প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব -০৮+৯

#প্রেমময়ী_বর্ষণে_তুই(০৮)
লাবিবা ওয়াহিদ

রায়াফ এবং ফাহান এতিমখানা থেকে ফিরে কাজের লোকের দেখানো রুমে যেতেই দুজনের অবস্থা কাহিল। রায়াফ তো একের পর এক হাঁচি দিয়েই চলেছে। মাত্রই সে মাস্কটি খুলেছে। ধুলোমাখা রুমটাকে পুরোই কুয়াশার ন্যায় লাগছে। যার ফলে সামনের কিছুই দেখা যাচ্ছে না শুধুমাত্র ধুলো ছাড়া। পুরো রুমে যেন ধুলোরা বিচরণ করছে। তবে ঝাড়ার শব্দ তাদের কানে আসছে সাথে জিনির খক খক করে কাশির আওয়াজ! রায়াফ আরেকটা হাঁচি দিয়ে চেঁচিয়ে বললো,

-“স্টপ! আই সে স্টপ ইট! যে ঝাড়ছো সে থামো!”

শেষোক্ত বাক্যটি কিছুটা উচ্চস্বরেই বলে উঠে রায়াফ। সাথে সাথে ঝাড় দেয়ার শব্দ বন্ধ হয়ে গেলো। অতঃপর সেই ধুলোর মধ্যে থেকে এক কন্যার আবির্ভাব ঘটলো যার নাক অবধি ওড়না দিয়ে বেঁধে রাখা। আফনা তার কাঁধে ঝাটাটা রাখার পোজ মেরে চোখ ছোট ছোট করে ওদের দিকে দৃষ্টিপাত স্থির করে।

-“কী সমস্যা?”

-“সেটা তো আমাদের বলা উচিত! হোয়াট’স ইওর প্রব্লেম? এভাবে ধুলো উড়াচ্ছো কেন?”

আফনা তার মুখের থেকে কাপড়টা সরিয়ে বললো,

-“রুমে ধুলো জমলে তা ঝাড়বো না? অদ্ভুত কথাবার্তা বলছেন তো আপনি!”

রায়াফ আফনার দিকে অবাক চোখে তাকালেও ফাহান হা করে আফনার দিকে তাকিয়ে রয়। কী অপরূপ সুন্দরী আফনা। তার তো দম যায় যায় অবস্থা। রায়াফ নিজেকে সামলে বলে,

-“রুম ঝাড়ছিলেন আগে থেকে বলে দেয়া কী উচিত হয়নি? শুধু শুধু ঝামেলায় পরার মানে হয় না!”

-“আপনাদের কেন বলবো? এতো দামড়া হয়েও যদি নিজ দায়িত্বে বুঝতে না পারেন তাহলে আমার কিছু করার নেই৷ তাও বলছি আপনারা পাশের রুমে গিয়ে রেস্ট করুন, আমার এই ঘর ঝাড় দিতে আরও কিছুক্ষণ সময় লাগবে!”

রায়াফ ফাহানের দিকে তাকাতেই দেখলো ফাহান আফনাকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে। তাই রায়াফ ফাহানকে টেনে নিয়ে যাওয়া ধরলেই আফনা ওদের পিছু ডাকলো।

-“শুনুন! কুকুরটা যদি আপনাদের হয়ে থাকে তাহলে একেও নিয়ে যান, বারংবার কাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে!”

আফনার এমন আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহারে রায়াফ বেশী অবাক হলো। এই ঝাঁঝলঙ্কা ভালো ব্যবহারও করতে জানে? বাহ! রায়াফ জিনিকে এক ডাক দিতেই জিনি চোখের পলকে রায়াফের সামনে হাজির। আফনা কোণা চোখে বিরক্তিমার্কা মুখ করে জিনির দিকে তাকিয়ে আছে। তার মন চাইছে কুকুরটাকে এই ঝাটা দিয়ে জম্মের মতো পিটাইতে, তাও যদি তার শান্তি হয়। রায়াফ তার জিনিকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আর আফনা আবার তার কাজে ফিরে গেলো।

পাশের রুমে আসার পর থেকেই ফাহান কেমন ঘোরের মাঝে রয়েছে। রায়াফ কিছু বললে হু, হা বলে উত্তর দিচ্ছে৷ একসময় ফাহানের প্রতি রায়াফের বিরক্তি ধরে গেলো৷ তা অজান্তে মুখে হাত যেতেই দেখলো তার মুখে মাস্ক নেই। রায়াফ চরম অবাক হলো এবং তার মনে পরলো সে তো পাশের ঘরে মাস্ক ছাড়া গেছিলো৷ আফনা? ইয়েস! ও কেন কোনোরকম রিয়েক্ট করলো না? রায়াফের এই ক্যারিয়ার জীবনে ফ্যামিলি বাদে বাহিরে মাস্ক না পরে বের হলে সবাই তাকে চেপে ধরতো, অটোগ্রাফ, সেল্ফি তোলার জন্য। মেয়েদের কথা তো বাদই দিলো, এরা তো হুমড়ি খেয়ে পরে। তাহলে আফনার বিষয়ে এমন কাহীনি ঘটলো কেন? হাউ? মেয়েটা কী তাকে দেখেনি? তখনই মনে পরলো আফনার আগের বলা কথাগুলো, আফনা ক্রিকেট বা রায়াফ কাউকেই পছন্দ করে না। তাই বলে এতো সামনে থেকে দেখেও কোনোরকম রিয়েক্ট করলো না? না চাইতেও কিছুটা মুগ্ধতা কাজ করলো আফনার প্রতি, মেয়েটা অদ্ভুত হলেও ছেলেদের থেকে ডিস্টেন্স রেখে চলে, সে যেই হোক না কেন! পরক্ষণে তার এই ভাবনাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ভাবলো,

-“না, নাহ! রায়াফ! মেয়েদের বিলিভ করো না, নারীর প্রতারণা পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর জিনিস যা থেকে বাঁচা ইমপসিবল। কান্ট্রোল ইওরসেল্ফ। সব মেয়েই একরকম, তাদের বিশ্বাস করো না!”

এদিকে আফনা বিরক্তি নিয়ে কাজ শেষ করতেই ছেলেগুলোর কথা মনে পরলো। ছেলেগুলোর চেহারা মস্তিষ্কে ভেসে উঠতেই আফনা অটোমেটিক চোখ বড় বড় করে ফেললো। আফনা পিছে ফিরে দরজার দিকে তাকিয়ে ভাবলো,

-“ওটা কী সত্যি সত্যিই রায়াফ সানভি ছিলো? হায় আল্লাহ! আমি কী স্বপ্ন দেখছি নাকি বাস্তব? আচ্ছা ভুল দেখিনি তো? দেখতে পারি। অথবা হয়তো রায়াফ সানভির মতো দেখতে কেউ? আমিও কী বলদ, রায়াফ সানভির মতো মানুষ আমাদের এই খানে কেন আসবে? তার তো রাজার হালে থাকার কথা।”

ভাবতে ভাবতেই সে পাশের ঘরে চলে গেলো এই রুমের কথা জানাতে। পাশে রুমে গিয়ে আফনা রায়াফকে দেখে ঠিক হজম করতে পারলো না। আসলেই রায়াফ সানভি তার বরাবর বসে। এ তো আসলেই সাদা। যাক আফনার দেয়া সাদা ইলিশ নামটা তাহলে ঠিক আছে। রায়াফ যখনই আফনার দিকে তাকাবে তার আগেই আফনা চোখ সরিয়ে এক ঢোক গিলে গলা ভিঁজিয়ে ফাহানের উদ্দেশ্যে বললো,

-“আপনাদের পাশের ঘর রেডি আছে, যে যেতে ইচ্ছুক আসতে পারেন। আর কোনোরকম সমস্যা হলে কাউকে ডেকে নিবেন। আর হ্যাঁ কিছুক্ষণের মাঝেই আপনাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হবে, আপনারা ফ্রেশ হয়ে নিচে আসুন!”

কথাগুলো বলার সময় আফনার হাত দুটো অধিকমাত্রায় কাঁপছিলো। কেন কাঁপছিলো সে নিজেও জানে না। তাই হাতদুটো পিছে নিয়ে রেখেছে যাতে করে ওদের দৃষ্টি আফনার হাতে না পরে। ফাহান কখন থেকেই আফনার দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে। রায়াফ আফনার দিকে একনজর তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। রায়াফ দাঁড়াতেই আফনা তার উচ্চতা মাপার চেষ্টা করলো। চোখে দেখে না বুঝলেও এটা ভালো করে বুঝলো যদি রায়াফ তার সামনে দাঁড়ায় তাহলে আফনা রায়াফের কাঁধের কিছুটা নিচে নামবে। এতো লম্বা আল্লাহ রে! আফনা আমার চোখ ফিরিয়ে রুম থেকে হনহন করে চলে গেলো। রায়াফ এবারও অবাক হলো। এবারও আফনা কোনোরকম রিয়েক্ট করলো না কেন? অদ্ভুত! রায়াফ আফনার কথা ভাবতে ভাবতে জিনিকে নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলো। যেহেতু এটা গ্রাম সেহেতু চারপাশে গাছপালার অভাব নেই। তাই হয়তো গরমটা কমই লাগে। খোলা জানালা, দরজা দিয়ে শীতল হাওয়া প্রবেশ করে রুমে ঘুরপাক খায়।

আফনা আরেকবার গোসল সেরে নিজের বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। তার চোখের সামনে এখনো সেই মুহূর্তগুলো ভাসছে। এখনো সে অস্বস্তির চাদরে আবৃত। আফনা এ-জম্মেও এতোটা অস্বস্তি ফিল করেনি যতোটা না রায়াফের সামনে দাঁড়িয়ে ফিল করেছে। আফনা চোখ বুজে কয়েকবার লম্বা নিঃশ্বাস ফেলো। অতঃপর আঁখিপল্লব মেলে ভাবে,

-“যাকে অপছন্দ করি তার সামনে অস্বস্তিতে পরার কোনো মানেই হয় না। আমি কোনো চোরও নই, ডাকাতও নই তাও কেন এতো অস্বস্তি? ধুর, ভালো লাগছে না কিছু!”

তখনই কলি আফনাকে হাঁক ছেড়ে খেতে ডাকলো। আফনা উঠে দাঁড়িয়ে আয়নার সামনে গিয়ে তার ভেঁজা চুলগুলো ঝেড়ে, মাথায় সুন্দরভাবে ওড়না দিয়ে নিচে চলে গেলো। বাসায় থাকলে মাথায় ওড়না দিতো না তবে এখানে দিচ্ছে কারণ, দাদু ওড়না মাথায় না দিয়ে চলাফেরা করা পছন্দ করেন না। খাওয়া-দাওয়া সেরে উঠতেই ফুপি বলে উঠলো,

-“আফনা মা! গিয়ে দেখ তো রহিম ভাই মেহমানদের ভালোভাবে আপ্যায়ন করছে কিনা!”

আফনা আবারও পরলো অস্বস্তিতে। সে কিছু বলার পূর্বেই যে যার ঘরে চলে গেলো। আফনা উপায় না পেয়ে একাই বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। দুই বাড়ি পরেই আফনার দাদুর বাড়ি। এখন তারা যে বাসায় থাকছে সেটা আফনার বাবা এবং চাচারা মিলে তৈরি করেছে।

খেতে খেতেই রায়াফের চোখজোড়া সদর দরজার দিকে চলে গেলো। আফনা প্রবেশ করছে। ভেঁজা চুল আফনার গালের দুপাশে চলে এসেছে। মাথায় ঘোমটা, ন্যাচারাল চেহারা। শুভ্র গায়ে কালো ড্রেসটা যেন আরও সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে। আফনাকে দেখে রায়াফ যেন খাবার চিবুতে ভুলে গেলো। কোন এক মোহ তাকে আফনার দিকে চৌম্বুকের মতো টানছে। আফনা তার মাথায় ভালোভাবে ঘোমটা দিতেই রায়াফ চোখ সরিয়ে ফেললো। ফাহান এখনো খেয়াল করেনি আফনাকে, সে আপাতত খেতে ব্যস্ত। খাওয়ার সময় ফাহানের আশেপাশে খেয়াল থাকে না। আবার যদি খুদা লাগে বেশি তাহলে তো কোনো কথাই নেই। আফনা রায়াফের দিকে একপলক তাকিয়ে রায়াফের পাশ কেটেই কিচেনের দিকে চলে গেলো। আফনা যেতেই এক মোহনীয় সুঘ্রাণ রায়াফের নাকে এসে ঠেকলো। রায়াফ সাথে সাথে চোখ বুজে সেই সুঘ্রাণ অনুভব করলো।

আফনা রহিম চাচার থেকে সব জেনে এবং কিছু বুঝিয়ে পেছন দরজা দিয়েই বেরিয়ে গেলো। তার সাহস হচ্ছে না আবারও ওদের সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার।

রাত্রিবেলায় ছাদে একাকী আফনা জোৎস্নাবিলাস করছিলো, সাথে ভাবনা তো আছেই। ভাবনার পুরোটাই তার অস্বস্তিকে কেন্দ্র করে। এখনো সে উত্তর পায়নি তার এই অজানা অস্বস্তির। অস্বস্তিটা তার কেমন বিদঘুটে স্বপ্নের ন্যায় লাগছে। তখনই কলি চেঁচাতে চেঁচাতে ছাদে আসলো এবং পেছন থেকে আফনার গলা জড়িয়ে বললো,

-“ইয়ার!! আমি জাস্ট সারপ্রাইজড হয়ে গেছি রায়াফকে সামনে থেকে দেখে। আমি তো কখনো স্বপ্নেও ভাবি নাই রায়াফকে কখনো সামনে থেকে দেখবো। কী হ্যান্ডসাম ভাই! ভাগ্যিস সেখানে সেন্সলেস হয়ে যাই নাই। ইরা দেখলে কী হতো বলতো?”

এবার আফনার বিরক্তি ধরে গেলো। এমন ভাব ধরছে যেন এলিয়েন দেখেছে। আরে ভাই সেলিব্রিটি হলেও তো সে একজন মানুষ, তাকে নিয়ে লাফানোর কী আছে আফনা তা বুঝে না। আফনা নিজেকে ছাড়িয়ে বললো,

-“শুধু চোখের দেখা দেখেই এমন লাফাচ্ছিস? কথা বলিসনি কেন?”

-“ইসহাক ভাই না করেছে। তার নাকি এসব পছন্দ না!”

মিনিটেই আফনার রাগ সপ্তম আসমানে উঠে গেলো। সে ঠিক ধরেছিলো, সেলিব্রিটি নামটাই অহংকারে আপ্লুত! এরে যখন হাতের কাছে পাইসে ভালো তেল মশলা দিয়ে মজা বুঝাতে হবে। ভেবেই আফনা তার অধর জোড়া প্রসারিত করলো। তার ভেতরের শয়তানি ধরাটা কলির পক্ষে সম্ভব হলো না!
#প্রেমময়ী_বর্ষণে_তুই(০৯)
লাবিবা ওয়াহিদ

বিকট ডং ডং শব্দে রায়াফ অনেকটা বিরক্ত নিয়ে পিটপিট করে তাকালো। শব্দের মাত্রা তীব্র থেকে আরও তীব্র হচ্ছে। দুই কানে হাত দিয়েও কোনো লাভ হলো না। শেষমেষ বালিশ চাপা দিয়ে শুয়ে পরলো। নাহ তাতেও কাজ হলো না। রায়াফ লাফ দিয়ে উঠে বসলো। চোখে-মুখে রাগী ভাব স্পষ্ট। জিনিও কিছুক্ষণ আগেই উঠেছে। রায়াফ ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো মাত্র সাড়ে ৪টা বাজে। এই সময়ে তার এতো সমস্যা যার জন্য কানের সামনে এসব বাজিয়ে কানের মাথা খাচ্ছে? শব্দটা দরজার দিক থেকেই আসছে, তাই রায়াফ দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। এগিয়ে যেতে যেতে শুনলো,

-“উঠুন, উঠুন। নামাজের সময় হয়ে গেছে উঠুন। ঘুম থেকে নামাজ উত্তম, উঠুন। গ্রামে এতো সময় নিয়ে ঘুমানো জায়েজ না উঠুন!”

আফনা এগুলো বলছে আর স্টিলের থালায় স্টিলের গ্লাস দিয়ে ধুরুম ধারুম বাজাচ্ছে। এই শব্দে মানুষ কেন, পশুপাখিও ঘুম থেকে উঠতে বাধ্য। আফনা শুধুমাত্র রায়াফের ঘুমের ১২টা বাজাতেই এসব কলকাঠি নেড়েছে। বড়লোককে এবার সে বুঝাবে ঠ্যালার নাম বাবাজি। আফনা আরও কিছু বলতে নিলেই খট করে দরজাটা খুলে রায়াফ বেরিয়ে আসে। রায়াফকে দেখে আফনার বাজানো মুহূর্তেই থেমে গেলো। আবারও এক বস্তা অস্বস্তি তাকে ঘিরে ধরলো। কিন্তু এই মুহূর্তে সে তার অস্বস্তিতে কান্ট্রোলে রেখেছে। রায়াফ ভ্রু-জোড়া কুচকে আফনার দিকে তাকিয়ে আছে। আফনা তার থালার একপলক তাকিয়ে রায়াফের দিকে তাকালো এবং দাঁত কেলিয়ে বললো,

-“এটাই নিয়ম৷ নামাজের সময় সকলকে উঠতে হবে, দাদীর হুকুম। তাই আমি এসেছি আপনাদের ঘুম ভাঙ্গাতে। আপনারা শহরের হলেও কিছু করার নাই, নিয়ম সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য!”

বলেই একটা পোজ মেরে আফনা চলে গেলো। আফনার মধ্যে খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। এদিকে রায়াফ মনে মনে বললো,

-“শেষোক্ত কথা দিয়ে কী মেয়েটা আমায় খোচা মারলো? স্টুপিড একটা!”

বলেই রুমের মধ্যে ঢুকে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলো। আল্লাহ মালুম আর কতদিন এখানে ঝামেলা সহ্য করতে হবে। রায়াফ আর ঘুমালো না কারণ, কিছুক্ষণের মধ্যেই ফজরের আযান দিবে। কিন্তু তার মাথা ব্যথা একদমই কাটছে না। কফি খাওয়া বড্ড জরুরি ছিলো। কিন্তু এ সময়ে কেই বা তাকে কফি বানিয়ে খাওয়াবে? ভাবতে ভাবতেই সে ওয়াশরুম চলে গেলো।

রায়াফ চোখ গরম করে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে না। ড্রাইভার সবটা চেক করে দেখলো টায়ার পাঞ্চার। ড্রাইভার রায়াফের কাছে এসে বললো,

-“টায়ার পাঞ্চার হয়েছে স্যার। কিন্তু কীভাবে হলো বুঝতে পারছি না, এখানে আসা অবধি তো সবই ঠিক ছিলো।”

রায়াফের হঠাৎ দূরে চোখ যেতেই কেউ একজন গাছের পিছে লুকিয়ে পরলো। ওড়নার কিছুটা অংশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রায়াফ এও বুঝলো এই ওড়নার অংশটি কার? রায়াফের এখন সবটা একে একে বুঝতে পারলো৷ সকালের ওই ঘটনা, এখন আবার টায়ার পাঞ্চার। রায়াফ দাঁত কিড়মিড় করে ভাবলো,

-“তোমার শাস্তি তুমি পাবে!”

-“হায় আল্লাহ আমায় কী ওই সাদা ইলিশটা দেখে ফেললো নাকি? ধুর! দেখলে তো সব ফিনিশ হিয়ে যাবে ওই অপদার্থের মতো!”

আরেকবার উঁকি দিয়ে দেখলো রায়াফ ভেতরের দিকে চলে যাচ্ছে। আফনা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো এবং নিজের কাজে চলে গেলো।
.
-“ভাই আপনি এতো বড় প্লেয়ার, আপনার সাথে তো এক ম্যাচ হওয়াই চলে কী বলেন? অনেকদিনের ইচ্ছে আপনার সাথে কিছুটা সময় হলেও খেলার।”

রায়াফ মুচকি হাসলো ইসহাকের কথায়। ইসহাকের পাশে থাকা আদনানও মন ভরে রায়াফকে দেখছে। কতো বছরের সাধনা যেন আজ সফল হলো। রায়াফ হেসে বললো,

-“ঠিক আছে, জাস্ট এক ওভার খেলবো। আর ব্যাট আমি ডান হাতেই নিতে পারবো, তুমি তো জানোই আমার বাম হাতে ইঞ্জুরি।”

-“বুঝেছি।”

রায়াফ তার ডান হাতে ব্যাটটা নিয়ে তার ব্যাটিং এর পজিশনে দাঁড়ালো। কিছু ছোট বাচ্চারাও এসেছে ওদের খেলা, বিশেষ করে রায়াফকে দেখতে। রায়াফের অবশ্য এখন আর এসবে অস্বস্তি হচ্ছে না।
রায়াফ নিজের পজিশনে দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকাতেই দেখলো আফনা হাতে একটা ঝুড়ি নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। রায়াফ ততক্ষণে একটা ফন্দি করে ফেললো সাথে তার বলটা ঠিক কোনদিকে ছুঁড়বে সেটাও। আফনা তখনো খেয়াল করেনি মাঠে রায়াফ খেলছে। ইসহাক বল ছুঁড়তেই রায়াফ জোরে ছক্কা মারলো। বাচ্চারা সবাই চেঁচিয়ে উঠলো। রায়াফের ছয় হলেও আফনার বারোটা বাজলো। বলটা আফনার কোমড়ের সাইডে সজোরে লাগলো। আফনা ঝুঁড়ি ফেলে কোমড়ে হাত দিয়ে “আল্লাহ গো” বলে চেঁচিয়ে বসে পরে। আফনার চিৎকার শুনে ইসহাক দৌড়ে আফনার দিকে গেলো। রায়াফ সেখানে দাঁড়িয়েই মুখ চেপে হাসছে। এক পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে সে। ফাহানও আফনার দিকে চলে গেলো। রায়াফ হাসতে হাসতে আফনাদের দিকে চলে গেলো। আফনার তার কোমড়ে হাত দিয়ে চেঁচিয়ে বললো,

-“কোন হতচ্ছাড়া রে! চোখে দেখিস না? উফফ মাগো, আমার কোমড় মনে হচ্ছে ভেঙ্গে গেলো। উফফ! যে না দেখে মারছিস তার চোখ দিয়ে আমি গোল্লা ছুট খেলবো!”

-“কোথায় বল লেগেছে বোন, তুই ঠিক আছিস?” ইসহাক উত্তেজিত সুরে বলে উঠে। ইসহাকের মুখে বোন ডাকটা শুনে ফাহানের ভালো লাগা মুহূর্তেই ফুঁস! ইসহাককে দেখে আফনা কাঁদো কাঁদো সুরে বললো,

-“ভাইয়া, দেখ না কোন কানায় আমার দিকে বল ছুঁড়সে!”

তখনই রায়াফ ওদের মাঝে আসলো এবং আফনার কথাগুলোও শুনলো। রায়াফ গলা খাকারি দিয়ে বললো,

-“কানা বল ছুঁড়া মানুষটা নয়, কানা হচ্ছো তুমি। তোমার ধ্যান কোথায় ছিলো? আগে থেকে খেয়াল করে সরে দাঁড়াওনি কেন? ইসহাক তোমার বোন কী মানসিক রোগী নাকি?”

রায়াফের কথায় আফনা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। আফনার মুখশ্রী দেখে রায়াফ তার ঠোঁটজোড়া আলতো প্রসারিত করে ইঙ্গিতে বললো,

-“কেউ অন্যের জন্য ফাঁদ পাতলে নিজেই সেই ফাঁদে গলা অবধি ডুবে যায়। নেক্সট টাইম কারো সাথে লাগতে যেও না। নয়তো কোমড় নয়, পুরো মানুষটাই তুমি হারিয়ে যাবা!”

বলেই হনহন করে চলে গেলো রায়াফ। আফনা সেখানে বসেই সাপের ন্যায় ফোঁসফোঁস করতে লাগলো।

-“ও আল্লাহ! কলির বাচ্চা আস্তে চাপ দিতে পারিস না? বরফ দেয়ার কী দরকার?’

-“বরফ দিলেই ব্যথা জলদি কমবে তাই এই ব্যথা চুপচাপ সহ্য কর, কিছুই করার নেই!”

আফনা রায়াফের কথা ভাবতে ভাবতে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

-“এর প্রতিশোধ আমি নিবোই, রায়াফ সানভী!”

আজ বিয়ের জন্য সকলে শপিং এ যাবে। গতকাল ইসহাক এবং নিহার এঙ্গেজমেন্টের অনুষ্ঠান হয়েছে। আজ বিয়ের শপিং এ শহরে যাচ্ছে। ইসহাক নিহাকেও নিবে ঠিক করেছে। ফাহান গেলেও রায়াফ যাবে না। তার এসব মোটেও পছন্দ না। তাই ফাহান জোর করেনি, জিনিকে রায়াফের কাছে রেখে চলে গেলো। আফনা যখন শুনলো রায়াফ যাবে না তখন সে নানান বাহানা দিয়ে নিজেও থেকে গেলো দাদীর কাছে। আফনা কাজ করে দাদীর বাসায় যাওয়ার নাম করে বের হলো আর ভাবতে লাগলো আজ কীভাবে রায়াফকে শায়েস্তা করা যায়। সেদিনের পর পাক্কা ২দিন আফনা কোমড়ের ব্যথায় ভুগেছে।
রায়াফ হয়তো ভাবছে আফনা থেমে যাবে কিন্তু আফনাও যে থেমে যাওয়ার পাত্রী নয়। তাই আফনা নানান ছক আঁকতে আঁকতে দাদীর কাছে যাচ্ছিলো। ওদের দুই বাড়ির মাঝামাঝি একটা বিশাল পুকুর পরে। ওই পুকুরটা আফনাদের পারিবারিক পুকুর। আফনার পুকুরের দিকে চোখ যেতেই দেখলো রায়াফ পুকুরের ঘাটে বসে দূরে তাকিয়ে আছে। রায়াফকে ওই অবস্থায় দেখে আফনার মাথায় আবারও একটা দুষ্টু বুদ্ধি আসলো। আফনা ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলো। রায়াফ তখনো ভাবনায় মত্ত।
আফনা আস্তে ধীরে রায়াফের পিছে এসে দিলো এক ধাক্কা। রায়াফও তাল সামলাতে না পেরে পা পিছলে পুকুরে গিয়ে পরলো। আর আফনা জোরে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বললো,

-“এই আফনার পিছে লেগে কোনো কাজ নেই খেলোয়াড় সাহেব! এই আফনা কী জিনিস এখনো আপনি বুঝেননি!”

রায়াফ তার চোখ কচলে কয়েকবার কাশি দিয়ে রাগি চোখে আফনার দিকে তাকালো। আফনার হাসিটা যেন কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মতো। রায়াফ জোরে “জিনি” বলে ডাকতেই জিনি কোথা থেকে এসে আফনাকেও ধাক্কা দিলো। আফনাও ঠিক একইভাবে পা পিছলে রায়াফের পাশেই পরলো। আফনা কাচুমাচু হয়ে পানির থেকে উঠতেই জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। আফনা পানির মধ্য থেকে মাথা উঠাতেই রায়াফ আফনার মাথায় হাত দিয়ে কয়েকবার আফনাকে পানির মধ্যে চুবালো। ঘাটের উপরের সিঁড়ি থেকে জিনি লেজ নাড়িয়ে ওদের চুবাচুবির খেলা দেখছে। জিনি বেশ মজা পাচ্ছে ওদের এমন কর্মকান্ডে।

~চলবে।

আসছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here