প্রেমময়ী তুমি পর্ব -০৫+৬

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_৫
#নিশাত_জাহান_নিশি

“এসব কী হচ্ছে নূর? মেয়েটি কে?”

তৎক্ষনাৎ নূর ভাইয়া আমার মুখের উপর থেকে হাতটি সরিয়ে নিলেন। কিছু হয়নি এমন ভাব নিয়ে ভদ্র ছেলেদের মতো দাঁড়িয়ে পড়লেন! আমি তাজ্জব দৃষ্টিতে নূর ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছি। হঠাৎ কী এমন হলো উনার? দেখে তো মনে হচ্ছে ভীষণ ভয় পেয়ে আছেন উনি! ঐ ছেলেটিকে এত ভয় পাওয়ার কী আছে আজব! মুহূর্তের মধ্যেই জোরপূর্বক হেসে উনি পেছনের চুলগুলো টেনে সেই অপরিচিত ছেলেটির দিকে অগ্রসর হলেন! সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি এক দৃষ্টিতে এখনও আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে! ভীষণ জড়তা কাজ করছিল আমার। তাই আমি সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেটির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম! মাথা নুইয়ে সোজা দাঁড়িয়ে পড়লাম। এর মধ্যেই নূর ভাইয়ার গলার স্বর শুনতে পেলাম। উনি বেশ নমনীয় গলায় ছেলেটিকে শুধাচ্ছেন,,

“হেই সাদমান। তুই এত সকালে আমার বাড়িতে?”

ছেলেটি দুর্বল গলায় বলল,,

“রোজ পাঠিয়েছে!”

গলার আওয়াজ কমিয়ে নিলেন নূর ভাইয়া! দাঁতে দাঁত চেপে নিম্ন আওয়াজে বললেন,,

“আস্তে কথা বল আস্তে!”

“আস্তে কথা বলব কেন?”

“দেখছিস না পেছনে ঐ হ্যাংলা মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে?”

“মেয়েটি কে?”

“পরে বলছি। আগে বল, রোজ হঠাৎ তোকে পাঠাতে গেল কেন?”

ছেলেটি লাগামহীন গলায় বলল,,

“কেন আবার? তুই সবসময় ঘুম থেকে উঠতে দেরি করিস তাই! সবসময় রোজকেই তোর জন্য অপেক্ষা করতে হয়। তাই এবার আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হলো!”

বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলো না এই রোজই হলো নূর ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড! আজ হয়তো তাদের দেখা করার কথা! আর সেই বিষয়টিকেই এড়িয়ে যাওয়ার জন্য নূর ভাইয়া নিচু গলায় কথা বলছেন! ভয়ে ঘাবড়ে আছেন! হয়তো ভাবছেন আমি কিছু শুনে ফেলব। খালামনিকে সব বলে দিব! আমিও কিন্তু কম যাই না! ভীতু মানুষদের ভয় দেখাতে এক পৈশাচিক আনন্দ পাই আমি। তাদের দুর্বল জায়গা নিয়ে খেলতেও বেশ পছন্দ করি! এবার কেউ যদি বলে এটা আমার খারাপ স্বভাব। হ্যাঁ, তো আমি খারাপ! পাছে লোকজনের কটু কথার চুল পরিমান ধাঁর ধারি না আমি! তাছাড়া একটু আগেই উনি আমাকে হ্যাংলা বলে অ্যাখায়িত করেছেন। তো এবার তো আরও বেশি বেশি করে হ্যাংলামিগিরি দেখাতে হবে! শীঘ্রই মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এঁটে আমি দ্রুত পায়ে হেঁটে তাদের মুখোমুখি দাঁড়ালাম। ঠোঁট চেপে হেসে অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নূর ভাইয়ার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,

“তো ভাইয়া, রোজ বুঝি আপনার গার্লফ্রেন্ড? তার সাথেই আজ আপনার দেখা করার কথা?”

ভড়কে উঠলেন নূর ভাইয়া! ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমতা আমতা গলায় বললেন,,

“কেকেকে রোজ? কাকার সাথে দেদেখা করার কথা?”

সামনে থাকা ছেলেটি ভীষণ অবাক হয়ে নূর ভাইয়ার মুখ থেকে কথা টেনে নিলেন! কোমড়ে দু’হাত রেখে উনি ভ্রু যুগল খড়তড়ভাবে কুঁচকে নূর ভাইয়ার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“রোজ কে মানে? তুই চিনিস না রোজকে?”

শুকনো ঢোক গিলে নূর ভাইয়া আমার দিকে তাকালেন। গলা খাঁকিয়ে ছেলেটির প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে তেজী গলায় বললেন,,

“এই তুমি এখানে কী করছ হ্যাঁ? যাও নিজের রুমে যাও। দেখছ না? এখানে আমি এবং আমার ফ্রেন্ড দাঁড়িয়ে আছি? গুরুজনদের মাঝখানে তোমার কী হ্যাঁ?”

ভ্রু যুগল কুঁচকে আমি রাগে ফোঁস করে নূর ভাইয়ার দিকে তাকালাম। সঙ্গে সঙ্গেই উনি প্রচুর ক্ষেপে বললেন,,

“ফোঁস করে লাভ নেই। যাও নিজের রুমে যাও!”

“ওকে। তাহলে আমিও এখন খালামনির রুমে যাচ্ছি! খালামনির সাথে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে৷ যা এখন না বললেই নয়!”

মিটিমিটি হেসে আমি পিছু ঘুরতেই নূর ভাইয়া দৌঁড়ে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়লেন! কোমড়ে এক হাত রেখে অন্য হাত দিয়ে কপাল ঘঁষতে আরম্ভ করলেন! রক্তিম মুখের আদল দেখেই বুঝা যাচ্ছে প্রচণ্ড রেগে গেছেন উনি! কিন্তু এই মুহূর্তে কী করতে পারি আমি? আমার যে লোকজনদের রাগাতে খুব ভালো লাগে! তাদের জ্বালাতেও প্রচুর আনন্দ পাই। কপাল থেকে হাত সরিয়ে নিলেন নূর ভাইয়া। রাগকে শান্ত করার মিথ্যে ভঙ্গি নিয়ে আমার দিকে খানিক ঝুঁকে এলেন। স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন,,

“কী চাও তুমি আমার কাছ থেকে বলো? কী করলে তুমি আমার মা’কে কিছু বলবে না?”

“আমি যা চাই তা আপনি রাখবেন তো?”

“কী চাও বলো?”

“আমি যদি বলি আপনি আজ কোথাও যাবেন না তবে?”

“হোয়াট? আমি আজ কোথাও যাব না মানে?”

“যাবেন না মানে আজ আপনি বাড়ি থেকে কোথাও বের হবেন না! আজ আমি আপনার সাথে পুরো ঢাকা শহরটা ঘুরে দেখতে চাই!”

“আর ইউ ক্রেজি চাঁদ? ইউ নো হোয়াট? আজ আমাদের রিলেশনশিপের এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে? আজ আমার লাইফের সবচেয়ে স্পেশাল একটা দিন! আর তুমি বলছ আজ আমাকে বের না হতে?

“বের হওয়াটা কী খুব জরুরি নূর ভাইয়া?”

রাগ শান্ত হয়ে এলো নূর ভাইয়ার! চোখে-মুখে প্রখর আনন্দের ছাপ। দেখেই বুঝা যাচ্ছে আজ দিনটার জন্য উনি বেশ এক্সাইটেড। যেকোনো প্রকারেই হোক আজ উনাকে বের হতেই হবে। কারো বাঁধা উনি মানবেন না আজ। কিছু ভেবে মৃদু হাসলেন উনি। প্রত্যত্তুরে বললেন,,

“হ্যাঁ! ভীষণ জরুরি। আজ আমাকে যেতেই হবে। যেতে হবে মানে যেতেই হবে!”

মায়া জন্ম নিলো আমার! এমন ভালোবাসা দেখে কার-ই বা মায়া জন্মাবে না? আর রাগাতে ইচ্ছে হলো না লোকটিকে! মন থেকে তাকে ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হলো৷ গলা খাঁকিয়ে নিলাম আমি। শান্ত গলায় শুধালাম,,

“ফিরবেন কখন?”

“সন্ধ্যা তো হবেই।”

তৎক্ষনাৎ আমি আবদার সূচক গলায় বললাম,,

“তাহলে সন্ধ্যার পর আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হবেন প্লিজ?”

তেজী শ্বাস ছাড়লেন নূর ভাইয়া! বিরক্তিমাখা গলায় দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,,

“ওকে। তবে শর্ত আছে।”

“আমি জানি কী শর্ত! ট্রাস্ট মি, খালামনিকে আমি কিছু বলব না। ঘুরে আসুন।”

নূর ভাইয়ার পাশ কাটিয়ে আমি ডাইনিং রুমের দিকে অগ্রসর হলাম! ইতোমধ্যেই নূর ভাইয়ার বন্ধু উত্তেজিত গলায় নূর ভাইয়ার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“এই নূর তুই কিন্তু মেয়েটির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলি না!”

নূর ভাইয়া কিছু বলার পূর্বেই আমি সৌজ্যনতার খাতিরে ছেলেটির মুখোমুখি দাঁড়ালাম। ম্লান হেসে প্রত্যত্তুরে বললাম,,

“আমি চাঁদ। নূর ভাইয়ার কাজিন। আই মিন, খালাতো বোন। আর আপনি?”

ছেলেটি মৃদু হাসল! শার্টের কলার উঁচিয়ে আমার দিকে ডান হাতটি বাড়িয়ে দিলো। উৎফুল্ল গলায় বলল,,

“আমি সাদমান। নূরের বেস্ট ফ্রেন্ড। পরিচিত হয়ে ভীষণ ভালো লাগল। আর একটা কথা৷ আপনার মতো, আপনার নামটাও কিন্তু ভীষণ মিষ্টি!”

“থ্যাংকস ভাইয়া।”

ছেলেটি উনার বাড়িয়ে রাখা হাতটির দিকে ইঙ্গিত করে বাঁকা হেসে বললেন,,

“আগে কখনো এই বাড়িতে দেখি নি তোমাকে! এই প্রথম এলে বুঝি এই বাড়িতে?”

“জি। এই প্রথমই এই বাড়িতে আসা।”

জোরপূর্বক হেসে আমি ছেলেটির বাড়িয়ে রাখা হাতটির দিকে তাকালাম! দু’টানায় ভুগছিলাম ছেলেটির সাথে হেন্ডশেইক করব কি-না! হঠাৎ করে অপরিচিত কারো সঙ্গে হেন্ডশেইক করা যায় নাকি? এর মধ্যেই নূর ভাইয়া আমাদের দিকে হেঁটে এলেন! অপ্রত্যাশিতভাবেই উনি সাদমান ভাইয়ার হাতটি আমার সামনে থেকে সরিয়ে নিলেন! স্মিত হেসে সাদমান ভাইয়ার কাঁধে হাত রেখে ডাইনিং রুমের দিকে অগ্রসর হতে হতে বললেন,,

“থাক না সাদমান। চাঁদ যেহেতু হেন্ডশেইক করতে চাইছে না তো ছেড়ে দে। তাছাড়া এখন আমাদের হাতে একদদদম সময় নেই। ব্রেকফাস্ট করেই আমাদের দৌঁড়াতে হবে। তাছাড়া এই পাঁজি মেয়েটার সাথে হেন্ডশেইক করার মতোও কিছু নেই!”

সাদমান ভাইয়া এখনও ঘাড় ঘুরিয়ে সম্মোহিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছেন! আমি বড্ড অদ্ভুত দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকাচ্ছি। চেনা নেই জানা নেই প্রথম পরিচয়ে কেউ এতটা বেহায়া হতে পারে? এর মধ্যেই ডাইনিং রুম থেকে খালামনি এবং আপুর ডাক পড়ল। ব্রেকফাস্ট টেবিলে সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সামনে মন্থর গতিতে হাঁটতে থাকা নূর ভাইয়া এবং সাদমান ভাইয়াকে ঠেলে আমি এক ছুটে ডাইনিং রুমের দিকে রওনা হলাম! দু’জনকে পাশ থেকে এমন ধাক্কা দিয়েছি যে দু’জনই জায়গা থেকে সরে অনেকখানি দূরে ছিটকে পড়েছে! দু’জনই বেকুব ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকাতে বাধ্য হচ্ছে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আমি বাঁকা হেসে একটু পিছু ঘুরেও তাকালাম! সাদমান ভাইয়া তাজ্জব দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। অন্যদিকে নূর ভাইয়া চোয়াল শক্ত করে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন! ভেতরে ভেতরে যে আমাকে শাসাচ্ছেন বেশ বুঝতে পারছি আমি! এদিকে আমিও যেতে যেতে ভেংচি কেটে নূর ভাইয়াকে বললাম,,

“সন্ধ্যার আগে যদি বাসায় ফিরে না আসেন না? তবে কিন্তু আমি খালামনিকে সব বলে দিব!”

পিছু ফিরে আর তাকালাম না! মূলত সাহস পাচ্ছিলাম না তাকানোর। তবে কারোর হাসির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি আমি। সেই হাসি সাদমান ভাইয়ার বেশ বুঝতে পেরেছি আমি! এক দৌঁড়ে সোজা আমি ডাইনিং রুমে ঢুকে পড়লাম। খাবার টেবিলে আগে থেকেই বসে আছেন আংকেল, নীড় ভাইয়া, আপু এবং খালামনি। সবাই খাবার সামনে রেখে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। খাবার টেবিলের কাছে আমাকে দেখামাত্রই আংকেল মৃদু হেসে বললেন,,

“গুড মর্ণিং চাঁদ।”

আমিও মিষ্টি হেসে জবাবে বললাম,,

“গুড মর্ণিং আংকেল।”

আপু এবং খালামনি আমাকে ইশারা করে বললেন তাদের মাঝখানের চেয়ারটিতে বসতে। আমিও তাদের কথা মতো চেয়ারটির দিকে এগিয়ে গেলাম। আমার পিছু পিছু নূর ভাইয়া এবং সাদমান ভাইয়াও খাবার টেবিলে চলে এলেন। সাদমান ভাইয়াকে দেখা মাত্রই আংকেল, খালামনি এবং নীড় ভাইয়া ভীষণ খুশি হয়ে গেলেন। নীড় ভাইয়া জুসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে সাদমান ভাইয়ার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“হেই সাদমান? কখন এলি?”

“এই তো একটু আগে ভাইয়া।”

“কখন এলি? দেখলাম না যে? আমরা তো এখানেই ছিলাম।”

“তোমরা তখন নিউজ পেপার পড়ছিলে ভাইয়া। তাই হয়তো খেয়াল করো নি।”

“ওহ্ আই সি। তা আজ এত সকাল সকাল এই বাড়িতে? কোনো বিশেষ কাজ আছে নাকি দুজনের?”

তাৎক্ষণিক খালামনি এবং আংকেল সন্দেহের দৃষ্টিতে সাদমান ভাইয়ার দিকে তাকালেন! খালামনি তো সাথে সাথেই সন্দিহান গলায় সাদমান ভাইয়ার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“হ্যাঁ তাই তো! আজ হঠাৎ তুই এত সকাল সকাল আমাদের বাড়িতে? নূরকেও দেখলাম আজ মার-ধরের আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে! শাওয়ার টাওয়ার নিয়ে একদম ফিটফাট। ব্যাপারটা কী বল তো?”

সাদমান ভাইয়া কনফিউজড হয়ে গেলেন! অস্থির দৃষ্টিতে নূর ভাইয়ার দিকে তাকালেন। কাঠ কাঠ গলায় মুখ খুলে কিছু বলার পূর্বেই নূর ভাইয়া পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য আমতা আমতা করে বললেন,,

“হ্যাঁ আছে তো! আজ ভার্সিটিতে বিশাশাশাল বড় এক প্রোগ্রাম আছে। ঐ প্রোগ্রামে অ্যাটেন্ড করার জন্যই আমরা আজ সকাল সকাল ওঠে গেছি!”

খালামনি খুব সহজেই এই মিথ্যাবাদীর কথা বিশ্বাস করে নিলেন! মৃদু হেসে তাদের দুজনকেই খেতে বসতে বললেন। অনুমতি পেয়ে দু’জনই খুব তাড়াহুড়ো করে চেয়ার টেনে বসে পড়ল! গপাগপ পাউরুটির পিসে বাইট বসাতে লাগল। দেখেই বুঝা যাচ্ছে দু’জন বেশ তাড়ায় আছে। কোনো রকমে এই বিরূপ পরিস্থিতি থেকে বের হতে পরলেই তারা যেন বাঁচে। তাদের দু’জনের কান্ড দেখে আমি ক্রুর হাসছি! কেন জানি না তাদের দু’জনকে আবারও ফাঁসাতে ইচ্ছে করছে আমার! তাছাড়া সমগ্র ডাইনিং রুম জুড়ে এখন পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। যা আমার মোটেও ভালো লাগছে না! মহল গরম করে তুলতে হবে। সবাইকে এন্টারটেইনমেন্ট দিতে হবে। আমি মনে করি মানুষ হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের-ই উচিৎ জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে পূঙ্খানুপুঙ্খভাবে উপভোগ করার! বেঁচে থাকার প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি সময়কে উচ্ছ্বাসের সাথে মাতিয়ে তোলার। সর্বত্র খুশি ছড়িয়ে দেওয়ার। মৃত্যুর আগ অবধি নিজেদের ভালো রাখার জন্য জীবন থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আনন্দ খুঁজে নেওয়ার! যা আমরা অনেকেই করি না! অবলীলায়, অলসতায়, অবসন্নতায় সময় পাড় করে দেই! মনে হয় যেন সময় পেরিয়ে গেলেই আমরা বেঁচে যাই।

মাথায় জলদি দুষ্টু বুদ্ধি এঁটে আমি আপুর পাশের চেয়ারটি টেনে বসে পড়লাম। সেদ্ধ ডিম মুখে তুলে জেগেন্সের পকেট থেকে আমার সেলফোনটি হাতে তুলে নিলাম! ফোনটিতে কোনো রিং না আসা সত্ত্বেও আমি নাটক করে ফোনটি কানে তুলে শান্ত গলায় বললাম,,

“হ্যাঁ জায়মা বল? কেমন আছিস?”

ডাইনিং টেবিলে থাকা সবার দৃষ্টি এখন আমার দিকে! আমি নিশ্চিন্তে পাউরুটির পিসে বাইট বসিয়ে অস্পষ্ট গলায় আবারও বললাম,,

“আনিশার ফোন হারিয়ে গেছে তো আমি কী করতে পারি আজব! আমাকে বলছিস কেন? আমি তো আছি ঢাকায়। কুমিল্লার খবর কীভাবে জানব?”

মুহূর্তের মধ্যেই আমি খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলাম! নাটক করে বিস্মিত গলায় বলতে আরম্ভ করলাম,,

“কী বলছিস কী এসব তুই? আনিশা তার নতুন বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলার জন্য শাওয়ার নিতে যাওয়ার সময়ও হাতে করে ফোন নিয়ে গিয়েছিল? সেই ফোনে কমোডে ভেতর পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে? নতুন নতুন প্রেম হয়েছে ওদের তাই না? কিন্তু শাওয়ার নিতে যাওয়ার সময় কে হাতে করে ফোন নিয়ে যায় ভাই?”

নূর ভাইয়া পাউরুটি অর্ধেক মুখে নিয়ে অস্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন! হয়তো বুঝতে পারছেন আমি উনাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছি! তবে এটা বুঝতে পারছেন না, উনাকে আজ আমি কিছুতেই ফাঁসতে দিব না! উনাকে দেওয়া কথা আমি রাখব। যেভাবেই হোক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে তুলব। আপাতত একটু মজা করে নেই! একটু পরে লোকটা চলেই যাবে। সারাদিন আর খুঁজে পাব কই?

ডাইনিং টেবিলের সবাই চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকাচ্ছে। তবে আমি কদাচিৎ হেসে নূর ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,,

“হ্যাঁ, তবে একজন আছে যে শাওয়ার নিতে যাওয়ার সময়ও হাতে করে ফোন নিয়ে যায়। সে হলো আমাদের নূর ভাইয়া! তবে নূর ভাইয়ার তো কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই! থাকলে তো খালামনি এই ব্যাপারে জানত। তবে নূর ভাইয়া কেন ওয়াশরুমে ফোন নিয়ে গেল?”
#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_৬
#নিশাত_জাহান_নিশি

“হ্যাঁ, তবে একজন আছে যে শাওয়ার নিতে যাওয়ার সময়ও হাতে করে ফোন নিয়ে যায়। সে হলো আমাদের নূর ভাইয়া! তবে নূর ভাইয়ার তো কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই! থাকলে তো খালামনি এই ব্যাপারে জানত। তবে নূর ভাইয়া কেন ওয়াশরুমে ফোন নিয়ে গেল?”

অর্ণগল কথাগুলো বলে চাঁদ বাঁকা চাহনিতে সাবরিনা আবরারে দিকে তাকাল! ‘সাবরিনা আবরার’ হলো নূরের মা। চাঁদের উস্কানিমূলক কথাবার্তা শুনে উনি তৎক্ষণাৎ তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন! নূরের দিকে সন্দেহজনক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। নূরের বাবা হাবিব আবরার প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকিয়ে আছেন! অন্যদিকে নূর শঙ্কিত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চাঁদের দিকে তাকাচ্ছে তো কিছুক্ষণ সাবরিনা আববারের দিকে তাকাচ্ছে! মুখে রাখা পাউরুটির পিসটি কিছুতেই তার গলা দিয়ে নামছে না। তাই স্বাভাবিকভাবে ঢোক গিলতেও তার সমস্যা হয়ে যাচ্ছে! বিরাট বিভ্রাটে ফেঁসে গেছে সে। ভয়ে হয়তো দমটা হাঁসফাস করছে! বিস্তীর্ণ ডাইনিং টেবিল জুড়ে এখন গুমোট পরিবেশ বিরাজ করছে। সবার এক চোখা চাহনি এখন নূর এবং সাদমানের দিকে সীমাবদ্ধ! কারণ, দুজনই ভয়ে সিঁটিয়ে আছে! মুখে এক গাল খাবার নিয়ে বসে আছে। চিবুতেও পারছে না উগলাতেও পারছে না। দেখতে অপরাধীর মতো ভীতসন্ত্রস্ত দেখাচ্ছে৷ তবে এর মধ্যে সোহানী বেশ বুঝতে পেরে গেছে এইসব চাঁদের টেকনিক! চাঁদের সাংঘাতিক দুষ্টু বুদ্ধির নতিজা এসব! চাঁদের এই দুরন্তপন স্বভাবের জন্য মাঝে মাঝে সোহানী নিজেও ফেঁসে যেত! তাই চাঁদের চালাকি ধরতে বেশি সময় লাগল না সোহানীর। মুহূর্তের মধ্যেই ক্ষেপে উঠল সোহানী। চাঁদের বাঁ হাতের শিরা বরাবর চিমটি কেটে ফিসফিসিয়ে বলল,,

“নাটক বন্ধ কর বলছি। পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগেই নাটক বন্ধ কর।”

চাঁদ শুকনো ঢোক গিলল! ব্যথায় খানিক কুঁকিয়ে উঠল। সোহানীর কানে কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,,

“তুমি বুঝতে পেরে গেছ আপু এসব আমি নাটক করছি?”

“তোর বড় বোন আমি! তোকে চিনতে আমার ভুল হবে? তাছাড়া তোকে এখনো যে চিনে নি, সে এখনো মায়ের গর্ভেই রয়ে গেছে!”

লজ্জায় জিভ কাটল চাঁদ! কান থেকে তাড়াহুড়ো করে ফোনটি নামিয়ে নিলো। পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য গলা খাঁকিয়ে সবার দিকে তাকাল। ব্যগ্র হেসে সাবরিনা আবরারকে কিছু উদ্দেশ্য করে বলার পূর্বেই সাবরিনা আবরার বাজখাঁই গলায় নূরের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“চাঁদ এসব কী বলছে নূর? তুই ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় সত্যিই ফোন নিয়ে গিয়েছিলি?”

জোড়ালো ঢোক গিলল নূর! মুখে থাকা পাউরুটির অবশিষ্ট অংশ খাদ্যনালীতে সোজা গড়িয়ে পড়ল। অস্থির গলায় জবাবে বলল,,

“হ্যাঁ নিয়ে গিয়েছিলাম! এতে সমস্যা কী মা? ওয়াশরুমে তো যে কেউ ফোন নিয়ে যেতে পারে। হয়তো ইম্পর্টেন্ট কলও আসতে পারে।”

“না! ওয়াশরুমে যে কেউ ফোন নিয়ে যায় না। শুধু তারাই নিয়ে যায়, যারা নতুন নতুন প্রেম করে! চাঁদ বলল যে শুনলি না?”

নূর হিংস্র দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকাল! পারলে হয়তো এখনই সে চাঁদকে আস্ত গিলে খেতে পারবে! তেজী চাহনিতে চাঁদকে ভস্ম করে দিতে পারবে! বর্তমানে নূরের ভয়াবহ রূপ দেখে চাঁদ ভয় পেতে বাধ্য হলো! শুকনো ঢোক গিলে নূরের দিকে তাকাল। তবে বেশিক্ষণ এই গরল দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে রাখতে পারল না চাঁদ! তৎক্ষনাৎ নূরের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সাবরিনা আবরারের দিকে অধীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। কম্পিত গলায় বলল,,

“আমি বললেই কি সব হয়ে গেল নাকি খালামনি? আমি কতটুকুই বা বুঝি বলো সব? আমি তো এখানে তোমাদের সব্বার ছোট। মুখ ফসকে কী থেকে কী বলে ফেলেছি। ছেড়ে দাও না এসব খালামনি৷ চলো আমরা বরং নাশতা করি৷ আর নূর ভাইয়া উনার কাজে চলে যাক। বেচারা সকাল থেকে কত এক্সাইটেড হয়ে আছে ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য।”

সাবরিনা আবরার শান্ত হয়ে এলেন! সন্দেহবাদী মনোভাব ভেতর থেকে উপড়ে ফেললেন। নূরের দিকে ধীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন! নূর আতঙ্কিত দৃষ্টিতে সাবরিনা আবরারের দিকে তাকিয়ে আস্ত একটি পাউরুটির পিস মুখে পুড়ে নিলো! নূরের অবাক করা কর্মকান্ড দেখে সাবরিনা আবরার ফিক করে হেসে নমনীয় গলায় বললেন,,

“এত তাড়াহুড়ো করে খেতে হবে না বাবা। আস্তে ধীরে খা। আগে নিজেকে ঠিক রাখতে হবে তো, পরে বাকি কাজ!”

নূর স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল! চাঁদের দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। বিনিময়ে চাঁদ ক্রুর হাসল। ডান পাশের ভ্রুটি উঁচু করে ইশারায় বলল,,

“দেখলেন তো চাঁদের কামাল?”

গলায় খাবার আটকে গেল নূরের! গড়গড় করে এক গ্লাস পানি নিমিষের মধ্যেেই সাভার করে ফেলল সে। নূরের এরূপ তাড়াহুড়ো দেখে সাবরিনা আবরারসহ হাবিব আবরারও নূরকে আচ্ছে মতো বকতে শুরু করলেন! ঐদিকে চাঁদ মনে মনে পৈশাচিক আনন্দে ফেটে পড়ছে! যা সোহানী এবং নূর ব্যতীত বাকি কেউ বুঝতে পারছে না। সোহানীও নূরের মতো চাঁদের উপর ফুঁসছে! সুযোগ পেলেই কখন চাঁদের কান মলে দিবে সেই ভাবনায় অস্থির। সীমিত সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি সামলে নূর সাদমানকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে সক্ষম হলো! পার্কিং অ্যারিয়ায় পার্ক করে রাখা বাইক নিয়ে ছুটে চলল প্যারাডাইস পার্কের উদ্দেশ্যে! সেই পার্কটিতে রোজ নূরের জন্য সেই কখন থেকে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে।

,
,

ঘড়িতে সন্ধ্যা প্রায় সাতটা পনেরো ছুঁইছুঁই। চাঁদ সেই কখন থেকে ড্রইং রুমের সোফায় হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। অপেক্ষমান চোখ দুটো কেবল ঘড়ির কাঁটার দিকেই সীমাবদ্ধ রয়েছে! নূরের জন্য অপেক্ষা করতে করতে এই পর্যায়ে এসে চাঁদ ভীষণ অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে। মুখটা ফুলিয়ে একটুটুটুখানি করে রেখেছে। ঠিক সন্ধ্যার দিকেই নূরের বাড়ি ফেরার কথা ছিল! কিন্তু সেই কথা রাখছে না নূর! সন্ধ্যা পেরিয়ে এখন প্রায় রাত হতে চলছে। চাঁদের ধৈর্য্য ধারণ ক্ষমতাও ক্রমশ লোপ পেতে চলেছে। যা চাঁদকে আরও ভীষণভাবে রাগিয়ে তুলছে। এর মধ্যেই হঠাৎ সাবরিনা আবরার এবং সোহানী কিচেন রুম থেকে সন্ধ্যার হালকা খাবার হাতে করে নিয়ে এলেন। এর মধ্যে চাঁদের ফেভারিট ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এবং পাকোড়াও আছে। ট্রে ভর্তি এত পছন্দের খাবার থাকা সত্ত্বেও চাঁদ মুখ তুলে একটি বার খাবারের দিকে তাকাচ্ছে না। ট্রে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সাবরিনা আবরারের দিকেও দৃষ্টিপাত করছে না। উদ্বেগী দৃষ্টিতে সাবরিনা আবরার চাঁদের বিবর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। ভ্রু যুগল কুঁচকে উনি এবার চাঁদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“কী হয়েছে চাঁদ? এভাবে মুখ ফুলিয়ে বসে আছিস কেন?”

সোহানী বেশ বুঝতে পেরে গেছে চাঁদ কেন মুখ ফুলিয়ে বসে আছে! তাই সে চাঁদের মন ভালো করার জন্য চুপটি করে চাঁদের পাশে বসল। মিটিমিটি হেসে চাঁদের দিকে খানিক ঝুঁকে বলল,,

“চল আমরা দু’বোন মিলে বাইরে থেকে ঘুরে আসি৷ মন ভালো হয়ে যাবে তোর?”

অসন্তোষ দৃষ্টিতে চাঁদ সোহানীর দিকে তাকাল। ভগ্ন গলায় বলল,,

“না যাব না। আমি আর কারো সাথেই কোথাও যাব না!”

“আচ্ছা বল। এখানে আমার কী দোষ আছে? আমি কী করেছি? কেন আমার সাথে যাবি না তুই? আমি তো তোর মন ভালো করার জন্যই তোকে নিয়ে ঘুরতে যেতে চাইলাম।”

“কারণ তুমিও আমাকে পছন্দ করো না! একটু আগেই তুমি আমাকে বকেছিলে, ধমকেছিলে, কান ধরেও টেনেছিলে! আমি একটু বেশি চঞ্চল স্বভাবের বলেই তোমাদের সমস্যা! বাচাল প্রকৃতির বলেই তোমাদের অনুশোচনা। অন্য সব মেয়েদের চেয়ে একটু দুষ্টু স্বভাবের বলেই তোমাদের আপত্তি। তাই প্রতি পদে তোমাদের কথা শুনতে হয়। সবার অবহেলার কারণ হতে হয়।”

বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো চাঁদ! সাবরিনা আবরারের দিকে ব্যথীত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। এক ঝটকায় সাবরিনা আবরারের হাত থেকে খাবারের ট্রে-টি ছিনিয়ে নিলো! বেকুব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা সাবরিনা আবারার এবং সোহানীকে উদ্দেশ্য করে চাঁদ অপ্রিয় গলায় বলল,,

“আমার পছন্দের খাবার শুধু আমিই খাব! তোমরা কেউ হাতও লাগাতে পারব না।”

খাবারের ট্রে হাতে নিয়ে হনহনিয়ে চাঁদ বাড়ির ছাদের দিকে রওনা হলো! সাবরিনা আবরার এবং সোহানী ফিক করে হেসে উঠল। দু’জনই সমস্বরে বলে উঠল,,

“ঠিকাছে আমরা খাব না। কোথায় যাচ্ছিস বলে তো যা?”

“ছাদে যাচ্ছি। তোমরা কেউ আমার পিছু পিছু আসবে না। মন ভালো হলে আমি নিজে থেকেই চলে আসব!”

সাবরিনা আবরার এবং সোহানী চুপ হয়ে গেল! দু’জনই হাসতে হাসতে কিচেন রুমে গেল। আলাদাভাবে প্লেটে তুলে রাখা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এবং পাকোড়া গুলো সোহানী হাতে তুলে নিলো। উদগ্রীব গলায় সাবরিনা আবরারকে বলল,,

“বুঝলে খালামনি? চাঁদ কখনো তার পছন্দের খাবার কারো সাথে শেয়ার করতে পছন্দ করে না। সবটা সে নিজে খেতেই পছন্দ করে। তাই আমরা সবসময় এভাবে কিছু খাবার তুলে রাখি। চুপিসারে যেন আমরাও খেতে পারি।”

সাবরিনা আবরার খিলখিলিয়ে হেসে উঠলেন! প্লেটে থাকা একটি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই মুখে তুলে বললেন,,

“চাঁদের এই বাচ্চামো স্বভাবটা আর গেল না। সবসময় বিনোদন দিয়েই চলছে! মেয়েটা পারেও বটে।”

সোহানী মৃদু হাসল। প্লেট থেকে একটি পাকোড়া মুখে তুলে নিয়ে তৃপ্তির সাথে বলল,,

“বাহ্ খালামনি। পাকোড়াটা বেশ মজা হয়েছে তো!”

————————————————–

ছাদের রেলিং ঘেঁষে আনমনে দাঁড়িয়ে আছে চাঁদ। মোহিত দৃষ্টিতে আকাশভরা উজ্জ্বল তাঁরার দিকে নিষ্কলুষ দৃষ্টি তার। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তাঁরকারাজিদের পাশে অবস্থান করা থালার মতো বড় চাঁদের দিকে অপলক চাহনি তার। প্রকৃতি যেন বিকেলের সমস্ত উত্তপ্ততা কাটিয়ে সন্ধ্যে হতেই নিজেকে হিম ভাবে তুলে ধরেছে। স্নিগ্ধ, প্রশান্ত এবং মিষ্টি বাতাসে প্রকৃতিকে মাতিয়ে তুলছে। প্রকৃতির পরম আবেশে চাঁদের রাগটাও কেমন শিথিল হয়ে আসছে! মন খারাপের মনোভাব পাল্টে যাচ্ছে। প্রকৃতিক অকৃত্রিম সৌন্দর্যে বেখবর হয়ে চাঁদ একটার পর একটা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এবং পাকোড়া টপাটপ খেয়ে চলছে। খাবারের স্বাদ পেয়ে সে সমস্ত রাগ-অভিমান ভুলতে শুরু করেছে। মিটিমিটি হেসে খুব তৃপ্তির সাথে প্রতিটি খাবার উপভোগ করছে। এর মধ্যেই হঠাৎ বাড়ির মেইন গেইট থেকে বাইকের হর্ণের আওয়াজ ভেসে এলো! উত্তেজিত হয়ে চাঁদ বাড়ির মেইন গেইটের দিকে অশান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। অমনি বাইকে বসা অবস্থায় ক্লান্ত নূরকে চাঁদ দেখতে পেল! আর এক মুহূর্ত ব্যয় করল না চাঁদ। অবশিষ্ট ফ্রেঞ্চ ফ্রাই গুলো একসাথে মুখে পুড়ে সে এক দৌঁড়ে ছাদ থেকে প্রস্থান নিলো। হাঁপাতে হাঁপাতে সে বাড়ির সদর দরজায় চলে এলো। কিচেন রুম থেকে দৌঁড়ে আসা সাবরিনা আবরারকে থামিয়ে চাঁদ তাড়াহুড়ো করে সদর দরজার খিলটা খুলে দিলো। মুখে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খাবার থাকার কারণে চাঁদ মুখ খুলে কথা বলতে পারছে না। তাই কিঞ্চিৎ মুহূর্তের মধ্যেই সে গপাগপ খাবার গুলো শেষ করে নিলো। দরজার মুখোমুখি পজিশন নিয়ে দাঁড়ালো। সাবরিনা আবরার অবাক দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছেন। আসলে উনি বুঝে উঠতে পারছেন না চাঁদ কী করতে চাইছে! এর মধ্যেই হঠাৎ নূর ফোন ঘাটতে ঘাটতে বাড়ির সদর দরজার দিকে এগিয়ে এলো। তার সম্পূর্ণ মনযোগ এখন ফোনের দিকে। ফোনের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন মিটিমিটি হাসছে সে! দেখেই বুঝা যাচ্ছে ভীষণ খুশি সে। সেই খুশি যেন আর ধরছে না তার। অনমনস্ক হয়ে সে সদর দরজার দিকে এগিয়ে আসতেই চাঁদ “ভাও” করে এক চিৎকার দিয়ে উঠল! সাথে সাথেই নূর ভড়কে উঠল! হাতে থাকা ফোনটি মাটিতে ছিটকে পড়ল। বুকে হাত চেপে নূর প্রকান্ড চোখে সামনের দিকে তাকাল! নূরের বর্তমান ভয়ার্ত অবস্থা দেখে চাঁদ ফিক করে হেসে উঠল! পাশ থেকে সাবরিনা আবরার উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। হন্ন হয়ে নূরের দিকে এগিয়ে গেলেন। চিন্তিত গলায় বললেন,,

“কী হয়েছে বাবা? ভয় পেয়েছিস?”

নূর বড় করে একটি স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল! চাঁদের দিকে রুক্ষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,,

“তুমি? তুমি আবারও?”

“আমি আবারও কী হ্যাঁ? কথা দিয়ে কথা রেখেছেন আপনি? সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরেছেন?”

“সন্ধ্যা হয়েছে মাত্র। এখনো কিন্তু রাত পেরিয়ে যায় নি। বড্ড জ্বালাচ্ছ কিন্তু তুমি আমায়!”

“কোথায় জ্বালাচ্ছি হ্যাঁ? কোথায় জ্বালাচ্ছি? আপনি যদি আমার দেওয়া শর্ত না রাখেন তো আমিও…

নূর উত্তেজিত হয়ে উঠল! সাবরিনা আবরারের দিকে শঙ্কিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। সাবরিনা আবরার উজবুক দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালেন। তৎক্ষণাৎ সাবরিনা আবরারের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নূর শুকনো ঢোক গিলে চাঁদকে বলল,,

“ওয়েট এ্য মিনিট৷ আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি!”

চাঁদ এবং সাবরিনা আবরারকে পাশ কাটিয়ে নূর এক ছুটে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলো। নূরের যাওয়ার পথে তাকিয়ে চাঁদ মুখ চেপে হাসতে লাগল। অবাক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকা সাবরিনা আবরার এবার চাঁদের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। ভ্রু উঁচিয়ে চাঁদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“তোদের ব্যাপারটা কী হ্যাঁ? কী চলছে তোদের মধ্যে? নূর তোকে এত ভয় পাচ্ছে কেন?”

চাঁদ হকচকিয়ে উঠল। ইতস্তত গলায় বলল,,

“কিছু না খালামনি। আমি যাচ্ছি কেমন? রেডি হতে হবে।”

এক দৌঁড়ে চাঁদ নিজের রুমে চলে এলো। গাঁয়ে থাকা গোলাপী রঙের কুর্তিটা খুলে লাল রঙের একটি কুর্তি পড়ে নিলো। সোহানী তাকে হালকা সেজে সাজিয়ে দিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে সেজেগুজে নূরের রুমে চলে এলো। এইদিকে নূর মাত্র ফ্রেশ হয়ে অফ-হোয়াইট রঙের একটি শার্ট পড়েছে। ধীর গতিতে সে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। দ্রুত পায়ে হেঁটে চাঁদ নূরের পাশে দাঁড়ালো। মিষ্টি হেসে উত্তেজিত গলায় বলল,,

“আমি রেডি ভাইয়া। এবার চলুন তাহলে।”

নূর হঠাৎ কেঁপে উঠল! রূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পাশ ফিরে চাঁদের দিকে তাকাল। তটস্থ গলায় প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“এই তুমি কি ভূমিকম্প? কখন কোথা থেকে চলে আসো টের-ই পাওয়া যায় না!”

ভ্রু যুগল কুঁচকে চাঁদ রাগান্বিত গলায় বলল,,

“কী? আমি ভূমিকম্প?”

“নয়তো আর কী? সব জায়গায় এসে তুমি হাজির। তুমি আসার পর থেকেই আমার প্যারাহীন লাইফটা প্যারাময় হয়ে উঠেছে! সব জায়গায় অশান্তি কাজ করছে। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতে হচ্ছে।”

“গার্লফ্রেন্ড থাকার পরেও আপনি কীভাবে বলছেন আপনার লাইফ প্যারাহীন ছিল?”

“অভেসলি ছিল! আমার গার্লফ্রেন্ড তোমার মতো এত প্যারাদায়ক নয়!”

“তাহলে তো বলব আপনার গার্লফ্রেন্ড শুধু নামে মাত্রই গার্লফ্রেন্ড! মন থেকে আপনাকে কখনো চায় নি বা ভালোবাসে নি! তার ঝোঁক হয়তো অন্যদিকে!”

মুহূর্তের মধ্যেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো নূরের! চাঁদের দিকে তেড়ে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“শাট ইউর মাউথ চাঁদ। জাস্ট শাট ইউর মাউথ। আমার গার্লফ্রেন্ড সম্পর্কে আর একটাও বাজে কথা শুনতে চাই না তোমার মুখ থেকে।”

“ওকে চুপ করলাম! তাহলে চলুন। এবার আমরা ঘুরতে যাই।”

চাঁদের সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো নূর। চিরুনিটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে বাইকের চাবিটি হাতে তুলে নিলো। শান্ত গলায় চাঁদকে শুধালো,,

“কোথায় যেতে চাও বলো?”

“আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন সেখানেই যাব।”

“এত সময় নেই এখন আমার হাতে। তাই আশপাশ থেকে ঘুরিয়ে আনব। তবে কাল অথবা পরশু বের হলে হয়তো ভালো হতো।”

“কাল না আজই। আজই আমি ঘুরতে বের হবো।”

“যদি কাল বা পরশু বের হও তাহলে ঢাকা শহরের অনেক কিছু ঘুরে দেখতে পারবে।”

“না! আমি আজ এক্ষণি যাব। এই বাড়িতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ছটফট ছটফট লাগছে। এক্ষণি আমার এই বাড়ি থেকে বের হতে হবে। যদি আপনি আমাকে নিয়ে এখন বের না হোন তবে আমি কিন্তু খালামনিকে সব বলে দিব!”

#চলবে…?
#চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here