাগ্রামে উড়ে বেরানো দস্যি মেয়েটাকে ঘরে বেধে দিয়েছে,ওটুকো অভিমান ওর সাজে। অভিমান কমাতে রাতে নিজহাতে তুলে খাইয়ে দিয়েছে খইকে। শুকমরার কাহীনি শুনিয়েছে। জ্বী’নের গল্প শুনিয়েছে। রাজপুত্র রাজকন্যার গল্প শুনিয়েছে। তারপর একসময় নিজেই ঘুমিয়ে গেছে সাহেরা।

খই চুপচাপ বসেবসে মায়ের গল্পগুলো মনোযোগ দিয়ে ভাবছে। শুকমরায় নাকি এ গ্রামের লোকের সুখ ম’রে। কই? আজোবদি কোনোদিনও তো কারো সুখ ম’রতে দেখলো না ও। কোনোদিন শুনলো না শুকমরায় নৌকাডুবি হয়েছে। মায়ের সাথে অভিমান করে কতো রাত এখানে ও নিজেই বসে থেকেছে,হিসেবছাড়া। ওর চোখেও তো পরলো না তেমন কিছু। তবে কি মা মিথ্যে বলে? মায়ের গল্পের রাজপুত্তর তো পক্ষীরাজ চেপে আসে। একবার পুঁটির মা বলেছিলো,রাজকন্যারা দেখতে নাকি চাঁদের চেয়েও সুন্দর হয়। ওর‌ মা কেনো বলে না ওমন? সাহেরা তো ওকেই নিজের রাজকন্যা বলে। কিন্তু ও তো দেখতে চাঁদের মতো ধবধবে ফর্সা না। আবার ওর জন্য তো কোনো রাজপুত্তরও পক্ষিরাজে চেপে আসলো না! তাহলে কি ওর মা মিথ্যে বলে? রাজকন্যা হতে গেলে আগে চাঁদের মতো সুন্দর হতে হয় বুঝি?

আচমকাই বেশ জোরেজোরে একটা শব্দ কানে বাজলো খইয়ের। শব্দ অনুসরন করে চোখ তুলে উপরে তাকালো ও। গোল বাটির মতো টিনের কিছু একটায় আলো জ্বলছে। একদম ঠিক ওর মাথার উপর দিয়ে উড়ছে বাটিটা। বড়বড় চোখে তাকালো খই। পাখি তো নয় ওটা! তবে কি? এই শুকমরার তীরে আজকে ওর প্রথম রাত না! অনেকবার, অনেকরাত অবদি এভাবেই ঘাটে বসে থেকেছে ও। কোনোদিন এমন কিছু তো চোখে পরেনি। এমন অদ্ভুত জিনিসটা কি হতে পারে ভেবে দাড়িয়ে গেলো খই। আজ প্রথমবার মায়ের বলা জ্বী’নের কাহীনির সাথে‌ বেশ মিল পাচ্ছে ও। ভয় পাওয়া উচিত ওর। কিন্তু এতোটুকোও‌ ভয় পেলো না খই। ভেতরের কোনো এক দৃঢ় সত্ত্বা ওকে বলে চলেছে,শুকমরার নৌকাডুবি আর রাজকন্যার কাহীনির মতো জ্বীনের গল্পও মিথ্যে বলেছে ওর মা। জ্বী’ন বলে কিছুই হয় না!

ড্রোন এবার ঘুরে উল্টোদিক চলে যেতে লাগলো। শশব্যস্তের মতো কাপড়ের আঁচলটা কোমড়ে‌ গুজে দিলো খই। পাড় বেয়ে উপরে উঠে এলো ও। তাকিয়ে দেখলো কোনদিকে উড়ে যাচ্ছে ওটা। দক্ষিনের সড়কের দিকে। একপলক বাড়ির দিকে তাকালো খই। ঘরদোর অন্ধকার। পাশের নয়নদের বাড়িতে সদ্য জন্মানো ছাগলছানার পাহাড়ায় রোয়াকের এককোনে নিভুনিভু সলতে রাখা। ওটার একফালি আলো পরেছে খইদের উঠোনেও। আবারো ড্রোনের দিকে ফিরলো খই। জিনিসটার প্রতি তীব্র আগ্রহ জন্মে গেছে ওর। ওমন জিনিস পুঁটি কোনোদিন দেখেনি। জ্বীনের চেরাগ বলে বেশ ভয় দেখানো যাবে ওকে। বেতুর চুরির শোধ তোলা যাবে ওর কাছ থেকে ভেবে হাসি দিলো একটা।

খই ছুট লাগালো ড্রোনের পিছন পিছন। ওর বয়সী গ্রামের আর পাঁচটা মেয়ে হলে নির্ঘাত ভয়ে উল্টোদিক ছুটতো। কিন্তু সেসব ভয়ের কারনকে মনে আসতেই দেয়নি ও। বেশ আগ্রহভরে দেখতে লাগলো উড়ন্ত আলোকবাটিকে। একসময় নিচে‌ নেমে আসতে‌ লাগলো ওটা। বেশ সুন্দরমতো গিয়ে পরলো ছোট খড়ের গাদার উপর। চকচক করে উঠলো খইয়ের চোখ। ওটা হাতে পাওয়ার‌ একরাশ খুশিতে ভেতরটা নাচছে ওর। জ্বলন্ত বাটি,জীনের চেরাগ,বাতিওয়ালা টিনের পাখি এমন হাজারটা নামের মধ্যে থেকে কোনটা বললে পুঁটিকে বেশি ভয় দেখানো যাবে,ভাবতে‌ লাগলো ও। নাচতে নাচতে গিয়ে সবে হাত লাগিয়েছে ড্রোনে,কেউ‌ একজন ওর হাত ধরে ফেললো।

অন্ধকারের মধ্যেও উজ্জ্বলবর্নের হাতটা চোখে পরলো খইয়ের। এ গায়ের মানুষজনকে‌ চেনে ও। তাদের কৃষ্ণবর্নের সাথেও বেশ পরিচিত ও। চাঁদ আলো আর ড্রোনের ক্ষুদ্র আলোকচ্ছটায় ওর হাত ধরে রাখা ফর্সা হাতটা দেখে এতোক্ষনের সুপ্ত ভয়টা হুড়হুড় করে জেগে উঠতে লাগলো ওর। মা বলেছিলো,জ্বী’নদের গায়ে নাকি আলো লেগে থাকে। উজ্জ্বল দেহী হয় তারা নাকি। তাহলে কি এটা সত্যিই জ্বীনের চেরাগ? প্রথমবারের মতো ভয় কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে ওর ভেতর। পাশ থেকে‌ পুরুষালি আওয়াজ এলো,

-এক্সকিউজ মি?

চোখমুখ খিচে বন্ধ করে নিলো খই। এটা কোন ভাষা? গ্রামের কেউ তো এই ভাষায় কথা বলে না! গলাটাও‌ পুরুষ মানুষের। এ সময় কোনো পুরুষমানুষ এদিকে আসবে,এটা বেশ অস্বাভাবিক। তার উপর গায়ের রঙটা বেশিই উজ্জ্বল। যা ভাদুলগায়ের কোনো পুরুষের‌ গায়ের রঙের সাথে যাবে না। চেচিয়ে বলে উঠলো,

-ইয়া আল্লা! গেরামে জ্বীন ঢুকছে!

পুরোই‌ বোকাবনে গেছে রাকীন। কি বললো এই মেয়ে? গ্রামে জ্বীন ঢুকেছে মানে? খইয়ের‌‌ হাত ধরে রেখে নিজেই নিজেকে আপাদমস্তক দেখে নিলো একবার। বোঝার চেষ্টা করলো,ঠিক কোন দিক থেকে জ্বীন মনে হয় ওকে। তেমন কিছু বুঝে না উঠে উকি দিয়ে খইয়ের দিকে তাকালো ও। ভয়ে সে মেয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে আছে। ড্রোনের গায়ে থাকা আলোতে চেহারা বুঝতে সমস্যা হয়নি ওর তেমন। বয়স বিশের এদিক ওদিক হবে হয়তো। চাপা রঙটা রাতের আধারে সেভাবে বোঝা যেতো না হয়তো। তবে ভয় পেয়ে করা বাচ্চামোতে চেহারায় আলাদা এক মোহনীয়তা একে দিয়েছে যেনো। এরইমাঝে খই এক চোখ আটকে রেখে আরেকচোখ খুললো। পাশে দাড়ালো আকাশী টিশার্ট পরিহিত শুভ্রবর্নের মানুষটাকে দেখে আটকে রইলো সেকেন্ডদুই। মানুষ হলে,নিসন্দেহে সে ওর জীবনে দেখা পুরুষমানুষের মাঝে সুন্দরতম। রাকীন ভ্রু নাচিয়ে বললো,

-হোয়াট?

ভাষা শুনে একপলক ড্রোন,আরেকপলক রাকীনের দিকে তাকালো খই। হোট আবার কি? এই ভাষা কোনো মানুষের নয়! এতো সুদর্শন কোনো মানুষ হয়না! জ্বী’নের সাক্ষাৎ দর্শন পেয়ে দ্বিতীয়দফায় ভয় পেতে বিলম্ব হলো না খইয়ের। আবারো চেচাতে যাচ্ছিলো ও। বুঝে উঠে রাকীন হাত ছেড়ে একহাতে পাশের তালগাছটার সাথে চেপে ধরলো খইকে। আরেকহাতে মুখ চেপে ধরলো ওর। রাকীনের বুকে হাত দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে,পা ছুড়তে ছুড়তে খই অস্ফুটস্বরে বললো,

-খই কিন্তু কোনো জ্বী’নেরে ডরায় না! বদু কাকারে কইয়া বোতলে ভরামু তরে কইলাম। ছাড় আমারে! ছাড়! ব’জ্জাত জ্বী’ন কোথাকার!

পুরোটা না বুঝলেও ব’জ্জাত জ্বী’ন শব্দদুটো স্পষ্ট শুনলো রাকীন। হতাশচোখে তাকিয়ে রইলো ওর হাত থেকে ছোটার চেষ্টারত মেয়েটার দিকে। ছেড়ে দিলে এই মেয়ে যে পুরো গ্রাম মাথায় তুলবে,বুঝতে বাকি রইলো না ওর। খই মুখ চেপে ধরে রাখা অবস্থাতেই,জ্বী’ন বলে বলে রাকীনের বুকে কিলঘুষি ছুড়তে শুরু করেছে এবার। বুকের উপর ধুমাধুম পরতে থাকা মার গুলোতে ব্যথা কম,হতাশা বাড়ছে রাকীনের। একটা ছোট শ্বাস ফেলে রাকীন একহাতের মুঠোয় খইয়ের দুহাতের কব্জি নিয়ে পেছনে খইয়ের কোমড়ে চেপে ধরলো। মার‌ লাগাতে না পেরে আরো উত্তেজিত হয়ে পরছিলো খই। রাকীন ওর মুখ আরো শক্ত করে চেপে‌ ধরে একদম কাছে চলে এসে বললো,

-হুশশশ! শান্ত হও! আমি মানুষ! কোনো জ্বী’নটিন না! রিল্যাক্স!

খই নড়াচড়া থামালো না। চোর যেমন বলে না আমি চোর,তেমনি জ্বী’নও কোনোদিনও‌ বলবে না আমি জ্বী’ন। মানুষ হলে‌ এভাবে চেপে‌ কেনো ধরবে ওকে? জ্বী’ন বলেই তো ধরেছে। মেরে এই তালগাছে ঝুলিয়ে দেবে‌ নাতো ওকে? মাথার উপরে থাকা বাবুইয়ের বাসাগুলোর দিকে তাকালো খই। সকালবেলা ওভাবেই ঝুলতে দেখবে গ্রামের সবাই ওকে। কাদোকাদো ভাবে রাকীনের দিকে তাকালো ও। ড্রোনের আলোটা নিভে যাওয়ায় ওর ভঙিমা রাকীন বেশ একটা বুঝলো না। উম্ উম্ শব্দে তখনো নড়াচড়া করছে খই। রাকীনের মনে হলো এই মেয়ের ভয় কাটেনি তখনো। খইকে আশ্বস্ত করবে বলে বললো,

-আরে আমি তোমার মতোই সাধারন মানুষ! ভয় পেয়ো না! শান্ত হও! কিছুই করবো না তোমাকে!

এটুকো বলে দুবার ফু দিলো ও খইয়ের চোখেমুখে। খই এবার আরো বেশি করে যেনো নিশ্চিত হয়ে গেছে,কালোজাদু করবে জ্বী’নটা বলে‌ ফু দিলো ওর‌ চোখেমুখে। কেদে দিলো এবার ও। আজকে এই‌ জ্বী’ন ওকে মেরেই‌ ক্ষান্ত হবে। মাকে আর দেখতে‌ পাবে না এ জীবনে। ওকে কাদতে দেখে নিজের উপর‌ই চরম বিরক্ত হলো রাকীন। বেছেবেছে এ কোথায় এসেছে ও? যেখানকার মানুষজনের বদ্ধ ধারনা,একটু গভীর রাতে রাস্তায় কোনো মানুষ থাকে না। জ্বী’ন থাকে! এক পর্যায়ে খইকে ধমক দিয়ে বললো,

-দু সেকেন্ডের মধ্যে এই মরা কান্না যদি না থামিয়েছো,সত্যিসত্যিই কিন্তু ঘাড় মটকে দেবো!

কান্না স্বয়ংক্রিয়ভাবে থেমে গেলো খইয়ের। রাকীন বুঝলো জ্বী’নের বাধ্যানুগত অন্ধবিশ্বাসী মেয়েটা। মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে,খইয়ের হাতদুটো ছেড়ে দিলো ও। সবে কিছু বলতে যাবে,মেয়েটা একদম ওর বুকের মাঝে এসে ঢলে পরলো। ঝিঝিডাকা মাঠের প্রান্তরে স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে রইলো রাকীন। খই জ্ঞান হারিয়েছে।

#চলবে…

[! ❤ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here