প্রেমময়ী তুমি পর্ব -০৭+৮

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_৭
#নিশাত_জাহান_নিশি

“না! আমি আজ এক্ষণি যাব। এই বাড়িতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ছটফট ছটফট লাগছে। এক্ষণি আমার এই বাড়ি থেকে বের হতে হবে। যদি আপনি আমাকে নিয়ে এখন বের না হোন তবে আমি কিন্তু খালামনিকে সব বলে দিব!”

চাঁদের দেওয়া কঠোর হুমকিতে নূরের অবস্থা নাজেহাল প্রায়! তাৎক্ষণিক হাতের মুঠোয় রাখা বাইকের চাবিটি সে অতি সাংঘাতিকভাবে মুঠোয় চেপে ধরল। এতটাই সজোরে চেপে ধরল যে চাবির কড়া দাগ তার নরম হাতে অতি তীক্ষ্ণভাবে গেঁথে গেল। এতে অবশ্য তার কোনো ভাবান্তর হলো না! ব্যথা-বেদনা ছাড়াই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। অন্তরে বিষ এবং মুখে মধু পোষে নূর জোরপূর্বক হাসিতে চাঁদের দিকে তাকাল। মলিন গলায় বলল,,

“চলো!”

চাঁদ হাসল। উচ্ছ্বলতার হাসি হাসল! দ্রুত পায়ে হেঁটে নূরের পাশে দাঁড়ালো। আচম্বিতেই নূরের বাঁ হাতটি চেপে ধরল! উৎফুল্লিত দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“চলুন।”

নূর চমকালো! সচকিত দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। রূঢ় গলায় বলল,,

“কী হলো? হাতে ধরলে কেন?”

চাঁদ মুখটা কালো করে নিলো! ধীর গলায় বলল,,

“কেন? আমি ধরলে বুঝি পাপ হবে?”

নূর এক ঝটকায় চাঁদের হাতটি ছাড়িয়ে নিলো! বিরক্তিমাখা দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। তটস্থ গলায় বলল,,

“নিজের সীমার মধ্যে থাকার চেষ্টা করো। হুটহাট করে আমার গাঁয়ে হাত দিবে না। অযথা গাঁয়ের সাথে ঢলাঢলিও করবে না। ইউ নো হোয়াট? মেয়ে মানুষের এমন ঢলাঢলি স্বভাব আমার পছন্দ না।”

রাগে গজগজ করে নূর স্থান পরিত্যাগ করল! চাঁদের প্রতি তার মনে এক সাগর ক্রোধ জন্ম নিলো। নূরের যাওয়ার পথে তাকিয়ে চাঁদ মুখটা বাঁকালো। বিড়বিড় করে বলল,,

“আইছে আমারে লিমিটেশন শিখাইতে। বয়ে গেছে আমার মাতালের গাঁয়ের সাথে ঢলাঢলি করতে! খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে তাকে ছুঁতে। জগতে আমি আর ছেলে মানুষ পাই নি? এই মাতালের সাথেই আমার ঢলাঢলি করতে হবে?”

নিজ খেয়ালে বিড়বিড় করে চাঁদ নূরের পিছু পিছু হাঁটা ধরল। তাকে অনুসরণ করে বাড়ির সদর দরজায় চলে এলো। সাবরিনা আবরার এবং সোহানীর কাছ থেকে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে দুজনই বাইকে উঠে বসল। গম্ভীর ভঙ্গিতে নূর বাইক স্টার্ট করার প্রস্তুতি নিতেই চাঁদ পেছন থেকে নূরকে থামিয়ে দিলো। আবদারসূচক গলায় বলল,,

“একটা পারমিশন নেওয়ার ছিল।”

নূর বিরক্তবোধ করল। রূঢ় গলায় বলল,,

“আবার কী নাটক?”

“উফফফ নাটক নয়। সত্যিই একটা সিরিয়াস কথা ছিল।”

“ঢং বন্ধ করো৷ আর তাড়াতাড়ি বলো কী বলবে?”

“আপনার কাঁধে হাত রাখতে পারব তো?”

নূর দ্বিমত পোষণ করল! অসন্তোষ গলায় বলল,,

“না! পারবে না।”

“কী? পারব না মানে? আপনার উদ্দেশ্যটা কী একটু বলবেন?”

“উদ্দেশ্য মানে? কী উদ্দেশ্য?”

“এই যে আমাকে মে’রে ফেলার উদ্দেশ্য!”

“মানে?”

“আপনার কাঁধে হাত না রাখলে যদি আমি বাই অ্যানি চান্স বাইক থেকে ছিটকে মাঝরাস্তায় পড়ে যাই তখন? তখন কী হবে হ্যাঁ? আপনি চান? আমি এক্সি’ডেন্টে ম’রে যাই?”

নূর ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল! কপালে পড়ে থাকা অবাধ্য চুলটিকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলো। কপাল ঘঁষে তিক্ততা প্রকাশ করল। তিরিক্ষি পূর্ণ গলায় বলল,,

“রাখো বাপ রাখো! তোমার সাথে অযথা কথা বাড়িয়ে আমি অকালে মর’ব নাকি?”

চাঁদ খুশি হয়ে গেল। মিষ্টি হেসে নূরের কাঁধে হাত রাখল। প্রফুল্লিত গলায় বলল,,

“তাহলে এবার চলুন। আমি রেডি।”

বিষন্ন ভঙ্গিতে নূর বাইকের হ্যান্ডেলে হাত রাখল। শরীরে প্রচণ্ড রাগ এবং জেদ নিয়ে বাইকটি স্টার্ট করে দিলো! মনে মনে আওড়ে বলল,,

“এ কোন মহা ঝঞ্জাটে ফেঁসে গেলাম আমি মাবুদ? কবে এই ভূমিকম্প থেকে মুক্তি মিলবে আমার? কবে আমি একটু শান্তিতে, নিশ্চিন্তে এবং নির্বিঘ্নে বসবাস করতে পারব? আগের মতো কোনো রকম ভয়-ভীতি ছাড়া স্বস্তিতে এবং শান্তিতে থাকতে পারব আমি? আদৌ কী এই কাজিন নামক ভূমিকম্প থেকে মুক্তি পাব আমি?”

মনে মনে এই হাহাকার জপতে জপতে নূর মেইন রাস্তায় বাইক নিয়ে উঠে গেল। চাঁদ আনন্দে হতবিহ্বল হয়ে আশেপাশে তাকিয়ে মুচকি হাসতে লাগল। তার এই অনাবিল খুশি দেখে মনে হচ্ছিল যেন আকাশের ঐ দুর্লভ চাঁদটিকে সে হাতের মুঠোয় পেয়ে গেল! চাঁদকে হাতে পাওয়ার খুশি যেন তার আর ধরছে না। নূরের কাঁধটি আরও সজোরে আঁকড়ে ধরল সে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে নূরকে মুগ্ধিত গলায় বলল,,

“কী সুন্দর রাতের প্রকৃতি নূর ভাইয়া! আমার না খুব ইচ্ছে ছিল জানেন? এইভাবে কারো বাইকের পিছনে ওঠে বিশাল রহস্যে ঘেরা রাতের এই টিমটিমে আলো আঁধারে যেখানে দু-চোখ যায় সেখানেই ঘুরে বেড়াতে! দু’দিকে দু’হাত ছড়িয়ে হিমেল হাওয়াকে নিঃসংকোচে গাঁয়ে মাখিয়ে নিতে। চোখ বুজে প্রকৃতিকে অনুভব করতে। চাঁদ দেখতে, তাঁরা দেখতে, আকাশ দেখতে, সমুদ্র দেখতে, আশেপাশের লোকজনদের দেখতে, তাদের অবজার্ভ করতে, কোনো এক নিরিবিলি নদীর ধারে বসে ধোঁয়া ওঠা গরম চা খেতে! সমুদ্রের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে। ঢেউয়ের তালে তালে বহুদূর ভেসে যেতে। সমুদ্রের ধারে একান্তে বসে জোছনা বিলাস করতে। ব্রীজের উপর আলুথালু পায়ে নির্বিঘ্নে অনেকখানি পথ হেঁটে যেতে। খালি পায়ে নির্জন রাস্তায় এদিক থেকে ওদিক ছোটোছুটি করতে। গলা ছেড়ে গান গাইতে। পাগলের মতো নাচানাচি করতে। চাঁদকে অনুসরণ করে দূর থেকে বহু দূরে হারিয়ে যেতে!”

নূর বিরক্তি প্রকাশ করল। নাক ফুলিয়ে উচ্চ আওয়াজে বলল,,

“একটু থামো প্লিজ! কান ঝালাফালা হয়ে গেল আমার! বাইকের পেছনে তোমাকে উঠিয়েছি মানে এই নয় যে তোমার সব ইচ্ছে আমি পূ্রণ করব! শুধু যেই শর্তটি তুমি দিয়েছিলে সেই শর্তটিই পূরণ করব। আশপাশ থেকে ঘুরিয়ে আনব। আর তুমি চাইলে রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু খাবার-দাবার খাইয়ে আনতে পারি।”

চাঁদ মুখটা বাঁকিয়ে নিলো! খড়তড় গলায় বলল,,

“আপনি কী ভেবেছেন হ্যাঁ? আমি আপনাকে বলব আমার এসব ইচ্ছে পূরণ করতে? আমাকে নিয়ে দূরে থেকে বহু দূরে হারিয়ে যেতে? আমাকে নিয়ে সমুদ্রে যেতে? তবে কান খুলে শুনে রাখুন মিস্টার মাতাল! আমি এতো ছোঁচা স্বভাবের নই যে অন্যের বয়ফ্রেন্ড নিয়ে এসব ইচ্ছে পোষণ করব!”

নূর বিব্রতবোধ করল। মনে মনে চাঁদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলল,,

“এহ্! আইছে এবার ভালো মানুষ সাজতে! অন্যের বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে রাতে-বিরাতে হ্যাংলামি করতে পারে আবার অন্যদিকে নিজেকে ছোঁচা ভাবতেও নারাজ! আর কী বলল ওটা আমাকে? আমি মাতাল? উফফফ! জাস্ট আর কয়েকটা দিন সহ্য করে নিই। ভাইয়ার বিয়েটা ভালোয় ভালোয় সেরে গেলেই এই আপদ আমার গলা থেকে আপনা আপনি-ই নেমে যাবে।”

এর মধ্যেই চাঁদের অতি উত্তেজিত হাত নূরের কাঁধে বেশ জোরেশোরেই পড়ল! হালকা ব্যথার অনুভূতি হলো নূরের কাঁধে৷ চোয়াল উঁচিয়ে উঠল নূর। তিরিক্ষিপূর্ণ গলায় বলল,,

“এই কী হলো? আমার কাঁধটা ভেঙে ফেলবে আমার? আমাকে লু’লা বানারোর প্ল্যানিং আছে নাকি তোমার?”

চাঁদ ফিক করে হেসে উঠল। হাতের বাঁধনটি হালকা করে ধরল। মিটিমিটি হেসে বলল,,

“আপনাকে লু’লা বানাব আমি? নিজের কাজিনকে? খালামনিকে কী জবাব দিব শুনি? আর তাছাড়া আপনার গার্লফ্রেন্ড? কী অবস্থা হবে তার? তাকে নিশ্চয়ই আমি লু’লা ছেলের গার্লফ্রেন্ড বানাতে পারি না!”

নূর এবার ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল! মাঝরাস্তা থেকে সরে এসে রাস্তার পাশ ঘেঁষে বাইকটি থামালো! নূরের এমন অদ্ভুত কান্ডে চাঁদ বেশ বিস্মিত হলো। কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“কী হলো? বাইক থামালেন কেন?”

“বাইক থেকে নামো বলছি!”

চাঁদ সন্দিহান গলায় বলল,,

“কেন বলুন তো? আপনার কি ই’য়ে পেয়েছে?”

নূর গর্জন করে উঠল! ধমকের স্বরে বলল,,

“চাঁ…..দ! তুমি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছ।”

“কী বাড়াবাড়ি করছি হ্যাঁ? কী বাড়াবাড়ি করছি আমি? শুনুন? যদি আপনার ইয়ে পেয়েও থাকে, তবে রাস্তাঘাটে এসব ইয়ে টিয়ে করা যাবে না! কেউ যদি দূর থেকে আপনার গো’পন অঙ্গ দেখে ফেলে তখন কী হবে? আপনার গার্লফ্রেন্ড রাগ করবে না? তাকে ঠকানো হবে না?”

নূর পারছে না চাঁদকে এক্ষণি এটেম টু মার্ডার করে ফেলতে! গলা টিপে ধরতে। তবুও রাগকে আংশিক সামলে সে ক্ষিপ্র গলায় বলল,,

“চাঁ…দ! তুমি কিন্তু অতিরিক্ত করছ। মুখে লাগাম লাগাও বলছি!”

“আরে রাখুন তো আপনার লাগাম। যা বলছি আপনার ভালোর জন্যই বলছি। আপনি জানেন? রাস্তায় যেসব ছেলেরা ই’য়ে করে তাদের যে ই’য়েতে ইনফেকশন হয়? আমি এমন অনেক দেখেছি এবং শুনেছিও। রাস্তায় ই’য়ে করতে এসে যুবকের গো’পন অঙ্গে ইনফেকশন হয়েছে!”

নূর তাজ্জব দৃষ্টিতে পিছু ফিরে চাঁদের দিকে তাকালো! কাঁদো কাঁদো মুখে বলল,,

“আমার শনি? কোথায় শুনেছ এসব?”

“কোথায় শুনেছি মানে? ফেসবুকে দেখেছি! সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন খবরের পেজের হ্যাডলাইনে দেখেছি! প্রথম লাইনে খুব বড় বড় করে এসব নিউজ লেখা থাকে। তবে লজ্জায় ভেতরে যাওয়া হয় না!”

নূর সাংঘাতিক ক্ষেপে বসল। কপালের ভাজে কয়েক দফা রাগ ফুটিয়ে তুলল। নিজেই নিজের কপাল চাপড়ে বিষাদময় গলায় বলল,,

“ভাই মা’রো, মুঝে মা’রো!”

চাঁদ উদগ্রীব হয়ে উঠল। চিন্তিত গলায় বলল,,

“বালাইষাট! আমি আপনাকে মা’রতে যাব কেন নূর ভাইয়া? আমার চৌদ্দ গোষ্ঠীতেও কেউ কখনো কাউকে মা’রে নি। আমার পার্শ্ববর্তী এলাকাতেও এমন দুর্ঘটনা ঘটে নি। তো আমি আপনাকে মে’রে নিজে ম’রব নাকি?”

নূর এবার প্রচণ্ড ক্ষেপে বাইক থেকে নামল! রাগান্বিত ভঙ্গিতে চাঁদের মুখোমুখি দাঁড়ালো। দাঁতে দাঁত চেপে চাঁদের দিকে কঠিন প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“তুমি এবার মুখে লাগাম দিবে কি-না বলো? চুপচাপ এবং শান্ত-শিষ্ট মেয়েদের মতো থাকতে পারবে কি-না বলো? আনসার শুধু হ্যাঁ বা না তে দিবে? একটাও এক্সট্রা কথা নয়। শুধু হ্যাঁ বা না।”

চাঁদ ফ্যালফ্যাল চাহনিতে নূরের দিকে তাকালো। ঢোক গিলে ধীর গলায় বলল,,

“যদি উত্তরটা ‘না’ হয় তখন কী করবেন নূর ভাইয়া?”

“এখানেই তোমাকে একা ফেলে চলে যাব! ভয়ে তখন ম’রবে তুমি। চো’র, ডা’কাত, ছি’নতাইকারী এবং সন্ত্রা’সদের কবলে পড়বে। খারাপ লোকেদের নজরে পড়বে। আর এটাই হবে তোমার জন্য চরম শা’স্তি।”

চাঁদ ভয়ে ঘাবড়ে উঠল। মিনমিনে চাহনিতে নূরের দিকে তাকালো। ঠোঁটের মধ্যখানে আঙুল চেপে অস্ফুটে গলায় বলল,,

“ঠিক আছে নূর ভাইয়া। আমি আর কথা বলব না। একদম চুপচাপ এবং শান্ত-শিষ্ট মেয়ে হয়ে থাকব।”

“মনে থাকবে তো?”

“থাকবে।”

“যদি ভুলে যাও?”

“তখন আপনি আবার মনে করিয়ে দিবেন।”

“সরি টু সে। দ্বিতীয়বার কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না!”

“একটু কনসিডার করুন না! আপনি তো জানেন-ই আমি একটু বাচাল প্রকৃতির!”

নূর তেজী শ্বাস ছাড়ল! চাঁদের সাথে অহেতুক কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে ওঠে বসল। আহত মনে বাইক ছেড়ে দিলো। চাঁদ আবারও নূরের কাঁধে হাত রাখল। নিজেকে যথেষ্ট চুপচাপ রাখার চেষ্টায় রইল। আশপাশে তাকিয়ে রাতের কলবরপূর্ণ পরিবেশকে উপভোগ করতে লাগল।

কিছুসময় এভাবে নিস্তব্ধতায় কাটিয়ে দেওয়ার পর চাঁদ হঠাৎ একটি বিশাল সাততলা বাড়ির সামনে একটি ভেলপুরির ভ্যান দেখতে পেল! অনেক ছেলে-মেয়েদের ভীড় সেখানে। তারা সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের মতো আড্ডা দিচ্ছে এবং সেই আড্ডাকে জমিয়ে রাখার জন্য ভেলপুরি খাচ্ছে! এই লোভনীয় দৃশ্য দেখামাত্রই চাঁদের জিভে জল লকলক করে উঠল! আর এক মুহূর্তও ব্যয় করল না চাঁদ। অতি উত্তেজিত হয়ে উচ্চ আওয়াজে নূরকে ডেকে বলল,,

“নূর ভাইয়া নূর ভাইয়া। প্লিজ বাইকটা এখানে থামান। আমি ভেলপুরি খাব! ঐ যে দেখুন ঐখানে ভেলপুরি।”

বাইকে চলন্ত অবস্থায় নূর ঘাড় ঘুরিয়ে ভেলপুরির ভ্যানটির দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে সাততলা বাড়িটির দিকেও তাকালো। অমনি নূর ভ্রু কুঁচকে নিলো! বিড়বিড় করে বলল,,

“যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়! রোজের ফ্ল্যাটের সামনেই এই ভূমিকম্পের ভেলপুরি খেতে ইচ্ছে হলো? এখন কোনোভাবে যদি রোজ আমার সাথে এই মেয়েকে দেখে ফেলে তখন? তখন তো রোজ আমাকে অযথা সন্দেহ করবে!”

নূর বাইক থামাতে না চাইলেও চাঁদ জোর করে নূরকে বাইক থামাতে বলল। তাছাড়া চাঁদ যেভাবে রাস্তার মাঝখানে চ্যাঁচাম্যাচি করছিল রাস্তা ঘাটের লোকজন নূরকে অন্যকিছু ভাবতে শুরু করছিল! তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই নূরকে বাইকটি থামাতে হলো। বাইকটি রাস্তার পাশ ঘেঁষে দাঁড় করাতেই চাঁদ ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বাইক থেকে নেমে পড়ল। বাইকে বসে থাকা নূরকে টানতে টানতে ভেলপুরির ভ্যানটির দিকে নিয়ে এলো। এইদিকে বেচারা নূর না পারছে চাঁদকে কিছু বলতে না পারছে এখান থেকে দৌঁড়ে পালাতে! উভয় সংকটে ফেঁসে গেছে বেচারা! শুধু নিজেকে বকছে আর এই বিপদ থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহ্ আল্লাহ্ করছে!

নূরকে নিয়ে চাঁদ ভীড় ঠেলে ভেলপুরির ভ্যানটির সামনে দাঁড়ালো! খুশিতে হাসতে হাসতে সে ভেলপুরি মামাকে বলল,,

“মামা দুই প্লেট ভেলপুরি দিবেন প্লিজ। সাথে মিষ্টি টক এবং ঝাল টক মিক্স। বেশি করে সালাদ দিবেন কেমন?”

ভেলপুরি মামা মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালো। চাঁদ এবার কিছুটা শান্ত হলো। পাশ ফিরে নূরের দিকে তাকালো। বেচারা নূর শার্ট দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে! মহিলা মানুষদের মতো নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে। চাঁদ অবাক হলো। ভ্রু যুগল সরু করে নূরের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,

“কী হয়েছে নূর ভাইয়া? আপনি এভাবে শার্ট দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছেন কেন?”

মিনমিনে গলায় নূর দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“চুপ করো চুপ করো। একদম আমার নাম ধরে ডাকবে না এখানে!”

“কেন নূর ভাইয়া? কী হয়েছে?”

“বলেছি না নাম ধরে না ডাকতে?”

“কারণটা কী বলবেন তো? কে আছে এখানে?কাকে ভয় পাচ্ছেন আপনি?”

“আমার য’ম আছে এখানে! আমার য’ম। তাকে ভয় পাচ্ছি আমি!”

“য’ম? য’ম আবার কে?”

এর মধ্যেই পাশ থেকে একটি মেয়ে ভেলপুরি মুখে দিয়ে নূর এবং চাঁদের মুখোমুখি দাঁড়ালো! সন্দিহান গলায় নূরের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“এই তুমি নূর না?”

নূরের গাঁ বেয়ে ঘাম ঝড়তে শুরু করল! গলার স্বর শুনে বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলো না মেয়েটি আর কেউ নয় রোজের বেস্ট ফ্রেন্ড নিহা! তারা দুজনে একই ফ্ল্যাটে থাকে। এভাবে আর নিজেকে লুকিয়ে রাখা যাবে না। পরিস্থিতি এতে হয়তো হীতে বিপরীত হতে পারে। তাই তৎক্ষণাৎ নূর মুখের উপর থেকে শার্টটি সরিয়ে নিলো! অস্থির দৃষ্টিতে নিহার দিকে তাকালো! শুকনো ঢোক গিলে যেই না নিহাকে কিছু বলতে গেল অমনি চাঁদ নূরের হাতটি আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরল! নিহার দিকে তাকিয়ে তটস্থ গলায় বলল,,

“হ্যাঁ নূর। তো কী হয়েছে হুম? আপনি এভাবে সন্দেহের দৃষ্টিতে নূর ভাইয়ার দিকে তাকাচ্ছেন কেন? কী করেছে নূর ভাইয়া?”

চাঁদের কথায় কোনো রূপ ভ্রুক্ষেপ না করে নূর যেই না মিষ্টি হেসে নেহাকে কিছু বলতে যাবে অমনি নেহা বিদ্রুপাত্নক হাসি হাসল! চাঁদ এবং নূরের মিলিয়ে রাখা হাতটির দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকালো। নূরের সামনে থেকে যেতে যেতে বলল,

“এজন্যই তুমি রোজের কল রিসিভ করছিলে না! আর ঐদিকে বেচারি রোজ ভাবছিল তুমি হয়তো কোনো কাজে ব্যস্ত আছো! পৃথিবীতে কেউ ভালো না। সবাই ফেইক।”
#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_৮ (বোনাস পর্ব)
#নিশাত_জাহান_নিশি

“এজন্যই তুমি রোজের কল রিসিভ করছিলে না! আর ঐদিকে বেচারি রোজ ভাবছিল তুমি হয়তো কোনো কাজে ব্যস্ত আছো! পৃথিবীতে কেউ ভালো না। সবাই ফেইক।”

নিহা জায়গা পরিত্যাগ করার পূর্বেই নূর খপ করে চাঁদের হাতটি চেপে ধরল! চাঁদকে নিয়ে হেঁটে সোজা নিহার মুখোমুখি দাঁড়ালো। নমনীয় গলায় নিহাকে বলল,,

“তুমি ভুল বুঝছ নিহা। এই যে মেয়েটিকে দেখছ সে আমার কাজিন। ঢাকায় নতুন এসেছে। তাই তাকে নিয়ে একটু ঘুরতে বের হয়েছিলাম। আর এর মাঝেই তুমি আমাদের দেখে নিলে। প্লিজ কিছু না জেনে শুনে অযথা আমার চরিত্র সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করো না। বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবে নেওয়ার চেষ্টা করো।”

নিহা কদাচিৎ হাসল! অবিশ্বাস্য গলায় বলল,,

“দেখে তো মনে হচ্ছে না তোমরা কাজিন। যেভাবে এখনো মেয়েটার হাত ধরে আছো!”

তাৎক্ষণিক চাঁদ নূরের হাতটি ছেড়ে দিলো! ব্যথীত দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। নূরের রাগী দৃষ্টি চাঁদের কাতর দৃষ্টিতে সীমাবদ্ধ। চাঁদ নিজের কাজে ভীষণ অনুতপ্ত হলো। ছোটো খাটো একটা আঘাতও পেল। তবে সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। জিজ্ঞাসু গলায় নিহাকে বলল,,

“আপু আপনি কী রোজ ভাবীর কোনো ফ্রেন্ড বা আত্নীয় হোন?”

নিহা গম্ভীর গলায় বলল,,

“ফ্রেন্ড হই। কেন?”

চাঁদ গলার স্বর নরম করল! মিষ্টি হেসে বলল,,

“কিছু মনে করবেন না আপু। আমি সত্যিই নূর ভাইয়ার কাজিন। গতকাল মাত্র ঢাকায় এসেছি আমি। আর আজই ভাইয়ার কাছে বায়না ধরলাম আমাকে নিয়ে একটু ঘুরতে বের হতে। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই উনি আমাকে নিয়ে বের হলেন। দয়া করে আপনি আমার ভুলের জন্য নূর ভাইয়াকে অযথা ভুল বুঝবেন না।”

নিহা এখনো সন্দেহজনক দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল। তার বর্তমান ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হলো সে চাঁদের কথা বিন্দু পরিমানও বিশ্বাস করছে না! অন্যদিকে নূর হতাশায় মাথা হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাগে-জেদে-ক্ষোভে এক প্রকার ফোঁস ফোঁস করছে। চাঁদ এবার ঘাবড়ে গেল। কীভাবে পরিস্থিতি সামলাবে তাই ভাবতে লাগল। আবারও সে মিষ্টি হাসল। নিহার ডান হাতটি মোলায়েম ভাবে চেপে ধরে বলল,,

“আপু আপনি জানেন? নূর ভাইয়া রোজ ভাবিকে ঠিক কতটা ভালোবাসেন? আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না নূর ভাইয়া রোজ ভাবির জন্য কতটা পাগল। হাঁটতে, বসতে, খেতে, যেতে, ঘুমাতে, ওয়াশরুমে যেতে সারাক্ষণ রোজ ভাবির না
জপ করে! মাত্র দু-একদিনে এসেই আমি বুঝে গেছি নূর ভাইয়া মন থেকে রোজ ভাবিকে ঠিক কতখানি চায়! এরপরেও আপনি আমার উপর বা নূর ভাইয়ার উপর কোনো সন্দেহ পুষে রাখবেন না আপু। বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবে নিবেন।”

নিহা ভ্রু কুঁচকালো। চাঁদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“তোমার নামটা যেন কী?”

“জি চাঁদ। পুরো নাম নাহিমা আহমেদ চাঁদনী।”

“তো চাঁদ? তুমি কী এখন কথাগুলো রোজের সামনেও বলতে পারবে?”

“কেন নয় আপু? অবশ্যই পারব। সত্য কথা আমি একবার নয় বরং বার বার বলতে পারব। তাছাড়া ভাবির সাথে দেখা করার ভীষণ ইচ্ছে আমার। প্লিজ ভাবিকে একবার এখানে ডেকে দিবেন?”

নিহা এবার নূরের দিকে তাকালো। শক্ত গলায় নূরের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“কী নূর? রোজকে ডেকে দিব?”

নূর মলিন হাসল। স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বলল,,

“কেন নয়? ডেকে দাও। সেই সুযোগে আমাদের দেখটাও হয়ে যাবে। সারাদিন তাকে দেখলেও আমার মন ভরবে না!”

নিহা আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। বাড়ির মেইন গেইটের ভেতর ঢুকে পড়ল। চাঁদ আহত দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। মাথা নুইয়ে বলল,,

“সরি নূর ভাইয়া। আমি আসলে বুঝতে পারি নি মেয়েটি ভাবির কোনো ফ্রেন্ড হবে। জানলে হয়তো তখন ঐভাবে আপনার হাতটা ধরতাম না। আগ বাড়িয়ে আপুটার সাথে কথাও বাড়াতাম না। কিংবা উনার সাথে খারাপ আচরণও করতাম না। আসলে আমি ঐ সময় ভেলপুরি দেখে খুব বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। তাই হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে আপনার হাত ধরে ফেলেছিলাম। এর জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত নূর ভাইয়া।”

“চুপ থাকো৷ একদম চুপ থাকো। এভাবে অনেক সম্পর্ক ভাঙার অভ্যেস আছে তোমার! সেদিন তো তুমি নিজের মুখেই বলেছিলে তোমার সব ফ্রেন্ডদের প্রেমের সম্পর্ক তুমি এভাবেই ভেঙে দিয়েছে! এখন আমার সম্পর্কটাও তুমি ভেঙে দিতে ওঠে পড়ে লেগেছ। আর যদি এটা সত্যিই হয় না চাঁদ? আমি কিন্তু তোমাকে আস্ত ছাড়ব না। এর ফল তোমাকে ভোগ করতেই হবে। খুব কঠিনভাবে ভোগ করতে হবে।”

“আমি সত্যিই এতকিছু বুঝতে পারি নি নূর ভাইয়া। প্লিজ আমার কথাটা বিশ্বাস করুন!”

“আমি তোমার অভিনয় বুঝতে পারি বুঝলে? আমার সামনে ভালো সাজার নাটক একদম করবে না!”

চাঁদ মাথা উঁচু করে নূরের দিকে তাকালো! চোখের কোণায় ভাসমান অশ্রুবিন্দু তার! চোখে জল এবং মুখে হাসি নিয়ে সে নূরের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“যদি কখনো ইচ্ছে হয় তবে আমার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবেন। তখন হয়তোবা বুঝতে পারবেন আমি মানুষকে যতোটা দেখাই বা বুঝাই আমি ভেতর থেকে ততোটাও খারাপ কিংবা নিচু মনের নই! আমার ভেতরটা কেমন তা শুধু আমি-ই জানি! তা অন্য কারোর জানার কথা নয়।”

নূর চটকে গেল। তিরিক্ষিপূর্ণ বলল,,

“আবারও নাটক করছ তাই না? আমার সেমপ্যাথি আদায়ের চেষ্টা করছ?”

“আমি সিরিয়াস ভাইয়া! এই ভাঙা-গড়ার বিষয়গুলোতে আমি খুব সিরিয়াস। জায়গা বুঝে কীভাবে নিজের অবাধ্যতাকে গুটিয়ে নিতে হয় আমার খুব ভালোভাবেই জানা আছে।”

তৎপর দৃষ্টিতে নূর চাঁদের ব্যথীত দৃষ্টিতে তাকালো! সত্যিই চাঁদকে খুব সিরিয়াস দেখাচ্ছে। এর আগে কখনো নূর চাঁদকে এতটা সিরিয়াস ভঙ্গিতে দেখে নি। যা এই মুহূর্তে এসে দেখছে। নূর ভ্রু কুঁচকে নিলো। সন্দিহান দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“তাহলে ঐদিন যে বলছিলে তুমি তোমার ফ্রেন্ডদের সব ব্রেকাপ করিয়েছ এসব বলার মানে কী?”

“আপনাকে ভয় দেখানোর জন্য বলেছিলাম। বলতে পারেন মজার ছলে! তবে এখন আমি সিরিয়াস নূর ভাইয়া। সো সিরিয়াস!”

এরমধ্যেই তাদের মাঝখানে রোজের আগমন ঘটল! অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারিণী রোজকে দেখা মাত্রই চাঁদ মুখটা হা করে নিলো। ড্যাব ড্যাব চাহনিতে রোজের দেহের সবচেয়ে মূল আকর্ষণ দীর্ঘলম্বা চুলগুলোর দিকে তাকালো! নূর মুগ্ধ চাহনিতে রোজকে দেখছে। এক প্রকার নিষ্পলক দৃষ্টিতে। দৃষ্টি যেন তার কিছুতেই সরছে না। রোজ প্রথমে বাঁকা চাহনিতে চাঁদের দিকে তাকালো। ভ্রু যুগল সরু করে পরমুহূর্তে নূরের দিকে তাকালো। বিস্মিত গলায় নূরকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“তুমি এখানে?”

নূর মৃদু হাসল। রোজের দিকে অনেকখানি এগিয়ে এসে বলল,,

“তোমাকে দেখতে এলাম!”

রোজ হাসল। লজ্জায় টুকটুকে লাল হয়ে গেল। চোখ ঘুরিয়ে সে চাঁদের দিকে তাকালো। রুক্ষ গলায় বলল,,

“মেয়েটি কী নূর? নিহা বলছিল তুমি কোনো মেয়ের সাথে এসেছ।”

নূর ঘাবড়ে উঠে কিছু বলার পূর্বেই চাঁদ স্মিত হেসে রোজের মুখোমুখি দাঁড়ালো। আকস্মিকভাবে সে রোজকে জড়িয়ে ধরল। আহ্লাদী গলায় বলল,,

“আমি শুধু মেয়ে নই ভাবি! আপনার ননদও! আপনার সাথে দেখা করতেই এখানে এসেছি। সত্যি বলব ভাবি? আপনি দেখতে না খু্ব কিউট। চেহারাটা কেমন যেন বাচ্চা বাচ্চা টাইপ। খুব ভালোবাসায় মোড়ানো। এজন্যই নূর ভাইয়া আপনার জন্য এতটা পাগল!”

রোজা এই পরিস্থিতিতে কী করবে বুঝে উঠে পারছিল না! তাই সে অসহায় ভঙ্গিতে নূরের দিকে তাকালো। নূর ইশারায় বলল,,

“আমার কাজিন। জড়িয়ে ধরতে পারো।”

রোজ আর সংকোচবোধ করল না। সেও একইভাবে চাঁদকে জড়িয়ে ধরল। মিষ্টি হেসে বলল,,

“তুমি নূরের কাজিন হও?”

“জি ভাবি। আপনার সাথে দেখা হয়ে খুব ভালো লাগল। আপনি যেমন খুব মিষ্টি একটা মেয়ে দেখদে আপনার নামটাও খুব মিষ্টি। সাথে আপনার চুলগুলোও।”

রোজকে ছেড়ে দিল চাঁদ। সংকোচবোধ নিয়ে রোজের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আপনি আবার মাইন্ড করেন নি তো ভাবি? আপনাকে হঠাৎ এভাবে জড়িয়ে ধরাতে? আসলে আমার যাকে খুব বেশি পছন্দ হয় তাকে প্রথম দেখাতেই আমার খুব আপন মনে হয়। আমার হিতাহিতজ্ঞান খুব কম বললেই চলে। যার কারণে বাড়িতে প্রতি বেলায় আম্মুর কাছ থেকে বকা শুনতে হয়।”

“এতো কিউট একটা মেয়েকে কেউ বকতে পারে চাঁদ? সত্যি বলতে তুমিও খুব মিষ্টি চাঁদ। ঠিক নূরের মতো মিষ্টি। আচ্ছা তোমাদের ফ্যামিলির কী সবাই দেখতে এমন কিউট?”

চাঁদ ফিক করে হেসে দিলো! হাসতে হাসতে বলল,,

“উঁহু। আমরা সবাই নূর ভাইয়া এবং তোমার মতো এত কিউট নাহ্!”

নূর খানিক ব্লাশ করল! পেছনের চুল গুলো টেনে রোজকে উদ্দেশ্য করে বলল,,

“আমরা কী এখানে দাঁড়িয়েই কথা বলব রোজ? আশেপাশে কোথাও বসব না?”

রোজ জিভ কাটল। ব্যস্ত গলায় বলল,,

“না নূর। এখন হবে না। বাড়িতে আমার অনেক কাজ পড়ে আছে। আমরা না হয় অন্য একদিন রেস্টুরেন্ট বা অন্য কোথায় বসব। মন খুলে আড্ডা দিব। পরের বার কিন্তু তুমি আসার সময় এই দুষ্টু মিষ্টি চাঁদকেও সাথে করে নিয়ে আসবে!”

বিষন্ন মনে নূর মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। নারাজ থাকা সত্ত্বেও রোজের থেকে বিদায় নিয়ে নূর এবং চাঁদ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। বাইকের উঠার পরেও নূর ঘাড় বাঁকিয়ে রোজকে দেখছিল! তবে সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হলো বাইকে উঠার পর থেকেই চাঁদ খুব চুপচাপ হয়ে গেল! সেইফটির জন্য নূরের কাঁধে পর্যন্ত হাত রাখল না। অন্যদিকে নূর একধ্যানে বাইক চালাতে লাগল। রোজের স্নিগ্ধ মুখটি ভাবতে লাগল। আনমনেই মুচকি হেসে উঠল। চাঁদের হঠাৎ চুপচাপ হয়ে যাওয়ার পেছনেও তার কোনো ভাবান্তর হলো না! কিছুদূর যাওয়ার পর নূর হঠাৎ চাঁদের দিকে মনযোগ দিলো। ব্যগ্র গলায় বলল,,

“ওহ্ শীট! তোমার ভেলপুরি তো খাওয়া হলো না!”

চাঁদ মলিন হাসল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,,

“কোনো সমস্যা নেই নূর ভাইয়া। আমার পেট ভরে গেছে!”

“কিছুই তো খেলে না। পেট ভরল কীভাবে?”

“গাড়ি ড্রাইভ করার সময় কথা বলতে নেই নূর ভাইয়া! আপনি প্লিজ মনযোগ দিয়ে গাড়িটা চালান!”

চাঁদের আকস্মিক পরিবর্তন দেখে নূর খুব অবাক হলো! তবে তা প্রকাশ করল না৷ আপন মনে বাইক চালাতে লাগল। নির্দিষ্ট সময় পর বাড়ির মেইন গেইটের কাছে পৌঁছে যেতেই চাঁদ খুব দ্রুত বাইক থেকে নেমে পড়ল। মাথা নুইয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। নূরও বাইকটি বাড়ির পার্কিং এরিয়ায় পার্ক করে বাড়ির সদর দরজার দিকে অগ্রসর হলো। এরমধ্যেই চাঁদ ভেজানো সদর দরজাটি খুলে বাড়ির ড্রয়িংরুমে চলে এলো। ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই শুনতে পেল সাবরিনা আবরার এবং হাবিব আবরার খুব হেসে হেসে বলছেন দু’একদিনের মধ্যেই “মাহিন” দেশে ফিরছে! নীড়ের বিয়ে এটেন্ড করতে! চাঁদ সেদিকে মনযোগ দিলো না। সোজা হেঁটে নিজের রুমে চলে গেল! অন্যদিকে নূর খুশিতে আত্মহারা প্রায়! কারণ দীর্ঘ পাঁচ বছর পর তার আরও এক ভাই দেশে ফিরছে। তাও আবার তার বড় ভাইয়ার বিয়েতে!

চাঁদ রুমে ঢুকে সোহানীকে কোথাও দেখতে পেল না। বিষন্ন মনে চাঁদ তার সেলফোনটি নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালো! অজান্তেই চোখের জল ছেড়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল! কাঁদতে কাঁদতে তার ফুফাতো ভাই “আয়মনের” নাম্বারে ডায়াল করল। প্রায় দু’বার রিং বাজতেই ঐপাশ থেকে আয়মন ব্যস্ত ভঙ্গিতে কলটি রিসিভ করল। মিহি গলায় বলল,,

“হ্যালো।”

চাঁদ হেচকি তুলে কেঁদে উঠল! অস্পষ্ট গলায় বলল,,

“ভাইয়া তুমি কবে আসবে?”

আয়মন অস্থির হয়ে উঠল! ঘাটতে থাকা ফাইলটি হাত থেকে নামিয়ে নিলো। উদ্বিগ্ন গলায় বলল,,

“তুই কাঁদছিস কেন চাঁদ? কী হয়েছে?”

“তোমাকে খুব মিস করছি ভাইয়া। আসলে তোমার মতো করে কেউ আমাকে বুঝে না ভাইয়া! তোমার মতো করে আমাকে কেউ তার আপনও ভাবে না।”

“হয়েছেটা কী বলবি তো?”

“কিছু না ভাইয়া। তোমাকে খুব মিস করছি।”

“সোহানী বকেছে তোকে? আন্টি, আঙ্কেল? নূর? অথবা নীড় ভাইয়া?”

“কেউ বকে নি আমাকে ভাইয়া। তবে তোমার কথা খুব মনে পড়ছে। রক্তের টান আলাদা হয় ভাইয়া! রক্ত যেভাবে রক্তকে বুঝে অন্যরা সেভাবে বুঝে না।”

“তুই কী নীড় ভাইয়া বা নূরের কথা বলছিস? মানে ওরা তোকে কোনো কারণে হার্ট করেছে?”

“তোমার মতো ভাইয়া পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার জানো? কারণ, তুমি আমাকে খুব বুঝো। ছোটবেলা থেকে আমাকে পরিচালনা করে আসছ। আমার সমস্ত অবাধ্যতার কারণগুলো বুঝার চেষ্টা করো। আমার সব কথা বা দুষ্টুমি তুমি সিরিয়াসলি কখন-ই নিতে পারো না। সবসময় আমাকে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে আসছ। বাকিরা এত আপন না ভাইয়া। আমার দুষ্টুমিও তারা বুঝে না! আমার সব কথাই তারা সিরিয়াসলি নেয়! ভাবে আমি খুব খারাপ। আমি তাদের সম্পর্ক ভাঙার চেষ্টা করি। অথচ ওরা এটা জানে না আমি একটা সম্পর্ক জোড়ার জন্য ঠিক কতখানি সেক্রিফাউজ করতে পারি। আমার ফ্রেন্ডকে পর্যন্ত বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য সাহায্য করেছিলাম!”

#চলবে…?

(আসসালামু আলাইকুম সবাইকে। একটি বিশেষ কারণে নোটটি লিখা। কারণটি হলো আগামী ২৭ ও ২৮ তারিখ আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ দুইটা পরীক্ষা রয়েছে। যার কারণে আমি আগামী চার থেকে পাঁচদিন গল্পটির নতুন পর্ব দিতে পারব না। আশা করি আপনারা আমার সমস্যাটি বুঝবেন। ধন্যবাদ সবাইকে।)
#চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here