#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২।
গাড়িটা তাদের কাছে আসতেই পৃথা চেঁচিয়ে উঠল,
‘ঐ তো রুহা, নিলয় আর সারা। ওরা আমার বন্ধু। চলুন।’
এই বলে সে ছেলেটির হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে দৌড়ে গাড়ির কাছে গেল। ততক্ষণে গাড়ি আরো এগিয়ে গিয়েছে। পৃথা পেছন থেকে চিৎকার করে ডাকল,
‘রুহা, দাঁড়া। এই নিলয়, আমি এখানে।’
তার অমন বিশাল চিৎকারের শব্দ অগ্রাহ্য করার শক্তি কারোর নেই। চলন্ত গাড়িতেই সেই শব্দ তার বন্ধুদের কানে পৌঁছে গেল। রুহা বলল,
‘আমি বোধ হয় পৃথার গলার স্বর পেয়েছি। তোরা কেউ শুনেছিস?’
সবাই তার সঙ্গে তাল মেলাল। নিলয় ড্রাইভার কে বলল, গাড়ি ব্যাক করতে, পৃথা হয়তো তাদের পেছনেই আছে। উদ্দেশ্য মোতাবেক পেছনে গিয়েই তারা পৃথাকে দেখতে পেল। তার পাশে থাকা এই জলজ্যান্ত পুরুষ মানুষটাকে দেখে আরো বেশি চমকাল তারা। রুহি গাড়ি থেকে নেমে ছুটে এল তার কাছে। প্রচন্ড রাগ দেখিয়ে বলে,
‘লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করে বেড়াচ্ছিস, আর এইদিকে আমরা তোকে খুঁজতে খুঁজতে পাগল প্রায়। এই প্রেমিক কবে জুটালি? আমাদের কাউকে কিছু বলিসনি তো।’
পৃথা বিরক্ত গলায় বলল,
‘উফফ, উনি আমার প্রেমিক কেন হতে যাবে? উনার চেহারা দেখলে কি তোর মনে হয়, উনি কোনো মেয়ের প্রেমিক হওয়ার যোগ্য? নেহাতই বিপদে পড়েছি, নয়তো আমার ঠেকা পড়েনি উনার মতো ছেলের সাথে ঘুরে বেড়ানোর।’
‘এক্সকিউজ মি, একদমই বাজে বকবেন না। আপনিও কোনো দুধে ধোয়া তুলসী পাতা না। আমিও দোয়া করি আপনার মতো প্রেমিকা যেন কোনো পুরুষের ভাগ্যে না জুটে। মেয়ে তো নয় যেন ধানি লংকা। কথার মাঝে যেন আগুন ঝরে।’
‘আপনার মতো ছেলেদের সাথে না এভাবেই কথা বলা উচিত, নয়তো আপনারা মেয়েদের পেয়ে বসবেন।’
ছেলেটা এবার রেগে গেল। পৃথার দিকে ঘুরে গরম গলায় বলল,
‘আপনি তো দেখছি বেশ স্বার্থপর মেয়ে। এতক্ষণ বিপদে ছিলেন বলে আমার সাথে চুম্বকের মতো লেগে ছিলেন, আর এখন বিপদ থেকে উদ্ধার হয়েই সব কৃতজ্ঞতা শেষ। এই জন্যই বলি, সহজে মেয়েদের সাহায্য করতে নেই। তারা ভীষণ অকৃতজ্ঞ।’
‘আর আপনি যেমন খুব কৃতজ্ঞ। একটু সাহায্য করে একশোটা কথা শুনান। আপনার মতো ছেলেদের কাছ থেকেও সাহায্য নিতে নেই। যাকগে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। ওরা আমার ফ্রেন্ড, আমি ওদের সাথে ফিরছি, চাইলে আপনিও আমাদের সাথে আসতে পারেন।’
‘নো থেংক্স। এতক্ষণ অনেক উপকার করেছেন, আর কোনো উপকারের প্রয়োজন নেই।’
এই বলে ছেলেটি হাঁটা ধরলে গাড়ির ড্রাইভার বললেন,
‘এই সময় একা আপনি কোথায় যাবেন? এইদিকে পথ ঘাট ভালো না। যেকোনো সময় যেকোনো বিপদ হতে পারে। তার চেয়ে আপনি বরং গাড়িতে উঠে বসুন, আমি আপনাকে আপনার রিসোর্টে পৌঁছে দিব।’
তার সাথে তাল মিলিয়ে নিলয়ও বলল,
‘হ্যাঁ, আপনি আমাদের সাথে চলুন। তাছাড়া এতক্ষণ আপনি আমাদের বন্ধুকে দেখে রেখেছেন, এখন আমাদেরও দায়িত্ব আপনাকে ঠিকঠাক মতো পৌঁছে দেওয়ার। কোথায় থাকেন আপনি?’
‘আপনারা যে রিসোর্টে উঠেছেন, সেই রিসোর্টেই।’
‘কী?’
পৃথা আবারও চেঁচাল। ছেলেটি বলল,
‘জি।’
নিলয় বলল,
‘তাহলে তো ভলোই হলো, একসাথে যাওয়া যাবে।’
রিসোর্টের সামনে পৌঁছাতেই পৃথা তার বন্ধুদের নিয়ে তাদের কটেজের দিকে চলে যায়। ছেলেটি যাওয়ার আগে নিলয় আর সেই গাড়ির ড্রাইভার কে ধন্যবাদ জানায়। তারপর সেও চলে যায় তার কটেজে। সেখানে গিয়ে দেখে তার বন্ধু রনি হাত পা ছড়িয়ে বেতের চৌকিতে শুয়ে আছে। ছেলেটি কোনো শব্দ না করে সোজা ওয়াশরুমে চলে যায়। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে গায়ের টি শার্ট টা খুলে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারে। তারপর সেও গিয়ে সটান করে শুয়ে পড়ে বিছানায়। তখনই তার আধমরা বন্ধু পাশ থেকে বলে উঠে,
‘কোথায় গিয়েছিলি, অর্ণব?’
অর্ণব চোখ বুজেই জবাব দিল,
‘পাহাড়ে।’
শোয়া থেকে তার বন্ধু ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। চিন্তিত কন্ঠে বলল,
‘দেখা হয়েছে ওর সাথে?’
অর্ণব তার দিকে তাকাল। বিষন্ন সুরে বলল,
‘শুধু দেখা না, কথাও হয়েছে।’
তার বন্ধু এবার আরো বেশি অস্থির হয়ে পড়ল। জিজ্ঞেস করল,
‘চিনতে পেরেছে তোকে?’
অর্ণব গভীর নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘না।’
‘একদমই চিনতে পারেনি?’
‘উঁহু।’
‘তুইও কিছু বলিসনি?’
‘না।’
রনি এবার রেগে গিয়ে অর্ণবকে বলল,
‘মানে কী? ও না হয় তোকে ভুলে গিয়েছে, কিন্তু তুই তো ওকে ভুলিসনি। তোর তো ওর সাথে কথা বলা উচিত। এভাবে আর কতদিন চলবে? এবার তো এর একটা বিহিত করা উচিত। শোন অর্ণব, তুই ওর সাথে সরাসরি কথা বল। ওকে সবকিছু খুলে বল। আমার মনে হচ্ছে ও তোর কথা বিশ্বাস করবে।’
অর্ণব মুখ ফিরিয়ে বলল,
‘আমার তো তা মনে হচ্ছে না। আমার মনে হচ্ছে, ও আমাকে কখনোই বিশ্বাস করবে না। আর তার উপর ডাক্তার ও বারণ করেছে ওর উপর কোনো প্রকার চাপ প্রয়োগ করতে, পরে হিতে বিপরীত হবে।’
‘কিন্তু, তুই ও তো এইদিকে কষ্ট পাচ্ছিস। কী করবি, এভাবেই চলতে দিবি সবকিছু?’
‘হ্যাঁ, তাছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আমাকে এখন শুধু অপেক্ষা করে যেতে হবে।’
‘যদি তোর এই অপেক্ষার মাঝেই ওর জীবনে নতুন কেউ চলে আসে, তখন? তখন তুই কী করবি?’
অর্ণব প্রচন্ড ক্ষেপে গিয়ে বলল,
‘বাজে কথা বলা বন্ধ কর। ওর জীবনে আমি ছাড়া আর কেউই আসবে না। আমিই আসব, পুরোনো আমি নতুন হয়ে আসব। তবু অন্য কাউকে আসতে দিব না।’
অর্ণবের গলার স্বর কাঁপছে। এই ভয়টা যে তারও হচ্ছে। যদি সত্যিই এমন কিছু হয়? যদি সত্যিই তার জীবনে নতুন কেউ চলে আসে? তবে সে কী করবে? কীভাবে বোঝাবে ওকে? কীভাবে বলবে, সে যে তার প্রেমাঙ্গনা, তার সহধর্মিণী।
______________________
‘ছেলেটা খুব ভালো, তাই না পৃথা?’
পৃথা ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘একদমই না। ঐ ছেলেকে তোর কোন দিক দিয়ে ভালো লাগল? একেবারে অসভ্য আর বেয়াদব একটা ছেলে। কীভাবে মেয়েদের সাথে কথা বলতে হয় সেটাও জানে না।’
নিলয় বিছানার এক পাশে গিয়ে বসে বলল,
‘ঐ খারাপ ছেলেটা ছিল বলেই কিন্তু এতক্ষন ঐ রাস্তায় তুই এত সেইফ ছিলি। নয়তো আরো বড়ো বিপদও হতে পারত। তাছাড়া ও আজকে তোর প্রাণও বাঁচিয়েছে। অন্তত একটু কৃতজ্ঞতাও তো দেখাতে পারিস।’
পৃথা নিলয়ের সেই কথায় কান না দিয়ে ফোন নিয়ে স্কাউচে গিয়ে বসল। নিলয় ব্যর্থ চোখে রুহার দিকে তাকাল। রুহার চোখে মুখেও হতাশার ছাপ। কী জানি কখন তাদের এই হতাশা কাটবে, কবে আবার একটু স্বস্তি পাবে?
রাতের খাবার শেষ করে কটেজের বারান্দায় গিয়ে সবাই বসে। নিলয় তার গিটারে তখন টুংটাং সুর তুলার চেষ্টা করছে। রুহা আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কী যেন দেখছে। পৃথা চুপচাপ বসে ফোন দেখছে। সারা তার মাঝে কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থেকে বলল,
‘উফফ, বোরিং লাগছে। তোরা সবাই এমন মরার মতো বসে আছিস কেন?’
‘তো কি নাচব নাকি?’
পৃথার কথার উত্তরে সারা বলল,
‘হে, চল নাচি। এই নিলয়, একটা সুন্দর গান ধরতো।’
এই বলে সে পৃথার হাত ধরে তাকে টেনে তুলে বলে,
‘আয়, আজকে তুই আমার হিরো; আর আমি তোর হিরোইন। এই নিলয়, গান ধর না।’
নিলয় ও তার গিটারে সুর তুলল। সাথে গলার স্বর মিলিয়ে গাইতে লাগল,
‘ও আমার বন্ধু গো
চির সাথী পথ চলার
তোমারই জন্য গড়েছি আমি
মঞ্জিল ভালোবাসার
এক সাথে রয়েছি দুজন
এক ডোরে বাঁধা দুটি প্রাণ
ছিঁড়বেনা কভু এই বাঁধন
আসলে আসুক তুফান’
সারা পৃথাকে নিয়ে নেচে গেয়ে অস্থির। পৃথাও বেশ মজা পাচ্ছে। খিলখিলিয়ে হাসছে। তার হাসির এই তীক্ষ্ণ সুরে বরাবরই একজনের বুকে তীব্র ব্যথার সূত্রপাত হয়। আজও তার ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। তবে সে যে বড়ো অসহায়, বড়ো অপারগ; নিষ্পলক চোখে কেবল দেখেই যেতে পারবে। কাছে থেকেও ছুঁতে পারবে না। এর থেকে বেশি যন্ত্রণার আর কী হতে পারে?
চলবে….#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩।
আকাশের বক্ষ ছেদ করে যে কিরণ দেখা যাচ্ছে সেই কিরণের আবির্ভাব ক্ষণিক সময় আগেই ঘটেছে। ভোর রাত কাটিয়ে এবার হলো ভোর সকাল। চারদিকে তখনও মেঘের আনাগোনা। তবে সেই মেঘের বিচরণ কিন্তু আকাশে নয়, বরং পাহাড়ের অন্তস্থলে। শীত শীতে একটা পরিবেশ। পা টিপে টিপে কেউ একজন রুম থেকে বেরিয়ে এল। গায়ের ওড়নাটা ভালো করে শরীরের সাথে জড়িয়ে নিল সে। পায়ে জুতা নেই, কিন্তু সেই খেয়াল তার আদৌ আছে কিনা কে জানে। সে বিস্ময় নিয়ে সামনে হেঁটে চলছে কেবল। তার পদক্ষেপ বেশ ক্ষীণ। পা বাড়ালেই যেন স্বর্গে পৌঁছে যাবে। এর থেকে সুন্দর অনুভূতি বুঝি আর কিছু হয় না।
খোলা প্রাঙ্গণে ঠেস দেওয়া বাঁশের গা ঘেঁষে দাঁড়াল পৃথা। উস্কো খুস্কো চুল তার। ঘুম ভেঙ্গেছে বেশিক্ষণ হয়নি হয়তো, চোখমুখ তাই ফোলাফোলা। আরেকটু সামনে যেত। তবে থমকে গেল সেই ছেলেটিকে দেখে। বিরক্তও হলো খুব। ছেলেটা তার সময় নষ্ট করছে। এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানেই হয়না।
পৃথাও মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইল ক্ষণিক সময়। পেছন থেকে দেখলেও ছেলেটাকে সে চিনেছে। এটা কালকের সেই ছেলেটাই।
দেখতে দেখতে সূর্যের আলো বাড়তে লাগল। তার সাথে বাড়তে লাগল পৃথার বিরক্তের মাত্রাও। ছেলেটা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে হা করে পাহাড়ের দিকে কী দেখছে? জীবনেও কি পাহাড় দেখেনি নাকি?
মনের মাঝেই প্রশ্নের বীজ জমা রেখে বিরক্ত হয়ে সামনের দিকে পা বাড়াল পৃথা। ছেলেটার পাশেই গিয়ে দাঁড়াল, তবে কয়েক ফুট দূরত্ব রেখে। সেও তাকাল সামনের পাহাড়ের দিকে। ঘোলাটে আবরণে ঢাকা সেটা। মেঘগুলো তার উপরে ভাসছে। তার সাথেই ছোট বড়ো আরো অনেক পাহাড় আছে। এই দৃশ্য মনোরম, সুন্দর।
পৃথা এবার ছেলেটার দিকে ফিরে চাইল। তার কেন যেন মনে হলো, ছেলেটার মনে খুব দুঃখ। কাল সে ভালোভাবে খেয়াল না করলেও আজ তার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে, খুব শুকনো, উদাস। যেন খুব প্রিয় কিছু একটা সে তার জীবন থেকে হারিয়ে ফেলেছে আর তারই হতাশায় এখন কাতরাচ্ছে সে।
পৃথার তাকিয়ে থাকার মাঝেই ছেলেটি হঠাৎ বলে উঠল,
‘আমাকে না দেখে পাহাড় দেখুন। মনে প্রশান্তি আসবে।’
তার কথা শুনে পৃথা চমকাল। সাথে বিরক্তও হলো খুব। একটু তাকিয়েছে বলে কি এভাবে বলতে হবে নাকি? অবশ্য ছেলেদের দিকে মেয়েরা একটু তাকালেই তো তারা নিজেকে শাহরুখ খান ভাবতে শুরু করে। নির্ঘাত এই ছেলেও এখন তাই ভাবছে।
পৃথা ক্ষিপ্ত কন্ঠে জবাব দিল,
‘আপনি কি ভাবছেন, আপনি খুব সুন্দর বলে আমি আপনাকে দেখছি? মোটেও না। আমি শুধু ভাবছিলাম, উপর দিয়ে দেখতে আপনি কত ভোলাভালা আর ভেতর দিয়ে একটা শয়তানের হাড্ডি।’
অর্ণব ঘাড় ঘুরিয়ে পৃথার দিকে চেয়ে বলল,
‘সেটা তো আপনি। নয়তো পাহাড় দেখতে এসে কি আর হা করে ছেলে দেখতেন?’
কথাটা শুনে মেজাজ বিগড়ে গেল পৃথার। তেড়ে এসে বলল,
‘বাজে কথা বলবেন না একদম। আমার এতও খারাপ দিন আসেনি যে আমি আমার এই সুন্দর দু’খানা চোখ দিয়ে আপনাকে দেখব। এমন একটা ভাব ধরছেন যেন আপনিই পৃথিবীর সেরা সুদর্শন পুরুষ। আপনাকে না দেখলে যেন মেয়ে হয়ে জন্মানোটাই বৃথা হবে।’
কথাটা বলে পৃথা অর্ণবকে ভেংচি কেটে অন্যদিকে মুখ ঘুরাল। অর্ণব তার এই ভেংচি দেখে মনে মনে হেসে মৃদু নিশ্বাস ফেলল। তারপর বলল,
‘আপনি কিন্তু বেশ সুন্দর ভেংচি দিতে পারেন।’
পৃথা চেয়ে বলল,
‘শুধু এক ভাবে না, আমি আরো অনেক ভাবে ভেংচি দিতে পারি। দেখতে চান?’
‘নো থেংক্স। সামনে এত সুন্দর জিনিস রেখে আপনার ভেংচি দেখার কোনো আগ্রহ আমার নেই।’
‘তো সেটাই দেখুন না, না করল কে।’
পৃথা ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে সামনের দিকে চাইল। ছেলেটার প্রতি তার খুব রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে এক ধাক্কায় তাকে পাহাড় থেকে নিচে ফেলে দিতে। মানুষ এত ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলে কীভাবে? সারাজীবন তো জেনে এসেছে, সেই একমাত্র ত্যাড়া; এখন তো দেখছে এখানে তার থেকেও বড়ো ত্যাড়া আছে, একেবারে অসভ্য রকমের ত্যাড়া।
অর্ণব আর বেশিক্ষণ দাঁড়াল না। সে চলে যেতেই পৃথা যেন মনে শান্তি পেল। এখন সে এই সুন্দর দৃশ্য প্রশান্তি নিয়ে দেখতে পারবে।
অর্ণব যেই জায়গাটাই দাঁড়িয়ে ছিল, পৃথাও গিয়ে সেখানেই দাঁড়ায়। খেয়াল করে তার পায়ের কাছে কিছু একটা পড়ে আছে। উবু হয়ে সেটা উঠিয়ে দেখে, একটা ব্রেসলেট। ছেলেদের সেটা। পৃথা বুঝতে পারে এটা অর্ণবেরই হবে হয়তো। সে রাগ দেখিয়ে সেটা ফেলে দিতে যাচ্ছিল, হঠাৎ কী ভেবে থেমে গেল। ব্যাপারটা খারাপ দেখায়। এভাবে একজনের জিনিস ফেলে দেওয়া ঠিক হবে না। সে পেছন ফিরে দেখে ছেলেটাও আশে পাশে কোথায় নেই যে তাকে ফিরিয়ে দিবে। উপায়ন্তর না পেয়ে সে সেটা নিজের কাছেই রেখে দেয়।
সকালের নাস্তা খেয়ে সবাই ঘুরতে বের হয়। চান্দের গাড়িতে উঠেই কোনো এক কথার প্রসঙ্গে নিলয় বলে,
‘জানিস, অর্ণব ভাইয়া কিন্তু আমাদের ভার্সিটি থেকেই গ্রেজুয়েট করেছেন।’
পৃথার কাছে এই নামটা অপরিচিত লাগল। তাই সে প্রশ্ন করল,
‘অর্ণব ভাইয়া কে?’
‘আরে ঐ ছেলেটা, কাল যে তোকে বাঁচাল।’
‘আচ্ছা, ওর নাম অর্ণব? তা তুই এতকিছু জানলি কী করে?’
‘ভাইয়ার সাথে আমার কথা হয়েছিল তো। তোরা যখন রেডি হচ্ছিলি, আমি তখন ভাইয়ার সাথেই কথা বলছিলাম। ছেলেটা কিন্তু বেশ ভালো। আমাদের পাঁচ বছরের সিনিয়র। মাস্টার্স শেষ, একটা প্রাইভেট কম্পানিতে এখন জব করছে। ঢাকায় থাকে। এখানে তার ফ্রেন্ডের সাথে ঘুরতে এসেছেন।’
নিলয়ের কথা শুনে পৃথা হেসে বলল,
‘বাবা, তুই তো পুরো বায়ো ডাটা নিয়ে নিয়েছিস। বিয়ে টিয়ের সম্বন্ধ পাঠাবি নাকি?’
‘ছেলে ভালোই। পরিচিত মেয়ে পেলে অবশ্যই ব্যাপারটা ভেবে দেখব।’
নিলয়ের কথার বিপরীতে পৃথা বলল,
‘আমার ছেলেটাকে মোটেও ভালো মনে হয়নি। খুব ভাবওয়ালা মনে হয়েছে। আর কথা বলে একদম গায়ে লাগিয়ে লাগিয়ে। এমন ছেলেকে যে বিয়ে করবে তার কপাল পুড়বে।’
‘হেএএ, বলেছে তোকে। উনার মতো ছেলে হয় নাকি। দেখতে যেমন সুন্দর তেমন সুন্দর উনার পার্সোনালিটি। মেয়েদের সম্মান করতে জানে।’
সারার কথায় পৃথা তেঁতো মুখে বলল,
‘তোদেরকে কি ঐ ছেলে যাদু করেছে নাকি, কাল থেকে দেখা হওয়ার পর থেকেই তার গুণগান গেয়ে যাচ্ছিস? এত পছন্দ হলে তুই’ই বিয়ে করে ফেল না যা।’
সারা আর কিছু বলল না। এই মেয়েকে আর কিছু বলেও কোনো লাভ হবে না। এবার আল্লাহ না চাইলে বাকি কেউই কিছু করতে পারবে না।
______________________
একটা ছোট্ট বাজারের কাছে এসে তাদের গাড়িটা থামল। সবাই মিলে ঠিক করল, সামনের টং থেকে গরম গরম রং চা খাবে। নিলয় মেয়েদের বসতে বলে ড্রাইভার কে নিয়ে সেই টং এর কাছে গেল। গাড়িতে তখন মেয়েরা কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে আর খুব হাসছে। এর মাঝেই সেখানে মধ্যবয়সী একটা ছেলে এসে উপস্থিত হয়। এসেই সে মেয়েগুলোর আপাদমস্তক পরখ করে পেছন ফিরে কাকে একটা যেন বলে উঠে,
‘হ বস, মাঝখানের গো হেব্বি।’
এই বলে সে আবার চলে যায়। পৃথা আর তার বান্ধবীরা ব্যাপারটা কিছুই বুঝল না। আহাম্মকের মতো চেয়ে রইল কেবল। এর মাঝেই নিলয় এল চা নিয়ে। গাড়িও আবার চলতে শুরু করল। কথার ব্যস্ততায় মেয়েগুলো ও এই ঘটনা একেবারে ভুলে যায়।
তারা গিয়ে তাদের কাঙ্খিত স্থানে পৌঁছাল। ছোট এক পাহাড়, যেটা কেটে সরু এক রাস্তা বানানো হয়েছে। আর সেই রাস্তার দুই দিকে শত শত স্টল। স্টলগুলো এখানকার স্থানীয়দের। তাদের চেহারা দেখলেই চেনা যায়, তারা আলাদা। পৃথা, সারা আর রুহা হাঁটছে সাথে স্টলের জিনিসপত্রগুলোও দেখছে। পছন্দ হলে হয়তো কিছু কিনবে। নিলয় তাদের পেছনেই। ফোনে যেন কার সাথে কথা বলছে।
এর মাঝেই হুট করে কোথ থেকে যেন দু’টো ছেলে এসে পৃথার পায়ের সামনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ চমকে উঠল সে। ভয়ে দুকদম পিছিয়ে গেল। হকচকিয়ে গেল আশে পাশের মানুষরাও। ব্যাপারটা বুঝল না কেউ। ছেলে দুটো হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘আমাগো রে মাফ কইরা দেন বইন। আর জীবনেও কিছু কইতাম না। প্লিজ, মাফ করেন।’
চলবে…