প্রেমময়ী তুমি পর্ব -০৯+১০

#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_৯
#নিশাত_জাহান_নিশি

“তোমার মতো ভাইয়া পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার জানো? কারণ, তুমি আমাকে খুব বুঝো! ছোটবেলা থেকে আমাকে পরিচালনা করে আসছ। আমার সমস্ত অবাধ্যতার কারণগুলো খুঁজে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছ। আমার সব কথা বা দুষ্টুমিগুলো তুমি সিরিয়াসলি কখন-ই নিতে পারো না। সবসময় আমাকে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে আসছ। বাকিরা এত আপন না ভাইয়া। আমার দুষ্টুমিও তারা বুঝে না! আমার সব কথাই তারা সিরিয়াসলি নেয়! ভাবে আমি খুব খারাপ! আমি তাদের সম্পর্ক ভাঙার চেষ্টা করি। অথচ ওরা এটা জানে না আমি একটা সম্পর্ক জোড়ার জন্য ঠিক কতখানি সেক্রিফাউজ করতে পারি। আমার ফ্রেন্ডকে পর্যন্ত বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য সাহায্য করেছিলাম!”

আয়মন হকচকিয়ে উঠল! সন্দিহান গলায় চাঁদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“তার মানে তুই-ই সিনথিয়াকে বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলি চাঁদ?

“করেছিলাম ভাইয়া! তবে বুঝতে পারি নি সিনথিয়ার বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার আঘাতটা আন্টি এত সহজে মেনে নিতে পারবেন না! স্ট্রোক করে হসপিটালে ভর্তি হয়ে যাবেন। আমি যা করেছিলাম তখন সিনথিয়ার ভালোর কথা ভেবেই করেছিলাম ভাইয়া। কীভাবে পারতাম আমি বলো? দুটো ভালোবাসার মানুষকে এভাবে আলাদা করে দিতে? আমার চোখের সামনে বেড়ে ওঠা তাদের এতদিনকারর ভালোবাসাকে এভাবে নিষ্ঠুরভাবে ভেঙে দিতে? খুব বিবেকে বাঁধছিল আমার। তাই আমি বাধ্য হয়ে তাদের দুজনকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলাম।”

“আমি ঠিক জানতাম এর পেছনে তোর হাত নিশ্চয়ই আছে! তোকে চিনতে আমার কখনও ভুল হতে পারে না। আর ঠিক একারণেই তোকে আমি জোরাজুরি করে ঢাকা পাঠাতে বাধ্য হয়েছিলাম। কুমিল্লায় থাকলে এতদিনে বিষয়টা পুরো এলাকায় জানাজানি হয়ে যেতো। তখন কী অবস্থা হতো তোর বল তো?”

“যাই হয়ে যাক ভাইয়া। আব্বু-আম্মু যেন এই বিষয়ে কিছু না জানে। তুমি প্লিজ আমাদের ফ্যামিলির কাউকে কিছু জানতে দিও না। এমনকি আমার সোহানী আপুকেও না।”

এর মধ্যেই সোহানী বেডরুমে প্রবেশ করল! চোখ বুলিয়ে রুমের কোথাও চাঁদনীকে দেখতে না পেয়ে সে বাথরুমের দিকে পা বাড়ালো। অমনি বেলকনির কাছ থেকে গুনগুন আওয়াজ ভেসে এলো সোহানীর কানে। সেই আওয়াজকে অনুসরণ করে সোহানী বেলকনির ধারে গেল! এদিক ওদিক খেয়াল নেই চাঁদের। সে ব্যস্ত আয়মনের সাথে কথা বলতে। সোহানী পেছন থেকে চাঁদকে ডাকতে গেলেই চাঁদ মিনমিনে গলায় আয়মনকে বলল,,

“আমি জানি ভাইয়া তুমি কখনও কাউকে কিছু বলবে না। সিনথিয়া এখন কোথায় আছে আমি জানি ভাইয়া! তবে তার বর্তমান ঠিকানা আমি এখন কাউকে বলব না।”

মুহূর্তের মধ্যেই সোহানী অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল! দাঁতে দাঁত চেপে পেছন থেকে চাঁদের চুলের মুঠি চেপে ধরল! তেজী গলায় বলল,,

“কী বললি তুই? তুই জানিস সিনথিয়া কোথায়?”

চাঁদের হাতে থাকা ফোনটি মাটিতে খসে পড়ল! চোখ জোড়া খিঁচে বন্ধ করে সে ব্যথায় আর্তনাদ করে বলল,,

“আপু আমি জানি না সিনথিয়া কোথায়!”

সোহানী চাঁদের কথা কানে তুলল না! চুলের মুঠি ছেড়ে সে একের পর এক চাঁদের গালে এলোপাথারি চড় বসাতে লাগল! চড়ের দাগ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে লাগল। অঢেল রাগে ফোঁস করে সোহানী বলল,,

“মিথ্যে বলছিস তুই আমার সাথে না? মিথ্যে বলছিস? আর কত আমাদের মানসম্মান ডুবাবি তুই? আর কত তোর এসব বেয়াদবির জন্য, তোর অবাধ্যতার জন্য, তোর দুরন্তপনার জন্য আমাদের কথা শুনতে হবে বল? আর কত?”

মুখ বুজে মার হজম করছে চাঁদ! প্রথমবারের ন্যায় এবার আর মুখ খুলে চিৎকার করার সাহস খুঁজে পাচ্ছে না সে। অন্যদিকে সোহানীর রাগ যেন কিছুতেই কমছে না! রাগের পরিমান আরও পালাক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশের রুমে নূর রোজের সাথে কথা বলছিল। সোহানীর গোঙানির শব্দ পেয়ে সে ফোন রেখে দৌঁড়ে এলো চাঁদ এবং সোহানীর বেডরুমে! বেলকনির ধারে উদগ্রীব দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই সে সোহানী এবং চাঁদকে দেখতে পেল! উদগ্রীব দৃষ্টি যেন তার মুহূর্তের মধ্যেই হতবিহ্বল হয়ে উঠল! আর এক মুহূর্তও নষ্ট না করে নূর ছুটে গেল সোহানী এবং চাঁদের কাছে। পরিস্থিতি না বুঝেই সে কোনো কথাবার্তা ছাড়াই পেছন থেকে সোহানীর হাত চেপে ধরল! বিস্মিত গলায় সোহানীর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“কী হয়েছে কী আপু? আপনি এত বড় একটা মেয়েকে এভাবে মারধর করছেন কেন?”

সোহানী পিছু ঘুরে তাকালো। নূরকে দেখামাত্রই সে উত্তেজিত হয়ে উঠল। বাজখাঁই গলায় বলল,,

“এই মেয়ের মতো অসভ্য, বেয়াদব, নির্লজ্জ মেয়েদের ঠিক এভাবেই মারধর করতে হয় নূর! এত বড় একটা মেয়ে অথচ কত বড় জঘন্য একটা কাজ করেছে তুমি শুনলে হয়তো তুমিও তাকে মারতে আসবে নূর! দিন দিন এই মেয়ে অসম্ভব রকম খারাপ হয়ে উঠছে। কোনো কাজ করার আগে ভেবে-চিন্তে করছে না। নিজের মন যা চাইছে ঠিক তাই করছে। নিজে তো বদনাম হচ্ছে হচ্ছে সাথে আমাদের পরিবারেরও বদনাম করে ছাড়ছে!”

চাঁদ মাথা নুইয়ে হেচকি তুলে কাঁদছে। নাকের জলে চোখের জলে ভেসে একাকার। চাঁদের কান্না দেখে সোহানীর রাগটা যেন আরও বেড়ে গেল! তাই সে প্রচণ্ড ক্ষেপে চাঁদের গালে আরও একটি চড়ে বসানোর পূর্বেই নূর পুনরায় সোহানীর হাতটি চেপে ধরল। উত্তেজিত গলায় বলল,,

“এবার কিন্তু আপনি একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছেন আপু! এতক্ষণ ধরে এত মারধর করার পরেও আপনি আবার ওর গাঁয়ে হাত তুলতে যাচ্ছেন? আমি কিন্তু আপনাকে এতটা নির্দয় ভাবি নি আপু।”

সোহানীর হাতটি ছেড়ে নূর অবিশ্বাস্যভাবেই চাঁদের মুখোমুখি দাঁড়াল! তব্ধ শ্বাস ছেড়ে অজান্তেই চাঁদের ডান হাতটি চেপে ধরল! কোনো রকম কথাবার্তা ছাড়াই সে চাঁদকে টানতে টানতে এনে বিছানার উপর বসিয়ে দিলো। গালে লাল হয়ে থাকা চড়ের দাগগুলোর দিকে মর্মাহত দৃষ্টিতে তাকালো। তাৎক্ষণিক প্যান্টের পকেট থেকে সে একটি টিস্যুর প্যাকেট বের করল! চাঁদের মুখের কাছে টিস্যুর প্যাকেটটি ধরে মলিন গলায় বলল,,

“মুখটা মুছে নাও।”

চাঁদ হেচকি তুলে কেঁদে নূরের দিকে তাকালো। গোঙাতে গোঙাতে ক্ষীণ গলায় বলল,,

“আপনি আমার রুমে কী করছেন হ্যাঁ? আপনি আমার রুমে কী করছেন? দয়া করতে এসেছেন আমাকে তাই না? বুঝাতে এসেছেন আপনি খুব দয়ালু, মহান?”

নূর ভড়কে উঠল! ভ্রু যুগল খড়তড়ভাবে কুঁচকালো। চাঁদের দিকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“এভাবে মার খাওয়ার পরেও গলায় এত জোর কোথা থেকে আসে তোমার হ্যাঁ? অহেতুক এভাবে ঝগড়া করার পাওয়ার কোথায় পাও তুমি? এই? তুমি কী ছোটবেলা থেকেই এমন ঝগড়ুটে স্বভাবের?”

“হ্যাঁ আমি ঝগড়ুটে স্বভাবের। তো কী হয়েছে হ্যাঁ? কারো জন্য আমি নিজের স্বভাব বদলাতে পারব না। আমি জানি আমি খুব উচ্ছৃঙ্খল, ঝগড়ুটে, বেয়াদব, বদমেজাজি আপনার দৃষ্টিতে বিরক্তিকরও। আমি এ ও জানি আমার মধ্যে সামান্যতম গুনের ছিঁটেফোঁটাও নেই। তো কী হয়েছে হ্যাঁ? আমি মানুষ না? আমার কী অনুভূতি নেই? আমি কী এতটাই ফেলনার বস্তু?”

নূর তাজ্জব বনে গেল! চাঁদ কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে গেল সেটাই বুঝতে পারছে না নূর। এরমধ্যেই চাঁদ আবার কাঁদতে কাঁদতে বলল,

“এখন তো আমি আপনাকে চিনে গেছি। এখন থেকে আর আপনার সাথে মিশব না, কথা বলব না, আপনার আশেপাশেও ঘেঁষব না, আপনাকে অযথা বিরক্তও করব না। আর একটা কথা। আমি মার খেয়েছি তো কী হয়েছে? আমার আপু আমাকে মেরেছে। অন্যায় করেছি বলেই আমাকে মেরেছে। এতে আপনার কী হ্যাঁ? মজা নিতে এসেছেন আপনি এখানে তাই না? দেখতে এসেছেন আপনার চিরশত্রু কীভাবে মার খায়? শান্তি হয়েছেন তো? খুশি হয়েছেন? এবার যান। দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করুন। আল্লাহ্’র কাছে দু’হাত তুলে বলুন আপনাকে বিরক্ত করা মেয়েটি যেন আজ রাতেই ম’রে যায়! তাহলে আপনিও শান্তি। আমার পরিবারের সবাইও শান্তি পাবে!”

ঠাস করে চাঁদের গালে আরও একটি চড় পড়ল! সোহানী আবারও চাঁদের গালে চড় মেরেছে। চাঁদ চোখ উঠিয়ে সামনে তাকাতেই সোহানী কেঁদে উঠল! নূরকে ঠেলে সরিয়ে তাৎক্ষণিক চাঁদকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,,

“আর কখনও এভাবে ম’রে যাওয়ার কথা বলবি না তুই। একটা মাত্র বোন আমার। আমি কী এতক্ষণ সাধে তোকে মেরেছি? কেন করিস এমন অবাধ্যতা হ্যাঁ? কেন আমাদের কারোর কথা শুনিস না তুই? কেন আগ বাড়িয়ে সবার উপকার করতে যাস বল? জানিস না লোকজনের উপকার করতে নেই। তারা তোর সেই উপকারের মূল্য দিবে না। উল্টো সুযোগ পেলে তোকে ফাঁসিয়ে দিয়ে যাবে। তুই দেখে নিস সিনথিয়া তোকে ফাঁসাবে! এই মেয়ে ফিরে এসে ঠিক তোকে ফাঁসাবে। আমি তো চিনি সিনথিয়াকে, খুব ভালো করেই চিনি। বড়লোক বয়ফ্রেন্ড পেয়ে সহ্য হয় নি। অকারণেই তাকে নিয়ে পালিয়েছে। কয়েকদিন পরে যখন ছেলের ফ্যামিলি চাপ দিতে শুরু করবে তখন সে ফিরে আসতে বাধ্য হবে! আর ফিরে এসেই তোকে জঘন্যভাবে ফাঁসাবে।”

নূর বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দু’বোনের কার্যকলাপ কিছুই বুঝতে পারছে না সে। তাই উৎসুক গলায় সে সোহানীর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“আপু আসল কাহিনীটা কী একটু বলবেন প্লিজ? আমি আপনাদের কোনো কথাই বুঝতে পারছি না।”

চাঁদকে ছেড়ে দাঁড়ালো সোহানী। চোখের জল মুছে নূরের দিকে তাকালো। মুখ খুলে সোহানী যেই না নূরকে কিছু বলতে যাবে অমনি চাঁদ সোহানীকে থামিয়ে দিলো। নাক টেনে কেঁদে বলল,,

“আপু প্লিজ। নূর ভাইয়াকে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। ভবিষ্যৎে আমার উপর কোনো বিপদ আপদ এলে তখন না হয় ব্যাপারটা দেখা যাবে! এখন প্লিজ এই বিষয়টা নিয়ে আর কথা বাড়িও না। আর দয়া করে আম্মু-আব্বুকে এখনি কিছু বলো না! সময় হলে আমি নিজেই আম্মু-আব্বুকে সব খুলে বলব।”

সোহানীকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না চাঁদ। সোজা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। নূরকে উপেক্ষা করে মাথা নুইয়ে তড়িঘড়ি করে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। নূরও বিষয়টিতে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে রুম থেকে প্রস্থান নিলো। নিজের রুমে ঢুকে সোজা দরজা আটকে দিলো।

এই রাতে চাঁদ অভুক্ত অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়ল। সোহানী এবং সাবরিনা আবরার হাজার জোর করেও চাঁদকে কিছু খাওয়াতে পারল না। চাঁদ কিছু খায় নি বলে সোহানী নিজেও কিছু খেলো না! সারারাত চাঁদের মাথায় বিলি কাটতে কাটতে সেও ভোররাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়ল। চাঁদকে মারধর করার পর সোহানীও অনেক কেঁদেছে। সারারাত ধরে চাঁদের গালে এবং সমস্ত মুখে বরফ ঘঁষে দিয়েছে। তাই চড়ের দাগগুলো ক্রমশ কমে এসেছে।

,
,

চারদিকে ফজরের আযান পড়তেই চাঁদের ঘুম ভেঙে গেল। কপাল কুঁচকে সে অর্ধখোলা চোখে আশপাশ তাকাতেই দেখল সোহানী তার মাথার পাশে বাঁকা হয়ে শুয়ে আছে। ঘুম থেকে ওঠার পরই নিশ্চয়ই তার ঘাড় ব্যথা শুরু হবে। যেভাবে ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে শুয়েছে ঘাড় একদম লক হয়ে গেছে হয়তো। চাঁদ হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল। হালকাভাবে সোহানীর শরীরে হাত রাখল। আস্তে ধীরে তাকে সোজা করে বিছানায় শুইয়ে দিলো। সোহানী আরাম পেয়ে নড়েচড়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়ল। চাঁদ ম্লান হেসে সোহানীর দিকে তাকালো। মিনমিনিয়ে বলল,,

“আমি কাল ঠিক-ই বলেছিলাম আপু। রক্তের টান আলাদা হয়! আমাকে মারধর করে তুমিও শান্তি পাও নি। আমার কষ্টে হয়তো আমার থেকে তুমিই বেশি কেঁদেছ!”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল চাঁদ। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ধীর পায়ে হেঁটে ওয়াশরুমে প্রবেশ করল। কিছুক্ষণের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে এসে ফজরের নামাজ আদায় করে নিলো। নামাজ শেষে মাথায় ঘোমটা টেনে সে দুরুদ পড়তে পড়তে বেলকনিতে এসে দাঁড়ালো। ভোরের মিষ্টি বাতাস গাঁ ছুঁয়ে দিতেই চাঁদ মাথা থেকে ঘোমটাটি সরিয়ে দিলো! প্রাণোচ্ছ্বল বাতাসে গাঁ ভাসিয়ে দিলো। চোখ বুজে মুখটা উঁচু করে সে বড় বড় শ্বাস নিতে লাগল। কিছুক্ষণ এই প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার পর মন-মর্জি শান্ত হয়ে উঠতেই চাঁদ মিষ্টি হাসল। এতক্ষণে চারিদিকে ভোরের আভা ফুটতে শুরু করেছে। প্রকৃতি এক অপরূপ সাজে সাজতে লাগল। আশপাশ থেকে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। এর মধ্যেই চাঁদের নজর গেল বাড়ির মেইন গেইটের দিকে। নীড় মাত্র জগিং করতে বের হচ্ছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে খুব তাড়ায় আছে সে। চাঁদ আর এক মিনিটও ব্যয় করল না। পেছন থেকে চিৎকার করে বলল,,

“নীড় ভাইয়া শুনছেন?”

নীড় পিছু ফিরে তাকালো। তার দূরদৃষ্টি চাঁদের রুমের বেলকনির দিকে আটকালো। চাঁদ মৃদু হাসল। প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“আমাকেও আপনার সাথে নিয়ে যাবেন ভাইয়া?”

নীড় মলিন হাসল। হাত দিয়ে ইশারা করে বলল,,

“চলে এসো।”

খুশি হয়ে গেল চাঁদ! দৌঁড়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। মাথায় ঘোমটা টেনে নূরের রুমের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতেই হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা লেগে গেল! চাঁদ হকচকিয়ে উঠল। মাথা তুলে উপরের দিকে তাকালো। অবিশ্বাস্যভাবে জগিং স্যুটে নূরকে দেখা মাত্রই মুখে সে হাত দিয়ে বলল,,

“আপনি? এত সকালে?”

নূর ঢুলুঢুলু দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো। ঘুম জড়ানো গলায় বলল,,

“হ্যাঁ আমি৷ তো?”

“এত সকালে? আজও কী দেখা করার কথা?”

“এখন থেকে আমি রোজ ভোরে ঘুম থেকে উঠব। ডেইলি রুটিন ফলো করব। রুটিন অনুযায়ী এখন আমার জগিং করার ফিক্সড টাইম। তাই এখন আমি জগিং করতে যাব ওকে?”

“আমাকে এসব শুনিয়ে লাভ কী? যান। নিজের কাজে যান। সকাল সকাল মুডটাই নষ্ট করে দিলো! আপনার জন্য এখন আমারও বাইরে যাওয়া পণ্ড হয়ে গেল!”

পূর্ণদৃষ্টিতে নূর এবার চাঁদের দিকে তাকালো। ভ্রু যুগল উঁচু করে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,

“মানে?”

“মানে আমি জগিংয়ে যাচ্ছিলাম।”

“তো মানা করল কে?”

চাঁদ রাগ দেখিয়ে বলল,,

“আপনি!”

“আজব! আমি কখন নিষেধ করলাম?”

“আমি গতকাল রাতে বলেছিলাম না? আপনার সাথে মিশব না। তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আমি এখন কোথাও আপনার সাথে যেতে পারব না!”

নূর চমকালো। তৎপর দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“হোয়াট? আর ইউ সিরিয়াস চাঁদ?”

চাঁদ ভাব নিলো। বুকের উপর দু’হাত গুজে দাঁড়ালো। মুখটা বাঁকিয়ে বলল,,

“টু সিরিয়াস।”

নূর কিয়ৎক্ষণ মৌণ রইল। এক দৃষ্টিতে চাঁদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল! চাঁদ অবাক হলো। প্রকান্ড দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“কী হলো? এভাবে কী দেখছেন?”

নূর মাথা ঝাঁকালো। আচ্ছন্ন গলায় বলল,,

“তোমাকে রোজ ভেবেছিলাম!”

“এহ্হ্?”

“এহ্হ্ না হ্যাঁ। গালে বরফ ঘঁষো নি?”

“কেন বলুন তো?”

“গালে কালসিটে দাগ পড়ে গেছে তাই বললাম!”

“আমার দিকে এত নজর দিতে হবে না আপনার।”

“আমি আর মানুষ পাই নি নজর দেওয়ার? আমার তো রোজ আছে। শুধু তার দিকেই নজর দিব। আর একটা কথা। আমি এখন ওর সাথে দেখা করার জন্যই জগিংয়ে যাচ্ছি। চাইলে তুমিও জয়েন করতে পারো।”
#প্রেমময়ী_তুমি
#পর্ব_১০
#নিশাত_জাহান_নিশি

“আমি আর মানুষ পাই নি নজর দেওয়ার? আমার তো রোজ আছে। শুধু তার দিকেই নজর দিব। আর একটা কথা। আমি এখন ওর সাথে দেখা করার জন্যই জগিংয়ে যাচ্ছি। চাইলে তুমিও জয়েন করতে পারো।”

চাঁদ নাক ফুলিয়ে নূরের দিকে তাকালো। রাগে গজগজ করে বলল,,

“আপনি কি আমাকে পাগল ভেবেছেন হ্যাঁ? ইচ্ছে হলো তো বললেন আপনার সাথে যেতে, আবার ইচ্ছে মিটে গেলে তো বললেন অহেতুক আপনাকে বিরক্ত না করতে! কী ভেবেছেন কী আপনি আমাকে হ্যাঁ? ম’রে গেলেও আমি আপনার সাথে এখন কোত্থাও যাব না। আপনার আশেপাশেও ঘেঁষব না। আমি তো এখন নীড় ভাইয়ার সাথে হাঁটতে বের হবো! খবরদার বলছি আপনি আমাদের সাথে যাওয়ার চেষ্টাও করবেন না। এমনকি আমার সাথে কথা বলারও চেষ্টা করবেন না। যতটা সম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করবেন।”

চাঁদ হাঁপাতে লাগল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। চাঁদের প্রতিটি কথায় নূর ভীষণ ক্ষোভের আঁচ পেল! চাঁদের এই আকস্মিক রুক্ষতা দেখে নূর খানিক বিস্মিত হলো! এক ভ্রু উঁচিয়ে চাঁদের দিকে তাকালো। নিস্তব্ধতা ভেঙে কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“এই তুমি ঠিক আছো তো? আই মিন ঘুমের ঘোরে আজেবাজে কিছু খাও নি তো?”

চাঁদ দাঁত কিড়মিড়িয়ে উঠল! লৌহ দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। আচমকা নূরের দিকে খানিক রুখে এসে বলল,,

“কী পেয়েছেনটা কী আমাকে হ্যাঁ? আপনার মতো দুনিয়ার সবাই নাকি? আপনি মাতাল বলে আমাকেও আপনার মতো মাতাল ভাবছেন? আপনার মতো রাত-বিরাতে নেশা-ভান করি আমি?”

নূর এবার ক্ষেপে গেল। চাঁদের মুখের কাছে আঙুল তাক করে খড়তড় গলায় বলল,,

“ডোন্ট কল মি মাতাল ওকে? মাঝে মধ্যে শখের বশে ড্রিংকস করা মানেই কিন্তু মাতাল হওয়া নয়! তোমাকে সাথে নিয়ে যেতে আমার বয়ে গেছে বুঝছ? তোমার সাথে কথা বলতে কিংবা তোমার সাথে মিশতে দমটা যেন বন্ধ হয়ে আসছে না আমার? একদম আমার ধারে কাছে ঘেঁষবে না তুমি। আমার থেকে একশ গজ দূরে থাকবে।”

রাগে ফোঁস ফোঁস নূর জায়গা থেকে প্রস্থান নিলো। নূরের যাওয়ার পথে তাকিয়ে চাঁদ হাঁসফাঁস করে উঠল। তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,,

“আইছে আমারে সাবধান করতে। আমি যখন সিরিয়াস হয়ে যাই না? তখন কিন্তু কেউ আমাকে আমার জায়গা থেকে টলাতে পারে না বুঝছ? আমি প্রয়োজনে হ্যাংলা হতে পারি, বেয়াদব হতে পারি, অসভ্য হতে পারি, নির্লজ্জ হতে পারি এবং দায়িত্বহীনও হতে পারি। তবে আবার প্রয়োজনে বাড়াবাড়ি রকমের সিরিয়াসও হতে পারি! এখন থেকে মিস্টার নূর শুধু আমার সিরিয়াস রূপটাই দেখবে। না বুঝে আমাকে অযথাই কাঁদিয়েছে না এই নূর? এবার আমিও তাকে কাঁদিয়ে ছাড়ব! এই লোকের সাথে আমি এতটাই সিরিয়াস ভাবে থাকব যে, সে আমাকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হবে।”

এরমধ্যেই চাঁদের আকস্মিক দৃষ্টি পড়ল বাড়ির সদর দরজার দিকে। সদর দরজার প্রবেশ দ্বারেই নীড় এবং নূর দাঁড়িয়ে আছে। দুই ভাইয়ের মধ্যে কথোপকথন চলছে। চাঁদের দেরি দেখে নীড় খুব তাড়াহুড়ো করে এসেছিল চাঁদকে ডাকতে। তবে মাঝপথেই নূরের সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। নীড়ও এই ভোরে নূরকে দেখে চাঁদের মতোই অবাক হলো! বিস্মিত গলায় নূরের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“কী রে? তুই এত সকালে?”

নূর মাথা চুলকালো! খানিক ইতস্তত বোধ করল। পরবর্তীতে ম্লান হেসে মিনমিনে গলায় বলল,,

“রোজের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি ভাইয়া! আসলে আজ নাকি রোজ বাড়ি যাবে। তাই বাড়ি যাওয়ার আগে আমার সাথে একটু দেখা করে যেতে চায়।”

নীড় বাঁকা হাসল। নূরের কাঁধে হাত রাখল। বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবে নিয়ে বলল,,

“ওকে। তাহলে চল। দেখা করে আয়।”

নূর স্মিত হেসে মাথা নাঁড়ালো। এর মধ্যেই নীড় পুনরায় নূরের দিকে ব্যগ্র গলায় প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“আচ্ছা তুই চাঁদকে কোথাও দেখেছিস? মানে মেয়েটা বলছিল আমার সাথে জগিংয়ে যাবে। কিন্তু এখনও বাড়ি থেকে বের হলো না। ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি?”

নূর প্রত্যত্তুরে কিছু বলার পূর্বেই চাঁদ দুজনের মাঝখানে এসে হাজির হয়ে গেল! নূরকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে চাঁদ ব্যতিব্যস্ত গলায় নীড়কে বলল,,

“চলুন ভাইয়া। আমি রেডি।”

নীড় মলিন হাসল। চাঁদ এবং নূরের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“তাহলে চল। আমরা একসাথেই যাই।”

চাঁদ আপত্তিকর দৃষ্টিতে নীড়ের দিকে তাকালো! মুখটা ভাড় করে বলল,,

“তাহলে ভাইয়া আপনারাই যান। আমি আজ যাব না।”

বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে নূর চাঁদের দিকে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,

“আমি তোমার সাথে মিশব না বললাম তো। প্রয়োজনে তোমার থেকে একশ গজ দূরে দূরে হাঁটব। এখন এসব নাটক বন্ধ করে চলো প্লিজ। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

চাঁদ মৌন রইল। জেদ দেখিয়ে নীড় এবং নূরকে উপেক্ষা করে সদর দরজা পেরিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। নীড় নির্বোধের মতো চাঁদের পিছু পিছু হেঁটে গেল। আচমকাই নূর কিছু একটা মনে করে দৌঁড়ে বাড়ির কিচেন রুমে চলে এলো! ফ্রিজ থেকে দুটি আপেল হাতে নিয়ে এক ছুটে আবারও বাড়ির বাইরে এলো! হাঁপাতে হাঁপাতে চাঁদের মুখোমুখি দাঁড়ালো। অপ্রত্যাশিতভাবেই নূর আপেল দুটি চাঁদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ব্যতিব্যস্ত গলায় বলল,,

“রাতেও কিছু খাও নি তুমি। আর এখনো কিছু না খেলে হাঁটতে পারবে না! তাই এখন আপেল গুলো খেয়ে নাও।”

চাঁদ প্রথমে প্রচণ্ড অবাক হলো। পরবর্তীতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল! হাতে থাকা আপেল দুটি মাটিতে ছুড়ে ফেলতেই নূর চাঁদের হাতটি খপ করে চেপে ধরল! ঘাড়ের রগ টান টান করে উত্তেজিত গলায় বলল,,

“খবরদার আপেল গুলো ছুড়ে ফেলবে না। ফটাফট খেয়ে নিবে। যদি আমার কথার নড়চড় হয় না? তবে ঠিক পুঁ’তে রেখে দিব।”

মুহূর্তের মধ্যেই চাঁদের হাতটি ছেড়ে দিলো নূর! আঙুল নাচাতে নাচাতে জায়গা পরিত্যাগ করল। এক দৌঁড়ে বাড়ির মেইন গেইট পাড় হয়ে গেল। চাঁদ রাগান্বিত দৃষ্টিতে নূরের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইল। কিছুতেই নূরের কথা রাখতে ইচ্ছে করছে না তার। নীড় নির্বোধের মতো চাঁদের মুখোমুখি দাঁড়ালো। ভ্রু যুগল সরু করে চাঁদের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“এই তোমরা কী ঝগড়া করেছিলে? দুজন এভাবে দুজনের সাথে ক্ষেপে আছো কেন? বাই অ্যানি চান্স তুমি আবার আম্মুর কাছে আমাদের দুই ভাইয়ের নামে খারাপ কিছু লাগাও নি তো?”

“লাগাইনি তবে লাগাব! আপনার ছোট ভাইয়ের নামে দুর্নাম লাগাব! আপনার এই ভাইটা কিন্তু একদমই ভালো না। মানুষকে বুঝতে চেষ্টা করে না। দুষ্টুমি তো এক্কেবারেই বুঝে না। তাই এই ছেলের সাথে আমার কখনো বনিবনা হবে না। আজীবন আমরা এভাবেই একজন আরেকজন লেগে থাকব! ঝগড়া করতেই থাকব!”

নীড় অট্ট হাসল! হাসতে হাসতে বলল,,

“তোমার ধারণা ভুল চাঁদ। নূর কখনো কারো পিছনে লাগতেই পারে না! এই প্রথম দেখলাম তোমার পেছনে এভাবে লাগতে। তাও আবার লাগার পর-তোমার এতটা যত্ন নিতে!”

চাঁদকে কিছু বলার সময় দিলো না নীড়। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে জায়গা পরিত্যাগ করল। আওয়াজ তুলে চাঁদকে উদ্দেশ্য করে পেছন থেকে বলল,,

“চলে এসো। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

চাঁদ আপেল দুটো হাতেই রেখে দিলো। না মুখে তুলল না মাটিতে ছুড়ে ফেলল। নীড়কে অনুসরণ করে সে বাড়ির মেইন গেইটে চলে এলো। দুজনই পাশাপাশি জগিং করতে করতে একটি ছোট খাটো পার্ক অ্যারিয়ায় চলে এলো! পার্কটির ভেতরে প্রায় শত শত লোক জগিং করছে। সবার মধ্যে পূর্ণবয়স্ক লোকের সংখ্যাই বেশি। কেউ কারোর দিকে তাকানোর সময় নেই। সবাই নিজেদের মতো করে জগিং করছে। স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে সবাই বেশ উদ্যোগী এবং সচেতন।

চাঁদ এবং নীড় নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে পার্কের প্রায় শেষ প্রান্তে চলে এলো। দুজনই প্রায় হাঁপিয়ে উঠল। হাঁটার গতি কমিয়ে দিলো। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বড় একটি বটগাছের তলায় দাঁড়ালো। এরমধ্যেই চাঁদের ক্ষুধামন্দা বেড়ে গেল! গাঁ থেকে ঘাম গড়াতে শুরু করল। মাথা অস্বাভাবিকভাবে ঘুরতে লাগল। শরীর অকোজা হয়ে আসল। কোমড়ে হাত গুজে চাঁদ কুজো হয়ে দাঁড়ালো। মাথা থেকে ঘোমটাটি সরিয়ে বড় বড় শ্বাস ছাড়তে লাগল। নীড় পাশ থেকে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। চাঁদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“কী হয়েছে চাঁদ? শরীর খারাপ লাগছে?”

“হ্যাঁ ভাইয়া। খুব খারাপ লাগছে।”

“পানি খাবে?”

“এখানে কোথাও পানি পাওয়া যাবে?”

“পাশেই দোকান। তুমি এক কাজ করো এখানে একটু দাঁড়াও। আমি দোকান থেকে পানি নিয়ে আসছি। আর হ্যাঁ। আপেল গুলোও খেয়ে নাও। তাহলে শরীরটা কিছুটা হলেও ভালো লাগবে।”

চাঁদ মাথা হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালো। নীড় হম্বিতম্বি হয়ে দোকানের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। ক্ষুধার্ত দৃষ্টিতে চাঁদ হাতে থাকা আপেলগুলোর দিকে তাকালো! বাধ্য হয়ে একটি আপেলে বড় একটি কামড় বসিয়ে দিলো। অতঃপর নাক সিটকে বলল,,

“ইশশ! গাঁ টা ঘিনঘিন করছে আমার। পরিস্থিতির চাপে পড়ে এখন ঐ দুষ্টু লোকের আপেলটাই আমার খেতে হলো।”

কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় বড় কামড়ে আপেল দুটো সাবার করে নিলো। শেষ আপেলের অংশটি চিবুতে চিবুতে সে চোখ বুলিয়ে আশেপাশে তাকালো। অমনি হাতের ডান পাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই চাঁদ হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো! ক্ষিপ্র অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা নূর এবং রোজকে দেখতে পেল! দুজনই আলাদাভাবে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানে বিস্তর ফাঁক! রোজের চোখে জল! নূরের চোখে অসম্ভব ক্ষোভের ঝড়! চাঁদ অবাক হলো। শুধু অবাক নয়, প্রচণ্ড অবাক হলো। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না সে। কী ঘটেছে তা জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠল। তাই এই শরীর খারাপ নিয়েই সে মন্থর গতিতে হেঁটে সোজা নূর এবং রোজের পাশে এসে দাঁড়ালো! আশেপাশে তৃতীয় কোনো ব্যক্তির উপস্থিতি পেয়ে নূর এবং রোজ পাশ ফিরে তাকালো। নূরের চক্ষুজোড়ায় এখনো ক্ষোভের রেশ! রোজের চোখের কোণে অবাধ্য জল। চরম কাতরতার ছাপও বটে। চাঁদকে দেখামাত্রই রোজ ভরসা পেল! হেচকি তুলে কেঁদে উঠল! নীরব থেকেই সে মুখ চেপে কেঁদে হঠাৎ এক ছুটে জায়গা পরিত্যাগ করল! চাঁদ চ্যাঁচিয়ে উঠল। উচ্চ আওয়াজে পেছন থেকে রোজকে ডেকে বলল,,

“কী হয়েছে ভাবি? কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”

রোজ পিছু ফিরে তাকালো না! এক দৌঁড়ে পার্ক থেকে বেরিয়ে গেল! নূর এবার দুর্বল হয়ে পড়ল। ক্ষোভ কাটিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হলো! শরীরের সমস্ত শক্তি বিসর্জন দিয়ে সে অকেজো শরীর নিয়ে পার্কে থাকা বেঞ্চির উপর বসে পড়ল। চাঁদ দৌঁড়ে এসে নূরের পাশে বসল। উদ্বিগ্ন গলায় শুধালো,,

“কী হয়েছে নূর ভাইয়া? আপনারা দুজনই এমন নিষ্প্রাণ হয়ে আছেন কেন? ঝগড়া হয়েছে আপনাদের মধ্যে?”

নূর হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল! ঘটনার আকস্মিকতায় চাঁদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল! অস্থির দৃষ্টিতে নূরের দিকে তাকালো। নূর নাক টেনে অস্পষ্ট গলায় বলল,,

“রোজের বিয়ে ঠিক হচ্ছে চাঁদ! আজ তাকে দেখতে আসবে!”

চাঁদ বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। উদগ্রীব গলায় বলল,,

“তাই বলে আপনি ভাবিকে এভাবে যেতে দিবেন নূর ভাইয়া? আটকাতে পারলেন না ভাবিকে? ধরে বেঁধে রেখে দিতে পারলেন না উনাকে? এই তাহলে আপনার ভালোবাসা?”

নূর গর্জে উঠল! কান্নাজড়িত রক্তিম মুখমন্ডলে চিৎকার করে বলল,,

“কীভাবে আটকাব আমি তাকে হ্যাঁ? কীভাবে আটকাব? কোন মুখে আমি তাকে ধরে বেঁধে রাখব? আমি কী আদৌ তার যোগ্য? পুরোপুরি অযোগ্য একটা ছেলে আমি! যার কোনো যোগ্যতাই নেই তাকে আটকে রাখার।”

“যোগ্য অযোগ্য নিয়ে এখানে কোনো প্রশ্ন উঠছে না নূর ভাইয়া। আপনি প্লিজ আগে ভাবিকে থামান। পরেরটা পরে ভেবে দেখা যাবে। আগের কাজটা আগে করুন প্লিজ। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আগেই কিছু একটা করুন।”

চাঁদের কোনো কথাই নূর কানে তুলল না! বিষন্নতায় মুর্ছে গেল। বিভৎস গলায় অনর্গল বলল,,

“এখনো স্টুডেন্ট আমি চাঁদ। লেখাপড়া চলমান। চাকরি বাকরি কিছু-ই নেই আমার হাতে। বাবা-মা’য়ের উপর ডিপেন্ড করে চলছি। তার উপর একজন খারাপ স্টুডেন্ট! বছর বছর ইম্প্রুভমেন্ট দিচ্ছি! আজ তাকে আটকে দিলে বাকি জীবন আমি তাকে আগলে রাখব কীভাবে চাঁদ?”

চাঁদ অবাক হলো! তেড়ে এলো নূরের দিকে। তটস্থ গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,,

“কেন? প্রেম করার আগে ভেবে দেখেন নি? এই সেম এইজ রিলেশানগুলো শেষ অবধি পরিণতি পায় না? খুব কম মানুষ-ই আছে যারা সেম এইজ রিলেশানগুলো বিয়ে অবধি গড়িয়ে আনতে পারে! এতদিন তো খুব বড় বড় কথা বলছিলেন! রোজ আপনার সব, রোজ আপনার জান, রোজ আপনার প্রাণ! তাকে ছাড়া আপনি বাঁচবেন না। তার সাথে কোনোভাবে ব্রেকাপ হয়ে গেলে আপনি আমাকে জানে মে’রে ফেলবেন! এখন কী হলো হ্যাঁ? যখন বিয়ের ব্যাপারটা উঠে এলো তখন নিজের দায়িত্ব দিব্যি ভুলে গেলেন? এতদিনের ভালোবাসাও ভুলে গেলেন?”

নূর বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। ক্ষেপে এলো চাঁদের কাছে। চোয়াল শক্ত করে বলল,,

“আমি আমার দায়িত্ব ভুলে যাই নি ওকে? না রোজকে ভুলে যাওয়ার কথা ভাবছি! আমাদের ভালোবাসা এখন পরিণতি না পেলেও তাকে আমি ঠিক এভাবেই আজীবন ভালোবেসে যাব। তার জায়গা কখনো কেউ দখল করতে পারবে না!”

“হ্যাঁ তাহলে যান না। দায়িত্ব দেখান। ভাবিকে আটকান। প্রয়োজনে ভাবির বাড়ি যান। ভাবির পরিবারকে বুঝান। কিছু একটা করুন। দেবদাস হয়ে না ঘুরে, সময় থাকতে কিছু একটা করুন।”

দুঃশ্চিন্তায় কপাল ঘঁষতে লাগল নূর। উতলা হয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,,

“এখানেই তো সমস্যাটা চাঁদ! আমি চাইলেই এখন রোজের পরিবারের কাছে কোনো প্রস্তাব নিয়ে যেতে পারছি না! রোজের পরিবার কখনোই জামাই হিসেবে আমাকে মেনে নিবে না। রোজের পরিবার খুব উচ্চবিত্ত! আমাদের চেয়েও অনেক অনেক অনেক গুন বেশি ধনী তারা। জামাই হিসেবে তারা এই বেকার ছেলেকে কখনই মেনে নিবে না! বুঝতে পারছি না কী করব আমি। খুব হেল্পলেস লাগছে নিজেকে। ম’রে যেতে ইচ্ছে করছে জাস্ট! এই বয়সে এত প্যারা নিতে পারছি না!”

চাঁদ শান্ত হয়ে এলো। কান্নাজড়িত চোখে নূরের দিকে তাকালো৷ গলা জড়ানো স্বরে বলল,,

“একবার তো চেষ্টা করে দেখুন নূর ভাইয়া। চাইলে হয়তো সব-ই সম্ভব।”

“সম্ভব না চাঁদ। কখন-ই সম্ভব না। তারা কখনো আমাকে মেনে নিবে না। তাদের এক্সপেকটেশন খুব হাই। সেই এক্সপেকটেশনের ধারে কাছেও আমি যাই না!”

“তাহলে এক কাজ করুন না? খালামনিকে সব বলে দিন! খালামনি হয়তো কিছু একটা করতে পারবে!”

নূর ভয় পেয়ে গেল! ভয়ার্ত গলায় বলল,,

“আম্মু জানতে পারলে আরও বেশি খারাপ সিচুয়েশন ক্রিয়েট হবে চাঁদ! আমাকে তো বাড়ি ছাড়া করবেই সাথে রোজের পরিবারকেও উস্কিয়ে দিবে রোজকে যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে দিয়ে দিতে! কারণ আম্মু প্রথম থেকেই আমাকে বারণ করেছিল রোজের সাথে মেলামেশা করতে! তখন হয়তো হাবভাব দেখে আম্মু কিছু বুঝেছিল আমার মনে রোজের জন্য কিছু আছে!”

চাঁদ নিরুপায় হয়ে নূরের ব্যথীত দৃষ্টিতে তাকালো। নূরের বর্তমান অবস্থা খুবই শোচনীয়। দেখতে ভীষণ মনমরা, নিষ্প্রাণ এবং বিষন্ন দেখাচ্ছে! চোখের জল কেবল গড়িয়ে গড়িয়ে বুকে লুটিয়ে পড়ছে। চাঁদ শুকনো ঢোক গিলল। কিছুটা সাহস সঞ্চার করে নূরের দিকে এগিয়ে গেল। নূর কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই সে তাৎক্ষণিক দু’হাত দিয়ে নূরের গড়িয়ে পড়া চোখের জলগুলো মুছে দিলো! ছটফটে গলায় বলল,,

“তাহলে এখন কী করবেন? পালিয়ে যাবেন দুজন?”

এরমধ্যেই আশপাশ থেকে নীড়ের গলার আওয়াজ ভেসে এলো নূর এবং চাঁদের কানে! দুজনই নড়েচড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। দূর থেকে চাঁদ এবং নূরকে দেখামাত্রই নীড় স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে দুজনের দিকে এগিয়ে এলো। হাতে থাকা পানির বোতলটি চাঁদের মুখের কাছে ধরে বলল,,

“এই নাও চাঁদ তোমার পানি। অনেকক্ষণ ধরে খুঁজছিলাম তোমায়। এখন এসে দেখি তুমি এখানে। আমি তো ভেবেছিলাম হারিয়ে টারিয়ে গেলে নাকি!”

চাঁদ জোরপূর্বক হাসল। পানিটা সে নিজে না খেয়ে নূরের মুখের কাছে ধরল! তৎপর গলায় বলল,,

“মুখটা ধুঁয়ে নিন। আর একটু পানিও খেয়ে নিন। মনোস্থির করুন। নিজেকে শান্ত করুন। দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে। থোরাই না আপনারা আলাদা হবেন! দুজনে এক হবেন-ই হবেন।”

নূর ভরসার দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকালো! নীড় কৌতূহলী হয়ে উঠল। নূরের মুখোমুখি দাঁড়ালো। উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন ছুড়ে বলল,,

“কী রে? হয়েছে তোর? কাঁদছিলি কেন তুই? তাছাড়া চাঁদ এসব কী বলছে? কার সাথে কে এক হবে?”

#চলবে…?
#চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here